আপনার একটু সময় হবে?

oputanvir
4.6
(58)

ছুটির দিন গুলোতে আমি সাধারণত সাইকেল নিয়ে এদিক ওদি ঘুরে বেড়াই । সারা সপ্তাহ সকাল থেকে রাত কখন সময় চলে যায় কোন হুস থাকে না । তাই সাইকেল চালানোর সুযোগ পাওয়া যায় না । ছুটির দিনটা তাই আরাম করে সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই । আজও সন্ধ্যার আগে বের হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । পরিকল্পনা ছিল যে মিন্টু রোডে যাওয়ার আগে হলি ফ্যামিলির সামনে থেকে এক প্লেট ফুচকা খাবো । ছাত্র জীবনে এখানে একটা টিউশনি করাতাম । টিউশনিতে ঢোকার আগে এখানে এক প্লেট চটপটি কিংবা ফুচকা খেতে তাররপর ঢুকতাম ভেতরে । সেই সময় থেকেই এখানকার চটপটি আমার পছন্দ । এখনও সময় পেলে এখানে আসি ।

আজও সেই দিকেই যাচ্ছিলাম। সরকারী অফিসার্স কোয়াটার পার করছি এমন সময়ে একটা মেয়ের দিকে চোখ গেল। মেয়েটার পরনে একটা কালো রংয়ের জিন্স । উপরে একটা শার্ট । মুখে একটা কালো মাস্ক পরা । আমার দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটা খানিকটা যেন থমকে গেল । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই যে একটু শুনুন !

আমার প্রথমে মনে হল হয়তো আমি ভুল শুনছি । আমার পেছনের কাউকে ডাকছে । আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সেদিকে কেউ নেই । তার মানে কি আমাকেই ডাকছে?
কিন্তু কেন ডাকবে ?
আমাকে ডাকার তো কোন কারণ নেই ।

-আরে আপনিই । আপনাকেই ডাকছি । প্লিজ শুনুন একটু !

আমি সাইকেল থামালাম । একটু দুরে চলে গিয়েছিলাম বটে আবার ফিরে মেয়েটার সামনে এসে দাড়ালাম । বললাম, আমাকে কিছু বলছেন ?

যদিও মেয়েটা আমার থেকে ছোটই হবে তবুও প্রথমে আপনি বলেই ডাকলাম । এখনকার মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি । অপরিরিত কেউ তুমি করে ডাকলে তারা রাগ করে । মেয়েটা আমার একটু কাছে এল । তারপর বলল, আপনার কাছে কি সময় হবে একটু ?
-সময় বলতে?
-মানে এই ধরুন মিনিট ১৫ । হবে ?
-কেন ?
মেয়েটি একটু যেন দ্বিধাবোধ করলো । বলতে যেন একটু সংকোচ বোধ করছে । তবে কিছু সময়ের ভেতরেই সব সংকোচ কাটিয়ে ফেলে মেয়েটি বলল, আপনি ১৫ মিনিটের জন্য আমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারবেন প্লিজ?

আমার মনে হল আমি ভুল শুনলাম কথাটা । আমাদের দেশে এই রকম কথা কোন মেয়ে কোন ছেলেকে বলতে পারে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল । আমি সরু চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে । মেয়েটি তখন বলল, আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে দেখাতে হবে যে আমি একদিনের ভেতরেই বয়ফ্রেন্ড জোগার করতে পারি । ওর বাসা একটু সামনেই । বেশি না মাত্র ১৫ মিনিট । প্লিজ !

আমি হেসে ফেললাম মেয়েটার ছেলে মানুষী দেখে । এখন অবশ্য মেয়েটাকে আর আপনি বলতে ইচ্ছে করছে না । এই মেয়ে যে খুবই অপরিপক্ক একটা মেয়ে সেটা মেয়েটার এই আচরণই বলে দিচ্ছি । এখন একে তুমি বলাই যায় । আমি বললাম, কোন ক্লাসে পড় তুমি?
মেয়েটা বলল, এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবো ।
আমি বললাম, আমি যাকে পড়াতাম সে এইবার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে । আমার প্রেমিকা হওয়ার জন্য আরেকটু বড় হলে ভাল হতো না ।
মেয়েটা বলল, ওসব কোন ব্যাপার না । আর আপনাকে দেখে এতো বয়স্ক মনে হচ্ছে না । মনে হচ্ছে যে আপনি হয়তো অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়েন । আমি যেখানে কোচিং করি সেখানকার ভাইয়াটা থার্ড ইয়ারে পড়ে । আপনাকে তার থেকে ছোট মনে হচ্ছে ।

ছেলে হোক মেয়ে হোক যখন কেউ বলে যে আপনাকে অনেক কম বয়স্ক দেখায় তখন সেটা মনে আনন্দের একটা অনুভূতি জাগায় । আমারও মনে হল যাক মেয়েটার একটা উপকার করাই যায় । আমি সাইকেল থেকে নামলাম । তারপর বলল, চল কোথায় বসতে হবে শুনি !
-সত্যি যাবেন?
-হ্যা চল ।

আমি মেয়েটার সাথে হাটতে হাটতে এগিয়ে গেলাম । কিছু দুর গিয়ে মেয়েটা ফুটপাথে বসতে ইশারা করলো । সাইকেল টা সামনে রেখে মেয়েটার সামনে বসলাম । এখানে আমি আগেও বসেছি অনেক । মেয়েটা বসলো আমার পাশে । বসতে বসতে বলল, ফারাজের বাড়ি সামনেই । ঐ যে ঐ বিল্ডিংয়ে । জানলা দিয়ে সে এখানে দেখতে পাবে ।
-তাকাবেই ?
-না তাকালে তাকানোর ব্যবস্থা করবো । দাড়ান ।

এই বলেই মেয়েটা নিজের মোবাইল বের করলো । তারপর বলল, আসুক একটা সেলফি তুলি !
-কী!
-হ্যা সেলফি তুলে স্টোরীতে দিবো । সেটা ওর কাছে ঠিক ঠিক চলে যাবে ।

আমার মনে হল মেয়েটাকে বাঁধা দিই কিন্তু কেন জানি দিলাম না । অবশ্য আমার মুখে মাস্ক পরানো রয়েছে । খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না । মেয়েটা ছবি তোলার আগে নিজের মুখের মাস্ক খুলে ফেলল । আমি তখন মেয়েটার চেহারার দিকে তাকালাম । মেয়েটা দেখতে বেশ চমৎকার । গোলাগাল চেহারায় একটা ছেলেমানুষী ভাব রয়েছে । সেই সাথে একটা মায়াময় চেহারা।

বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল । তারপর কিছু সময় টেপাটেপি করলো । কী ক্যাপশন দিল কে জানে । আমি সেদিকে গেলাম । ছবি আপলোড শেষে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি নাজিয়া । আপনার নামই জানা হল না ।
আমি আমার নাম বললাম । মেয়েটা নাম শুনে বলল, আপনার নাম টা সুন্দর । ছোট একটু নাম । শুনলেই আদর করতে ইচ্ছে করে ।
নাজিয়া দেখি বেশ চটপটে । কথা বলতে পারে বেশ ।

আমি বললাম তা বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ কেন হল ?
-বেটা চিট করছে আমার সাথে । আমার সাথে প্রেম থাকা অবস্থায় আরেকটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরছিলো । হাতে নাতে ধরেছি । বলে কিনা আমি নাকি ক্ষেত । আচ্ছা বলেন তো প্রেম করলেই শরীরে হাত দিতে হবে ? আমাকে এসব পছন্দ করতাম না বলেই নাকি অন্য মেয়ের কাছে গেছে । আমি যদি ওকে এসব করতে দিই তাহলে নাকি আবার আমার কাছে আসবে । ব্যাটা তোকে আসতে দিলে তো !
আমি বললাম, তাহলে এসব কেন করছো?
-করছি কারন ফারাজ বলেছে আমি নাকি আর প্রেম করতেই পারবো না । এখন সব ছেলেদের নাকি এসব করতে দিতে হয় । আমিও বলেছি যে তোদের লুচ্চাদের সাথে আমি নাই আর !

আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম । মেয়েটা যে আসলেই সরল তা বুঝতে কষ্ট হল না । আমার সামনে এমন ভাবে কথা বলছিলো যেন আমরা কতদিনের পরিচিত !

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই দেখলাম নাজিয়া আমার দিকে সরে এল । একটা হাত আমার হাতের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল । আমাকে বলল, ঐ যে জানালা দিয়ে এদিকে তাকিয়ে রয়েছে । বেটা এবার দেখুক ।

আমি সামনের দিকে তাকালাম । একটা ছেলেকে দেখতে পেলাম এদিকে তাকিয়ে রয়েছে । এতো দুর থেকে চোখের অবস্থা না দেখলেও আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে তার চোখে আগুন রয়েছে ।

নাজিয়ার সাথে আরো কিছু সময় গল্প করলাম । তারপর বললাম, এখন উঠতে হবে । আশা করি তোমার কাজ হয়েছে ।
-হুম খুব হয়েছে ।
সাইকেলে উঠে শেষ বারের মত বিদায় নেওয়ার আগে নাজিয়াকে বলল, শোনো মেয়ে, লয়ালিটি খুব দামী একটা জিনিস । এটা সস্তা মানুষ এফোর্ড করতে পারে না । আর এসব সস্তা মানুষের জন্য নিজের সময় নষ্ট করবে না । ঠিক আছে !
-হুম ঠিক আছে ।
-আর এই যুগেও যে তোমার মত মেয়ে আছে জেনে ভাল লাগলো । ভালবাসা প্রেম এসবের সাথে শরীরের ব্যাপারটা ম্যান্ডাটরি কোন ব্যাপার না । অসৎ মানুষ গুলো তোমার মন নয় শরীর খুজবেে । আর সেই শরীরের কাছে পৌছাতে মনকে ব্যবহার করবে । এই জন্য সাবধান । ওকে !
-ওকে!

আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম । ভেবেছিলাম নাজিয়ার সাথে আমার সেই শেষ দেখা । তবে আবারও দেখা হল । মাস ছয়েক পরে । ততদিনে নাজিয়া হারিয়ে গেছে মন থেকে ।

দুই
-ভাই চলে না ! কী হবে !

আমি সজিবের দিকে কিছু সময় বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম । সজিব আমার অফিসে র জুনিয়র । আমার সাথে বেশ ভাব । ওর কাজে কর্মে আমি বেশ সাহায্য করি তাই আমাকে ও পছন্দ করে বেশ । আজকে ওর একটা বিয়ের দাওয়াত রয়েছে । অফিস থেকে সেখানেই সে যাবে । এখন আমাকে ধরেছে আমিও যাতে ওর সাথে যাই । আমি বললাম, তুই জানি আমি বিয়ের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি । ভীড় ভাল লাগে না ।
-আরে ভাই । ভীড় দিয়ে আপনি কী করবেন ! আমরা যাবো । খাবো চলে আসবো । ব্যাস ।
-তুই যা । আমাকে কেন টানছিস !
-ভাই একা একা যাবো । আর আব্বা বলেছে ৫ হাজার টাকা দিতে । এতো গুলো টাকা দিয়ে মাত্র একজন যাবো । প্লিজ চলেন ভাই । অফিসার্স ক্লাবে । খাওয়া ভাল দিবে । চলেন প্লিজ চলেন । আর আজকে এমনিতেও স্যুট পরে এসেছেন । একেবারে পার্ফেক্ট পোশাক বিয়ের জন্য । চলেন চলেন ।

আজকে একটা মিটিং ছিল বাইরের বায়ারদের সাথে তাই ফিটফাট হয়ে আসতে হয়েছিলো । খাওয়া দাওয়া যেহেতু ভাল হবে তাই আর আপত্তি করলাম না ।

যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলাম । আমাকে অনুষ্ঠানের একপাশে রেখে সজিব কোথায় যেন হারিয়ে গেল । আমি কিছু সময় এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম তারপর মনে হল সজিবের আশায় বসে থেকে লাভ নেই । এখনই খাওয়া দিবে । খেয়ে আমি একাই দৌড় দিবো । এই ভেবে যেই না ঘুরেছি তখনই নাজিয়াকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । বুঝতে পারলাম যে আমাকে সে দেখেছে আগেই । আমার কাছে এগিয়ে এল । তারপর বলল, আপনি এখানে?
-কাচ্চি খেতে এসেছি ।
-বিনা দাওয়াতে ।
-না । দাওয়াতেই । তুমি এখানে?
-আমার বোনের বিয়ে ।
-আরে তাই নাকি ? গ্রেট !

ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো যে আমাকে এখানে দেখে ও খুবই খুশি হয়েছে । আমার সাথে গল্প জুড়ে দিতে সময় লাগলো না । এটো দিন কী হয়েছে কী করেছে এই সব । তারপর এক সময়ে আমাকে নিয়ে সে চলে গেল স্টেজে । তারপর সেখানে দারিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলো । আমি খেয়াল করলাম যে কয়েকটা কৌতুহলী চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এবং তাদের ভেতরে একজোড়া চোখ আমার বড় পরিচিত মনে হল । সেই দিনের সেই জানালা থেকে দেখা চেহারাটা মনে পড়লো । আমি নাজিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, তোমার এক্স !
-ইয়েস ।
-এখানে?
-আব্বু আর ও আব্বু কলিগ । আসবে তো অবশ্যই ।
-ও আচ্ছা । তা এরপর আর এসেছে !
-আসে নি আবার । লিটারেলী বেগ করেছে আসার জন্য । আমি ওদিকে মুখই ঘোরাই নি । এমন কি ওর মাকে দিয়ে আমার মাকে বলিয়েছে পর্যন্ত ।
-তারপর আর কি ! আমি আপনার সাথে তোলা ছবি দেখিয়েছি । বলেছি যে আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড ।
-সেকি তোমার আম্মুকে !
-হ্যা ।
-তারপর?
-তার আর পর নেই । আম্মু আর কিছু বলে নি ।

আমার মনে হল যে এই মেয়ের কাছ থেকে আমি এখনই দুরে চলে যাওয়া উচিৎ নয়তো আমি বিপদে পড়তে পারি । কোন নিশ্চয়তা নেই । তবে চাইলেই যাওয়া হল না । নাজিয়া পুরো সময় টুকু আমার সাথেই চিপকে রইলো । আর কত গুলো ছবি যে তুলল তার কোন ঠিক নেই । এমন কি বর বউের সাথে পর্যন্ত আমি ছবি তুললাম । কেন তুললাম কে জানে !

খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন বের হয়ে আসবো তখন আবার সজিব এসে হাজির । সজিব নাজিয়াকে চেনে অল্প সল্প । হাই হ্যালো করে আমরা বের হয়ে এলাম । সজিব বলল, এই মেয়েকে কিভাবে চিনেন ?
-চিনি এক ভাবে । লম্বা কাহিনী ।
সজিব বুঝলো লম্বা কাহিনী আমি বলতে চাই না তাই সে জানতে চাইলো না । আমার এবার কেন জানি মনে খুব জলদিই নাজিয়ার সাথে আমার আবার দেখা হবে । এবং আমার এই আসংঙ্খা সত্যি হল সপ্তা খানেক পরেই । লাঞ্চ আওয়ারে সজিবের সাথে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এল । এবং সজিব তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । সেই ভদ্রলোক আর কেউ নয়, নাজিয়ার আব্বা । আমার খোজ খবর নিল। কোথায় বাড়ি আব্বা কী করে এই সব !

আমি বুঝতে পারলাম যে সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে ।

পরদিনই সজিব জানালো যে নাজিয়া বাসায় বলেছে যে আমার সাথে তার প্রেম চলছে । প্রমান স্বরূপ ছবি দেখিয়েছে । আর ওর বাবা এসেছিলো খোজ নিতে এবং তারও কোন আপত্তি নেই ।

কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার ! আমি কিছু সময় ঘুম মেরে বসে রইলাম কেবল । এইখবর যদি কোন ভাবে বাসায় পৌছে যায় তাহলে উপায় আছে !

দুইদিন পরে আমি নাজিয়ার বাবার সাথে দেখা করলাম । তারপর তাকে সমস্তটা খুলে বললাম যে কেমন করে নাজিয়ার সাথে আমার পরিচয় । নাজিয়ার আব্বা সব শুনে বললেন, আমার মেয়েটা তোমাকে খুব পছন্দ করেছে । ওর ভাব দেখেই আমি বুঝেছি । আর ছেলে হিসাবে তুমি তো চমৎকার । তোমার কি অন্য কোথাও মানে কারো সাথে কথা না দেওয়া আছে?
-না তা নেই ।
-তাহলে সমস্যা কী ! আমাকে মেয়ে তো খারাপ না কোন অংশে !
-না আংকেল আমি খারাপের কথা বলছি না । ওর বয়সটা দেখবেন না আপনি ! আমার বয়স এখন ৩১ চলছে । ওর বয়স খুব বেশি হলে ১৯ । পার্থক্যটা দেখবেন না আপনি !
ভদ্রলোক হেসে বললেন, আরে দুর এটা কোন ব্যাপার নাকি ! আমার সাথে তোমার আন্টির বয়সের ডিফারেন্স কত জানো? ১৫ বছর । তোমার তো মাত্র ১২ । এটা কোন ব্যাপারই না । আমি তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাই ।

আমি কী বলতে এলাম আর কী হল । এই ভদ্রলোক যদি আমার বাসায় পৌছে যায় তাহলে আমার খবরই আছে । কিভাবে এসব আটকাবো সেটাই ভাবতে লাগলাম । শেষ মেষ মনে হল নাজিয়ার সাথেই কথা বলতে হবে । এটাই সব থেকে ভাল উপায় । ওকে বোঝাতে পারলেই এই ঝামেলা থেকে মুক্তি মিলবে।

তিন

নাজিয়ার সাথে আমার দেখা হল আবার সেই স্থানে সেখানে আমরা প্রথমদিন বসেছিলাম । তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের বাসার সামনের ফুটপাথে । কিছু সময় আমরা কেউ কোন কথা বললাম না । চুপচাপ বসে রইলাম । কী ভাবে যে কথা শুরু করবো ঠিক যেন বুঝতে পারছি না । তবে আমার কাজটা নাজিয়াই সহজ করে দিল । প্রথমে সেই কথা বলল।
-আপনার তো অন্য কোন প্রেমিকা নেই । তাই না ?
-নাহ নেই ।
-এখন নেই নাকি কোন কালেই ছিল না ।
-এখন নেই ।
-তার মানে ছিল এক সময়ে?
-হ্যা ছিল ।
-কী হল তার ? মানে ব্রেক আপ কেন হল ?
আমি একটু যেন ভাবলাম । তারপর বললাম সম্পর্কের শুরুতে তার মনে হয়েছিলো যে আমি খুব ইন্টারেস্টিং কেউ হব । তবে যতই সময় যেতে থাকে ততই বুঝতে পারে যে আমি আসলে খুবই বোরিং একজন মানুষ । তাই এক সময়ে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । ওকে অবশ্য দোষ দিই না আমি । শুরুর দিকে বয়স কম ছিল ওর । আমারও কমই ছিল । যখন বয়স বাড়ে তখন অনেক কিছু বদলে যায় ।

নাজিয়া কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, এখন আপনার ধারণা যে আমার বেলাতেও এমন কিছুই হবে ?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি নাজিয়ার দিকে ফিরে চাইলাম । আমার মনের একটা অংশ তখন হঠাৎ করেই বলে উঠলো যে এতো সব চিন্তা করে কোন লাভ নেই । এই মেয়ে এখন প্রেমে পাগল হয়ে আছে, এখনই বিয়ে করে ফেল । পরে যা হবে দেখা যাবে । খুব ইচ্ছেও করছিলো যে এমন কিছু করতে ! কিন্তু মনের অন্য অংশ সেটাতে সায় দিল না
আমি বললাম, আমার মনে হয় না, আমি জানি এমনই হবে ।
-তাই?
-হ্যা । একটা সময়ে তোমার আর আমাকে এতো আকর্ষনীয় মনে হবে না । এবং এটা কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার । তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্যটা দেখো । তুমি যা পছন্দ কর আমি সেটা করবো না আমার যেটা ভাল লাগে তোমার সেটা লাগবে না । এভাবে যখন এক সাথে থাকা শুরু করবো দেখা যাবে আমাদের ভেতরে হাজারো পার্থক্য রয়েছে । আর এখন তোমার বয়স কম আবেগ বেশি । সব কিছু আবেগ দিয়ে চিন্তা করছো । আরেকটু বড় হলেই এই আবেগ কমে যাবে তখন বাস্তবতা এসে জমা হবে । হ্যা এখন আমার এই কথা তোমার পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু কিছুদিন পরে ঠিকই হবে ।

নাজিয়া বলল, কত দিন পরে?
-নো আইডিয়া । এক বছর দুই তিন বছর ।
-ওকে আমার সামনে ইন্টার পরীক্ষা । তারপর অনার্স । আমার যদি অনার্স শেষ হওয়ার পরেও আপনার প্রতি এমন আকর্ষণ থাকে তখন কি বলবেন যে আপনার ধারণা ভুল?

নাজিয়া যে এমন কথা বলবে সেটা আমি ঠিক বুঝি নি । ও ঠিক কী বলতে চাইছে সেটাও যেন আমার মাথায় এল না । আমি কিছুটা সময় দ্বিধান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম । তবে ওর চোখে মুখে একটা দৃঢ়তা দেখতে পেলাম । আমি বললাম, হ্যা ঐ বয়সে সব মেয়েই পরিপক্ক হয়ে ওঠে ।
-ওকে তাহলে আসুন ডিল করি ।
-কী ডিল ?
-আমি অনার্স পর্যন্ত দেখবো যে আপনার প্রতি এই আবেগ থাকে কিনা ! যদি না থাকে তখন তো আলাদা হয়ে গেলাম । কিন্তু যদি থাকে, তাহলে সেই সময়ে আপনি রাজি হবেন?
-তার মানে তুমি এই সামনের চার বছর আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে?
-আপনি থাকবেন ?

আমি চট করেই জবাব দিতে পারলাম না । নাজিয়া বলল, আমি জানি আমার মন কী চায় । এবং আমি জানি চার কেন চল্লিশ বছর পরেও এটা বদলাবে না । আমার অনার্স শেষ করে ঠিক এই স্থানে আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় আসবো । সেদিন আপনি আসেন কিংবা না আসেন তবে এখন জেনে রাখেন যে আমি ঠিক আসবো । আপনাকে সেদিন আমাকে গ্রহন করতে হবে না । এমন কী আপনি এই সময়ের ভেতরে বিয়ে শাদী করে সংসারিও হয়ে যেতে পারেন । কেবল অনুরোধ যে একবার আসবেন । এবং এসে দেখবেন যে আপনার প্রতি আমার অনুভূতি বদলায় নি ।

আমাদের মাঝে যখন কারো প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয় তখন সত্যিই মনে হয় যে তাকে আমরা সব সময় একই ভাবে ভালোবাসবো । এই ভালোবাসা কখনই বদলাবে না । একই রকম থাকবে । তবে সত্যি বলতে কী সেটা থাকে না । সময়ের সাথে তা বদলে যায় । আর কম বয়সে এই অনুভূতিটা আরও বেশি মনে হয় । বয়স যখন বাড়ে তখন এই আবেগ কমে যায় । আমি নিশ্চিত জানি যে নাজিয়ারও কমে যাবে তখন এটাকে বোমাকী মনে হবে। কিন্তু আমার নিজের মাঝে হঠাৎ কি যে হল আমিও একটা বোকামী করে বসলাম । বললাম, ওকে তাহলে ডিল রইলো । ইউ উইল ফাইন্ড মি হেয়ার । তবে একটা কথা দিতে হবে ।
-কী?
-তুমি এখানে আসবে এই কারণে নয় যে তুমি আমাকে কথা দিয়েছো যে আমার প্রতি ভালোবাসা কমবে না, বরং আসবে এই কারণে যে তুমি সত্যিই আমার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছো । বুঝেছো ? মানে আমরা যখন কাউকে কথা দিই তখন আমরা একটা বন্ধনে আটকে যাই । এই বন্ধনের কারণে আমরা নিজের মনকে জোর করে সেটা বুঝাই যা আমরা অনুভব করি না । আমি চাই সত্যিই যদি সেই দিন আমার প্রতি তোমার আবেগ কাজ করে তবেই আসবে ! ঠিক আছে? এই অনেস্টি টুকু আমি কি আশা করতে পারি তোমার কাছ থেকে ?

নাজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বলল, হ্যা তাই হবে ।
-এবং মনে রেখো যে যদি না আসো তখন আমি মোটেই কিছু মনে করবো না কিংবা তোমাকে খারাপ কিছু মনে করবো না । ঠিক আছে কি?
-হুম !
-গুড । এখন পড়াশোনাতে মন দাও ।

সেদিনই নাজিয়ার সাথে আমার শেষ যোগাযোগ । আমরা আসার আগে একটা তারিখ ঠিক করলাম । সেই তারিখে ঠিক একই স্থানে আমরা এসে হাজির হব । তারপর বিদায় নিয়ে চলে এলাম ।
গত চার বছরে নাজিয়ার সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ হয় নি । কেবল মাঝে একবার নাজিয়া আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল যে কানাডা চলে যাচ্ছে পড়তে ।
প্রথম কয়েকদিন নাজিয়ার কথা আামর মনে পড়তো । তবে একটা সময়ে আমিও নাজিয়ার কথা ভুলে গেলাম । নিজের কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে গেলাম । এদিকে বাসা থেকে আামকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো । কয়েকবার আমি রাজি হয়েও হতে পারলাম না । আগেই বলেছিলাম যে আমরা যখন কাউকে কথা দিই তখন আমরা একটা বান্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাই । যতবারই ভুলে যেতে চাই তখনই মনে হয় চার বছর পরে সত্যিই যদি মেয়েটা চলে আসে তখন? আমি কিছুতেই এই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারি না ।

পরিশিষ্টঃ

আমি চুপচাপ বসে রয়েছি সেই আগের জাগয়ায় যেখানে নাজিয়ার সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা রয়েছে । এই পুরো সময়ে আমি নাজিয়াকে যে মনে রেখেছি ব্যাপারটা আসলে তেমন নয় । এবং আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে নাজিয়া হয়তো আসবে না । এমনটা মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে নাজিয়ার সম্ভবত এখন মাস্টার্সের ক্লাস চলছে । এখন ওখানে পড়াশোনার সিজন পুরোদমে । নাজিয়া নিশ্চিত ভাবেই অনার্সের পরে ওখানে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হয়ে গেছে । কোন সন্দেহ নেই । এরপর পিএইচডি করতে পারে । তাই বছরের এই সময়ে একটা সিলি ব্যাপারের জন্য ওর দেশে ছুটে আসাটা একেবারে অসম্ভব একটা ব্যাপার ।

তবুও আমি এসেছি । কথা যেহেতু দিয়েছিলাম চলে এসেছি । সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক আগেই । ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমি বসে রয়েছে । হয়তো সে আসবে অথবা হয়তো আসবে না । তবে আজকের পর থেকে আমি একটা বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবো ।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি । সেই যে একটু সময়ে হবে নাজিয়া আমার জীবনে এল তারপর এতো লম্বা সময় ধরে আমাকে অপেক্ষা করাবে সেটা হয়তো আমি কখনই ভাবতে পারি নি ।
মেয়েটা কি আসবে?

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 58

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

4 Comments on “আপনার একটু সময় হবে?”

  1. নাজিয়া কি সত্যি এসেছিল?
    নাকি সব আবেগের মোহমায়া

Comments are closed.