ছুটির দিন গুলোতে আমি সাধারণত সাইকেল নিয়ে এদিক ওদি ঘুরে বেড়াই । সারা সপ্তাহ সকাল থেকে রাত কখন সময় চলে যায় কোন হুস থাকে না । তাই সাইকেল চালানোর সুযোগ পাওয়া যায় না । ছুটির দিনটা তাই আরাম করে সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই । আজও সন্ধ্যার আগে বের হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । পরিকল্পনা ছিল যে মিন্টু রোডে যাওয়ার আগে হলি ফ্যামিলির সামনে থেকে এক প্লেট ফুচকা খাবো । ছাত্র জীবনে এখানে একটা টিউশনি করাতাম । টিউশনিতে ঢোকার আগে এখানে এক প্লেট চটপটি কিংবা ফুচকা খেতে তাররপর ঢুকতাম ভেতরে । সেই সময় থেকেই এখানকার চটপটি আমার পছন্দ । এখনও সময় পেলে এখানে আসি ।
আজও সেই দিকেই যাচ্ছিলাম। সরকারী অফিসার্স কোয়াটার পার করছি এমন সময়ে একটা মেয়ের দিকে চোখ গেল। মেয়েটার পরনে একটা কালো রংয়ের জিন্স । উপরে একটা শার্ট । মুখে একটা কালো মাস্ক পরা । আমার দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটা খানিকটা যেন থমকে গেল । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই যে একটু শুনুন !
আমার প্রথমে মনে হল হয়তো আমি ভুল শুনছি । আমার পেছনের কাউকে ডাকছে । আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সেদিকে কেউ নেই । তার মানে কি আমাকেই ডাকছে?
কিন্তু কেন ডাকবে ?
আমাকে ডাকার তো কোন কারণ নেই ।
-আরে আপনিই । আপনাকেই ডাকছি । প্লিজ শুনুন একটু !
আমি সাইকেল থামালাম । একটু দুরে চলে গিয়েছিলাম বটে আবার ফিরে মেয়েটার সামনে এসে দাড়ালাম । বললাম, আমাকে কিছু বলছেন ?
যদিও মেয়েটা আমার থেকে ছোটই হবে তবুও প্রথমে আপনি বলেই ডাকলাম । এখনকার মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি । অপরিরিত কেউ তুমি করে ডাকলে তারা রাগ করে । মেয়েটা আমার একটু কাছে এল । তারপর বলল, আপনার কাছে কি সময় হবে একটু ?
-সময় বলতে?
-মানে এই ধরুন মিনিট ১৫ । হবে ?
-কেন ?
মেয়েটি একটু যেন দ্বিধাবোধ করলো । বলতে যেন একটু সংকোচ বোধ করছে । তবে কিছু সময়ের ভেতরেই সব সংকোচ কাটিয়ে ফেলে মেয়েটি বলল, আপনি ১৫ মিনিটের জন্য আমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারবেন প্লিজ?
আমার মনে হল আমি ভুল শুনলাম কথাটা । আমাদের দেশে এই রকম কথা কোন মেয়ে কোন ছেলেকে বলতে পারে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল । আমি সরু চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে । মেয়েটি তখন বলল, আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে দেখাতে হবে যে আমি একদিনের ভেতরেই বয়ফ্রেন্ড জোগার করতে পারি । ওর বাসা একটু সামনেই । বেশি না মাত্র ১৫ মিনিট । প্লিজ !
আমি হেসে ফেললাম মেয়েটার ছেলে মানুষী দেখে । এখন অবশ্য মেয়েটাকে আর আপনি বলতে ইচ্ছে করছে না । এই মেয়ে যে খুবই অপরিপক্ক একটা মেয়ে সেটা মেয়েটার এই আচরণই বলে দিচ্ছি । এখন একে তুমি বলাই যায় । আমি বললাম, কোন ক্লাসে পড় তুমি?
মেয়েটা বলল, এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবো ।
আমি বললাম, আমি যাকে পড়াতাম সে এইবার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে । আমার প্রেমিকা হওয়ার জন্য আরেকটু বড় হলে ভাল হতো না ।
মেয়েটা বলল, ওসব কোন ব্যাপার না । আর আপনাকে দেখে এতো বয়স্ক মনে হচ্ছে না । মনে হচ্ছে যে আপনি হয়তো অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়েন । আমি যেখানে কোচিং করি সেখানকার ভাইয়াটা থার্ড ইয়ারে পড়ে । আপনাকে তার থেকে ছোট মনে হচ্ছে ।
ছেলে হোক মেয়ে হোক যখন কেউ বলে যে আপনাকে অনেক কম বয়স্ক দেখায় তখন সেটা মনে আনন্দের একটা অনুভূতি জাগায় । আমারও মনে হল যাক মেয়েটার একটা উপকার করাই যায় । আমি সাইকেল থেকে নামলাম । তারপর বলল, চল কোথায় বসতে হবে শুনি !
-সত্যি যাবেন?
-হ্যা চল ।
আমি মেয়েটার সাথে হাটতে হাটতে এগিয়ে গেলাম । কিছু দুর গিয়ে মেয়েটা ফুটপাথে বসতে ইশারা করলো । সাইকেল টা সামনে রেখে মেয়েটার সামনে বসলাম । এখানে আমি আগেও বসেছি অনেক । মেয়েটা বসলো আমার পাশে । বসতে বসতে বলল, ফারাজের বাড়ি সামনেই । ঐ যে ঐ বিল্ডিংয়ে । জানলা দিয়ে সে এখানে দেখতে পাবে ।
-তাকাবেই ?
-না তাকালে তাকানোর ব্যবস্থা করবো । দাড়ান ।
এই বলেই মেয়েটা নিজের মোবাইল বের করলো । তারপর বলল, আসুক একটা সেলফি তুলি !
-কী!
-হ্যা সেলফি তুলে স্টোরীতে দিবো । সেটা ওর কাছে ঠিক ঠিক চলে যাবে ।
আমার মনে হল মেয়েটাকে বাঁধা দিই কিন্তু কেন জানি দিলাম না । অবশ্য আমার মুখে মাস্ক পরানো রয়েছে । খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না । মেয়েটা ছবি তোলার আগে নিজের মুখের মাস্ক খুলে ফেলল । আমি তখন মেয়েটার চেহারার দিকে তাকালাম । মেয়েটা দেখতে বেশ চমৎকার । গোলাগাল চেহারায় একটা ছেলেমানুষী ভাব রয়েছে । সেই সাথে একটা মায়াময় চেহারা।
বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল । তারপর কিছু সময় টেপাটেপি করলো । কী ক্যাপশন দিল কে জানে । আমি সেদিকে গেলাম । ছবি আপলোড শেষে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি নাজিয়া । আপনার নামই জানা হল না ।
আমি আমার নাম বললাম । মেয়েটা নাম শুনে বলল, আপনার নাম টা সুন্দর । ছোট একটু নাম । শুনলেই আদর করতে ইচ্ছে করে ।
নাজিয়া দেখি বেশ চটপটে । কথা বলতে পারে বেশ ।
আমি বললাম তা বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ কেন হল ?
-বেটা চিট করছে আমার সাথে । আমার সাথে প্রেম থাকা অবস্থায় আরেকটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরছিলো । হাতে নাতে ধরেছি । বলে কিনা আমি নাকি ক্ষেত । আচ্ছা বলেন তো প্রেম করলেই শরীরে হাত দিতে হবে ? আমাকে এসব পছন্দ করতাম না বলেই নাকি অন্য মেয়ের কাছে গেছে । আমি যদি ওকে এসব করতে দিই তাহলে নাকি আবার আমার কাছে আসবে । ব্যাটা তোকে আসতে দিলে তো !
আমি বললাম, তাহলে এসব কেন করছো?
-করছি কারন ফারাজ বলেছে আমি নাকি আর প্রেম করতেই পারবো না । এখন সব ছেলেদের নাকি এসব করতে দিতে হয় । আমিও বলেছি যে তোদের লুচ্চাদের সাথে আমি নাই আর !
আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম । মেয়েটা যে আসলেই সরল তা বুঝতে কষ্ট হল না । আমার সামনে এমন ভাবে কথা বলছিলো যেন আমরা কতদিনের পরিচিত !
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই দেখলাম নাজিয়া আমার দিকে সরে এল । একটা হাত আমার হাতের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল । আমাকে বলল, ঐ যে জানালা দিয়ে এদিকে তাকিয়ে রয়েছে । বেটা এবার দেখুক ।
আমি সামনের দিকে তাকালাম । একটা ছেলেকে দেখতে পেলাম এদিকে তাকিয়ে রয়েছে । এতো দুর থেকে চোখের অবস্থা না দেখলেও আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে তার চোখে আগুন রয়েছে ।
নাজিয়ার সাথে আরো কিছু সময় গল্প করলাম । তারপর বললাম, এখন উঠতে হবে । আশা করি তোমার কাজ হয়েছে ।
-হুম খুব হয়েছে ।
সাইকেলে উঠে শেষ বারের মত বিদায় নেওয়ার আগে নাজিয়াকে বলল, শোনো মেয়ে, লয়ালিটি খুব দামী একটা জিনিস । এটা সস্তা মানুষ এফোর্ড করতে পারে না । আর এসব সস্তা মানুষের জন্য নিজের সময় নষ্ট করবে না । ঠিক আছে !
-হুম ঠিক আছে ।
-আর এই যুগেও যে তোমার মত মেয়ে আছে জেনে ভাল লাগলো । ভালবাসা প্রেম এসবের সাথে শরীরের ব্যাপারটা ম্যান্ডাটরি কোন ব্যাপার না । অসৎ মানুষ গুলো তোমার মন নয় শরীর খুজবেে । আর সেই শরীরের কাছে পৌছাতে মনকে ব্যবহার করবে । এই জন্য সাবধান । ওকে !
-ওকে!
আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম । ভেবেছিলাম নাজিয়ার সাথে আমার সেই শেষ দেখা । তবে আবারও দেখা হল । মাস ছয়েক পরে । ততদিনে নাজিয়া হারিয়ে গেছে মন থেকে ।
দুই
-ভাই চলে না ! কী হবে !
আমি সজিবের দিকে কিছু সময় বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম । সজিব আমার অফিসে র জুনিয়র । আমার সাথে বেশ ভাব । ওর কাজে কর্মে আমি বেশ সাহায্য করি তাই আমাকে ও পছন্দ করে বেশ । আজকে ওর একটা বিয়ের দাওয়াত রয়েছে । অফিস থেকে সেখানেই সে যাবে । এখন আমাকে ধরেছে আমিও যাতে ওর সাথে যাই । আমি বললাম, তুই জানি আমি বিয়ের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি । ভীড় ভাল লাগে না ।
-আরে ভাই । ভীড় দিয়ে আপনি কী করবেন ! আমরা যাবো । খাবো চলে আসবো । ব্যাস ।
-তুই যা । আমাকে কেন টানছিস !
-ভাই একা একা যাবো । আর আব্বা বলেছে ৫ হাজার টাকা দিতে । এতো গুলো টাকা দিয়ে মাত্র একজন যাবো । প্লিজ চলেন ভাই । অফিসার্স ক্লাবে । খাওয়া ভাল দিবে । চলেন প্লিজ চলেন । আর আজকে এমনিতেও স্যুট পরে এসেছেন । একেবারে পার্ফেক্ট পোশাক বিয়ের জন্য । চলেন চলেন ।
আজকে একটা মিটিং ছিল বাইরের বায়ারদের সাথে তাই ফিটফাট হয়ে আসতে হয়েছিলো । খাওয়া দাওয়া যেহেতু ভাল হবে তাই আর আপত্তি করলাম না ।
যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলাম । আমাকে অনুষ্ঠানের একপাশে রেখে সজিব কোথায় যেন হারিয়ে গেল । আমি কিছু সময় এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম তারপর মনে হল সজিবের আশায় বসে থেকে লাভ নেই । এখনই খাওয়া দিবে । খেয়ে আমি একাই দৌড় দিবো । এই ভেবে যেই না ঘুরেছি তখনই নাজিয়াকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । বুঝতে পারলাম যে আমাকে সে দেখেছে আগেই । আমার কাছে এগিয়ে এল । তারপর বলল, আপনি এখানে?
-কাচ্চি খেতে এসেছি ।
-বিনা দাওয়াতে ।
-না । দাওয়াতেই । তুমি এখানে?
-আমার বোনের বিয়ে ।
-আরে তাই নাকি ? গ্রেট !
ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো যে আমাকে এখানে দেখে ও খুবই খুশি হয়েছে । আমার সাথে গল্প জুড়ে দিতে সময় লাগলো না । এটো দিন কী হয়েছে কী করেছে এই সব । তারপর এক সময়ে আমাকে নিয়ে সে চলে গেল স্টেজে । তারপর সেখানে দারিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলো । আমি খেয়াল করলাম যে কয়েকটা কৌতুহলী চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এবং তাদের ভেতরে একজোড়া চোখ আমার বড় পরিচিত মনে হল । সেই দিনের সেই জানালা থেকে দেখা চেহারাটা মনে পড়লো । আমি নাজিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, তোমার এক্স !
-ইয়েস ।
-এখানে?
-আব্বু আর ও আব্বু কলিগ । আসবে তো অবশ্যই ।
-ও আচ্ছা । তা এরপর আর এসেছে !
-আসে নি আবার । লিটারেলী বেগ করেছে আসার জন্য । আমি ওদিকে মুখই ঘোরাই নি । এমন কি ওর মাকে দিয়ে আমার মাকে বলিয়েছে পর্যন্ত ।
-তারপর আর কি ! আমি আপনার সাথে তোলা ছবি দেখিয়েছি । বলেছি যে আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড ।
-সেকি তোমার আম্মুকে !
-হ্যা ।
-তারপর?
-তার আর পর নেই । আম্মু আর কিছু বলে নি ।
আমার মনে হল যে এই মেয়ের কাছ থেকে আমি এখনই দুরে চলে যাওয়া উচিৎ নয়তো আমি বিপদে পড়তে পারি । কোন নিশ্চয়তা নেই । তবে চাইলেই যাওয়া হল না । নাজিয়া পুরো সময় টুকু আমার সাথেই চিপকে রইলো । আর কত গুলো ছবি যে তুলল তার কোন ঠিক নেই । এমন কি বর বউের সাথে পর্যন্ত আমি ছবি তুললাম । কেন তুললাম কে জানে !
খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন বের হয়ে আসবো তখন আবার সজিব এসে হাজির । সজিব নাজিয়াকে চেনে অল্প সল্প । হাই হ্যালো করে আমরা বের হয়ে এলাম । সজিব বলল, এই মেয়েকে কিভাবে চিনেন ?
-চিনি এক ভাবে । লম্বা কাহিনী ।
সজিব বুঝলো লম্বা কাহিনী আমি বলতে চাই না তাই সে জানতে চাইলো না । আমার এবার কেন জানি মনে খুব জলদিই নাজিয়ার সাথে আমার আবার দেখা হবে । এবং আমার এই আসংঙ্খা সত্যি হল সপ্তা খানেক পরেই । লাঞ্চ আওয়ারে সজিবের সাথে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এল । এবং সজিব তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । সেই ভদ্রলোক আর কেউ নয়, নাজিয়ার আব্বা । আমার খোজ খবর নিল। কোথায় বাড়ি আব্বা কী করে এই সব !
আমি বুঝতে পারলাম যে সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে ।
পরদিনই সজিব জানালো যে নাজিয়া বাসায় বলেছে যে আমার সাথে তার প্রেম চলছে । প্রমান স্বরূপ ছবি দেখিয়েছে । আর ওর বাবা এসেছিলো খোজ নিতে এবং তারও কোন আপত্তি নেই ।
কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার ! আমি কিছু সময় ঘুম মেরে বসে রইলাম কেবল । এইখবর যদি কোন ভাবে বাসায় পৌছে যায় তাহলে উপায় আছে !
দুইদিন পরে আমি নাজিয়ার বাবার সাথে দেখা করলাম । তারপর তাকে সমস্তটা খুলে বললাম যে কেমন করে নাজিয়ার সাথে আমার পরিচয় । নাজিয়ার আব্বা সব শুনে বললেন, আমার মেয়েটা তোমাকে খুব পছন্দ করেছে । ওর ভাব দেখেই আমি বুঝেছি । আর ছেলে হিসাবে তুমি তো চমৎকার । তোমার কি অন্য কোথাও মানে কারো সাথে কথা না দেওয়া আছে?
-না তা নেই ।
-তাহলে সমস্যা কী ! আমাকে মেয়ে তো খারাপ না কোন অংশে !
-না আংকেল আমি খারাপের কথা বলছি না । ওর বয়সটা দেখবেন না আপনি ! আমার বয়স এখন ৩১ চলছে । ওর বয়স খুব বেশি হলে ১৯ । পার্থক্যটা দেখবেন না আপনি !
ভদ্রলোক হেসে বললেন, আরে দুর এটা কোন ব্যাপার নাকি ! আমার সাথে তোমার আন্টির বয়সের ডিফারেন্স কত জানো? ১৫ বছর । তোমার তো মাত্র ১২ । এটা কোন ব্যাপারই না । আমি তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাই ।
আমি কী বলতে এলাম আর কী হল । এই ভদ্রলোক যদি আমার বাসায় পৌছে যায় তাহলে আমার খবরই আছে । কিভাবে এসব আটকাবো সেটাই ভাবতে লাগলাম । শেষ মেষ মনে হল নাজিয়ার সাথেই কথা বলতে হবে । এটাই সব থেকে ভাল উপায় । ওকে বোঝাতে পারলেই এই ঝামেলা থেকে মুক্তি মিলবে।
তিন
নাজিয়ার সাথে আমার দেখা হল আবার সেই স্থানে সেখানে আমরা প্রথমদিন বসেছিলাম । তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের বাসার সামনের ফুটপাথে । কিছু সময় আমরা কেউ কোন কথা বললাম না । চুপচাপ বসে রইলাম । কী ভাবে যে কথা শুরু করবো ঠিক যেন বুঝতে পারছি না । তবে আমার কাজটা নাজিয়াই সহজ করে দিল । প্রথমে সেই কথা বলল।
-আপনার তো অন্য কোন প্রেমিকা নেই । তাই না ?
-নাহ নেই ।
-এখন নেই নাকি কোন কালেই ছিল না ।
-এখন নেই ।
-তার মানে ছিল এক সময়ে?
-হ্যা ছিল ।
-কী হল তার ? মানে ব্রেক আপ কেন হল ?
আমি একটু যেন ভাবলাম । তারপর বললাম সম্পর্কের শুরুতে তার মনে হয়েছিলো যে আমি খুব ইন্টারেস্টিং কেউ হব । তবে যতই সময় যেতে থাকে ততই বুঝতে পারে যে আমি আসলে খুবই বোরিং একজন মানুষ । তাই এক সময়ে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । ওকে অবশ্য দোষ দিই না আমি । শুরুর দিকে বয়স কম ছিল ওর । আমারও কমই ছিল । যখন বয়স বাড়ে তখন অনেক কিছু বদলে যায় ।
নাজিয়া কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, এখন আপনার ধারণা যে আমার বেলাতেও এমন কিছুই হবে ?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি নাজিয়ার দিকে ফিরে চাইলাম । আমার মনের একটা অংশ তখন হঠাৎ করেই বলে উঠলো যে এতো সব চিন্তা করে কোন লাভ নেই । এই মেয়ে এখন প্রেমে পাগল হয়ে আছে, এখনই বিয়ে করে ফেল । পরে যা হবে দেখা যাবে । খুব ইচ্ছেও করছিলো যে এমন কিছু করতে ! কিন্তু মনের অন্য অংশ সেটাতে সায় দিল না
আমি বললাম, আমার মনে হয় না, আমি জানি এমনই হবে ।
-তাই?
-হ্যা । একটা সময়ে তোমার আর আমাকে এতো আকর্ষনীয় মনে হবে না । এবং এটা কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার । তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্যটা দেখো । তুমি যা পছন্দ কর আমি সেটা করবো না আমার যেটা ভাল লাগে তোমার সেটা লাগবে না । এভাবে যখন এক সাথে থাকা শুরু করবো দেখা যাবে আমাদের ভেতরে হাজারো পার্থক্য রয়েছে । আর এখন তোমার বয়স কম আবেগ বেশি । সব কিছু আবেগ দিয়ে চিন্তা করছো । আরেকটু বড় হলেই এই আবেগ কমে যাবে তখন বাস্তবতা এসে জমা হবে । হ্যা এখন আমার এই কথা তোমার পছন্দ নাও হতে পারে কিন্তু কিছুদিন পরে ঠিকই হবে ।
নাজিয়া বলল, কত দিন পরে?
-নো আইডিয়া । এক বছর দুই তিন বছর ।
-ওকে আমার সামনে ইন্টার পরীক্ষা । তারপর অনার্স । আমার যদি অনার্স শেষ হওয়ার পরেও আপনার প্রতি এমন আকর্ষণ থাকে তখন কি বলবেন যে আপনার ধারণা ভুল?
নাজিয়া যে এমন কথা বলবে সেটা আমি ঠিক বুঝি নি । ও ঠিক কী বলতে চাইছে সেটাও যেন আমার মাথায় এল না । আমি কিছুটা সময় দ্বিধান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম । তবে ওর চোখে মুখে একটা দৃঢ়তা দেখতে পেলাম । আমি বললাম, হ্যা ঐ বয়সে সব মেয়েই পরিপক্ক হয়ে ওঠে ।
-ওকে তাহলে আসুন ডিল করি ।
-কী ডিল ?
-আমি অনার্স পর্যন্ত দেখবো যে আপনার প্রতি এই আবেগ থাকে কিনা ! যদি না থাকে তখন তো আলাদা হয়ে গেলাম । কিন্তু যদি থাকে, তাহলে সেই সময়ে আপনি রাজি হবেন?
-তার মানে তুমি এই সামনের চার বছর আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে?
-আপনি থাকবেন ?
আমি চট করেই জবাব দিতে পারলাম না । নাজিয়া বলল, আমি জানি আমার মন কী চায় । এবং আমি জানি চার কেন চল্লিশ বছর পরেও এটা বদলাবে না । আমার অনার্স শেষ করে ঠিক এই স্থানে আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় আসবো । সেদিন আপনি আসেন কিংবা না আসেন তবে এখন জেনে রাখেন যে আমি ঠিক আসবো । আপনাকে সেদিন আমাকে গ্রহন করতে হবে না । এমন কী আপনি এই সময়ের ভেতরে বিয়ে শাদী করে সংসারিও হয়ে যেতে পারেন । কেবল অনুরোধ যে একবার আসবেন । এবং এসে দেখবেন যে আপনার প্রতি আমার অনুভূতি বদলায় নি ।
আমাদের মাঝে যখন কারো প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয় তখন সত্যিই মনে হয় যে তাকে আমরা সব সময় একই ভাবে ভালোবাসবো । এই ভালোবাসা কখনই বদলাবে না । একই রকম থাকবে । তবে সত্যি বলতে কী সেটা থাকে না । সময়ের সাথে তা বদলে যায় । আর কম বয়সে এই অনুভূতিটা আরও বেশি মনে হয় । বয়স যখন বাড়ে তখন এই আবেগ কমে যায় । আমি নিশ্চিত জানি যে নাজিয়ারও কমে যাবে তখন এটাকে বোমাকী মনে হবে। কিন্তু আমার নিজের মাঝে হঠাৎ কি যে হল আমিও একটা বোকামী করে বসলাম । বললাম, ওকে তাহলে ডিল রইলো । ইউ উইল ফাইন্ড মি হেয়ার । তবে একটা কথা দিতে হবে ।
-কী?
-তুমি এখানে আসবে এই কারণে নয় যে তুমি আমাকে কথা দিয়েছো যে আমার প্রতি ভালোবাসা কমবে না, বরং আসবে এই কারণে যে তুমি সত্যিই আমার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছো । বুঝেছো ? মানে আমরা যখন কাউকে কথা দিই তখন আমরা একটা বন্ধনে আটকে যাই । এই বন্ধনের কারণে আমরা নিজের মনকে জোর করে সেটা বুঝাই যা আমরা অনুভব করি না । আমি চাই সত্যিই যদি সেই দিন আমার প্রতি তোমার আবেগ কাজ করে তবেই আসবে ! ঠিক আছে? এই অনেস্টি টুকু আমি কি আশা করতে পারি তোমার কাছ থেকে ?
নাজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বলল, হ্যা তাই হবে ।
-এবং মনে রেখো যে যদি না আসো তখন আমি মোটেই কিছু মনে করবো না কিংবা তোমাকে খারাপ কিছু মনে করবো না । ঠিক আছে কি?
-হুম !
-গুড । এখন পড়াশোনাতে মন দাও ।
সেদিনই নাজিয়ার সাথে আমার শেষ যোগাযোগ । আমরা আসার আগে একটা তারিখ ঠিক করলাম । সেই তারিখে ঠিক একই স্থানে আমরা এসে হাজির হব । তারপর বিদায় নিয়ে চলে এলাম ।
গত চার বছরে নাজিয়ার সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ হয় নি । কেবল মাঝে একবার নাজিয়া আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল যে কানাডা চলে যাচ্ছে পড়তে ।
প্রথম কয়েকদিন নাজিয়ার কথা আামর মনে পড়তো । তবে একটা সময়ে আমিও নাজিয়ার কথা ভুলে গেলাম । নিজের কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে গেলাম । এদিকে বাসা থেকে আামকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো । কয়েকবার আমি রাজি হয়েও হতে পারলাম না । আগেই বলেছিলাম যে আমরা যখন কাউকে কথা দিই তখন আমরা একটা বান্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাই । যতবারই ভুলে যেতে চাই তখনই মনে হয় চার বছর পরে সত্যিই যদি মেয়েটা চলে আসে তখন? আমি কিছুতেই এই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারি না ।
পরিশিষ্টঃ
আমি চুপচাপ বসে রয়েছি সেই আগের জাগয়ায় যেখানে নাজিয়ার সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা রয়েছে । এই পুরো সময়ে আমি নাজিয়াকে যে মনে রেখেছি ব্যাপারটা আসলে তেমন নয় । এবং আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে নাজিয়া হয়তো আসবে না । এমনটা মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে নাজিয়ার সম্ভবত এখন মাস্টার্সের ক্লাস চলছে । এখন ওখানে পড়াশোনার সিজন পুরোদমে । নাজিয়া নিশ্চিত ভাবেই অনার্সের পরে ওখানে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হয়ে গেছে । কোন সন্দেহ নেই । এরপর পিএইচডি করতে পারে । তাই বছরের এই সময়ে একটা সিলি ব্যাপারের জন্য ওর দেশে ছুটে আসাটা একেবারে অসম্ভব একটা ব্যাপার ।
তবুও আমি এসেছি । কথা যেহেতু দিয়েছিলাম চলে এসেছি । সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক আগেই । ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমি বসে রয়েছে । হয়তো সে আসবে অথবা হয়তো আসবে না । তবে আজকের পর থেকে আমি একটা বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবো ।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি । সেই যে একটু সময়ে হবে নাজিয়া আমার জীবনে এল তারপর এতো লম্বা সময় ধরে আমাকে অপেক্ষা করাবে সেটা হয়তো আমি কখনই ভাবতে পারি নি ।
মেয়েটা কি আসবে?
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
নাজিয়া কি সত্যি এসেছিল?
নাকি সব আবেগের মোহমায়া
ধুর এটা কোন কথা?
Do you plan to write more chapters of this story?
আরেকটা পর্ব লেখার ইচ্ছে আছে !