সেহরি টেলসঃ ছায়া

oputanvir
4.2
(43)

আমরা ঢাকাতে যে ফ্ল্যাটে থাকতাম তার উপরের ফ্ল্যাটে আজগর নামের একজন বয়স্ক লোক থাকতো । ঢাকাতে যদিও কে কোন ফ্ল্যাটে থাকে এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা থাকার কথা না । তবে আজগর মিয়াকে আমাদের এপার্টমেন্টের সবাই চিনতাম তার কারণ হচ্ছে তিনি অন্যের ব্যাপারে খুব নাক গলাতো । কার ছেলে কার মেয়ের সাথে মিশছে কার ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব নিয়ে খুব কথা বলতেন । প্রথম প্রথম আমাদের বাবা মায়েরা ব্যাপারটা নিয়ে কিছুই বলেন নি । তাদের মনে হয়েছিলো যে বৃদ্ধ একজন মানুষ হয়তো সবার প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থেকে কাজটা করছে কিন্তু এক সময়ে সবাই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো !

আমাকে এই আজগর মিয়া রাইনার সাথে দেখেছিলো কয়েকবার । রাইয়ানার বাড়ি আমাদের এলাকা থেকে ছাড়িয়ে আরও একটু দুরে তাই প্রায়ই দিনই আমি ওর সাথে আসতাম । এটা আজগর মিয়া দেখতো নিজের বারান্দায় দাড়িয়ে । বেটার একটা দুর্বিনও ছিল যেটা দিয়ে আরও কত দিকে তার নজর ছিল তার খোজ নেই ।

যথারীতি সন্ধ্যা বেলা আমার বাসায় নালিশ চলে এল । আমি তখন সবে কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরেছি । দরজা খুলে দেখি আজগর মিয়া বসে বাবার সাথে কথা বলছেন । আমাকে ঢুকটে দেখে বাবা কিছু বললেন না তবে আজগর মিয়া বললেন, এই বয়সে মেয়েদের সাথে মোটেও ঠিক না । বুঝেছো? তুমি ঐ মেয়েটার সাথে কী কর শুনি?

মেজাজটা এমন গরম হল । বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমাকে কিছু বলতে মানা করছে । তবে সে নিজেও খানিকটা বিরক্ত । তবে মা এসবের ধার দিয়ে গেলেন না । সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সোজা আজগর মিয়ার দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, দেখুন চাচা আমার ছেলে কার সাথে মিশবে সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না । আপনি দয়া করে এসব নিয়ে আমাদের বাসায় আর আসবেন না । এসব আমরা শুনতে চাই না ।

মায়ের কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে আজগর মিয়া আর কোন কথাই বলতে পারলো না । সম্ভবত কোন ছেলে মেয়ের মা এমন করে বলতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল । তার জানমায় এমন নালিশ নিয়ে গেলেও বাবা মায়েরা তার সন্তানকে কঠিন শাসন করতো । তবে সময় এখন বদলেছে ।

এক সময়ে এমন হল প্রতিটি বাড়ি থেকেই আজগর মিয়া বিড়ারিত হতে শুরু করলেন । কেউ কেউ প্রবল অপমানও করতে শুরু করলো তাকে । সবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তার । তবে তার নজরদারী কিন্তু বন্ধ হল না ।
কিন্তু সেটা চলল না খুব বেশি দিন। তার বাসায় কাজের একটা লোক ছিল । সে সকালে এসে রান্না বান্না করে দিয়ে যেত । একদিন সকালে হইচই শুনে আমরা বের হয়ে দেখি আজগর মিয়ার কাজের লোকটি কেমন চিৎকার চেঁচামিচি করছে । আবার বাবাও ছিল সেখানে । কী হয়ে বলতেই জানালো যে কালকেও সে এসেছিলো । তবে অনেকবার ডাকা ডাকির পরেও দরজা না খোলার কারণে চলে গেছে । আজকেও একই কাহিনী । তার মনে হচ্ছে ভেতরে হয়তো কোন ঝামেলা হয়েছে ।

এপার্টমেন্টের সবাই মিলে পুলিশে খরব দিল । পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকলো তখন দেখলো আগজর মিয়া নিজের বিছানায় চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন । যদিও মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছেন তবে আমার বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না যে তিনি মারা গেছেন । পুলিশ পরীক্ষা করে দেখে বলল ঘুমের ভেতরেই সম্ভবত মৃত্যু হয়েছে । বার্ধক্যজনিত মৃত্যু ।

সত্যি বলতে কি তার মৃত্যুতে কেউ ঠিক শোক প্রকাশ করলো না । তবুও সবাই একটা মুখ ভার করা ভাব নিয়ে থাকলো ।

তবে দুদিনের ভেতরেই সব কিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল । সবার মাঝেই একটা স্বস্তির ভাব ছিল । বিশেষ করে আমাদের বয়সী সবার মনে একটা নিশ্চিন্ত ভাব ছিল যে আজগর মিয়া আর আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না । আমাদের দিকে শকুনের চোখের দৃষ্টি ফেলবে না । যতই আমাদের বাবা মায়েরা তার কথা না শুনুক সব সময় একজোড়া চোখ আমাদের উপর নজর রাখছে সেটা মোটেও আমার জন্য ভাল অনুভূতি ছিল না ।
এরপরই আমি আর নীতু খানিকটা সাহসী হয়ে উঠলাম । নীতুর সাথে আমার প্রেমটা শুরু হয়েছিলো আরও বছর খানেক আগেই তবে ঐ আজগর মিয়ার জন্য আমরা মোটেই আমাদের এপার্টমেন্টে কোন দেখা সাক্ষাত করতাম না । দেখা হলে এমন একটা ভাব করতাম যেন আমরা চিনিই না একে অন্য কে । পাছে বেটা আমাদের দেখে ফেলে । তবে সেই ভয় কেটে যাওয়ার পরেই আমরা আমাদের বিল্ডিংয়েই দেখা সাক্ষাত শুরু করলাম । বিশেষ করে ছাদে । রাতের বেলা প্রায়ই আমরা দুজন হাজির হতাম ছাদে । গল্প করতাম আপন মনে । তেমনই এক রাতে গল্প করছি নীতুর সাথে । একটা সময়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যাবো তখনই মনে হল যেন একটা ছায়া আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল । কেবল আমিই না নীতুও যে ছায়াটাকে দেখেছে সেটা ওর আচরণেই বুঝতে পারলাম । আমাকে খানিকটা জড়িয়ে ধরলো ভয়ে ।
আমি চুপিস্বরে বললাম, তুমি দেখেছো?
-হুম । দেখেছি !
-চল এখান থেকে ।

আর কিছু না বলে নীতুর হাত ধরে দ্রুত সিড়ির দিকে দৌড় দিলাম । এবং এরপরে এই ছায়াকে আমরা আবারও দেখা শুরু করলাম । কেবল যে আমরা সেটাও না আমাদের বিল্ডিংয়ের আরও কয়েকজন দেখা শুরু করলো । হঠাৎ কেউ কেউ অনুভব করতে পারে কে যেন তাদের কাছ দিয়ে চলে গেল । যখন তার ফিরে তাকাচ্ছে তখনই কেবল একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছে । তবে সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে কয়েক মুহুর্ত পরেই ।

তারপরেই আমি ছায়াটাকে আরো স্পষ্ট দেখতে পেলাম । কী হয় কোন ভয় জিনিস যদি আমরা বারবার দেখি তাহলে আমাদের মাঝে ভয়টা কেটে যায়, এখানেও তাই হয়েছে । আমি আর নীতু সিড়ি ঘরে বসে গল্প করছিলাম । সবাই লিফট দিয়ে চলাচল করে । সিড়ি দিয়ে খুব একটা কেউ আসে না । এই দুপুর বেলাও কেউ আসবে না । এই জন্য গল্প করছিলাম । তখনই দেখতে পেলাম ছায়াটাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে ।

নীতু আমার হাত চেপে ধরেছে শক্ত করে । এখনই হয়তো চিৎকার দিবে । আমি তখন একভাবে তাকিয়ে রয়েছি ছায়ার দিকে । তখনই আমার বড় একটা পরিচিত ব্যাপার খেয়াল হল । ছায়াটা যেভাবে হাটছে সেটা বড় পরিচিত মনে হল !

আজগর মিয়া ঠিক এভাবেি হাটতো !
ছায়াটা মিলিয়ে গেল তখনই । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কেবল । বেটা দেখি মরেও আমাদের শান্তি দিচ্ছে না । নীতুকে বললাম আজকে রাতে আবার আমরা ছাদে দেখা করবো !
নীতু ভয়ে ভয়ে রাজি হল ।

যথা সময়ে ছাদের হাজির হল ও । আমরা কিছ সময়ে গল্প করলাম । তারপর সেদিনের মত আবারও ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেলাম । তখনই দেখতে পেলাম সেই ছায়াকে । নীতু একটু শক্ত হয়ে গেলেও আমি ওকে বললাম একদম ভয় না পেতে । কিছু হবে না । ছায়াটাকে আমরা যেন দেখি নি এমন ভাব করে একে অন্যকে চুমু খেলাম । তারপর আরও কয়েকবার । যখন চুমু খাওয়া শেষ হল চেয়ে ডেখি কোন ছায়া নেই ।

এরপর প্রতি রাতেই আমরা গিয়ে হাজির হতাম ছাদে । একই ভাবে চুমু খেতাম আর এমন যেন ভাব করতাম কাউকে দেখি নি । কয়েক রাতের পরে আবিস্কার করলাম যে ছায়াটাকে আমরা আর দেখতে পাচ্ছি না । আমাদের সামনে আসছে না বেটা ।

বিল্ডিংয়ের সবাইকে একই কথা বলে দিলাম । বললাম যে একেবারে ভয় না পেতে। যা করছিলে তাই করে যেতে । পাত্তা না দিলে কিছুই করতে পারবে না ।

এতে আসলেই কাজ হল । আগে যখন প্রতিদিন ছায়াটাকে দেখা যেত আস্তে আস্তে সেটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল । আসলে বেঁচে থাকতে যখন আমাদের বাবা মায়েরা তাকে পাত্তা দিতো তখন ঘন ঘন নালিশ নিয়ে সে হাজির হত । তারপর যখন মা বাবারা বিরক্ত হয়ে সেটা শোনা বন্ধ করে দিল তিনিও আর যেতে পারলেন না । মরার পরে সেই স্বভাবটা যায় নি । যখনই আমরা পাত্তা দিয়েছে তখনই তিনি নাক গলিয়েছেন । যখন পাত্তা দেওয়া বন্ধ করেছি তখনওই তার ছায়া আর আমাদের সামেন আসে নি । একটা সময়ে সেই ছায়াটাকে দেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.2 / 5. Vote count: 43

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →