তৃষার ভালবাসা ২.০

oputanvir
4.9
(97)

কাজের সময় তৃষার ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না । তাই যখন কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন বেশির ভাগ সময়ই ওর ফোনটা সাইলেন্ট মোডে থাকে । আজ কী কারণে সেটা ছিল না । নতুন প্রোজেক্টের ফাইন নিয়ে কাজ করার সময় সেটা বেজে উঠায় একটু বিরক্ত হল । লাইনটা কেটেই দিতে যাচ্ছিলো তখনই নামটার দিকে চোখ গেল ওর !

অপুর বস !
অপুর বস ওকে হঠাৎ ফোন দিচ্ছে কেন ?

ফোনটা আর কেটে দিতে পারলো না । রিসিভ করলো ।
-হ্যা ভাইয়া । কেমন আছেন?
-হ্যা ভাল আছি । তুমি কেমন আছো?
-আমিও আছি আর কি । কাজে ব্যস্ত । কোন কারণে ফোন দিয়েছিলেন?
-হ্যা । অপুর কোন খোজ নেই কেন? গতকাল অফিসে এসে বলল যে কাজ আছে একটু বের হতে হবে । সেই যে বের হল তারপর আর কোন খোজ নেই । আজকে তো অফিসে আসে নি । ও কোথায় বল তো !

তৃষা কিছু সময় চুপ করে শুনলো কথা গুলো । প্রথমে মাথার ভেতরে একটা রাগের ভাব আসতে গিয়েও থেমে গেল । অপু নিজের কাজ তো কামাই করে না । গত পুরশুদিন অপুর সাথে তৃষার ঝগড়া হয়েছে । তারপরই তৃষা রাগ করে অপুর সাথে কথা বলে নি । কোন খোজ নেয় নি । নিজ থেকে যত সময় না অপু সরি বলবে তত সময়ে সে অপুর কাছে যায় না । প্রতিবার অপু আগে এসে সরি বলে তারপর সব কিছু ঠান্ডা হয় । তাহলে আজকে এখনও এল না কেন?
তার উপরে অফিসে যায় নি ।

তৃষা বলল, আচ্ছা ভাইয়া আমি খোজ নিয়ে জানাচ্ছি ।
ফোন রাখার পরে তৃষার কেন মনের ভেতরে একটা কু ডেকে উঠলো । কেন উঠলো সেটা তৃষা নিজেও জানে না । আসলে গতদিন তৃষার সাথে অপুর কোন ঝগড়া হয় নি । তৃষাই মুখে যা এসেছে তাই বলেছে ওকে । বিশেষ করে ওর প্রাক্তন প্রেমিকার প্রসঙ্গটা তোলা তৃষার মোটেও উচিৎ হয় নি । তারপরেও তৃষা তুলেছে । চাইলে অপুও তুলতে পারতো তবে সে তেমনটা করে নি । চুপচাপ শুনেছে । তারপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছে ।
তৃষা জানে যে অপুর খুব বেশি দুরে যাওয়ার নেই । খুব বেশি হলে ও কোন বন্ধুর বাসায় যাবে । নয়তো ওদের গাজিপুরের ফার্ম হাউজে যবে । আর না হলে যাবে ওর গ্রামের বাড়ি । এর বাইরে সে কোথাও যেতে পারবে না । এই কারণে খুব একটা চিন্তা করে নি সে । কিন্তু এখন কেন জানি মনে হচ্ছে অপু এসবের কোনটাতেই যায় নি ।

হাতের কাজ বাদ দিয়ে তখনই অপু প্রথমে ওর সব বন্ধুদের ফোন দিল । কারো বাসায় যায় নি সে । ফার্ম হাউজের কেয়ারটেকারকে ফোন দেখলো সেখানেও যায় নি । সব শেষে ফোন দিল ওর শ্বাশুড়িকে । যখন রিং বাজছে তখন মনের ভেতরে একটা ভয় এসে জড় হল ।
শ্বাশুরির সাথে কথা বলা শেষ যখন তখন তৃষা অনুভব করলো যে ওর ভেতরে একটা ভয় এসে জড় হয়েছে ।
অপু ওখানে যায় নি ।
তাহলে কোথায় গেল সে?

দুই
মইনুল আহসান নিজের ফোনের দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন ঘড়ির দিকে । এই সময়ে তার মেয়ে কখনই ফোন করে না তাকে । তৃষার ফোন করার সময় হচ্ছে রাতের খাওয়ার পরে । এছাড়া তৃষা কখনই ফোন করে না । ফোন করেছে এর অর্থ হচ্ছে কোন ঝামেলা হয়েছে ।

মইনুল আহসান ফোন রিসিভ করার আগেই নিজের মনকে শক্ত করে নিলেন কঠিন কিছু শোনার জন্য ।
-হ্যালো ।
-হ্যালো বাবা !

মইনুল আহসান একটা লম্বা করে দম নিলেন । তৃষা সব সময় তাকে ড্যাড বলেই ডাকে কিন্তু যখন সে খুব বেশি আপসেট হয়ে যায় তখন বাবা বলে ডাকে । তার মানে সত্যিই খারাপ কিছু হয়েছে । তিনি নিজেকে শান্ত করে বললেন, কী হয়েছে রে মা ?
-বাবা অপুকে খুজে পাচ্ছি না ।
-খুজে পাচ্ছি না মানে কি ! অপু কি এক বছরের ছেলে নাকি হারিয়ে যাবে ।
-বাবা পরশু ওর সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে !
-তোর সাথে ও ঝগড়া করেছে?
তৃষা একটু দম নিলো যেন । তারপর বলল, আমি ওকে মুখে যা এসেছি বলেছি। ও কিছুই বলে নি । তারপর বাসা ছেড়ে গেছে । আমি ভেবেছিলাম বড়জোড় ফার্ম হাউজে যাবে কিন্তু যায় নি । কোথাও নেই ।
-সব জায়গায় খোজ নিয়েছিস?
-সব জায়গা খোজ নিয়েছি । কোথাও নেই !

বলতে বলতেই তৃষার কান্নার আওয়াজ ভেসে এল । মইনুল আহসান জীবনে সব সহ্য করে নিতে পারেন কিন্তু মেয়ের কান্না কিছুতেই মনে নিতে পারেন না । তিনি বললেন, তুই চিন্তা করিস না । আমি খুজে বের করবো অপুকে । একদম চিন্তা করিস না ।

তিনি ফোন রেখে কিছু সময় অবাক হয়ে বসে রইলেন । নিজের মেয়েকে তিনি প্রায়ই বুঝতে পারেন না । এতো বড় কোম্পানি সে একা হাতে সামলাচ্ছে । কয়েক হাজার কর্মী এক কথায় উঠবস করে তৃষার কাছে । যখন তিনি ব্যবসা ছেড়ে রাজনীতিতে ঢুকেছিলেন তখন মনে একটা সন্দেহ ছিল যে তৃষা একা সামলাতে পারবে তো সব কিছু ! কিন্তু তার সেই সন্দেহ একেবারে ভুল প্রমানিত করেছে তৃষা । সব কিছু সামলাতে পারে কিন্তু এই এক অপুর কথা আসলেই সব কিছু তাল হারিয়ে ফেলে মেয়েটা । একবার তো পরীক্ষা করার জন্য অপুকে সে তুলে নিয়ে এসেছিলো । তৃৃষা কোন কিছু না ভেবে এক কোটি টাকা পর্যন্ত দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো । সেদিনই মইনুস আহসান বুঝেছিলেন যে এই অপু তার মেয়ের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ !

তিন
হাসানের দিকে তাকিয়ে মিমু বলল, আপনি গুল মারছেন !
-আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি গুল মারছি !
-তার মানে ম্যামের হাজব্যান্ড সত্যি হারিয়ে গেছে ।
-আরে হারিয়ে যাবে কেন ? ম্যামকে টাইট দেওয়ার জন্য তাকে ছেড়ে চলে গেছে । এর আগে একবার এই ভাবে চলে গিয়েছিলো । তুমি তো জানো ম্যাম যেমন । সবাইকে দৌড়ের উপরে রাখে । অপু স্যার কেও রাখেন তবে …..
-তবে অপু স্যারের সামনে তিনি কিছুই করতে পারেন না । মনে নেই একবার কিভাবে আমাদের আমির হোসেন আর রাকিবের চাকরি বাঁচিয়েছিলো সে ।

মিমু ঘটনাটা শুনেছে । বছর চারেক আগের ঘটনা । সেবার এই দুইজনের ভুলে বড় একটা টেনডার হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। চাকরি চলেই যেত তখন এরা অপু মানে ম্যামের হাসব্যান্ডের সাথে যোগাযোগ করে তখন যদিও বিয়ে হয় নি। প্রেমিক ছিল । সেই অফিসে এসে কিভাবে জানি ম্যামের রাগ প্রশমন করে দিয়েছিলো ।
হাসান বলল, অপু স্যার চলে যাওয়ার পর ম্যাম এখন একটা দানা পানিও মুখে নেন নি । আজকে সকালে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে । আমি ওখানেই যাচ্ছি ।
মিমুর কী যেন মনে হল বলল, আমি আসবো আপনার সাথে
-আসবে? আসো !

মিমু আর হাসান হাসপাতালে পৌছে দেখলো সেখানে তৃষার বাবা আগে থেকেই বসে আছে । তৃৃষা শুয়ে আছে বেডের উপরে । মিমু তাদের বসের চেহারা দেখে খানিকটা অবাক হয়ে গেল । এই কোম্পানীতে সে বছর দুয়েক হল কাজ করছে কোন দিন তৃষা ম্যাডামকে এই চেহারাতে দেখেন নি । সব সময় নিজের উপর আত্মবিশ্বাসী আর কাউকে দরকার নেই এমন একটা চেহারায় দেখেছেন অথচ আজকে তাকে কেমন দেখাচ্ছে । সত্যিই কাউকে সত্যিকারের ভালবাসা মানুষকে দুর্বল আর অসহার করে তোলে ।

তৃষার বাবা মইনুল আহসান বললেন, মনে হয় অপুর খোজ পাওয়া গেছে ।
-কোথায় বাবা?
-চারদিন আগে ওকে থানচি ক্রস করতে দেখা গেছে । ওখানে লাস্ট এন্ট্রি । ওরা বলছে রেমাক্রি হয়ে নাফাকুম যাবে ।
-নাহ । ও ঐ সহজ পথে যাবেই না ।
-হ্যা আমারও তাই মনে হয় । খোজ করা হচ্ছে । সম্ভব্য সব রুটেই লোক গেছে । খোজ পাওয়া যাবে । টেনশন নিস না ।

চার
বনমোরগের মাংস টুকু মুখ দিতে দিতে অপু আকাশের দিকে তাকালো । প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । আজকের রাতটা এখানেই কাটানোর প্লান করা হয়েছে । ওর গাইড বাহাদুর সেই মোতাবেগই তাবু খাটিয়েছে । এখানে । রাতে এখানে ঘুমিয়ে কাল সকালে আরও সামনের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে অপু । যদিও সামনে যাওয়াটা একটু ঝুকি পূর্ন হয়ে যাবে । একেবারে মায়ানমার বর্ডারের কাছে চলে এসেছে ওরা দুজন । যদিও বাহাদুর বলছে যে এখানে ওদের গ্রাম থেকে প্রায় শিকারে আসে । এখানে ভালল বনমোরগ পাওয়া যায় । শেয়াল বানর আর হরিণও নাকি এখানে প্রচুর আছে । যদিও অপুর হরিণ মারার কোন ইচ্ছে নেই । তবে খাবার দাবার শেষ হয়ে আসছে । আরও দিন দুয়েক এখানে থাকার ইচ্ছে । তারপর আবার ফিরে যাওয়ার সময় আছে । এই সময়ে খাবার দরকার হবে ।

গত তিনদিন ধরে অপু এই বনের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । সময়টা বেশ কাটছে । যদিও মাথার ভেতরে তৃষার জন্য একটা চিন্তা কাজ করছে । মেয়েটার যদি এরই ভেতরে রাগ কমে যায় তাহলে চিন্তায় অস্থির হয়ে যেতে পারে !

একটু পরেই বাহাদুরের দিকে তাকাতেই বুঝলো কোন একটা ঝামেলা হয়েছে । বাহাদুর কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করছে । সম্ভবত কেউ আছে আসে পাসে । মানুষ হওয়ার সম্ভবনা কম । ভাল্লুক যদি হয় তাহলে বিপদ হতে পারে ।
অপুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই অপু ব্যাগ থেকে বড় ছুরিটা তুলে নিল । সামনে কিংবা পেছন থেকে যেই আসুক না কেন তাকে প্রতিহত করতে একেবারে প্রস্তুত ।
কিন্তু কোন পশু এল না । এল মানুষ ।
আর্মির লোক । মোট চারজন ।

ওদের দিকে তাকিয়ে প্রথমে প্রশ্ন করলো, অপু হাসান আপনার নাম ?
-জ্বী !
-আপনি এখানে কেন এসেছেন? জানেন না এখানে আসা নিষেধ ।
তারপর বাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কেন নিয়ে এসেছিস ওনাকে? আজ তোকে …
অপু জানে আর্মি গাইডদের ধরে মাইর দেয় । অপু সাথে সাথে সামনে এসে দাড়ালো । তারপর বলল, ওর কোন দোষ নেই । ওকে কিছু বলা যাবে না । যা বলার আমাকে বলুন ।

আর্মির লোকটা একবার অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার এখনই ঢাকা ফিরতে হবে ।
-কেন ?
-আপনার ওয়াইস হাসপাতে ভর্তি । আপনার খোজে সরাসরি মন্ত্রনালয় থেকে তলব এসেছে ।
অপুর বুঝতে কষ্ট হল না এটা তার শ্বশুর মশাইয়ের কাজ । আর্মির লোকটা আবার বলল, আপনি এখনই হাটা দিবেন আমাদের সাথে । থানচি গিয়ে সেখানে হেলিকাপ্টারে করে সোজা চট্টগ্রামে যাবেন । তারপর সেখানে আপনার জন্য প্লেন অপেক্ষা করছে ।

তবুও থানচি পৌছাতে আরও একটা দিন পার হয়ে গেল । সেখানে থেকে চপারে করে চট্রগ্রাম এয়ারপোর্ট তারপর সেখান থেকে ঢাকা । এারপোর্ট থেকে সরাসরি হাসপাতালেই গিয়ে হাজির হল অপু । রুমে ঢুকতে যদিও একটু ভয় লাগছিলো একটু ।

রুমে ঢুকেই দেখতে পেল তার শশুর শাশুড়ি দুজনেই বসে আছেন । এছাড়া হাসান আছে । আরেকজন মেয়েকেো দেখা যাচ্ছে । তৃষা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল । ওর রুমে ঢুকতেই চোখ মেলে তাকালো । ওর দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো । অপু দেখতে পেল চোখ দিয়ে পানি পরা শুরু করেছে । অপু ধীর পায়ে এগিয়ে বসলো তৃষার পাশে । তৃষার কোন মতে উঠতে যাচ্ছিলো তার আগেই অপু ওকে উঠতে সাহায্য করলো । সেখানেই ওকে জড়িয়ে ধরলো ।
আশে পাশে যে ও বাবা মা ছাড়াও আরও কয়েকজন মানুষ আছে সেদিকে তৃষার কোন খেয়াল নেই । অপুর ঠোঁটে একটা গভীর চুমু খেল সে । তারপর বাচ্চা মেয়ের মত করে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, আমি খুব সরি । আর কখন কিছু বলবো না কিছু না । আর কোন দিন ঐ কথা বলবো না । প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না । কেমন !
-আরে বোকা মেয়ে তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি নাকি আমি !
-তাহলে কেন গিয়েছিলে? কেন?
-আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রাগ করে আছো । এই কদিন আমার মুখ দেখবে না । তাই কী করবো ভাবলাম ঘুরে আসি কোথাও !
অপু ভেবেছিলো এবার বোধহয় তৃষা ঝাড়ি দিবে ওকে । তবে তৃষা তেমন কিছুই করলো না । কেবল অপুকে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ।

পরিশিষ্টঃ
আমরা সবাই জীবনে আশা করি যে আমাদের জীবনেও এমন কেউ থাকবে যে আমাদেরকে তৃষার মত করে ভালবাসবে । কিন্তু একটা বয়সে এসে উপলব্ধি করতে পারি যে এমন ভাবে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে না । এসব কেবল গল্প সিনেমাতেই হয় বাস্তবে কখনই হয় না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 97

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →