নানাবাড়ি কাছে হওয়ার কারণে ছোটবেলা স্কুলে ছুটি পেলেই আমরা যশোর থেকে নানাবাড়ি চলে আসতাম কয়েকদিনের জন্য । যাওয়া আসাটা অনেক সহজ ছিল । যশোর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতাম তারপর চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে নেমে পড়তাম । ঘন্টা দেড় দুয়ের ব্যাপার ছিল । যাত্রাটাও ছিল সহজ । তাই প্রায়ই যাওয়া আসা হত । তবে আমার এই ট্রেন যাত্রার সব থেকে পছন্দের ব্যাপার ছিল স্টেশনে থাকা ছোট বইয়ের একটা স্টল । তখন বইয়ের দোকান বলতে এই স্টেশনে দেখা বইয়ের দোকানটাই ছিল । যেখানে নানান গল্পের বই পাওয়া যেত । ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি এই ছোট বইয়ের স্টলের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করতাম । আমার মনে আছে এখান থেকেই আমার প্রথম সেবা প্রকাশনির বই কিনেছিলাম । শহরের আর কোথাও এই সেবা প্রকাশনির গল্পের বই পাওয়া যেত না । অন্তত আমি যেগুলো চিনতাম সেগুলোতে পাওয়া যেত না ।
এরপর নিজেদের বাড়ি নানাবাড়ির একদম কাছে হওয়ার পরে আলাদা ভাবে আর ট্রেশনে যাওয়ার প্রয়োজন হত না । আমি একটু বড় হয়ে যখন একা একাই চলতে ফিরতে শুরু করলাম তখন প্রায়ই যাওয়া হত আমার ট্রেশনে হত । সাইকেল কেনার পর থেকে এই যাওয়া আসাটা বেড়ে গেল অনেক গুণে । বড়বাজারের বড় বড় লাইব্রেরীতে যে গল্পের বই গুলো তখন পাওয়া যেত তখন সেগুলো পড়ার আগ্রহ আমার খুব বেশি জন্মাতো না । আমার আগ্রহ ছিল স্টেশনে পাওয়া সেই ভুতের গল্প, সেবা প্রকাশনীর বই গুলো । এখানে সেবা থেকে বের হওয়া রহস্য পত্রিকা পাওয়া যেত । পুরো শহরে কেবল এখানেই এই পত্রিকা পাওয়া যেত । এছাড়া নানান ছোট ছোট ভুতের গল্পের বই পাওয়া যেত । দাম ছিল কম । এক দুই দিনের টিফিনের খরচ দিতেই কেনা যেত ।
এরপর অবশ্য স্টেশনের এই বুক স্টলে যাওয়া কমে গেল । জেলা পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য হয়ে গেলাম । সেখানে মাসিক মাত্র দশ টাকা চাঁদা দিয়ে বই পড়া শুরু করলাম । তবে তারপরেও মাঝে মাঝে এই স্টেশনের বুক স্টলে আমি যেতাম । প্রায়ই মনে হত এই একম একটা ছোট বইয়ের দোকান দিতে পারলে কতই না মজা হত !
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরি থেকেই বই নিয়ে পড়েছি । ক্লাস সেভেন থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত মাসে অন্তত ২০ থেকে ২৫টা বই আমার পড়া হত । ঢাকাতে আসার পরে প্রথম কিছুদিন একদমই বইটই পড়া হয় নি । ঢাকার নতুন আবহাওয়া বুঝতেই কয়েকমাস পার হয়ে গেল । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে আমি প্রায় বাসায় ফেরার পথে নীলক্ষেতের রাস্তার ঘুরে বেড়াতাম । প্রতিদিনই যে বইকিনতাম তেমন না । তবে বইয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে অদ্ভুত ভাল লাগতো । এখানে রাস্তার তো পুরানো বই পাওয়া যেত । এছাড়া নীলক্ষেতের ভেতরেও এমন অনেক গুলো বইয়ের দোকান ছিল যেখানে অনেক পুরানো বই পাওয়া যেত । আমার অবশ্য নতুন পুরানো বইয়ের কোন ভেদাভেদ ছিল না । আমার কাছে মুখ্য ছিল দাম টা । নতুন বইয়ের দাম বেশি । সেই একই টাকাতে প্রায় দুই তিনটা পুরানো বই কেনা যায় । তাই পুরানো বই বেশি কিনতাম । বুড়ো মত এক মামা বসে থাকতো দোকানে । বইয়ের নাম বললে সে খুজে দিতো এতো এতো বইয়ের ভেতরে । মামার নামটা ভুলে গেছি তবে যারা নীলক্ষেত থেকে বই কিনতো তারা বলতে গেলে প্রায় সবাই তাকে চিনতো । বই গ্রুপে একটা ভিডিও প্রতিবেদনে দেখেছিলাম যে করোনা কারনে ব্যবসায়ে লস খেয়ে মামা তার ৩০ বছরের পুরানো বইয়ের দোকান বন্ধ করে গ্রামে চলে গেছে ।
এরপর যখন টাকা পয়সার আর অভাব ঘুচলো তখন নীল ক্ষেতের বইয়ের যাওয়াও কমিয়ে দিলাম । ক্যাম্পাস শেষ হওয়ার পরে তখন কালে ভাদ্রে নীলক্ষেতে যাওয়া হত । হাতে যেহেতু টাকা আছে তাই বইয়ের পেছনে খরচ করাই যায় । তখন ঢাকার সব পস বইয়ের দোকানে যাওয়া আসা শুরু হল । আমার বাড়ির খুব কাছেই বেঙ্গল বই অবস্থিত । এখনকারটা আগে মিনাবাজারের পেছনে যেটা ছিল । যদিও ওখানে যেতে আমার কেন জানি ভাল লাগতো না । বেঙ্গলবইটাকে আমার বইয়ের দোকান থেকে ক্যাফেই বেশি মনে হত । আমার পছন্দ ছিল বাংলামোটরের বাতিঘর । এখানে গেলে একটা একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব ভরে যেত । বই কেনা বাদ দিলেও ওখানে বসে বই পড়া যেত যত সময় ইচ্ছে । কেউ কিছু বলছে না । এমন কি আমি যদি কোন বই না কিনে ফিরেও চলে আসতাম তখনও কেউ কিছু বলতো না । তবে ওখানে গেলে বই না কিনে আসা হত না একেবারেই ।
আরেকটা বইয়ের দোকান ছিল জাহাঙ্গির গেটের কাছে । বিমানবাহিনীর হেড অফিসের সামনে । বুকওয়ার্ম । এতো চমৎকার একটা স্থানে বইয়ের দোকানটা ছিল । এখানে যদিও প্রায় সবই বিদেশী বই তারপরেও যারা পড়তে ভালোবাসে তাদের কাছে এই বইয়ের দোকানটা আলাদা একটা স্থান দখল করে আছে । আমি প্রতিদিন যখন মহাখালিতে যেতাম প্রতিদিন এই দোকানটার সামনে দিয়েই যেতাম । ভেতরে ঢুকলে তো ভাল লাগতোই কিন্তু বাইরে দিয়ে তাকিয়ে থাকতেও এতো ভাল লাগতো যে বলার অপেক্ষা রাখে না । বইয়ের দোকান সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে । প্রায় ২৮ বছর ধরে বইয়ের দোকানটা ওখানে ছিল । বিমানবাহিনী থেকে বলা হয়েছে স্থানটা খালি করে দিতে, তারা সম্ভব নতুন কিছু তৈরি করবে ওখানে । বইয়ের দোকান টা এখনও বন্ধই আছে । তবে তাদের পেজ থেকে জানতে পারলাম যে বুকওয়ার্মটা চালু হবে আবার । গুলশানের একটা পার্কে মেয়র সাহেব নাকি তাদের জন্য স্থান বরাদ্দ দিয়েছে । পার্কের ভেতরে বইয়ের দোকান ব্যাপারটা মন্দ হবে না আশা করি ।
এখন অবশ্য বইয়ের দোকানে যাওয়া হয় কম । আগের থেকে বইয়ের দোকানে গিয়ে বই কেনার পরিমান করে গেছে । বিশেষ করে করোনার সময় থেকে যত বই কেনা হয়েছে সব অনলাইনে । প্রথম হিসাবে রকমারিই আছে । এছাড়া ফেসবুকে অনেক কয়টা পেজ আছে যারা বেশ ভাল সার্ভিস দেয় ! আর এখন বই এতো এতো মজা হয়েছে যে সেগুলো সব পড়ে শেষ করে কয়েক বছর গেলে যাবে ।
আমার সেই স্টেশনের বইয়ের দোকান থেকেই একটা বইয়ের দোকান দেওয়ার শখ ছিল । হতে চেয়েছিলাম বইয়ের দোকানদার । দোকানের চারিদিকে কেবল বই আর বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে । নতুন পুরানো সব ধরণের বই । বইয়ের দোকার ভেতরে এক পাশে থাকবে কয়েকটি টেবিল আর চেয়ার । ছোট একটা ক্যাফে থাকবে তবে সেখানে কেবল কফি ছাড়া আর কিছু । মানুষ বই কিনতে আসবে । মন চাইলে চেয়ারে বসে এককাপ কফি খাবে । কফি খেতে খেতে বই পড়বে যাদের বই কেনার টাকা থাকবে না । বইয়ের দোকানটা কোন ব্যস্ত শহরের রাস্তার পাশে হবে না কিংবা কোন বহুতল ভবনেও না । একতলা একটা ভবন থাকবে। ব্যস্ত রাস্তা পার হয়ে কোন ছোট রাস্তায় পাশে হবে বইয়ের দোকানটা । বইয়ের দোকানে উপরে ছাদ নয়, থাকবে টিনের ছাওনি । যাতে যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ শোনা যায় ।
কোন এক বৃষ্টির দিনে বাইরে যখন প্রবল বৃষ্টি হবে তখন কোন বিষণ্ণ তরুণী বই সামনে নিয়ে হাতে কফি কাপ ধরে বই পড়বে । আর মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকাবে । আবার কোন যুগল বই কিনতে গিয়ে আটকা পড়বে বৃষ্টিতে । কফির কাপ হাতে নিয়ে বসবে ক্যাফে । আর হিসাব করে দেখবে কী কী বই তারা কিনলো ! আমিও কাউন্টারে বসে কফি হাতে বসে পড়বো ।
আমি এমনই এক বইয়ের দোকানদার হতে চেয়েছিলাম ।
একটা সময় অনেক বই পড়েছিলা। এখন ডিফেন্সে থাকায় তেমন একটা বই পড়া হয়না। লেখার সাথে অনেক কিছুই মিলে গেল।