অসমাপ্ত তোমার আমার গল্প …

oputanvir
4.7
(43)

প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই তানিয়ার রাত হয়ে যায় । প্রতিদিনই চায় একটু আগে আগে বের হতে কিন্তু কোন ভাবেই সেটা সম্ভব হয় না । আজকে যখন বাসায় ঢুকলো তখন প্রায় আটটা বেজে গেছে । দরজা ভেতরে ঢুকে একটু অবাক হল । তানিয়া আর ওর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু নাতাশা, এই দুজন মিলে এই ফ্ল্যাটে থাকে । ঢাকা শহরে দুজন তরুণীকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে চায় না কেউ । তবে এই ফ্ল্যাটটার মালিক তানিয়ের অফিসের একজন । তাই ভাড়া পেতে খুব একটা সমস্যা হয় নি।

চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল বসার আলো জ্বলছে । এর মানে হচ্ছে নাতাশা ওর আগেই বাসায় চলে এসেছে । নাতাশারও বাসায় আসতে ওর মতই সময় লাগে । নাতাশা আগে বাসায় এসে টুকটাক রান্না বান্না করে । অন্তত বুয়ার রান্না করে রাখা খাবার গুলো গরম করে টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখে । বসার ঘরে তখন উচ্চস্বরে টিভি চলে নয়তো ইউটিউবে গান চলে । এটা নাতাশার একটা স্বভাব । তানিয়ে ঘরে ঢোকার আগেই টের পেয়ে যায় যে নাতাশা ভেতরে আছে । আজকে কোন আওয়াজ না পেয়ে ভেবেছিলো নাতাশা এখনও বাসায় আসে নি ।

তানিয়া নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে আগে নাতাশার ঘরের দিকে রওয়ানা দিল। দরজাটা খোলাই দেখা যাচ্ছে । দরজাটা একটু ঠেলে ভেতরে তাকালো তানিয়া । দেখতে পেল ঘর অন্ধকার তবে বিছানার উপরে নাতাশার শুয়ে থাকাটা তানিয়ার চোখ এড়ালো না । স্পষ্টই বুঝতে পারলো যে নাতাশা মুখটা বালিয়ে ঠেকিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে । একটু যেন কেমন লাগলো তানিয়ার কাছে । নাতাশা স্বাধারনত এমনটা করে না । খুবই ফুর্তিবাজ মেয়ে সে । সহজে বিচলিত হয় না । ক্লান্তিও যেন ওকে সহজে কাবু করতে পারে না । আজকে এমন ভাবে শুয়ে কেন আছে মেয়েটা?
শরীর খারাপ নাকি?

তানিয়া ঘরের ভেতরে ঢুকলো । আলো জ্বালতেই দেখতে পেল নাতাশাকে । বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে । তানিয়ার কেন জানি মনে হল ও কাঁদছে । বিছানা ঘুরে আরও একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পালরো যে ওর ধারণা সঠিক ।
নাতাশা কাঁদছে !

ওর আওয়াজ পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো । তানিয়া দেখলো ওর চোখে ভেজা । সত্যি সত্যিই মেয়েটা কাঁদছিলো । তানিয়া আর কিছু না বলে আরও একটু সামনে এগিয়ে গেল । তারপর নিজের বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো । এই জড়িয়ে ধরার জন্যই বুঝি নাতাশা অপেক্ষা করছিল । নাতাশার কান্নার বেগটা যেন আরও একটু বাড়লো ।

আপাতত তানিয়া ওকে আর কোন কথাই জিজ্ঞেস করলো না । কেবল শান্তনা দিতে লাগলো ।

একটা সময়ে নাতাশা শান্ত হয়ে এল । তারপর তানিয়ে বলল, কী হয়েছে আমাকে বলবি?
-রেহানের কথা মনে আছে?
-ঐ যে তোর কলেজ জীবনের বন্ধু?
-বয়ফ্রেন্ড !
-হ্যা হ্যা । তুই বলেছিলি । মনে আছে । সে আবার কী করলো !
-আজকে ওর সাথে দেখা হয়েছে ।
-কোথায়?
-আমাদের অফিসে । নতুন একজন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার ফ্রিলাঞ্চার হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে আমাদের অফিসে পুরো অফিসের আইটি সিস্টেম চেক করার জন্য।
-রেহানই হচ্ছে সেই ইঞ্জিনিয়ার !
-হ্যা !
-ও কিছু বলেছে ! মানে কোন খারাপ কথা কিংবা ….
-না ! আমার সাথে কথাই হয় নি ওর !
-তাহলে !

নাতাশা কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, রেহানের সাথে আমি যা করেছি তা কখনই ঠিক করি নি । বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে ওর সাথে সম্পর্ক গড়েছিলাম । আমার কারণেই ওর এইচএসসির রেজাল্ট খারাপ হয়েছিলো । আমার কারণেই ও বুয়েটে চান্স পায় নি আমি জানি ।

তানিয়া এই ব্যাপারটা জানে । নাতাশা সব সময় ফুর্তিবাজ মেয়ে । সব কিছু নিয়ে ওর ঠোট্টা তামাশা চলছেই । কেবল এই একটা ব্যাপার মাঝে মাঝে নাতাশাকে পীড়া দিতো । নাতাশা বলল, এতোগুলো বছর পরে আমি ভেবেছিলাম রেহান হয়তো মুভ অন করে নিয়েছে । নিজের জীবন এগিয়ে নিয়ে গেছে । কিন্তু …
-কিন্তু ?
-কিন্তু আজকে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম যে ও মুভ অন করে নি । একদম সেখানে আটকে আছে !

তানিয়া কী বলবে ঠিক খুজে পেল না । নাতাশা বলল, ও মুভ অন করে নি তানি । আমার কারণে ও আটকে গেছে !
-আচ্ছা এখন এই চিন্তা করে লাভ আছে । রেহান যদি মুভ অন না করে তাহলে ওটা ওর দোষ । তোর না ! আর তখন তুই ছোট ছিলি । মাত্র ইন্টারে পড়িস । এতো কিছু বুঝিস নাকি !
-আমি ঠিক করি নি । আমি মোটেই ঠিক করি নি ! আমি মোটেই ঠিক করি নি ।

তানিয়ে কেবল দেখলো নাতাশা কেঁদেই চলেছে । রাতে কোন ভাবেই ওকে আর খাওয়ানো গেল না । ওভাবেই সে ঘুমিয়ে পড়লো । তানিয়া ওকে ওনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো বটে কিন্তু খুব একটা কাজ হল না ।

পরের দিন নাতাশা অফিসে গেল না । তানিয়া কোন মতেই ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে অফিসে নিয়ে যেতে পারলো না । নাতাশার কেবল একটাই কথা যে রেহানের সামনে সে দাড়াতে পারবে না কিছুতেই ।

তানিয়া শেষে বাধ্য হয়ে নিজের অফিসে গিয়ে হাজির হল । কিন্তু নিজের কাজে ঠিক মন বসাতে পারলো না কিছুতেই । বারবার কেবল নাতাশার কথা মনে হতে লাগলো । বারবার কেবল মনে হতে লাগলো যে রেহানের নামের ছেলেটা কি এখনও নাতাশার প্রেমে পড়ে আছে? এখনও কি আটকে আছে সেখানেই ।

দুই
তানিয়া যখন নাতাশার অফিসে এসে তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে । যদিও সে নিজেই জানে না যে কেন সে এখানে এসেছে । নাতাশার সাথে দেখা করতে এর আগেও এই অফিসে এসে হাজির হয়েছে সে । তাই এই অফিসের মানুষজন তাকে চেনে । আজকে নাতাশা নেই । তাই আজকে একটু অস্বস্তি লাগছিলো ওর কাছে । বিশেষ করে কার সাথে দেখা করতে যাবে এটা সে কিভাবে বলবে?

রিসিপশনের মেয়েটা তানিয়ে দেখেই হাসলো । তারপর বলল, আজকে তো নাতাশা আপু আসেন নি অফিসে?
-জানি। আসলে আজকে অন্য আরেকজনের সাথে দেখা করতে এসেছি । জানি না সে আছে না কিনা এখনও?
-কে ?
-আপনাদের নতুন একজন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার এসেছে না, রেহান নাম?

রিসিপশনের মেয়েটা একটু কেমন চোখে তাকালো যেন। তারপর বলল, হ্যা আজকে এসেছে। এখনো আছে আমি যতদুর জানি। আপনাকে চিনে আপু?
তানিয়া কী বলবে ঠিক খুজে পেল না । রেহান ওকে নিশ্চিত ভাবেই চেনে না। চেনার কথাও না। তানিয়া বলল, ঠিক আমার চেনা না । নাতাশার চেনা। ওরা একই সাথে পড়াশোনা করেছে কলেজে। আজকে নাতাশা আসে নি তো । ওকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল । অন্য সময় হলে তানিয়া সরাসরি নাতাশার ডেস্কে চলে যেত তবে আজকে সেখানে যাওয়ার উপায় নেই । তানিয়া ওয়েটিং রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো । রেহান এল মিনিস পাঁচেক পরেই। তানিয়া রেহানের দিকে তাকিয়ে একটু বেশ স্বপ্রসন্ন হল । ছেলেটা দেখতে যে সুদর্শন সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । চেহারাতে একটা সৌম্য এবং ভদ্র ভাব রয়েছে। যেকোন মেয়ের প্রথম দেখাতে রেহানকে পছন্দ হবে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
রেহান তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি নাতাশার বন্ধু?
-হ্যা।
রেহান একটু হাসলো। তারপর সামনের চেয়ারে বসে পড়লো।
-আজকে তো নাতাশা আসে নি।
-হ্যা। আসে নি । আসলে ও আপনার কারণে আসে নি।
-আমার কারণে?
-হ্যা। আপনার কারণে । আসলে আপনার মুখোমুখি হতে পারছে না ও ।

রেহান কিছু সময় চুপ করে রইলো। তারপর বলল, গিল্টি ফিলিং থেকে?
-হ্যা।
-ওকে বলবেন যে গিল্টি ফিলিং না করতে । আমি ওর উপর রাগ করে নেই।
-ওর মনে হচ্ছে আপনি এখনও ওর উপর থেকে সরে আসতে পারেন নি। এই কারণে ওর নিজেকে বড় অপরাধি ভাবছে।

তানিয়া ভেবেছিলো যে রেহান হয়তো বললে যে ও কবেই মুভ অন করেছে । হয়তো বলবে ওর একটা প্রেমিকাও আছে। কিন্তু যখন তানিয়া রেহানের মুখের দিকে তাকালো তখন অবাক হয়ে খেয়াল করলো তার মুখের ভাবটা। তখন তানিয়ার কাছেও মনে হল যে এই ছেলে আসলেই মুভ অন করে নি ।
কী আশ্চর্য!

রেহান বলল, এটা সত্যি যে আমি……
কিছু যেন বলতে গিয়েও আটকে গেল সে । একটু সময় থামলো । তারপর বলল, আপনি প্লিজ ওকে বলবেন যে এটা একান্তই আমার নিজের সিদ্ধান্ত । এর কারণে ও যেন কোন ভাবেই নিজেকে দোষী না ভাবে ।
তানিয়া সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নাতাশা যা বলেছে সব সত্যি । মনের ভেতরে একটা তীব্র আকাঙ্খা জেগে উঠলো যে এমন একজন যদি ওকে ভালোবাসতো । অবশ্য সাথে সাথেই সেটা সরিয়ে দিল মন থেকে । রেহানের দিকে তাকিয়ে বলল, নাতাশাকে বলেছিলাম । বলেছিলাম যে এটা একান্তই আপনার নিজের ব্যাপার কিন্তু ও কোন ভাবেই নিজেকে সামতালে পারেনি । সমস্ত দোষ নিজেকে দিয়ে গেছে । যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন মাঝে মাঝে আপনার কথা সে বলবো ।
-বলতো ?
-হুম । আপনার সাথে ও যা করেছে সেটা ও ঠিক করে নি এই কথা বলতো প্রায়ই । এই অপরাধবোধ থেকে কোন ভাবেই সে বের হতে পারে নি । আপনি কি জানেন ও নিজেও কোন ছেলের সাথে আর সম্পর্কে জড়ায় নি ?
এই তথ্যটা রেহানের কাছে নতুন ছিল। খানিকটা আগ্রহ নিয়ে তাকালো তানিয়ার দিকে । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ওর পেছনে অনেকেই ঘুরেছে কিন্তু ও কাউকেই পাত্তা দেয় নি । আমার কেন জানি এখন মনে হচ্ছে আপনার কারণেই দেয় নি ।

কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না । আসলে কেউ ঠিক কথা খুজে পাচ্ছে না । এমন সময়ে তানিয়া বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?
-কী কাজ?
-আপনি আমার সাথে এখন চলুন আমাদের বাসায় !
-আপনার সাথে?
-হুম। নাতাশা নিশ্চিত ভাবে মন খারাপ করে বাসায় আছে । আপনি চলুন । ওর সাথে কথা বলুন । জীবন তো এভাবে চলতে পারে না । আপনিও একা রয়েছেন সেও একা রয়েছে । যদি আপনার আপনারা একসাথে হতে পারেন । মন্দ কী !

তানিয়া দেখতে পেল রেহানের মুখটা একেবারে চট করে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । অবশ্য সাথে সাথেই সেটা আবার মলিন হয়ে গেল । বলল, ও কী রাজি হবে?
-হলে হবে না হলে না হবে । আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী ! আমার মনে হয় যে ও আসলে নিজেও জানে না এই ব্যাপার । আর এটা কেবল ওর গিল্টি ফিলিং হতে পারে না ।
রেহান বলল, ওকে চলুন !

তানিয়া যখন চাবি দিয়ে দরজা খুলল তখন ওর নিজের কাছেই কেমন যেন একটা উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে । ও এখনও জানে না যে কী হবে । নাতাশার সাথে রেহানের কিছু একটা হয়েও যেতে পারে আবার নাও পারে । হয়তো নাতাশা রেহানের কাছে ফিরে যাবে অথবা ফিরিয়ে দেব ওকে । তানিয়া জানে না।

গল্পটা আমি এখানেই শেষ করলাম । তবে গল্প এখানে শেষ নয় । এই গল্পটার বাকী অংশ আপনারা লিখুন । এখানে রেহানের সাথে নাতাশার মিল দেখাতে পারেন আবার বিচ্ছেদও দেখাতে পারেন । আপনাদের মত করে লিখে পাঠান । যে লেখাটা সব থেকে বেশি পছন্দ হবে সেটা আমি এখানে এডিট করে বসিয়ে দিবো । লেখা পাঠাবেন আমার মেইলে: contact@oputanvir.com

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 43

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →