চারু – আগমন

oputanvir
4.7
(41)

বিকেল বেলা। ঈদের মৌসুম । কুরবানীর গরুর হাট। ক্রেতা বিক্রেতাদের ভীড় । মানুষ তাদের পছন্দ এবং বাজেট অনুযায়ী গরু দেখতে ও কিনতে ব্যস্ত । চারিদিকে হইচই । আনন্দমূখর একটা অবস্থা । কিন্তু এই আনন্দমুখর শব্দের ভেতরে একটা তীব্র চিৎকার শোনা গেল । তীব্র ব্যাথায় একজন চিৎকার করে উঠেছে । ঠিক তারপর পরে আরো কিছু সম্মিলিত ভয়ের চিৎকার শোনা গেল ।

একটা বিশালদেহী ষাড় ছুটে যাচ্ছে । সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে তীব্র ভাবে ঢাক্কা দিচ্ছে নিজের মাথা দিয়ে । লোকজন রাস্তা ছেড়ে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে । কয়েক মুহুর্তের ভেতরে রাস্তা ফাকা হয়ে গেল । সবাই বাশের ঘেরের ভেতরে ঢুকে পড়লো । কিন্তু তখনই সবাই দেখতে পেল ষাড়টির পথে একটা ১০/১১ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে । হয়তো হুটপুটিতে রাস্তায় পড়ে গেছে । তার বাবা কিংবা অন্য আত্মীয়কে দেখা যাচ্ছে না । মেয়েটি রাস্তায় উপরে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ষাড়টি দ্রুত গতিতে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । মানুষ যেন দম নিতে ভুলে গেছে । সবাই তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটার দিকে আর তার দিকে ছুটে আসা ষাড়টার দিকে । প্রতি নিয়ত তাদের ভেতরকার দুরত্ব কমে আসছে । কেউ যে মেয়েটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে কিংবা মেয়েটাকে বাঁচাবে এমন কথা কারো মাথাতে আসছেই না । সবাই অপেক্ষা করছে কখন ষাড়টা মেয়েটাকে আঘাত করবে আর মেয়েটা তীব্র ব্যাথায় চিৎকার করে উঠবে ।

কিন্তু তখনই ঘটলো সব থেকে অবাক হওয়ার ঘটনা । সবাই অবাক হয়ে দেখতে পেল ষাড়টা মেয়েটার দিকে ঠিক এক হাত দূরে এসেই থেমে গেল । একভাবে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় মেয়েটার দিকে । মেয়েটাও ষাড়টার চোখের দিকেই একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । সবাই একেবারে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা আর ষাড়টার দিকে । মেয়েটা এবার এক কদম এগিয়ে গেল । তারপর ষাড়টার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো । তারপর কিছুই যেন হয় নি এমন একটা ভাব করে ঘুরে উল্টো দিকে হাটা দিলো । ষাড়টা তখনও আগের স্থানেই স্থির হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ।

আকিব একেবারে অবাক হয়ে গেল তার সুপিরিয়র লতিফুল রহমানের কথা শুনে । এই ক্রাইসিসের সময়ে এমন দায়িত্ববান মানুষের মুখ থেকে এমন কথা যে বের হতে পারে সেটা সে ভাবতেও পারে নি । তবে মুখে কিছু বলার সাহস পেল না । মনে মনে তীব্র অসন্তুষ্ট হল ।

লতিফুল রহমান বলল, মেয়েটাকে খুজে বের কর আকিব ।  একমাত্র ঐ মেয়েটাই আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে।

-কিন্তু স্যার …

-কোন কিন্তু না । তোমাকে তো আমি আগে সুযোগ দিয়েছি । দেই নি ? তুমি তোমার মত করে ব্যবস্থা নিয়েছো । ওদের মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পেরেছো কী? বল পেরেছো ?

আকিব মাথা নীচু করলো । সত্যিই সে পারে নি ।

কোন মতে বলল, না স্যার । এখনও পারি নি । তবে …

-আর কত সময় চাও? কাল ২৬শে মার্চ । কালই ঘটবে ঘটনাটা । আমরা এখনও কোন ক্লুই বের করতে পারি নি যে বোমাটা কোথায় আছে ? কোন জায়গায় ফাটবে এবস কিছুই বের করতে পারো নি । আমি কি এখন তোমার ভরশায় বসে থাকবো? তারপর চেয়ে দেখবো দেখবো কত জন মারা গেল?

আকিব আবারও কোন কথা না বলে চুপ করে রইলো । লতিফুল রহমান বললেন, মেয়েটা ঢাবিতে পড়ে আমি জানি । নাম চারুলতা । এই টুকু আমি জানি । গাজিপুর থাকতো । এখানকার সরকারি স্কুলে পড়তো যখন মেয়েটাকে প্রথম দেখি এবং মেয়েটা আমাদের সাহায্য করে । বুঝতে পেরেছো কি ? কেবল মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা সব কিছু বলে দিতে পারে । আমি জানি তুমি আমার কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছো কিন্তু আমি নিজের চোখে না দেখলে তোমাকে বলতাম না । কেবল একবার নয় তারপরে বেশ কয়েকবার মেয়েটাকে আমি ডেকে নিয়ে সাহায্য নিয়েছি । বুঝেছো আমার কথা?

আকিব মাথা নীচু করেই বলল, জ্বী স্যার !

-যাও মেয়েটাকে খুজে বের কর ।

 আকিব ঘর থেকে বের হয়ে গেল । একটু বিরক্ত হলেও চারুলতার খোজে সে বের হল । খুব বেশি কষ্ট হবে না । গাজিপুর সরকারী স্কুলে পড়েছে । যদি সেখান থেকে এসএসসি পাশ করে এবং পরে ঢাবিতে ভর্তি হয় তাহলে এই তথ্য নিয়ে তাকে খুজে বের করা খুব বেশি জটিল হবে না । কিন্তু যদি অন্য স্কুলে চলে যায় এসএসসির আগে তাহলে অবশ্য একটু ঝামেলা হবে ।

তবে ঝামেলা হল না । মেয়েটার খোজ বের করতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো । ঢাবির এপ্লাইড ফিজিক্স পড়ে মেয়েটা থাকে রোকেয়া হলে । এমন কী ফোন নম্বর পর্যন্ত পাওয়া গেল । সরকারি যোগাযোগ করা হল হল প্রোভোস্টের কাছে । আকিব নিজে গেল হলের সামনে । প্রভোস্ট সহ মেয়েটি বের হয়ে এল একটু পরেই । মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আকিবের কোণ অস্বাভাবিক কিছু মনে হল না । চোখে চশমা । ঘন চুল । একটু আগে ঘুমিয়ে ছিল সেটা চোখের দিকে তাকিয়েই আকিব বলে দিতে পারে । সেই সাথে মেয়েটা খানিকটা বিরক্তও হয়েছে বোঝা যাচ্ছে । এই ব্যাপারটাই আকিবের কাছে নতুন লাগলো । রাতের বেলা পুলিশ এসেছে তাকে নিয়ে যেতে অথচ মেয়েটার চোখে কোন ভয় নেই । তার মানে মেয়েটা খুব ভাল করেই জানে যে তার সাথে কী হচ্ছে ।

প্রভোস্ট ম্যাডাম চারুর দিকে তাকিয়ে বলল, চারু ইনাদের সাথে যাও একটু । কেবল তুমিই নাকি এদের সাহায্য করতে পারবে । লতিফুল রহমানকে চিনো তুমি ?

চারু চোখ তুলে তাকালো । তারপর বলল, জ্বী ম্যাম চিনি ।

-তাহলে তো আর নতুন করে কিছু বলতে হবে না ।

তারপর আকিবের দিকে তাকিয়ে প্রোভোস্ট ম্যাম বললেন, আপনি চারুকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছেন কাজ শেষ করে আবার আপনিই এখানে দিয়ে যাবেন । ঠিক আছে ? যদি এমন না হয় তাহলে আমি ওকে আপনার হাতে ছাড়বো না ।

আকিব আবারও একটু বিরক্ত হল বটে তবে বলল, জ্বী আমিই ওকে দিয়ে যাবো । কোন চিন্তা করবেন না।

চারু খুব শান্ত ভাবে গাড়িতে উঠলো । গাড়ি ছুতে চলল এটিওর অফিসের দিকে । আকিব শান্ত ভাবে বসে আছে চারুর পাশে । চারুও কোন কথা বলছে না । আপন মনে নিজের মোবাইল টিপছে । মেয়েটার ভেতরে যে কিছু আছে সেটা আকিব টের পাচ্ছে ।

চারুলতা কালো রংয়ের একটা টিশার্ট পরে আছে । নিচে একটা সাদা রংয়ের লেগিংস । সম্ভবত রাতের পোশাক এটা পরেই সে ঘুমিয়েছিল । কেবল একটা ওড়না জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে । তারমনে কোন প্রকার বিকার নেই । যে কোন মেয়ের পক্ষেই রাতের বেলা এই রকম পুলিশের গাড়িতে করে কোথায় যাওয়ার সময় এতো স্বাভাবিক থাকা সম্ভব না । কিন্তু এই মেয়ে এমন ভাবে বসে আছে যেন এটা ওর কাছে ডাল ভাতের মত একটা ব্যাপার ।

আকিব খানিকটা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো, লতিফ স্যার তোমার খুব প্রশংসা করলেন ? কী এমন করেছিলে তুমি ?

মোবাইল থেকে চোখ না তুলেই চারু বলল, তেমন কিছুই না । আসলে লতিফ আঙ্কেল আমার গলার গান খুব পছন্দ করেছিলেন । আমাদের স্কুলের এক বার্ষিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে । সেখান থেকেই আমাকে চিনেন ।

আকিব খেয়াল করলো চারু তার প্রশ্নটা খানিকটা এড়িয়ে গেল । সে উত্তর দিতে চায় না । আকিবের মেজাজটা আরও একটু খারাপ হল । পুলিশ অফিসার হিসাবে আকিবের সুনাম আছে বেশ । তার তীক্ষ বুদ্ধির কারণে সে অনেক এগিয়ে গেছে সবার থেকে । কিন্তু সেই সাথে তার একটা বদনামও আছে। তার কথার জবাব না দিলে সে খুব জলদিই মেজাজ হারিয়ে ফেলে । এই কারণে ইন্টারোগেশন রুম্ম থেকে সে নিজেকে একটু দুরেই রাখে সব সময় ।  এছাড়া সব সময় নিজেকে সে একটু সুরিয়র মনে করে অন্য সবার থেকে । ভাবে সবাই তাকে মান্য করে চলবে । পুলিশের চাকরে প্রবেশের পরে এই অভ্যাসটা তার বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক মাত্রায় । তাই যখনই দেখে সামনের কেউ তাকে সমীহ করছে না, তখন তার উপর স্বভাবই বিরক্ত হয় সে । চারুর উপরে বিরক্তিটা তাই আসলো চট করেই ।

এটিওর অফিসে তারা প্রবেশ করলো আরও আধা ঘন্টা পরে । স্বয়ং লতিফুল রহমান গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল । চারুলতাকে দেখে হাসিমুখে বলল, অবশেষে আবার দেখা হল ?

চারু হাসলো কেবল । আর কোন জবাব দিলো না । লতিফুল রহমান তাকে নিয়ে সরাসরি ইন্টারোগেশন রুমের ওয়াচিং সেকশনে নিয়ে গেল । ইন্টারোগেশন রুমটা এই রুম থেকে দেখা যায় একটা কাঁচের মাধ্যমে । চারু দেখতে পেল এখানে একই সাথে দুইজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে । চারুর দিকে তাকিয়ে লতিফুল রহমান বলল, এই দুইজন হচ্ছে, বোমা বিশেষজ্ঞ । আই এস আই এর প্রোডাক্ট । মিডিলইস্টের প্রায় অর্ধেক বোমা হামলার পেছনে এদের হাত রয়েছে । আমাদের হাতে ধরা পরেছে গত পরশু । স্বভাবই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে যে তারা এখানে বোমা সেট করে চলে গেছে । এখন বোমার লোকেশন এরা কিছুতেই আমাদের বলছে না । আমরা কিছুতেই এদের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারি নি ।

চারু বলল, আপনি জানেন তো কী হতে পারে?

লতিফুল রহমান বলল, কিছু যায় আসে না । এ যদি পাগল হয়েও যায় এবং তার কারণে যদি হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচে তাহলে আমি যে কোন রিস্ক নিতে প্রস্তুত ।

-একটা মানুষের হয়ে অন্য মানুষ কিন্তু এই সিদ্ধন্ত নিতে পারে না । আপনি জানেন সেটা ?

-প্লিজ চারু । এতো গুলো মানুষের জীবনের প্রশ্ন !

আকিব অবাক হয়ে তার উর্ধ্বতন অফিসারের কন্ঠটা খেয়াল করলো । কিভাবে সামান্য একটা মেয়ের সামনে সে অনুনয় করছে । আকিবের মেজাজ টা আরও একটু খারাপ হল । এই পিচ্চি মেয়ের সামনে অনুরোধ করার কী আছে ! এক ধমক দিয়েই তো কাজ করানো যায় ।

চারু বলল, ওকে । একজনকে বের করে আনুন । ঐ যে লাল শার্ট পরা, ওনাকে বের করুন । আমি অন্য জনের সাথে কথা বলল। তবে এর দায়ভার আমার নয় । মনে থাকে যেন । এর পরে এই মানুষটার সকল দায়িত্ব আপনার ।

-হ্যা হ্যা আবশ্যই । তুমি কোন চিন্তা করবে না । সব কিছু আমি সামলাবো ।

সাথে আথেই লাল শার্ট পরা ইনিস্ত আবেদকে ঘর থেকে বের করা হল ঘরে রইলো তৈফিক জাফ্রি । আকিব দেখতে পেল চারু খুব স্বাভাবিক ভাবে দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো । এইবার আকিব একটু অবাকই হল । একটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীর সাথে একই ঘরে প্রবেশ করাটা খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার না । যে কোন মানুষ বিশেষ কম বয়সী কোন মেয়ের বেলাতে এই ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক । অথচ চারু এমন ভাবে ভেতরে ঢুকলো যেন এমন কাজ সে সব সময় করে । এই প্রথম চারু মেয়েটাকে একটু অন্য রকম মনে হল আকিবের কাছে ।

চারু টেবিলের ওপাশে রাখা চেয়ারে বসতেই জাফ্রি একতা বাজে মুখভঙ্গি করে হাসলো । চারু অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না । সে শান্ত হয়ে বসলো । তারপর নিজের চশমাটা খুলে রাখলো টেবিলের উপরে । এরপর সরাসরি তাকালো জাফ্রির দিকে । জাফ্রি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মাঝ পথেই থেমে গেল সে । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে । শরীর কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে । নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু হাত কড়ায় আটকে গেল সে । নিজেকে মুক্তি করতে চাইছে সে !

আকিব খুব অবাক হয়ে গেল । এই দুইদিনে জাফ্রির উপরে এমন কোন টেকনিক নেই যে প্রয়োগ করা হয় নি । কিন্তু তারা জাফ্রির কিছুই করতে পারে নি । অথচ এই মেয়েটার সামনে এ এমন আচরণ কেন করছে ? কী আছে মেয়েটার মাঝে ।

আকিব দেখতে পেল চারু একভাবে জাফ্রির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেবল । জাফ্রির চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে । সে এখন একেবারে স্থির হয়ে গেছে । একটুই নড়ছে না ।

চারু চোখ সরিয়ে নিল । সাথে সাথেই থপ করে জাফ্রি টেবিলের উপরে পড়ে গেল । চারু আবারও শান্ত ভাবে টেবিলের উপর থেকে চশমা টা নিয়ে পরলো । তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো । দরজার খুলে এরপর বের হয়ে এল । লতিফুর রহমানের সাথে সাথে আকিবও দ্রুত এগিয়ে গেল চারুর দিকে । চারুকে বসানো হল লতিফুল রহমানের অফিসে ।

-একটু পানি খাবো ।

লতিফুল রহমান নিজে পানি এগিয়ে দিল । এক ঢোকে পুরো পানি টুকু খেয়ে চারু কিছু সময় স্থির হয়ে বসলো । তারপর বলল, আপনাদের এই লোক জানে না বোম কোথায় সেট করা আছে ।

আকিব ফুস করে একটা শব্দ করলো কেবল । যাক একটু শান্তি পেল সে । মুখ দিয়ে একটা টিটকারি মারার মত কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগে লতিফুর রহমান বলল, অন্য জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে?

-সেও জানে না ।

আকিব বলল, তুমি কিভাবে জানো? মাইন্ড রিডিং করেছো তুমি ? নাকি সব জান্তা তুমি ?

চারু আকিবের দিকে একবার তাকালো । তারপর আবার তাকালো লতিফুর রহমানের দিকে । তারপর বলল, জাফ্রি বোমাটা বানিয়েছে সত্য । তবে সে জানে না সেটা কোথায় সেট করা হবে । এমন কি সে তার এম্লোয়ারের নাম পর্যন্ত জানে না । তাকে আগে টাকা পাঠানো হয়েছে । ইমেলে জানানো হয়েছে কীকী করতে হবে। সে এসেছে । বোমা বানিয়েছে তারপর বোমা হ্যান্ডওভার করে দিয়েছে ।

লতিফুর রহমান হতাশ হয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন । চারু বলল, তবে এখনও এই এম্লোয়ারের খোজ পাওয়া সম্ভব ।

লতিফুর রহমান মুখ তুলে তাকালো । বলল, সম্ভব?

-হ্যা । হত পরশুদিনের আগের দিন মানে যেদিন তারা ধরা পরে তার আগের দিন সন্ধ্যায় তারা বোমাটা হ্যান্ডওভার করেছে । এবং এটা জন্য তারা কোণ গোপন স্থান বেঁছে নেয় নি । বনানীর ওয়ায়ো রেস্টুরেন্টে এই বোমার ব্যাগটা সরবারহ করা হয়েছে । একেবারে খাওয়া দাওয়া করার সময়ে নিজেদের ব্যাগটা বদলে নিয়েছে । ওকে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে ব্যাগটা নিয়ে সে একটা টেবিলের নিচে রাখবে কিন্তু বসবে অন্য টেবিলে । সেই টেবিলের নিচেও একটা ব্যাগ থাকবে । পারিশ্রমিক । টেবিল দুটোই রিজার্ভ করা থাকবে । জাফ্রি লোকটার চেহারা না দেখলেও কেবল দেখেছে যে লোকটা ব্যাগ বদলেছে সে কালো স্যুট পরে ছিল । কেবল এইটুকু আমি জানি । আমরা ঐ রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেন তাহলেই আশা করি খুজে পাবেন ।

লতিফুর রহমান আকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, কুইক এখনই কাজে লেগে যাও ।

আকিব এতো সময় অবাক হয়ে চারুর কথা শুনছিল । কিছুই তার মাথায় ঢুকছিলো না । এই মেয়ে কিভাবে এসব বলছে ! লতিফুর রহমানের কথা শুনে তন্ময় ভাঙ্গলো । সে দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিলো তার আগে চারু আরও একটা কথা বলল, আপনাদের বোমা ডিফিউজ করতে একটা কোড লাগবে । কোণ ভাবেই কোন তার কেটে সেটা বন্ধ করা যাবে না । কোডটা হচ্ছে ৩৪৪২২০।

পরবর্তি দুইঘন্টার ভেতরে সত্যি সত্যি সেই কালো স্যুট পরা লোকের খোজ বের করে ফেলল ওরা । রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে । মালিককে ডেকে এনে সেটা খোলানো হল । সকল সিটিভিভি ফুটেজ চেক করে দেখা গেল সত্যিই ঐদিন সন্ধ্যায় জাফ্রি এই রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিল । তার হাতে কালো ব্যাগ ছিল । এবং কালো স্যূট পরা সেই লোকেরও খোজ পাওয়া গেল । তার হাতেও একই ধরনের কালো ব্যাগ । পার্কিং থেকে বের হওয়ার সময় তার গাড়ির নম্বরটা সিসিটিভিতে ধরা পরলো পরিস্কার । সেখান থেকে তাকে খুজেও বের করা গেল খুব জলদি ।

লোকটার নাম জাহিদ হাসান । সে এক বিদেশী এনজিওর সাথে যুক্ত । তাকেও সেই একই রুমে নিয়ে আসা হল । আকিব তখন লতিফুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার এর গায়ে এতো সহজে হাত দেওয়া যাবে না । আর আমরা যেটার বেসিসে একে ধরে নিয়ে আসলাম সেটাও কিন্তু ধোপে টিকবে না । মানে কোন ভাবেই কিন্তু জাফ্রির সাথে এই লোকের দেখা হয়েছে কিংবা পরিচয় হয়েছে এমন কি একটা শব্দ আদান প্রদান হয়েছে এমন কোন ফুটেজ সিসিটিভিতে নেই । রেস্টুরেন্টে আরও কত লোক ছিল । কেবল এক রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়ার জন্য তো একে টর্চার করা যাবে না । পরে যদি আমরা কিছু প্রমাণ না করতে পারি তাহলে আমার কিন্তু খবর আছে।

লতিফুল রহমান বলল, তাহলে এখন উপায়?

আকিব কী যেন ভাবলো । তারপর বলল, স্যার একটা উপায় আছে কিন্তু ।

-কী?

-চারু !

লতিফুল রহমান বলল, মেয়েটা রাজি হবে না । তুমি জানো এর আগে এই মেয়েটাকে আমি একবার ব্যবহার করেছিলাম, আরও ভাল করে বললে মেয়েটাই আমাদের সাহায্য করেছিল নিজ থেকে । ওদের স্কুলের দপ্তরি দুইটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল । দপ্তরি ধরতেও পারলেও মেয়ে দুইটাকে আমরা কিছুতেই খুজে পাচ্ছিলাম না। তখন এই চারুই আমাদের সাহায্য করে । কিন্তু তারপর ঐ দপ্তরি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় নি । ওর মস্তিস্ক একেবারে উলট পালট হয়ে গিয়েছিল । এই যে জাফ্রি তোমার কি মনে হয় এ আর কোণ দিন সুস্থ হবে? কোন দিন হবে না ।

আকিব বলল, বুঝতে পারছি । আমরা সেটা করবো না । কেবল ভয় দেখাবো ।

-কাজ হবে?

-হতেও পারে । চলুন ট্রাই করা যাক !

আকিব আর লতিফুল রহমান যখন ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকলো তখ জাহিদ হাসান শান্ত ভাবে বসে আছে । একটু আগে তৈফিক জাফ্রি যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে আছে জাহিদ হাসান । তবে তার হাতে কোন হ্যান্ডকাফ পরানো নেই । ওরা ভেতরে ঢুকতেই জাহিদ হাসান বলল, আপনারা আমাকে কেন আটকে রেখেছেন ? আমি কি করেছি ? আমি আমার লয়ারের সাথে কথা বলব ।

আকিব একবার লতিফুর রহমানের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভেতরে কিছু বোঝপড়া করে নিল । তারপর জাহিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, আমরা জানি আপনি তৈফিক জাফ্রিকে দিয়ে বোমাটা বানিয়ে নিয়েছেন । তবে আপনার জন্য সুসংবাদ হচ্ছে আমরা সেটা কোন ভাবেই প্রমান করতে পারবো না যে আপনি জাফ্রির সাথে মিলিত ছিলেন । এমন কি জাফ্রি নিজেও আপনাকে চিনে না । অবশ্য ওর এখন যা অবস্থা ও কাউকেই চিনবে না আর !

জাহিদ হাসান এবার আরও একটু সোজা হয়ে বসলো ।। তারপর বলল, আমাকে আপনারা কেন ধরে এনেছেন ? আমাকে যেতে দিন !

-যেতে দিবো মিস্টার জাহিদ হাসান । আমরা কেবল জানতে চাই বোমার লোকেশন টা কোথায়?

-দেখুন আপনারা যা বলছেন তার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না ।

আকিব এবার একটু হাসলো । তারপর বলল, আপনাকে আমরা একতা সুযোগ দিতে চাই । তাই জানতে চাইছি । নয়তো আমাদের কাছে অন্য উপায় আছে ।

-আমাকে টর্চার করবেন? মারবেন ?

-হা হা হা ! কী যে বলেন না ! যাই হোক আমি বরং আপনাকে একটা ভিডিও দেখাই । সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন । আমাকে কিছুই বলতে হবে না !

সাথে করে আনা ল্যাপটপ টা স্ক্রিন জাহিদ হাসানের দিকে ঘুরিয়ে দিলো । একটু আগে চারু ও তৈফিক জাফ্রির ভিডিওটা চালু হল । সেটার দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাহিদ হাসান ।

ভিডিও শেষ হতে এবার আকিব আবার বলল, ভাববেন না যে এটা কোণ বানানো ভিডিও । তার প্রমান আপনি নিজেই । জাফ্রি আপনার কথা জানেই না । তারপরেও আপনি এখানে । কিভাবে জানেন? কারণ হচ্ছে এই মেয়েটা । এই মেয়েটা একটা সাইকিক । সে চাইলেই যে কারো মস্তিস্কের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে । জাফ্রির ভেতরেও সে ঢুকেছিল । সেই তার মনের ভেতরে থাকা সকল তথ্য বের করে এনেছে । এই যেমন জাফ্রিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যে ব্যাগ নিয়ে সে রেস্টুরেন্টে যাবে একটা নির্দিষ্ট টেবিলের নিচে রেখে অন্য টেবিলে বসবে। সেই টেবিলের নিচে আগে থেকেই একটা কালো ব্যাগ থাকবে । তাই না ? দুজন দুটো টেবিলে স্বাভাবিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করে চলে আসবে । কেউ কাউকে চিনবে না, দেখবে না । কিন্তু তারপরেও দেখুন আপনি এখানে চলে এসেছেন । এখন কী হবে শুনুন । আমি ঐ মেয়েটাকে একটু পরেই এই ঘরে নিয়ে আসবো । সে আপনার মস্তিস্ক থেকেই বোমাটা আপনি কোথায় রেখেছেন সেটা বের করে নিয়ে আসবে । এমন কি জাফ্রির মাথা থেকে আমরা বোমা ডিফিউজের কোডটাও বের করেছি ।

আকিব তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলো । আকিব এরপর মুখ দিয়ে কোডটা বলতেই জাহিদ হাসানের চেহারায় একটা পরিবর্তন আসলো । আকিব যেন এটাই দেখতে চাইছিল । আকিব আবার বলল, এতো কিছু আপনাকে বলার আসলে কোন দরকার ছিল না । কেবল চারুলতা মানে মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এলেই হত কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে চারু একবার যার মাথার ভেতরে ঢোকে সে মস্তিস্ত একেবারে উলট পাল্ট হয়ে যায় । স্কুলে থাকতে সে এমন ভাবেই একবার পুলিশ সাহায্য করেছিল । সেই লোক প্রায় আট বছর কোমাতে ছিল । কোমা থেকে জেগেও তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি । এই জাফ্রির অবস্থা তো নিজ চোখে দেখলেন । আপনার পাশের রুমেই সে শুয়ে আছে । চোখ খোলা । তার মস্তিস্ক আর কোন দিন ঠিক হবে না । আপনাকে এই যুযোগ দিলাম । এখন এতা গ্রহন করা না করা আপনার ব্যাপার ।

এরপর লতিফুর রহমানের দিকে তাকাল আকিব। তারপর বলল, স্যার তাহলে চারুকে ডাক দিই । ইনি যখন বলবেন না তখন তো আর কোন পথ খোলা নেই । তারপর কাঁচের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো । কিছু সময় পরে দরজা খুলে গেল । জাহিদ হাসান চারুকে দেখতে পেল । চশমা পরা চারুকে দেখেই একতীব্র আতঙ্ক জমা হল তার চেহারায় । কিন্তু চারু এক পা ঘরে ঢোকালো তখনই জাহিদ হাসান চিৎকার করে বলল, খবরদার আমার কাছে আসবে । ওকে নিয়ে যান নিয়ে যান ! আমি বলছি । সব বলছি ।

পরিশিষ্টঃ

চারুকে আবার যখন আকিব হলের সামনে নামিয়ে দিল তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। আকিব নিজেও নেমে এল । গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে তখনই আকিব বলল, থ্যাঙ্কিউ ফর ইরোর হেল্প ।

-আমার কারণে একটা লোক কোমাতে গিয়েছে । এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই ।

-তুমি না থাকলে কত গুলো মানুষ মারা পড়তো সেই হিসাবটা দেখছো না?

-তবুও ! এই অপরাধের বোঝা আমার বইতে ভাল লাগে না ।

-তোমার মত আমি হলে, জগতে সকল ক্রিমিনাল গুলোকে এমন ভাবে সোজা করে দিতাম ।

চারু হাসল। তারপর বলল, এই কারণেই হয়তো নেই আপনার কাছে এমন কিছু । আসি । ভাল থাকবেন আর দয়া করে এই কাজের জন্য আর আমাকে ডাকাবেন না ।

আকিব বলল, চেষ্টা করবো । তবে কথা দিতে পারছি না ।  ভাল থেকো আর সাবধানে থেকো ।

চারু গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুটা সময় । আকিবকে গাড়িতে করে চলে যেতে দেখলো । চারুর কেন জানি মনে হল আবারও ওদের দেখা হবে খুব জলদি ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 41

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →