আদিবার গল্প ২.০

oputanvir
4.8
(48)

রাইসুল আলম বিকেল হাটাহাটি করার ইচ্ছে অনেক দিনের । আসরের নামাজের পরে পুরো সময়টা তিনি বাইরেই হাটাচলা করেন । একেবারে সন্ধ্যার নামাজ পরে বাসায় আসেন । আজও তাই করলেন । সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে টিভির সামনে বসতেই দেখতে পেলেন তার মেয়ে অফিস থেকে ফিরেছে। রাইসুল আলম তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অফিস কেমন গেল মা?
আদিবা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল, ভাল বাবা !

রাইসুল আলমের তখনই মনে হল মেয়ে যেন ভাল নেই । কিছু একটা ব্যাপার মেয়েটাকে সব সময় তাড়া করে বেড়াছ্ছে । অহনার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরে আদিবা একেবারে বদলে গেল । অহনার শোক রাইসুল আসল কাটিয়ে উঠেছেন এতো দিনে কিন্তু আদিবা কেন জানি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি ।

রাতের খাওয়ার পরে রাইসুল আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর জন্মদিন কেমন গেল ?
-আর জন্মদিন । এই বয়সে আবার জন্মদিন ?
-কেন বয়সের আবার কি হল? কী এমন বয়স হয়েছে শুনি ?
-না কিছু না বাবা । কিছু হয় নি !

রাইসুল আলম আর কথা বাড়ালেন না । এই নিয়ে আদিবার সাথে আগেও কথা হয়েছে । প্রতিবার তাকে ব্যর্থ হতে হয়েছে । এখন কেন জানি তিনি আর শক্তি পান না একই কথা বারবার বলার জন্য ।

দুই
এখানে বসে আছিস কেন মা ?
আদিবা ফিরে তাকালো । রাতের এই সময়ে বাবাকে এই ছাদে আসতে দেখে একটু অবাকই হল । বলল, তুমি আবার উঠে এলে কেন বাবা !
-আজকে ঘুম আসছে না । তুই কি প্রায়ই ছাদে আসিস ?
আদিবা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। প্রায় বলতে প্রতিদিনই আদিবা এই ছাদে আসে । রাতে কেন জানি এখন আর খুব একটা ঘুম আসে না ওর । জেগে থাকে । বেশি বিরক্ত হয়ে গেলে ছাদে আসে । খোলা বাতাসে বসলে ভাল লাগে ।
আদিবার বাবা বললেন, তুই আমাকে কিছু বলবি?
-কী বাবা?
-না মানে আমার কেন জানি মনে হল কিছু বলতে চাস?
-না তো ! কিছু …..

আদিবা থেমে গেল । কিছু বলতে কি চায় সে? কিছু কি বলার আছে ?
বলে কোন লাভ হবে কি !
বাবা মেয়ে কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো । তারপর আদিবা হঠাৎ করে বলল, তুমি আমার বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তায় আছো, তাই বাবা?
-এটাই কি স্বাভাবিক নয়? মেয়ের বাবার তো চিন্তায় থাকেই ।
-কিন্তু বিয়ের পরে যদি আমার অবস্থাও আপুর মত হয়? তখন?
-সবাই কি এক রকম হয়? আমি তোর মায়ের সাথে এমন কিছু করেছি?
-তবুও ভয় লাগে বাবা ! আপুর ঐ অবস্থা আমি এখনও চোখের সামনে থেকে মুছে ফেলতে পারি না ।

রাইসুল আলম চুপ করে রইলেন কিছু সময় । অহনার নিজের পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো । তিনি মানা করেন নি । কিন্তু বিয়ের পরে মাত্র এক বছরের মাথায় ওদের বিয়েতে ভাঙ্গন ধরে । অহনার স্বামী নাকি ওকে মারধোর করতো । যখন এক বছর পরে অহনা বাবার বাসায় চলে আসে তখন আর আগের অহনা ছিল না । শরীরের নানান স্থানে ছিল মারের দাগ । অহনা এতোদিন কিছু বলে নি । শেষে সহ্য না করতে পেরে চলে এসেছে । কিন্তু বাসায় এসেও সে শান্তিতে থাকতে পারে নি । সম্ভত এই ট্রামে সে সহ্য করতে পারে নি । অপ্রকৃস্থর মত আচরণ করতো । বাসায় আসার এক মাসের মাথায় অহনা বাসার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে ।

-বাবা !
-বল মা !
-আমি যখন ভার্সিতে প্রথম বর্ষে পড়তাম তখন সবুজ একটা ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো । আমার ক্লাসেই পড়তো । আমাকে খুব পছন্দ করতো । আমিও করতাম ।
-তারপর?
-আপুর যেদিন বিয়ে হয় তার দুইদিন আগে এই বাসায় এসেছিলো । বাসার সামনে বসে আমরা গল্প করছিলাম । গল্প করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেল আমরা দুজনের কেউ টেরই পেলাম না । সেদিনই আমি টের পেল যে ওর প্রতি আমার আলাদা একটা অনুভূতি আছে । আমরা কখনও মুখ ফুটে বলি নি যে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি । এভাবে বেশ কিছু দিন চলে যাওয়ার পরে আপুর দুর্ঘটনা ঘটলো । আমার তখন মনে হল যে সবুজও বুঝি ওমনটাই করবে । তখন সবুজের সাথে আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিই । প্রথম প্রথম সবুজ বুঝতো না । কিন্তু আপুর ঘটনা কারো কাছ থেকে শুনে সে বুজে গেল যে আমি ওকে কেন ইগ্নোর করছি । তারপর থেকে ও আমার কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রাখতো !

রাইসুল আলম চুপ করে মেয়ের কথা শুনে গেলেন । কী বলবেন সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না । আদিবা আবার বলা শুরু করলো ।
কিন্তু প্রতিবছর আমার জন্মদিনে সবুজ আমার মোবাইলে একটা করে মেসেজ পাঠাতো ! প্রথমে বলতো হ্যাপি বার্থডে । তারপর সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, করবে । এই দুটো লাইন । আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে ছোট কম বয়সের আবেগ !

লাইন গুলো বলত বলতে আদিবার গলা ধরে এল । চুপ করে রইলো কিছু সময় । রাইসিল আলম বলল, এখনও সে মেসেজটা পাঠায়?
-হুম ! আজকে প্রায় আট বছর হয়ে গেছে । গ্রাজুয়েশনের পরপরই ও চাকরি পেয়ে যায় । সেখানেই চাকরি করছে আজকে প্রায় পাঁচ বছর । প্রতি বছর কেবল একটা মেসেজ । আর কিছু না । প্রতিবার মেসেজ পাঠানোর পরে মনে হয় ওর কাছে ছুটে যাই কিন্তু তখনই আপুর কথা মনে পড়ে । যদি এমন কিছু হয় আমার সাথেও । তখন ?
-সবাই এক রকম হয় কি? ছেলেটাকে একবার সুযোগ দিয়েই দেখ ।
-আমার খুব ইচ্ছে করে বাবা কিন্তু ভয় হয় খুব । খুব ভয় হয় ! আমি আপুর মত করে আমার জীবন শেষ করে দিতে চাই না ।

রাইসুল আলম আর কথা বললেন না । এর আগে তিনি অনেক আদিবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ওর পড়াশুনা শেষ হওয়ার পরে অনেকবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আদিবা সেদিকে যায়ই নি । কিন্তু আজকে আদিবার মুখ থেকে সবুজের কথা শুনে মনে মনে ঠিক করে নিলেন কী করতে হবে ।

তিন
প্রতিদিনই অফিস থেকে আদিবার সন্ধ্যা হয় । ঢাকার রাস্তায় যা জ্যাম তাতে একটু সময় লাগেই সব সময় । আজকে বাসায় কলিংবের বাজাতে যাবে তখনই মনে হল বাসায় আজকে ওর বাবা মা ছাড়াও আরও মানুষজন রয়েছে । ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে । তখনই মনে হল একটা আওয়াজ ওর কানে গেল। পুরো শরীর যেন তখনই কেঁপে উঠলো । কলিং বাজানোর মত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলল আদিবা ।
তবে কলিংবেল তাকে চাঁপতে হল না । দরজাটা খুলে গেল একটু পরেই । আদিবা দেখতে পেল ওর বাসার দরজার সামনে সবুজ দাড়িয়ে রয়েছে । ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে হাসি মুখে । খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল, এতো দেরী হল আসতে? খুব জ্যাম ছিল কি?
আদিবা কোন কথা বলল না । বলতে পারলো না । ওর পুরো শরীরে একটা অবশ ভাব কাজ করছে । এতো গুলো বছর পরে প্রিয় মানুষটাকে এভাবে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আবেগ মোটেই সামলাতে পারছে না ও । চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে কেবল !

সবুজের দিকে কেবল তাকিয়ে রইলো । সবুজের চোখের দৃষ্টিতে একটু পরিবর্তন আসে নি । সে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে সবুজ যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো একই ভাবে তাকিয়ে রয়েচে । সেই একই মুগ্ধ চোখে ।

রাতের বেলাতেই আদিবার বিয়ে পড়ানো হল । আদিবার কোন কথা কেউ শুনলো না । রাইসুল আলম আদিবার কাছ থেকে সবুজের কথা জানতে পেরে পরদিনই তার বন্ধুর কাছে যোগাযোগ করে । সেখান থেকে সবুজের পরিচয় বের করে সেইদিন হাজির হয় সবুজের অফিসে । সেখানে গিয়ে সব কিছু খুলে বলে । সবুজকে জানায় যে তার মেয়ে সবুজ কে ছেড়ে কষ্ট পাচ্ছে । তারপর দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে আজকেই সবুজ ওর বাবা মা কে নিয়ে আদিবাদের বাসায় যাবে ।

আদিবা যখন কবুল বলল তখনও ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না ও সবুজকে বিয়ে করে ফেলছে । এতো দিনের এতো দ্বিধা এতো ভয় কাটিয়ে উঠে সে সত্যিই সবুজকে বিয়ে করে ফেলল ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 48

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →