চারু (২য় ভাগ)

oputanvir
4.8
(18)

আগের পর্ব

006

ডিবির এটিও অফিসে তারা প্রবেশ করলো আরও আধা ঘন্টা পরে । স্বয়ং লতিফুল রহমান গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল । চারুলতাকে দেখে হাসিমুখে বলল, অবশেষে আবার দেখা হল ?

চারু হাসলো কেবল । আর কোন জবাব দিলো না । লতিফুল রহমান তাকে নিয়ে সরাসরি ইন্টারোগেশন রুমের ওয়াচিং সেকশনে নিয়ে গেল । ইন্টারোগেশন রুমটা এই রুম থেকে দেখা যায় একটা কাঁচের মাধ্যমে । চারু দেখতে পেল এখানে একই সাথে দুইজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে । চারুর দিকে তাকিয়ে লতিফুল রহমান বলল, এই দুইজন হচ্ছে বোমা বিশেষজ্ঞ । আইএসআই এর প্রোডাক্ট । মিডিলইস্টের প্রায় অর্ধেক বোমা হামলার পেছনে এদের হাত রয়েছে । আমাদের হাতে ধরা পরেছে গত পরশু । স্বভাবই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে যে তারা এখানে বোমা সেট করে চলে গেছে । এখন বোমার লোকেশন এরা কিছুতেই আমাদের বলছে না । আমরা কিছুতেই এদের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারি নি । 

চারু বলল, আপনি জানেন তো কী হতে পারে?

লতিফুল রহমান বলল, কিছু যায় আসে না । এরা যদি পাগল হয়েও যায় এবং তার কারণে যদি হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচে তাহলে আমি যে কোন রিস্ক নিতে প্রস্তুত ।

-একটা মানুষের হয়ে অন্য মানুষ কিন্তু এই সিদ্ধন্ত নিতে পারে না । আপনি জানেন সেটা ?

-প্লিজ চারু । এতো গুলো মানুষের জীবনের প্রশ্ন !

আকিব অবাক হয়ে তার উর্ধ্বতন অফিসারের কন্ঠটা খেয়াল করলো । কিভাবে সামান্য একটা মেয়ের সামনে সে অনুনয় করছে । আকিবের মেজাজ টা আরও একটু খারাপ হল । এই পিচ্চি মেয়ের সামনে অনুরোধ করার কী আছে ! এক ধমক দিয়েই তো কাজ করানো যায় ।

চারু বলল, ওকে । একজনকে বের করে আনুন । ঐ যে লাল শার্ট পরা, ওনাকে বের করুন । আমি অন্য জনের সাথে কথা বলল। তবে এর দায়ভার আমার নয় । মনে থাকে যেন । এর পরে এই মানুষটার সকল দায়িত্ব আপনার ।  

-হ্যা হ্যা আবশ্যই । তুমি কোন চিন্তা করবে না । সব কিছু আমি সামলাবো ।

সাথে আথেই লাল শার্ট পরা ইনিস্ত আবেদকে ঘর থেকে বের করা হল ঘরে রইলো তৈফিক জাফ্রি । আকিব দেখতে পেল চারু খুব স্বাভাবিক ভাবে দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো । এইবার আকিব একটু অবাকই হল । একটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীর সাথে একই ঘরে প্রবেশ করাটা খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার না । যে কোন মানুষ বিশেষ ক্রে কম বয়সী কোন মেয়ের বেলাতে এই ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক । অথচ চারু এমন ভাবে ভেতরে ঢুকলো যেন এমন কাজ সে সব সময় করে । এই প্রথম চারু মেয়েটাকে একটু অন্য রকম মনে হল আকিবের কাছে ।

চারু টেবিলের ওপাশে রাখা চেয়ারে বসতেই জাফ্রি একতা বাজে মুখভঙ্গি করে হাসলো । চারু অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না । সে শান্ত হয়ে বসলো । তারপর নিজের চশমাটা খুলে রাখলো টেবিলের উপরে । এরপর সরাসরি তাকালো জাফ্রির দিকে । জাফ্রি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মাঝ পথেই থেমে গেল সে । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে । শরীর কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে । নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু হাত কড়ায় আটকে গেল সে । নিজেকে মুক্তি করতে চাইছে সে !

আকিব খুব অবাক হয়ে গেল । এই দুইদিনে জাফ্রির উপরে এমন কোন টেকনিক নেই যে প্রয়োগ করা হয় নি । কিন্তু তারা জাফ্রির কিছুই করতে পারে নি । অথচ এই মেয়েটার সামনে এ এমন আচরণ কেন করছে ? কী আছে মেয়েটার মাঝে ।

আকিব দেখতে পেল চারু একভাবে জাফ্রির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেবল । জাফ্রির চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে । সে এখন একেবারে স্থির হয়ে গেছে । একটুই নড়ছে না ।

চারু চোখ সরিয়ে নিল । সাথে সাথেই থপ করে জাফ্রি টেবিলের উপরে পড়ে গেল । চারু আবারও শান্ত ভাবে টেবিলের উপর থেকে চশমা টা নিয়ে পরলো । তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো । দরজার খুলে এরপর বের হয়ে এল । লতিফুল রহমানের সাথে সাথে আকিবও দ্রুত এগিয়ে গেল চারুর দিকে । চারুকে বসানো হল লতিফুল রহমানের অফিসে ।

-একটু পানি খাবো ।

007


লতিফুল রহমান নিজে পানি এগিয়ে দিল । এক ঢোকে পুরো পানি টুকু খেয়ে চারু কিছু সময় স্থির হয়ে বসলো । তারপর বলল, আপনাদের এই লোক জানে না বোমা কোথায় সেট করা আছে ।

আকিব ফুস করে একটা শব্দ করলো কেবল । যাক একটু শান্তি পেল সে । মুখ দিয়ে একটা টিটকারি মারার মত কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগে লতিফুল রহমান বলল, অন্য জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে?

-সেও জানে না ।

আকিব বলল, তুমি কিভাবে জানো? মাইন্ড রিডিং করেছো তুমি ? নাকি সব জান্তা তুমি ?

চারু আকিবের দিকে একবার তাকালো । তারপর আবার তাকালো লতিফুল রহমানের দিকে । তারপর বলল, জাফ্রি বোমাটা বানিয়েছে সত্য । তবে সে জানে না সেটা কোথায় সেট করা হবে । এমন কি সে তার এম্লোয়ারের নাম পর্যন্ত জানে না । তাকে আগে টাকা পাঠানো হয়েছে । ইমেলে জানানো হয়েছে কী কী করতে হবে। সে এসেছে । বোমা বানিয়েছে তারপর বোমা হ্যান্ডওভার করে দিয়েছে ।

লতিফুল রহমান হতাশ হয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন । চারু বলল, তবে এখনও এই এম্লোয়ারের খোজ পাওয়া সম্ভব ।

লতিফুল রহমান মুখ তুলে তাকালো । বলল, সম্ভব?

-হ্যা । গত পরশুদিনের আগের দিন মানে যেদিন তারা ধরা পরে তার আগের দিন সন্ধ্যায় তারা বোমাটা হ্যান্ডওভার করেছে । এবং এটা জন্য তারা কোন গোপন স্থান বেঁছে নেয় নি । বনানীর ওয়ায়ো রেস্টুরেন্টে এই বোমার ব্যাগটা সরবারহ করা হয়েছে । একেবারে খাওয়া দাওয়া করার সময়ে নিজেদের ব্যাগটা বদলে নিয়েছে । ওকে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে ব্যাগটা নিয়ে সে একটা টেবিলের নিচে রাখবে কিন্তু বসবে অন্য টেবিলে । সেই টেবিলের নিচেও একটা ব্যাগ থাকবে । পারিশ্রমিক । টেবিল দুটোই রিজার্ভ করা থাকবে । জাফ্রি লোকটার চেহারা না দেখলেও কেবল দেখেছে যে লোকটা ব্যাগ বদলেছে সে কালো স্যুট পরে ছিল । কেবল এইটুকু আমি জানি । আমরা ঐ রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেন তাহলেই আশা করি খুজে পাবেন ।

লতিফুল রহমান আকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, কুইক এখনই কাজে লেগে যাও ।

আকিব এতো সময় অবাক হয়ে চারুর কথা শুনছিল । কিছুই তার মাথায় ঢুকছিলো না । এই মেয়ে কিভাবে এসব বলছে ! লতিফুল রহমানের কথা শুনে তন্ময় ভাঙ্গলো । সে দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিলো তার আগে চারু আরও একটা কথা বলল, আপনাদের বোমা ডিফিউজ করতে একটা কোড লাগবে । কোন ভাবেই কোন তার কেটে সেটা বন্ধ করা যাবে না । কোডটা হচ্ছে ৩৪৪২২০। 

পরবর্তি দুইঘন্টার ভেতরে সত্যি সত্যি সেই কালো স্যুট পরা লোকের খোজ বের করে ফেলল ওরা । রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে । মালিককে ডেকে এনে সেটা খোলানো হল । সকল সিটিভিভি ফুটেজ চেক করে দেখা গেল সত্যিই ঐদিন সন্ধ্যায় জাফ্রি এই রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিল । তার হাতে কালো ব্যাগ ছিল । এবং কালো স্যূট পরা সেই লোকেরও খোজ পাওয়া গেল । তার হাতেও একই ধরনের কালো ব্যাগ । পার্কিং থেকে বের হওয়ার সময় তার গাড়ির নম্বরটা সিসিটিভিতে ধরা পরলো পরিস্কার । সেখান থেকে তাকে খুজেও বের করা গেল খুব জলদি ।

লোকটার নাম জাহিদ হাসান । সে এক বিদেশী এনজিওর সাথে যুক্ত । তাকেও সেই একই রুমে নিয়ে আসা হল । আকিব তখন লতিফুল রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার এর গায়ে এতো সহজে হাত দেওয়া যাবে না । আর আমরা যেটার বেসিসে একে ধরে নিয়ে আসলাম সেটাও কিন্তু ধোপে টিকবে না । মানে কোন ভাবেই কিন্তু জাফ্রির সাথে এই লোকের দেখা হয়েছে কিংবা পরিচয় হয়েছে এমন কি একটা শব্দ আদান প্রদান হয়েছে এমন কোন ফুটেজ সিসিটিভিতে নেই । রেস্টুরেন্টে আরও কত লোক ছিল । কেবল এক রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়ার জন্য তো একে টর্চার করা যাবে না । পরে যদি আমরা কিছু প্রমাণ না করতে পারি তাহলে আমার কিন্তু খবর আছে।

লতিফুল রহমান বলল, তাহলে এখন উপায়? 

আকিব কী যেন ভাবলো । তারপর বলল, স্যার একটা উপায় আছে কিন্তু ।

-কী?

-চারু !

লতিফুল রহমান বলল, মেয়েটা রাজি হবে না । তুমি জানো এর আগে এই মেয়েটাকে আমি একবার ব্যবহার করেছিলাম, আরও ভাল করে বললে মেয়েটাই আমাদের সাহায্য করেছিল নিজ থেকে । ওদের স্কুলের দপ্তরি দুইটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল । দপ্তরি ধরতেও পারলেও মেয়ে দুইটাকে আমরা কিছুতেই খুজে পাচ্ছিলাম না । তখন এই চারুই আমাদের সাহায্য করে । কিন্তু তারপর ঐ দপ্তরি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় নি । ওর মস্তিস্ক একেবারে উলট পালট হয়ে গিয়েছিল । এই যে জাফ্রি তোমার কি মনে হয় এ আর কোণ দিন সুস্থ হবে? কোন দিন হবে না ।

আকিব বলল, বুঝতে পারছি । আমরা সেটা করবো না । কেবল ভয় দেখাবো ।

-কাজ হবে?

-হতেও পারে । চলুন ট্রাই করা যাক !

008


আকিব আর লতিফুল রহমান যখন ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকলো তখন জাহিদ হাসান শান্ত ভাবে বসে আছে । একটু আগে তৈফিক জাফ্রি যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে আছে জাহিদ হাসান । তবে তার হাতে কোন হ্যান্ডকাফ পরানো নেই । ওরা ভেতরে ঢুকতেই জাহিদ হাসান বলল, আপনারা আমাকে কেন আটকে রেখেছেন ? আমি কি করেছি ? আমি আমার ল’য়ারের সাথে কথা বলব ।

আকিব একবার লতিফুল রহমানের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভেতরে কিছু বোঝপড়া করে নিল । তারপর জাহিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, আমরা জানি আপনি তৈফিক জাফ্রিকে দিয়ে বোমাটা বানিয়ে নিয়েছেন । তবে আপনার জন্য সুসংবাদ হচ্ছে আমরা সেটা কোন ভাবেই প্রমান করতে পারবো না যে আপনি জাফ্রির সাথে মিলিত ছিলেন । এমন কি জাফ্রি নিজেও আপনাকে চিনে না । অবশ্য ওর এখন যা অবস্থা ও কাউকেই চিনবে না আর !

জাহিদ হাসান এবার আরও একটু সোজা হয়ে বসলো ।। তারপর বলল, আমাকে আপনারা কেন ধরে এনেছেন ? আমাকে যেতে দিন !

-যেতে দিবো মিস্টার জাহিদ হাসান । আমরা কেবল জানতে চাই বোমার লোকেশন টা কোথায়?

-দেখুন আপনারা যা বলছেন তার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না ।

আকিব এবার একটু হাসলো । তারপর বলল, আপনাকে আমরা একতা সুযোগ দিতে চাই । তাই জানতে চাইছি । নয়তো আমাদের কাছে অন্য উপায় আছে ।

-আমাকে টর্চার করবেন? মারবেন ?

-হা হা হা ! কী যে বলেন না ! যাই হোক আমি বরং আপনাকে একটা ভিডিও দেখাই । সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন । আমাকে কিছুই বলতে হবে না !

সাথে করে আনা ল্যাপটপ টা স্ক্রিন জাহিদ হাসানের দিকে ঘুরিয়ে দিলো । একটু আগে চারু ও তৈফিক জাফ্রির ভিডিওটা চালু হল । সেটার দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাহিদ হাসান ।

ভিডিও শেষ হতে এবার আকিব আবার বলল, ভাববেন না যে এটা কোণ বানানো ভিডিও । তার প্রমান আপনি নিজেই । জাফ্রি আপনার কথা জানেই না । তারপরেও আপনি এখানে । কিভাবে জানেন? কারণ হচ্ছে এই মেয়েটা । এই মেয়েটার ভেতরে এক ভয়ংকর ক্ষমতা আছে । সে চাইলেই যে কারো মস্তিস্কের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে । জাফ্রির মাথার ভেতরে সে ঢুকেছিল । সেই তার মনের ভেতরে থাকা সকল তথ্য বের করে এনেছে । এই যেমন জাফ্রিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যে ব্যাগ নিয়ে সে রেস্টুরেন্টে যাবে একটা নির্দিষ্ট টেবিলের নিচে রেখে অন্য টেবিলে বসবে। সেই টেবিলের নিচে আগে থেকেই একটা কালো ব্যাগ থাকবে । তাই না ? দুজন দুটো টেবিলে স্বাভাবিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করে চলে আসবে । কেউ কাউকে চিনবে না, দেখবে না । কিন্তু তারপরেও দেখুন আপনি এখানে চলে এসেছেন । এখন কী হবে শুনুন । আমি ঐ মেয়েটাকে একটু পরেই এই ঘরে নিয়ে আসবো । সে আপনার মস্তিস্ক থেকেই বোমাটা আপনি কোথায় রেখেছেন সেটা বের করে নিয়ে আসবে । এমন কি জাফ্রির মাথা থেকে আমরা বোমা ডিফিউজের কোডটাও বের করেছি ।

আকিব তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলো । আকিব এরপর মুখ দিয়ে কোডটা বলতেই জাহিদ হাসানের চেহারায় একটা পরিবর্তন আসলো । আকিব যেন এটাই দেখতে চাইছিল । আকিব আবার বলল, এতো কিছু আপনাকে বলার আসলে কোন দরকার ছিল না । কেবল চারুলতা মানে মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এলেই হত কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে চারু একবার যার মাথার ভেতরে ঢোকে সে মস্তিস্ত একেবারে উলট পাল্ট হয়ে যায় । স্কুলে থাকতে সে এমন ভাবেই একবার পুলিশ সাহায্য করেছিল । সেই লোক প্রায় আট বছর কোমাতে ছিল । কোমা থেকে জেগেও তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি । এই জাফ্রির অবস্থা তো নিজ চোখে দেখলেন । আপনার পাশের রুমেই সে শুয়ে আছে । চোখ খোলা । তার মস্তিস্ক আর কোন দিন ঠিক হবে না । আপনাকে এই যুযোগ দিলাম । এখন এতা গ্রহন করা না করা আপনার ব্যাপার । 

এরপর লতিফুল রহমানের দিকে তাকাল আকিব। তারপর বলল, স্যার তাহলে চারুকে ডাক দিই । ইনি যখন বলবেন না তখন তো আর কোন পথ খোলা নেই । তারপর কাঁচের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো । কিছু সময় পরে দরজা খুলে গেল । জাহিদ হাসান চারুকে দেখতে পেল । চশমা পরা চারুকে দেখেই একতীব্র আতঙ্ক জমা হল তার চেহারায় । কিন্তু চারু এক পা ঘরে ঢোকালো তখনই জাহিদ হাসান চিৎকার করে বলল, খবরদার আমার কাছে আসবে না । ওকে নিয়ে যান নিয়ে যান ! আমি বলছি । সব বলছি ।

009

ভোর বেলা চারুর হলের গেটের কাছে গাড়িটা থামলো । চারু শান্ত ভাবে গাড়ি থেকে নেমে তাকালো চারিদিকে । তখনই চোখ গেল ফরিদ মামার চায়ের দোকানের দিকে । তখনও আলো ঠিক মত ফোটে নি কিন্তু মামা দোকান খুলে বসেছে । এই সময়ে মূলত কিছু ঝাড়ুদার আসে তার দোকানে চা খেতে । তার দোকান থেকে চা পাউরুটি খেয়ে মূলত তারা কাজে যায় । এতো সকালে এই একটা দোকান ছাড়া আর কোন দোকান খোলে না । সবাই জানে ব্যাপারটা । 

চারু সেদিকে হাটা দিলো । হলে ঢোকার আগে ফরিদ মামার দোকান থেকে এককাপ চা আগে খেয়ে নেওয়া যান । 

চারুকে আসতে দেখেই ফরিদ মামা বলল, আরে আফা আইজ এতো সকালে ! পুলিশের গাড়িতে কই গেছিলেন?

চারু যে পুলিশের গাড়ি থেকে নেমেছে সেটা ফরিদ মামা ঠিকই খেয়াল করেছে । চারু কেবল একটু হাসলো । এই প্রশ্নের জবাব দে দিতে চায় না । কেবল বলল, এক কাপ চা দেন মামা । কেবল লিকার দিয়ে । অন্য কিছু না ।

-আমার জন্য এক কাপ !

চারু দেখলো আকিবও নেমে এসেছে গাড়ি থেকে । চারুর সাথে আরো কয়েকটা কথা সে বলতে চায় । চায়ের পানি গরমই ছিল । কেবল টিব্যাগ দিয়ে দুজনের হাতে দিয়ে দেওয়া হল । চারু চায়ে চুমুক দিতেই আকিব বলল, তুমি এটা কিভাবে কর?

-কোনটা ?

-যা তুমি একটু আগে করলে ? মানে …

আকিব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তবে চারু তাকে লাইন শেষ করার আগেই বলল, আমি জানি না কিভাবে করি ! কেবল করি এটাই জানি । আপনি যেমন প্রথম বার চোখে মেলে তাকান তারপর বুঝতে পারেন যে আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমি বলতে পারেন ঠিক একই ভাবে এই সব করতে পারি । কেবল পারি । কিভাবে পারি আমি নিজেও জানি না । আমার আসল বাবা মা হয়তো জানতে পারেন ।

-তুমি তোমার আসল বাবা মায়ের কথা জানো না?

-নাহ । আমাকে গাজিপুরের একটা এতিম খানা থেকে আমার বর্তমান বাবা মা নিয়ে এসেছিলেন । তারপর তাদের কাছেই আমি মানুষ হয়েছি। তবে তারা যখন বুঝতে পারেন যে আমার ভেতরে কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে তারা চেয়েছিলেন আমাকে ফিরিয়ে দিতে । তবে কেন দেয় নি সেটা আমি জানি না । আমাকে বুঝিয়েছেন যে আমি যা পারি তা যেন না করি । এটা হলেই আর কোন সমস্যা নেই । আমিও বুঝতে পারি যে এই কাজ গুলো অন্য কেউ আর করতে পারে না । আমার এই কাজের ফলে অনেকের ক্ষতি হতে পারে । তারপর থেকে আমি সাবধান হয়ে যাই । আর পরে খুব একটা সমস্যা হয় নি । 

আকিব চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে । ওর কাছে এখনও কেমন যেন অবিশ্বাস মনে হচ্ছে সব কিছু । বিশেষ করে চারু একটু আগে আসলে যা করেছে তা কোন ভাবেই স্বাভাবিক কোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয় । এমনটা কখনই হতে পারে না । কিন্তু তারপরেও হয়েছে । এবং এই অস্বাভাবিক মেয়েটার কারণেই আজকে তারা খুব দ্রুত একটা বড় অঘটনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ।

চারু না থাকলে এতো দ্রুত কি এই বোমাটা উদ্ধার করা যেত? 

এতো দ্রুত কেন কোণ কালেই কি যেত?

চা শেষ করে আকিব যখন বিল দিতে গেল চারু বলল, বিল দিতে হবে না । আমার আথে মামার হিসাব আছে । 

আকিব কেন জানি আর উচ্চবাচ্চ করলো না । চারুর চা শেষ হয়েছে । সে গেটের দিকে বাড়ানোর আগে আকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাল থাকুন মিস্টার আকিব । আশা করি আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না ।

আকিব কিছু না বলে হাসলো । তবে চারুর তখনই মনে হয়েছিল যে এই ছেলের সাথে তার আবার দেখা হবে । হতে বাধ্য । 

## 

চারু আরও কিছুটা সময় বিছানাতে শুয়ে রইলো । আজকে সারাদিন তার ব্যস্তায় কেটেছে । তারপর ঐ যুবকের সাথে দেখা । এখন আবার এই পুলিশ এসে হাজির হয়েছে ওর হলের গেটে । তবে আজকে সে মনে মনে ঠিক করেই রেখেছে যে স্বয়ং ভিসি এসে বললেও সে কোথাও যাবে না । নো মানে না । 

প্রতিদিন এসে বলবে এটা করে দাও ওটা করে দাও এর মাথার ভেতরে ঢোকো ওর মাথা উল্টে পাল্টে দাও ! এসব মোটেই হবে না ! 

010

গেট খুলে বাইরে আসতেই আকিবকে দেখতে পেল চারু । রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে । ঢাকার জন্য এই সময়টা তেমন কোন রাতই না । মেয়েদের হলের গেট নয়টার ভেতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এগারোটা পর্যন্ত গেট খোলা থাকে । বিশেষ করে এই সময়ে তহলের মেয়েরা নিজেদের প্রেমিকের সাথে বসে বসে গল্প করে হলের আসে পাশের ফুটপাতে বসে । কেউ বা গেটের আশে পাশের চায়ের দোকানে চা খায় আর আড্ডা দেয় এক সাথে । গেটের মামা গেট বন্ধ করার আগে একটা ডাক দিলে মেয়েরা সব এক সাথে ভেতরে ঢোকে । তবে মামা খুব একটা তাড়াহুড়া করেন না । কাছে পিঠেই বসে থাকে বলে কর্তৃপক্ষও খুব একটা নিষেধ করেন না । চারু অবশ্য খুব একটা বাইরে আসে না । ক্লাস টিউশনী পরের সোজা হলের রুমে চলে যায় । তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুম । এই হচ্ছে চারুর জীবন । মাঝে মাঝে অবশ্য মাথা ধরলো, ফরিদ মামার দোকানে এসে চা খেয়ে যায়।
আজকে গেট দিয়ে বের হতেই দেখতে পেল আকিবকে । তারপর চারিদিকে চোখ গেল ওর । সবাই নিজের মত ব্যস্ত । ওর দিকে তাকানোর কেউ নেই । কারো সময় নেই । চারু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আকিবের দিকে । আকিব ওকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এল তারপর খানিকটা উত্তেজিত কন্ঠে বলল, আমি তো আরেকবার ফোন করতে যাচ্ছিলাম । তুমি না আসলে আমি নিজেই ভেতরে ঢুকে পড়তাম ।
চারু আকিবের দিকে তাকালো । ছেলেটার চোখ দুটো বড় অস্থির আর উত্তেজিত হয়ে আছে । এই অস্থিরতার কারণ চারু ঠিক বুঝতে পারলো না । গতদিনও আকিব এমন উত্তেজিত ছিল তবে সেটা সে নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলো । কেবল চারু সেটা বুঝতে পারছিলো নিজের অস্বাভাবিক ক্ষমতার কারণে । মানুষের মনের ভেতর থেকে আলাদা একটা স্পন্দন একটা আওয়াজ সব সময় বের হয় । চারু সেটা শুনতে পায় খুব ভাল করেই । আজকে সেটা একেবারেই অন্য রকম মনে হচ্ছে চারুর কেন জানি মনে হল আকিব ওর জন্য খানিকটা অস্থির হয়ে আছে । এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই তবুও চারুর এটাই মনে হল ।

চারু শান্ত কন্ঠে বলল, রাতে খেয়ে উঠেছিলাম । এই জন্য নিচে নেমে এলাম । নয়তো আসতাম না । 

আকিব যেন কথাটা শুনলো না । সে বলল, তুমি কী বিপদে পড়তে যাচ্ছো, সেটার খেয়াল আছে?

চারু বলল, আপনার কথার মানে বুঝলাম না । 

-বললাম তোমার সামনে বিপদ আসছে । তুমি এমন একজন মানুষের সাথে আজকে দেখা করেছো যা মোটেও উচিৎ হয় নি তোমার । 

-আপনার কথা আমি এখনও বুঝছি না । আপনি কেন আমাকে এখানে আসতে বলেছেন পরিস্কার করে বলুন । নয়তো আমি চললাম ।

আকিব আর কথা না বলে নিজের মোবাইল টা বের করলো । তারপর কিছু সময় কয়েকবার সোয়াপ করে মোবাইলের স্ক্রিনটা বাড়িয়ে দিলো । একটা মানুষের ছবি দেখতে পেল সেখানে । আজকে বিকেলে দেখা হওয়ার মানুষটা । 

কিছুই হয় নি এমন একটা ভাব করে চারু তাকিয়ে রইলো আকিবের দিকে । আকিব বলল, তুমি চেনো এই মানুষটাকে ?

-জ্বী না । তবে আজকে এসেছিল এখানে । আমার সাথে দেখা করতে ।

-কেন এসেছিল?

-জানি না । বলল তার নাকি কী একটু কথা আছে আমার সাথে ।

-তারপর ?

-তারপর আর কী ! আমি বললাম যে এখন কথা বলতে পারবো না । কাল দেখা করতে বললাম । 

আকিব কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । আকিবের যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না চারুর কথাটা । আকিব আবার বলল, তুমি তার মুখের উপরে বললে যে তুমি এখন কথা বলতে পারবে না । এবং সে সেটা শুনলো ?

-আশ্চর্য শুনবে না কেন ! আর না শুনলেই বা কি ! সে কে এমন লোক ! 

-তুমি জানো সে কে?

-না জানি না । জানতে চাইও না । আর আপনার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে ভাল লাগছে না । আজকে সারাদিন আমার অনেক পরিশ্রম গেছে । এখন খেয়ে আমি ঘুমাবো । 

আকিব বলল, চারু তুমি আজকে যার সাথে কথা বলেছো, এই মানুষটার কথায় পুর ঢাকা শহর তো বটেই পুরো দেশ চলে ! পুরো ঢাকা শহরের আন্ডার ওয়ার্ল্ড সে একা সামলায় ।

চারু একটু চমকালো । এই ব্যাপারটা সে মোটেই আশা করে নি । তবে এমন একটা আশা করেছিল যে ছেলেটা বড় কোন হোমড়া চোমড়া হবে । তবে একেবারে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন হবে সেটা সে মোটেই ভাবে নি । এতো কম বয়সে কেউ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন হতে পারে সেটা চারুর জানা ছিল না । 

চারু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বুঝলাম । সে ডন । আর কিছু বলবেন?

আকিব সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো চারু নামের মেয়েটার দিকে । এই মেয়েটা তাকে বারবার কেবল বিস্মিতই করছে । 

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 18

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →