আমি হতে চেয়েছিলাম বইয়ের দোকানদার

oputanvir
4.9
(11)

নানাবাড়ি কাছে হওয়ার কারণে ছোটবেলা স্কুলে ছুটি পেলেই আমরা যশোর থেকে নানাবাড়ি চলে আসতাম কয়েকদিনের জন্য । যাওয়া আসাটা অনেক সহজ ছিল । যশোর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতাম তারপর চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে নেমে পড়তাম । ঘন্টা দেড় দুয়ের ব্যাপার ছিল । যাত্রাটাও ছিল সহজ । তাই প্রায়ই যাওয়া আসা হত । তবে আমার এই ট্রেন যাত্রার সব থেকে পছন্দের ব্যাপার ছিল স্টেশনে থাকা ছোট বইয়ের একটা স্টল । তখন বইয়ের দোকান বলতে এই স্টেশনে দেখা বইয়ের দোকানটাই ছিল । যেখানে নানান গল্পের বই পাওয়া যেত । ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি এই ছোট বইয়ের স্টলের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করতাম । আমার মনে আছে এখান থেকেই আমার প্রথম সেবা প্রকাশনির বই কিনেছিলাম । শহরের আর কোথাও এই সেবা প্রকাশনির গল্পের বই পাওয়া যেত না । অন্তত আমি যেগুলো চিনতাম সেগুলোতে পাওয়া যেত না ।

এরপর নিজেদের বাড়ি নানাবাড়ির একদম কাছে হওয়ার পরে আলাদা ভাবে আর ট্রেশনে যাওয়ার প্রয়োজন হত না । আমি একটু বড় হয়ে যখন একা একাই চলতে ফিরতে শুরু করলাম তখন প্রায়ই যাওয়া হত আমার ট্রেশনে হত । সাইকেল কেনার পর থেকে এই যাওয়া আসাটা বেড়ে গেল অনেক গুণে । বড়বাজারের বড় বড় লাইব্রেরীতে যে গল্পের বই গুলো তখন পাওয়া যেত তখন সেগুলো পড়ার আগ্রহ আমার খুব বেশি জন্মাতো না । আমার আগ্রহ ছিল স্টেশনে পাওয়া সেই ভুতের গল্প, সেবা প্রকাশনীর বই গুলো । এখানে সেবা থেকে বের হওয়া রহস্য পত্রিকা পাওয়া যেত । পুরো শহরে কেবল এখানেই এই পত্রিকা পাওয়া যেত । এছাড়া নানান ছোট ছোট ভুতের গল্পের বই পাওয়া যেত । দাম ছিল কম । এক দুই দিনের টিফিনের খরচ দিতেই কেনা যেত ।

এরপর অবশ্য স্টেশনের এই বুক স্টলে যাওয়া কমে গেল । জেলা পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য হয়ে গেলাম । সেখানে মাসিক মাত্র দশ টাকা চাঁদা দিয়ে বই পড়া শুরু করলাম । তবে তারপরেও মাঝে মাঝে এই স্টেশনের বুক স্টলে আমি যেতাম । প্রায়ই মনে হত এই একম একটা ছোট বইয়ের দোকান দিতে পারলে কতই না মজা হত !

ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরি থেকেই বই নিয়ে পড়েছি । ক্লাস সেভেন থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত মাসে অন্তত ২০ থেকে ২৫টা বই আমার পড়া হত । ঢাকাতে আসার পরে প্রথম কিছুদিন একদমই বইটই পড়া হয় নি । ঢাকার নতুন আবহাওয়া বুঝতেই কয়েকমাস পার হয়ে গেল । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে আমি প্রায় বাসায় ফেরার পথে নীলক্ষেতের রাস্তার ঘুরে বেড়াতাম । প্রতিদিনই যে বইকিনতাম তেমন না । তবে বইয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে অদ্ভুত ভাল লাগতো । এখানে রাস্তার তো পুরানো বই পাওয়া যেত । এছাড়া নীলক্ষেতের ভেতরেও এমন অনেক গুলো বইয়ের দোকান ছিল যেখানে অনেক পুরানো বই পাওয়া যেত । আমার অবশ্য নতুন পুরানো বইয়ের কোন ভেদাভেদ ছিল না । আমার কাছে মুখ্য ছিল দাম টা । নতুন বইয়ের দাম বেশি । সেই একই টাকাতে প্রায় দুই তিনটা পুরানো বই কেনা যায় । তাই পুরানো বই বেশি কিনতাম । বুড়ো মত এক মামা বসে থাকতো দোকানে । বইয়ের নাম বললে সে খুজে দিতো এতো এতো বইয়ের ভেতরে । মামার নামটা ভুলে গেছি তবে যারা নীলক্ষেত থেকে বই কিনতো তারা বলতে গেলে প্রায় সবাই তাকে চিনতো । বই গ্রুপে একটা ভিডিও প্রতিবেদনে দেখেছিলাম যে করোনা কারনে ব্যবসায়ে লস খেয়ে মামা তার ৩০ বছরের পুরানো বইয়ের দোকান বন্ধ করে গ্রামে চলে গেছে ।

এরপর যখন টাকা পয়সার আর অভাব ঘুচলো তখন নীল ক্ষেতের বইয়ের যাওয়াও কমিয়ে দিলাম । ক্যাম্পাস শেষ হওয়ার পরে তখন কালে ভাদ্রে নীলক্ষেতে যাওয়া হত । হাতে যেহেতু টাকা আছে তাই বইয়ের পেছনে খরচ করাই যায় । তখন ঢাকার সব পস বইয়ের দোকানে যাওয়া আসা শুরু হল । আমার বাড়ির খুব কাছেই বেঙ্গল বই অবস্থিত । এখনকারটা আগে মিনাবাজারের পেছনে যেটা ছিল । যদিও ওখানে যেতে আমার কেন জানি ভাল লাগতো না । বেঙ্গলবইটাকে আমার বইয়ের দোকান থেকে ক্যাফেই বেশি মনে হত । আমার পছন্দ ছিল বাংলামোটরের বাতিঘর । এখানে গেলে একটা একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব ভরে যেত । বই কেনা বাদ দিলেও ওখানে বসে বই পড়া যেত যত সময় ইচ্ছে । কেউ কিছু বলছে না । এমন কি আমি যদি কোন বই না কিনে ফিরেও চলে আসতাম তখনও কেউ কিছু বলতো না । তবে ওখানে গেলে বই না কিনে আসা হত না একেবারেই ।

আরেকটা বইয়ের দোকান ছিল জাহাঙ্গির গেটের কাছে । বিমানবাহিনীর হেড অফিসের সামনে । বুকওয়ার্ম । এতো চমৎকার একটা স্থানে বইয়ের দোকানটা ছিল । এখানে যদিও প্রায় সবই বিদেশী বই তারপরেও যারা পড়তে ভালোবাসে তাদের কাছে এই বইয়ের দোকানটা আলাদা একটা স্থান দখল করে আছে । আমি প্রতিদিন যখন মহাখালিতে যেতাম প্রতিদিন এই দোকানটার সামনে দিয়েই যেতাম । ভেতরে ঢুকলে তো ভাল লাগতোই কিন্তু বাইরে দিয়ে তাকিয়ে থাকতেও এতো ভাল লাগতো যে বলার অপেক্ষা রাখে না । বইয়ের দোকান সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে । প্রায় ২৮ বছর ধরে বইয়ের দোকানটা ওখানে ছিল । বিমানবাহিনী থেকে বলা হয়েছে স্থানটা খালি করে দিতে, তারা সম্ভব নতুন কিছু তৈরি করবে ওখানে । বইয়ের দোকান টা এখনও বন্ধই আছে । তবে তাদের পেজ থেকে জানতে পারলাম যে বুকওয়ার্মটা চালু হবে আবার । গুলশানের একটা পার্কে মেয়র সাহেব নাকি তাদের জন্য স্থান বরাদ্দ দিয়েছে । পার্কের ভেতরে বইয়ের দোকান ব্যাপারটা মন্দ হবে না আশা করি ।

এখন অবশ্য বইয়ের দোকানে যাওয়া হয় কম । আগের থেকে বইয়ের দোকানে গিয়ে বই কেনার পরিমান করে গেছে । বিশেষ করে করোনার সময় থেকে যত বই কেনা হয়েছে সব অনলাইনে । প্রথম হিসাবে রকমারিই আছে । এছাড়া ফেসবুকে অনেক কয়টা পেজ আছে যারা বেশ ভাল সার্ভিস দেয় ! আর এখন বই এতো এতো মজা হয়েছে যে সেগুলো সব পড়ে শেষ করে কয়েক বছর গেলে যাবে ।

আমার সেই স্টেশনের বইয়ের দোকান থেকেই একটা বইয়ের দোকান দেওয়ার শখ ছিল । হতে চেয়েছিলাম বইয়ের দোকানদার । দোকানের চারিদিকে কেবল বই আর বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে । নতুন পুরানো সব ধরণের বই । বইয়ের দোকার ভেতরে এক পাশে থাকবে কয়েকটি টেবিল আর চেয়ার । ছোট একটা ক্যাফে থাকবে তবে সেখানে কেবল কফি ছাড়া আর কিছু । মানুষ বই কিনতে আসবে । মন চাইলে চেয়ারে বসে এককাপ কফি খাবে । কফি খেতে খেতে বই পড়বে যাদের বই কেনার টাকা থাকবে না । বইয়ের দোকানটা কোন ব্যস্ত শহরের রাস্তার পাশে হবে না কিংবা কোন বহুতল ভবনেও না । একতলা একটা ভবন থাকবে। ব্যস্ত রাস্তা পার হয়ে কোন ছোট রাস্তায় পাশে হবে বইয়ের দোকানটা । বইয়ের দোকানে উপরে ছাদ নয়, থাকবে টিনের ছাওনি । যাতে যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ শোনা যায় ।
কোন এক বৃষ্টির দিনে বাইরে যখন প্রবল বৃষ্টি হবে তখন কোন বিষণ্ণ তরুণী বই সামনে নিয়ে হাতে কফি কাপ ধরে বই পড়বে । আর মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকাবে । আবার কোন যুগল বই কিনতে গিয়ে আটকা পড়বে বৃষ্টিতে । কফির কাপ হাতে নিয়ে বসবে ক্যাফে । আর হিসাব করে দেখবে কী কী বই তারা কিনলো ! আমিও কাউন্টারে বসে কফি হাতে বসে পড়বো ।
আমি এমনই এক বইয়ের দোকানদার হতে চেয়েছিলাম ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 11

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “আমি হতে চেয়েছিলাম বইয়ের দোকানদার”

  1. একটা সময় অনেক বই পড়েছিলা। এখন ডিফেন্সে থাকায় তেমন একটা বই পড়া হয়না। লেখার সাথে অনেক কিছুই মিলে গেল।

Comments are closed.