রাজু সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিল । আমি সাধারণত সিগারেট খুব একটা খাই না । তবে আজকে হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিলাম । একটা সুখ টান দিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম শূন্যের দিকে । ঘুরে ফিরে আমার কেবলই আদিবার কথাই মনে আসছে । কিছুতেই ওকে মন থেকে বের করতে পারছি না । রাজু আবার আমার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে বলল, মামা, এই মেয়ে জেনুইন । কোন ভেজাল নাই । এমনে কেউ কারো জন্য কাঁন্তে পারে না রে, পারে না! আমার জন্য কেউ এমনে কাঁনলে দুনিয়ার সব ফালায়া তার পেছন পেছন ঘুরতাম খালি !
আমি কোন কথা বললাম না । আবারও আদিবার কথা আমার মনের ভেতরে ভেসে উঠলো । মেয়েটার সুন্দর গোলগাল চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবার ।
আদিবাকে আমি চিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের শুরু থেকেই । তখন সবে মাত্র বুয়েটে ভর্তি হয়েছি । বাবার বাসা থেকে টাকা পাঠানোর খুব একটা অবস্থা নেই । নজরুল ভাই জানতেন আমার অবস্থা । তিনি আমাকে আদিবাকে পড়ানোর দায়িত্ব দিলেন । আদিবা ছিল নজরুল ভাইয়ের বসের মেয়ে ।
আদিবা তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে । আমার থেকে মাত্র এক বছরের জুনিয়র । আদিবার লক্ষ্য ছিল ডাক্তার হবে । তাই ম্যাথের দিকে ওর ঝোক ছিল কম কিন্তু পরীক্ষায় তো পাশ করতে হবে । কেবল পাশ নয়, ভাল নম্বর না পেলে তো রেজাল্টের নম্বর কমে যাবে ভর্তি পরীক্ষায় । তাই আমাকে নিয়োগ দেওয়া দেওয়া হয়েছে ।
গ্রাম থেকে তখন সবে মাত্র শহরে গিয়েছি । কিছুই ঠিক ঠাক মত চিনি না, জানি না, বুঝি না । দেখতাম আদিবা প্রায়ই আমার আচরণে হাসতো । আমার বড় অস্বস্তি লাগতো । বিশেষ করে ওর আধুনিক পোশাকের সামনে আমি সহজে সহজ হতে পারতাম না । একদিন ও পড়তে এল শর্টস পরে । আমি খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম । ওর ফর্সা পায়ের দিকে একবার চোখ চলে গিয়েছিলো । সাথে সাথে সরিয়ে নিলাম তবে ঠিকই বুঝতে পারলাম যে বারবার সেদিকে চোখ যেতে চাইছে । সেদিন কিভাবে নিজেকে সামলেছিলাম তা কেবল আমিই জানি ।
আদিবাদের বাসার টিউশনিটা আমি ছাড়তাম না । ভাল টাকা আসছিল ওখানে থেকে । কিন্তু যেদিন বুঝতে পারলাম যে আদিবার মনে আরো অন্য কিছু রয়েছে সেদিন থেকেই আমি সুযোগ খুজছিলাম সরে পড়ার । আমার সামনে খুব কঠিন একটা দেওয়াল তোলা রয়েছে যা আমি কোন ভাবেই টপকে যেতে পারবো না । তাই সরে পড়াই আমার জন্য ভাল । মাস ছয়েকের ভেতরে সেই সুযোগ এসে হাজির হল । আরেকজন নতুন ছাত্র নিযুক্ত করে দিয়ে আমি সরে পড়লাম আদিবার কাছ থেকে । ভেবেছিলাম বোধহয় আমার জীবন থেকে আদিবার অধ্যায়ের শেষ কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গলো তার নয় মাস পরে । তখন নতুন ব্যাচ ভর্তি হয়েছে বুয়েটে । এবং নবীন বরণেই আমি তীব্র অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে আদিবা আমার ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছে এবং আমার সাবজেক্টেই । আমি কেবল চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম । কোন ভাবেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । আদিবার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল । তাহলে ও এখানে কী করছে ?
কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার মনের সন্দেহ একেবারে সত্যে রূপান্তরিত হল । আদিবা কেবল আমার জন্য এই খানে এসেছে । কেবল আমার জন্য । এবং ওর আচরণেই সেটা আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম । আমি যতই ওর কাছ থেকে দুরে সরে যেতে চাই ও আমার কাছে ততই ঘেষে আসে । কিছুতেই ওর কাছ থেকে পিছু ছাড়াতে পারি না । এভাবে বছর খানেক চলার পরে মনে হল একটা কিছু করা দরকার । এমন কিছু যাতে করে আদিবা আমার কাছে আর আসবে না । সেই পরিক্ল্পনা মোতাবেকই ক্লাসের নিলুকে ঠিক করলাম। ও কিছুদিন আমার প্রেমিকা হিসাবে অভিনয় করবে । আদিবার সামনেই একটু ঢলাঢলি করবে। ব্যাস এই হচ্ছে ওর কাজ । গতকালই সেই সুযোগ চলে এল । তবে নিলু যেন একটু বেশি ঢলাঢলি করে ফেলল । একেবারে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল । আমার চোখ তখন পড়লো আদিবার উপর । ওর চোখের দিকে আমি গতকাল তীব্র একটা যন্ত্রনা দেখতে পেলাম । সত্যি বলতে কী ওর এমন প্রতিক্রিয়া আমি কল্পনা করি নি । ও তখনই দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে । পরে আমি রাজুর কাছ থেকে শুনেছি যে আদিবা নাকি আমাদের পুকুর পাড়ে গিয়ে হাউমাউ করে কান্না করছিলো । ওর বান্ধুরা ওকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কেউ নাকি থামাতে পারে নি । শেষে মেয়েটা খানিকটা অসুস্থ হয়ে যায় । ক্যাম্পাসের ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় ।
তখন থেকেই আমার আর কিছু ভাল লাগছে না । রাজু নিজ চোখে এই কান্না দেখে এসেছে । আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে অনেক হয়ছে এসব । আদিবার সাথে এই ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে হবে । বুঝিয়ে বললে ও নিশ্চয়ই বুঝবে ।
দুই
আমার হলের সামনেই রাস্তায় সন্ধ্যা হলে অনেকেই বসে আড্ডা দেয় । আদিবাকে এখানেই আসতে বলেছিলাম । ওর টেক্সট পেয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম । দেখলাম ও শান্ত হয়ে ফুটপাথের উপরে বসে । অন্যদের থেকে একটু দুরে । আমি কোন কথা না বলে ওর পাশে গিয়ে বসলাম । আদিবাও কোন কথা বলল না । চুপচাপ কিছু সময় কেটে গেল । আমি নিজের পকেট থেকে ডেইরি মিল্কের চকলেটটা বের করে ওর হাতেে দিলাম । আদিবা সেটা নিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল । ওকে যখন পড়াতে যেতাম ও প্রায়ই আমাকে নানান রকম চকলেট খেতে দিতো । ওর ড্রয়ার ভর্তি সব সময় চকলেট থাকতো, নানান রকমের নানান দেশের সব চকলেট । মাঝে মাঝে আমি নিজেও ওকে চকলেট কিনে দিতাম । বলাই বাহুল্য আমার দৌড় ছিল কিটক্যাট নয়তো ডেইরি মিল্ক পর্যন্তই ।
চকলেট খুলে আদিবা একটা কামড় দিল । তারপর শান্ত কন্ঠে বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করবো? রাখবেন?
-বল ।
-আপনি প্লিজ এই ক্যাম্পাসের কয়টা দিন অন্য মেয়ের সাথে ঘুরবেন না । প্লিজ । আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবো না কেবল আমার চোখের সামনে আপনার সাথে অন্য কোন মেয়েকে আমি সহ্য করতে পারবো না । এই টুকু কি করবেন আমার জন্য !
আদিবার কন্ঠে এই হাহাকার শুনে আমার কেন জানি মনে হল সব বাঁধা আজই পেরিয়ে আমি আদিবার কাছে গিয়ে হাজির হই । আমি ওর দিকে কিছু সময় কেবল তাকিয়ে রইলাম । কী বলবো কীভাবে বলবো কিছুই যেন বুঝতে পারছিলাম না । বুকের মাঝে একটা তীব্র আন্দোলন উঠছিলো কেবল । এক সময় সেটা শান্ত হল। আমি বললাম, নজরুল ভাইকে তো চিনো?
আদিবা মাথা নাড়ালো । বলল, বাবার সাথে কাজ করে ।
-হ্যা । আমার বাবা নজরুল ভাইদের বাড়িতে সারা জীবন কাজ করেছে । এখনও কাজ করে । আমার বড় ভাইও তাই । আমি নিজেও তাদের জমিতে কাজ করেছি । পড়াশুনায় ভাল ছিলাম বলে নজরুল ভাইয়ের বাবা আমাকে পড়িয়েছেন । সত্যি বলতে তাদের দয়া না থাকলে আমার পড়া হত না কোন দিন । আর তুমি হচ্ছো সেই নজরুল ভাইয়ের বসের মেয়ে । আমি তোমার কাছে কিভাবে যাই বল ? তোমাকে যেদিক পড়াতে যাই সেদিনই নজরুল ভাই আমাকে কড়া করে বলে দিয়েছিলেন যেন আমি আমার অবস্থান কোন দিন না ভুলে যাই । বিশ্বাস কর, আমি চাইলেও এই দেয়াল কোনদিন অতিক্রম করতে পারবো না । কোন দিন না ।
আমি আদিবার দিকে তাকালাম না । আরও ভাল করে বললে তাকাতে পারলাম না । রাস্তার দিকে তাকিয়েই আমি বললাম, আদিবা, তুমি এমন একজন মেয়ে যাকে চাইলেও কেউ দুরে রাখতে পারবে না । আমিও পারি না । কিন্তু বাস্তবে আসলে আমার কিছু করার নেই । এখন তুমিও যদি এই ছেলেমানুষী গুলো কর আমার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে যাবে খুব ।
আমাদের মাঝে আর কথা হল না । আমরা কেবল বসে রইলাম । কেন জানি বসে থাকতে ভাল লাগছিলো । একটা সময়ে আদিবার যাওয়ার সময় হল । ও আসি বলে উঠে চলে গেল । আমি কেবল ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম । যতদুর পর্যন্ত চোখ যায় তাকিয়ে রইলাম ।
এরপর থেকে আদিবা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছিল । ক্যাম্পাসে আমাদের দেখা হত মাঝে মাঝে । চোখে চোখ পড়তো । আমি ওর চোখে নিজের প্রতি সেই ভালবাসাটা দেখতে পেতাম প্রতিবার । ওর প্রতি আমার মনভাব কি ও দেখতে পেতো আমার চোখে?
কে জানে !
বিএসসি শেষের পরেই বাইরে যাওয়ার একটা সুযোগ চলে এল । সেটা হাত ছাড়া করলাম না । চলে এলাম দেশের বাইরে । মাস্টার্সের পর পিএইচডির জন্য এপ্লাই করলাম । সব কিছু নিজের গতিতে চলছিলো ঠিক তখনই আবারও আমার সাথে আদবার দেখা হল । নতুন পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের রিসিভ করতে আরেকজনের সাথে আমিও গিয়ে হাজির হলাম । গিয়েই আমার চোখ কপালে উঠলো । এগারোজন নতুন স্টুডেন্টডের ভেতরে আদিবা একজন । আমার দিকে চোখ পড়তেই হাসলো । যেন জানতো আমার সাথে দেখা হবে ওর এখানেই ।
ঠিক তখনই আমার মনে কথাটা এল । সারা দিনের সকল কাজ কর্ম শেষ করে আদিবাদের থাকা খাওয়ার জায়গা ঠিক করে দিয়ে ওকে নিয়ে বের হলাম কফি খেতে । কফির কাপ হাতে নিয়ে প্রথম প্রশ্নটা করলাম আমিই ।
-এটাই কি তোমার প্রথম সুযোগ এখানে আসার নাকি আরও কোথাও হয়েছিলো?
-ইংল্যান্ডে হয়েছিলো, অস্ট্রেলিয়াতেও । এমন কি এই এখানেও হয়েছিলো গত বছর কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে । তাই আসি নি । একেবারে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার প্রোফেসরের আন্ডারে হয়েছে তারপর এসেছি ।
-পাগলামো যায় নি এখন?
-নোপ ! এরপর আপনি যেখানে চাকরি নিবেন আমিও সেখানে চাকরি নেব । তারপর সেখানে বিয়ে করবেন সেই পরিবারের কোন ছেলেকে বিয়ে করবো !
-যদি সেই পরিবারে কোন ছেলে না থাকে তখন?
-তখন আপনার শ্বশুরকে বিয়ে করবো !
আমি কফি কেবল মুখে দিয়েছিলাম । সেটা হাসির দমকে বের হয়ে এল । যদিও ও হাসছে তবে আমার কেন জানি মনে হল ও সত্য সত্যি এটা করবে । আমি বললাম, কোন দিন আমার পিছু ছাড়বে না ?
-নোপ ! কোন দিন না । মেয়েদের ভালোবাসা বড় ভয়ংকর হয় জনাব ।
তখনই আমার মনে হল এবার একটু সাহস কি দেখানো যায়? দেশ ছেড়ে এতো দুরে এসে কি একটু দেওয়াল আমি অতিক্রম করতে পারি? একবার কি চেষ্টা করে দেখবো?
আমি বললাম, আমি কোন কথা নিশ্চিত করে দিচ্ছি না তবে যদি এখানে সেটেল্ড হতে পারি তাহলে …
আমি কথাটা শেষ করতে পারলাম না দেখলাম আদিবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে । আমার দিকে খানিকটা অবিশ্বাস্য আনন্দের চোখে ও তাকিয়ে রয়েছে । আমার কেন জানি মনে হল আদিবার আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু দ্বিধার কারণে পারছে না ।
কফি শেষ করে বাইরে বের হয়ে এলাম। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে বাইরে । মূল রাস্তা থেকে একটু নামতেই অনুভব করলাম আদিবা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । তারপর সেই হুহু করে কান্না । এতো জোড়ে ও কাঁদতে লাগলো যে আমি আবার ভয় পেয়ে গেলাম যে কেউ না এই কান্না শুনে এগিয়ে আসে ।
ওর শান্ত হতে বেশ সময় লাগলো । রাতে ওকে ডর্মেটরিটতে রেখে নিজের ঘরে এলাম । কেন জানি মনে হল যে আমি দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলেছি একদম । যদি এখানে আমি সেটেল্ড নাও হতে পারি তারপরেও আদিবাকে আর হয়তো কোন দিন আমার জীবন থেকে আলাদা করতে পারবো না ।
এত্তো এত্তো বানান ভুল 😕🤢
যথা সম্ভব বানান ঠিক করলাম ।
আদিবা নামটাই তো প্রেমে পরার মত