এই সব মিথ্যে গল্প (২.৭)

oputanvir
4.6
(74)

নাজিয়া খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে । আরিয়ানের চোখে পানি দেখে একটু অবাকই হল । নিজের ভেতরেই খানিকটা দ্বিধান্বিত বোধ করলো । ছেলেটার আচরণ এমন কেন মনে হচ্ছে । আজকে অনেকদিন পরে ছেলেটা ওর সামনে এসেছে । সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে কথা বলছে ।

নাজিয়া আবারও বলল, এমন কথা কেন বলছো?
আরিয়ান বলল, এটাই সত্য ।
-কী বলতে চাইছো । এটা সত্য মানে?
-মানে যে আমি তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি । মিথ্যা মিথ্যি না । সত্যি সত্যি ।

এই লাইনটা শুনে নাজিয়ার আনন্দিত হওয়ার কথা । কিন্তু আরিয়ান কথাটা এমন ভাবে বলল যে এটা মোটেই ভাল কোন কথা না কিংবা এটা হওয়া উচিৎ না ।
নাজিয়া বলল, কী বলছো তুমি?
আরিয়ান লম্বা একটা সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, তুমি জানো সাধারণ সবাই তোমার সাথে মিশতে পারে না । তাই না?
-হ্যা আমি জানি । আমার বাবার কারণে । আমি কখনই অন্য স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের মত বন্ধু বানাতে পারি নি । কাউকে ভালো বাসতে পারি নি।
-তারপরেও আমার উপরে তোমার একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে । আমি জানি ।
-কারণ তুমি আমাকে অন্য সবার মত ট্রিট করো নি । এমন ভাবে আচরণ কর নি যে আমি অস্বাভাবিক কেউ ।
-করি নি কারণ ….
-কারণ আমাকে এই কাজের জন্যই এসাইন করা হয়েছে ।

নাজিয়া প্রথম কিছু সময় যেন বুঝতে পারলো না আরিয়ান আসলে কী বলতে চাইছে । অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল । আরিয়ান বলল, আমাকে একজন হায়ার করেছে তোমার কাছাকাছি আসার জন্য । এই যে দেখছো আর্ট শেখার ক্লাস এখানেও ভর্তি করা হয়েছে । আমার ক্ষমতা ছিল না এখানে ভর্তি হওয়ার । কিন্তু আমি একটা সময়ে কেবল বুঝতে পারলাম যে তোমার ব্যাপারে আমার তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে । আমি কিছুতেই এটাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না ।

নাজিয়া কেবল অবাক আর ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে । এতো দিন পরে একজন মানুষকে মনে ধরেছিলো ।

আরিয়ান বলল, আমি আজকের পরে আর কখনই এখানে আসবো । আমাদের আর কখনই দেখা হবে না । আমাকে ভালোবেসো না । তোমাকে সত্যটা না বলেই চলে যেতে পারতাম কিন্তু তখন তুমি সারাজীবন আমাকে ভালোবাসতে । কষ্ট পেতে । কিন্তু সেটা আমি চাই না মোটেও । আমি চাই তুমি আমাকে ঘৃণাই কর ।

নাজিয়া আর কিছু বলতে পারলো না । ওর চোখ দিয়ে কেবল পানি বের হয়ে এল । নাজিয়া কেবল তাকিয়ে দেখলো আরিয়ানের চলে যাওয়া দেখলো । কোন কথাই বলতে পারলো না কেবল ।

দুই
আজিজুর চৌধুরী কফির কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে । অফিসের ফাইলের দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । অন্য কোন দিকে তাকানোর যেন তার ফরসতই নেই তার । মেয়েটা এই ক’বছরে যেন একেবারে বদলে গেছে । ইউনিভার্সিটির সেই চঞ্চল মেয়েটা আর নেই সে । ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষ থাকতেই আজিজুর রহমান হঠাৎ করে খেয়াল করলেন যে তার মেয়েটা একেবারে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে । তিনি অনেক ভাবে নিজের মেয়েকে উৎফুল্ল করে তোলার চেষ্টা করলেন বটে তবে কোন কাজ হয় নি । মেয়েটা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে । মেয়েটার আগে আর্টের প্রতি একটা তীব্র আগ্রহ ছিল । সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে ।

বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পরে সরাসরি অফিস এসে যুক্ত হয়েছে । এখন বলতে গেলে তার নিজের সব কাজ নাজিয়া নিজেই করে । এই কম বয়সেই মেয়েটা কত গম্ভীর হয়ে গেছে । তিনি কত চিন্তা করেছেন । তবে একটা ব্যাপারে কখনই তার মাথায় আসে নি । এই মাত্র বছর খানেক আগে তিনি আসল ব্যাপারটা জানতে পেরেছেন ।

ব্যবসায়ী প্রতিপক্ষ একজন তার মেয়ের পেছনে একজনকে লাগিয়েছিলো কয়েক বছর আগে । ছেলেটার কাজ ছিল নাজিয়াকে তার প্রেমে ফেলা। ছেলেটা সেটা সক্ষমও হয়েছিলো তবে সমস্যা ছিল যে সেই নিজেও নাজিয়ার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো । তারপর সে নিজেই নাজিয়ার কাছ থেকে দুরে সরে চলে যায় । সেই ছেলেকে এতো দিন অনেক খুজেছে । মাত্র মাস খানেক আগে তার খোজ পেয়েছে । একটা ভয় ছিল যে ছেলেটা বুঝি এই কয় বছরে বিয়ে করে সংসারি হয়ে যাবে । তবে সেও বিয়ে করে নি । বিক্রমপুরের একটা গ্রামে একটা ছেলেটা থাকে । সেখানকার স্কুলে শিক্ষক হিসাবে কাজ করে । পড়ানো বাদ দিয়ে একেবারে একাকী জীবন যাপন করে সে ।

আজিজুর চৌধুরীর আসলে বুঝতে কষ্ট হয় নি যে ছেলেটাও কেন এমন ভাবে তার জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে । সব ভেবে তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । সেই মোতাবেকই কাজ করা হচ্ছে ।

তিন
-বাবা আমরা এখানে কেন এসেছি ? আমাদের কালকে রকটেল কোম্পানির সাথে একটা ডিল আছে মনে নেই ? সেটার কাজ এখনও বাকি রয়েছে ।
-আরে রাখ তো তোর কাজ ! এতো কাজ করে হবে টা কি শুনি !
-কী বলছো এসব !
-আরে বাবা তুই হচ্ছিস একমাত্র মেয়ে । আমার যা আছে বসে বসে খােলেও চৌদ্দপুরুষ ধরে শেষ হবে না । তুই তো আবার বিয়েও করবি না । কার জন্য এতো টাকা পয়সা আয় ! একটু বাবা মেয়ে সময় কাটাই ।
-তাহলে মাকেও আনতে !
-তুই জানি না তোর মা এই সব গ্রামে আসতে চায় না । তাকে নিয়ে যেতে হবে সিঙ্গাপুর । আর কত যাবো ওখানে বলতো ! এখানে একটা বাগান বাড়ি বানাবো ভাবছি । সেই জায়গা দেখতে এসেছি । নদীর ধারে !

নাজিয়া কিছু বলল না । গাড়িটা এসে থামলো সত্যি সত্যি একটা নদীর ধারেই । নাজিয়া গাড়ির ভেতরে বসে নিজের মোবাইলে একটা ফাইল দেখছিলো তখন গাড়িটা এসে থামলো একটা বাড়ির উঠোনে । বাড়িটার ঠিক পেছনেই নদী গেছে । টিনের বাড়ি । সেখানে কিছু ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করছে । গাড়িটা উঠোনে থামতেই একজন বের হয়ে ঘর থেকে । নাজিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়েই নামলো গাড়ি থেকে ।
মোবাইলটা পকেটে রেখে যখন সামনের দিকে তাকালো তখনই তাকে দেখতে পেল ।

আরিয়ান ওর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । ওকে এখানে দেখে সে অবাক হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
নাজিয়া কেবল অনুভব করলো যে এতো গুলো বছর পরে ওর বুকের স্পন্দন বড় তীব্র ভাবে লাফাতে শুরু করেছে ।

কত সময় একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলো সেটা কারো মনে নেই । নাজিয়ার বাবা বলল, তুই এখানে কিছু সময় থাক । আমি জমি বাগানাবাড়ির জমিটা দেখে আসি !

নাজিয়া কোন কথাই কান দিয়ে ঢুকলো না । সে তখনও কেবল এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে আরিয়ানের দিকে । ওর কেবল মনে হল যে বিগত বছরগুলো যে মুখটা সে বারবার দেখতে চেয়েছে, শত চেষ্টা করেও যাকে ঘৃণা করতে চেয়েও পারে নি, সেই মানুষটা আজকে ওর সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । একই ভাবে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে । সেই আগে দৃষ্টিতে । নাজিয়ার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে ওর মতই অন্য দিকের মানুষটাও একই ভাবে তৃষ্ণিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । একই তৃষ্ণা যে সামনের মানুষটাও ওর জন্য অনুভব করে আছে সেটা নাজিয়ার বুঝতে কষ্ট হল না ।

বাচ্চারা হই হই করে বের হয়ে গেল সময়ের আগে ছুটি পেয়ে । পুরো বাসাটা একেবারে নির্জন হয়ে গেল মুহুর্তেই । নাজিয়া বলল, কত দিন ধরে আছো এখনে?
-সেই সময় থেকেই।
-এখানেই?
-হ্যা ।
-কেন?
-জানি না । আমার কেন জনাি মনের ভেতরে একটা স্বপ্ন ছিল যে একদিন তুমি খুজতে খুজতে আমার এখানে এসে হাজির হবে ।
-একই স্বপ্ন আমিও দেখটাম যে তুমি একদিন না একদিন আমার কাছে ফিরে আসবে । তুমি তো আমার বাসার ঠিকানা জানতে । জানতে না ?

আরিয়ান কোন কথা বলল না । কেবল তাকিয়ে রইলো । আজকে এভাবে যে নাজিয়া চলে আসবে সেটা সেটা ভাবে নি সে । তবে স্বপ্নটা সে প্রতিদিন দেখতো । প্রতিদিন ভাবতো এমন একটা দিন আসবে যখন নাজিয়া সত্যিই চলে আসবে তার কাছে । তার ভালোবাসাটা যেভাবেই শুরু হোক না কেন, নাজিয়ার প্রতি ওর অনুভূতি তো মিথ্যা ছিল না কখনই ।

বাস্তবের গল্প আসলে কখনই এমন হয় না । বাস্তবে আরিয়ান কখনই নাজিয়ার কাছে কিংবা নাজিয়া কখন আরিয়ানের কাছে ফিরে আসে না । এমন কি যদি তারা চায় তবুও তারা আসতে পারে না । এই পৃথিবী তাদেরকে আসতে দেয় না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 74

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →