এই সময়ে ..

oputanvir
4.7
(74)

ক্যান্টিনে বসেই কথাটা আমার কানে এল । জহির সিঙ্গারায় কামড় দিতে দিতে বলল, আদিবা এমন বাচ্চার মত আচরণ করবে ভাবি নি ।
আমি খুব একটা মনযোগ দেই নি, এমন একটা ভাব করে বললাম, ঘড়ি হারিয়েছে, খুজতেই পারে ! সমস্যা কি!
-আরে এমন কি আমার ঘড়ি । দেখছি তো । একটা রেপ্লিকা ঘড়ি । এপেল ওয়াচ হলেও না হয় বুঝতাম । বাচ্চাটার মত কাঁদছিলো ! এমন হাসি আসছিলো !

কান্নার কথাটা শুনে বুকের ভেতরে আটকে গেল । মেয়েটা আসলেই বাচ্চাই রয়ে গেল । আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না জহিরকে । ওকে বললাম না যে আদিবার হাতেই ঐঘড়িটা আমি ওকে উপহার দিয়েছিলাম । আমি ওকে আরও বললাম যে ওর কাছে সত্যিই একটা এপেল ওয়াচ আছে তারপরেও ও আমার দেওয়া রেপ্লিকা ঘড়িটাই পরে সব সময় !

এমন হয় না প্রথম দেখাতেই কাউকে খুব ভাল লাগে । আদিবাকে আমার ভাল লাগার ব্যাপারটাও ঠিক এমন ছিল । অরিয়েনটেশন ক্লাস শুরু থেকেই আদিবার দিকে আমার চোখ পড়ে । এবং ক্লাস শুরুর কদিন পরে আমি নিজেও খেয়াল করলাম যে কেবল আমিই না, আদিবাও আমার প্রতি খানিকটা আগ্রহী । মাঝে মাঝে আমার কাছে আসতো পড়া বুঝতে । এমন না যে আমি খুব ভাল ছাত্র । মোটামুটি মানের ছাত্র । ক্লাসে কে ভাল কে মন্দ ততদিনে অনেকেই জেনে গেছে । আমি মোটেও ভালর কাতারে পড়ি না । তারপরেও আদিবা আমার কাছেই আসতো ! টুকটাক কথা আমাদের মাঝে হতে শুরু করলো । তারপরই আদিবা আমাকে ওর জন্মদিনে আমন্ত্রন জানালো । ২৭ নম্বরের একটা রেস্টুরেন্টে । সন্ধ্যার পরে । আদিবাকে বললাম যে টিউশনি শেষ করে আমি হাজির হব ।

তবে আমি সেদিন আসলে বুঝতে পারলাম যে আদিবা আর আমার লাইন এক না । আমরা একে অন্য দিকে একেবারে আলাদা । পরদিন ক্লাসে এসে দেখলাম ওর মন খানিকটা ভার । আমার কেন জানি মনে হল যে আমার না যাওয়ার কারণেই আদিবার মন খারাপ । ক্লাস শেষ করে খুব সাহস নিয়ে ওর কাছে গেলাম । আমার দিকে খানিকটা অভিমানের কন্ঠেই বলল, কাল কেন আসো নি?

আমি মিথ্যা বলতে পারলাম না। ঠিক করে রেখেছিলাম যে বলবো যে টিউশনি থেকে সময় মত বের হতে পারি নি । তবে মিথ্যা বের হল না মুখ দিয়ে । বললাম, আমি আসলে …..
-তুমি আসলে?
-আমি আসলে এসেছিলাম !
-তারপর ? আমাকে কেন ডাক দিলে না । ফোন দিতে গিয়ে দেখি তোমার ফোন বন্ধ !

আমি কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম আদিবার দিকে । তারপর বলল, আমি যখন রেস্টুরেন্টে ঢুকতে যাচ্ছিলাম তখন সেখানকার গার্ড আমাকে আটকায় । নানান প্রশ্ন করলো কিছু সময় । অথচ আমি দেখেছি অনেকেই ভেতরে যাচ্ছে তাদেরকে সে আটকাচ্ছে না । বরং সালাম ঠুকছে ।

আদিবা সাথে সাথে তীব্র কন্ঠে বলল, তুমি আমাকে ফোন দিতে !
-আরে না না । আমাকে সে আটকায় নি । যখন বললাম একজন দাওয়াত দিয়েছে । জন্মদিনের আয়োজনে । তখন আর কিছু বলে নি । তুমি সম্ভবত বলে রেখেছিলে। তাই না ?
-হ্যা !
-আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল ।
-তাহলে কেন এলে না ?
-আসলে আমি আর আসতে পারি নি । নিজের পোশাক নিজের পায়ের স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে আমি আার ঢুকতে পারি নি । যদি ভেতরে ঢুকতাম নিজেই বড্ড লজ্জা পেতাম । নিজের এই জড়াজীর্ণ পোশাকে তোমার সামনে হাজির হলে লজ্জা পেতাম খুব । তুমিও লজ্জা পেতে ! বিব্রত হতে ।
-আমি কোনদিন তোমার পোশাক দেখে তোমার সাথে কথা বলি নি ।
-তুমি না বল, তোমার আশে পাশের মানুষ বলতো । বলতোই । এটা থেকে তাদের বিরত থাকা যেত না আদিবা । কোন ভাবেই না । তুমিও জানো এটাই সত্য !

আদিবা কিছু বলতে গিয়েও বলল না । বিশেষ করে আমার কন্ঠ শুনেই মনে হল ও কিছু বলতে পারলো না । কারণ ও নিজেও জানে যে আমি যা বলছি তা মোটেও মিথ্যা নয় । আদিবা কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো কেবল আমার দিকে । ও যখন চলে যাচ্ছিলো তখনই ব্যাগ থেকে আমি ঘড়িটা বের করে দিলাম । বললাম, ঘড়িটা তোমার জন্য কিনেছিলাম !

আদিবা ঘুড়ে দাড়ালো । তারপর খুব আগ্রহ নিয়ে ঘড়িটা হাতে পরলো । বলল, থেঙ্কিউ ।

তারপর আমাদের কথা বার্তা হত ঠিকই তবে একটা নির্দিষ্ট দেওয়াল ঠিকই আমরা তুলে রেখেছিলাম নিজেদের ভেতরে । আদিবার থেকে এই ব্যাপারটা আমি বেশি খেয়াল রাখতাম । তবে সব সময়ই দেখতাম যে ঘড়িটা হাতে পরে থাকতো । কখনই হাত থেকে খুলতো না । ওটা যে একটা কমদামি রেপ্লিকা সেটা অনেকেই দেখে বুঝতে পেরেছে । তারপরেও সেটা কখনই হাত থেকে খুলতো না ।

আমি জানি আদিবার কেন মন খারাপ । ঘড়িটা হারিয়েছে এই কারণে ঠিক ওর মন খারাপ নয় । ওর মন খারাপ কারণ ঘড়িটা ওকে আমি দিয়েছিলাম । এই কারণেই ও এমন আচরণ করছিলো !

দুই

রাতের এই বেলায় আমার মেসেজ পেয়ে আদিবা অবাক হবে আমি নিশ্চিত । তবে কেন জানি মনের ভেতরে কিছুতেই শান্ত পাচ্ছিলাম না । তাই দেরি না করে মনে মনে ঠিক করে নিলাম আমাকে যা করতে হবে ।

আমি ওদের বাসার ঠিক সামনে এসে ওকে মেসেজ পাঠানোর কয়েক মিনিট পরেই আদিবা নেমে এল নিচে । আমার দিকে খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, এখানে?
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম । তারপর বলল, টিউশনি শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম ।
তাকিয়ে দেখি আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার তখনই মনে হল আদিবা ঠিক ঠিক জানে যে আমি আজকে এখানে কেন এসেছি । আমার সেই ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে দিয়েই আদিবা হাত বাড়িয়ে দিল । আমিও আর কিছু লুকানোর চেষ্টা করলাম না । ব্যাগ থেকে ওর জন্য কেনা ঘড়িটা বের করে দিলাম । সেদিনের মতই ও আমার সামনেই ঘড়িটা পরলো । আমি দেখতে পেলাম ওর নে একটা আনন্দের আভা দেখা যাচ্ছে ।
গতবারের মত করেই বলল, থ্যাঙ্কিউ ।
আমি হাসলাম । আদিবা বলল, আমার মনেই হচ্ছিলো যে তুমি আসবে । ঘড়িটা হারিেয় এতো মন খারাপ লাগছিলো । ঘড়িটা যখন পরে থাকতাম মনে হত যে তোমার হাত ধরে আছি । হাত ছুটে গিয়ে খারাপ লাগছিলো খুব ।
আমি কী যে বলবো বুঝতেই পারলাম না ।
আদিবা আবার বলল, এখন ঠিক আছে সব কিছু । থ্যাঙ্কিউ এগেইন ।
আমার মাঝে কী হল আমি বললাম, চা খাবে?
-চা ?
-হুম । ঐ যে তোমাদের বাসার সামনে ঐ দোকানে খুব চমৎকার চা বানায় !

লাইনটা বলেই মনে হল ভুল করে ফেললাম । ওদের বাসার সামনের চায়ের দোকানে ভাল চা বানায় এটা আমার জানার কথা না । আমি কিভাবে জানলাম ! আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বলল, আর কত নিজেকে দুরে রাখবে তুমি ! আমার বাসার দোকানের সামনের চা ভাল তুমি কিভাবে জানো ? কতদিন এখানে বসে চা খেয়েছো ? আমাকে দেখার জন্য?

আমার উত্তরের আশা না করেই আদিবা আমার দিকে এগিয়ে এল একটু । তারপর আমার হাতটা ধরলো । বলল, চল একটু হাটি । চা খেতে হবে না এখন । ওখানে পাড়ার কিছু অকেজো লোকজন বসে থাকে । এখন যদি যাই তাহলে কত কিছু খেয়ালী পোলাউ বানাবে তার ঠিক নেই । এর চেয়ে বরং হাটি একটু !

আমি আর কিছু বললাম না । হাটতে লাগলাম । সত্যি বলতে এতো চমৎকার লাগছিলো যে অন্য কোন কিছু আর ভাবতে ভাল লাগছিলো না । এই যে আদিবার হাত ধরে হাটছি । আর কিছু ভাবতে ভাল লাগছিলো না । কেবল মনে হচ্ছিলো আমি এই সময়ে বেঁচে আছি । এই সময়ে আর কিছুই নেই । আমি আছি আর আদিবা আছে । এই সময়ে আর কিছু নেই !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 74

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →