নিশুতি রাস্তায়
আমার প্রায় দিনেই বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায় । এমন না যে, আমি যেখানে কাজ করি সেখানে অনেক কাজের চাপ বরং আমি ইচ্ছে করেই সেখানে থেকে যাই । কেন যেন কর্ম ক্ষেত্রে থাকতে ভাল লাগে । বাসায় এমন কেউ নেই যে আমার জন্য অপেক্ষা করবে । তার চেয়ে বরং কাজই করে যাই । বছর চারেক আগে বাবা আর মা দুজনেই সবুজ শহরে থাকার কার্ড পেয়ে গেছে । তারা এখন সেখানে থাকে । আমি এখনও রেড সিটি ছাড়ার অনুমুতি পাইনি । জানি না আদৌও এই শহর ছেড়ে সবুজ শহরে যাওয়া হবে কি না ।
মা অবশ্য কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছিলো না । তার এক কথা, আমাকে ছেড়ে সে কিছুতেই যাবে না । তবে সে থাকতেও পারে নি । তাকে ঠিকই চলে যেতে হয়েছে । সিকটেক ফাইভ স্টেটের নিয়ম কানুণ খুবই কড়া । প্রতিটা নিয়ম সবাইকে কঠিন ভাবে মেনে চলতে হয় । নয়তো সারা জীবন এই রেড জোনেই জীবন কাটাতে হবে । মা অবশ্য তাতেও রাজি ছিল কিন্তু আমি জোর করে তাদের পাঠিয়ে দিলাম । এখন তাদের বয়স হয়েছে । জীবন ভর তারা অনেক কষ্ট করেছে, এখন একটু শান্তিতে থাকুক তারা ।
আর তাছাড়া প্রতি সপ্তাহে একদিন তো আমি যেতেই পারি তাদের কাছে । সেই অনুমুতি তো রয়েছেই । তারা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি অনেকটা একাই হয়ে গেছি বলতে গেলে । আগে প্রত্যেক সপ্তাহেই যাওয়া হত গ্রিন সিটিতে কিন্তু ইদানিং কেন জানি যাওয়া হয় না । মাসে একবার যাওয়া হয় কিংবা তারও কম । অবশ্য এর পেছনে অন্য একটা কারণও আছে ।
স্টোর হাউজ থেকে বের হতে হতে প্রায় রাত ১২টা বেজে গেল । আমি বাইকটা বের করে নিজের বাসার দিকে রওনা দিলাম । শুনশান নিরবতা চারিদিকে । এতো রাতে কারোই বাইরে থাকার অনুমুতি নেই কেবল মাত্র অল্প কিছু মানুষের বাদ দিয়ে, যাদের কাজ এই রাতের বেলা । আমার মাঝে মাঝে নাইট ডিউটি থাকে, তখন আমাকে এই রাতের বেলাতেই বাসা থেকে বের হতে হয় । আমার রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার অনুমুতি আছে ।
আমি শুনশান নিরব রাস্তা দিয়ে নিজের বাইক চালিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম । এই সময়টাতে নিয়ম কানুন একটু শিথিল হয়ে ওঠে । গার্ডেরা একটু ঝিমুতে থাকে । আমি পাশ দিয়ে চলে গেলেও দেখেও না দেখার ভান করে । মাঝে মাঝে নির্ধারিত গতিসীমা থেকে একটু বেশি তুলে ফেললেও তাই খুব একটা সমস্যা হয় না ।
আমার বাসাটা একেবারে শহরের শেষ মাথায় । পাকা রাস্তা পার করে আরও কিছুটা পথ যেতে হয় । তবে তার আগে বেশ খানিকটা পথ একেবারেই জনমানব শূন্য পথে চলতে হয় । শহরের শেষ মাথায় হওয়ার এখানে গার্ডও নেই । আমার মাঝে মাঝেই এই জায়গায় বাইক চালাতে একটু গা ঝমঝম করে । আমি এই রাস্তাটার নাম দিয়েছি নিশুতি রোড । এক মাত্র আমিই এই রাস্তাটা দিয়ে যাওয়া আশা করি । অবশ্য শহরের আরও কিছু লোক এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে তবে সেটা মাঝে খুব বেশি হলে এক কি দুইবার । আসলে এটা একটা বিকল্প পথ । অন্য দিক দিয়েও যাওয়া যায় । রাস্তাটা অন্য স্টেটের দিকে গেছে । তবে সেটা কোথায় আমরা এই শহরের মানুষ কেউ জানি না । আমাদের সেদিকে যাওয়ার কোন অনুমুতি নেই ।
অনেক বার ভেবেছি এখান থেকে চলে যাবো, আরও সামনের কোন জায়গাতে বাসা বানাবো কিন্তু কেন জানি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে নি । এখানেই এই নির্জনতার ভেতরেই আমার থাকতে ভাল লাগে ।
আমি যখন নিশুতি রাস্তার অর্ধেকটা পার করেছি তখনও একটা আলো মত দেখতে পেলাম সামনে । একটু ভয় হল মনের ভেতরে । এই দ্বাবিংশ শতাব্দিতে এসে রাতের বেলা আলো মত কিছু দেখে অন্য কিছু ভাবাটা খানিকটা হাস্যকরই শোনাবে ।
আমি আরও একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম যে কোন অলৌকিক কারনে আলোটা দেখা যাচ্ছে না । আগুন ধরেছে । আরও একটু কাছে যেতেই আবিস্কার করলাম যে আগুনটা এমনি এমনি ধরে নি । রাস্তার পাশে কোন যান বাহন এক্সিডেন্ট করেছে । সেখানে থেকে আগুনের সুত্রপাত । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে এতো রাতে তো কারো গাড়ি আসার কথা না । তাহলে ?
আমি যখন বাইকটা নিয়ে একেবারে কাছে চলে এলাম তখন সম্ভবত জীবনে সব থেকে অদ্ভুত আর লোমহর্ষক দৃশ্যটা দেখতে পেলাম । জ্বলতে থাকা গাড়ির আলো আর নিজের বাইকের হেড লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম জলন্ত গাড়ি থেকে কিছুটা দুরে একটা কালো লম্বা চুলের মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে । এবং সে তার নিজের হাত কামড়ে খাচ্ছে । আলো পড়তেই আমার দিকে তাকালো । তার মুখে লেগে থাকা রক্ত আমি পরিস্কার দেখতে পেলাম ।
একটা তীব্র ভয়ের স্রোত আমার পুরো শরীর বয়ে বয়ে গেল । মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো বাইক থামিও না । পালিয়ে যাও… পালিয়ে যাও …
নোভার আগমন
আমি পালানোর প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম । বাইকে ঘুরিয়ে সব থেকে কাছের স্টেশনে যেতে হবে আমাকে । যদিও সেটাও এখান থেকে বেশ খানিকটা দুরে । তবে আশার কথা হচ্ছে আমি বাইক টান দিলে পেছনে পরে থাকা মানুষটা আমাকে ধরতে পারবে না । কিন্তু যখনই আমি বাইকটা টান দিতে যাবো তখনই পেছন থেকে আওয়াজটা কানে এল ।
-হেল্প । প্লিজ হেল্প মি …
মেয়েটার কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে আমার মনে হল মেয়েটা আসলেই বিপদে পরেছে । যতই ভয় পাই না কেন এভাবে সাহায্যের আকুতি প্রত্যাক্ষান করা খুব সহজ কাজ নয় । আমি বাইকটা আবারও মেয়েটার দিকে ফিরালাম । ঠিক থামলাম মেয়েটার সামনে । মেয়েটা ততক্ষণে পাঁকা রাস্তার উপরে মুখ উল্টে পরে গেছে । দেখে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়েছে । আমি হাতের ক্ষতের দিকে ভাল করে তাকালাম । প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল মেয়েটা তার হাত কামড়ে খাচ্ছে কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা আসলে মেয়েটা কিছু যেন টেনে বের করতে চেয়েছে । মেয়েটার হাতের ভেতরে এমন কি থাকতে পারে যে যেটা সে টেনে বের করতে চেয়েছে ?
ঠিক তার পাশেই জিনিসটা খুজে পেলাম । ইঞ্চি দুয়েক লম্বা, পাতলা আর খানিকটা চ্যাপটা ! পাতলা জিনিসটা থেকে যে মৃদ্যু আলো জ্বলছে সেটা আমার চোখ এড়ালো না । যখন জিনিসটা চিনতে পারলাম তখন আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না !
মেয়েটার হাতে একটা ট্রাকিং ডিভাইস লাগানো ছিল ।
মানে কি ?
এই মেয়ে কে ?
তার হাতে কেন ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগানো থাকবে ?
নিয়ম অনুযায়ী কোন মানুষের শরীরের এমন কিছু সেট করা যাবে না যেটা দিয়ে তাকে ট্রাক করা যায় । সবার কাছে যোগাগাযের জন্য মোবাইল আছে সেটা থাকাই যথেষ্ঠ । কারো শরীরের ভেতরে কিছু স্থাপন করা মানে হচ্ছে তার স্বাধীনতা খর্ব করা, তার চলাচল সীমিত করা । এটা কোন ভাবেই হতে দেওয়া যাবে না । তাহলে এই মেয়েটার শরীরে এটা লাগানো ছিল কেন ?
আমার মন আবারও কু ডেকে উঠলো । মনের ভেতরে ডেকে কেউ যেন বলে উঠলো এখান থেকে ভালই ভালই কেটে পড় । বিপদে পড়বে !
কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে একা রাস্তার উপর ফেলে রেখে যেতে মন বলল না । আমি সবার আগে পা দিয়ে চাপ দিয়ে ডিভাইস টা নষ্ট করে ফেললাম । যে বা যারা মেয়েটার শরীরে এটা স্থাপন করেছিল তারা হয়তো চলেো আসতে পারে । মেয়েটা যেহেতু পালিয়ে এসেছে তাতে মেয়েটার আবার বিপদ না হয় ! আমি জলদি এখান থেকে কেটে পড়ার পরিকল্পনা করলাম ।
পরিকল্পনা খুব সহজ । আমি মেয়েটাকে বাইকে উঠিয়ে নিয়ে সব থেকে কাছের মেডিক্যাল সেন্টারে রেখে আসবো । ব্যাস আমার ঝামেলা শেষ।
আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে মেয়েটার হাতের ক্ষত স্থানে বেঁধে দিলাম । তারপর মেয়েটাকে একটু উঠানোর চেষ্টা করলাম । একটু উঠাতেই মেয়েটা কেমন নড়ে উঠলো । আমি বললাম
-চল তোমাকে মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাই ।
-না না না ! ওরা আমাকে ধরে ফেলবে । না, ধরে ফেলবে ।
-ওরা কারা ?
-ওরা ধরে ফেলবে। প্লিজ আমাকে বনের ভেতরে কোথাও রেখে আসুন অথবা এখান থেকে দুরে !
-কিন্তু আপনি আহত হয়েছেন ?
-সমস্যা নেই আমি ঠিক হয়ে যাবো । আমাকে দয়া করে এখান থেকে দুরে কোথায়ও রেখে আসুন প্লিজ ।
অন্য কেউ হলে হয়তো আমি এমনটাই করতাম কিন্তু আগেই বলেছি মেয়েটার কন্ঠে কিছু একটা আছে । যেটা আমাকে মেয়েটা কে এভাবে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে হল না । আমি বললাম
-আপনি বাইকে আমার পেছনে বসতে পারবেন ?
-মনে হয় পারবো ।
-আচ্ছা আসুন তাহলে ।
যদিও কাজটা ঠিক হচ্ছে না তবুও কিছু করার নেই । মেয়েটাকে কোন ভাবেই একখানে একা ফেলে চলে যাওয়া উপায় নেই । হয়তো মেয়ে নিষ্পাপ অথবা বড় কোন অন্যায় করেছে যার কারনে আমাকেও হয়তো বড় কোন বিপদে পড়তে হতে পারে কিন্তু আমি মেয়েটাকে একা রেখে চলে যেতে পারলাম না ।
বাসায় এসে মেয়েটার হাতে সবার আগে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিলাম । আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে মেয়েটা খানিকটা সামলে উঠেছে । একটু যে অবাক হলাম না তা বলবো না ! বিশেষ করে জ্বলন্ত গাড়িটার অবস্থা দেখে মনে হয়েছিলো গাড়িটা খুব জোড়ে কিছুর সাথে ধাক্কা লেগেছিলো কিংবা অন্য কিছু হয়েছিলো । এটো বড় এক্সডেন্ট সত্ত্বেও মেয়েটার শরীরের খুব বড় রকমের আঘাতের কোন চিহ্ন নেই । কেবল হাতের আঘাতটা ছাড়া ।
তবে মেয়েটার সাথে এখন কথা বলা ঠিক মনে করলাম না । মেয়েটা আগে একটু বিশ্রাম নিক । মেয়ের হাট মুখ থেকে রক্ত মুখে পরিস্কার করিয়ে দিলাম । তারপর তোয়ালে দিয়ে যকখন মেয়েটার মুখ মুছে দিয়ে তাকালাম মেয়েটার দিকে তখন ছোট খাটো মত একটা ধাক্কার মত খেলাম ।
মেয়েটার চেহারা খুবই সুন্দর । তবে খুব যেন পরিচিতও মনে হল । কোথায় দেখেছি ?
আরও কিছুটা সময় মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটাকে কোথায় দেখেছি আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না । শেষে মনে করা বাদ দিয়ে আমি টিভির ঘরের দিকে রওনা দিলাম । কাল আমার নাইট ডিউটি । একটু রাত করে টিভি দেখবো তারপর একটু বেলা করা ঘুমাবো । কালকে এই মেয়েকে নিয়ে কি করবো সেটা কাল ভাবা যাবে !
দরজাতে খুব জোরে কেউ আঘাত করছে । ঘুম ভাঙ্গার প্রথম কয়েক সেকেন্ড আমি বুঝতে পারলাম না আমি কোথায় আছি । কারণ প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে আমি সবার আগে যে দৃশ্যটা দেখি আজকে তেমন কিছু দেখছি না । কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য । নিজের ড্রয়িং রুমটা চিনতে পারলাম মুহুর্তেই ।
আমি টিভির ঘরে শোফার উপরে শুয়ে ছিলাম !
পর মুহুর্তেই সব মনে গেল । গত রাতে কি হয়েছিল, কেন আমি এখানে ?
মেয়েটা ?
মেয়েটা কেমন আছে ?
আমি যখনই নিজের শোবার ঘরের দিকে উঠতে যাবো তখনই আবারও দরজায় ধাক্কার আওয়াজ পেলাম । এবার আরও জোরে । আমার মনে হল যে আমি যদি এখনই দরজা না খুলি তাহলে বাইরে যারা আছে তারা দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়বে । আমি কোন মতে চিৎকার করে জানতে চাইলাম
-কে ?
দরজার বাইরে থেকে প্রায় সাথে সাথেই আওয়াজ এল
-পুলিশ ! দরজা খোল।
আমি আমার শোবার ঘরের দিকে যাওয়ার আর সুযোগ পেলাম না । জানি আর গিয়ে লাভও নেই । ওর এতো সময়ে নিশ্চয়ই আমার বাসার চারিপাশে ঘিরে ফেলেছে । আমি দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম । তবুও শেষ চেষ্টা করতে হবে ।
আমি দরজা খুলতেই কয়েকজন কালো পোষাক পরা সৈনিক আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো । আমার অনুমুতির তোয়াক্কা না করে ছড়িয়ে পড়তো বাসার ভেতরে ।
খাইছে আমারে, স্টেট পুলিশ !
রেড সিটির পুলিসের পোষাক লাল রংয়ের । আমি তো ভেবেছিলাম রেড পুলিশই আসবে কিন্তু এখানে তো স্টেট পুলিশ এসে হাজির । তার মানে অনেক বড় কোন ঝামেলা হয়েছে । ঐ মেয়েটা নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ না । আমি ধাক্কা খেয়ে যখন নিজেকে খানিকটা সামলেছি তখনই সামনে দাড়ানো লোকটার দিকে আমার চোখ গেল । আমি বেশ বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম ।
মনের ভেতরে প্রথম যে প্রশ্নটা উদোয় হল সেটা হচ্ছে এই লোকটা এখানে কি করছে ?
এই লোকের তো এখানে থাকার কথা না । মোটেই না । আমি আমার চিন্তা ভাবনা আবারও খানিকটা সুস্থির করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম । মনে হল আমি খুব বড় কোন ঝামেলাতে পড়তে যাচ্ছি, কিংবা এতো ক্ষনে আমি হয়তো পরেও গেছি ।
মেয়েটা আসলেই আমার বাসাতে নিয়ে আসা উচিৎ হয় নি ।
অবশ্য এই লোক অন্য কোন কাজেও আসতে পারে । আমার এই ভয়টা অনেক দিন থেকেই আছে । খুব বড় ধরনের কিছু অপরাধ আমি গোপনে করেছি । তা যদি ধরা পরে তাহলে আমাকে সারা জীবন ব্ল-থ্রী সাগরের কারাগারে কাটাতে হবে ।
আমার সামনে সিকটেক ফাইভ স্টেটের পুলিশ চিফ ইরোন আইভান দাড়িয়ে আছে । পুরো সিকটেক ফাইভ স্টেট এই লোককে জমের মত ভয় পায় । লোকে বলে প্রেসিডেন্টের পরেই এই লোক সব থেকে বেশি ক্ষমতাবান । যে কাউকে যখন তখন কোন কারণ দর্শানোর বাদ দিয়েও গায়েব করে দিতে পারে । কারো কাছে তার জবাবদিহি করতে হয় না ।
আমার মনে হল আমি সব কিছু এখনই বলে দেই । কিন্তু তখনই এই লোক আমাকে প্রশ্ন করবে যে আমি কেন তখন পুলিশকে খবর দেই নি । এটার কোন জবাব আমার কাছে নাই । তাহলে ?
ইরোন আইভান আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চুপচাপ হাটতে হাটতে আমার ঘরের শোফার উপর গিয়ে বসলেন । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । মনে হল যে সত্য কথাটা বলে ফেলাই ভাল । কিন্তু যখনই বলতে যাবো তখনই ভেতর থেকে সেই চারজন গার্ড ফিরে এল ।
পুলিশ চিফের দিকে তাকিয়ে বলল
-স্যর । ভেতরে কেউ নেই !
নেই !
আমি নিজেই খানিকটা চমকে গেলাম । তবে ওরা যখন খুজে পাই নি তখন নিশ্চয়ই মেয়েটা কোথাও পালিয়ে গেছে । যেতেই পারে !
আমি নিজের ভেতরে একটু ভারহীন অনুভব করলাম । তবে মনের ভেতর থেকে ভয়টা পুরোপুরি চলে গেল না । পুলিশ চিফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কাল তুমি বাসায় এসেছো কখন ?
-এই তো ১২টার দিকে !
-আসার পথে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছো ?
-ক-কই না তো ! অবশ্য এই রাস্তাটা খুব নির্জন । এখানে সব কিছুই অস্বাভাবিক লাগে ।
পুলিশ চিফ কোন কথা না বলে ঘরের চারিদিক দেখতে লাগলো । তারপর বলল
-এতো দুরে থাকো কেন ?
-এমনি স্যার । নির্জনতা ভাল লাগে !
-আচ্ছা !
তারপর সে উঠে পড়লো । আমার দিকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল
-এখানে আমার নাম্বার আছে । যদি সামান্যতম কোন কিছু অস্বাভাবিক লাগে তাহলে আমার সাথে সাথে ফোন করবে । ঠিক আছে ? খুব বড় একটা ঝালেমা হয়ে গেছে । যদি সঠিক ভাবে সাহায্য করতে পারো তাহলে একেবারে সোজা হোয়াইট সিটিতে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করবো আমি নিজে !
হোয়াইট সিটি !
হোয়াইট সিটি হচ্ছে আমাদের স্টেটের স্বর্গ বলা চলে । গ্রিন সিটির থেকে সেখানে উচ্চ লেভেলের লোকজনের বাস । শুনেছি সেখানে যারা থাকে তারা যা ইচ্ছে সব করতে পারে । এমন কোন কাজ নেই কিংবা তাদের এমন কোন ইচ্ছা নেই যা অপূর্ণ থাকে !
আমি কার্ডটা হাতে নিতে নিতে বললাম
-অবশ্যই । আমি কোন কিছু দেখতে পেলেই আপনাকে ফোন দিবো !
আমার সামনে দিয়ে ওরা যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো ঠিক তেমনি ঝড়ের বেগেই চলে গেল । আমি দরজার সামনে দাড়িয়ে থেকে ওদের চলে যাওয়া দেখলাম । তারপর দরজা বন্ধ করে নিজের শোবার ঘরের দিকে হাটা দিলাম ।
মনের ভেতরে চিন্তা কাজ করছে মেয়েটা গেল কোথায় ?
কোথায় যাবে ?
পুরো ঘর বাড়ি আবারও খুজে দেখলাম ।
নাহ কোথাও নেই । তাহলে কি দরজা খুলে কোন দিক দিয়ে বের হয়ে গেল ?
না এটা হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই ।
তাহলে ?
তখনই আমার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল । যদিও মন বলছিলো যে এটা হবার নয় । কিন্তু মেয়েটা অন্য কোন যায়গায় যাবে ?
আমি আমার শোবার ঘরের ওয়াল আলমারির কাছে গিয়ে হাজির হলাম । আলমারির একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে চাপ দিতেই আলমারিটা মৃদ্যু শব্দ করে খুলে গেল । একটা সিক্রেটর দরজা !
আমি আগেই বলেছিলাম আমি নিজে কিছু অন্যায় করেছি যেটা জানতে পারলে হয়তো আমাকে সারাটা জীবন ব্ল-থ্রী সাগরের কারাগারে কাটাতে হবে । আমার সেই অন্যায় গুলো এখান থেকে করা । মানে এখানে বসেই করা ।
আমি সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম । যা ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হল । মেয়েটা আমার পিসির সামনে বসে আছে । আমাকে আসতে দেখেই উঠে দাড়ালো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-ওরা চলে গেছে ?
আমি তখন অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি ! কাল রাতেই আমার কেন জানি মেয়েটার চেহারা একটু একটু পরিচিত মনে হচ্ছিলো । তবে কাল রাতের কারনে আমি ঠিক মত মেয়েটাকে চিন্তে পারি নি । কিন্তু এখন মেয়েটাকে চিন্তে পেরেছি !
কি হচ্ছে এসব আমার সাথে ?
স্টের পুলিশ চিফ ইরোন আইভান কেন এসেছিলো সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না ।
আরে এতো হোয়াইট প্যালেসের ভাবী প্রিন্সেস !
আগামী মাসেই প্রেসিডেন্ডের ছেলের সাথে এই মেয়ের বিয়ে হতে যাচ্ছে !
কিন্তু এই মেয়ে আমার এখানে কেন ?
কেন ?
আমি আমাদের স্টেটের সব থেকে নিখুত সুন্দরী মার্গারেট নাইরিনের সামনে দাড়িয়ে আছি অথবা মার্গারেট নাইরিন আমার সামনে দাড়িয়ে আছে । গতকালকে আমি মেয়েটাকে চিনতে না পারার কারন হচ্ছে মেয়েটার চুল কালো ছিল । কিন্তু মার্গারেটের চুলের রং সোনালী ! এ ছাড়া আর কোন দিক দিয়ে মেয়েটার সাথে মার্গারেটের কোন পার্থক্য নেই ।
আমি বললাম
-আপনি এখানে ?
-আসলে ওদের আওয়াজ পেয়েই আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল । পালাবো যে তার কোন উপায় ছিল না । শেষ উপায় না দেখে ওয়াল আলমারীর কাছে আসতেই কেন জানি মনে হল এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে । কয়েক মিনিটের ভেতরেই সিক্রেট দরজাটা খুজে পাই ।
আমি মুখ হা করে বললাম
-আপনি কিভাবে বুঝলেন ?
-জানি না । কেবল জানি যে জানি ! আর আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমার কোন কথা মনে পড়তে না । গত কালকের আগের কোন স্মৃতি আমার মনে পড়ছে না । কিছু না । কেবল কয়েকটা কথা বাদ দিয়ে !
-কি কথা ?
-আমাকে কয়েকটা লোকের কাছ থেকে পালাতে হবে আর একজনের কাছে যেতে হবে । আর কিছু না !
আমি খানিকটা সঙ্কিত গলায় বললাম
-আপনার নিজের নাম মনে আছে তো ?
-আমার নাম…. নোভা !
-আপনি কি শিওর যে আপনার নাম নোভা ?
-হ্যা ! আমি এটা নিশ্চিত । আমার স্মৃতিতে যা আছে তাতে আমার নাম নোভাই । অন্য কিছু না !
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । আমাদের স্টেটের সব থেকে সুন্দরী মেয়েটা এখন আমার সামনে দাড়িয়ে আছে অথচ সে নিজের নাম পর্যন্ত ঠিক মত মনে করতে পারতেছে না । আমার এখন কি করা উচিৎ ?
সিসটেক ফাইভ স্টেট
প্রাচীন কালে টমাস রবার্ট ম্যালথাস নামে একজন অর্থনীতিবিদ ও জনমিতিবিদ ছিলেন । তিনি অর্থনীতি ও জনসংখ্যা বিষয়ক ম্যালথাসের তত্ত্ব প্রদানের জন্য বিখ্যাতও হয়েছিলেন । সেই তত্ত্বানুসারে “খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে” । টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে এই তত্ত্ব প্রচার করেন । এই তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসংকট এমনকী দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী । এই কারণে ম্যালথাস মনে করতেন যে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য । জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা না-গেলে দুর্ভিক্ষ এবং নানান প্রকৃতিক কারণে মানুষ মারা পড়বে এবং এভাবেই জনসংখ্যা উল্লেখযেওগ্যভাবে হ্রাস পাবে ।
ঠিক এমনটাই হয়েছিল । তখন সালটা যতদুর জানি ২০৩৭ সাল । আমাদের পৃথিবীর জনসংখ্যা এতো বৃদ্ধি পেয়ে গেছে যে সেখানে মানুষের জন্য সঠিক ভাবে খাদ্য যোগান দেওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল । সেই সাথে প্রকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকতো । তখনকার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে পৃথিবীর ধারন ক্ষমতা থেকে লোকসংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ার কারনেই এমনটা হচ্ছে । তারপর সেই অন্তিম দিন এসে হাজির হল । পৃথিবীতে খুব বড় মাত্রায় ভুমিকম্প দেখা দিল । সব উচু উচু বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়লো । সেই সাথে এসে হাজির হল সুনামী । কতলোক যে মারা পড়লো সেটার কোন ঠিক নেই । আমি বই পত্র ঘেটে যতদুর জানতে পেরেছি সেখান থেকে জানতে পারে প্রথম ধাক্কায় প্রায় ৭০% মানুষ মারা যায় । এর পরে রোগে শোকে অনাহারে মারা যায় আরও অনেক মানুষ । শেষে মোটে ৫ শতাংশ মানুষ বেঁচে ছিল তখন । কিন্তু তারা ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ।
সেই সময়ে অল্প কিছু মানুষ বেঁচে ছিল তাদের ভেতরে জন সিসটেক নামের একলোক নিজের থেকে এগিয়ে এল পৃথিবীর বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে । গড়ে তুললো সেসটেক স্টেস । সব কিছু নিয়ম মত চলতে শুরু করলো । আগের পৃথিবী যে ভুল কাজ করেছিলো তারা সেই ভুল করলো না । জন্ম নিয়ন্ত্রন করা খুব কঠিন ভাবে । সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে কঠিন নিয়ম কার্যকর করা হল । এভাবে খুব ধীরে ধীরে সিসটেক স্টেট বৃদ্ধি পেতে লাগলো । পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে থাকা মানুষ গুলো আস্তে আস্তে এই সিসটেক শহরের দিকে আসতে লাগলো । যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন আরেকটা নতুন শহরের গোড়া পত্তন হয় এবং সেখানেও নতুন ভাবে সব শুরু হয় । প্রথম প্রথম অন্যান্য স্টেট গুলো নতুন স্টেসকে সাহায্য করে এবং সেটাকে স্বয়ংসম্পর্ণ করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে । এভাবেই আমাদের সিসটেক ফাইভ স্টেটের জন্ম । এভাবে চলে আসছে । এসব প্রায় আড়াইশ বছর আগের ইতিহাস !
নোভা আমার কথা শুনে চুপ করে রইলো । মেয়েটা নিজে যে মার্গারেট নাইরিন এই কথাটা ও কিভাবে ভুলে গেল আমি সেটা ঠিক এখনও বুঝতে পারে নি । মাথায় কি আঘাত লাগার কারনে এমনটা হয়েছে ? কিন্তু চুল সোনালী থেকে কালো কিভাবে হয়ে গেল এটাও বুঝতে পারছি না ।
আচ্ছা মেয়েটা কি তার বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে ?
অবশ্যই পালিয়ে এসেছে । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মেয়েটা কেন পালাবে ?
মেয়েটার বাবা বর্তমান সিসটেক সায়েন্স এন্ড বায়োটেক ইনস্টিটিউটের প্রধান ব্যক্তি । তার নিজেও ক্ষমতার শেষ নেই । তার নিজের মেয়ে এভাবে কিভাবে পালিয়ে যাবে ? এমন কী বিপদ হতে পারে ?
আমি নিজে চিন্তা করে কোন কুল কিনারা খুজে পেলাম না । তবে এসবের ভেতরে যে কোন ঝামেলা আছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না । আমি নোভাকে বললাম
-আপনার শেষ কি কথা মনে পড়ে আমাকে কি বলবেন ?
-আমি ঠিক জানি না । কেবল আমি যখন চোখ খুলি একজনকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি । সাদা এপ্রোন পরা ছিল । মুখেও একটা ফেসমাস্ক পরা ছিল । তবে সে যে আমারই মত কেউ ছিল যেটা আমি বুঝতে পারছিলাম । তার চুলের রং আমার মত ছিল না আর চোখ দুটো অন্যরকম ছিল । আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, তোমাকে খুব কঠিন একটা কাজ করতে হবে !
আমি জানি না আমার ভেতরে কি হল । আমি তার কথা শুনে বললাম, জি ! আমি নিজের ভেতরেই যেন অনুভব করতে পারছিলাম যে আসলেই আমাকে একটা কঠিন কাজ করার জন্য এই খানে নিয়ে আসা হয়েছে ।
সে বলল, তোমাকে এখন আমি কিছুই বলতেছি না তবে তুমি আস্তে আস্তে সব নিজেই বুঝতে পারবে যে তোমাকে আসলে কি করতে হবে ।
এইলাইন গুলো বলে নোভা চুপ করে রইলো ।
আমি জানতে চাইলাম, তারপর ?
-তারপর আমি যখন চোখ খুলি তখন দেখি আমি গাড়িতে চালাচ্ছি তবে সেটা সামলাতে পারছি না । আমার সিটের পেছনে কয়েকজন মানুষ পড়ে আছে । ওদের আর নিজের অবস্থা দেখে আমার কেবল মনে হচ্ছিলো আমার সাথে ওদের একটু আগে হাতাহাতি হয়েছে এবং আমি নিজেই ওদেরকে মেরে ফেলেছি । তারপর গাড়িটা একটা বড় গাছের সাথে ধাক্কা খায় । আমি ছিটকে বাইরে চলে আসি ।
তখনই আমার প্রথম যে কথাটা মনে পড়ে যে আমার হাতের ভেতরে কিছু একটা আছে এবং সেটা আমাকে বের করতে হবে । কিভাবে এই কাজটা করতে হবে আমাকে কেউ বলে দেই নি তবে আমি জানি যে আমাকে এই কাজটা করতে হবে । ব্যাস । আমি তাই করলাম । তার পরের ঘটনা তুমি জানো !
আমি কি বলবো নিজেই বুঝতে পারছি না । তাহলে কি মেয়েটা মার্গারেট নয় ?
কিন্তু …… আমি আর ভাবতে চাচ্ছি না । নোভাকে আমি দেখলাম নিজের হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলতে ! আমি হায়হায় করে এগিয়ে আসার আগেই খুলে ফেলল । তারপর আমার দিকে দেখালো ।
একদম ঠিক হয়ে গেছে !
এতো জলদি মেয়েটার শরীরের ক্ষত কিভাবে ঠিক হয়ে গেল ।
আমি বললাম
-এতো জলদি কিভাবে ঠিক হল ?
-জানি না । কেন এতো জলদি ঠিক হওয়ার কথা না ?
-কোন ভাবেই না । কাল যেভাবে তুমি কামড়ে তোমার হাত থেকে ওটা বের করেছিলে সেটা কোন ভাবেই এটো জলদি ঠিক হওয়ার কথা না ।
নোভাকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ মনে হল । আমি তো আগে থেকেই কনফিউজ হয়ে আছি । তবে মেয়েটার কথা শুনে মনে হচ্ছে এর পেছনে আসলেই বড় কোন কাহিনী আছে । আর মেয়েটার আচরনও খানিকটা অন্য রকম । এতো সময় আমি মেয়েটাকে আপনি করে বলছিলাম তাকে মার্গারেট ভেবে কিন্তু আপাতত সেটার উপরে আমার নিজের সন্দেহ দেখা দেয়েছে । তার উপরে তার হাতের ক্ষতটা এতো জ্বলদি সেরে ওঠাটাও কেমন মনে হচ্ছে ।
আমি ওর হাতটা আরেকটু ভাল করে দেখতে গিয়ে একটা জিনিস আবিস্কার করে ফেললাম । মেয়েটার হাতে কিছু লেখা আছে !
একটু অস্পষ্ট তবে বোঝা যাচ্ছে । দেখলাম নোভা নিজেও সেটা দেখতে পেয়েছে । ওর চোখেও কেমন একটা দৃষ্টি দেখতে পেলাম । আমি নিজে যেমন কিছু বুঝতে পারছি না মেয়েটাও নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপার গুলো কিছু বুঝতে পারছে না । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এটা কিসের সংকেত ? কি লেখা এখানে ?
-দাড়াও দেখতেছি ।
আমি সেলফের উপর থেকে ম্যাগনিফাইনিং গ্লাস টা নিয়ে এলাম ।
গ্রীন সিটিতে পদার্পণ
আজকে শনিবার। গ্রীন সিটিতে যাওয়ার দিন। সপ্তাহের এই একটা দিনে আমরা, রেড সিটির লোকেরা কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই গ্রীন সিটিতে যেতে পারি। বিশেষ করে যাদের অবস্থা আমার মত অর্থাৎ যাদের ফ্যামিলির সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন সিটিতে থাকে। এই বারটাতে আমার ভালই লাগবে বলতে গেলে বিশেষ করে মায়ের মুখটা দেখতে এই অনুভুতিটা অন্য রকম আনন্দময় হয়ে থাকে ।
কিন্তু আজকে খানিকটা চিন্তার ভেতরে আছি। আজকে কোন কিছু ঠিক স্বাভাবিক না । আজকে আমি কোন স্বাভাবিক কাজের জন্য যাচ্ছি না । মায়ের সাথেও আজকে দেখা করতে যাচ্ছি না । মাকে যখন ফোন করে বললাম যে এই শনিবার আমি আসতে পারবো না তখন মা খুব মন খারাপ করেছিলো । কিন্তু আমার কিছু করার নেই কারন না চাইতেও যে ঝামেলাতে আমি জড়িয়ে পরেছি সেটার শেষ না দেখে আমি ছাড়ছি না । আসলে আমি চাইলেই এই ঝামেলাটা শেষ করে ফেলতে পারে এক মুহুর্তেই । কেবল ফোন হাতে পুলিশ চিফ ইরোন আইভানকে ফোন করলেই ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে । আমি নিজে বাকি জীবনটা খুব সুখ আর শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবো ।
কিন্তু আমার কেন যেন এই শান্তিময় আর এক ঘেয়ে জীবনটা ভাল লাগে না । অন্যায় আর নিয়ম ভাঙ্গার ভেতরে একটা আলাদা উত্তেজনা আছে । অনেক দিন পরে আজকে আমি সেই উত্তেজনা অনুভব করছি !
এর আগে আমি যে অবৈধ কাজ করি নি সেটা বলব না তবে এই সে সবই ছিল কম্পিউটার ভিত্তিক, সব কাজ করেছি ঘরে বসেই। কিন্তু এই প্রথমবার আমি সরাসরি মাঠে নেমে এমন কো কাজ করতে যাচ্ছি। ধরা পরার সম্ভাবনা অনেক খানি । তাই এবারের উত্তেজনাও অনেক বেশি ।
আমি চোখ তুলে নোভার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। মেয়েটার মুখ প্রায় কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। কেবল চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেয়েদের লাইনে আস্তে আস্তে করে এগিয়ে যাচ্ছে । আমার আগেই সিকিউরিটি চেক পার হয়ে যাবে আশা করি। তারপর দুজনকে যেতে হবে একেবারে শেষ প্রান্তে। সেখানে একটা লোক কে আমাদের খুজে বের করতে হবে ।
আমরা কেবল একটা নাম জানি। রাভিস্কি ম্যারি । আগে হোয়াইট সিটির অধিবাসী ছিল কিন্তু এখন সে গ্রীন জোনে থাকে। ঠিক গ্রীন জোনেও না। হোয়াইট আর গ্রীন জোনের মাঝে খানিকটা নো-ম্যান্স ল্যান্ডের মত জায়গা আছে। এই লোক সেখানে থাকে। তাকে কেন ডিমশন দিয়ে নিচে নামানো হয়েছে কেউ বলতে পারে না। এই সব কথা যদিও আমার জানার কথা না তবুও আমি জানি। আরো এমন অনেক কিছুই আছে যা আমার জানার কথা না কিন্তু আমি জানি।
জীবনে আমি সব থেকে ভয়ংকর কাজটা করি মেইন কম্পিউটারের সার্ভারে প্রবেশ করে ডাটা উল্টে পাল্টে দিয়ে। অবশ্য নিজের বাবা মায়ের সুখের জন্য এরকম পদক্ষেপ যে কোন সন্তানই নিতে পারে। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় যে আমি অনেক বড় ঝুকি নিয়ে ফেলেছি। ধরা পরলে নিজের বিপদ তো হতোই আমার বাবা আর মায়ের অবস্থা কি হত আমি জানি না। তবে আমি খুশি যে তারা এখন ভাল আছে সুখে আছে। জীবনের শেষ একটা দিন তারা যে শান্তিতে থাকতে পারতেছে একটা আমার জন্য অনেক বড় একটা ব্যাপার।
আমি নোভাকে সিকিউরিটি বুথ দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখলাম। জানতাম ঝামেলা হবে না। সেরকম ভাবেই ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার প্লানে খুব একটা ফাঁক নেই । আমাদের সিকিউরিটি বুথে কোন মানুষ কিংবা গার্ড নেই । কেবল মাত্র সেখানে একটা স্কেন করার সিস্টেম আছে । সেখানে প্রবেশ করে হাতের ছাপ দিতে হয় । যদি সবুজ আলো জ্বলে ওঠে তাহলে সে প্রবেশ করতে পারে আর অনুমুতি না থাকলে সেখানে লাল বাতি জ্বলে ওঠে । তখন গার্ডটা ভেতর থেকে তাকে বাইরে বের করে দেয় । শনিবারে যাওয়ার জন্য অনুমুতি চাইলেই পাওয়া যায় ।
কাজটা করেছি খুব সহজ ভাবে । আমাদের স্টেশনে প্রায় একটা মেয়ে আসে, নাম সোমা আরিয়ান । তার মা অনেক দিন আগে মারা গেছে । গ্রীন সিটির আধিবাসি ছিল সে । তাই এখন তার খুব একটা যাওয়া হয়না গ্রিন সিটিতে । আমি সোমা আরিয়ানের হাতের ছাপ জোগার করেছি । সেটা একটা গ্লোভসে সেট করে নোভার হাতে সেট করে দিয়েছি । যখন নোভা হাতের ছাপটা দিয়ে স্ক্যানে দিবে তখন শোমার নাম উঠবে এবং সেটা গ্রিন দেখাবে । এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে সোমা যদি চলে আসে তখন ! এক মানুষ যখন দুবার স্ক্যান করবে তখন একটা ঝামেলা বেঁধে যাবে নিশ্চয়ই । আমি তাই যথা সম্ভব সকাল সকাল সকাল এসেছি এবং ওকে নিয়ে কেটে পড়লে পারলেই হল ।
যদিও সোমার জন্য একটু খারাপ লাগছে । মেয়েটা একটু বিপদে পড়ে যাবে । তবে সমস্যা হবে না আশা করি । যখন ওকে ঠিক মত চেক করা হবে তখন ওর কোন দোষ কেউ খুজে পাবে না । তখন ওকে ছেড়ে দিবে আশা করি ।
নোভার হাতে যে অক্ষর গুলো লেখা ছিল সেটা দেখে আমি আর নোভা দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেলাম । “নোভা সি/টু” । এই শব্দ দুটো ভাল করেই বোঝা যাচ্ছিলো তবে ম্যাগিফাইনিং গ্লাস দিয়ে ভাল করে লক্ষ্য করতেই আরও নতুন কিছু লেখা লক্ষ্য করলাম। ছোট আর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “ফাইন্ড রাভেস্কি ম্যারি“। রাভেস্কি ম্যারিকে খুজে বের করে। যে বা যারা নোভাকে এখানে পাঠিয়েছে সে বলছে রাভেস্কি নামের মানুষটাকে খুজে বের কর । তাহলে হয়তো নোভা এখানে কেন এসেছে কেনই বা নোভা কিছু মনে করতে পারছে না সেসব বুঝতে পারা যাবে । সে কি আসলেই মার্গারেট নাকি অন্য কেউ সেটাও জানা খুব জরুরী ।
আমি কম্পিউটারের বসে গেলেই রাভেস্কি ম্যারি খুজে বের করার জন্য। আমাদের পুরো সিটি একটা সেন্ট্রাল কম্পিউটার দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা হয়। প্রায় সব রকম তথ্য প্রায় সবার জন্যই উন্মুক্ত। এমনটা আসলে ধারনা তবে এমন অনেক কিছুই আছে যা সবার চোখের আড়াল করে রাখা হয়। আমি রাভেস্কি ম্যারির নাম ইম্পুট দিতেই এক্সেস ডিনাইড দেখালো। যদি এই নামে কোন তথ্য না থাকতো তাহলে সার্চ রেজাল্টে কিছুই আসতো না তবে এখানে এক্সেস ডিনাইড এসেছে এর অর্থ হচ্ছে সে আছে কিন্তু তার তথ্য সবার জন্য নয় ! এমন টা সাধারণত হয় যদি নিচের লেভেলের কেউ উপরের লেভেলের কারো তথ্য জানতে চায়। তখন অথোরাইজেশন চাওয়া হয়। তার মানে এই লোক সাধারণ কেউ না।
আমাকে এখন অন্য পথ বের করতে হবে । খুব বেশি সময় লাগার কথা না । আমি যখন প্রথমবার অবৈধ পথে মেইন কম্পিউটারে প্রবেশ করি তখন আমার বয়েস ছিল মাত্র পনেরো বছর । স্কুলের রেজাল্ট বের হওয়ার আগের দিন । আমি খুব ভাল করেই জানতাম আমার রেজাল্ট খুব ভাল হবে কিন্তু আমার মনে শান্তি ছিল না । কারণ আমি যদি স্কুলে টপ করি তাহলে সেই বয়সেই চলে যেতে হবে গ্রিন জোনে আরও উচ্চতর পড়ালেখার জন্য । এবং আমাকে যেতে হবে একা । আমার বাবা মা এখানেই থাকবে । তাই আমি সেদিন প্রথমে ঢুকেছিলাম সার্ভারে । খুব সুক্ষতার সাথে আমার নাম্বার গুলো নামিয়ে এনেছিলাম ।
আমি কাজ শুরু করতে যাবো তখনই নোভা বলল, কি করছো তুমি ?
-দেখা যাক ।
-আমি মনে হয় সাহায্য করতে পারবো ?
-মানে ?
নোভা কিছু না বলে আমাকে উঠে যেতে ইশারা করলো । আমি চেয়ার ছেড়ে দিলাম ওর জন্য । এরপর ও আমাকে অবাক করে অথোরাইজশোন কোড বক্সে কিছু সংখ্যা লিখলো । এন্টার চাপতেই অবাক হয়ে দেখলাম একটা পেইজ এসে হাজির ।
আমি কেবল অবাক হয়ে বললাম
-এটা তুমি কিভাবে করলে ?
-জানি না । কেবল মনে হল যে এখানে একটা কোড লিখলে কাজ হয়ে যাবে । আর এই কোড টা আমি জানি ।
কিছু কিছু হাই-প্রোফাইল মানুষদের আইডেন্টি ফিকেশনের জন্য আলাদা আলাদা নাম্বার আছে । সেগুলো এতোই ভি আইপি যে এই কোড যেকোন জায়গাতে ব্যবহার করলে সেটা এক্সেক করবে । এমন কি এই কোড ব্যাবহার করে ব্যাংক থেকে মিলিয়ন পরিমান মানি কারেন্সিও তুলে ফেলা সম্ভব !
আমি আরেকটু পরীক্ষার জন্য মার্গারেট নাম লিখে সার্চ দিলাম । যথারীতি সেই অথোরাইজেসন কোড চাইলো । আমি ওকে ওপেন করতে বলতে ও ওটাতেই সেই কোড টা লিখলো । এবং অবাক হয়ে দেখলাম প্রোফাইল টা খুলে গেছে ।
নিজের চেহারা আর নাম দেখে ও খানিকটা সময় বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো । একবার আমার দিকে আরেকবার কম্পিউটার মনিটরের দিকে চেয়ে রইলো । আমি ওকে কি বলবো ? আমার নিজের কাছেই তো এর কোন উত্তর নেই । আমি বললাম
-আচ্ছা আমরা এসব পরে ভাববো । এই রহস্য বের হয়ে যাবে আশা করি । আগের কাজ আগে করতে হবে ।
রাভেস্কি সাহেবের প্রোফাইল থেকেও আমরা তেমন কোন জানতে পারলাম না । যেন কেউ ইচ্ছে করে এই প্রোফাইলের অনেক তথ্য মুছে ফেলেছে । তবে যেটুকু জানার জেনে নিলাম ।
আমি আর নোভা সিকিউরিটি চেক শেষ করে গ্রিন সিটির রাস্তায় ক্যাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম । আমার মনটা পেছনে পরে আছে । বারবার মনে হচ্ছে আজকে যদি সোমা আরিয়ান চলে আসে তাহলে বিপদেই পড়তে হবে । একটা ক্যাব আসতে দেখে হাত নাড়লাম । সেটা আমাদের সামনে থেমে যেতেই চটপট উঠে পড়তে যাবো তখনই একটা লাল হুউসেল শুনতে পেলাম । বুঝলাম ঝামেলা শুরু হয়েছে । শোমা আজকে ঠিকই চলে এসেছে । একেই বলে কপাল । আমি চট জ্বলদি উঠে পড়লাম ক্যাবে । ক্যাবওয়ালাকে বললাম সোজা চালাতে । ক্যাবওয়ালা একটু ইতস্তর করলেও পরে আর কিছু না বলে এক্সেলেরটরে চাপ দিল ।