বাড়িটার সামনে এসে কিছু সময় মনটা দমে গেল । কিন্তু মন দমে গেলেও পেট দমবে না । পেটকে শান্ত আর ঠিকঠাক রাখতে আমাদের অনেক কাজ কর্ম করতে হয় । এই কাজটাও ঠিক তেমনই একটা । আমাকে এই বাড়িটার দারোয়ান হিসাবে কাজ করতে হবে । অবশ্য এর আগে আমি নাইটগার্ডের চাকরি করেছি । সারা রাত জেগে থেকে বাড়িঘর পাহারা দেওয়াটা খুব বেশি ঝামেলার মনে হয় নি। কিন্তু এই চাকরিতে বেতন খুব কম। এতো কম যে সেটা দিয়ে আমার একার জীবনই চলে না ঠিকমত । বাসায় টাকা পাঠাবো কী ! বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে পারলে ভাল লাগতো । যদিও আমার বাবা মা আমার জীবন দান ছাড়া আসলে আর কিছু করেনও নি । ছোট বেলা থেকেই যখন বুঝতে শিখেছি মানুষের লাথি গুটা খেয়ে বড় হয়েছি । আমার বাবা মায়ের কোন চিন্তা ছিল না যে আমি কিভাবে খাচ্ছি বেঁচে আছি আদৌও খেয়েছি কিনা । বেশির ভাগ দিনেই বাসায় কোন রান্না বান্না হত না । মানুষের বাড়িতে চেয়ে চিন্তে বেঁচে থেকেছি।
ঢাকা শহরে এসে কোন মতে জীবন পার করে দিচ্ছিলাম । তবে এখন জিনিসপত্রের দাম যেহারে বেড়ে যাচ্ছে সামান্য বেতনে আসলে টিকে থাকা সত্যিই কষ্টের হয়ে যাচ্ছে । তখনই ভাগ্য ক্রমে এই চাকরির খবরটা এল । খবরটা নিয়ে এল আমার সিকিউরিটি অফিসের একজন কর্মচারি । সে জানালো যে একটা বাড়ি আছে ঢাকা থেকে একটু দুরে । সেখানে দারোয়ানের কাজ করতে হবে । থাকা খাওয়া দিবে বাসা থেকেই । পুরো বেতনটাই রয়ে যাবে । সে এটাও জানালো যে কাজটা সেই করতো তবে বাড়িটা একটু নির্জনের দিকে । মানুষজন নেই একদম । থাকতে হবে একদম একা একা । এই কারণে সে করবে না । আমাকে সে দেখেছে সব সময় চুপচাপ থাকতে । কারো সাথে খুব একটা না মিশতে । তাই আমি চাইলে করতে পারি ।
সত্যিই তাই । আমার মানুষ জনের সাথে কথা বার্তা বলতে খুব একটা ভাল লাগে না । আমার খুব ভাল বন্ধু বান্ধব নেইও । আমি আপন মনেই থাকতে পছন্দ করি সব সময় । আমি রাজি হতেই সে আমাকে একটা মোবাইল নম্বর দিল । আমি সেদিনই সেই নম্বরে ফোন দিল । ফোনেই আমার চাকরি হয়ে গেল । সে আমাকে ঠিকানা বলে দিলো কিভাবে আসতে হবে । এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমার যাতায়াতের জন্য আমার বিকাশ নম্বর এক হাজার টাকাও পাঠিয়ে দিল । আমার মনে আর কোন দ্বিধা রইলো না । মনে মনে ঠিক করেই নিলাম যে এই বাসায় চাকরি করবো আমি ।
বাড়িটা উচু দেয়ালে ঘেরা । দুর থেকেই দুইতলা বাসাটার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিলো । বাড়ির ভেতরে অনেক গাছ পালা রয়েছে সেটা আমি বাইরে থেকেই বুঝতে পারছিলাম । বাড়িটার বিশাল বড় আর মজবুত গেট রয়েছে । গেটের ঠিক পাশের একটা ছোট জানালা । আর তার ঠিক পাশেই একটা দরজা । সেটাও লোহার । আমি গেটের সামনে দাড়িয়ে আমার নিয়োগ কর্তাকে ফোন দিলাম । তাকে জানালাম যে আমি চলে এসেছি ।
মিনিট পাঁচেক পরে গেট খোলার আওয়াজ এল । তবে মুল গেট খুলল না । ছোট জানালার পাশে যে দরজাটা ছিল সেটা খুলে গেল ফর্সা মত মানুষকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম । পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । বিশেষ করে আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে এই লোকটাই আমার নিয়োগ কর্তা । সে যে নিজেই এখানে আসবে সেটা আমি বুঝতে পারি নি ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিই জমির ?
-জ্বী স্যার ।
-এসো ভেতরে ।
এই বলে সে ভেতরে ঢুকে গেল । আমি ভেতরে ঢুকতেই একটু অবাক হলাম । দরজা দিয়ে ঢুকতেই আমি আরেকটা ঘরে ঢুকলাম । আসলে এটা দারোয়ানের ঘর । তবে ঘরটা দারোয়ানের জন্য বেশ বড় । ঘরের এক পাশে একটা ছোট বিছানা পাতা । তার পাশে টেবিল । সেখানে একটা ছোট টিভি দেখা যাচ্ছে । টেবিলের পাশ দিয়ে ছোট একটা পথ চলে গেল । বুঝতে পারলাম সেটা আরেকটা রুম ।
লোকটা বলল, ঐ যে ঘর দেখছো ঐটা দিয়ে ছোট রান্নাঘর আছে। আর ওখানেই ওয়াশরুম আছে । তবে রান্না করতে হবে না তোমাকে । প্রটিদিন সময় মত খাবার চলে আসবে । খাবার দিয়ে যাবে এই পথে বলেই সে সরে দাড়ালো ।
যে দরজা দিয়ে ঢুকেছি সেই দরজার উল্টোদিকে আরেকটা লোহার দরজার দেখতে পেলাম । সেই দরজার নিচের দিকের কিছুটা অংশ হাত দিয়ে উঠিয়ে দেখালেন । একটা খাবার ট্রেনে এই পথ দিয়ে অনায়াসে চলে আসবে । লোকটা বললেন, এই পথেই তোমাকে তিন বেলা খাবার দিয়ে যাবে । খাবারের জন্য ধাক্কা দিলে তুমি এই ছিটকানি খুলে খাবার নিবে ।
সেই ছোট অংশ টুকু কিভাবে খুলতে হয় সেটা দেখালো । লোকটা আবার বলল, তবে খবরদার দরজা খুলবে না কিন্তু । মনে থাকবে তো?
আমি ঘাড় কাত করে বললাম জ্বী আচ্ছা ।
লোকটা বলল, এবার আসি মুল গেট খোলা নিয়ে । লোকটা জানলার দিকটা ইশারা করলো । আমি দেখতে পেলাম যে জানালার দেয়াল লাগোয়া আরেকটা দেয়ালের ভেতর দিয়ে দুইটা স্টিলের চওড়া আর মোটা পাত পাত চলে এসেছে । সেই দিটো স্টিলের পাতে একটা বড় তালা দেওয়া । বুঝতে পারলাম যে এদের একটা পাত আসলে গেলের সাথে সংযুক্ত । এখানে তালা খুলে গেটটা ঠেলে খুলতে হয় ।
লোকটা বলল, তালা এখান থেকে খুলবে তারপর বাইরে গিয়ে গেট ঠেলে খুলে দিবে । এবং একই ভাবে ঠেলে বন্ধ করে ঘরের ভেতরে এসে বন্ধ করবে । মনে রাখবে কখনই ভেতরে ঢুকে দরজা খোলার চেষ্টা করবে না। মনে থাকবে তো?
-জ্বী স্যার থাকবে ।
-আর একটা কথা । আমার ফোন পাওয়া ছাড়া কখনই দরজা খুলবে না । দেশের প্রধানমন্ত্রী এসে বললেও না । বুঝতে পেরেছো?
-জ্বী স্যার ।
-এখন বিশ্রাম নাও। রান্নাঘরে চায়ের সরঞ্জাম রাখা আছে । রাতে জেগে থাকার জন্য চা খেতে পারো । আর টিভি দেখতে পারো । আবারও বলছি কখনই আমার ফোন ছাড়া মুল গেট খুলবে না আর ভুলেও রাতের বেলা এই ভেতরের গেট খুলবে না । এমন কি আমিও যদি তোমাকে দেয়ালের ওপাশ থেকে খুলতে বলি তখনও না । আগে আমাকে ফোন দিবে । ফোনে যদি বলি খুলতে তবে খুলবে । মনে থাকবে?
-জ্বী স্যার ।
তিনি আমার কাছে গেটের একটা চাবি ধরিয়ে দিলেন । তারপর ভেতরের দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন । আমি যখন দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম তখন টের পেলাম যে দরজাটা বেশ মজবুত । একজন দারোয়ানের জন্য বেশ ভাল ব্যবস্থা করা । আমার একটু অবাকই লাগলো । তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে খুবই পরিস্কার মনে হল যে লোকটা কোন ভাবেই চায় না যে আমি তার বাড়ির ভেতরে ঢুকি । যাক আমার এতো চিন্তা করে কাজ নেই । আমার কাজ বাড়ি পাহাড়া দেওয়া এবং মাস শেষে বেতন নেওয়া । অন্য কিছু নিয়ে আমার চিন্তা না করলেও চলবে ।
দুই
সন্ধ্যা নামার পরে চারিদিকটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল । আমি তখন বিছানাতে শুয়ে টিভি দেখছি । আর কোন আওয়াজ নেই । কোন দিকে কোন শব্দ নেই । এভাবে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে নয়টা বেজে গেছে সেটা আমি খেয়াল করি নি । ভেতরের দরজায় একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম । একটা লোকের কন্ঠ ।
দরজার ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, খাবার নিয়ে এসেছি।
আমি দ্রুত গিয়ে ছোট অংশ টুকু খুলে দিলাম । দেখলাম একটা ট্রে ভেতরে প্রবেশ করলো । ওপাশ থেকে আবার বলল, কাল সকালে নাস্তা দেওয়ার সময়ে এই থালা বাসন দিয়ে দিবেন ।
আমি ট্রের উপরে থাকা খাবার দেখে আরও খানিকটা অবাক হলাম । পর্যাপ্ত পরিমান ভাত । সেই সাথে মুরগির মাংস আর ডাল । সত্যই আমার একজন দারোয়ানের জন্য এমন আপ্যায়ন দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । খাবার দেখেই পেটের ভেতরের ক্ষুধাটা যেন একটু বেড়ে গেলে । খাওয়া শেষ করে যকখন আয়েশ করে একটু শুয়েছি বিছানাতে তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো । মালিক ফোন দিয়েছে । আমি সাথে সাথেই ফোন ধরলাম ।
-জ্বী স্যার ।
-খাওয়া শেষ ?
-জ্বী স্যার । দেখো এখনই একটা গাড়ি আসবে । গেট খুলে দাও । তারপর গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকবে । গাড়ি বের হয়ে যাওয়ার পরে আবারও গেট বন্ধ করে দিবে ।
-জ্বী ।
ফোন রাখার সাথে সাথে দেখলাম গাড়ির হর্ণ । আমি দ্রুত ভেতরের তালা খুলে বাইরে বের হয়ে এলাম। গেটে একটা বড় আলো জ্বলছে । সেই আলোতেই আমি গাড়িটাকে দেখতে পেলাম । একটা লাশবাসি ফ্রিজিং গাড়ি । আমি গাড়িটা দেখে বেশ চমকে গেলাম । এই গাড়ি এখানে কেন ? অবাক হয়ে যাওয়ার কারণে আমি খানিকটা সময় বিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। তবে চালকের হর্ণের শব্দ শুনে আবারও বাস্তবে ফিরে এলাম। দ্রুত গেটটা ঠেলে খুলে দিলাম ।
গেটটা খুলতেই আমাকে আরও একটু অবাক হতে হল । কারণ গেট দিয়ে যে রাস্তাটুকু গেছে সেটার দুইপাশে দেয়াল দেওয়া এবং উপরে লোহার খাঁচা দেওয়া । মোড় ঘুরের যাওয়ার অংশ আরও একটা গেট রয়েছে । গাড়িটা ভেতরে ঢুকে গেল । ঐ গেটের সামনে গিয়ে সেটা থামলো । একটু পরে সেটাও খুলে গেল । তখনও গেটের কাছে দাড়িয়ে ভাবছি । আসলে এই বাড়িতে এতো নিরাপত্তার কী হল ? কী এমন আছে এখানে সেটাই তো বুঝতে পারছি না ।
মিনিট দশেক পরে গাড়িটা বের হয়ে গেল। আমি গেট ঠেকে বন্ধ করে আবারও নিজের ঘরের ভেতরে চলে এলাম ।
আমি আবারও টিভি দেখতে শুরু করলাম । তবে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি আমার মনে নেই । রাতে কোন কিছুর আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ মেলে কিছু সময় আমি বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমি কোথায় আছি । কয়েক সেকেন্ড পরেই মনে পড়ে গেল যে আমি কোথায় আছি । একটু ধাতস্থ হতেই আমি ভাবার চেষ্টা করলাম যে কেন আমার ঘুম ভাঙ্গলো । যদিও আমার ঘুমানোর কথা ছিল না । আমি ঘুমিয়ে পরেছি । তারপর কোন কিছুর আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গেছে ।
কিসের আওয়াজ?
টিভির দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে সেটা তখনও চলছে । তবে টিভির আওয়াজ অনেক কমিয়ে দেওয়া । এখান থেকে কোন আওয়াজে ঘুম আমার ভাঙ্গবে না । তাহলে কিসের আওয়াজ এল?
তখনই আওয়াজটা পেলাম আমি । কান খাড়া করে আমি বসে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । আওয়াজটা শুনে আমার কাছে মনে হল যেন কোন বাঘ কিংবা নেকড়ে জাতীয় কোন প্রাণী দেয়ালের ঠিক ওপাশে মৃদু স্বরে আওয়াজ করছে । আমি কান খাড়া করেই বসে রইলাম । তবে আওয়াজটা আর হল না । কিছু সময় পরে সব কিছু চুপচাপ হয়ে গেল ।
আমি আমার মোবাইল ফোনটা চেক করে দেখলাম । সেখানে মালিকের কোন ফোন আসে নি । তার মানে কোন চিন্তা নেই । পুরো রাতটা আর কোন ঝামেলা ছাড়াই কেটে গেল । ভোরের দিকে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙ্গলো সেই খাবার ডাকে ।
দ্রুত হয়ে খাবার নিলাম সেই ছোট গেট দিয়ে । আর গতদিনের খাবারের ট্রে ফেরৎ দিলাম ।
ঠিক এভাবেই আমার দিন গুলো কাটতে লাগলো কোন ঝামেলা বিহীন ভাবে । এক সপ্তাহ পার করার পরেই আমি একটা রুটিনের ভেতরে চলে এলাম । প্রতিদিন রাত দশটার দিকে এই লাশবাহি ভ্যানটা এসে হাজির হয় । রাতে আর দরজা খুলতে হয় না । বাড়ির মালিক দুই একদিন পরপরই দিনের ভেতরে বের হন । তার বের হওয়ার জন্য আলাদা গাড়ি আছে । সকালের দিকের গাড়ি নিয়ে যান এবং বিকেলের দিকে ফিরে আসেন । এই সময়ে বাড়ির ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসে না । তবে আমার খাওয়া একদম ঠিক সময়ে হাজির হয় । আমি দশটার গাড়ি চলে গেলেই আর জেগে থাকি না । ঘুমিয়ে পড়ি ।
প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল । মোট ২০ হাজার টাকা দিয়েছে সে । আরও জানিয়েছে যে আমার কাজে সে খুবই সন্তুষ্ট । কয়েক মাস পরে আমার বেতন বাড়িয়ে দিবে । এতো সুখের চাকরি আমি কোন দিন পাবি সেটা আমি ভাবতেও পারি নি । তবে এটো কিছুর পরেও আমার মনে একটা দ্বিধা কিংবা সংকোচ রয়েই গেছে । আমি যদিও এখন আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়ি তবে মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি সেই জন্তুর আওয়াজটা ঠিকই শুনতে পাই । মনে হয় যেন জন্তুটা আমার ঘরের চারিপাশে ঘোরাফেরা করছে । আমার তখন বেশ ভয় লাগে । তবে ভয় লাগলেও এটা ঠিকই টের পাই যে আমি এই ঘরের ভেতরে বেশ নিরপদ । এই ঘর আর ঘরের দরজা গুলো বেশ মজবুত করে তৈরি করা । দেয়ালের ওপাশে যদি কোন জন্তু থাকেও সেটা বের হতে পারবে না । আমি নিজে নিজে একটা চিন্তা ভেবে নিয়েছি যে বাড়ির ভেতরে নিশ্চয়ই কোন বন্য প্রাণী আছে । বাঘ কিংবা নেকড়ে জাতীয় প্রাণী । আর ফ্রিজিং গাড়িতে সম্ভবত ঐ জন্তুর খাবার আসে । আর মালিক আমাকে এই কারণে দরজা খুলতে মানা করেছে ।
এভাবে চলল কিছু দিন । তারপরই রুটিনের একটু হেরফের হল । খাওয়া শেষ করে আমি অপেক্ষা করছি ফ্রিজিং গাড়ি আসার কিন্তু গাড়িটা এল না । দশটার সময় প্রতিদিন আসে কিন্তু সেদিন বারোটা বেজে গেল কিন্তু গাড়ির কোন খোজ নেই । আমি আরও একটা ঘন্টা অপেক্ষা করে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি তখনই তীব্র এক চিৎকার শুনতে পেলাম বাড়ির ভেতর থেকে। কেউ যেন মরন চিৎকার দিচ্ছে । আমার পুরো শরীর হিম হয়ে গেল । আমি কী করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কোন দিকে যাবো কিংবা কী করবো কিচুই মাথাতে এল না ।
ঠিক তার দুই মিনিট পরেই ঘটলো আসল ঘটনা । ভেতরে দরজা মানে যে দরজা দিয়ে খাবার আসে, সেই দরজার কাছে কাউকে দৌড়ে আসতে শুনলাম । তারপর সেখানে দমদম আওয়াজ হতে লাগলো । কেউ যেন খুব ব্যাথ আর কষ্ট নিয়ে দরজা খুলতে বলছে । আমার শিরদাড়া দিয়ে কেবল একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল । আমি কী করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ।
আমাকে মালিক একদম পরিস্কার কন্ঠে বলে দিয়েছে যে কোন ভাবেই যেন দরজা না খুলি ! কিন্তু দরজার ওপাশে যে রয়েছে সে ভয়ংকর কোন বিপদে পড়ে আছে । তাকে যদি আমি উদ্ধার না করি তাহলে কী হবে?
আমি যখন মনস্থির করেই ফেলেছি যে দরজা খুলবো তখনই একটা হিংস্র আওয়াজ শুনতে পেলাম । এবং সাথে সাথে সেই লোকটার চিৎকারের আওয়াজ । আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে সেই জন্তুটা লোকটাকে কামড় দিয়েছে । লোকটা চিৎকার করেই চলেছে । ব্যাথা আর্তনাদ করেই চলেছে এবং সাথে সাথে আমি সেই জন্তুটার কামড়ের আওয়াজও শুনতে পেলাম । কোন বাঘ কিংবা সিংহ যেমন করে মাংস হাড় কামড়ে ধরে ঠিক সেই রকম আওয়াজ। একটা সময় লোকটার আওয়াজ কমে গেল । তবে সেই হিংস্র আওয়াজটা বন্ধ হল না । সেটা হতেই লাগলো । জন্তুটা যে মানুষটাকে খাচ্ছে সেই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই ।
আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম । বারবার মনে হচ্ছিলো দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু সাথে সাথে মনে হচ্ছিলো আমি এই ঘর থেকে বের হলেই বুঝি জন্তুটা আমাকে চেপে ধরবে । আমাকেও খেয়ে ফেলবে । তবে একটা সময়ে খাওয়ার আওয়াজ কমে এল । এবং আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে সেই জন্তুটা ঠিক দরজার ওপাশেই বসে আছে । ওটার ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম ।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করে । আমি প্রবল কৌতুল হল নিচে ট্রে নেওয়ার স্থান দিয়ে দরজার ওপাশে তাকালাম । এবং যা দেখলাম তা দেখে চোখ আমার কপালে উঠলো । দেখতে পেলাম আমার মালিক আমার ঠিক দরজার ওপাশেই পরে আছে । তার সারা সরিরে রক্ত লেগে আছে । সে একেবারে নগ্ন হয়ে আছে ।
আমি আর কিছু না ভেবে দ্রুত দরজা খুলে তার কাছে গেলাম । সে তখন অচেতন হয়ে পড়ে আছে । তার শরীর বেশ ভারী । তাকে চেনে নিয়ে যেতে আমার ঘাম ছুটে গেল । আমার বাথরুমে নিয়ে তাকে পরিস্কার করালাম । তারপর তাকে কোন মতে আমার বিছানাতে এনে শুইছে দিলাম । দুপুরের দিকে তার জ্ঞান ফিরলো । আমার দিকে কিছু সময় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো । তারপর একটা কথা বলে উঠে চলে গেল ।
পরিশিষ্টঃ
এখন আমার দায়িত্ব বেড়ে অনেক । অবশ্য বেতনও বেড়েছে । সন্ধ্যা হতেই এখন আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হয় । মুল বাড়িটা তালা দিয়ে বন্ধ করতে হয় । এই বাড়িতে এই একটা তালা দিলেই আর বের হওয়ার কোন উপায় নেই তালা ভাঙ্গা ছাড়া । এরপর যখন ফ্রিজিং গাড়িতে করে মাংস আছে সেটা নিয়ে নিজ হাতে গ্রিল দিয়ে ভেতরে ছুড়ে ফেলতে হয় । কোন কোন দিন মাংস ছুড়ে ফেলতে ফেলতেই জন্তুটা এসে হাজির হয় । তবে মজবুত গ্রিল থাকার কারণে সেটা বের হতে পারে না । তবে তার নজর থাকে মাংসের দিকে । তাই গ্রিল ভাঙ্গার চেষ্টা সে করে না । তবে মাসের ভেতরে এক কী দুইদিন মাংস আমি ভেতরে না ছড়িয়ে দিয়ে বাগানে ছড়িয়ে দিই আগে আগেই । সেদিন ড্রাইভারকে বলাই থাকে যেন সন্ধ্যা বেলা মাংস নিয়ে আসে । আর সেদিন গ্রিলে তালাও মারি না । সেই দিন সারা রাত আমার ঘরের চারিপাশে কোন হিংস্র জন্তু ঘোরাফেরা করে । মাঝে মাঝে ভয়ংকর ডাক দেয় । যদিও আমার বুক কেঁপে ওঠে তবে আমি জানি এই দেয়াল কিংবা দরজা ভেঙ্গে সে ভেতরে আসতে পারবে না ।
সচারাচর অন্য গল্প থেকে আলাদ। তবে কাহিনীটা চমৎকার, চাইলে আরো কঠিন করা যেন।