হিংস্র শ্বাপদ

oputanvir
4.5
(31)

বাড়িটার সামনে এসে কিছু সময় মনটা দমে গেল । কিন্তু মন দমে গেলেও পেট দমবে না । পেটকে শান্ত আর ঠিকঠাক রাখতে আমাদের অনেক কাজ কর্ম করতে হয় । এই কাজটাও ঠিক তেমনই একটা । আমাকে এই বাড়িটার দারোয়ান হিসাবে কাজ করতে হবে । অবশ্য এর আগে আমি নাইটগার্ডের চাকরি করেছি । সারা রাত জেগে থেকে বাড়িঘর পাহারা দেওয়াটা খুব বেশি ঝামেলার মনে হয় নি। কিন্তু এই চাকরিতে বেতন খুব কম। এতো কম যে সেটা দিয়ে আমার একার জীবনই চলে না ঠিকমত । বাসায় টাকা পাঠাবো কী ! বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে পারলে ভাল লাগতো । যদিও আমার বাবা মা আমার জীবন দান ছাড়া আসলে আর কিছু করেনও নি । ছোট বেলা থেকেই যখন বুঝতে শিখেছি মানুষের লাথি গুটা খেয়ে বড় হয়েছি । আমার বাবা মায়ের কোন চিন্তা ছিল না যে আমি কিভাবে খাচ্ছি বেঁচে আছি আদৌও খেয়েছি কিনা । বেশির ভাগ দিনেই বাসায় কোন রান্না বান্না হত না । মানুষের বাড়িতে চেয়ে চিন্তে বেঁচে থেকেছি।

ঢাকা শহরে এসে কোন মতে জীবন পার করে দিচ্ছিলাম । তবে এখন জিনিসপত্রের দাম যেহারে বেড়ে যাচ্ছে সামান্য বেতনে আসলে টিকে থাকা সত্যিই কষ্টের হয়ে যাচ্ছে । তখনই ভাগ্য ক্রমে এই চাকরির খবরটা এল । খবরটা নিয়ে এল আমার সিকিউরিটি অফিসের একজন কর্মচারি । সে জানালো যে একটা বাড়ি আছে ঢাকা থেকে একটু দুরে । সেখানে দারোয়ানের কাজ করতে হবে । থাকা খাওয়া দিবে বাসা থেকেই । পুরো বেতনটাই রয়ে যাবে । সে এটাও জানালো যে কাজটা সেই করতো তবে বাড়িটা একটু নির্জনের দিকে । মানুষজন নেই একদম । থাকতে হবে একদম একা একা । এই কারণে সে করবে না । আমাকে সে দেখেছে সব সময় চুপচাপ থাকতে । কারো সাথে খুব একটা না মিশতে । তাই আমি চাইলে করতে পারি ।

সত্যিই তাই । আমার মানুষ জনের সাথে কথা বার্তা বলতে খুব একটা ভাল লাগে না । আমার খুব ভাল বন্ধু বান্ধব নেইও । আমি আপন মনেই থাকতে পছন্দ করি সব সময় । আমি রাজি হতেই সে আমাকে একটা মোবাইল নম্বর দিল । আমি সেদিনই সেই নম্বরে ফোন দিল । ফোনেই আমার চাকরি হয়ে গেল । সে আমাকে ঠিকানা বলে দিলো কিভাবে আসতে হবে । এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমার যাতায়াতের জন্য আমার বিকাশ নম্বর এক হাজার টাকাও পাঠিয়ে দিল । আমার মনে আর কোন দ্বিধা রইলো না । মনে মনে ঠিক করেই নিলাম যে এই বাসায় চাকরি করবো আমি ।

বাড়িটা উচু দেয়ালে ঘেরা । দুর থেকেই দুইতলা বাসাটার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিলো । বাড়ির ভেতরে অনেক গাছ পালা রয়েছে সেটা আমি বাইরে থেকেই বুঝতে পারছিলাম । বাড়িটার বিশাল বড় আর মজবুত গেট রয়েছে । গেটের ঠিক পাশের একটা ছোট জানালা । আর তার ঠিক পাশেই একটা দরজা । সেটাও লোহার । আমি গেটের সামনে দাড়িয়ে আমার নিয়োগ কর্তাকে ফোন দিলাম । তাকে জানালাম যে আমি চলে এসেছি ।

মিনিট পাঁচেক পরে গেট খোলার আওয়াজ এল । তবে মুল গেট খুলল না । ছোট জানালার পাশে যে দরজাটা ছিল সেটা খুলে গেল ফর্সা মত মানুষকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম । পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । বিশেষ করে আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে এই লোকটাই আমার নিয়োগ কর্তা । সে যে নিজেই এখানে আসবে সেটা আমি বুঝতে পারি নি ।

আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিই জমির ?
-জ্বী স্যার ।
-এসো ভেতরে ।
এই বলে সে ভেতরে ঢুকে গেল । আমি ভেতরে ঢুকতেই একটু অবাক হলাম । দরজা দিয়ে ঢুকতেই আমি আরেকটা ঘরে ঢুকলাম । আসলে এটা দারোয়ানের ঘর । তবে ঘরটা দারোয়ানের জন্য বেশ বড় । ঘরের এক পাশে একটা ছোট বিছানা পাতা । তার পাশে টেবিল । সেখানে একটা ছোট টিভি দেখা যাচ্ছে । টেবিলের পাশ দিয়ে ছোট একটা পথ চলে গেল । বুঝতে পারলাম সেটা আরেকটা রুম ।
লোকটা বলল, ঐ যে ঘর দেখছো ঐটা দিয়ে ছোট রান্নাঘর আছে। আর ওখানেই ওয়াশরুম আছে । তবে রান্না করতে হবে না তোমাকে । প্রটিদিন সময় মত খাবার চলে আসবে । খাবার দিয়ে যাবে এই পথে বলেই সে সরে দাড়ালো ।

যে দরজা দিয়ে ঢুকেছি সেই দরজার উল্টোদিকে আরেকটা লোহার দরজার দেখতে পেলাম । সেই দরজার নিচের দিকের কিছুটা অংশ হাত দিয়ে উঠিয়ে দেখালেন । একটা খাবার ট্রেনে এই পথ দিয়ে অনায়াসে চলে আসবে । লোকটা বললেন, এই পথেই তোমাকে তিন বেলা খাবার দিয়ে যাবে । খাবারের জন্য ধাক্কা দিলে তুমি এই ছিটকানি খুলে খাবার নিবে ।
সেই ছোট অংশ টুকু কিভাবে খুলতে হয় সেটা দেখালো । লোকটা আবার বলল, তবে খবরদার দরজা খুলবে না কিন্তু । মনে থাকবে তো?
আমি ঘাড় কাত করে বললাম জ্বী আচ্ছা ।
লোকটা বলল, এবার আসি মুল গেট খোলা নিয়ে । লোকটা জানলার দিকটা ইশারা করলো । আমি দেখতে পেলাম যে জানালার দেয়াল লাগোয়া আরেকটা দেয়ালের ভেতর দিয়ে দুইটা স্টিলের চওড়া আর মোটা পাত পাত চলে এসেছে । সেই দিটো স্টিলের পাতে একটা বড় তালা দেওয়া । বুঝতে পারলাম যে এদের একটা পাত আসলে গেলের সাথে সংযুক্ত । এখানে তালা খুলে গেটটা ঠেলে খুলতে হয় ।
লোকটা বলল, তালা এখান থেকে খুলবে তারপর বাইরে গিয়ে গেট ঠেলে খুলে দিবে । এবং একই ভাবে ঠেলে বন্ধ করে ঘরের ভেতরে এসে বন্ধ করবে । মনে রাখবে কখনই ভেতরে ঢুকে দরজা খোলার চেষ্টা করবে না। মনে থাকবে তো?
-জ্বী স্যার থাকবে ।
-আর একটা কথা । আমার ফোন পাওয়া ছাড়া কখনই দরজা খুলবে না । দেশের প্রধানমন্ত্রী এসে বললেও না । বুঝতে পেরেছো?
-জ্বী স্যার ।
-এখন বিশ্রাম নাও। রান্নাঘরে চায়ের সরঞ্জাম রাখা আছে । রাতে জেগে থাকার জন্য চা খেতে পারো । আর টিভি দেখতে পারো । আবারও বলছি কখনই আমার ফোন ছাড়া মুল গেট খুলবে না আর ভুলেও রাতের বেলা এই ভেতরের গেট খুলবে না । এমন কি আমিও যদি তোমাকে দেয়ালের ওপাশ থেকে খুলতে বলি তখনও না । আগে আমাকে ফোন দিবে । ফোনে যদি বলি খুলতে তবে খুলবে । মনে থাকবে?
-জ্বী স্যার ।
তিনি আমার কাছে গেটের একটা চাবি ধরিয়ে দিলেন । তারপর ভেতরের দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন । আমি যখন দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম তখন টের পেলাম যে দরজাটা বেশ মজবুত । একজন দারোয়ানের জন্য বেশ ভাল ব্যবস্থা করা । আমার একটু অবাকই লাগলো । তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে খুবই পরিস্কার মনে হল যে লোকটা কোন ভাবেই চায় না যে আমি তার বাড়ির ভেতরে ঢুকি । যাক আমার এতো চিন্তা করে কাজ নেই । আমার কাজ বাড়ি পাহাড়া দেওয়া এবং মাস শেষে বেতন নেওয়া । অন্য কিছু নিয়ে আমার চিন্তা না করলেও চলবে ।

দুই
সন্ধ্যা নামার পরে চারিদিকটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল । আমি তখন বিছানাতে শুয়ে টিভি দেখছি । আর কোন আওয়াজ নেই । কোন দিকে কোন শব্দ নেই । এভাবে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে নয়টা বেজে গেছে সেটা আমি খেয়াল করি নি । ভেতরের দরজায় একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম । একটা লোকের কন্ঠ ।
দরজার ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, খাবার নিয়ে এসেছি।
আমি দ্রুত গিয়ে ছোট অংশ টুকু খুলে দিলাম । দেখলাম একটা ট্রে ভেতরে প্রবেশ করলো । ওপাশ থেকে আবার বলল, কাল সকালে নাস্তা দেওয়ার সময়ে এই থালা বাসন দিয়ে দিবেন ।

আমি ট্রের উপরে থাকা খাবার দেখে আরও খানিকটা অবাক হলাম । পর্যাপ্ত পরিমান ভাত । সেই সাথে মুরগির মাংস আর ডাল । সত্যই আমার একজন দারোয়ানের জন্য এমন আপ্যায়ন দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । খাবার দেখেই পেটের ভেতরের ক্ষুধাটা যেন একটু বেড়ে গেলে । খাওয়া শেষ করে যকখন আয়েশ করে একটু শুয়েছি বিছানাতে তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো । মালিক ফোন দিয়েছে । আমি সাথে সাথেই ফোন ধরলাম ।
-জ্বী স্যার ।
-খাওয়া শেষ ?
-জ্বী স্যার । দেখো এখনই একটা গাড়ি আসবে । গেট খুলে দাও । তারপর গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকবে । গাড়ি বের হয়ে যাওয়ার পরে আবারও গেট বন্ধ করে দিবে ।
-জ্বী ।

ফোন রাখার সাথে সাথে দেখলাম গাড়ির হর্ণ । আমি দ্রুত ভেতরের তালা খুলে বাইরে বের হয়ে এলাম। গেটে একটা বড় আলো জ্বলছে । সেই আলোতেই আমি গাড়িটাকে দেখতে পেলাম । একটা লাশবাসি ফ্রিজিং গাড়ি । আমি গাড়িটা দেখে বেশ চমকে গেলাম । এই গাড়ি এখানে কেন ? অবাক হয়ে যাওয়ার কারণে আমি খানিকটা সময় বিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। তবে চালকের হর্ণের শব্দ শুনে আবারও বাস্তবে ফিরে এলাম। দ্রুত গেটটা ঠেলে খুলে দিলাম ।

গেটটা খুলতেই আমাকে আরও একটু অবাক হতে হল । কারণ গেট দিয়ে যে রাস্তাটুকু গেছে সেটার দুইপাশে দেয়াল দেওয়া এবং উপরে লোহার খাঁচা দেওয়া । মোড় ঘুরের যাওয়ার অংশ আরও একটা গেট রয়েছে । গাড়িটা ভেতরে ঢুকে গেল । ঐ গেটের সামনে গিয়ে সেটা থামলো । একটু পরে সেটাও খুলে গেল । তখনও গেটের কাছে দাড়িয়ে ভাবছি । আসলে এই বাড়িতে এতো নিরাপত্তার কী হল ? কী এমন আছে এখানে সেটাই তো বুঝতে পারছি না ।
মিনিট দশেক পরে গাড়িটা বের হয়ে গেল। আমি গেট ঠেকে বন্ধ করে আবারও নিজের ঘরের ভেতরে চলে এলাম ।

আমি আবারও টিভি দেখতে শুরু করলাম । তবে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি আমার মনে নেই । রাতে কোন কিছুর আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ মেলে কিছু সময় আমি বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমি কোথায় আছি । কয়েক সেকেন্ড পরেই মনে পড়ে গেল যে আমি কোথায় আছি । একটু ধাতস্থ হতেই আমি ভাবার চেষ্টা করলাম যে কেন আমার ঘুম ভাঙ্গলো । যদিও আমার ঘুমানোর কথা ছিল না । আমি ঘুমিয়ে পরেছি । তারপর কোন কিছুর আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গেছে ।
কিসের আওয়াজ?
টিভির দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে সেটা তখনও চলছে । তবে টিভির আওয়াজ অনেক কমিয়ে দেওয়া । এখান থেকে কোন আওয়াজে ঘুম আমার ভাঙ্গবে না । তাহলে কিসের আওয়াজ এল?
তখনই আওয়াজটা পেলাম আমি । কান খাড়া করে আমি বসে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । আওয়াজটা শুনে আমার কাছে মনে হল যেন কোন বাঘ কিংবা নেকড়ে জাতীয় কোন প্রাণী দেয়ালের ঠিক ওপাশে মৃদু স্বরে আওয়াজ করছে । আমি কান খাড়া করেই বসে রইলাম । তবে আওয়াজটা আর হল না । কিছু সময় পরে সব কিছু চুপচাপ হয়ে গেল ।
আমি আমার মোবাইল ফোনটা চেক করে দেখলাম । সেখানে মালিকের কোন ফোন আসে নি । তার মানে কোন চিন্তা নেই । পুরো রাতটা আর কোন ঝামেলা ছাড়াই কেটে গেল । ভোরের দিকে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙ্গলো সেই খাবার ডাকে ।
দ্রুত হয়ে খাবার নিলাম সেই ছোট গেট দিয়ে । আর গতদিনের খাবারের ট্রে ফেরৎ দিলাম ।

ঠিক এভাবেই আমার দিন গুলো কাটতে লাগলো কোন ঝামেলা বিহীন ভাবে । এক সপ্তাহ পার করার পরেই আমি একটা রুটিনের ভেতরে চলে এলাম । প্রতিদিন রাত দশটার দিকে এই লাশবাহি ভ্যানটা এসে হাজির হয় । রাতে আর দরজা খুলতে হয় না । বাড়ির মালিক দুই একদিন পরপরই দিনের ভেতরে বের হন । তার বের হওয়ার জন্য আলাদা গাড়ি আছে । সকালের দিকের গাড়ি নিয়ে যান এবং বিকেলের দিকে ফিরে আসেন । এই সময়ে বাড়ির ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসে না । তবে আমার খাওয়া একদম ঠিক সময়ে হাজির হয় । আমি দশটার গাড়ি চলে গেলেই আর জেগে থাকি না । ঘুমিয়ে পড়ি ।

প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল । মোট ২০ হাজার টাকা দিয়েছে সে । আরও জানিয়েছে যে আমার কাজে সে খুবই সন্তুষ্ট । কয়েক মাস পরে আমার বেতন বাড়িয়ে দিবে । এতো সুখের চাকরি আমি কোন দিন পাবি সেটা আমি ভাবতেও পারি নি । তবে এটো কিছুর পরেও আমার মনে একটা দ্বিধা কিংবা সংকোচ রয়েই গেছে । আমি যদিও এখন আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়ি তবে মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি সেই জন্তুর আওয়াজটা ঠিকই শুনতে পাই । মনে হয় যেন জন্তুটা আমার ঘরের চারিপাশে ঘোরাফেরা করছে । আমার তখন বেশ ভয় লাগে । তবে ভয় লাগলেও এটা ঠিকই টের পাই যে আমি এই ঘরের ভেতরে বেশ নিরপদ । এই ঘর আর ঘরের দরজা গুলো বেশ মজবুত করে তৈরি করা । দেয়ালের ওপাশে যদি কোন জন্তু থাকেও সেটা বের হতে পারবে না । আমি নিজে নিজে একটা চিন্তা ভেবে নিয়েছি যে বাড়ির ভেতরে নিশ্চয়ই কোন বন্য প্রাণী আছে । বাঘ কিংবা নেকড়ে জাতীয় প্রাণী । আর ফ্রিজিং গাড়িতে সম্ভবত ঐ জন্তুর খাবার আসে । আর মালিক আমাকে এই কারণে দরজা খুলতে মানা করেছে ।

এভাবে চলল কিছু দিন । তারপরই রুটিনের একটু হেরফের হল । খাওয়া শেষ করে আমি অপেক্ষা করছি ফ্রিজিং গাড়ি আসার কিন্তু গাড়িটা এল না । দশটার সময় প্রতিদিন আসে কিন্তু সেদিন বারোটা বেজে গেল কিন্তু গাড়ির কোন খোজ নেই । আমি আরও একটা ঘন্টা অপেক্ষা করে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি তখনই তীব্র এক চিৎকার শুনতে পেলাম বাড়ির ভেতর থেকে। কেউ যেন মরন চিৎকার দিচ্ছে । আমার পুরো শরীর হিম হয়ে গেল । আমি কী করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কোন দিকে যাবো কিংবা কী করবো কিচুই মাথাতে এল না ।

ঠিক তার দুই মিনিট পরেই ঘটলো আসল ঘটনা । ভেতরে দরজা মানে যে দরজা দিয়ে খাবার আসে, সেই দরজার কাছে কাউকে দৌড়ে আসতে শুনলাম । তারপর সেখানে দমদম আওয়াজ হতে লাগলো । কেউ যেন খুব ব্যাথ আর কষ্ট নিয়ে দরজা খুলতে বলছে । আমার শিরদাড়া দিয়ে কেবল একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল । আমি কী করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ।
আমাকে মালিক একদম পরিস্কার কন্ঠে বলে দিয়েছে যে কোন ভাবেই যেন দরজা না খুলি ! কিন্তু দরজার ওপাশে যে রয়েছে সে ভয়ংকর কোন বিপদে পড়ে আছে । তাকে যদি আমি উদ্ধার না করি তাহলে কী হবে?
আমি যখন মনস্থির করেই ফেলেছি যে দরজা খুলবো তখনই একটা হিংস্র আওয়াজ শুনতে পেলাম । এবং সাথে সাথে সেই লোকটার চিৎকারের আওয়াজ । আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে সেই জন্তুটা লোকটাকে কামড় দিয়েছে । লোকটা চিৎকার করেই চলেছে । ব্যাথা আর্তনাদ করেই চলেছে এবং সাথে সাথে আমি সেই জন্তুটার কামড়ের আওয়াজও শুনতে পেলাম । কোন বাঘ কিংবা সিংহ যেমন করে মাংস হাড় কামড়ে ধরে ঠিক সেই রকম আওয়াজ। একটা সময় লোকটার আওয়াজ কমে গেল । তবে সেই হিংস্র আওয়াজটা বন্ধ হল না । সেটা হতেই লাগলো । জন্তুটা যে মানুষটাকে খাচ্ছে সেই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই ।

আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম । বারবার মনে হচ্ছিলো দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু সাথে সাথে মনে হচ্ছিলো আমি এই ঘর থেকে বের হলেই বুঝি জন্তুটা আমাকে চেপে ধরবে । আমাকেও খেয়ে ফেলবে । তবে একটা সময়ে খাওয়ার আওয়াজ কমে এল । এবং আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে সেই জন্তুটা ঠিক দরজার ওপাশেই বসে আছে । ওটার ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম ।

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করে । আমি প্রবল কৌতুল হল নিচে ট্রে নেওয়ার স্থান দিয়ে দরজার ওপাশে তাকালাম । এবং যা দেখলাম তা দেখে চোখ আমার কপালে উঠলো । দেখতে পেলাম আমার মালিক আমার ঠিক দরজার ওপাশেই পরে আছে । তার সারা সরিরে রক্ত লেগে আছে । সে একেবারে নগ্ন হয়ে আছে ।
আমি আর কিছু না ভেবে দ্রুত দরজা খুলে তার কাছে গেলাম । সে তখন অচেতন হয়ে পড়ে আছে । তার শরীর বেশ ভারী । তাকে চেনে নিয়ে যেতে আমার ঘাম ছুটে গেল । আমার বাথরুমে নিয়ে তাকে পরিস্কার করালাম । তারপর তাকে কোন মতে আমার বিছানাতে এনে শুইছে দিলাম । দুপুরের দিকে তার জ্ঞান ফিরলো । আমার দিকে কিছু সময় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো । তারপর একটা কথা বলে উঠে চলে গেল ।

পরিশিষ্টঃ

এখন আমার দায়িত্ব বেড়ে অনেক । অবশ্য বেতনও বেড়েছে । সন্ধ্যা হতেই এখন আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হয় । মুল বাড়িটা তালা দিয়ে বন্ধ করতে হয় । এই বাড়িতে এই একটা তালা দিলেই আর বের হওয়ার কোন উপায় নেই তালা ভাঙ্গা ছাড়া । এরপর যখন ফ্রিজিং গাড়িতে করে মাংস আছে সেটা নিয়ে নিজ হাতে গ্রিল দিয়ে ভেতরে ছুড়ে ফেলতে হয় । কোন কোন দিন মাংস ছুড়ে ফেলতে ফেলতেই জন্তুটা এসে হাজির হয় । তবে মজবুত গ্রিল থাকার কারণে সেটা বের হতে পারে না । তবে তার নজর থাকে মাংসের দিকে । তাই গ্রিল ভাঙ্গার চেষ্টা সে করে না । তবে মাসের ভেতরে এক কী দুইদিন মাংস আমি ভেতরে না ছড়িয়ে দিয়ে বাগানে ছড়িয়ে দিই আগে আগেই । সেদিন ড্রাইভারকে বলাই থাকে যেন সন্ধ্যা বেলা মাংস নিয়ে আসে । আর সেদিন গ্রিলে তালাও মারি না । সেই দিন সারা রাত আমার ঘরের চারিপাশে কোন হিংস্র জন্তু ঘোরাফেরা করে । মাঝে মাঝে ভয়ংকর ডাক দেয় । যদিও আমার বুক কেঁপে ওঠে তবে আমি জানি এই দেয়াল কিংবা দরজা ভেঙ্গে সে ভেতরে আসতে পারবে না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 31

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “হিংস্র শ্বাপদ”

  1. সচারাচর অন্য গল্প থেকে আলাদ। তবে কাহিনীটা চমৎকার, চাইলে আরো কঠিন করা যেন।

Comments are closed.