এই সময়ে ..

oputanvir
4.7
(77)

ক্যান্টিনে বসেই কথাটা আমার কানে এল । জহির সিঙ্গারায় কামড় দিতে দিতে বলল, আদিবা এমন বাচ্চার মত আচরণ করবে ভাবি নি ।
আমি খুব একটা মনযোগ দেই নি, এমন একটা ভাব করে বললাম, ঘড়ি হারিয়েছে, খুজতেই পারে ! সমস্যা কি!
-আরে এমন কি আমার ঘড়ি । দেখছি তো । একটা রেপ্লিকা ঘড়ি । এপেল ওয়াচ হলেও না হয় বুঝতাম । বাচ্চাটার মত কাঁদছিলো ! এমন হাসি আসছিলো !

কান্নার কথাটা শুনে বুকের ভেতরে আটকে গেল । মেয়েটা আসলেই বাচ্চাই রয়ে গেল । আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না জহিরকে । ওকে বললাম না যে আদিবার হাতেই ঐঘড়িটা আমি ওকে উপহার দিয়েছিলাম । আমি ওকে আরও বললাম যে ওর কাছে সত্যিই একটা এপেল ওয়াচ আছে তারপরেও ও আমার দেওয়া রেপ্লিকা ঘড়িটাই পরে সব সময় !

এমন হয় না প্রথম দেখাতেই কাউকে খুব ভাল লাগে । আদিবাকে আমার ভাল লাগার ব্যাপারটাও ঠিক এমন ছিল । অরিয়েনটেশন ক্লাস শুরু থেকেই আদিবার দিকে আমার চোখ পড়ে । এবং ক্লাস শুরুর কদিন পরে আমি নিজেও খেয়াল করলাম যে কেবল আমিই না, আদিবাও আমার প্রতি খানিকটা আগ্রহী । মাঝে মাঝে আমার কাছে আসতো পড়া বুঝতে । এমন না যে আমি খুব ভাল ছাত্র । মোটামুটি মানের ছাত্র । ক্লাসে কে ভাল কে মন্দ ততদিনে অনেকেই জেনে গেছে । আমি মোটেও ভালর কাতারে পড়ি না । তারপরেও আদিবা আমার কাছেই আসতো ! টুকটাক কথা আমাদের মাঝে হতে শুরু করলো । তারপরই আদিবা আমাকে ওর জন্মদিনে আমন্ত্রন জানালো । ২৭ নম্বরের একটা রেস্টুরেন্টে । সন্ধ্যার পরে । আদিবাকে বললাম যে টিউশনি শেষ করে আমি হাজির হব ।

তবে আমি সেদিন আসলে বুঝতে পারলাম যে আদিবা আর আমার লাইন এক না । আমরা একে অন্য দিকে একেবারে আলাদা । পরদিন ক্লাসে এসে দেখলাম ওর মন খানিকটা ভার । আমার কেন জানি মনে হল যে আমার না যাওয়ার কারণেই আদিবার মন খারাপ । ক্লাস শেষ করে খুব সাহস নিয়ে ওর কাছে গেলাম । আমার দিকে খানিকটা অভিমানের কন্ঠেই বলল, কাল কেন আসো নি?

আমি মিথ্যা বলতে পারলাম না। ঠিক করে রেখেছিলাম যে বলবো যে টিউশনি থেকে সময় মত বের হতে পারি নি । তবে মিথ্যা বের হল না মুখ দিয়ে । বললাম, আমি আসলে …..
-তুমি আসলে?
-আমি আসলে এসেছিলাম !
-তারপর ? আমাকে কেন ডাক দিলে না । ফোন দিতে গিয়ে দেখি তোমার ফোন বন্ধ !

আমি কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম আদিবার দিকে । তারপর বলল, আমি যখন রেস্টুরেন্টে ঢুকতে যাচ্ছিলাম তখন সেখানকার গার্ড আমাকে আটকায় । নানান প্রশ্ন করলো কিছু সময় । অথচ আমি দেখেছি অনেকেই ভেতরে যাচ্ছে তাদেরকে সে আটকাচ্ছে না । বরং সালাম ঠুকছে ।

আদিবা সাথে সাথে তীব্র কন্ঠে বলল, তুমি আমাকে ফোন দিতে !
-আরে না না । আমাকে সে আটকায় নি । যখন বললাম একজন দাওয়াত দিয়েছে । জন্মদিনের আয়োজনে । তখন আর কিছু বলে নি । তুমি সম্ভবত বলে রেখেছিলে। তাই না ?
-হ্যা !
-আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল ।
-তাহলে কেন এলে না ?
-আসলে আমি আর আসতে পারি নি । নিজের পোশাক নিজের পায়ের স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে আমি আার ঢুকতে পারি নি । যদি ভেতরে ঢুকতাম নিজেই বড্ড লজ্জা পেতাম । নিজের এই জড়াজীর্ণ পোশাকে তোমার সামনে হাজির হলে লজ্জা পেতাম খুব । তুমিও লজ্জা পেতে ! বিব্রত হতে ।
-আমি কোনদিন তোমার পোশাক দেখে তোমার সাথে কথা বলি নি ।
-তুমি না বল, তোমার আশে পাশের মানুষ বলতো । বলতোই । এটা থেকে তাদের বিরত থাকা যেত না আদিবা । কোন ভাবেই না । তুমিও জানো এটাই সত্য !

আদিবা কিছু বলতে গিয়েও বলল না । বিশেষ করে আমার কন্ঠ শুনেই মনে হল ও কিছু বলতে পারলো না । কারণ ও নিজেও জানে যে আমি যা বলছি তা মোটেও মিথ্যা নয় । আদিবা কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো কেবল আমার দিকে । ও যখন চলে যাচ্ছিলো তখনই ব্যাগ থেকে আমি ঘড়িটা বের করে দিলাম । বললাম, ঘড়িটা তোমার জন্য কিনেছিলাম !

আদিবা ঘুড়ে দাড়ালো । তারপর খুব আগ্রহ নিয়ে ঘড়িটা হাতে পরলো । বলল, থেঙ্কিউ ।

তারপর আমাদের কথা বার্তা হত ঠিকই তবে একটা নির্দিষ্ট দেওয়াল ঠিকই আমরা তুলে রেখেছিলাম নিজেদের ভেতরে । আদিবার থেকে এই ব্যাপারটা আমি বেশি খেয়াল রাখতাম । তবে সব সময়ই দেখতাম যে ঘড়িটা হাতে পরে থাকতো । কখনই হাত থেকে খুলতো না । ওটা যে একটা কমদামি রেপ্লিকা সেটা অনেকেই দেখে বুঝতে পেরেছে । তারপরেও সেটা কখনই হাত থেকে খুলতো না ।

আমি জানি আদিবার কেন মন খারাপ । ঘড়িটা হারিয়েছে এই কারণে ঠিক ওর মন খারাপ নয় । ওর মন খারাপ কারণ ঘড়িটা ওকে আমি দিয়েছিলাম । এই কারণেই ও এমন আচরণ করছিলো !

দুই

রাতের এই বেলায় আমার মেসেজ পেয়ে আদিবা অবাক হবে আমি নিশ্চিত । তবে কেন জানি মনের ভেতরে কিছুতেই শান্ত পাচ্ছিলাম না । তাই দেরি না করে মনে মনে ঠিক করে নিলাম আমাকে যা করতে হবে ।

আমি ওদের বাসার ঠিক সামনে এসে ওকে মেসেজ পাঠানোর কয়েক মিনিট পরেই আদিবা নেমে এল নিচে । আমার দিকে খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, এখানে?
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম । তারপর বলল, টিউশনি শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম ।
তাকিয়ে দেখি আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার তখনই মনে হল আদিবা ঠিক ঠিক জানে যে আমি আজকে এখানে কেন এসেছি । আমার সেই ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে দিয়েই আদিবা হাত বাড়িয়ে দিল । আমিও আর কিছু লুকানোর চেষ্টা করলাম না । ব্যাগ থেকে ওর জন্য কেনা ঘড়িটা বের করে দিলাম । সেদিনের মতই ও আমার সামনেই ঘড়িটা পরলো । আমি দেখতে পেলাম ওর নে একটা আনন্দের আভা দেখা যাচ্ছে ।
গতবারের মত করেই বলল, থ্যাঙ্কিউ ।
আমি হাসলাম । আদিবা বলল, আমার মনেই হচ্ছিলো যে তুমি আসবে । ঘড়িটা হারিেয় এতো মন খারাপ লাগছিলো । ঘড়িটা যখন পরে থাকতাম মনে হত যে তোমার হাত ধরে আছি । হাত ছুটে গিয়ে খারাপ লাগছিলো খুব ।
আমি কী যে বলবো বুঝতেই পারলাম না ।
আদিবা আবার বলল, এখন ঠিক আছে সব কিছু । থ্যাঙ্কিউ এগেইন ।
আমার মাঝে কী হল আমি বললাম, চা খাবে?
-চা ?
-হুম । ঐ যে তোমাদের বাসার সামনে ঐ দোকানে খুব চমৎকার চা বানায় !

লাইনটা বলেই মনে হল ভুল করে ফেললাম । ওদের বাসার সামনের চায়ের দোকানে ভাল চা বানায় এটা আমার জানার কথা না । আমি কিভাবে জানলাম ! আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বলল, আর কত নিজেকে দুরে রাখবে তুমি ! আমার বাসার দোকানের সামনের চা ভাল তুমি কিভাবে জানো ? কতদিন এখানে বসে চা খেয়েছো ? আমাকে দেখার জন্য?

আমার উত্তরের আশা না করেই আদিবা আমার দিকে এগিয়ে এল একটু । তারপর আমার হাতটা ধরলো । বলল, চল একটু হাটি । চা খেতে হবে না এখন । ওখানে পাড়ার কিছু অকেজো লোকজন বসে থাকে । এখন যদি যাই তাহলে কত কিছু খেয়ালী পোলাউ বানাবে তার ঠিক নেই । এর চেয়ে বরং হাটি একটু !

আমি আর কিছু বললাম না । হাটতে লাগলাম । সত্যি বলতে এতো চমৎকার লাগছিলো যে অন্য কোন কিছু আর ভাবতে ভাল লাগছিলো না । এই যে আদিবার হাত ধরে হাটছি । আর কিছু ভাবতে ভাল লাগছিলো না । কেবল মনে হচ্ছিলো আমি এই সময়ে বেঁচে আছি । এই সময়ে আর কিছুই নেই । আমি আছি আর আদিবা আছে । এই সময়ে আর কিছু নেই !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 77

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →