গতমাসে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে DAHMER – Monster: The Jeffrey Dahmer Story লিমিটেড সিরিজ । সিরিজটার সব থেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে সিরিজের কাহিনীটা বাস্তব ঘটনা থেকে নেওয়া হয়েছে । একেবারে শতভাগ না হলেও সিরিজটার প্রায় সব টুকুই বাস্তব ঘটনার পরিপেক্ষিতে বানানো । সিরিজটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হলেও কিছু ফ্যাক্ট দেখানো হয়েছে যেগুলো বাস্তবে ঘটে নি । মুভি সিরিজ গুলোতে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক । সিরিজট মুক্তি পাওয়ার পররপই টপ চার্টে চলে আসে । সেই সাথে ক্রিটিসিজমও হয় প্রচুর । বিশেষ করে ফিকশন পার্টটার জন্য । আজকে মানে অক্টোবরের ৭ তারিখে, নেটফ্লিক্স তিন পর্বের আরও একটা সিরিজ রিলিজ করে । এটা পুরোপুরি ভাবেই ডকুমেন্টারি সিরিজ । ঐ সময়ে আসলেই কী হয়েছিলো সেটার উপরে ভিত্তি করে ।
১৯৭৮ সাথে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জেফরি ডাহমার মোট ১৭ টা খুন করে । সেই কাহিনী নিয়েই এই সিরিজটা । এই সিরিজে দেখানো হয়েছে ডাহমার কিভাবে ছোট থেকে বড় হয়েছে, কেমন ছিল তার জীবন, কিভাবে সে প্রথম খুন করেছে, সেই প্রথম খুনের বডিটার সাথে সে কী করেছে কিভাবে সেটা ডাম্প করে, তারপর একের পর এক খুন করেই গিয়েছে । এবং খুন করে যাওয়ার পরেও কেন আর কিভাবে সবার নাকের ডগায় চুপচাপ থাকতে পেরেছে । সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপারটা হচ্ছে সে কিভাবে তার ভিক্টিমকে হত্যা করার পরে তাদের দেহের কিছুটা অংশ খেয়েও ফেলেছে । সে তার ভিক্টিকদেরকে নিজের এপার্টমেন্টে ডেকে নিয়ে আসতো । মূলত তাদের সাথে সেক্স করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে নিয়ে আসতো । কাউকে আবার ফটোগ্রাফির কথা বলে ডেকে নিয়ে আসতো অথবা কেবল আড্ডা ড্রিংক করার কথা বলে নিয়ে আসতো। তাদেরকে ড্রিংক অফার করতো । সেই ড্রিংকে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়ে তাদের অজ্ঞান করে, তাদের খুন করতো । তারপর তাদের সাথে তারপর খুন হওয়ার বডির বিভিন্ন অংশ আলাদা করতো। ছোট ছোট অংশ কেটে এসিডে জ্বাল দিয়ে সে ড্রেনে ফ্লাশ করে দিতো আবার ভিক্টিমের বিশেষ কিছু অংশ রান্না করে খেয়েও ফেলতো । এভাবেই সে ১৩ বছর ধরে ১৭ জনকে খুন করেছে ।
সিরিজটা দেখে শেষ করার পরে নেটে সার্চ দিলাম এই ব্যাপারে আরও জানার জন্য । উইকপিডিয়াতেই তার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্তটা বেশ ভাল করেই তুলে দেওয়া হয়েছে । উইকি তথ্য।
ডাহমারের ছোট বেলাটা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না । তার বাবা নিজের কাজ নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকতো । ডাহমারের মা কিংবা পরিবারকে সময় দেওয়ার মত যথেষ্ঠ সময় তার ছিল না । বাসায় প্রতি নিয়ত বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে জেফরি বড় হয়েছে । তাই বেশির ভাগ সময়েই সে আলাদা নিজের ভেতরেই থাকতো । এছাড়া তার মায়ের সকল মনযোগ ছিল তার ছোট ভাইয়ের প্রতি। সে মূলত বেশির ভাগ সময়েই আইসোলেটেড অবস্থায় থাকতো । ছোট বেলা থেকেই মৃত প্রাণীর প্রতি ডাহমারের একটা আকর্ষণ ছিল । সে সেই দেহ গুলো কেটে কুটে দেখতো । এই কাটাকুটির প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল । তার বাবা এই কাজে তাকে সাহায্য করতো ।
১৭ বছর বয়সে ডাহমারের বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় । একদিন বাসায় এসে দেখে তার মা ছোট ভাইকে নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছে । আর এই দিকে তার বাবা অনেক দিন ধরেই নতুন প্রেমিকা/প্রিয়ন্সে সাথে মোটেলে থাকছে । পুরো বাসায় জেফরি তখন একা । এই একা থাকার ব্যাপারটাই এই সিরিয়াল কিলার হওয়ার ব্যাপারে একটা সহায়ক ভুমিকা রাখে । তখন তাকে দেখে রাখার কেউ নেই । পুরো বাসায় সে একা । যা ইচ্ছে তাই করতে পারে । এই সময়ে সে ড্রিংক করা শুরু করে । নিজের বাসাতেই সে প্রথম খুনটা করে । গ্রাজুয়েশন শেষ করে একজন হিচহাইকাকে (স্টেফেন হিচক) লিফট দেওয়ার অযুহাতে নিজের বাসায় নিয়ে আসে । সেখানে বসে দুজন গল্প করে ড্রিংক করে । এক সময়ে যখন সেই হিচহাইকার চলে যেতে চায় তখন ডামার নিজের ডাম্বেল দিয়ে তাকে আঘাত করে মেরে ফেলে । এটাই ছিল তার প্রথম খুন । সময়টা ছিল ১৯৭৮ সালের ১৮ই জুন। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ ।
খুনটা যে ইচ্ছেকৃত ছিল নাকি অন্য কোন কারণে হয়েছিলো সেটা নিশ্চিত না । তবে ডাহমার চেয়েছিলো যাতে স্টেফেন হিচক তাকে ছেড়ে না যায় । সে হিচককে নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলো । পরে সেই লাশ নিয়ে সে বিপাকে পড়ে ! কি করবে না করবে প্রথমে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না । এটাই ছিল তার প্রথম খুন । প্রথমে বেজমেন্টে সে বডিটা বিছিন্ন করে । পরে পেছনের ব্যাকইয়ার্ডে সেই বডির বিভিন্ন পার্ট পুতে রাখে । বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে সেই বডিপার্ট গুলো আবার মাটি থেকে তুলে নিয়ে আসে এবং ছুরি দিয়ে মাংস আর হাড় আলাদা করে । মাংশ গুলো এসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলে । আর হাত গুলো চুর্ণ করে পেছনের মাঠে ছড়িয়ে দেয় । এটাই মূলত ছিল তার প্রথম খুনের দাফন কাজ !
এর কিছুদিন পরে ডাহমারের বাবা বাসায় ফিরে আসে । সাথে ছিল ডাহমারের নতুন সৎমা । জেফরির বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন । তবে ড্রিংকিংয়ের অভ্যাস ততদিনে তাকে পেয়ে বসেছে । তাকে কলেজ থেকে এক্সপেল করা হয় । এরপর সে মিলিটারিতে ভর্তি হয় । সেখানেও একই কারণে এক বছরের মাথায় তাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয় । বাসায় আসার পরে বাবা এবং সৎ মায়ের সাথে কিছুদিন থাকার পরে সে চলে যায় তার দাদীর সাথে থাকতে । সেখানেও তার হেভি ড্রিংকিং ও পাবলিক নুইসেন্সের জন্য বদনাম রটে যায় । মূলত এখান থেকেই তার খুনের যাত্রা আবার শুরু হয় । সে সমকামী ছিল । গে বার কিংবা বাথ হাউজে যাওয়া আশা করতো ।তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তার জন্য সকল গে বার কিংবা বাথ হাউজ গুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায় । কারণ সে সেখানে ড্রাগ নিয়ে যেত । তারপর মানুষকে অজ্ঞান করিয়ে তাদের সাথে সেক্স করতে চাইতো ! এই রকম বাথ হাউজ গুলো ব্যান হয়ে যাওয়ার পরে সে হোটেলে যাওয়া শুরু করে ।
একবার হোটেলে তার এক গে পার্টনারকে নিয়ে যাওয়ার রাত কাটায় । রাত ভর তারা ড্রিং করে । পরে সকালে উঠে দেখে তার সেই পার্টনাম মরে পরে আছে । নেশার ঘোরে সে কিভাবে তার পার্টনারকে মেরেছে সেটা তার মনেই নেই । বড় সুটকেসে করে সেই লাশটা ভরে নিয়ে আসে হোটেলের বাইরে ।
দাদীর বাসা থাকায় অবস্থায়ও সে তার গে পার্টনারদের বাসায় নিয়ে আসা করে এবং দাদীর চোখের আড়ালে তাদের খুন করে । তবে এদের ভেতরে একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । কিন্তু সে নিগ্রো ব্লাক হওয়ার কারণে পুলিশ তাকে ঠিক বিশ্বাস করে না । পরে একজন এসিয়ান ছেলের সাথে একই কাজ করতে গেলে সেও পালিয়ে যায় । ডানামের নামে কেস হয় ১৩ বছরের এক এশিয়ান ছেলেকে ড্রাগড দেওয়া এবং সেক্সুয়ালি এবিউজ করার কারণে।
জেল থেকে ফিরে এসে কিছুদিন দাদীর কাছে থেকে, তারপর সে ৯২৪ নর্থ ২৫ স্ট্রিট বিল্ডিংএর ২১৩ নম্বর এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে থাকা শুরু করে । এবং এখানেই তার বাকি খুন গুলো করে । ভিক্টিমকে নিয়ে এসে প্রথমে তাদের ড্রাগ দিয়ে অচেতন করে ফেলতো । তারপর তাদের হত্যা করতো । তারপর মৃতদেহের সাথে সেক্স করতো সে । এরপরে তাদের বিভিন্ন অংশ কেটে আলাদা করতো । কিছু অংশ এসিড দিয়ে কিংবা আগুনে জ্বাল দিয়ে গলিয়ে ফ্লাশ করে ফেলে দিতো, কিছু জমা করে রাখতো ফ্রিজে, কিছু রান্না করে খেয়ে ফেলতো । এভাবে একের পর এক হত্যা করে গেছে সে । সর্ব শেষ ভিক্টিমকে হত্যা করার সময়ে ভিক্টিম পালিয়ে যায় । এবং পুলিশ কে যখন নিয়ে আসে তখন পুলিশ ঘর সার্চ করে মৃত দেহের বিভিন্ন অংশ খুজে পায় ! ফ্রিজের ভেতরে বেশ কয়েকটা কাটা মাথা খুজে পায় ।
ট্রায়ালের সময় ডাহমারের বাবা এইটা প্রমানের চেষ্টা করে যে তার ছেলে মানসিক ভাবে অসুস্থ তবে সেটা কাজে দেয় নি । সন্দেহয়াতীত ভাবে সে অপরাধী হিসাবে প্রমানিত হয় । মোট ৯৯৯ বছর জেল হয় তার । তবে তার জেলে থাকা অবস্থায় একজন কয়েদী ডাহমারকে পিটিয়ে খুন করে । ১৯৯৪ সালের ২৮শে নভেম্বর এই নরখাদকের জীবনের অবসান ঘটে ।
সিরিজ কিংবা বাস্তবে দেওয়া ইন্টারভিউ গুলোতে একটা ব্যাপার দেখে অবাক হয়েছি যে ডামার কোন সময় উত্তেজিত হয় নি । এমন কি সে খুন গুলো যে করেছে সেই ব্যাপারেও বিন্দু মাত্র অস্বীকারও করে নি । সব কিছু এমন ভাবে স্বীকার করেছে যেন সে খুনের কথা স্বীকার করছে না, ছেলে বেলার স্মৃতি কথা বলছে । তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে মনে হল তা হচ্ছে জেফরি ডাহমারের এই সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার পেছনে তার বাবা আর মাকে অবশ্যই দায়ী করা হয় । যদি ডিভোর্সের পরে তার মা যখন জেফরিকে একা রেখে চলে গেল, যদি সেটা না করতো, কিংবা সেই সময়ে তার বাবা যদি মোটেলে না থেকে নিজের বাসায় থাকতো তাহলে কী সে সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠতো ? আমার কেন জানি মনে হয় উঠতো না !
একজন মানুষের সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে । বিশেষ একটা কারণ হচ্ছে কোন বিশেষ শ্রেনী পেশার মানুষের প্রতি ঘৃণা । তবে ডাহমারের বেলাতে সেই ব্যাপারটা মোটেও হয় নি । সে মানুষ গুলোকে খুন করেছে কারণ হিসাবে সে বলেছে যে সে তাদেরকে নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছিলো । কেউ যাতে তাকে ছেড়ে না যেতে পারে ।ছোট বেলা থেকেই দেখা গেছে প্রবল ভাবে সে তার মা আর বাবার কাছ থেকে উপেক্ষিত । তারপর যখন সে নিজেই বুঝতে পারলো সে সমকামী তখন এটাকে অস্বাভাবিক ধরে নিজেই অন্য সবার থেকে দুরে থাকা শুরু করে । এই উপেক্ষা উপেক্ষিত এটাই মূলত তাকে ড্রাইভ করেছে এই মানুষ গুলোকে নিজের কাছে রাখার জন্য ।
নেট ফ্লিক্সের এডাপশনটা দেখতে পারেন পুরো কাহিনীটা ভাল করে বুঝতে । তারপরে ডকিউমেন্টারিটাও দেখতে পারেন আসল পুরো ঘটনা জানতে । সিরিজ দুটো দেখার পরে ইউটিউবে বেশ কিছু ভিডিও পাবেন । তিনটা ভিডিওর লিংক যুক্ত করে দিলাম এগুলো দেখলে আশা করি ব্যাাপরটা আরও পরিস্কার হবে আপনাদের কাছে।
এছাড়া এই সিরিয়াল কিলিং নিয়ে আরও অনেক ডকিউমেন্টারি, মুভি, সিরিজ, বই এবং টিভি শো বের হয়েছে । সেগুলোর কয়েকটা দেখে ফেলতে পারেন ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.