হঠাৎ নীতুর অনেক কান্না আসতে লাগলো । নিজের হলের বিছানায় বালিশে মুখ লুকিয়ে কয়েক ফোটা চোখের পানিও পড়ে গেল । ফোনের ওপাশে রিয়াদ তখন কথা বলে চলেছে । নীতুর যে কান্না পাচ্ছে সেটা রিয়াদ বুঝতেও পারে নি ।
-নীতু শুনছো?
কান্না আটকে কোন মতে নীতু বলল, হুম ।
-ঘুম পাচ্ছে কি?
-হুম ।
-আচ্ছা তাহলে তুমি ঘুমাও । কেমন !
-আপনি ঘুমাবেন না?
-উহু । আমি ঘুমালে আমার আর ঘুম ভাঙ্গবে না । তখন সেহরী খেতে পারবো না ।
-তাই বলে এভাবে রাত জেগে থাকবেন? সকালে আবার অফিস আছে না ?
-তা আছে ! একটু সমস্যা হয় বটে । তবে কোন ব্যাপার না !
-আপনি ঘুমিয়ে নিন । আমি আপনাকে ডেকে দিবো ।
ওপাশ থেকে প্রথমে কোন কথা শোনা গেল না । নীতু এবার খানিকটা জোর দিয়ে বলল, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন । আমি আপনাকে ডেকে দিবো । চিন্তা করবেন না ।
-সিওর তুমি ?
-হ্যা । আমার সময় মত ঘুম ভেঙ্গে যাবে ।
-আচ্ছা তাহলে একটু ঘুমাই আমি । ডেকে দিও কিন্তু !
-দিব !
নীতুর খুব ইচ্ছে করলো রিয়াদকে বলে যে একটু ভিডিও কল দিতে । সে ভিডিও কল দিয়েই ঘুমাবে । নীতুর খুব রিয়াদের ঘুমন্ত চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে করলো কিন্তু লজ্জার কারণে বলতে পারলো না । ফোনটা কেটে যাওয়ার পরেও সে কানে চেপে ধরে রাখলো । মনে হল যেন এখনও সে ফোনের ওপাশ থেকে রিয়াদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাবে ।
নীতু নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের আচরণ নিয়ে খানিকটা সময় ভাবলো । রিয়াদের প্রতি এই অল্প দিনের ভেতরেই এতোটা আবেগ যে সৃষ্টি হবে নীতু নিজেও ভাবতে পারে নি । রিয়াদের প্রতি অদ্ভুত একটা মায়া জন্ম নিচ্ছে নীতুর ভেতরে । অবশ্য নীতু একটা আটকানোর চেষ্টা করছে না । যে মানুষটার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে তার প্রতি যদি ভালোবাসা জন্ম নেয় তাহলে সেটা মোটেো খারাপ কিছু নয় ।
বিয়েতে নীতুর প্রথমে একদম মত ছিল না । কিন্তু বাসা থেকে সবার খুব ইচ্ছে যে রিয়াদের সাথেই নীতুর বিয়েটা হোক । নীতুকে নাকি তাদের অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে । তারা যে কোন শর্তেই বিয়েতে রাজি । শেষ পর্যন্ত সবার ইচ্ছের কাছে নীতু হার স্বীকার করলো । তবে এই শর্ত জুড়ে দিল যে এখন কেবল বিয়ে হবে । কোন বড় অনুষ্ঠান না । এবং বিয়ের পরেও নীতুর পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন প্রকার সংসার শুরু হবে না । পড়াশোনা শেষ করেই তবে ঐদিকে যাওয়া যাবে । রিয়াদরা তাতেই রাজি হয়ে গেল ।
কিন্তু বিয়ের পর থেকে রিয়াদের প্রতি আলাদা একটা মায়া জন্মেছে নীতুর । এই যে প্রথম রমাজের সেহরী খাওয়ার কথা শুনে নীতুর মন কত খারাপ লাগছে । মানুষটার হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে ফ্রিজে রেখেছে। সেটাই খাবে শেষ রাতে এটা শোনার পর থেকে কেমন মন খারাপ হয়ে আছে । অথচ এতে কি খুব বেশি মন খারাপের কোন কারণ আছে ! প্রতিটি ব্যাচেলরের জীবন তো এমনই হয়ে থাকে ।
দুই
রিয়াদ একেবারে সঠিক সময়ে নীতুর হলের সামনে এসে দাড়ালো । নীতুর দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় ইফতারি করবে বল? এদিকে না একটা হোটেল ছিল !
নীতু বলল, না কোন হোটেলে ইফতারি করবো না ।
-তাহলে?
-ঐ যে দোকানটা দেখছেন ওখান থেকে ইফতারি কিনে আনুন । আমরা মাঠে বসবো !
রিয়াদ কিছু বলতে গিয়েও বলল না । সোজা ইফতারি কিনে নিয়ে এল । নীতু সাথে করে খবরের কাগজ নিয়ে এসেছিলো । সেটা বিছিয়ে বসলো । তারপর আস্তে আস্তে ইফতারি সাজাতে শুরু করলো । অন্যান্য বার নীতু ওর হলেই ইফতারি করে । আজকেও প্রথম রমজান উপলক্ষে তেমন আয়োজন করা হয়েছিলো । নীতুর ইচ্ছেও ছিল যে সেখানেই করবে ইফতারি । কিন্তু রিয়াদ যখন বলল যে প্রথম ইফতারিটা ওর সাথে করা যায় কিনা তখন নীতুর অন্য সব কিছু চোখের সামনে থকেে গায়েব হয়ে গেল । কেবল মনে হল যে রিয়াদের সাথেই ওর ইফতারি করতে হবে ।
-জানো অনেক দিন পরে আমি প্রথম রমজান কারো সাথে ইফতার করছি । কাজের জন্য সব সময় বাইরে । বাড়িতে ঈদের আগে । দুই তিন সময় থাকে । পুরোটা সময়ই একা একাই ইফতার করতে হয় ।
-মন খারাপ লাগতো?
-অভ্যাস হয়ে গেছে ।
নীতুর আবারও এতো মায়া লাগলো । খুব কষ্টে চোখের পানি আটকালো . তারপর বলল, এইবার বাসায় যাওয়ার আগে প্রতিদিন আমরা একসাথে ইফতার করবো ।
নীতু দেখলো রিয়াদের চোখ মুখ সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে গেল । তারপর বলল, তোমার কষ্ট হবে না?
-না হবে না । আর আজকে ইফতারির পরে আমি আপনার সাথে আপনার বাসায় যাবো !
এবার রিয়াদ একটা বিস্ময় ভাব নিয়ে তাকালো নীতুর দিকে । নীতু খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, এভাবে অবাক হয়ে তাকাবেন না তো ! বউ তার স্বামীর বাসায় যাবে এতে অবাক হওার কী আছে শুনি ?
-সত্যি যাবে?
-হ্যা । আজ থেকে বাইরের খাবার বন্ধ । ঠিক আছে । বাসায় রান্না করার জিনিস পত্র আছে তো ?
-হ্যা আছে ।
-গুড । আগে ইফতার করি । তারপর চলুন একসাথে !
ইফতারির পর নীতু সোজা গিয়ে হাজির হল রিয়াদের বাসায় । ছোট দুই কামড়ার একটা বাসা । নিত্য দিনের সব জিনিসই সেখানে রয়েছে । পুরো রান্নাঘর পরিদর্শন শেষ করে নীতু একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিল । সেগুলো তখনই কিনে নিয়ে আসতে বলল। রিয়াদ বিনা বাক্য ব্যয়ে সেগুলো কিনে নিয়ে এল । তারপর দুজন মিলে রান্না শুরু করলো । মুরগির মাংস, ডাল আর ভাত হবে আজকে । কাল অন্য কিছু রান্না করা যাবে ।
নীতু একেবারে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এখানে আসার । এমন কি যখন ইফতার করতে আসলো তখনও নীতুর কো ইচ্ছে ছিল না । কিন্তু কেন যে আসতে চাইলো সেটা সে নিজেই জানে না । কিন্তু এই যে একসাথে রান্না করা, রান্না করতে করতে কথা বলা এটা নীতুর কাছে অমূল্য এক আনন্দ দিতে শুরু করলো । আর সব থেকে বড় কথা হল আজকে সে রিয়াদকে ঘুমন্ত অবস্থা ঠিক ঠিক দেখতে পাবে । কালকের রাতের মত আজকে আর মন খারাপ করে ঘুমাতে হবে ।
জীবনে সুখী হতে আসলে খুব বেশি কিছুর দরকার নেই । এই রিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে নীতুর মনে হচ্ছে এই দুনিয়াতে ওর থেকে সুখী আর আনন্দিত মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই । নীতুর নিজের মনকেও যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে সেও উত্তর পাবে যে ওর নিজেকে বর্তমানে অসম্ভব সুখী একটা মেয়ে মনে হচ্ছে ।
গল্পের নোটিফিকশন পেতে হোয়াটস এপ গ্রুপ কিংবা টেলগ্রাম চ্যানেলে জয়েন করুন । সরাসরি পেয়ে যাবেন নোটিফিকেশন আকারে ।