চারু (শেষ ভাগ)

oputanvir
4.9
(62)

আগের পর্ব

026

সময়টা বিকেল । অন্যান্য দিন হলে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে এই সময়টা লোকজনে একেবারে সমাগম থাকতো । তবে আজকে চিত্র একেবারে ভিন্ন । বসুন্ধরার সিটির সামনে আজকে একদম লোকজন নেই । এমন কি মুভির জন্য কোন লোকজনকেও ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না । গাড়ি প্রবেশ মুখেই বড় বড় বন্ধের সাইণবোর্ডটা দেখা যাচ্ছে ।

চারু প্রধান রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো । ভেবেছিলো অন্যান্য মানুষের মত ওকে থামানো হবে । তবে অবাক হয়ে দেখলো কেউ ওকে থামালো না । এমন একটা ভাব করলো যে ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না ।

চারু মুল শপিং সেন্টারে ঢোকার আগে সিড়িতে একটু থামলো । ভেতরে ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা সে জানে না । চাইলে এখনই সে ঘুরে চলে যেতে পারে । এখানে সে কেন এসেছে সেটাও তার নিজের কাছে পরিস্কার না । আজকে চারুর টিউশনি ছিল না । এমন দিন গুলোতে ক্লাস শেষ করে চারু খাওয়া শেষ করে কিছুটা সময় বিছানাতে গড়াগড়ি করে । আজও তেমন করেই বিছানাতে শুয়ে ছিল । তখনই মনে হল সে স্বপ্ন দেখতে পেল যে বসুন্ধরা সিটির কোন অন্ধকার ফ্লোরে লোকটা বসে রয়েছে । সামনে কিছু একটা জ্বলছে । আর ঠিক তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আরিয়ান । আরিয়ানের ঘুমন্ত চেহারা দেখে সে অবাক হয়ে গেল ।
ঐ লোকটা আরিয়ানকে ধরে নিয়ে এসেছে । ব্যাপারটা মোটেও চারুর হজম হল না । হতে পারে না । কেউ এই কথা বিশ্বাস করবে না ।
কিন্তু চারুর কেন জানি এই কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে । সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে গেল চারুর । চোখ মেলে কিছু সময় সে তাকিয়ে রইলো সিলিংয়ের দিকে ।

একবার মনে হল যে ব্যাপারটা সে পুরোপুরি এড়িয়ে যায় । এমন কিছু আসলে হতেই পারে না । আকিব বলেছিলো যে আরিয়ান আহমেদের সিকিউরিটি খুবই শক্ত । সে খুবই সাবধানী । এই কথা সে নিজেও জানে । পিউয়ের ঘটনার সময় যখন সে আরিয়ানের বাসায় গিয়েছিলো নিজ চোখেই সে দেখতে পেয়েছিলো । কোন মানুষের পক্ষে আরিয়ানকে এভাবে বের করে নিয়ে একেবারে অসম্ভব একটা ব্যাপার !
এমন করে বুঝ দিচ্ছিলো নিজের মনকে । কিন্তু চারু কিছু সময় পরে বুঝতে পারলো যে এভাবে সে শান্তি পাবে না । তারপর যে কাজটা মোটেও করা উচিৎ নয় কিংবা অযৌক্তিক সেই কাজটাই সে করলো । পোশাক পরে তৈরি হয়ে বের হল বসুন্ধরা সিটির দিকে । শপিং সেন্টারের সামনে এসে বুঝতে পারলো কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার এখানে ঘটেছে । নয়তো এমন দিনে এই শপিংসেন্টার বন্ধ থাকার কোন কারণ নেই ।

আরও লম্বা একটা দম নিয়ে চারু শপিং সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলো । গ্রাউন্ডফ্লোর দিয়ে হাটতে শুরু করলো । এর আগেও অনেক বার সে এই শপিং সেন্টারে এসেছে । লোকজন যখন থাকে, দোকান পাট যখন খোলা থাকে তখন পরিবেশ থাকে একেবারে অন্য রকম । অথচ এখন সব দোকান পাট বন্ধ থাকায় কেমন যেন একটা মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে । চারুর শরীরটা যেন একটু ছমছম করে উঠলো । তৃৃতীয় তলাতে উঠতেই চারুর মনে হল যেন সে একেবারে অন্য জগতে চলে এল । ঢাকার একেবারে প্রাণকেন্দ্র অবস্থিত এই শপিং সেন্টারটা । বাইরে যখন ছিল তখন একেবারে কোলাহল গাড়ির হর্ন সহ আরও কত আওয়াজ ছিল কিন্তু এখানে যেন সব কিছু একেবারে শান্ত আর নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে ।

চারু এবার চতুর্থ তলাতে উঠলো না । কেন উঠলো না সেটা সে নিজেই জানে না । ওর কাছে মনে হল যে আর উপরে উঠতে হবে না । ডান দিকে করিডোরের দিকে পা বাড়ালো । সারি সারি বন্ধ দোকান । দুটো করিডোর পার হয়ে মোড় দিতেই একেবারে জমে গেল চারু । একে বারে স্বপ্নে যেমনটা দেখেছিলো সে তেমন করেই একটা লোকটা আসন গেড়ে বসে আছে । তার সামনে আগুন জ্বলছে । তার তার ঠিক পাশেই পড়ে আছে একটা যুবক । এতো দুর থেকে চেহারা না দেখেও চারু ঠিক ঠিক জানে যে মানুষটা আরিয়ান । তাহলে লোকটা সত্যিই আরিয়ানকে এভাবে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে ।

লম্বা করিডোরে পা দিতেই লোকটা চোখ মেলে তাকালো । এতো দুর থেকেও চোখ দুটো স্পষ্ট দেখতে পেল চারু । ওকে দেখেই লোকটা হাসলো । তারপর বলল, চলে এসেছো । আমি ভাবি নি প্রথম বারেই তুমি খবর পেয়ে যাবে । এসো এদিকে এসো ।
চারু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে ।

027

চারিদিকের সব কিছু যেন থেমে গেছে । চারুর মনে হল যেন এই দুনিয়াতে সামনের লোকটা সে আর আরিয়ান ছাড়া আর কোন জীবিত মানুষ নেই । চারিদিকে করবের নিস্তব্ধতা কাজ করছে । চারু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে । আরেক পা ফেলতে যাবে তখনই ওর কানের কাছে কেউ যেন বলে উঠলো, সাবধান । বৃত্তের ভেতরে ঢুকো না ।
চারু থেমে গেল সাথে সাথে । তারপরই দেখতে পেল বৃত্তটা । ওকে থেমে যেতে লোকটা বলল, এসো ।
চারু এবার গলা ঊচু করে বলল, আপনি জানেন আমি এখন এখান থেকে চলে যেতে পারি । এবং আমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসার ক্ষমতা নেই । এই জন্য আপনি আরিয়ানকে টোপ হিসাবে নিয়ে এসেছেন । ওয়েল আপনি জানেন যে আরিয়ানের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই । ইভেন সে নিজে আমাকে একবার ধরে নিয়ে গিয়েছিলো নিজের কাজ করানোর জন্য । তাকে টোপ হিসাবে কেন ব্যবহার করলেন আমি ঠিক বুঝলাম না ।
চারুর মনে হল ওর কথা শুনে লোকটা কিছু সময়ের জন্য যেন একটু দ্বিধান্বিত হল । তবে তারপরেই বলল, আমার তো তা মনে হয় না । এই ডন তোমার জন্য কেয়ার করে । তোমার নিরাপত্তার জন্য সে লোক লাগিয়েছে । তুমি যেখানে যেখানে যাও সব খানে । এমন কি তোমার বাবা মায়ের বাসার সামনেও ।

এই তথ্যটা চারুর কাছে নতুন ছিল । সে একটু চমকালো । তবে মুখে কিছু প্রকাশ করলো না । লোকটা আবার বলল, আমার মনে হয় তোমার কিছু না কিছু যায় আসে । এই জন্যই তো তুমি এখানে এসেছো । তাই না ? দেখো ডিল খুব সহজ । তুমি বৃত্তের ভেতরে ঢুকবে । আমি এই ডনকে ছেড়ে দেব সে চলে যাবে । আমি কথা দিচ্ছি যে তোমার কোন ক্ষতি হবে না ।তোমার ভেতরে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ন কিছু আছে যার জন্য আমি অনেক গুলো বছর অপেক্ষা করছি । সেটা নিয়ে নেওয়ার পরে তুমি তোমার পথে আমি আমার পথে ।
-আমি ঠিক বুঝলাম না । আর আমার ভেতরে যদি গুরুতপূর্ণ কিছু থেকেো থাকে সেটা আপনাকে কেন দিবো আমি ?
-কেন তুমি তোমার এই অভিশাপটা দুর করতে চাও না?

চারু একটু যেন থমকে গেল । অভিশাপ মানে লোকটা কী বলতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে চারুর মোটেও কষ্ট হল না ।
হ্যা চারু সব সময় চেয়েছে অন্য সব ছেলে মেয়েদের মত স্বাভাবিক থাকতে । এই বিশেষ ক্ষমতাটা সে মোটেও চায় নি । সে খুবই স্বাভাবিক হতে চেয়েছে । প্রথমবার যখন ওর দ্বারা ওর বাসার কুকুরটা প্রায় মরে গিয়েছিলো সেদিন থেকেই সে বারবার চেয়েছে যেন এই অস্বাভাবিক ক্ষমতাটা তার না থাকে । তারপর স্কুলের ঐ দপ্তরির কোমাতে চলে যাওয়ার পরে নিজেকে সে অভিশপ্ত মনে করে এসেছে । সবার কাছ থেকে দুরে থেকেছে । এমন কী নিজের বাবা মায়ের কাছ থেকেও সে দুরে দুরে থেকেছে । বারবার মনে হয়েছে যে হয়তো যে কোন ভাবে সে তাদের ক্ষতি করে ফেলবে । তাই কোন কাছের বন্ধুও সে বানাতে সাহস করে নি । কাউকে ভালোবাসতেও সাহস করে নি । এমন কি নিজের এই অস্বাভাবিকত্ব নিয়ে কাউকে কিছু বলতেও সাহস করে নি ।

চারু বলল, আমার সাথে কি আপনি ঠোট্টা করছেন? আপনি জানেন আমি চাইলে এখনই আপনাকে মেরে ফেলতে পারি?
-হ্যা জানি তো ! তবে আপাতত আমি খানিকটা সংঙ্কা মুক্ত আছে । তুমি চাইলেও আমার কাছে আসতে পারবে না । এই যে দেখছো এখানে একটা বৃত্ত আঁকা রয়েছে । এটা আমার রক্ষা কবজ, এটার ভেতরে তোমার ঐ শক্তি প্রবেশ করতে পারবে না । চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারো !
চারুর কেন জানি মনে হল লোকটা সত্য কথা বলছে । তাই আলাদা ভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে চাইলো না ।
চারু বলল, আপনি যখন এই ডনকে ধরে নিয়ে আসতে পেরেছেন, চাইলে আমাকেও তো ধরে নিয়ে আসতে পারতেন । এভাবে ঘুরে বিপদ মোড় নেওয়ার দরকার ছিল কী ?
লোকটা আবারও হাসলো । তারপর বলল, না না । তোমাকে আসলে এভাবে ধরে আনা সম্ভব ছিল না । তোমাকে স্বাভাবিক ভাবে ধরে নিয়ে আসতে চাইলে এই ডনের লোক আমাকে বাঁধা দিতো আর যদি আমি আমার কালো বিদ্যা প্রয়োগ করতাম তাহলে তাহলে তোমার ভেতরের ঐ শক্তিটা আমাকে বাঁধা দিতো ! তোমার উপর কেউ অস্বাভাবিক জাদু প্রয়োগ করলেই ওটা এসে হাজির হবে। 

-লাইক মাই গার্ডিয়ান এঞ্জেল !

-অনেক টা । ঐটাঈ তোমার সকল শক্তির উৎস ।

-কে ও?

-আমাদের হাতে এতো সময় নেই চারু । আমাকে কাজ শুরু করতে হবে ।

-আমার প্রশ্নের জবাব ছাড়া আমি আপনার কোন কাজে সম্মতি জানাবো না । 

দুইজনের ভেতরে বেশ কিছু সময় দৃষ্টি বিনিময় হল । হার মানলো লোকটাই । আচ্ছা আমি তোমাকে সব কিছু বলবো । একবার তুমি বৃত্তের ভেতরে ঢুকলে, কিছুটা সময় পাওয়া যাবে । তখন তোমাকে সব কিছু বলবো । 

-ওকে তাহলে আগে আরিয়ানকে যেতে দিন । ওর নিরাপদ দুরত্বে গেলে আমি ভেতরে ঢুকবো ।

লোকটা খানিকটা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও রাজি হল । হাতের একটা আঙ্গুলের ইশারা করতেই আরিয়ান নড়ে চড়ে উঠলো। তার কিছু সময় পরেই উঠে বসলো । 

028

আরিয়ান চোখ মেলে খানিকটা সময় সঠিক ভাবে কোন কোন কিছুই বুঝতে পারছিলো না । তার পরিস্কার মনে আছে জেরিন তার অফিস রুমে ঢুকেছিলো কফির কাপ নিয়ে । তারপর হঠাৎ করেই ঘরের আপমাত্রা এবং আলো কমে আসে । একটা সময়ে একদম অন্ধকার হয়ে আসে । তারপর আরিয়ানের আর কিছু মনে নেই । এখন চোখ মেলে আরিয়ান চারুকে দেখতে পেল ওর সামনে ।
ওর ঠিক সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । ওর মাথার ভেতরে ঠিক মত কাজ করছে না । এখন ও কোথায় আছে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছে না ।
চারুকে সামনে দেখে আরিয়ান বলল, আমি কোথায় আছি ?
-এটা বসুন্ধরা সিটি ।
-এখানে কিভাবে এলাম আমি?
-লম্বা গল্প । সেটা এখন বলার সময় নেই ।
এই বলে চারু আরিয়ানের হাত ধরলো । ওকে উঠতে সাহায্য করলো ।
আরিয়ান নিজেকে সামলে নিলো একটু পরেই । চারু ছাড়াও করিডোরে অন্য লোকটাকে দেখতে পেল তারপরেই । ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুখে হাসিহাসি ভাব নিয়ে । লোকটাকে চিনতে আরিয়ানের কয়েক সেকেন্ড লাগলো । এই লোকটাই যে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে সেটার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । সাথে সাথে একটা তীব্র রাগ এসে জড় হল আরিয়ানের মনে । ইচ্ছে হল যে এখনই লোকটাকে সে খুন করে ফেলে । কিন্তু চারু ওর সামনে এসে দাড়ালো । তারপর আরিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন এটার সময় না । এই পুরোটা এখনও তার আয়ত্তে রয়েছে । আপনি কিছুই করতে পারবেন না । পরে সময় পাবেন । এখন আপাতত চলে যান । প্লিজ । আমার জন্য ও আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে । প্লিজ চলে যান এখন।

আরিয়ান কিছু সময় চারুর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর আস্তে আস্তে করিডোর দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল । একটা ব্লক পার হতেই আরিয়ানের চিন্তা ভাবনা একদম পরিস্কার হয়ে এল । একটু আগেও সে পরিস্কার ভাবে চিন্তা করতে পারছিলো না যেন । মাথার উপরে একটা চাপ অনুভব করছিলো । কিন্তু এখন মাথাটা একদম পরিস্কার হয়ে গেছে । এখন সবার আগে ওর নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। হাতের স্মার্টফোনের সুইচটা টিপে দিল সে । ওকে নিতে খুব জলদিই মানুষ চলে আসবে । এই ঘড়ি দিয়েই ওকে ট্র্যাক করবে ওর সিকিউরিটি টিম ।

আরিয়ান আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করলো । পুরো মার্কেটটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে আছে । মনে হচ্ছে যেন কতই না রাত হয়ে গেছে । কোন মৃত্যুপুরিতে যেন এসে পৌছিয়েছে সে । আসে পাশে পাশে কোন মানুষ নেই । ঠিক এই সময়ে একটা গুলির আওয়াজ হল । আরিয়ান খেয়াল করলো গুলিটা ঠিক ওর মাথার উপর দিয়ে বের হয়ে গেল ।
ওকে কেউ গুলি করছে!
মানে কেউ জানে ও এখানে আছে?
কে জানে ?

এতো কিছু ভাবার সময় নেই । ঘুরে বাম দিয়ে দৌড় দিল আরিয়ান । ঠিক পায়ের কাছে একটা গুলি ছিটকে পড়লো । আর একটু হলে সেটা লাগতো শরীরে । আরিয়ান দৌড়াতে শুরু করলো । অন্ধকার কোন দিয়ে যাচ্ছে সেটা তার ঠিক খেয়াল নেই । তবে অনুভব করলো পেছন থেকে দুই জনের দৌড়ে আসার শব্দ হচ্ছে ।
আরিয়ান দৌড়াতে শুরু করলো প্রাণপনে । শেষ কবে সে এভাবে দৌড়িয়েছে সেটা সে জানে না । এতো অরক্ষিত অবস্থায় সে কোন দিন ছিল না এর আগে । এমন কি যখন ওর বাবার কাছে সব ক্ষমতা ছিল আরিয়ানের সাথে সব সময় বডিগার্ড থাকতো ।
আরেকটা গুলির আওয়াজ হল । তবে এটা ঠিক কাছে পিঠে না । কোন দিকে আওয়াজ হল সেটা সে ঠিক বুঝতে পারছে না । সামনেই সিড়ি পড়লো । নিচে নামবে কি উপরে যাবে সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ দ্বিধায় পড়ে রইলো । এমন অবস্থায় যে কেউ নিচে নেমে পালিয়ে যেতে চাইবে । আরিয়ান সেটা না করে উপরে ওঠার সিড়ি ধরলো । তবে এবার দৌড়ালো বেশ সাবধানে । যাতে করে পায়ের আওয়াজ না পাওয়া যায়!

আরিয়ান দ্রুত সরে গেল সিড়ির কাছ দিয়ে । কোন দিকে যাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিল । লুকানোর জায়গা নেই বললেই চলে । চারিদিকের সব দোকান পাঠ বন্ধ । একমাত্র খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে ওয়াশরুম । অন্ধকার ।
কিন্তু সেই অন্ধকার ওয়াশরুম দিয়ে যদি ভেতরে ঢোকে তাহলে পালানোর পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে । এটা একটা বোকার মত কাজ হবে । তবে এটাই এখন সব থেকে ভাল উপায়। বাইরে থাকা মানেই হচ্ছে পিস্তলের মুখে থাকা ।

তবে আরিয়ান সেই তলার ওয়াশরুমের দিকে গেল না । পা টিপে টিপে আরও একতলা উপরে চলে গেল । ওয়াশরুমের দরজা ঠেকে ভেতরে ঢুকে পড়লো ।

029

চারু অনুভব করলো যে কিছু একটা যেন ওর চারিদিকে ঘিরে ধরলো । একটা অদৃশ্য দেওয়াল । চারু সেটা দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু খানিকটা অনুভব করতে পারছে । মনের ভেতরে কেমন যেন একটা অশুভ দানা বেঁধে উঠলো । আরেকবার নিজের সিদ্ধান্তের উপরে দ্বিধান্বিত হল সে । যে কাজটা যে করতে যাচ্ছে সেটা কি ঠিক করতে যাচ্ছে ?
কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । এই বৃত্ত থেকে সে আর কি বের হতে পারবে ? অদৃশ্য দেয়ালটা সে অনুভব করতে পারছে খুব ভাল ভাবেই ।
লোকটা তখন বলে উঠলো, ঐ ”রাও”কে আর কতবার দেখেছো তুমি?
-রাও? এটা কী?
-ও আচ্ছা তুমি জানোই না । মানে হচ্ছে ঐ মুখ বিহীন সত্ত্বা । ওটার নাম রাও । ওটাকে কতবার দেখেছো তুমি?
-বেশি না । মাত্র দুইবার ।
-তোমার ভেতরে যে অস্বাভাবিকত্বটা আছে সেটার প্রধান কারণই হচ্ছে ওটা । ওটা যতদিন তোমার ভেতরে আছে ততদিন তোমার ভেতরে এই শক্তি আছে ।
-আমার ভেতরে ?
-হ্যা তোমার ভেতরে তোমার সাথে । তোমার একটা অংশই ওটা !
-তার মানে ওটা আমার কোন ক্ষতি করবে না ।
-না । বরং ওটা তোমাকে সকল অস্বাভাবিক শক্তি থেকে রক্তা করবে । আমি দুইদিন তোমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি আমার শক্তি প্রয়োগ করে দুইদিনই ওটা বের হয়ে এসেছে । এই কারণেই আমি অন্য ভাবে বিনা যাদু প্রয়োগ করে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি । যদি জাদু প্রয়োগ করে নিয়ে আসতে চাইতাম তাহলে ওটা ঠিক ঠিক চলে আসতো । তবে এখন যে বৃত্তের ভেতরে তুমি বসে আছো ওটার কারণে রাও বের হতে পারছে না ।
চারুর তখনই মনে হল যে ও বড় ভুল করতে যাচ্ছে । যদি এই রাও ওর অংশ হয়ে থাকে তাহলে কোন ভাবেই একে এই লোকের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না । এমনটা ভাবনাতে আসতেই চারু উঠে দাড়ালো । কিন্তু সে বৃত্ত ছাড়ার আগে অদ্ভুত একটা কান্ড হতে শুরু করলো ।

লোকটার সামনে যে আগুন ছিল সেটা থেকে একটা ধোঁয়ার হাত সোজা এগিয়ে এল চারুর দিকে । সোজা এসে ঢুকে গেল চারুর ভেতরে । তখনই চারু একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো । ওর মনে হল যেন ওর শরীর থেকে কোন অঙ্গ যেন কেউ টেনে বের করে নিয়ে আসছে । তীব্র একটা চিৎকার বের হয়ে এল ওর ভেতর থেকে । ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে চারু কয়েক মুহুর্তের জন্য চেতনা হারিয়ে ফেলল । মাটিতে থপ করে পড়ে গেল সে । তবে কিছু সময়ের পরে তার জ্ঞান ফিরে এল আবারও । জ্ঞান ফিরে আসতেই অনুভব করলো যে কিছু যেন একটা নেই ওর ভেতরে । একেবারে অন্য রকম অনুভব হচ্ছে ।

উঠে বসতেই লোকটা বলল, তুমি এখন মুক্ত । যাও । সোজা বাসায় চলে যাও । আজকের পরে আর কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে না তোমার সাথে । চলে যাও ।

বোকার মত কিছু সময় বসে রইলো সে । এখন থেকে সে একদম স্বাভাবিক একটা মেয়ে । এই স্বাভাবিক হতে সে কত দোয়া করেছে, প্রার্থনা করেছে । আর আজকে সে স্বাভাবিক হয়ে গেছে । কিন্তু ওর এমন কেন লাগছে ? মনে হচ্ছে যেন ওর ভেতর থেকে কিছু নেই । কেমন যেন একটা খালি খালি অনুভব করছে বুকের ভেতরে !
তখনই ওর চোখ গেল সেই মুখ বিহীন রাওয়ের উপর । ও যে বৃত্তের ভেতরে ছিল তার পাশে আরও একটা বৃত্ত আঁকা ছিল । সেটার ভেতরে সেই আটকা পরেছে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে ।

চোখ নেই মুখ নেই কিন্তু চারুর মনে হল রাও নামের এই অদ্ভুত অস্তিত্বটা ওর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে । যেন চারুকে বলছে যে ওকে ছেড়ে যেন না যায় ।

চারু এখনই যদি পেছন ঘুরে চলে যায় তাহলে ওর জীবন একদম স্বাভাবিক হয়ে যাবে হয়তো । কিন্তু এতো গুলো বছর যে জিনিসটা ওর সাথে জুড়ে ছিল তাকে এভাবে একা এখানে ফেলে রেখে ও কিভাবে যাবে ।

চারু উঠে দাড়ালো । সাথে সাথেই লোকটা বলে উঠলো, না চারু মোটেই না । সোজা চলে যাও .
কিন্তু চারু শুনলো না । সে সোজা লাফ দিলো সেই বৃত্ত বরাবর । তবে সেই অবদি সে পৌছাতে পারলো না । তার আগে কিছু একটা এসে আঘাত করলো ওর শরীরে । সে ছিটকে গিয়ে পড়লো অনেকটা দুরে । চারুর মনে হল যে ওর পুরো শরীর যেন দুমড়ে গেল !

কিছু সময় যে পড়েই রইলো মেঝেতে । তারপর আবারও উঠে বসলো । লোকটা এবার রাগত স্বরে বলল, চারু পরের বার কিন্তু আর আমি মাফ করবো না । এখনও বলছি চলে যাও ।
চারু বলল, চলে যাবো। আমার রাওকে আমাকে দিয়ে দাও ।
-একে তুমি আর কখনও পাবে না । এই একটাকে ধরার জন্য তোমাকে সেই ছোট বেলা থেকে আমি বড় করে এসেছি । এতো দিনের অপেক্ষা নষ্ট হতে দেব ভাবছো?
চারু আবারও উঠে দাড়ালো । তারপর আবারও বৃত্ত বরাবর দৌড় দিলো । তবে এইবারও সে তার কাছে পৌছাতে পারলো না । দেখতে পেল লোকটা নিজের হাতের লাঠি জাতীয় কিছু নাড়ালো সাথে সাথে একটা অদৃশ্য বাতাস এসে যেন আঘাত করলো চারুকে । আগের থেকেও জোড়ে সেটা লাগলো চারুর শরীরে । একেবারে উড়িয়ে নিয়ে চলল ওকে । তবে শক্ত মেঝেতে পড়ার আগেই কেউ তাকে ধরে ফেলল । চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো চারু । চোখ মেলে দেখতে পেল একটা পরিচিত মুখ । এই মুখটা এখানে দেখবে সে আশা করে নি ।

030

আরিয়ান নিজের জীবন নিয়ে একটা ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিয়েছে। তার কাজের জীবনে নানান ধরনের রিস্ক তাকে এর আগেই নিতে হয়েছে । তবে এবারের মত এতো তীব্র ঝুকি সে আগে নেয় নি । আরিয়ানের কাছে মনে হয়েছে যে বন্দুকের সামনে খোলা থাকার থেকে কোথাও লুকিয়ে থাকাটা বেশি যুক্ত সংগত । নিচের মানুষ দুটো নিচের তলার দিকে চলে গেছে । যদি তারা উপরের তলাতে আসেও ওয়াশরুমের দিকে প্রতিটা ওয়াশরুম খুজে পেতে ওদের সময় লাগবে । এই সময়ের ভেতরে ওর রেস্কিউ টিম চলে আসবে । এবং শেষ পর্যন্ত আরিয়ানের ক্যালকুলেশন ঠিক প্রমানিত হল । ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ যখন আরিয়ান পেল ওর বুকের ভেতরে দ্রুত স্পন্দন শুরু হয়ে গিয়েছিলো তবে পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে সেটা খানিকটা শান্ত হয়ে এল ।
আরিয়ান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এল । জামসেদকে দেখে বলল, নাইস টাইমিং ।
-আপনি ঠিক আছেন স্যার?
-হ্যা ঠিক আছি । কজন এসেছে ?
-আমরা ছয়জন । চপার নিয়ে এসেছি ।
-গুড ।
-স্যার চলুন ফেরা যাক । সবাই আপনার জন্য টেনশন করছে ।
-হ্যা । তবে এখনই না । আগে আমাকে আরেকটা কাজ করতে হবে । তোমরা এসো আমার পেছনে !

কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিয়ান দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল পেছনের ছয়জন তাকে অনুরসন করতে শুরু করলো । আরিয়ান যখন নির্দিষ্ট করিডোরের শেষ মাথায় এসে পৌছালো, মোড় ঘুরতেই দেখতে পেল চারুকে । চারু যেন খানিকটা উড়ে এগিয়ে আসছে । আরিয়ান একেবারে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে এসে হাজির হল চারুকে ধরতে । চারু খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো আরিয়ানের দিকে । তারপর বলল, আপনি !
-তুমি ঠিক আছো?
-ব্যাথা পেয়েছি তবে ঠিক আছি ।

ব্যাথা শব্দটা শুনতেই আরিয়ানের পুরো শরীর জুড়ে একটা তীব্র রাগের প্রবাহ বয়ে গেল । ওদের থেকে দুরে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালো সে । লোকটাও ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এখনও চোখে খানিকটা অবজ্ঞার ভাব । আরিয়ান দেখতে পেল লোকটার ঠিক বাঁ দিকে একটা অয়বয় দাড়িয়ে রয়েছে । সেটার চারিদিকে একটা আলোর গোলাকার দেওয়াল রয়েছে ।

আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ডন এইবার কিন্তু তোমাকে এভাবে ছেড়ে দেব না । সোজা চলে যাও এখনও সময় আছে ।
আরিয়ান উঠে দাড়ালো । এবং সাথে সাথেই অনুভব করলো যে একটা শিপ মত করে শব্দ এসে একটা কিছু ওর শরীরের দিকে এগিয়ে আসছে। জিনিসটা অদৃশ্য । তবে ওকে লক্ষ্য করেই লোকটা ছুড়ে মেরেছিলো । আরিয়ান শেষ মুহুর্তে সরে গিয়েছে.
লোকটা বলল, নট ব্যাড । তবে প্রতিবার তুমি পাশ কাটাতে পারবে না ।
আরিয়ান এবার যেন হাসলো । সে ইশারা করতেই দুজন রাইফেল নিয়ে সামনে এগিয়ে এল । তারপর সোজা লোকটার দিকে শুরু করলো । তবে ওরা সবাই অবাক হয়ে দেখলো যে লোকটার শরীর পর্যন্ত কোন বুলেট পৌছাচ্ছে না । তার আগেই যেন কিছুতে আটকে যাচ্ছে ।
লোকটার মুখে এখনও সেই হাসি লেগে রয়েছে । আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ডন তোমাকে আমি অনেক সুযোগ দিয়েছি ।

আরিয়ান অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না । জামসেদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই জামসেদ একটা রকেট লাঞ্চার কাধে তুলে নিলো । সোজা তাক করে আছে লোকটার দিকে । এবার আরিয়ানের মনে হল যে লোকটা একটু যেন ভয় পেয়েছে । নিশ্চিত ভাবেই লোকটা কোন এনার্জি শীল্ডের মত তৈরি করে রেখেছে নিজের সামনে । কিন্তু সেটা তৈরি করতে নিশ্চিত ভাবেই শক্তির দরকার হচ্ছে । বুলেট ঠেকিয়ে দিতে পারলেও রকেট ঠেকাতে পারবে কি?
আরিয়ান বলল, ফায়ার !
সাথে সাথে রকেট ছোড়া হল । বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হল । ধোঁয়ায় ভরে গেল চারিদিক। তবে যখন আবার সব কিছু দৃষ্টিগোচর হল আরিয়ান দেখতে পেল লোকটা নিজের অবস্থান থেকে একটু দুরে সরে গেছে । এই রকেট সেখানে বিস্ফোরনে একটা গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা । দেয়াল ভেঙ্গে পড়ার কথা কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে তেমন কিছুই হয় নি । কেবল দেখা যাচ্ছে লোকটা নিজের স্থান থেকে একটু দুরে পড়ে আছে । সম্ভবত ধাক্কা খেয়ে দুরে পড়েছে ।

আরিয়ান এবং বাকি সবাই খানিকটা অবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো । কারণ এমন হামলায় টিকে একজন মানুষের পক্ষে টিকে থাকার কথা না সেখানে লোকটার কিছুই হয় নি । আরিয়ান বুঝতে পারলো যে এমন ভাবে এই লোকের সাথে পেরে উঠবে না । তাদের এখন অন্য ব্যবস্থা করতে হবে ।
তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে চারু দৌড়ে সামনে চলে এল । এতো সময় সবার চোখ ঐ লোকটার দিকে থাকায় কেউ খেয়াল করে নি যে কাঁচের দেয়ালের মত করে যে দেয়ালটা ছিল রকেটের আঘাতে সেটাও ভেঙ্গে গেছে ।এবং ভেতরের অয়বয়টা বের হয়ে এসেছে ।
আরিয়ান অয়বয়টা দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল । অয়বয়টার মুখ বলতে কিছু নেই । সেখানে রয়েছে একদম ফাঁকা শূন্যতা । উচ্চতায় চাররু সমান । চুল একটু বড় । বন্ধুক গুলো আপনা আপনি সেটার দিকে ঘুরে গেল কিন্তু চারু সামনে থাকায় কেউ গুলি করতে পারছিলো না ।

আরিয়ান হাতের ইশারাতে গুলি করতে মানা করলো । আরিয়ান দেখলো চারু একেবারে ওটার সামনে চলে গেল । সেই ফেসলেস চেহারার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । চারু নিজের হাত বাড়িয়ে সেটাকে স্পর্শ করলো । এবং তখনই সবাই অবাক হয়ে দেখলো অয়বয়টা আস্তে আস্তে চারুর শরীরের সাথে মিশতে শুরু করলো । পুরো ঘটনা ঘটলো সবার সামনে । চারুর শরীরটা কাঁপছিলো পুরো সময় ধরেই । যখন সেটা পুরোপুরি চারুর শরীরের সাথে মিশে গেল তখন চারু মাটিতে পড়ে গেল । কিন্তু আরিয়ান দৌড়া চারুর কাছে যাওয়ার আগেই চারু আবার উঠে বসলো ।
-তুমি ঠিক আছো ?
চারু একবার ফিরে তাকালো আরিয়ানের দিকে । তারপর সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিল । কিছুটা সময় আরও চোখ বন্ধ করে বসে রইলো সে । নিজেকে যেন সামলে নিচ্ছে সে।

031

চারু যখন উঠে বসলো তখন ওর কাছে আবার সব কিছু যেন নতুন মনে হতে শুরু করলো । অনুভব করলো যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে আবার । একটু আগেই যখন রাও ওর শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো তখন ও বুঝতে পারছিলো ওর ভেতরে একটা শূন্যতা অনুভব হচ্ছে কিন্তু যখন ওটা আবার চারুর ভেতরে একটু আগে প্রবেশ করলো তখন সেই পরিপূর্ন ভাবটা ফিরে আসলো সাথে সাথেই । কিন্তু সেই সাথে আরও একটা বিশেষ পরিবর্তন চারু অনুভব করতে পারছে ।
চারু ঘরের ভেতরে ভয় অনুভব করতে পারছে, ভয়ের সাথে সংঙ্কা, দ্বিধা উৎকন্ঠাও বুঝতে পারছে । চারু চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো । বন্দুক হাতে মানুষ গুলো ওর দিকে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে । আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো উৎকন্ঠা আর চিন্তাটা আরিয়ানের । কিন্তু ভয়টা আসছে অন্য জনের কাছ থেকে । ওদের থেকে দুরে মেঝেতে বসে থাকা মানুষটার কাছ থেকে ভয়ের অনুভূতিটা আসছে । মানুষটা ওকে ভয়ংকর ভাবে ভয় পাচ্ছে ।

চারু তখনই বুঝতে পারলো লোকটা কী করতে যাচ্ছে ।লোকটা নিজের হাত সামনে নিয়ে কিছু যেন পড়তে চেষ্টা করলো । চারু বুঝতে পারছে সে কী পড়ছে । পুরো মন্ত্রটা সে বুঝতে পারছে এতো এখান থেকেও । এতো পরিস্কার ভাবে সে মনের কথা বুঝতে পারছে দেখে নিজের কাছেই অবাক হয়ে গেল । হঠাৎ করেই চারু সেই কথা গুলো আটকে দিলো । কেবল ইচ্ছে করলো আর লোকটা কোন কথাই বলতে পারলো না । নিজের হাত পর্যন্ত নড়াতে পারলো না । এভাবে মানুষকে সে নিয়ন্ত্রন করতে পারে সেটা ওর নিজের জানা ছিল না । চারুর মাথার ভেতরে একটা যন্ত্রনা শুরু হয়েছে । প্রতিবারই হয় যখন সে কারো মাথার ভেতরে ঢোকে । এই লোকটা তাকে ঢুকতে দিতে চাইছে না । তবে চারু তাকে ছাড়লো না ।
-তুমি আমার মাথার ভেতড়ে ঢুকতে পারবে না । পারবে না !
লোকটা যেন চিৎকার করে কথাটা বলতে চাইলো । তবে সেটা কেবল মাথার ভেতরেই ।
-পারবো । খুব ভাল করেই পারবো ।
-না না । না । ঢুকো না। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি । ঢুকো না !
চারুর মনে হল যেন লোকটাকে সে ক্ষমা করে দেয় কিন্তু তখনই কেউ যেন ওর মাথার ভেতরেই বলে উঠলো এর কোন ক্ষমা নেই । কোন ক্ষমা নেই । চারু জানে কে বলেছে কথা !

চারু এবার সরাসরি তাকালো লোকটার দিকে । লোকটা একেবারে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে চারুর দিকে । চোখের পাতা ফেলতে পারছে না । নড়তে পারছে না ।

আরিয়ান সহ সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রয়েছে লোকটার দিকে । লোকটার চোখ নিজের কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে । তীব্র একটা কষ্ট অনুভব করছে সে । চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু কোন কিছুতে যেন তার চিৎকার করাটা বন্ধ করে রেখেছে । এভাবে কয়েক মিনিট স্থির হয়ে থাকলো লোকটা । তারপর মাটিতে পড়ে গেল ।

আরিয়ান চারুর একদম কাছেই দাড়িয়ে ছিল । অনুভব করলো চারু শরীরটাও মেঝেতে এলিয়ে পড়ছে । পুরোপুরি মেঝেতে পড়ার আগেই আরিয়ান তাকে ধরে ফেলল ।
-চারু ।
চারু কোন কথা বলতে পারলো না । আলতো করে আরিয়ানের কোলে মাথা রেখে জ্ঞান হারালো । তবে আরিয়ানের মনে হল যে চারু মুখে কোন চিন্তার ছাপ নেই । যেন ও খুব ভাল করেই জানে যে মানুশ কোলে মাথা রেখে সে জ্ঞান হারাচ্ছে সে তাকে ঠিক ঠিক দেখে রাখবে ।


আরিয়ান কিছুটা সময় একভাবে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে । মেয়েটা কেমন নিশ্চিন্তে তার কোলে মাথা রেখে জ্ঞান হারালো । এমন ভাবে কোন মেয়ে তার কোলে মাথা রাখে নি । এই মেয়েটাকে সে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে বারবার । কিন্তু কোন ভাবেই দূরে রাখতে পারে নি । বারবার মেয়েটা এসেছে ওর সামনে । ওর সাথে কেমন ভাবে জড়িয়ে গেছে । আজকেও সে কেন চারুকে রক্ষা করতে এলো সেটার কোন ব্যাখ্যা কী আছে ওর কাছে ! কোন ব্যাখ্যা নেই । 


-স্যার আমাদের যেতে হবে । পুলিশ নিচে চলে এসেছে ।
-ওকে ।
-মেয়েটাকে আমার কাছে দিন ।
-না ঠিক আছে । আমিই নিচ্ছি ওকে । আমাদের কোন ট্রেস যাতে না থাকে সেটা দেখো তুমি ।
-ওকে স্যার । আর ঐ লোকটাকে কী করবো ?
-থাকুক এখানে । একে দিয়ে আমাদের আর কোন কাজ নেই ।

আরিয়ান চারুকে কোলে তুলে নিলো । তারপর এগিয়ে চলল রুফটপের দিকে ।

the last

-হ্যালো !

-কেমন আছেন ঢাকার ডন?

চারুর কন্ঠে কৌতুক পূর্ণ ব্যাঙ্গটা আরিয়ান ঠিক ঠিক টের পেল । কোন কথা বলল না ।
চারু আবার বলব, নাকি বলব ঢাকার কিং অথবা নম্বর ওয়ান সাকিব খান ! সরি নম্বর ওয়ান আরিয়ান খান ! কোন নামে ডাকবো ?
-কেন ফোন দিয়েছো ?
-আরে বাবুটা রেগে কেন গেছে ওলে ওলে !

আরিয়ান তীব্র একটা রাগ অনুভব করলো । কিন্তু সেটা সহ্য করে নিল । চারু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে রাগটাগ বাদ । আপনি ঐদিনের সিসিটিভি ফুটেজ কি চেক করেছিলেন ?
-কেন?
-না করে থাকলে চেক করুন । আমার মনে হয় চেক করলে আপনি আমাকে আবার নিজ থেকেই ফোন দিবেন ।

চারু ফোন কেটে দিল । অরিনকে ডেকে সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে আসতে বলল । ঐদিনের পরে প্রায় একটা সপ্তাহ পার হয়ে গেছে । সেদিন চপারে করে সোজা নিজের বিল্ডিংয়ে এসে হাজির হয় আরিয়ান । দ্বিতীয় তলাতে যে ওর যে নিজেস্ব হাসপাতাল আছে সেখানে চারুকে নিয়ে যায় । ডাক্তার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানায় যে চারুর বড় কোন ক্ষতি হয় নি । তবে শরীর বেশ ট্রমার ভেতর দিয়ে গেছে । বিশ্রাম নিতে হবে ।
তিনদিন চারু হাসপাতালেই ছিল । আরিয়ান দুইদিন কাজের কারণে চারুকে দেখতে যেতে পারে নি তবে খোজ খবর ঠিকই নিয়েছে । তৃৃতীয়দিন চারুকে দেখতে যাওয়ার পর চারু ওকে বেশ অপ্রস্তুত করে দিলো কথা বলে । চারু জানালো যে এখন মানুষকে বুঝতে তার আর চোখের দিকে তাকানোর কোন দরকার পরছে না । মানুষের মনের অনুভূতি সে খুব ভাল টের পাচ্ছে ।
আরিয়ান একটু থতমত খেয়ে বলল, মানে কী বলতে চাও?
-এই যে আপনি যে আমার প্রেমে পড়েছেন ডন সাহেব সেটা আমি খুব ভাল করে বুঝতে পারছি ।
এই বলে চারু হাসতে শুরু করলো ।
-কীকী যা তা বলছো !

আরিয়ানের এই প্রতিক্রিয়া দেকখে চারু আরও জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো । আরিয়ান আর কিছু না বলে দ্রুত নিজের অফিসে এসে হাজির হল । নিজের কাছেই ওর কেমন যে বিরক্ত লাগছে । ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন কিনা একজনের প্রেমে পড়েছে ।
কী হাস্যকর শোনাবে যখন কথাটা মানুষজন জানবে !
না না এই সব অহেতুক আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে । প্রশ্রয় দিলে চলবে না ।

চারু চলে যাওয়ার সময়েও আরিয়ান আর চারুর সামনে দেখা করতে যায় নি । মেয়েটা যদি মনের কথা টের পায় তাহলে সেটা বড় লজ্জা আর বিব্রতকর ব্যাপার হবে । আরিয়ান মোটেই তা চায় না ।

সিসি টিভি ফুটেজ আসতেই আরিয়ান সেটা চেক করতে শুরু করলো । আধা ঘন্টা ফুটেজ দেখার পরেই আরিয়ানের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো । যাওয়ার দিন চারু তার বাবার কেবিনে ঢুকেছিলো । তাহলে কী !
আরিয়ান নিজের ভেতরে একটা উত্তেজনা বোধ করলো । সাথে সাথেই সে ফোন দিল চারুকে ।
-তুমি কোথায় এখন ? আমি তোমার সাথে এখনই দেখা করতে চাই ।
চারু বলল, আমি আপনাকে লোকেশন পাঠাচ্ছি । আমি চলে আসুন ! আপনার জন্য অপেক্ষা করছি ।

একটু পরেই লোকেশনটা চলে এল আরিয়ানের ফোনে। আরিয়ান দ্রুত বের হয়ে গেল বিল্ডিংয়ের বাইরে । নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে দ্রুত এগিয়ে চলল । কোন সিকিউরি নিলো না । তবে সে জানে তার পেছন পেছন ঠিকই জামসেদ আসবে ।

মুন্সিগঞ্জের এই পুরানো বাড়িতে পৌছাতে আরিয়ানের ঘন্টা দুয়েক সময় লাগলো । বাড়িটাতে সে আগেও এসেছে । তবে খুব বেশি না। সেখানেই চারু ওকে আসতে বলেছে । ওর মাথার ভেতরে তখন ঝড় চলছে । কেন চারু ওকে এখানে আসতে বলল । বাড়ির ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল কেয়ারটেকার দৌড়ে এল । ওকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে । আশা করে নি এখানে এই সময়ে আরিয়ান আসবে ।
আরিয়ান কোন ভণিতা না করেই বলল, মেয়েটা কোথায়?
কেয়ারটেকার বলল, পুকুর পাড়ে !
আরিয়ান দ্রুত বাড়ির পেছনের দিকে চলে এল । দেখতে পেল শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে চারু বসে আছে আপন মনে । পানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
আরিয়ান দ্রুত এগিয়ে গেল । তারপর বলল, তুমি কি জেনেছো ?
চারু সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আরে ডন নম্বর ওয়ান ! এতো তাড়াহুড়া কেন ? বসুব বসুন !
-প্লিজ বল । প্লিজ ।
চারু বলল, বসুন । আপনাকে বলবো বলেই ডেকেছি ।
আরিয়ান চারুর পাশেই বসে পড়লো । চারু বলল, জানতেই হবে?
-হ্যা । আমি যে কোন ভাবেই জানতে চাই ।
চারু কিছু সময় পানির দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, আমি কেবল কৌতুহল থেকে আপনার বাবার রুমে ঢুকেছিলাম । রুমে ঢুকেই আপনার বাবার দিকে আমার চোখ গেল । উনার চোখ খোলা দেখে অবাক হলাম । আপনি বলেছিলেন কোমা থেকে উঠেছেন তবে সে কোন কথা বলতে কিংবা নড়তে পারেন না । আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই তিনিই যেন আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন তার মাথার ভেতরে । যেন তার নিজের কোন কথা বলার আছে ।

এই পর্যন্ত বলে চারু থামলো । আরিয়ান সাথে সাথে বলল, তারপর?
-আপনার বাবা সিড়ি থেকে একা একা পড়েন নি । আপনি তাকে ধাক্কা দিয়েছেন ।
কিছু সময় নিস্তদ্ধতা । চারু আবার বলল, আপনার বাবা তবে আপনার উপরে রাগ করেন নি । এরপরে আমি যা জানতে পারলাম তা হচ্ছে তিনি আপনার বাবা নন।
আরিয়ানের দিকে না তাকিয়েই চারু আবার বলা শুরু করলো, আপনার বাবা যখন নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে তখন আপনার মা অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে । হয়তো একাকিত্ব থেকেই সে ঐদিকে গিয়েছিলো । আপনি সেই মানুষটির সন্তান । আপনার বাবা যখন জানতে পারলো এই সম্পর্কের কথা তখন সেই পুরুষটাকে মেরে ফেলে সে । রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে । তবে আপনার মাকে সে প্রচন্ড ভালবাসতো । এই ঘটনার পরে মানে যখন সে প্রেগনেন্ট ছিল তখন আপনার মাকে সে জীবনের সেরা ভালোবাসাটা দিল । এই ভালোবাসার ব্যাপারটাই আপনার মা সহ্য করতে পারে নি । প্রতিনিয়ত একটা অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খেত । আপনার জন্মের বছর খানেক পড়ে সে আত্মহত্যা করে ।

চারিদিকে একেবারে সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে আছে যেন । কেউ কোন কথা বলছে না । চারু হাত দিয়ে বাড়ির পেছনের দোতালাটা দেখালো । ঐ যে কোনার ঘরে, ওখানে সে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে ।
আরিয়ান সেই ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ।
চারু বলল, আপনার বাবা কোন দিন আপনাকে ঘৃণা করেন নি । আজীবন নিজের ছেলে ভেবে এসেছেন । মনে করে এসেছেন আপনি তার সন্তান । আপনার মায়ের কবরটা কোথায় সেটা আমি জানতে পারি নি । তবে আমার মনে হয় এই বাড়ির শেষে, ঐ যে পুকুরের ওপাশে যে কবর টা দেখা যাচ্ছে ওটা আপনার মায়ের । এটা আমার অনুমান !

আরিয়ান সেই কবরটার দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । একটু আগে শোনা কথা গুলো তার ঠিক হজম হচ্ছে না এখনও । এতোটা দিন সে তার বাবাকে কী ঘৃণাই না করে এসেছে অথচ এই মানুষটাই তাকে কতই না ভালোবেসে এসেছে । এটা জেনেও যে আরিয়ান তার তার ছেলে নয় ।
পুকুর পাড়েই হাটু গেড়ে বসে পড়লো সে । চোখ দিয়ে কখন যে পানি বের হয়ে এসেছে সেটা সে নিজেও বলতে পারবে না । কত গুলো বছর পরে এভাবে সে কাঁদতে পারলো সেটা সে নিজেও জানে না । তখনই অনুভব করলো চারু ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে ।
কানের কাছে মুখটা এনে বলল, সব সত্য জানতে নেই সব সময় । তাই না? সেটা কেবল আমাদের দুঃখকে আরও বৃদ্ধি করে ।
আরিয়ান কোন জবাব দিলো না । তবে চারুর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করেও নিলো না ।

বাইরে তখন সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে আসছে । আস্তে আস্তে দিবের আলো কমে আসছে । এটা হয়তো একটা গল্পের সমাপ্তি । এবং এখান থেকেই নতুন গল্পের শুরু । আরিয়ান আর চারুর নতুন কোন গল্প ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 62

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →