আমি খুব অবাক হয়ে আমার ছাত্রের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । আমার আসলে এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না এই ছেলে সত্যি সত্যিই তার বড় ভাইকে ডেকে নিয়ে এসেছে । বড় ভাই আবার যে কেউ না । বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র অঙ্গ সংগঠনের বড় নেতা । তার ভাই আমার ছাত্র । পুরো সেমিস্টার জুড়ে কোন পরীক্ষা দেয় নি । কোন ক্লাস করে নি । এখন এসেছে আমার কাছে ক্লাস এটেনডেন্স আর পারফরমেন্সের নাম্বার নিতে ।
কামাল আফসার হচ্ছে সেই বড় নেতা । আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, তাহলে আপনি নাম্বার দিবেন না ?
-না । আমি ওকে কেন নাম্বার দিবো ? দেখো তোমার ভাই কোন পরীক্ষা দেয় নি । আমি এটা ওর জন্য কনসিডার করতে পারি । কাল পরশু ওর জন্য আলাদা একটা পরীক্ষা নিতে পারি । সেই নাম্বার যোগ হবে । কিন্তু ও যে ক্লাসে উপস্থিত হয় নি সেখানে ওকে আমি কোন নাম্বার দিবো না । মোট ২৬টা ক্লাস নিয়েছি । তোমার ভাই একটাতেও উপস্থিত ছিল না ।
কামাল আফসার বলল, আপনি জানেন আমি কে ? আর আমার ভাই হিসাবে ওর নিজের অনেক কাজ থাকে । অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে ।
এবার আমি কামাল আফসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্টুডেন্টের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন কাজ হচ্ছে পড়াশুনা করা । তারপর অন্য কাজ ! আমার কাছ থেকে যদি নাম্বার পেতে হয় তাহলে ওকে এই কাজই করতে হবে । ফ্রিতে আমি ওকে কোন নাম্বার দিবো না ।
-কাজটা কিন্তু আপনি ভাল করছেন না !
-আমি ভাল করছি কি করছি না সেটা আমার উপরে ছেড়ে দাও । আমাকে আমার কাজ শেখাতে এসো না । এখন তোমরা আসতে পারো । আমার ক্লাস নেওয়ার সময় হয়েছে ।
আমি আর ওদের দিকে মনযোগ দিলাম না । একটু যে অস্বস্থি লাগছিলো না, সেটা বলবো না । শুনেছি অন্য সব স্যারেরা নাকি এই ছেলেকে ঠিকই নাম্বার দিয়ে দিয়েছে । কেবল আমি দিচ্ছি না । আমি অফিস রুম থেকে বের হতে যাবো তার আগে কামাল আফসার বলল
-আমি আপনাকে আরও দুইদিন সময় দিলাম ।
-তুমি আমাকে দুইদিন যেন ২০০ দিন সময় দিলেও আমার কথার নড়চড় হবে না । তা তুমি যাই কর না কেন ?
-আপনি কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকরি করতে পারবেন না ।
-না পারলে পারবো না । কোন সমস্যা নেই । তুমি এখন আসো !
আমার দিকে আরও কিছু সময় কঠিন চোখ তাকিয়ে রইলো কামাল আফসার । তারপর রুম থেকে বের হয়ে গেল ।
এই ঘটনা প্রায় মাস খানেক আগের । তারপর থেকে আমার উপর আরও কয়েকবার হুমকি ধামকি এসেছে । এমন কি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছে আমি যেন ঝামালে না করে নাম্বার টা দিয়ে দেই । কি দরকার এমন উটকো ঝামেলায় জড়ানো । আমি সেই কথা গুলো শুনেও না শোনার ভান করেছি । এমন কি একদিন ফিজিস ডিপার্টমেন্টের সেই রিদি ম্যাডামও আমাকে বলল, যেন আমি ঝামেলা এড়িয়ে চলি । কিন্তু ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারলাম না ।
তারপর গত সপ্তাহের ঘটনা ঘটলো । সত্যিই বলতে কি ওরা যখন আমাকে প্রথম তুলে নিয়ে গেল তখন আমার সবার আগে এই মনে হয়েছে যে হয়তো কামাল আফসারের লোকই আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে । তখন আমি খানিকটা ভয়ই পেয়েছিলাম ।
আজকে ক্লাস নিয়ে এসে অফিস রুমে বসে আছি তখনই হইচই শুনতে পেলাম । তার কিছু সময় পরেই পিয়ন ছুটে এল আমার রুমে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-স্যার আপনি আজকে চলে যান । পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান !
-কেন ?
-স্যার আজকে ঝামেলা হবে । কালাম মামার লোকজন আসতেছে । তাদের মাথা হট আছে ।
একটু পরে দেখলাম চেয়ারম্যান স্যার রুমে ঢুকলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-অপু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ।
-কি হয়েছে স্যার ।
-আজকে ওরা তোমাকে সম্ভবত আটকে দিবে । আমি পুলিশে খবর দিয়েছি কিন্তু কি কারনে যেন ওরা ঠিক গা করছে না । সম্ভবত এখানে আসার আগে পুলিশে বলে এসেছে । আমি প্রোক্টর স্যারকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু তিনি ফোন ধরছেন না ।
তারপর আমার সামনে বসে পড়লেন । কি করবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না । তারপর আবারও বলল
-এই জন্য আমি ঝামেলা এড়াতে বলেছিলাম । ওদের মত আমরা না তুমি জানো !
-কিন্তু তাই বলে অনৈতিক কাজ করবো !
-সব সময় নৈতিকতা ধরতে গেলে চলে ! বাস্তব কত কঠিন বুঝতে পারছো না । আমাদের সব সময় কম্পমাইজ করতেই হয় !
পুরো দুপুর আমি রুম থেকে বের হতে পারলাম না । বেশ কিছু ছাত্র/অছাত্র আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । এরই মাঝে একবার পুলিশ এল তবে এসে তারা আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল । এর জন্য অবশ্য ডিপার্টমেন্টের সামনে থেকে ওরা চলে গেল । তবে আমি খবর পেলাম যে ওরা ক্যাম্পাসের গেটের সামনে অপেক্ষা করছে । আমাকে দেখা মাত্রই হামলা করবে !
যখন বিকেল হয়ে গেল তখন আস্তে আস্তে ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে লাগলো । আমি বাইরে বের হতে পারলাম না । একটু ভয় সত্যিই করছিলো । একবার ভাবছি প্রধান গেট দিয়ে না বের হয়ে পেছনের দেওয়াল টপকে যাবো । কিন্তু সেখানেো কেউ থাকতে পারে । এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো ।
অপরিচিত নাম্বার !
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পরিচিত আওয়াজটা শুনতে ।
-আমাকে একবার ফোন করা যেত না ?
-না মানে !!
-না মানে কি ? আমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকি তোমার উপর কি ঝামেলা হচ্ছে সেটা কিভাবে জানবো ! একবার জানাবে না আমাকে ?
আমি চুপ করে রইলাম । আসলে নিকিতা ফোন করার কথা মনে এসেছিল কিন্তু কেন জানি করতে ইচ্ছে করে নি । মেয়েটির সাথে সেদিনের পরে আর দেখা হয় নি । মাঝে অবশ্য দুইবার কথা হয়েছিলো । ও বলেছিলো যে কটাদিন নাকি ও একটু বেশি ব্যস্ত থাকবে । একটু ফ্রি হলেই আমাকে ফোন দিবে । তাই আমি আর ওকে ফোন দেই নি ।
নিকিতা বলল
-তুমি এখনই বের হও অফিস থেকে ।
আমি ফোন রেখে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম । হাটতে লাগলাম প্রধান গেটের দিকে । সামনে কয়েকজন ছেলেকে দেখতে পেলাম । ওরা যে কামাল আফসারের লোক সেটা বুঝতেও কষ্ট হল না । দেখলাম কয়েকজন আমার সাথে সাথেই হাটতে লাগলো । কেউ কেউ আবার ফোন দিচ্ছে । সামনে মানুষকে প্রস্তুত থাকতে বলছে ।
আমি বুকে ঢিপঢিপ ভয় নিয়ে এগিয়ে চলছি । যখন গেট থেকে আর মিনিট খানেকের পথ তখনই পুলিশের গাড়িটা দেখতে পেলাম । একটা নয় পরপর তিনটা । একেবারে সামনে এসে থামলো আমার । তারপর সেই গাড়ি তিনটা থেকে হুরমুর করে পুলিশ নামতে শুরু করলো । আমাকে ঘিরে কম করে হলেও ৫০ জন পুলিশ দাড়িয়ে গেল । ওরা আমার দুই পাশে চলে এল । কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । কেবল ওরা আমাকে দুইপাশ থেকে গার্ড দিয়ে হাটতে লাগলো । আমাদের দলটা বের হয়ে এল গেটের কাছে । আমি কামাল আফসারকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে আছি খানিকটা অবাক চোখ । সম্ভবত বুঝতে পারছে না কিংবা হিসাব মেলাতে পারছে না । আমাকে কেন এতো পুলিশ গার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।
সিএনজিতে ওঠার আগ পর্যন্ত পুলিশ আমাকে ঘিরেই রাখলো । আমি যখন সিএনজিতে উঠলাম তখন একজন অফিসার গোছের পুলিশ আমার কাছে এসে বলল
-একটা গাড়ি আপনার সিএনজির পেছন পেছন যাবে আপবার বাড়ি পর্যন্ত !
আমি বললাম
-কোন দরকার নেই । আমার মনে হয় না ওরা পেছন পেছন আসবে !
-আমরা সরি স্যার । আমাদের আও আগে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল ।
কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । সিএনজি ওয়ালাকে সামনে চালাতে বললাম ।
নিকিতার ফোন এসে হাজির হল আবারও । বলল
-সব কিছু ওকে ?
-হ্যা । এমন একজন পাওয়ারফুল পরিচিত মানুষ থাকলে সব কিছু ওকে না হয়ে পারে !
নিকিতা হাসলো । তারপর বলল
-আমি এরপর থেকে খেয়াল রাখবো । তুমি বাসায় যাও ।
পরদিন যখন আবার ক্যাম্পাসে এলাম দেখলাম সব কিছু কেমন বদলে গেছে । কালকের ঘটনা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে । স্যারেরা আমাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করছে । আমার কোন ক্ষমতাবান পরিচিত আছে এটা জেনে গেছে তারা । আমাকে এখন একটু সমীহ করে চলতেই হবে তাদের ।
কিন্তু সব থেকে মজার ঘটনা ঘটলো যখন কামাল আফসার এসে হাজির হল । আমি ক্লাস নিয়ে বের হচ্ছি তখনই তাকে দেখতে পেলাম । সাথে অবশ্য আজকে কেউ নেই । সে একদম একা । আমি বের হতেই আমার সামনে এসে হাজির ! বলল
-স্যার আমি আসলে খুব লজ্জিত ।
আমি না বুঝার ভান করে বললাম
-লজ্জিত কেন ?
-কালকের আচরনের জন্য । আমি আসলে বুঝতে পারি নি ।
-তুমি কোনটা বুঝতে পারো নি ?
কামাল আফসার খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল । আমি বললাম
-এখানে দুইটা ব্যাপার আছে । তুমি কোনটা বুঝতে পারো নি ! তোমার ভাইকে অনৈতিক ভাবে নাম্বার দেওয়ার অনুরোধ পরে হুমকি দেওয়াটা ঠিক হয় নি এটা বুঝতে পারো নি নাকি আমার একজন ক্ষমতাবান পরিচিত মানুষ আছে বুঝতে পারো নি ?
কামাল আফসার আবারও চুপ করে রইলো । আমি বললাম
-যদি প্রথমটা হয়ে থাকে তাহলে ইউ আর ফরগিভেন কিন্তু দ্বিতীয় কারনে যদি তুমি লজ্জিত হও তাহলে সামনে থেকে চলে যাও । তোমার মুখ আমি দেখতে চাই না !
দেখতে পেলাম কামাল আফসারের মুখ লাল হয়ে গেছে । তার সাথে এই ভাবে কথা বলার সাহস হয়তো কারো নেই । কেউ হয়তো বলেও নি । আমার কাছ থেকে শুনে অমানিত বোধ করছে কিন্তু সে নিশ্চয়ই এতো সময়ে টের পেয়ে গেছে যে আমার পেছনে যে মানুষটা আছে সে তার থেকেও অনেক ক্ষমতাবান । আমাকে কিছু বলার সাহস তার নেই ।
আমি বললাম, তুমি আমাকে সেদিন হুমকি দিয়েছিলে যে আমি এখানে চাকরি করতে পারবো না । এখন আই গেস আমি এমন কিছু করতে পারি । সত্যিই পারি ! তুমি দেখতে চাও ?
তাররপই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিলাম । এই কাজটা করা মোটেও ঠিক হল না । ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান মানুষ গুলো তাদের ক্ষমতা মানুষকে দেখাতে পছন্দ করে অন্য দিকে প্রকৃত ক্ষমতাবানেরা কেবল প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেয় । আমি আর কিছু না বলে নিজের অফিসের দিকে হাটা দিলাম ।
গতকয়েক দিন আমি নিকিতার ব্যাপারে খানিকটা দ্বিধান্বিত ছিলাম । মেয়েটা কেন হঠাৎ করে আমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না । তবে আজকে কেন জানি সেসব আর কিছু মনে হচ্ছে না । বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে এবং আমার নিজের কাছে যথেষ্ঠ কারন আছে তাকে পছন্দ করার !
Comments are closed.