চারু (৩য় ভাগ)

oputanvir
4.8
(19)

আগের পর্ব

011

চারুর নির্লিপ্ত ভাব দেখে আকিব সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না । খানিকটা উত্তেজিত কন্ঠে বলল, তুমি বুঝতে পারছো না, ঐ লোক কী পরিমান বিপদজনক !

-আকিব সাহেব আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি । আপনি তো পুলিশ আপনি তাকে কেন ধরছেন না? আপনি জানেন সে ডন । তাহলে ?

-আসলে আমাদের হাতে তাকে ধরার মত কোন প্রমান নেই ।

-বাহ চমৎকার । তা এখন আপনি নিশ্চিয় আমাকে বলবেন না ঐ লোকের মাথার ভেতরে থেকে প্রমান বের করতে হবে? দয়া করে বলবেন না। কারণ এটা আমি করবো না । আপনি কেন দেশের প্রধানমন্ত্রী এসে বললেও করবো না । এখন বলেন আর কিছু বলবেন ?

-আরিয়ান তোমার কাছে কেন এসেছিল?

-কী একটা দরকারে ! বলেনি । কাল বলবে।

-কাল বলবে মানে কী ? তুমি কি তার সাথে দেখা করবে?

-জ্বী দেখা করবো । কথা দিয়েছি দেখা করবো ।

-তুমি মোটেই ঐ লোকের সাথে দেখা করবে না । তোমার জীবন কতখানি হুমকির ভেতরে পড়বে সেই হিসাব আছে ।

চারুর সব কিছু ভাল লাগে কেবল যখন কেউ তাকে কিছু করতে মানা করে কিংবা করতে বলে তখন ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগে না । বিশেষ করে যখন সেই কাজটা করার ব্যাপারে অনুরোধ নয় আদেশ করে তখন মেজাজ খারাপ হয় । আকিবের দিকে তাকিয়ে চারু বলল, শুনুন মিস্টার আকিব আপনি বললেন আমি শুনেছি । আমার বিপদ নিয়ে আপনি চিন্তিত এটা জেনেও আমি আনন্দিত । কিন্তু দয়া আমি কী করবো আর কী করবো না, এটা আমাকে বলতে আসবেন না দয়া করে ! মনে থাকবে কি? আমার মনে হয় অনেক কথা হয়েছে । আমি আসি ।

চারুর কন্ঠের উত্তাপ শুনে আকিব একটু বিস্মিত হল । চারু ওকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হলের গেটের দিকে পা বাড়ালো । 

যদিও চারু আকিবের সাথে রাগ করেই চলে এল কিন্তু কিছু সময় পরে বুঝতে পারলো যে আকিব ওর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত । চারু নিজের খেয়াল রাখতে জানে । তারপরেও সে একা একটা মেয়ে । যে মানুষটা পুরো ঢাকা শহর তথা পুরো দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন সে মানুষ নিঃসন্দেহে বিপদজনক মানুষ । কোন সন্দেহ নেই এই মানুষটা ওর ব্যাপারে জানে ।  কিভাবে জানে সেটা চারু জানে না কিন্তু জানে এটা নিশ্চিত ! নয়তো ওর মত একজন চেনা জানা হীন মানুষের সাথে দেখা করতে চাওয়ার কোন মানে নেই । 

কিন্তু সব কিছুর পরে যে কথাটা থেকে যায় সেটা হচ্ছে এমন একজন বিপদজনক মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আগে যদি জানতো তাহলে হয়তো চারু মানুষটাকে কথাই দিতো না । কথা দিয়ে কথা না রাখাটা সে মোটেই পছন্দ করে না । আরও কিছু সময় চিন্তা ভাবনার পরে সে সিদ্ধান্ত নিলো যে কাল টিউশনীর পরে আরিয়ান আহমেদ খানের সাথে দেখা করতে যাবে । রেস্টুরেন্টে আরও অনেক লোক থাকবে । তাদের সামনে নিশ্চিত ভাবে কিছু করতে পারবে না । তারপরেও আরেকটা চিন্তা মাথায় এল ওর । একেবারে খালি হাতে যাওয়া উচিৎ হবে না। একটা ব্যাকআপ সাথে নিয়েই তারপর যেতে হবে ভেতরে ! 

পরদিন টিউশনি একটু আগে আগেই শেষ হল । চারু রাস্তা দিয়ে যখন থাইম রেস্টুরেন্টের দিকে যাচ্ছিলো অনুভব করছিল যে নিজের ভেতরে কেমন একটা অস্থির বোধ করছে । নিজেকে আরেকবার ভাল করে বোঝালো যে ভয়ের কোন কারণ নেই । সে যাবে রেস্টুরেন্টের ভেতরে । কথা বলবে তারপর চলে আসবে । ব্যাস আর কিছু না । এটা নিয়ে আর কোন চিন্তা ভাবনার দরকার নেই । 

থাইম রেস্টুরেন্টের বিল্ডিংয়ের সামনে আসতেই চারুর মনে হল যে কিছু একটা ঠিক নেই এই বিল্ডিং এ । এই বিল্ডিংটা মোট চৌদ্দ তলা । প্রতিটিটা ফ্লোরেই দুই তিনটা করে রেস্টুরেন্ট । এই বিল্ডিংয়ের প্রবেশ মুখে সব সময় মানুষের ভীড় লেগেই থাকে । অথচ আজকে একদম ভীড় নেই । কেবল কয়েকজন কালো স্যুট পরা লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে । এরা যে ডনের লোক সেটা চিনতে কষ্ট হল না । 

চারু যখন গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো, তখনই ওর মাথায় এই চিন্তাটা এসে হাজির হল । গেট পেরিয়ে যখন নিচ তলায় এল তখন সেই চিন্তাটা একেবারে বদ্ধমূল ধারনাতে পরিনত হল । এই বিল্ডিংয়ের নিচ তলাতে জারা আর রিচম্যানের শোরুম রয়েছে । এই দুইটা দোকান সব সময় খোলা থাকে । কিন্তু আজকে এই দোকান দুইটা বন্ধ । চারুর মনে হল ও একেবারে বাঘের মুখে এসে পড়েছে । 

ডন সাহেব মোটেই এতো বোকা হবেন না এটা চারুর আগেই বোঝা উচিৎ ছিল । সাধারণ পাব্লিকের মধ্যে অরক্ষিত ভাবে সে বের হয়ে আসবে না এভাবে । নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করবে সবার আগে । পুরো বিল্ডিং নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিবে । এবং নিয়েছেও তাই । 

চারু যখন লিফটের বোটাম চাপ দিল, তখনই বুঝে গেল যে পুরো বিল্ডিংয়ে ডন, ডনের লোক আর চারু ছাড়া বাইরের আর একটা লোকও নেই । 

012

লিফটটা যখন বন্ধ হচ্ছিলো তখনও চারুর মনে হচ্ছিলো যে দরজা দিয়ে ছুটে বের হয়ে যায় সে । একবার দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলে হয়তো এই বিল্ডিং থেকে সে বাইরে চলে যেতেও পারে । কিন্তু যখন চোখের সামনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতে দেখলো নিজের কাছেই একটা বন্দী ভাব অনুভূত হল । যেন ও আটকা পড়েছে সিংহের খাঁচার ভেতরে । 

লিফটটা যখন নির্দিষ্ট তলাতে থামলো তখনও চারুর মনে এই চিন্তা উকি দিল যে এখনই ও আমার নিচে যাওয়ার বাটনটা চাপ দেয় তারপর চলে যায় নিচে । কিন্তু সেটা সে করলো না । লম্বা একটা দম ফেলে লিফট থেকে বের হয়ে এল । থাইম রেস্টুরেন্টের দরজার কাছে এসেই দেখতে পেল সেখানে পরিচিত পোশাকের বদলে একজন কালো স্যুট পরা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে । ওকে দেখতেই দরজাটা খুলে দিলো । চারু ধীর পায়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলো । পুরো রেস্টুরেস্ট খাঁ খাঁ করছে । একেবারে ডান দিকে একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখলো । মানুষটা ওর দিকে পেছন ফিরে আছে । চারুকে আলাদা ভাবে কিছু বলে দিতে হল না । সে সোজা সেদিকেই পা বাড়ালো । 

আরিয়ান আহমেদ খানকে আজকে যেন গতকালের চেয়েও আরও বেশি সুদর্শন মনে হচ্ছে । এই কথা মানতেই হবে যে ডন হোক আর সন্ত্রাসী হোক, ছেলেটা দেখতে বেশ চমৎকার । উচুলম্বা আর গায়ের রঙ নায়কের মতই । আজকে কোণ স্যুট পরে নি । একটা সাদা নীল রংয়ের ফুলহাটা শার্ট পরেছে । সাথে কালো জিন্স । চোখে কালো চশমা । চশমাটা যে তার নিরাপত্তার জন্য সেটা বুঝতে চারুর খুব বেশি সময় লাগলো না । ব্যাপারটা বুঝতেই চারুর ভেতরকার ভয়ের ব্যাপারটা একদম চলে গেল । এই প্রচন্ড ক্ষমতাধর মানুষটি তাকে ভয় পাচ্ছে কিংবা অন্তত তার সামনে অস্বস্তিতে পরেছে । ব্যাপারতা বেশ মজাই লাগলো  ভাবতে ।

-মিস চারুলতা চৌধুরী! তুমি যে যথেষ্ঠ সাহসী সেটা আমাকে মানতেই হচ্ছে । আমি খানিকটা নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি আজকে আসবে না ।

-কিভাবে নিশ্চিত ছিলেন?

-গতকাল রাতে তোমার সাথে ডিবির একজন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার দেখা করেছে । এবং আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে সে তোমাকে আমার ব্যাপারে সব কিছু বলেছে । তাই না?

-হ্যা বলেছে । তাতে আসলে কিছুই যায় আসে না । আপনার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই । তাই আশা করি আমার কোন ক্ষতি  করার জন্য আপনি আমাকে এখানে ডাকেন নি । আর আমি জানি মানুষ আমার সহজে খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না । 

চারু খেয়াল করলো যে ডন সাহেবের শারীরিক নড়াচড়াতে একটু যেন পরিবর্তন এল । সম্ভবত চারু তাকে ভয় পাচ্ছে না সেটা সে ঠিক মত হজম করতে পারছে না । চারু আবার বলল, এভাবে পুরো বিল্ডিং নিজের নিয়ন্ত্রনে নেওয়ার কোন দরকার ছিল না ।

আরিয়ান হাসল । তারপর বলল, আসলে আমার নিজের নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে ।  আমি যেখানেই যাই সেখানে সবার আগে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি । তবে চিন্তার কোন কারণ নেই । সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া হয়েছে ।

-আচ্ছা বুঝলাম । এখন আমি কি জানতে পারি আপনি আমার সাথে কেন আর কী নিয়ে কথা বলতে চান?

কথার মাঝেই একজন দু’কাপ কফি নিয়ে এল ।

কফির দিকে তাকিয়ে চারু একটু চমকালো । কারণ এখানে আসলে প্রতিবার সে এই কফিটাই অর্ডার দেয় । তার মানে সামনে বসা লোকটা তার ব্যাপারে সব কিছু জেনে গেছে । এই লোক আসলেই বিপদজনক । আকিব সাহেব ঠিকই বলেছিলেন । চারু সেই চিন্তাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে কফিতে চুমুক দিলো । একটা ভাল কফি সব কিছু ভুলিয়ে দিতে পারে । 

আরিয়ান বলল, গত সপ্তাহে তোমাকে ডিবির একটা আলাদা ব্রাঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল একটা বিশেষ কাজে । 

চারু চোখ তুলে তাকাল । আরিয়ানের কালো চশমার ভেতর দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলো । তবে বুঝতে পারলো আরিয়ান তার দিকে তাকিয়ে নেই । সম্ভবত চোখ বন্ধ করে আছে । ব্যাপারটা ধরতে পেরে চারুর বেশ মজা পেল । 

আরিয়ান অবশ্য সেটা খেয়াল করলো না । সে বলেই চলেছে, ফেঞ্চ ডেলিকেটদের যেখানে মিটিং হওয়ার কথা ছিল সেই ভবনের নিচে বোমাটা সেট করা ছিল । এবং সেই ভবনটার টপ ফ্লোরে ওরা আমার সাথে দেখা করতো ।

-আপনি বলতে চান বোমাটা আপনাকে মারার জন্য সেট করা হয়েছিল ?

-বলতে পারো । আমার কারণে অনেকেই তাদের কার্যক্রম এ দেশে চালাতে পারে না । দেশে যেমন আছে, বিদেশেও আছে । আমি মারা গেলে তাদের পথ পরিস্কার হবে । তোমার কারণে আমি রক্ষা পেয়েছি । থ্যাঙ্কসটু ইউ ।

-ওয়েলকাম । তবে আমি নিশ্চিত যে শুরু এই ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে এখানে ডাকেন নি । আর দয়া করে কালো চশমাটা খুলে রাখুন । আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই । 

ভয় শব্দটা শুনে আরিয়ান আহমেদের মুখের হাসি একটু মিলিয়ে গেল । সে এই দেশের প্রচন্ড ক্ষমতাধর একজন মানুষ তার তাকেই কিনা এক পুঁচকে মেয়ে বলছে ভয় না পেতে । আরিয়ান চশমাটা খুলে রাখলো টেবিলের সামনে । তারপর চারুর দিকে সরাসরি তাকালো । চারু আরিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে এই ছেলের কেবল চেহারাই নয় চোখ অসম্ভব সুন্দর !   

013

চারু সেই চোখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে গিয়ে দেখলো আরিয়ান নিজের চোখ সরিয়ে নিয়েছে । চারু হেসে ফেলল। তারপর বলল, ভয় পাবেন মিস্টার ডন । আমি কারো মনের ভেতরে এভাবে ঢুকে পরি না । মানুষের মন বড় ভয়ংকর এক জায়গা । এটার থেকে দূরে থাকা ভাল । এখন বলুন যে আমাকে কেন এখানে আসতে বলেছেন?

আরিয়ান তার সামনে রাখা কফির কাপে একটা চুমুক দিলো । তারপর বলল, আমার বাবার নাম তো শুনেছো তুমি ? আকবার আহমেদ খান! অনেক দিন ধরেই সে বিছানাতে । সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে সে এই অবস্থাতে আছে । কোমাতে ছিল অনেক দিন ।
আরিয়ান থামলো একটু । কাঁচের দেওয়াল দিয়ে তাকালো বাইরে । সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর বলল, আমি আমার বাবার কাছ থেকে আমার মায়ের তথ্য জানতে চাই । আমার মা কে আমি জানি না । খুব সম্ভবত আমার মাকে সে মেরে ফেলেছে । কোথায় মেরেছে, কিভাবে মেরেছে এটা জানতে চাই।

চারু এবার সত্যিই অবাক হল । এভাবে সোজাসুজি যে আরিয়ান আহমেদ নিজের মনের কথা বলে দিবে সেটা সে ভাবতে পারে নি । চারুর মুখের ভাবটা দেখে আরিয়ান বলল, অবাক হলে আমার কথা শুনে ? আসলে আমি ঠিক ঠিক জানি তুমি কী করতে পার । এই জন্য আমি কোন ভণিতা করি নি । সরাসরি যা চাই তাই বলে দিয়েছি ।

চারু বলল, বুঝতে পারছি । কিন্তু আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না । মানে আপনি যা চাচ্ছেন তা আমি করবো না । আমার ব্যাপারে যেহেতু আপনি সব কিছু জানেন তাই এই টুকুও জানেন যে এরপর আপনার বাবার কী অবস্থা হবে !
-তাতে আমার কিছু যায় আসে না ।
-আপনার কিছু না যায় আসলেও আমার আসে । মানুষের মন বড় গোপন জায়গা । একমাত্র উপরওয়ালার ছাড়া আর কারো সেখানে ঢোকার অনুমূতি নেই । এমন কি মানুষের মনের ভেতরে এমন সব স্থান আছে যেখানে সে নিজেও প্রবেশ করতে পারে না কিংবা ভয় পায় । আর আপনি আমাকে সেই কাজটা করতে বলছেন ! এটা আমি করবো না ।

চারু দেখলো আরিয়ানের চোখ দুটো মুহুর্তেই জ্বলে উঠলো । সেখানে একটা তীব্র আগুন দেখতে পেল সে । শান্ত আর ঠান্ডা গলায় আরিয়ান আহমেদ বলল, তুমি জানো আমি কী করতে পারি?
-আপনি কী করতে পারেন সেটা আমার মোটেও দেখার বিষয় না মিস্টার আরিয়ান । আমি কী করবো না করবো সেটা একান্তই আমার নিজের ব্যাপার । কেউ আমাকে কিছু করতে জোড় করুক সেটা আমি মোটেই পছন্দ করি না । আমি এখন আসি । কফির জন্য ধন্যবাদ । 

আরিয়ানকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই চারু উঠে দাড়ালো । তারপর দরজাা ঠেলে বের হয়ে গেল । একটু যে ভয়ভয় করছিলো না সেটা চারু অস্বীকার করবে না । তবে একটা ভরশা ছিল যে আরিয়ান আহমেদ কিছু করবে না । কারণ বিল্ডিংয়ে আসার আগে সে গিয়েছিল আকিবের কাছে । আরকিব ওর শরীরে একটা এয়ারপিচ বসিয়ে দিয়েছে । পুরোটা সময় আকিব লাইনে ছিল । এবং আকিবের গাড়িটা বিল্ডিংয়ের আশে পাশেই আছে । যে কোন সমস্যা হলে কেবল একটা ডাক দিলেই আকিব চলে আসতো । তাই মনের ভেতরে এই ভয়টা খুব একটা কাজ করে নি । 


বিল্ডিং থেকে বের হতেই আাকিবকে দেখতে পেল । গাড়ি নিয়ে সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । চারু কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠে পড়লো । গাড়ি চলতে শুরু করলে আকিব বলল, তোমার সত্যিই সাহস আছে । মানতেই হবে !

চারু কেবল হাসলো । তারপর বলল, গতরাতে আপনার সাথে ওমন ব্যবহারের জন্য আমি সরি । আসলে আমাকে কেউ যখন কিছু করতে বলে আমার মেজাজ খুব খারাপ হয় । আপনি যখন বললেন যে আমি মোটেই দেখা করতে যাবো না তখন কেন জানি মেজাজ খুব খারাপ হল । তাই ওমন করে বলেছিলাম । পরে ভেবে দেখলাম যে আপনার কথা আসলে ঠিক । এই লোক আসলেই বিপদজনক ।

আরিয়ান বলল, হ্যা । আর আমি চাই যে এরপর থেকে তুমি একটু সাবধানে চলাচল কর।

-কেন? 

-তুমি দেশের সব চেয়ে ক্ষমতাধর অপরাধীকে না করে এসেছো ! হিসাব আছে ?

চারু ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করলো । সত্যি একটু চিন্তার ব্যাপার । যদিও চারুর নিজের প্রতি ভরশা আছে । সে নিজেকে সামলে নিতে পারবে । 

আকিব বলল, তবে আমি তোমার উপর কিছু চোর রাখার ব্যবস্থা করছি । প্লিজ মানা করো না । এটা তোমার ভালর জন্যই !

চারু কিছু বলতে গিয়েও বলল না । 

আকিব চারুকে হলের গেটে নামিয়ে দিল । তারপর চারুর উপর নজর রাখার জন্য দুইজন পুলিশ ঠিক করলো । যদিও লাভের কিছুই হল না । দুইদিন পরে চারু যখন সন্ধ্যা বেলা টিউশনী থেকে হলের দিকে ফিরছিলো রিক্সা করে তখনই চারুকে কিডন্যাপ করা হয় । চারু কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন লাফ দিয়ে চারুর রিক্সাতে উঠে পড়ে এবং একটা রুমাল চেপে ধরে ওর মুখে । বলা চলে সাথে সাথেই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ।

014

আরিয়ান বেশ কিছু সময় ধরেই চারুকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে । চারুকে কিভাবে ধরে আনতে হবে সেটা সে তাদের লোকজনকে খুব ভাল করেই জানিয়ে দিয়েছিল। তাদেরকে পরিস্কার ভাবে বলা হয়েছিল যাতে চারু কোন ভাবেই চিৎকার করার সুযোগ না পায় । প্রথম কাজই হবে চারুর মুখে ক্লোফর্ম মিশ্রিত রুমাল চেয়ে ধরা । অন্য সব কাজ পরে । কারণ হিসাবে কেবল বলা হয়েছিলো যে চারুর পেছনে সব সময় পুলিশ থাকবে । তাই চিৎকার যদি করতে পারে তাহলে তাকে কোন ভাবেই তুলে আনা যাবে না ।
আরিয়ান তার সব থেকে যোগ্য লোকদের কাজের ভার দিয়েছিলো । সামান্য একটা মেয়েকে তুলে আনার জন্য এই রকম দক্ষ লোকের ব্যবহার করাটা ওর দলের অনেকেই ঠিক বুঝতে পারে নি । তবে আরিয়ানের উপর কথা বলা কিংবা তার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন প্রশ্ন করার সাহস আসলে কারোরই ছিল না । কাজটা খুব সহজেই তারা করে ফেলেছে । চারুকে ধরে আনা হয়েছে ।
নিজের অফিসের সোফাতে চারুকে আধশোয়া ভাবে রাখা হয়েছে । চারুর হাত পেছন দিক দিয়ে হ্যান্ড কাফ দিয়ে আটকানো আর চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা । নিজ হাত দিয়ে সে কোন ভাবেই নিজের চোখ খুলতে পারবে না । আর চোখ না খুলতে পারলে চারুর কাছ থেকে কোন ভয় নেই ।

চারুর ব্যাপারে প্রথম যখন সে জানতে পারে তখন কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারে নি । এমন ক্ষমতা কি মানুষের থাকতে পারে?
কোন ভাবেই সেটা সম্ভব না । ডিবির ভেতরে তার নিজের লোক আছে । সব সময় সব রকম খবর তার কানে চলে আসে । কিন্তু যখন ভিডিওটা আরিয়ানকে দেখানো হল আর সেটার সাহায্য বোমাটার খোজ বের করে ফেলা হল তখন সে বিশ্বাস না করে পারে নি । এর ভেতরে হয়তো কোন অলৌকিক ব্যাপার নেই । বিজ্ঞান বলে যে মানুষ তার মস্তিস্কের মাত্র বিশ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে । হয়তো চারুর ব্রেনে এমন কিছু আছে যার সাহায্য যে তার নিজের মস্তিস্ক কয়েক গুণ বেশি ব্যবহার করার ব্যাপারে । এর ভেতরে অলৌকিক কিছু নেই।

তবে ভিডিওটা দেখার পর প্রথম যে কথাটা আরিয়ানের মাথায় তা হল নিজের বাবার মাথার ভেতর থেকে সে তার মায়ের সংবাদটা বের করে আসতে পারবে এইবার । আরিয়ান ভেবেছিলো যে চারুকে কেবল বললেই হবে । সে সুরসুর করে সব কাজ করে দিবে । যারা তার পরিচয় জানে তাদের কাছে আরিয়ান যে কত বড় আতঙ্কের নাম সেটা সে ভাল করেই জানে । চারুও যে এমন কিছু করবে সেটা সে ভেবে রেখেছিল । কিন্তু এই মেয়ে ভয় তো দুরে থাকুক সামান্য তম সমীহ পর্যন্ত করে নি । নিজের দরকার না হলে চারুকে এই দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিতে আরিয়ানের খুব বেশি সময় লাগবে না । এই কথাটা এই মেয়েটাও খুব ভাল করেই জানে অথচ সে মোটেই ভয় পাচ্ছে না । এটাই আরিয়ানকে আরও বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে । এই মেয়েকে সে ভয় দেখিয়েই ছাড়বে । এটা সে প্রতিজ্ঞা করেছে নিজের কাছেই ।

তখনই খেয়াল করলো যে চারুর ঘুম ভেঙ্গেছে । একটু একটু নড়ছে । জেরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাও বুঝতে পেরেছে যে চারুর ঘুম ভাঙ্গছে । জেরিন চারুর ব্যাপারে সব কিছুই জানে । তাই ওর চোখে একটা ভয় ফুটে আছে । মেয়েটাকে সে শুরু থেকেই ভয় পাচ্ছে । তার মতে মেয়েটার ভেতরে অলৌকিক কিছু আছে । এই কারণে সে এসব করতে পারছে ।
আরিয়ান চারুকে একটু ধাস্তত্ব হতে সময় দিলো । তবে অবাক হয়ে খেয়াল করলো যে এই রকম চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় যে কেউ পরলে যেরকম আচরণ করা উচিৎ ছিল কিংবা যেই রকম প্যানিক করার দরকার ছিল চারুর ভেতরে তেমন কিছুই দেখা গেল না । সে কেবল শান্ত হয়ে বোঝার চেষ্টা করলো যে বর্তমানে সে কোথায় আছে । চারুর শান্ত ভাবটা দেখে আরিয়ান সত্যিই একটু অবাক হল । এমন একটা মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না । অবশ্য চারু নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে খুব ভাল করেই জানে । সে জানে অন্য সবার থেকে তার ভেতরে অন্য কিছু রয়েছে । এই ক্ষমতার ব্যাপার অন্য রকম । আরিয়ান নিজে জানে অন্য সবার থেকে বেশি ক্ষমতাধর হওয়ার অনুভূতি কেমন !

আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই । আরিয়ান বলল, মিস চারুলতা চৌধুরী । ঘুম ভাঙ্গলো তাহলে । 

আরিয়ান দেখতে পেল চারু সোজা হয়ে বসলো আরও একটু । আরিয়ানের কন্ঠস্বর সে চিনতে পেরেছে । 

015

কয়েক মুহুর্ত চলে গেল । চারু নিজেকে পুরোপুরি শান্ত করে নিয়েছে । তারপর শান্ত গলায় বলল, আপনি?
-চিনতে পেরেছো ?
-না চেনার তো কোন কারণ নেই । আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে আসার কারণ কী ?
-তুমি সম্ভবত জানো তোমাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
-তাহলে আপনারও জানার কথা যে আমি আপনাকে সেদিনই মানা করে দিয়েছিলাম । বলেছিলাম যে আমি এই কাজটা করবো না ।

আরিয়ান সত্যি অবাক না হয়ে পারছে না । এই মেয়ের নার্ভ দেখে অবাক হতে হচ্ছে ওকে । চারুকে ও ধরে নিয়েছে । এমন একটা অবস্থায় চারু আছে যেখানে চারু এখন পুরোপুরি আরিয়ানের হাতে বন্দী অথচ চারুর কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয় নি । আরিয়ান বলল, তুমি কি বুঝতে পারছো না যে তুমি আসলে এখানে কোন আর্গুমেন্টের পর্যায়ে নেই । তোমাকে যা করতে বলা হবে তাই করবে ।
-না করলে?
-না করলে তোমার সাথে কী হবে তুমি অনুমান করতে পারো ?
চারু একটু থামলো । তারপর বলল, না অনুমান করতে পারি না । আর করতেও চাই না ।
বলেই চারু যেন একটু হাসলো । আরিয়ান খানিকটা থমথমে গলায় বলল, হাসছো কেন? তুমি কি ভাবছো তোমাকে আমি কিছু করবো না ?
-না সেই জন্য হাসছি না । আমি জানি আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন ।
-তাহলে?
-হাসছি আপনার অসহায়ত্ব আর ভয় দেখে ।

আরিয়ান তীব্র ভাবে অবাক হয়ে তাকালো চারুর দেখে । মেয়েটার সাহস দেখে সে সত্যিই অবাক হয়েছে । অসহায়ত্ব আর ভয় শব্দ দুটো তার সেক্রেটারি জেরিনও শুনতে পেয়েছে । আরিয়ানের চোখ যখন জেরিনের উপর পড়লো, সে দেখতে পেল যে জেরিনের মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে । সে আরিয়ানকে ভয় পায় জমের মত । সে খুব ভাল করেই জানে যে আরিয়ান রেগে গেলে কী হতে পারে । আর সামনে বসা এই মেয়েটা তাকে রাগিয়ে দিচ্ছে কিংবা দেওয়ার চেষ্টা করছে । মেয়েটা কী বোকা নাকি !
আরিয়ান বলল, ভয়?
-নয়তো কি? আপনি এতো ক্ষমতাবান মানুষ অথচ আমার সামনে বসে আছেন ভয় নিয়ে । এই যে চোখে কালো কাপড় বেঁধে রেখেছেন, ভয় থেকে । আপনি আসলে ভয় পাচ্ছেন আমাকে । আর পাওয়াই উচিৎ ।
শেষের লাইনটা একটু টিটকারির সুরেই বলল চারু ।
-কথা বার্তা সামলে বল !

এই লাইণ শুনে চারু এবার সত্যিই হেসে ফেলল । তারপর বলল, শুনেন মিস্টার আরিয়ান আপনি যে আমার সামনে অতিক্ষুদ্র একজন মানুষ সেটা আপনি নিজেও জানেন । কেবল মাত্র আমার চোখ খুললে আপনি আমার সামনে ৫ মিনিটও চিকবেন না । ৫ মিনিট । আমি আপনাকে স্পর্শ পর্যন্ত করবো না তারপরেও আপনার অবস্থা কাহিল করে দিতে পারি । এই যে আমাকে এভাবে বীর পুরুষের মত চোখ বেঁধে রেখেছেন এটা আপনার সাহসের পরিচয় ! আপনি নাকি আবার পুরো ঢাকার ডন । নাম্বার ওয়ান সাকিব খান । না, নাম্বার ওয়ান আরিয়ান খান !

এই লাইনটা বলে চারু যেন খুব মজা পেল । তারপর নিজে নিজেই হাসতে শুরু করলো । আরিয়ান সত্যিই অবাক হয়ে গেল . জন্মের পর থেকে তার সাথে এমন ভাবে কেউ কোন দিন কথা বলেছে কিনা সেটা আরিয়ান নিজেও বলতে পারবে না । এমন কি যখন সে ডন হয় নি তখনও মানুষ তার সাথে সামলে কথা বলতো । তাদের চোখে সব সময় সে সমীহ দেখেছে, ভয় দেখেছে । অথচ সামনে বসা এই পিচ্চি মেয়ে ওকে অপমান করে টিককারি মেরে কথা বলছে । বিস্ময়ের পর আরিয়ান অনুভব করলো ওর পুরো শরীর জুড়ে একটা রাগের প্রবাহ বয়ে গেল । আর এই রাগের প্রধান কারণ হচ্ছে চারু যা বলছে সেটা মিথ্যা না । কিন্তু তাই বলে এভাবে নিজের অপমান সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না । জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, জেরিন ওর চোখ আর হাত খুলে দাও ।
-কিন্তু স্যার ….
-কোন কিন্তু না । যা বলছি কর ।
জেরিন আর কিছু বলার সাহস পেল না । ধীর পায়ে এগিয়ে এসে চারুর হাতের হ্যান্ডকাফ এবং পরে চোখের বাঁধন খুলে দিলো।
আরিয়ান তখনও কালো সানগ্লাস পরে আছে । সে চারুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যদি তোমার সামনে ৫ মিনিট টিকতে পারি তাহলে তুমি আমার কথা মত কাজ করবে । মানে আমার মায়ের সাথে কী হয়েছিলো সেটা বের করবে আমার বাবার কাছ থেকে আর যদি এই পাঁচ মিনিটের আগে আমি মারা যাই তাহলে তুমি নিশ্চিন্তে এই ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে যাবে, নিজের জীবনে ফেরৎ যাবে । আমার দল থেকে কোন দিন তোমাকে কোন প্রকার ডিস্টার্ব করা হবে না আর কোন দিন ! ডিল !
চারু একটু নড়ে চড়ে বসলো । তারপর বলল, ডিল !

আরিয়ান তার সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি শুনলে তো সব !
-জ্বী স্যার !
-এখন বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর ।

016

আরিয়ান জানে যে কাজটা সে করতে যাচ্ছে সেটা মোটেই বুদ্ধিমানের কোন কাজ নয় । তবে এই কাজটা না করলে নিজের কাছেই সে ছোট হয়ে যাবে । বারবার মনে হবে যে সে আসলে ভীতু । একটা পিচ্চি মেয়ের সামনে সে ভয় পেয়ে ছিল । কিন্তু আরিয়ান কাউকে পায় না ।

আরিয়ান নিজের চোখের চশমা খুলে ফেলল । তারপর সরাসরি তাকালো চারুর দিকে । চারু যখনই ফিরে তাকালো ওর চোখের দিকে তখনই অনুভব করলো যে কিছু একটা সরাসরি ধাক্কা মারলো যেন ওর মাথায় । মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করলো । চোখ সে সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু পারলো না । মনে হল যেন ওর মাথাটার ভার অনেক বেশি হয়ে গেছে । সে কিছুতেই সেই ভার বহন করতে পারছে না । কেউ ধারালো কোন ছুরি দিয়ে ওর মাথার ভেতরটা ফলা ফলা করে কেটে দিচ্ছে । সেই চিরে ফলা ফলা করে দেওয়ার অনুভূতিটা আরিয়ান একেবারে সত্যি সত্যি টের পেল । এই যন্ত্রণা কোন মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না ।
আরিয়ান আর সহ্য করতে পারলো না । জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে !

চারু নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলল । সে চাইলে আরিয়ান আহমেদের অবস্থা আরও খারাপ করে দিতে পারতো । আরিয়ান অজ্ঞান হয়েছে কারণ চারু তাকে অজ্ঞান হতে দিতেছে । একবার যখন চারু কারো মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ে তখন চাইলেও তারা নিজেদের চোখ বন্ধ করতে পারে না । চোখ সরিয়ে নিতে পারে না । একবার চারুর মনেই হয়েছিলো যে আজকেই সব কিছু শেষ করে দেওয়া যায় । আজকেই এই ডনকে একেবারে নিস্তেজ করে কোমাতে পাঠানো যায় তবে সেটা সে করলো না । কেন করলো না সেটা চারু নিজেও জানে না । এই মানুষটা ওকে ধরে নিয়ে এসেছে । হয়তো কথা না শুনলে ওকে মেরেও ফেলতে পারতো । তারপরেও চারুর ডন সাহেবের উপর কেন জানি রাগ হচ্ছে না ।
সোফার উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা ডনের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সে । আরিয়ান আহমেদ যে দেখতে সুদর্শন সেই ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই । চারু কিছু সময় তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে । তারপর উঠে দাড়ালো । ডান দিকে বড় একটা সেক্রেটারি টেবিল । তার উপরেই চারুর ব্যাগটা রয়েছে । ধীর পায়ে এগিয়ে ব্যাগটা তুলে নিল সে । তারপর দরজার দিকে পা বাড়ালো ।

দরজা খুলে বের হতেই দেখতে পেল একটা মেয়ে ওর দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । মেয়েটা এতো সময় দরজার সামনেই দাড়িয়ে ছিল । এই মেয়েটার নামই সম্ভবত জেরিন । জেরিনের দিকে তাকিয়ে চারু মিষ্টি করে হাসলো । তারপর বলল, আপনার ডন স্যারের জন্য ডাক্তার ডাকেন । সে অজ্ঞান হয়ে গেছে ।
জেরিন তবুও নড়লো না । চারুর দিকে তাকিয়ে রইলো । চারু বলল, আপনি কোন দিক দিয়ে নিচে নামবো বলতে পারেন ?
জেরিন হাত দিয়ে কেবল বাম দিকের একটা করিডোর দেখালো । চারু লক্ষ্য করলো মেয়েটার হাত একটু একটু কাঁপছে ।
চারু বলল, ধন্যবাদ । আপনার ডন স্যার নিশ্চয় তার দেওয়া কথা রাখবে । সে নিজে খানিকটা বুঝতে পেরেছে যে আমি যখন কাজটা করি তখন সামনের মানুষটার উপর দিয়ে কি যায় । আশা করি সে অন্য কারো উপর এটা প্রয়োগ করতে বলবে না । আর আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই । আমি ভুত প্রেত না ।

জেরিনকে দাড় করিয়ে দিয়ে সে বাম দিকের দেখানো পথ দিয়ে হাটা শুরু করলো । বেশ কয়েকটা দরজা পার হতে হল তাকে । প্রতি দরজার সামনেই গার্ড রয়েছে । তবে সবাই ভদ্র পোশাকে । কেউ তাকে আটকালো না । তবে সবাই খানিকটা অবাক চোখেই তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে ।  

যখন আরিয়ান চোখ মেলে তাকালো দেখতে পেল সে বিছানাতে শুয়ে আছে । তার মুখের উপরে জেরিনের চিন্তিত মুখটা দেখা যাচ্ছে।
ওর চোখ মেলে তাকাতেই জেরিন বলল, স্যার আপনি ঠিক আছেন ?
-কতক্ষণ জ্ঞান নেই আমার ?
-প্রায় ৫ ঘন্টা ।
-চারু কোথায় ?
-চলে গেছে স্যার !

ডাক্তার ওকে আরেকবার পরীক্ষা করলো । তার হাতে বেশ কিছু কাগজ । আরিয়ানের এই বিল্ডিংয়ের নিচেও একটা হাসপাতাল আছে । সেটা ওর নিজের হাসপাতাল । সেখানে ওর বাবাকেও রাখা আছে ।
ডাক্তার বলল, আপনার ব্রেনের উপরে সম্প্রতি খুব চাপ পরেছে । সেখান থেকে ব্রেক ডাউনটা হয়েছে । কদিন এসব চিন্তা ভাবনা থেকে দুরে থাকুন । বিশ্রাম নিন একদম ।

আরিয়ান কোন কথা বলল না । নিজের উপর তীব্র একটা রাগ হল । নিজের বোকামী দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল । বিশেষ করে চারুর কাছ থেকে ওভাবে অপমান হওয়াটা সে মেনে নিতে পারে নি । তাই হয়তো এমন করেছিলো যার ফল সে পেয়েছে হাতে হাতেই । 

017

রতন চৌধুরী সোজা হয়ে বসে আছেন । কিছুতেই তিনি স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না । তার সামনে বসা মানুষটা তাকে স্বস্তিতে বসতে দিচ্ছে না । এই মানুষটার এখানে বসে থাকা মানেই তার কাছে অস্বাভাবিক কিছু, অশুভ কিছু । এতো গুলো বছর পরে এ এই মানুষটাকে আবার দেখতে পাবেন সেটা তিনি কখনই ভাবেন নি । 

এই যে মাঝখান দিয়ে প্রায় বিশ বছরের বেশি পার হয়ে গেছে অথচ লোকটা এখনও একদম আগের মতই আছে । যেমন সে তাকে দেখেছিল । শান্ত আর নিষ্প্রাণ তার চোখ । ঠান্ডা মাথার খুনীদের চোখে যেমন হয় ঠিক সেই রকম । এখন তারই ড্রয়িং রুমে বসে চা খাচ্ছে শান্ত ভাবে । এমন একটা ভাব করে আছে যেন রতন সাহেব তার অনেক দিনের পরিচিত । অনেক বছর পরে তাদের দেখা হয়েছে । পুরানো বন্ধুর আথে বসে গল্প করছেন ।

-কী ব্যাপার চা নিচ্ছেন না কেন রতন সাহেব!

কথাটা শুনেই চমকে উঠলেন রতন চৌধুরী । কথাটা যেন একেবারে রতন চৌধুরীর বুকে গিয়ে লাগলো । 

লোকটা আবার বলল, আপনি এমন ভাব করছেন যেন আমি না আপনিই আমার বাসায় এসেছেন । নিন নি চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । ভাবীর হাতের চা কিন্তু চমৎকার ।

চা নিতে গিয়ে রতন চৌধুরী খেয়াল করলেন যে তার হাত একটু একটু কাঁপছে । তিনি নিজেকে শান্ত করলেন । একটা বড় করে দম নিলেন । চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিলেন । তারপর বললেন, আপনি কেন এসেছেন? এতোগুলো বছর পরে ?

রতন চৌধুরী দেখলেন লোকটার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল । তবে সেটা ফিরে এল প্রায় সাথে সাথেই । রতন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনি জানেন আমি কেন এসেছি।

-দেখুন চারু আমাদের মেয়ে । আপনি তাকে নিয়ে যেতে পারবেন না ।

কথাটা যেন খুব মজার কিছু । লোকটা হো হো করে হেসে ফেলল । তারপর বলল, আপনি খুব ভাল করেই জানেন চারু কে আরও ভাল করে বললে সে কী ! সে আপনাদের মেয়ে না এটাও খুব ভাল করেই জানেন । আর আপনিই তো ওকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । মনে নেই? সব ভুলে গেছেন ? চারুকে এখানে রাখার বিনিময়ে কত টাকা নিয়েছিলেন মনে আছে?

রতন চৌধুরী কী বলবেন খুজে পেলেন না । কারণ সামনে বসা লোকটা যা বলছে তার কোনটাই মিথ্যা না । চারুকে নিজেদের কাছে রাখার জন্য সে এই লোকটার কাছ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা নিয়েছিল । সেই টাকা দিয়েই পরে নিজেদের ব্যবসা বানিজ্য করে ভাগ্য ফিরিয়েছেন । এই কথা তিনি কখনই ভুলে যান নি । কিন্তু তারপরেও চারুকে নিজের মেয়ের মত করেই বড় করেছেন । চারুকে তিনি ভয় পেয়েছেন সত্য তবে তাকে সে ভালও বেসেছেন এটাও তো মিথ্যা না । এখন এতো গুলো বছর পরে এসে কেউ যদি চারুকে নিয়ে যেতে চায় তাহলে তিনি কিভাবে মেনে নিবেন ?

রতন চৌধুরী বললেন, আমি আপনার সব টাকা ফেরত দিয়ে দিবো । 

এই কথাটা শুনে সামনে বসা লোকটা এতো জোড়ে হেসে উঠলো যে রান্না ঘর থেকে রতন চৌধুরীর স্ত্রী রাবেয়া চলে এল । লোকটার হাসি থামিয়ে রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবি রতন ভাই এমন হাসির কথা যে বলে আপনাকে কী বলবো । অনেক দিন আমি এই রকম মজার কথা শুনি নি । যাই হোক এখন যেহেতু আমি দেশে এসেছি আমি কিন্তু প্রায়ই আসবো আপনাদের বাসায় । আপনার হাতের চা খেয়ে যাবো । 

রাবেয়া কিছুই বুঝলো না । কেবল হাসলো । আর বলল, হ্যা ভাই অবশ্যই আসবেন । কোন সমস্যা নেই । 

রাবেয়া রান্না ঘরের দিকে চলে যেতেই লোকটা তার হাসি থামিয়ে দিলো । তারপর বলল, শোন রতন মিয়া হাসি মশকরা অনেক হয়েছে । তুমি জানো আমার কাছে টাকা পয়সার কোণ মূল্য নেই। চাও তো আরও ২০ লাখ তোমাকে দিতে পারি । কাল তোমার ব্যাংক একাউন্টে পৌছে যাবে । টাকা নিয়ে চিন্তা কর না । তবে অন্য কথাবার্তা বলবে না । তোমার কাছে আমার এক অমূল্য সম্পদ আমি রাখতে দিয়েছিলাম । সেটা রাখার জন্য তোমাকে টাকা দেওয়া হয়েছে । বলেছিলাম আমি যখন আবার ফেরত আসবো তখন আমাকে আমার সম্পদ দিয়ে দিবে । এখন কথার অন্যথায় হলে সেটা তোমার জন্য মোটেই ভাল হবে না । চারু কোথায় ?

রতন চৌধুরী কিছু সময় কোন কথাই বলতে পারলো না । ভয়ের একটা স্রোত তার পুরো শরীর বেয়ে বয়ে গেল । সামনে বসা মানুষটার চোখের রঙ লাল হয়ে গেছে । ভয়ংকর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রয়েছে রতন চৌধুরীর দিকে । রতন চৌধুরীর মনে হল যে এ এখনই মারা যাবে । এই লোকটা এখনই তাকে মেরে ফেলবে।

-চারু এখানে থাকে না।

-কোথায় থাকে ?

-ঢাকা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । হলে থাকে । 

-তোমাকে না বলেছিলাম ওকে দেখে শুনে রাখতে। তাহলে ওকে হলে যেতে দিলে কেন?

-আমার কিছুই করার ছিল না । চারু যখন নিজের ভেতরকার অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা জানতে পারে তখন সে নিজেই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় পাছে আমাদের কোণ ক্ষতি করে ফেলে । আর আপনি তো জানেন যে তাকে বাধ্য করানোর মত ক্ষমতা আমাদের ছিল না । 

লোকটা বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো রতন চৌধুরীর দিকে । রতন চৌধুরী খেয়াল করলো যে তার চোখ আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে । সে চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছেন আপনি । আসলে ওকে বাধ্য করাতে পারবে না কেউ । যাক সমস্যা নেই । আমি নিজেই যাবো ওর কাছে । 

এই বলে লোকটা উঠে দাড়ালো । তারপর দরজার দিকে হেটে গেল । সেখানে গিয়ে ফিরে তাকালো আবার । বলল, আপনার একাউন্টে টাকা ঢুকে যাবে । আর আমি কিন্তু সত্যিই আবার আসবো চায়ের জন্য । আপনার স্ত্রী আসলেই চা ভাল বানায় । 

এই বলে লোকটা দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল । রতন চৌধুরীর বুকের উপর থেকে যেন একটা বড় চাপ নেমে গেল । কিন্তু সেই সাথে সাথে মনের ভেতরে একটা তীব্র আতংঙ্ক এসে জড় হল চারুর জন্য । মেয়েটা এখন কোথায় আছে কে জানে । মায়ের সাথে সে কথা বলে প্রায় কিন্তু তিনি নিজে কথা বলেন না খুব একটা । একটা সংকোচ তার রয়ে গেছে সেই শুরু থেকেই । মোবাইল বের করে চারুকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলেন কয়েকবার কিন্তু চারুর মোবাইল বন্ধ । মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে ! রতন চোধুরী জানেন না চারুকে যখন সে ফোন দিচ্ছে তখন চারুকে আরিয়ান আহমেদের লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে । তার মোবাইল এই কারণে বন্ধ । 

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 19

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →