মাই ডিয়ার হোম মিনিস্টার (পর্ব ০৪)

4.9
(11)

আমি খুব অবাক হয়ে আমার ছাত্রের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । আমার আসলে এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না এই ছেলে সত্যি সত্যিই তার বড় ভাইকে ডেকে নিয়ে এসেছে । বড় ভাই আবার যে কেউ না । বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র অঙ্গ সংগঠনের বড় নেতা । তার ভাই আমার ছাত্র । পুরো সেমিস্টার জুড়ে কোন পরীক্ষা দেয় নি । কোন ক্লাস করে নি । এখন এসেছে আমার কাছে ক্লাস এটেনডেন্স আর পারফরমেন্সের নাম্বার নিতে ।

কামাল আফসার হচ্ছে সেই বড় নেতা । আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, তাহলে আপনি নাম্বার দিবেন না ?

-না । আমি ওকে কেন নাম্বার দিবো ? দেখো তোমার ভাই কোন পরীক্ষা দেয় নি । আমি এটা ওর জন্য কনসিডার করতে পারি । কাল পরশু ওর জন্য আলাদা একটা পরীক্ষা নিতে পারি । সেই নাম্বার যোগ হবে । কিন্তু ও যে ক্লাসে উপস্থিত হয় নি সেখানে ওকে আমি কোন নাম্বার দিবো না । মোট ২৬টা ক্লাস নিয়েছি । তোমার ভাই একটাতেও উপস্থিত ছিল না ।

কামাল আফসার বলল, আপনি জানেন আমি কে ? আর আমার ভাই হিসাবে ওর নিজের অনেক কাজ থাকে । অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে ।

এবার আমি কামাল আফসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্টুডেন্টের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন কাজ হচ্ছে পড়াশুনা করা । তারপর অন্য কাজ ! আমার কাছ থেকে যদি নাম্বার পেতে হয় তাহলে ওকে এই কাজই করতে হবে । ফ্রিতে আমি ওকে কোন নাম্বার দিবো না ।

-কাজটা কিন্তু আপনি ভাল করছেন না !

-আমি ভাল করছি কি করছি না সেটা আমার উপরে ছেড়ে দাও । আমাকে আমার কাজ শেখাতে এসো না । এখন তোমরা আসতে পারো । আমার ক্লাস নেওয়ার সময় হয়েছে ।

আমি আর ওদের দিকে মনযোগ দিলাম না । একটু যে অস্বস্থি লাগছিলো না, সেটা বলবো না । শুনেছি অন্য সব স্যারেরা নাকি এই ছেলেকে ঠিকই নাম্বার দিয়ে দিয়েছে । কেবল আমি দিচ্ছি না । আমি অফিস রুম থেকে বের হতে যাবো তার আগে কামাল আফসার বলল

-আমি আপনাকে আরও দুইদিন সময় দিলাম ।

-তুমি আমাকে দুইদিন যেন ২০০ দিন সময় দিলেও আমার কথার নড়চড় হবে না । তা তুমি যাই কর না কেন ?

-আপনি কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকরি করতে পারবেন না ।

-না পারলে পারবো না । কোন সমস্যা নেই । তুমি এখন আসো !

আমার দিকে আরও কিছু সময় কঠিন চোখ তাকিয়ে রইলো কামাল আফসার । তারপর রুম থেকে বের হয়ে গেল ।

এই ঘটনা প্রায় মাস খানেক আগের । তারপর থেকে আমার উপর আরও কয়েকবার হুমকি ধামকি এসেছে । এমন কি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছে আমি যেন ঝামালে না করে নাম্বার টা দিয়ে দেই । কি দরকার এমন উটকো ঝামেলায় জড়ানো । আমি সেই কথা গুলো শুনেও না শোনার ভান করেছি । এমন কি একদিন ফিজিস ডিপার্টমেন্টের সেই রিদি ম্যাডামও আমাকে বলল, যেন আমি ঝামেলা এড়িয়ে চলি । কিন্তু ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারলাম না ।

তারপর গত সপ্তাহের ঘটনা ঘটলো । সত্যিই বলতে কি ওরা যখন আমাকে প্রথম তুলে নিয়ে গেল তখন আমার সবার আগে এই মনে হয়েছে যে হয়তো কামাল আফসারের লোকই আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে । তখন আমি খানিকটা ভয়ই পেয়েছিলাম ।

আজকে ক্লাস নিয়ে এসে অফিস রুমে বসে আছি তখনই হইচই শুনতে পেলাম । তার কিছু সময় পরেই পিয়ন ছুটে এল আমার রুমে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-স্যার আপনি আজকে চলে যান । পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান !

-কেন ?

-স্যার আজকে ঝামেলা হবে । কালাম মামার লোকজন আসতেছে । তাদের মাথা হট আছে ।

একটু পরে দেখলাম চেয়ারম্যান স্যার রুমে ঢুকলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-অপু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ।

-কি হয়েছে স্যার ।

-আজকে ওরা তোমাকে সম্ভবত আটকে দিবে । আমি পুলিশে খবর দিয়েছি কিন্তু কি কারনে যেন ওরা ঠিক গা করছে না । সম্ভবত এখানে আসার আগে পুলিশে বলে এসেছে । আমি প্রোক্টর স্যারকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু তিনি ফোন ধরছেন না ।

তারপর আমার সামনে বসে পড়লেন । কি করবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না । তারপর আবারও বলল

-এই জন্য আমি ঝামেলা এড়াতে বলেছিলাম । ওদের মত আমরা না তুমি জানো !

-কিন্তু তাই বলে অনৈতিক কাজ করবো !

-সব সময় নৈতিকতা ধরতে গেলে চলে ! বাস্তব কত কঠিন বুঝতে পারছো না । আমাদের সব সময় কম্পমাইজ করতেই হয় !

পুরো দুপুর আমি রুম থেকে বের হতে পারলাম না । বেশ কিছু ছাত্র/অছাত্র আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । এরই মাঝে একবার পুলিশ এল তবে এসে তারা আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল । এর জন্য অবশ্য ডিপার্টমেন্টের সামনে থেকে ওরা চলে গেল । তবে আমি খবর পেলাম যে ওরা ক্যাম্পাসের গেটের সামনে অপেক্ষা করছে । আমাকে দেখা মাত্রই হামলা করবে !

যখন বিকেল হয়ে গেল তখন আস্তে আস্তে ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে লাগলো । আমি বাইরে বের হতে পারলাম না । একটু ভয় সত্যিই করছিলো । একবার ভাবছি প্রধান গেট দিয়ে না বের হয়ে পেছনের দেওয়াল টপকে যাবো । কিন্তু সেখানেো কেউ থাকতে পারে । এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো ।

অপরিচিত নাম্বার !

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পরিচিত আওয়াজটা শুনতে ।

-আমাকে একবার ফোন করা যেত না ?

-না মানে !!

-না মানে কি ? আমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকি তোমার উপর কি ঝামেলা হচ্ছে সেটা কিভাবে জানবো ! একবার জানাবে না আমাকে ?

আমি চুপ করে রইলাম । আসলে নিকিতা ফোন করার কথা মনে এসেছিল কিন্তু কেন জানি করতে ইচ্ছে করে নি । মেয়েটির সাথে সেদিনের পরে আর দেখা হয় নি । মাঝে অবশ্য দুইবার কথা হয়েছিলো । ও বলেছিলো যে কটাদিন নাকি ও একটু বেশি ব্যস্ত থাকবে । একটু ফ্রি হলেই আমাকে ফোন দিবে । তাই আমি আর ওকে ফোন দেই নি ।

নিকিতা বলল

-তুমি এখনই বের হও অফিস থেকে ।

আমি ফোন রেখে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম । হাটতে লাগলাম প্রধান গেটের দিকে । সামনে কয়েকজন ছেলেকে দেখতে পেলাম । ওরা যে কামাল আফসারের লোক সেটা বুঝতেও কষ্ট হল না । দেখলাম কয়েকজন আমার সাথে সাথেই হাটতে লাগলো । কেউ কেউ আবার ফোন দিচ্ছে । সামনে মানুষকে প্রস্তুত থাকতে বলছে ।

আমি বুকে ঢিপঢিপ ভয় নিয়ে এগিয়ে চলছি । যখন গেট থেকে আর মিনিট খানেকের পথ তখনই পুলিশের গাড়িটা দেখতে পেলাম । একটা নয় পরপর তিনটা । একেবারে সামনে এসে থামলো আমার । তারপর সেই গাড়ি তিনটা থেকে হুরমুর করে পুলিশ নামতে শুরু করলো । আমাকে ঘিরে কম করে হলেও ৫০ জন পুলিশ দাড়িয়ে গেল । ওরা আমার দুই পাশে চলে এল । কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । কেবল ওরা আমাকে দুইপাশ থেকে গার্ড দিয়ে হাটতে লাগলো । আমাদের দলটা বের হয়ে এল গেটের কাছে । আমি কামাল আফসারকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে আছি খানিকটা অবাক চোখ । সম্ভবত বুঝতে পারছে না কিংবা হিসাব মেলাতে পারছে না । আমাকে কেন এতো পুলিশ গার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।

সিএনজিতে ওঠার আগ পর্যন্ত পুলিশ আমাকে ঘিরেই রাখলো । আমি যখন সিএনজিতে উঠলাম তখন একজন অফিসার গোছের পুলিশ আমার কাছে এসে বলল

-একটা গাড়ি আপনার সিএনজির পেছন পেছন যাবে আপবার বাড়ি পর্যন্ত !

আমি বললাম

-কোন দরকার নেই । আমার মনে হয় না ওরা পেছন পেছন আসবে !

-আমরা সরি স্যার । আমাদের আও আগে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল ।

কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । সিএনজি ওয়ালাকে সামনে চালাতে বললাম ।

নিকিতার ফোন এসে হাজির হল আবারও । বলল

-সব কিছু ওকে ?

-হ্যা । এমন একজন পাওয়ারফুল পরিচিত মানুষ থাকলে সব কিছু ওকে না হয়ে পারে !

নিকিতা হাসলো । তারপর বলল

-আমি এরপর থেকে খেয়াল রাখবো । তুমি বাসায় যাও ।

পরদিন যখন আবার ক্যাম্পাসে এলাম দেখলাম সব কিছু কেমন বদলে গেছে । কালকের ঘটনা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে । স্যারেরা আমাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করছে । আমার কোন ক্ষমতাবান পরিচিত আছে এটা জেনে গেছে তারা । আমাকে এখন একটু সমীহ করে চলতেই হবে তাদের ।

কিন্তু সব থেকে মজার ঘটনা ঘটলো যখন কামাল আফসার এসে হাজির হল । আমি ক্লাস নিয়ে বের হচ্ছি তখনই তাকে দেখতে পেলাম । সাথে অবশ্য আজকে কেউ নেই । সে একদম একা । আমি বের হতেই আমার সামনে এসে হাজির ! বলল

-স্যার আমি আসলে খুব লজ্জিত ।

আমি না বুঝার ভান করে বললাম

-লজ্জিত কেন ?

-কালকের আচরনের জন্য । আমি আসলে বুঝতে পারি নি ।

-তুমি কোনটা বুঝতে পারো নি ?

কামাল আফসার খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল । আমি বললাম

-এখানে দুইটা ব্যাপার আছে । তুমি কোনটা বুঝতে পারো নি ! তোমার ভাইকে অনৈতিক ভাবে নাম্বার দেওয়ার অনুরোধ পরে হুমকি দেওয়াটা ঠিক হয় নি এটা বুঝতে পারো নি নাকি আমার একজন ক্ষমতাবান পরিচিত মানুষ আছে বুঝতে পারো নি ?

কামাল আফসার আবারও চুপ করে রইলো । আমি বললাম

-যদি প্রথমটা হয়ে থাকে তাহলে ইউ আর ফরগিভেন কিন্তু দ্বিতীয় কারনে যদি তুমি লজ্জিত হও তাহলে সামনে থেকে চলে যাও । তোমার মুখ আমি দেখতে চাই না !

দেখতে পেলাম কামাল আফসারের মুখ লাল হয়ে গেছে । তার সাথে এই ভাবে কথা বলার সাহস হয়তো কারো নেই । কেউ হয়তো বলেও নি । আমার কাছ থেকে শুনে অমানিত বোধ করছে কিন্তু সে নিশ্চয়ই এতো সময়ে টের পেয়ে গেছে যে আমার পেছনে যে মানুষটা আছে সে তার থেকেও অনেক ক্ষমতাবান । আমাকে কিছু বলার সাহস তার নেই ।

আমি বললাম, তুমি আমাকে সেদিন হুমকি দিয়েছিলে যে আমি এখানে চাকরি করতে পারবো না । এখন আই গেস আমি এমন কিছু করতে পারি । সত্যিই পারি ! তুমি দেখতে চাও ?

তাররপই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিলাম । এই কাজটা করা মোটেও ঠিক হল না । ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান মানুষ গুলো তাদের ক্ষমতা মানুষকে দেখাতে পছন্দ করে অন্য দিকে প্রকৃত ক্ষমতাবানেরা কেবল প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেয় । আমি আর কিছু না বলে নিজের অফিসের দিকে হাটা দিলাম ।

গতকয়েক দিন আমি নিকিতার ব্যাপারে খানিকটা দ্বিধান্বিত ছিলাম । মেয়েটা কেন হঠাৎ করে আমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না । তবে আজকে কেন জানি সেসব আর কিছু মনে হচ্ছে না । বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে এবং আমার নিজের কাছে যথেষ্ঠ কারন আছে তাকে পছন্দ করার !

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 11

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

Comments are closed.