নাজিয়া খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে । আরিয়ানের চোখে পানি দেখে একটু অবাকই হল । নিজের ভেতরেই খানিকটা দ্বিধান্বিত বোধ করলো । ছেলেটার আচরণ এমন কেন মনে হচ্ছে । আজকে অনেকদিন পরে ছেলেটা ওর সামনে এসেছে । সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে কথা বলছে ।
নাজিয়া আবারও বলল, এমন কথা কেন বলছো?
আরিয়ান বলল, এটাই সত্য ।
-কী বলতে চাইছো । এটা সত্য মানে?
-মানে যে আমি তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি । মিথ্যা মিথ্যি না । সত্যি সত্যি ।
এই লাইনটা শুনে নাজিয়ার আনন্দিত হওয়ার কথা । কিন্তু আরিয়ান কথাটা এমন ভাবে বলল যে এটা মোটেই ভাল কোন কথা না কিংবা এটা হওয়া উচিৎ না ।
নাজিয়া বলল, কী বলছো তুমি?
আরিয়ান লম্বা একটা সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, তুমি জানো সাধারণ সবাই তোমার সাথে মিশতে পারে না । তাই না?
-হ্যা আমি জানি । আমার বাবার কারণে । আমি কখনই অন্য স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের মত বন্ধু বানাতে পারি নি । কাউকে ভালো বাসতে পারি নি।
-তারপরেও আমার উপরে তোমার একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে । আমি জানি ।
-কারণ তুমি আমাকে অন্য সবার মত ট্রিট করো নি । এমন ভাবে আচরণ কর নি যে আমি অস্বাভাবিক কেউ ।
-করি নি কারণ ….
-কারণ আমাকে এই কাজের জন্যই এসাইন করা হয়েছে ।
নাজিয়া প্রথম কিছু সময় যেন বুঝতে পারলো না আরিয়ান আসলে কী বলতে চাইছে । অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল । আরিয়ান বলল, আমাকে একজন হায়ার করেছে তোমার কাছাকাছি আসার জন্য । এই যে দেখছো আর্ট শেখার ক্লাস এখানেও ভর্তি করা হয়েছে । আমার ক্ষমতা ছিল না এখানে ভর্তি হওয়ার । কিন্তু আমি একটা সময়ে কেবল বুঝতে পারলাম যে তোমার ব্যাপারে আমার তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে । আমি কিছুতেই এটাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না ।
নাজিয়া কেবল অবাক আর ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে । এতো দিন পরে একজন মানুষকে মনে ধরেছিলো ।
আরিয়ান বলল, আমি আজকের পরে আর কখনই এখানে আসবো । আমাদের আর কখনই দেখা হবে না । আমাকে ভালোবেসো না । তোমাকে সত্যটা না বলেই চলে যেতে পারতাম কিন্তু তখন তুমি সারাজীবন আমাকে ভালোবাসতে । কষ্ট পেতে । কিন্তু সেটা আমি চাই না মোটেও । আমি চাই তুমি আমাকে ঘৃণাই কর ।
নাজিয়া আর কিছু বলতে পারলো না । ওর চোখ দিয়ে কেবল পানি বের হয়ে এল । নাজিয়া কেবল তাকিয়ে দেখলো আরিয়ানের চলে যাওয়া দেখলো । কোন কথাই বলতে পারলো না কেবল ।
দুই
আজিজুর চৌধুরী কফির কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে । অফিসের ফাইলের দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । অন্য কোন দিকে তাকানোর যেন তার ফরসতই নেই তার । মেয়েটা এই ক’বছরে যেন একেবারে বদলে গেছে । ইউনিভার্সিটির সেই চঞ্চল মেয়েটা আর নেই সে । ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষ থাকতেই আজিজুর রহমান হঠাৎ করে খেয়াল করলেন যে তার মেয়েটা একেবারে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে । তিনি অনেক ভাবে নিজের মেয়েকে উৎফুল্ল করে তোলার চেষ্টা করলেন বটে তবে কোন কাজ হয় নি । মেয়েটা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে । মেয়েটার আগে আর্টের প্রতি একটা তীব্র আগ্রহ ছিল । সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে ।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পরে সরাসরি অফিস এসে যুক্ত হয়েছে । এখন বলতে গেলে তার নিজের সব কাজ নাজিয়া নিজেই করে । এই কম বয়সেই মেয়েটা কত গম্ভীর হয়ে গেছে । তিনি কত চিন্তা করেছেন । তবে একটা ব্যাপারে কখনই তার মাথায় আসে নি । এই মাত্র বছর খানেক আগে তিনি আসল ব্যাপারটা জানতে পেরেছেন ।
ব্যবসায়ী প্রতিপক্ষ একজন তার মেয়ের পেছনে একজনকে লাগিয়েছিলো কয়েক বছর আগে । ছেলেটার কাজ ছিল নাজিয়াকে তার প্রেমে ফেলা। ছেলেটা সেটা সক্ষমও হয়েছিলো তবে সমস্যা ছিল যে সেই নিজেও নাজিয়ার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো । তারপর সে নিজেই নাজিয়ার কাছ থেকে দুরে সরে চলে যায় । সেই ছেলেকে এতো দিন অনেক খুজেছে । মাত্র মাস খানেক আগে তার খোজ পেয়েছে । একটা ভয় ছিল যে ছেলেটা বুঝি এই কয় বছরে বিয়ে করে সংসারি হয়ে যাবে । তবে সেও বিয়ে করে নি । বিক্রমপুরের একটা গ্রামে একটা ছেলেটা থাকে । সেখানকার স্কুলে শিক্ষক হিসাবে কাজ করে । পড়ানো বাদ দিয়ে একেবারে একাকী জীবন যাপন করে সে ।
আজিজুর চৌধুরীর আসলে বুঝতে কষ্ট হয় নি যে ছেলেটাও কেন এমন ভাবে তার জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে । সব ভেবে তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । সেই মোতাবেকই কাজ করা হচ্ছে ।
তিন
-বাবা আমরা এখানে কেন এসেছি ? আমাদের কালকে রকটেল কোম্পানির সাথে একটা ডিল আছে মনে নেই ? সেটার কাজ এখনও বাকি রয়েছে ।
-আরে রাখ তো তোর কাজ ! এতো কাজ করে হবে টা কি শুনি !
-কী বলছো এসব !
-আরে বাবা তুই হচ্ছিস একমাত্র মেয়ে । আমার যা আছে বসে বসে খােলেও চৌদ্দপুরুষ ধরে শেষ হবে না । তুই তো আবার বিয়েও করবি না । কার জন্য এতো টাকা পয়সা আয় ! একটু বাবা মেয়ে সময় কাটাই ।
-তাহলে মাকেও আনতে !
-তুই জানি না তোর মা এই সব গ্রামে আসতে চায় না । তাকে নিয়ে যেতে হবে সিঙ্গাপুর । আর কত যাবো ওখানে বলতো ! এখানে একটা বাগান বাড়ি বানাবো ভাবছি । সেই জায়গা দেখতে এসেছি । নদীর ধারে !
নাজিয়া কিছু বলল না । গাড়িটা এসে থামলো সত্যি সত্যি একটা নদীর ধারেই । নাজিয়া গাড়ির ভেতরে বসে নিজের মোবাইলে একটা ফাইল দেখছিলো তখন গাড়িটা এসে থামলো একটা বাড়ির উঠোনে । বাড়িটার ঠিক পেছনেই নদী গেছে । টিনের বাড়ি । সেখানে কিছু ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করছে । গাড়িটা উঠোনে থামতেই একজন বের হয়ে ঘর থেকে । নাজিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়েই নামলো গাড়ি থেকে ।
মোবাইলটা পকেটে রেখে যখন সামনের দিকে তাকালো তখনই তাকে দেখতে পেল ।
আরিয়ান ওর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । ওকে এখানে দেখে সে অবাক হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
নাজিয়া কেবল অনুভব করলো যে এতো গুলো বছর পরে ওর বুকের স্পন্দন বড় তীব্র ভাবে লাফাতে শুরু করেছে ।
কত সময় একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলো সেটা কারো মনে নেই । নাজিয়ার বাবা বলল, তুই এখানে কিছু সময় থাক । আমি জমি বাগানাবাড়ির জমিটা দেখে আসি !
নাজিয়া কোন কথাই কান দিয়ে ঢুকলো না । সে তখনও কেবল এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে আরিয়ানের দিকে । ওর কেবল মনে হল যে বিগত বছরগুলো যে মুখটা সে বারবার দেখতে চেয়েছে, শত চেষ্টা করেও যাকে ঘৃণা করতে চেয়েও পারে নি, সেই মানুষটা আজকে ওর সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । একই ভাবে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে । সেই আগে দৃষ্টিতে । নাজিয়ার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে ওর মতই অন্য দিকের মানুষটাও একই ভাবে তৃষ্ণিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । একই তৃষ্ণা যে সামনের মানুষটাও ওর জন্য অনুভব করে আছে সেটা নাজিয়ার বুঝতে কষ্ট হল না ।
বাচ্চারা হই হই করে বের হয়ে গেল সময়ের আগে ছুটি পেয়ে । পুরো বাসাটা একেবারে নির্জন হয়ে গেল মুহুর্তেই । নাজিয়া বলল, কত দিন ধরে আছো এখনে?
-সেই সময় থেকেই।
-এখানেই?
-হ্যা ।
-কেন?
-জানি না । আমার কেন জনাি মনের ভেতরে একটা স্বপ্ন ছিল যে একদিন তুমি খুজতে খুজতে আমার এখানে এসে হাজির হবে ।
-একই স্বপ্ন আমিও দেখটাম যে তুমি একদিন না একদিন আমার কাছে ফিরে আসবে । তুমি তো আমার বাসার ঠিকানা জানতে । জানতে না ?
আরিয়ান কোন কথা বলল না । কেবল তাকিয়ে রইলো । আজকে এভাবে যে নাজিয়া চলে আসবে সেটা সেটা ভাবে নি সে । তবে স্বপ্নটা সে প্রতিদিন দেখতো । প্রতিদিন ভাবতো এমন একটা দিন আসবে যখন নাজিয়া সত্যিই চলে আসবে তার কাছে । তার ভালোবাসাটা যেভাবেই শুরু হোক না কেন, নাজিয়ার প্রতি ওর অনুভূতি তো মিথ্যা ছিল না কখনই ।
বাস্তবের গল্প আসলে কখনই এমন হয় না । বাস্তবে আরিয়ান কখনই নাজিয়ার কাছে কিংবা নাজিয়া কখন আরিয়ানের কাছে ফিরে আসে না । এমন কি যদি তারা চায় তবুও তারা আসতে পারে না । এই পৃথিবী তাদেরকে আসতে দেয় না ।