আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম বাড়িটার দিকে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় বারোটা বাজে । এই সময়ে ঢাকা শহরের প্রায় সব ঘরেই আলো জ্বলে । আমাদের গ্রামে হলে পুরো গ্রাম নিশুতি হয়ে যেত অনেক আগেই । আমি সাইকেলটা নিয়ে আদিবাদের বাসার সামনে কেন এসেছি আমি নিজেই জানি না ।
বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে মেয়েটা আমার সাথে ভাল করে কথা বলেছে তার মানে এই না যে সে আমাকে পছন্দ করে । আন্তরিক ভাবে যে কোন ছেলের সাথেই যে কোন মেয়ে কথা বলতে পারে । আমাদের মফস্বলে ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক হলেও এই বড় শহরে এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয় । কিন্তু তারপর মনে হল যে এটাকে আমি অন্য দিকে নিয়ে কেন যাচ্ছি । এমটা তো হতেই পারে । একজন বন্ধু আরেকজনের সাথে দেখা করতে আসতেই পারে । এই বড় শহরে এটা খুবই ছোট একটা ব্যাপার ।
আমি ফোন বের করে আদিবার ডোনে ফোন দিলাম । জেগে আছে আমি জানি । এছাড়া এও জানি যে তিনদিন পরেই আদিবার বড় বোনের বিয়ে । প্রেম করে বিয়ে করছে । বাসা থেকে সেটা মেনেও নিয়েছে । ফোনটা একবার বাজতেই রিসিভ করলো আদিবা ।
-হাই । কী খবর?
-ভাল খবর । ব্যস্ত নাকি?
-আরে না । বসে বসে বিরক্ত হচ্ছি ।
-তোমাদের বাসার রংটা কি নীল রংয়ের ।
-হ্যা ।
-বড় একটা গেট আছে ।
-হ্যা । তুমি কি বাসার সামনে ?
-হ্যা । আসলে সাইকেল কিনেছি কদিন আগে । রাতের বেলা প্রায়ই বের হই । ভাবলাম আজকে এদিকে আসি । তোমার রুম কি রাস্তার দিকে?
আমি তখনই দেখতে পেলাম আদিবা বারান্দায় বের হয়ে এল । আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো । আমিও তাই করলাম ।
আদিবার দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবেই । আদিবার পরনে একটা থ্রিকোয়াটার লেগিংস আর টিশার্ট । বাসায় মেয়েরা যেভাবে থাকে সেই রকম । ভার্সিটিতে যখন আসে তখন খুব পরিপাটি করেই আসে । আজকে এভাবে একেবারে বাসায় পোশাকে দেখে অন্য রকম লাগলো । মনে হল যেন মেকআপ ছাড়া মেয়েটাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে !
আদিবা বলল, তুমি দাড়াও, আমি আসছি ।
-আরে এই রাতের বেলা নামতে হবে না মোটেও ।
-চুপ কোন কথা বলবা । দাড়াতে বলছি, দাড়াও ।
মিনিট পাঁচেক পরেই আদিবা মেনে এল । আমি ওকে সামনা সামনে দেখে আরও একটু ভিমড়ি খেলাম । একেবারে একই পোশাকে চলে এসেছে । দুর থেকে যেমন লাগছে সামনে দাড়িয়ে আরও বেশি আকর্ষনীয় মনে হল ওকে । আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাসায় সব আপুর বান্ধবীরা । কী সব প্যাঁচাল যে পাড়তেছে । আমার মোটেই ভাল লাগছে না । এর থেকে বরং তোমার সাথে গল্প করি । তার আগে তোমার সাইকেল দাও । আমি একটু চালাই ।
-আমি বললাম, তুমি চালাতে পারো !
-আরে পারি পারি ।
খুব যে ভাল পারে সেটা বলবো না তবে পারে মোটামুটি । মাঝে মাঝে ওকে ধরতে হল । ও বেশ ভালই সাইকেল চালালো । একবার পরেই যাচ্ছিলো কোন মতে ওকে ধরলাম । বলা যায় খানিকটা জড়িয়ে ধরা মত করেই ওর পতন ঠেকালাম । আমি যেমন অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম দেখলাম যে ও নিজেও খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল । তবে সামলে নিলো সাথে সাথে । সহজ হয়ে এল একটু পরেই । আরও কিছু সময় সাইকেল চালানোর পরে আমরা ওদের বাসার সামনের ফুটপাতে বসলাম । তারপর গল্প করতে শুরু করলাম ।
সত্যি বলতে কি এভাবে যে আমি ওর সাথে গল্প করতে পারবো সেটা আমি মোটেই ভাবি নি । ভেবেছিলাম যে ওকে দেখতে পাবো । হয়তো নেমে আসবে আবার নাও আসতে পারে । বারান্দা থেকে ডেখে চলে যাবো । কিন্তু এভাবে যে দেখা হবে, কথা হবে, ও সাইকেল চালাবে সেটা আমি মোটেও ভাবি নি । এই যে এখন বসে বসে গল্প করছি সেটাও ভাবি নি । আমার একেবারে গা ঘেষে বসে আছে ও । কত কিছু নিয়ে গল্প করছে সেটার কোন ঠিক নেই ।
একটা সময়ে আমি খেয়াল করলাম যে ভোরের আযান দিয়ে দিয়েছে । আমি খানিকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম । ও নিজেও খানিকটা অবাক হল । আমরা দুজনের গল্পের মাঝে এতো অবাক হয়েছি যে সময় কখন চলে গেছে আমি টের পাই নি । যখন আযান দিলো তখন আদিবা বলল, কী সর্বনাশ আমরা এতো সময় গল্প করেছি !
আমি বললাম, তাই দেখছি !
-আচ্ছা এখন বাসায় যাও । তোমার ঘুম নষ্ট করলাম !
-আরে কী যে বল ! তোমার সাথে গল্প করার জন্য এই রকম কত ঘুম কুরবান করা যায় !
কথাটা বলেই মনে হল ভুল হল । আদিবাকে দেখলাম আমার দিকে কেমন চোখে তাকালো । ল্যাম্পপোস্টের আলোতেই দেখলাম ওর চেহারাতে একটু লজ্জার ভাব ফুটে উঠেছে । তারপর বলল, আচ্ছা হয়েছে । এখন আর গুল মারতে হবে না । এখন বাসায় যাও । আমি কয়েকদিন ক্লাসে যাবো না । আপুর বিয়ের পর আবার যাবো । তুমি কিন্তু বিয়েতে আসবে অবশ্যই ।
আমি যখন সাইকেল নিয়ে চলে আসছিলাম তখন মোড়ের মাথায় আসার আগ পর্যন্ত দেখতে পেলাম আদিবা দাড়িয়ে রয়েছে আমার দিকে তাকিয়ে । এতো দুর থেকেও ওর চোখের দৃষ্টি চিনতে আমার মোটেও কষ্ট হল না । সেই চোখে আমার জন্য ভালোবাসা চিনতে আমার মোটেও কষ্ট হয় নি । আমাদের নতুন গল্প শুরু হতে চলেছে ।