সেহরি টেলসঃ ছায়া

oputanvir
4.2
(42)

আমরা ঢাকাতে যে ফ্ল্যাটে থাকতাম তার উপরের ফ্ল্যাটে আজগর নামের একজন বয়স্ক লোক থাকতো । ঢাকাতে যদিও কে কোন ফ্ল্যাটে থাকে এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা থাকার কথা না । তবে আজগর মিয়াকে আমাদের এপার্টমেন্টের সবাই চিনতাম তার কারণ হচ্ছে তিনি অন্যের ব্যাপারে খুব নাক গলাতো । কার ছেলে কার মেয়ের সাথে মিশছে কার ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব নিয়ে খুব কথা বলতেন । প্রথম প্রথম আমাদের বাবা মায়েরা ব্যাপারটা নিয়ে কিছুই বলেন নি । তাদের মনে হয়েছিলো যে বৃদ্ধ একজন মানুষ হয়তো সবার প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থেকে কাজটা করছে কিন্তু এক সময়ে সবাই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো !

আমাকে এই আজগর মিয়া রাইনার সাথে দেখেছিলো কয়েকবার । রাইয়ানার বাড়ি আমাদের এলাকা থেকে ছাড়িয়ে আরও একটু দুরে তাই প্রায়ই দিনই আমি ওর সাথে আসতাম । এটা আজগর মিয়া দেখতো নিজের বারান্দায় দাড়িয়ে । বেটার একটা দুর্বিনও ছিল যেটা দিয়ে আরও কত দিকে তার নজর ছিল তার খোজ নেই ।

যথারীতি সন্ধ্যা বেলা আমার বাসায় নালিশ চলে এল । আমি তখন সবে কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরেছি । দরজা খুলে দেখি আজগর মিয়া বসে বাবার সাথে কথা বলছেন । আমাকে ঢুকটে দেখে বাবা কিছু বললেন না তবে আজগর মিয়া বললেন, এই বয়সে মেয়েদের সাথে মোটেও ঠিক না । বুঝেছো? তুমি ঐ মেয়েটার সাথে কী কর শুনি?

মেজাজটা এমন গরম হল । বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমাকে কিছু বলতে মানা করছে । তবে সে নিজেও খানিকটা বিরক্ত । তবে মা এসবের ধার দিয়ে গেলেন না । সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সোজা আজগর মিয়ার দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, দেখুন চাচা আমার ছেলে কার সাথে মিশবে সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না । আপনি দয়া করে এসব নিয়ে আমাদের বাসায় আর আসবেন না । এসব আমরা শুনতে চাই না ।

মায়ের কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে আজগর মিয়া আর কোন কথাই বলতে পারলো না । সম্ভবত কোন ছেলে মেয়ের মা এমন করে বলতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল । তার জানমায় এমন নালিশ নিয়ে গেলেও বাবা মায়েরা তার সন্তানকে কঠিন শাসন করতো । তবে সময় এখন বদলেছে ।

এক সময়ে এমন হল প্রতিটি বাড়ি থেকেই আজগর মিয়া বিড়ারিত হতে শুরু করলেন । কেউ কেউ প্রবল অপমানও করতে শুরু করলো তাকে । সবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তার । তবে তার নজরদারী কিন্তু বন্ধ হল না ।
কিন্তু সেটা চলল না খুব বেশি দিন। তার বাসায় কাজের একটা লোক ছিল । সে সকালে এসে রান্না বান্না করে দিয়ে যেত । একদিন সকালে হইচই শুনে আমরা বের হয়ে দেখি আজগর মিয়ার কাজের লোকটি কেমন চিৎকার চেঁচামিচি করছে । আবার বাবাও ছিল সেখানে । কী হয়ে বলতেই জানালো যে কালকেও সে এসেছিলো । তবে অনেকবার ডাকা ডাকির পরেও দরজা না খোলার কারণে চলে গেছে । আজকেও একই কাহিনী । তার মনে হচ্ছে ভেতরে হয়তো কোন ঝামেলা হয়েছে ।

এপার্টমেন্টের সবাই মিলে পুলিশে খরব দিল । পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকলো তখন দেখলো আগজর মিয়া নিজের বিছানায় চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন । যদিও মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছেন তবে আমার বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না যে তিনি মারা গেছেন । পুলিশ পরীক্ষা করে দেখে বলল ঘুমের ভেতরেই সম্ভবত মৃত্যু হয়েছে । বার্ধক্যজনিত মৃত্যু ।

সত্যি বলতে কি তার মৃত্যুতে কেউ ঠিক শোক প্রকাশ করলো না । তবুও সবাই একটা মুখ ভার করা ভাব নিয়ে থাকলো ।

তবে দুদিনের ভেতরেই সব কিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল । সবার মাঝেই একটা স্বস্তির ভাব ছিল । বিশেষ করে আমাদের বয়সী সবার মনে একটা নিশ্চিন্ত ভাব ছিল যে আজগর মিয়া আর আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না । আমাদের দিকে শকুনের চোখের দৃষ্টি ফেলবে না । যতই আমাদের বাবা মায়েরা তার কথা না শুনুক সব সময় একজোড়া চোখ আমাদের উপর নজর রাখছে সেটা মোটেও আমার জন্য ভাল অনুভূতি ছিল না ।
এরপরই আমি আর নীতু খানিকটা সাহসী হয়ে উঠলাম । নীতুর সাথে আমার প্রেমটা শুরু হয়েছিলো আরও বছর খানেক আগেই তবে ঐ আজগর মিয়ার জন্য আমরা মোটেই আমাদের এপার্টমেন্টে কোন দেখা সাক্ষাত করতাম না । দেখা হলে এমন একটা ভাব করতাম যেন আমরা চিনিই না একে অন্য কে । পাছে বেটা আমাদের দেখে ফেলে । তবে সেই ভয় কেটে যাওয়ার পরেই আমরা আমাদের বিল্ডিংয়েই দেখা সাক্ষাত শুরু করলাম । বিশেষ করে ছাদে । রাতের বেলা প্রায়ই আমরা দুজন হাজির হতাম ছাদে । গল্প করতাম আপন মনে । তেমনই এক রাতে গল্প করছি নীতুর সাথে । একটা সময়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যাবো তখনই মনে হল যেন একটা ছায়া আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল । কেবল আমিই না নীতুও যে ছায়াটাকে দেখেছে সেটা ওর আচরণেই বুঝতে পারলাম । আমাকে খানিকটা জড়িয়ে ধরলো ভয়ে ।
আমি চুপিস্বরে বললাম, তুমি দেখেছো?
-হুম । দেখেছি !
-চল এখান থেকে ।

আর কিছু না বলে নীতুর হাত ধরে দ্রুত সিড়ির দিকে দৌড় দিলাম । এবং এরপরে এই ছায়াকে আমরা আবারও দেখা শুরু করলাম । কেবল যে আমরা সেটাও না আমাদের বিল্ডিংয়ের আরও কয়েকজন দেখা শুরু করলো । হঠাৎ কেউ কেউ অনুভব করতে পারে কে যেন তাদের কাছ দিয়ে চলে গেল । যখন তার ফিরে তাকাচ্ছে তখনই কেবল একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছে । তবে সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে কয়েক মুহুর্ত পরেই ।

তারপরেই আমি ছায়াটাকে আরো স্পষ্ট দেখতে পেলাম । কী হয় কোন ভয় জিনিস যদি আমরা বারবার দেখি তাহলে আমাদের মাঝে ভয়টা কেটে যায়, এখানেও তাই হয়েছে । আমি আর নীতু সিড়ি ঘরে বসে গল্প করছিলাম । সবাই লিফট দিয়ে চলাচল করে । সিড়ি দিয়ে খুব একটা কেউ আসে না । এই দুপুর বেলাও কেউ আসবে না । এই জন্য গল্প করছিলাম । তখনই দেখতে পেলাম ছায়াটাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে ।

নীতু আমার হাত চেপে ধরেছে শক্ত করে । এখনই হয়তো চিৎকার দিবে । আমি তখন একভাবে তাকিয়ে রয়েছি ছায়ার দিকে । তখনই আমার বড় একটা পরিচিত ব্যাপার খেয়াল হল । ছায়াটা যেভাবে হাটছে সেটা বড় পরিচিত মনে হল !

আজগর মিয়া ঠিক এভাবেি হাটতো !
ছায়াটা মিলিয়ে গেল তখনই । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কেবল । বেটা দেখি মরেও আমাদের শান্তি দিচ্ছে না । নীতুকে বললাম আজকে রাতে আবার আমরা ছাদে দেখা করবো !
নীতু ভয়ে ভয়ে রাজি হল ।

যথা সময়ে ছাদের হাজির হল ও । আমরা কিছ সময়ে গল্প করলাম । তারপর সেদিনের মত আবারও ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেলাম । তখনই দেখতে পেলাম সেই ছায়াকে । নীতু একটু শক্ত হয়ে গেলেও আমি ওকে বললাম একদম ভয় না পেতে । কিছু হবে না । ছায়াটাকে আমরা যেন দেখি নি এমন ভাব করে একে অন্যকে চুমু খেলাম । তারপর আরও কয়েকবার । যখন চুমু খাওয়া শেষ হল চেয়ে ডেখি কোন ছায়া নেই ।

এরপর প্রতি রাতেই আমরা গিয়ে হাজির হতাম ছাদে । একই ভাবে চুমু খেতাম আর এমন যেন ভাব করতাম কাউকে দেখি নি । কয়েক রাতের পরে আবিস্কার করলাম যে ছায়াটাকে আমরা আর দেখতে পাচ্ছি না । আমাদের সামনে আসছে না বেটা ।

বিল্ডিংয়ের সবাইকে একই কথা বলে দিলাম । বললাম যে একেবারে ভয় না পেতে। যা করছিলে তাই করে যেতে । পাত্তা না দিলে কিছুই করতে পারবে না ।

এতে আসলেই কাজ হল । আগে যখন প্রতিদিন ছায়াটাকে দেখা যেত আস্তে আস্তে সেটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল । আসলে বেঁচে থাকতে যখন আমাদের বাবা মায়েরা তাকে পাত্তা দিতো তখন ঘন ঘন নালিশ নিয়ে সে হাজির হত । তারপর যখন মা বাবারা বিরক্ত হয়ে সেটা শোনা বন্ধ করে দিল তিনিও আর যেতে পারলেন না । মরার পরে সেই স্বভাবটা যায় নি । যখনই আমরা পাত্তা দিয়েছে তখনই তিনি নাক গলিয়েছেন । যখন পাত্তা দেওয়া বন্ধ করেছি তখনওই তার ছায়া আর আমাদের সামেন আসে নি । একটা সময়ে সেই ছায়াটাকে দেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.2 / 5. Vote count: 42

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →