রাতের খাবার শেষ করে মিয়ারা সাধারনত কিছু সময় টিভি দেখে । এই সময়ে নির্দিষ্ট কিছুই দেখে না । এই সময়ে তার মায়ের সাথে টুকটাক গল্প করে । টিভি দেখা মুল উদ্দেশ্য না । বরং মায়ের সাথে গল্প করাটাই মিয়ারার আসল উদ্দেশ্য । সারাটা দিন ওর মা অফিসে থাকে । মিয়ারাও নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে । মাকে ঠিক যেন কাছেই পায় না সারাদিন । খাওয়ার পরের এই সময়টাই দুজন একে অন্যকে সময় দেয় । প্রতিদিনের মত আজও মিয়ারা তার মায়ের সাথে গল্প করছিলো । এমন কোন সিরিয়াস বিষয় নয় । কলেজে আজকে কী হল কোন মেয়ে কী করলো এই সব গল্প করছিলো ।
নাইরাও একই ভাবে নিজের অফিসের গল্প করছিলো । তখনই থমকে গেল । একভাবে তাকিয়ে রইলো টিভির দিকে । মিয়ারাও কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো যে তার মা তার কথা শুনছে না । একভাবে তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে । টিভিতে একটা সংবাদ দেখানো হচ্ছে । সংবাদের দিকে মিয়ারা মনযোগ দিল । সংবাদে বলছে
দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি আজিজুর চৌধুরীর বড় ছেলে আরবাজ চৌধুরীকে বা কারা অপহরন করেছে । আরবাজ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে ছিল । দুইদিন আগেই সে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছে । এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফেরার পথেই তাকে অপহরণ করা হয় । পুলিশ সর্বাত্বক চেষ্টা করে চলেছে তারপরেও এখনও কোন কুল কিনারা করতে পারে নি । আজিজুর রহমান জনসাধারণের সাহায্য চেয়েছে । সন্ধান দাতাকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে ।
মিয়ারা মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো একটু অবাক হয়ে । দেশে এই রকম ঘটনা হার হামেশায় হচ্ছে । এতে এমন করে একভাবে তাকিয়ে থাকার কী হল সেটা মিয়ারা বুঝতে পারলো না । মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল আম্মু ?
নাইরা একবার নিজের মেয়ের দিকে আরেকবার টিভির দিকে তাকালো । মিয়ারা দেখতে পেল তার মায়ের চোখে পানি জমতে শুরু করেছে । মিয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । তারপর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মাকে । বলল, কী হয়েছে আম্মু ? কী হয়েছে !
-ঐ লোকটা ? আরবাজ !
-হ্যা ! কী হয়েছে !
-ঐ লোকটা তোর বাবাকে খুন করেছিলো !
মিয়ারা খানিকটা সময় থমকে দাড়ালো । এই সংবাদটা ওর জন্য একেবারে নতুন । ওর বাবা পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে প্রাণ হারায় সেটা সে জানে । কিন্তু সে যে খুন হয়েছে এই তথ্য সে জানতো না । অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইলো টিভির দিকে । এতোদিন পরে জানতে পারলো যে তার বাবাকে একজন খুন করেছিলো । এবং সেই খুনী এতোদিন খোলা আকাশের নিচে আরাম করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো । আর আজকে তাকে কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে ।
নাইরা বলল, আজিজুর চৌধুরীকে তো চিনিস । দেশ সেরা শিল্পপতি কিন্তু আসল চেহারা হল সে একটা আস্ত শয়তান । তার ছেলে গুলোও হয়েছে ঠিক তার মতই । দেশে যত ড্রাগস সাপ্লাই হয় সেটার একা নিয়ন্ত্রন করে এই চৌধুরীরা । কিন্তু প্রমানের অভাবে কিছুই করতে পারে না পুলিশ । কিন্তু তোর বাবা একবার ঠিকই হাতের নাগালে পেয়ে গিয়েছিলো । তার একটাই ভুল ছিল যে সে একা কাউকে না জানিয়ে অপরারেশনে গিয়েছিলো । এমন কী ফয়সাল বলে নি । এটাই সব থেকে বড় ভুল হয়েছিলো । ওরা যে ওকে মেরে ফেলবে সেটা সম্ভবত ও নিজেও বুঝতে পারে নি । কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে আরবাজ তাই করেছিলো ।
-তারপর ?
-তারপর আর কী ! আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম আরবাজকে ধরতে । মানে ফয়সাল চেষ্টা করেছিলো খুব বেশি । কিন্তু কোন প্রমান ছিল না । আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে কোন সাহায্য পাই নি । ফয়সালের উপর কড়া নির্দেশ ছিল যে প্রমান ছাড়া যেন সে কোন পদক্ষেপ না নেয় । সে সেদিন নিতে পারে নি । আজিজুর চৌধুরী অবশ্য সেই রিস্ক নেন নি । মামলা একটু ঠান্ডা হতেই ছেলেকে লন্ডন পাঠিয়ে দিয়েছেন । আজকে এতো গুলো বছর পরে সে দেশে ফিরে এসেছে । আর….
-আর আজকেই তাকে কেউ কিডন্যাপ করলো ! কে করতে পারে?
মিয়ারা তাকালো মায়ের দিকে । মিয়ারার কেন জানি মনে হল তার মা নাইরা ঠিকই জানে যে আরবাজ চৌধুরীকে কে কিডন্যাপ করেছে । মিয়ারার মনে হল সে নিজেও জানে উত্তরটা ।
দুই
আজিজুর চৌধুরী নিজের বসার ঘরে সোজা হয়ে বসে রয়েছে । এখনও যেন সব কিছু তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে । এমনটা আসলে কোন ভাবেই হতে পারে না। তার নিজের ছেলেকে কেউ দিনে দুপুরে ধরে নিয়ে যেতে পারে এটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না । এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে আরবাজ বাসায় আসছিলো । সামনের গাড়িতে লোকজন ছিল । নিশ্চিত মনেই ওরা এগিয়ে আসছিলো । পেছনের গাড়িতে আরবাজ আর ওর দুই মেয়ে আর স্ত্রী বসেছিলো । তাদের পেছনেও একটা গাড়ি ছিল । মাঝে ছিল আরবাজদের গাড়ি । তিনি নিজে কাজে ব্যস্ত ছিলেন বিধায় যেতে পারেন নি । ছোট ছেলে আরমান গিয়েছিলো বড় ভাই ভাবীকে রিসিভ করতে । তার স্ত্রীর শরীর খারাপ থাকা সে যেতে পারে নি ।
আরমান বাইকে আসছিলো । একটু সম্ভবত আগেই চলে এসেছিলো । আগে আগেই বাসায় চলে আসে সে । তার কিছু সময় পরেই সামনের গাড়িটা বাসায় চলে আসে । আর তার দশ মিনিটের মাথায় পেছনের গাড়িটা । কিন্তু মাঝের গাড়িটার কোন খবর নেই ।
ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিলো আরমানের । সে তখনই বের হয়ে গেল বাইক নিয়ে । পুরো রাস্তা খুজে বের করে তার ভাইয়ের গাড়িটা । গাড়িটা এয়ারপোর্ট রোডের এক পাশে থেমে আছে । দ্রুত সেখানে গিয়ে হাজির হয় । দরজা চাপ দিতেই খুলে যায় । তার ভাবী আর দুই মেয়ে ঠিকই রয়েছে । তবে ঘুমন্ত অবস্থায় । কেউ তাদের অজ্ঞান করে রেখেছে । আর ড্রাইভার এবং তার বড় ভাইয়ের কোন খোজ নেই ।
সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে যায় । খোজা খুজি শুরু হয় । পুরো দিন পুরো ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খোজা হয় কিন্তু কেউ কোন খোজ দিতে পারে না । শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পুলিশে খবর দেওয়া হয় ।
আরবাজের স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়া হয় । ডাক্তার জানায় যে কড়া ঘুমের ঔষধের কারণে তারা বেহুশ হয়েছে । মেয়ে দুইজনের বয়স কম হওয়াতে তারা একটু ঝুকিতে রয়েছে । সন্ধ্যার দিকে আরবাজের বইয়ের জ্ঞান ফিরে এলে সে জানায় যে তার কিছুই মনে নেই । এয়ারপোর্ট থেকে গল্প করতে করতে তারা আসছিলো । এমন সময় তার ঘুম পেয়ে যায় । মনে হতে থাকে যেন কোন ভাবেই সে চোখের পাতা খোলা রাখতে পারছে না । মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখে ততক্ষনে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে । লম্বা প্লেন জার্নির কারণে হয়তো এমনটা হচ্ছে – এই ভেবে সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে । তারপর আর কিছুই মনে নেই তার ।
আজিজুর চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারছেন না । পুলিশে তার বড় বড় লোক রয়েছে । তাদেরকে বলা হয়েছে যে কোন মূল্যেই তার ছেলেকে সে ফেরৎ চায় ।
এক মনে ভেবে চলেছেন তিনি । তখনই আরমান ঘরের ভেতরে ঢুকলো । বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা এই কাজ ঐ অফিসারই করেছে ।
আরমান আগেও কথাটা বলেছে । প্রথমে সে গা করে নি । তবে এখন তার নিজেরও মনে হচ্ছে যে কাজটা অন্য কেউ করতে পারে না । আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারো এই কাজ করার সাহসই হবে না । একমাত্র পুলিশ পারে এই কাজ করতে ।
-বাবা তুমি এভাবে চুপ করে বসে রয়েছো ! আমি ঐ পুলিশকে ছাড়বো না ।
-চুপ । একদম চুপ ! কী করবো তুই শুনি? ঐ পুলিশ এখন ডিএসপি । ছেলের হাতের মোয়া না সে ! আমি দেখছি । সে যদি কিছু করে থাকে সে বের হবে । আর আমার কাছ থেকে না শুনে কোন কাজ করবি না । মনে থাকে যেন !
তিন
ফরসাল আহমেদ কফিতে খুব আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছে । সামনে তার উর্ধতন কর্মকর্তা রয়েছে সেটা যেন ভুলেই গেছে । তার সকল মনযোগ এই কফির দিকেই । অবশ্য ফরসালকে যারা চেনে তারা জানে যে সে একটু বেপোরোয়া । পুরো ডিপার্টমেন্ট তার একটা বদনাম আছে । সে খুব কম মানুষকেই গোনার ভেতরে ধরে । বিশেষ করে ফয়সালের বাবা একজন ডিফেন্স মিনিস্ট্রির একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন । তার আরও আত্মীয় স্বজন আছেন বিভিন্ন পদে । তাই তার ব্যাকাপও বেশ ভাল । সবাই তাকে সামলে চলে । তবে তাকে সামলে চলার আরেকটা কারণ হচ্ছে পুলিশ অফিসার হিসাবে সে সৎ । আজ পর্যন্ত কোন অন্যায় সে কখনই করে নি । কাউকে ছাড়ও দেয় নি । একবার কারো পেছনে লাগলে তার খবর বের করে ছেড়েছেন ।
-ফয়সাল !
কাপটা টেবিলের উপরে রেখে সে তাকালো জাফর আলীর দিকে । তারপর বলল, জ্বী স্যার ! আমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছিলেন ।
-হ্যা । তুমি জানো তোমাকে কেন ডাকা হয়েছে ?
-কেন স্যার । আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-দেখো এটা ইয়ার্কি ঠোট্টার সময় না ।
-স্যার এই রাতের বেলা আপনি আমাকে এখানে কেন ডেকে এনেছেন সেটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না ।
-ও কাম অন ফয়সাল । আমি যেমন জানি তুমিও খুব ভাল করে জানো যে এর ফল খুব বেশি ভাল হবে না ।
-স্যার আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাচ্ছেন । কিসের ফল ভাল হবে না ।
জাফর আলী নিজের ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন এক সময়ে । চিৎকার করে বললেন, আমি জানি আরবাজকে তুমিই সরিয়েছো!
ফরসাল এমন একটা মুখের ভাব করলো যেন এর থেকে বিস্ময়ের কথা সে শোনেই নি । বলল, কী বলছেন স্যার । আমি তো পরশু থেকে আজকে এই পর্যন্ত পুরোটা সময় অফিস আর বাসা ছাড়া কোথাও ছিলাম না । আপনার সাথেই তো দেখা হয়েছে কতবার । আর আপনি নিজেই তো আমার সব থেকে বড় এলিবাই , মনে নেই পরশু দুপুরে আমরা একটা মিটিং করছিলাম । আমরা যে তথ্য পেয়েছি সেই তথ্য অনুযায়ী আরবাজ চৌধুরীকে ঠিক সেই সময়েই অপহরণ করা হয়েছে । মনে নেই আপনার ? সিসি টিভি বের করবো ?
জাফর আলীর খুব ভাল করেই মনে আছে । সেদিন ফরসাল নিজ থেকে এসেছিলো জাফর আলীর কাছে । পুরোটা সময় তার সাথেই ছিল । এখন জাফর আলী বুঝতে পারছে যে ফয়সাল এটা ইচ্ছে করেই করেছে যাতে শক্ত এলিবাই তৈরি করতে পারে ।
ফয়সাল উঠে দাড়ালো । তারপর বলল, কফির জন্য ধন্যবাদ স্যার । আজকে আসি । বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেব !
জাফর আলীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দরজার দিকে হাটা দিল । দরজার কাছে গিয়ে একটু ঘুরে দাড়ালো । তারপর বলল, ১৫ বছর আগে আপনি কী বলেছিলেন মনে আছে তো স্যার । আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই । আজও কিন্তু আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই ।
দরজা খুলে ফরসাল বের হয়ে গেল ।