ঠান্ডা প্রতিশোধ

oputanvir
4.8
(44)

রাতের খাবার শেষ করে মিয়ারা সাধারনত কিছু সময় টিভি দেখে । এই সময়ে নির্দিষ্ট কিছুই দেখে না । এই সময়ে তার মায়ের সাথে টুকটাক গল্প করে । টিভি দেখা মুল উদ্দেশ্য না । বরং মায়ের সাথে গল্প করাটাই মিয়ারার আসল উদ্দেশ্য । সারাটা দিন ওর মা অফিসে থাকে । মিয়ারাও নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে । মাকে ঠিক যেন কাছেই পায় না সারাদিন । খাওয়ার পরের এই সময়টাই দুজন একে অন্যকে সময় দেয় । প্রতিদিনের মত আজও মিয়ারা তার মায়ের সাথে গল্প করছিলো । এমন কোন সিরিয়াস বিষয় নয় । কলেজে আজকে কী হল কোন মেয়ে কী করলো এই সব গল্প করছিলো ।

নাইরাও একই ভাবে নিজের অফিসের গল্প করছিলো । তখনই থমকে গেল । একভাবে তাকিয়ে রইলো টিভির দিকে । মিয়ারাও কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো যে তার মা তার কথা শুনছে না । একভাবে তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে । টিভিতে একটা সংবাদ দেখানো হচ্ছে । সংবাদের দিকে মিয়ারা মনযোগ দিল । সংবাদে বলছে

দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি আজিজুর চৌধুরীর বড় ছেলে আরবাজ চৌধুরীকে বা কারা অপহরন করেছে । আরবাজ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে ছিল । দুইদিন আগেই সে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছে । এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফেরার পথেই তাকে অপহরণ করা হয় । পুলিশ সর্বাত্বক চেষ্টা করে চলেছে তারপরেও এখনও কোন কুল কিনারা করতে পারে নি । আজিজুর রহমান জনসাধারণের সাহায্য চেয়েছে । সন্ধান দাতাকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে ।

মিয়ারা মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো একটু অবাক হয়ে । দেশে এই রকম ঘটনা হার হামেশায় হচ্ছে । এতে এমন করে একভাবে তাকিয়ে থাকার কী হল সেটা মিয়ারা বুঝতে পারলো না । মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল আম্মু ?
নাইরা একবার নিজের মেয়ের দিকে আরেকবার টিভির দিকে তাকালো । মিয়ারা দেখতে পেল তার মায়ের চোখে পানি জমতে শুরু করেছে । মিয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । তারপর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মাকে । বলল, কী হয়েছে আম্মু ? কী হয়েছে !
-ঐ লোকটা ? আরবাজ !
-হ্যা ! কী হয়েছে !
-ঐ লোকটা তোর বাবাকে খুন করেছিলো !

মিয়ারা খানিকটা সময় থমকে দাড়ালো । এই সংবাদটা ওর জন্য একেবারে নতুন । ওর বাবা পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে প্রাণ হারায় সেটা সে জানে । কিন্তু সে যে খুন হয়েছে এই তথ্য সে জানতো না । অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইলো টিভির দিকে । এতোদিন পরে জানতে পারলো যে তার বাবাকে একজন খুন করেছিলো । এবং সেই খুনী এতোদিন খোলা আকাশের নিচে আরাম করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো । আর আজকে তাকে কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে ।

নাইরা বলল, আজিজুর চৌধুরীকে তো চিনিস । দেশ সেরা শিল্পপতি কিন্তু আসল চেহারা হল সে একটা আস্ত শয়তান । তার ছেলে গুলোও হয়েছে ঠিক তার মতই । দেশে যত ড্রাগস সাপ্লাই হয় সেটার একা নিয়ন্ত্রন করে এই চৌধুরীরা । কিন্তু প্রমানের অভাবে কিছুই করতে পারে না পুলিশ । কিন্তু তোর বাবা একবার ঠিকই হাতের নাগালে পেয়ে গিয়েছিলো । তার একটাই ভুল ছিল যে সে একা কাউকে না জানিয়ে অপরারেশনে গিয়েছিলো । এমন কী ফয়সাল বলে নি । এটাই সব থেকে বড় ভুল হয়েছিলো । ওরা যে ওকে মেরে ফেলবে সেটা সম্ভবত ও নিজেও বুঝতে পারে নি । কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে আরবাজ তাই করেছিলো ।
-তারপর ?
-তারপর আর কী ! আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম আরবাজকে ধরতে । মানে ফয়সাল চেষ্টা করেছিলো খুব বেশি । কিন্তু কোন প্রমান ছিল না । আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে কোন সাহায্য পাই নি । ফয়সালের উপর কড়া নির্দেশ ছিল যে প্রমান ছাড়া যেন সে কোন পদক্ষেপ না নেয় । সে সেদিন নিতে পারে নি । আজিজুর চৌধুরী অবশ্য সেই রিস্ক নেন নি । মামলা একটু ঠান্ডা হতেই ছেলেকে লন্ডন পাঠিয়ে দিয়েছেন । আজকে এতো গুলো বছর পরে সে দেশে ফিরে এসেছে । আর….
-আর আজকেই তাকে কেউ কিডন্যাপ করলো ! কে করতে পারে?

মিয়ারা তাকালো মায়ের দিকে । মিয়ারার কেন জানি মনে হল তার মা নাইরা ঠিকই জানে যে আরবাজ চৌধুরীকে কে কিডন্যাপ করেছে । মিয়ারার মনে হল সে নিজেও জানে উত্তরটা ।

দুই
আজিজুর চৌধুরী নিজের বসার ঘরে সোজা হয়ে বসে রয়েছে । এখনও যেন সব কিছু তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে । এমনটা আসলে কোন ভাবেই হতে পারে না। তার নিজের ছেলেকে কেউ দিনে দুপুরে ধরে নিয়ে যেতে পারে এটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না । এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে আরবাজ বাসায় আসছিলো । সামনের গাড়িতে লোকজন ছিল । নিশ্চিত মনেই ওরা এগিয়ে আসছিলো । পেছনের গাড়িতে আরবাজ আর ওর দুই মেয়ে আর স্ত্রী বসেছিলো । তাদের পেছনেও একটা গাড়ি ছিল । মাঝে ছিল আরবাজদের গাড়ি । তিনি নিজে কাজে ব্যস্ত ছিলেন বিধায় যেতে পারেন নি । ছোট ছেলে আরমান গিয়েছিলো বড় ভাই ভাবীকে রিসিভ করতে । তার স্ত্রীর শরীর খারাপ থাকা সে যেতে পারে নি ।

আরমান বাইকে আসছিলো । একটু সম্ভবত আগেই চলে এসেছিলো । আগে আগেই বাসায় চলে আসে সে । তার কিছু সময় পরেই সামনের গাড়িটা বাসায় চলে আসে । আর তার দশ মিনিটের মাথায় পেছনের গাড়িটা । কিন্তু মাঝের গাড়িটার কোন খবর নেই ।

ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিলো আরমানের । সে তখনই বের হয়ে গেল বাইক নিয়ে । পুরো রাস্তা খুজে বের করে তার ভাইয়ের গাড়িটা । গাড়িটা এয়ারপোর্ট রোডের এক পাশে থেমে আছে । দ্রুত সেখানে গিয়ে হাজির হয় । দরজা চাপ দিতেই খুলে যায় । তার ভাবী আর দুই মেয়ে ঠিকই রয়েছে । তবে ঘুমন্ত অবস্থায় । কেউ তাদের অজ্ঞান করে রেখেছে । আর ড্রাইভার এবং তার বড় ভাইয়ের কোন খোজ নেই ।

সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে যায় । খোজা খুজি শুরু হয় । পুরো দিন পুরো ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খোজা হয় কিন্তু কেউ কোন খোজ দিতে পারে না । শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পুলিশে খবর দেওয়া হয় ।

আরবাজের স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়া হয় । ডাক্তার জানায় যে কড়া ঘুমের ঔষধের কারণে তারা বেহুশ হয়েছে । মেয়ে দুইজনের বয়স কম হওয়াতে তারা একটু ঝুকিতে রয়েছে । সন্ধ্যার দিকে আরবাজের বইয়ের জ্ঞান ফিরে এলে সে জানায় যে তার কিছুই মনে নেই । এয়ারপোর্ট থেকে গল্প করতে করতে তারা আসছিলো । এমন সময় তার ঘুম পেয়ে যায় । মনে হতে থাকে যেন কোন ভাবেই সে চোখের পাতা খোলা রাখতে পারছে না । মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখে ততক্ষনে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে । লম্বা প্লেন জার্নির কারণে হয়তো এমনটা হচ্ছে – এই ভেবে সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে । তারপর আর কিছুই মনে নেই তার ।

আজিজুর চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারছেন না । পুলিশে তার বড় বড় লোক রয়েছে । তাদেরকে বলা হয়েছে যে কোন মূল্যেই তার ছেলেকে সে ফেরৎ চায় ।

এক মনে ভেবে চলেছেন তিনি । তখনই আরমান ঘরের ভেতরে ঢুকলো । বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা এই কাজ ঐ অফিসারই করেছে ।

আরমান আগেও কথাটা বলেছে । প্রথমে সে গা করে নি । তবে এখন তার নিজেরও মনে হচ্ছে যে কাজটা অন্য কেউ করতে পারে না । আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারো এই কাজ করার সাহসই হবে না । একমাত্র পুলিশ পারে এই কাজ করতে ।
-বাবা তুমি এভাবে চুপ করে বসে রয়েছো ! আমি ঐ পুলিশকে ছাড়বো না ।
-চুপ । একদম চুপ ! কী করবো তুই শুনি? ঐ পুলিশ এখন ডিএসপি । ছেলের হাতের মোয়া না সে ! আমি দেখছি । সে যদি কিছু করে থাকে সে বের হবে । আর আমার কাছ থেকে না শুনে কোন কাজ করবি না । মনে থাকে যেন !

তিন
ফরসাল আহমেদ কফিতে খুব আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছে । সামনে তার উর্ধতন কর্মকর্তা রয়েছে সেটা যেন ভুলেই গেছে । তার সকল মনযোগ এই কফির দিকেই । অবশ্য ফরসালকে যারা চেনে তারা জানে যে সে একটু বেপোরোয়া । পুরো ডিপার্টমেন্ট তার একটা বদনাম আছে । সে খুব কম মানুষকেই গোনার ভেতরে ধরে । বিশেষ করে ফয়সালের বাবা একজন ডিফেন্স মিনিস্ট্রির একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন । তার আরও আত্মীয় স্বজন আছেন বিভিন্ন পদে । তাই তার ব্যাকাপও বেশ ভাল । সবাই তাকে সামলে চলে । তবে তাকে সামলে চলার আরেকটা কারণ হচ্ছে পুলিশ অফিসার হিসাবে সে সৎ । আজ পর্যন্ত কোন অন্যায় সে কখনই করে নি । কাউকে ছাড়ও দেয় নি । একবার কারো পেছনে লাগলে তার খবর বের করে ছেড়েছেন ।
-ফয়সাল !
কাপটা টেবিলের উপরে রেখে সে তাকালো জাফর আলীর দিকে । তারপর বলল, জ্বী স্যার ! আমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছিলেন ।
-হ্যা । তুমি জানো তোমাকে কেন ডাকা হয়েছে ?
-কেন স্যার । আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-দেখো এটা ইয়ার্কি ঠোট্টার সময় না ।
-স্যার এই রাতের বেলা আপনি আমাকে এখানে কেন ডেকে এনেছেন সেটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না ।
-ও কাম অন ফয়সাল । আমি যেমন জানি তুমিও খুব ভাল করে জানো যে এর ফল খুব বেশি ভাল হবে না ।
-স্যার আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাচ্ছেন । কিসের ফল ভাল হবে না ।
জাফর আলী নিজের ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন এক সময়ে । চিৎকার করে বললেন, আমি জানি আরবাজকে তুমিই সরিয়েছো!

ফরসাল এমন একটা মুখের ভাব করলো যেন এর থেকে বিস্ময়ের কথা সে শোনেই নি । বলল, কী বলছেন স্যার । আমি তো পরশু থেকে আজকে এই পর্যন্ত পুরোটা সময় অফিস আর বাসা ছাড়া কোথাও ছিলাম না । আপনার সাথেই তো দেখা হয়েছে কতবার । আর আপনি নিজেই তো আমার সব থেকে বড় এলিবাই , মনে নেই পরশু দুপুরে আমরা একটা মিটিং করছিলাম । আমরা যে তথ্য পেয়েছি সেই তথ্য অনুযায়ী আরবাজ চৌধুরীকে ঠিক সেই সময়েই অপহরণ করা হয়েছে । মনে নেই আপনার ? সিসি টিভি বের করবো ?

জাফর আলীর খুব ভাল করেই মনে আছে । সেদিন ফরসাল নিজ থেকে এসেছিলো জাফর আলীর কাছে । পুরোটা সময় তার সাথেই ছিল । এখন জাফর আলী বুঝতে পারছে যে ফয়সাল এটা ইচ্ছে করেই করেছে যাতে শক্ত এলিবাই তৈরি করতে পারে ।

ফয়সাল উঠে দাড়ালো । তারপর বলল, কফির জন্য ধন্যবাদ স্যার । আজকে আসি । বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেব !

জাফর আলীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দরজার দিকে হাটা দিল । দরজার কাছে গিয়ে একটু ঘুরে দাড়ালো । তারপর বলল, ১৫ বছর আগে আপনি কী বলেছিলেন মনে আছে তো স্যার । আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই । আজও কিন্তু আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই ।

দরজা খুলে ফরসাল বের হয়ে গেল ।

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 44

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →