অফিস থেকে আমাকে কাজের কারণে কোথাও পাঠাতে চাইলে আমি সাধারণত একা যাওয়ার জন্য শর্ত দিয়ে থাকি । এমন কি কাজটা দুই তিনজনের হলেও সেটা একাই সামলে নিই সব সময় । এই কারণে আমার এই শর্ত প্রায় সব সময়ই মেনে নেওয়া হয় । তবে এইবার তার ব্যতিক্রম ঘটলো । আমাকে আরও একজনের সাথে স্কটল্যান্ডে আসতে হল । এবং সেই একজন টা হচ্ছে সারাহ । অফিসের এই মেয়েটাকে সবাই একটু এড়িয়ে চলে । সারাহ মানুষ হিসাবে ভাল তবে একটু বেশিই গুরুগম্ভীর । মানুষের সাথে ঠিক মিশতে পারে না কিংবা ইচ্ছে করেই মিশে না । দেখতে শুননে বেশ চমৎকার হলেও এই সবাইকে এড়িয়ে চলার জন্য অফিসে তাকে সবাই খুব একটা পছন্দ করে না । অবশ্য তাতে সারাহর খুব একটা যে কিছু যায় আসে সেটাও না । কিন্তু এই মেয়ের সাথে বস কেন আমাকে স্কটল্যান্ড পাঠানোর বুদ্ধি করলো আমার জানা নেই ।
বসের কেবিনে গিয়ে নক দিতেই বস বলল যে কাজ দুইদিনের ভেতরে শেষ করতে হবে । স্কটল্যান্ডের দিকটা সারাহ একাই সব সময় সামলায় তবে এইবার ওর সাহায্য লাগবে । এই জন্য আমাকে যেতে হবে । আমি বলতেই যাচ্ছিলাম অন্য কাউকে পাঠান কিন্তু তার আগেই বস বলল কাজ শেষ করে দুইদিন ওখানেই থাকতে পারো । কোম্পানীর গেস্ট হাউজেই তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সুতরাং থাকা খাওয়ার খরচটা বেঁচে যাবে ।
বস আসলে ঠিক ঠিক জানে যে কাকে কিভাবে কোন কথা দিয়ে রাজি করাতে হয় । আমার দুর্বলাতার কথা সে ভাল করে জানে । কাজের পরে একটু ঘোরাঘুরি না করলে আমার চলে না । আর সেটা যদি কোম্পানীর টাকায় হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই । আমি আর কথা বাড়ালাম না ।
স্কটল্যান্ডে আমাদের কোম্পানীর গেস্টহাউজটা বেশ চমৎকায় জায়গাতে । শহর ছেড়ে একটু দূরে আমাদের কোম্পানীর ফ্যাক্টারী সাথে অফিস । সেখানেই মূলত আমাদের কাজ । ফ্যাক্টারী থেকে আরু মাইল পাঁচেক ভেতরে এই গেস্টহাউজ । এই গেস্ট হাউজটা সম্প্রতি কেনা হয়েছে । হেড অফিস থেকে প্রায়ই এখানে আসা হয় অডিটের কাজে । আমি নিজেও আগে এসেছি । তখন শহরের হোটেলেই উঠেছিলাম । তারপর কোম্পানী ঠিক করলো যে যেহেতু নিয়মিতই আসা যাওয়া লাগে, প্রতিবার হোটেল খরচ না দিয়ে একবারে একটা গেস্ট হাউজে কিনে নেওয়া যাক । তাই করা হল । মাস ছয়েক আগে এই গেস্ট হাউজ কেনা হয়েছে । দেখা শুনার জন্য একজন কেয়ারটেকার কাম রাধুনী রাখা হয়েছে ।
প্রথম দুটোদিন যে কিভাবে চলে গেল আমি আর সারাহ কেউ টের পেলাম না । বস আসলে ঠিকই বলেছিল । এই কাজ সারাহ কিংবা আমি যদি একা করতে যেতাম আমাদের দুইজনের খবর ঘোলা হয়ে যেত । আর সারাহকে আমি আসলে যেমন ভেবেছিলাম, এই অফিসের বাইরে এসে ওকে কেন জানি তেমন মোটেই মনে হচ্ছে না । বরং প্রানবন্ত, মিশুক আর হাসিখুশি মনে হচ্ছে । মেয়েটা যেন হঠাৎ করে নিজেকে মেলে ধরছে ।
কাজের চাপ একটু কমে এলে পরদিন সন্ধ্যায় গেস্ট হাউজের বারান্দায় দুজন বসে কফি খেতে খেতে গল্প করতে শুরু করলাম । এই দুইদিনে আমাদের দুইজনের অফিস র ফ্যাক্টরি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত । শরীর থাকতো ক্লান্ত । কোন মতে খেয়েই বিছানাতে শুয়ে পড়তাম । গল্প গুজবের ইচ্ছে থাকতো না । কিন্তু আজকে একটু আগে আগেই ফিরেছি। ফ্রেশ হয়েছে বসলাম বারান্দায়। কেয়ারটেকার কফি নিয়ে এল । সেটাতে চুমুক দিতে দিতে গল্প করতে শুরু করলাম ।
আমরা দুজনেই বারান্দায় পেতে রাখা আরামদায়ক চেয়ারে বসেছি । বাইরে একটি ঠান্ডা পরেছে । তবে এই বারান্দায় বসে থাকতে আমাদের কারোরই খারাপ লাগছে না । অফিসের এই গেস্ট হাউজটা দুই তলা । আমরা দুইতলার বারান্দাতে বসে আছি । বারান্দাটা গেস্ট হাউজের পেছনের দিকে । মেইন বিল্ডিংয়ের পরেই একটু খোলা জায়গা । তারপর নিচু একটা দেওয়াল দিয়ে গেস্ট হাউজের সীমানা দেওয়া হয়েছে । দেওয়ালের ওপাশ থেকে গাছ পালা শুরু হয়েছে । সেটা ক্রমেই ঘন হয়েছে । তারপর ঘন বন। পেছনের দিকটা একেবারে আলোকিত হয়ে আছে । একটা ফ্লাডলাইটের মত উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে । তার কারণে পেছনের উঠান, দেওয়াল আর তারপরের জঙ্গল একেবারে আলোকিত হয়ে আছে । এতো আলো জ্বালিয়ে রাখার কারণ ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না । দুইদিন ধরে আছি, এই আলো খেয়াল করেছি । আমি আলোর দিক থেকে মনযোগ সরিয়ে সারাহর দিকে মনযোগ দিলাম ।
সারাহর সাথে আমি কাজ করছি প্রায় দুই বছরের উপরে । কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে ওর সম্পর্কে আমি বলতে গেলে কিছুই জানি না । তবে তার থেকেও অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে সারাহকে দেখলাম আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলে দিতে । বিশেষ করে আমি কী পছন্দ করি না করি, কোথায় যাই না যাই এইসব । হঠাৎ করেই সারাহ বলল, টামিম তোমাকে এই ভিজিটে আমি পাঠাতে বস কে অনুরোধ করেছিলাম ।
সারাহ আমার তামীম নাম টা ঠিক উচ্চারণ করতে পারে না । ত এর স্থানে ট বলে । সব বিদেশীর বেলাতেই এই ব্যাপারটা হয় । আমি সারার মুখে এই কথা শুনে এবার সত্যিই অবাক হলাম । বলল, তুমি বলেছিলে?
-হ্যা । স্যার ক্রিসকে পাঠাতে চাইছিল আমার কাছে । কিন্তু আমার ক্রিসকে পছন্দ না ।
সারাহ একটু হাসলো । আমি ওর হাসিতে একটু যেন লজ্জা মিশ্রিত আভা দেখতে পেলাম । তবে আমার কাছে ব্যাপারটা নতুন ছিল । আমি কোন কালেই আশা করি নি যে সারাহ এই রকম ভাবে আমাকে আলাদা ভাবে আসতে বলবে সেটা আমি ভাবতে পারি নি । আর বলল যে ক্রিসকে ওর পছন্দ না । তার মানে কি আমাকে পছন্দ ?
ঐ সব দিকে যাওয়া ঠিক হবে না । ভাবাও ঠিক হবে না । আমি খানিকটা অস্বস্থি নিয়েই কফির কাপে চুমুক দিতে শুরু করলাম । তখন সারাহ আবারও বলতে শুরু করলো, আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন আমার বাবা আর মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় !
এই কথাটা অবশ্য আমি জানতাম । আমার তখন মনেই মনে হয়েছিল যে সারার বাবা মা আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণেই বুঝি ওর ছোটবেলাটা ঠিক সুখের হয় নি । এই কারণেই হয়তো ও সবাইকে এড়িয়ে চলে । এতো গম্ভীর থাকে । সারাহ আবার বলা শুরু করলো, প্রথমে আমি আমার মায়ের আথেই থাকা শুরু করি । কিছু দিনের ভেতরেই মা নতুন করে আবার বিয়ে করে । আমি মায়ের সাথে নতুন বাবার বাসায় উঠে পড়ি । নতুন স্কুলে ভর্তি হই । সব কিছু ঠিকই চলছিল কিন্তু তারপরই প্রথ ধাক্কাটা খাই । যদিও প্রথম থেকেই ব্যাপারটা আমার মনের এক কোনে খোঁচা দিচ্ছিলো । তুমি জানো মেয়েরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে কোন পুরুশ তাদের দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকায় । এটা মেয়েদের একটা সহজাত ক্ষমতা বলতে পারো । আমি আমার নতুন বাবার আমার দিকে তাকানোর ধরণটা নিয়ে একটু অস্বস্থিতে পড়লেও সেটা আসলে আমলে নিতাম না । কিন্তু একদিন সেই ফল পেলাম । বাসায় একা পেয়ে সে আমাকে চেপে ধরলো ।
আমি ধাক্কার মত খেয়াল কথাটা শুনে । দেখলাম সারাহ চোখে পানির বিন্দু কেমন চিকচিক করছে । সারাহ আবারও বলল, সেদিন কিভাবে কপাল গুণে রক্ষা পেয়েছিলাম । হাতের কাছে একটা পেপার ওয়েট ছিল । বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম । একটা বড় পেপার ওয়েট ছিল বইয়ের উপরে । সেটা দিয়েই মাথায় আঘাত করেছিলাম । তারপর দৌড়ে পালিয়েছিলাম ঘর থেকে । কাছেই আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড থাকতো সেখানে গিয়ে হাজির হলাম । পুরো দিনই সেখানে ছিলাম । রাতে মা বাসায় ফিরলে মা আসে আমাকে নিতে । তাকে সব টুকু খুলে বললাম । মুখ বুঝে শুনলো কেবল । কিছু বলল না । পরের দিন আমি আমার বাবার কাছে চলে এলাম । তারপর থেকে সেখানেই বড় হয়েছি ।
সারাহ বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলো । আমি সত্যিই ধাক্কার মত খেয়েছি । চুপচাপ থাকা এই মেয়েটার কাছ থেকে সব সময় আমি দুরেই থেকেছি । কাজ ছাড়া কখনই কাছে যাই নি । তবে কোন দিন ভাবতেও পারি নি যে এই মেয়েটার মনে এই জিনিস নিয়ে সে বড় হয়েছে । নিজের সৎ বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই আচরণ যে কোন মেয়ের পুরো জীবনটা উলট পালট করে দিতে পারে এক নিমিষেই ।
সারাহ আবার বলল, তারপর থেকে আমি প্রায় পুরুষের চোখে এই দৃষ্টি দেখতে পেতাম । তোমরা তো ভাবি আমি আসলে মানুষের সাথে মিশি না । আমার এই না মেশার মূলে রয়েছে পুরুষের এই দৃষ্টি । আমি খুব ভাল করে চিনি কোন পুরুষ আমার দিকে কোন চোখে তাকায় !
এরপরেই সারাহ আসল বোমা ফাটালো । বলল, কেবল তুমি বাদ দিয়ে !
আমি চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে । সারাহ একেবারে আমার চোখে চোখ দিয়ে গভীর চোখে তাকিয়ে রয়েছে । চোখ না সরিয়েই সারাহ বলল, আমি যতবার তোমার চোখের দিকে তাকিয়েছি ততবার মনে হয়েছে যে অন্য সব পুরুষ থেকে তুমি আলাদা । এখনও তাই মনে হয়। এই কথাটা হয়তো কোন দিন অফিসের ঐ পরিবেশে তোমাকে বলতে পারতাম না ।
আমি সত্যিই একটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি সারাহর দিকে । সারাহর কাছ থেকে এমন কিছু শুনতে পাবো বলে আশা করি নি কোন দিন । আমার এখন কেমন অনুভব করা উচিৎ কিংবা কী বলা উচিৎ আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না । আমি কিছু বলতে যাবো তখন পুরো গেস হাউজ অন্ধকার হয়ে গেল ।
পাওয়ার কাট হয়েছে !
আমরা অন্ধকারের ভেতরেই বসে থাকতাম কিছু সময় । মনে হল যে এখনই বিদ্যুৎ চলে আসবে নয়তো জেনারেটর চালু হবে । তবে দেখলাম দুটির একটাও হল না । অবশ্য খুব যে খারাপ লাগছিলো সেটাও না । বিশেষ করে অন্ধকারের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভাল লাগছে । আমরা দুজন কিছু সময় সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম ।
এক সময় হঠাৎ সারাহ খানিকটা চিৎকার করেই বলে উঠলো, ওটা কি?
চিৎকার শুনে আমি সেদিকে তাকালাম । বারান্দা থেকে নিচে দেওয়ার ঠিক ওপাশেই । অন্ধকারের ভেতরে অনেক সময় থাকার কারণে আমাদের দুজনের চোখেই অন্ধকার সয়ে এসেছে । সেই অন্ধকারের ভেতরেই জিনিসটা সারাহর চোখে পড়েছে । আমিও সেদিকে তাকালাম ।
প্রথমে মনে হবে কেউ দেওয়ালেটার ঠিক ওপাশে বসে প্রাকৃতিক কর্ম সাধন করছে । কালো গায়ের রং । অন্ধকারের ভেতরে সেই কালো শরীরটা ভাল করেই দৃষ্টি গোচর হচ্ছে । আমি আর সারাহ সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছি এক ভাবে । একটু পরেই সেই অয়োবয়টা উঠে দাড়ালো । তবে ঠিক মানুষের মত উঠে দাড়ালো না । মনে হল যেন বসে থাকা অবস্থাতেই দাড়িয়ে পড়লো ! তারপর সোজা আমাদের দিকে ফিরে তাকালো । আমরা দুজনেই দেখলাম জ্বলতে থাকা লাল চোখ দুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে ।
আমি অনুভব করলাম যে সারাহ আমার হাত চেপে ধরেছে শক্ত ভাবে । আমরা দুজনেই তাকিয়ে রয়েছি সেই লাল চোখের দিকে । আমাদের দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে সেটি । কত সময় আমাদের দিকে সেটা তাকিয়ে ছিল সেটা আমরা কেউ বলতে পারি নি । এমন সময়ে আলো জ্বলে উঠলো । চারিদিক আলোকিত হওয়ার সাথে সাথেই আমি দেখলাম যে জিনিসটা দেখে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম সেটা আর সেখানে নেই !
একবার মনে হল যে আমি হয়তো ভুল দেখেছি । কিন্তু আমরা দুজনেই কি একই ভুল দেখবো । আমি সারাহের চোখের দিকে তাকিয়েই বলতে পারি যে ও বেশ ভয় পেয়েছে । আমি নিজেও খানিকটা যে ভয় পাই নি সেটা আমি বলবো না । সব থেকে বড় কথা আমরা দেখলাম টা কি !
সারাহ আর কোন কথা না বলেই উঠে গেল নিজের ঘরে । আমিও ফিরে এলাম নিজের ঘরে । নিজের ঘরেই পায়চারি করতে থাকলাম । মাথার ভেতর থেকে কিছুতেই ঐ দৃশ্যটা যাচ্ছে না ।
কিছু সময় পরেই আমার ঘরে টোকা পরলো । দরজা খুলতে দেখি সারাহ দাড়িয়ে আছে ভীত মুখে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে ! আমি একা ঘুমাতে পারবো না ঘরে !
আমি দরজা ছেড়ে দিলাম । আমার মনেই হচ্ছিলো এমন কিছু হবে ! আমারই এমন একা একা ভয়ে লাগছিলো নিজের ঘরে । সেখানে সারাহর ভয় লাগবে সেটা স্বাভাবিক ।
দুই
পরের দিনের কাজ আরও অল্প ছিল । আজই সারাহর লন্ডন ফিরে যাওয়ার কথা । তবে আমার জন্য আরও দুইদিন ছুটি বস দিয়ে রেখেছেন । অফিস থেকে গেস্ট রুমে যাওয়ার পথে আমি কেবল ভালছিলাম কেবল গতরাতের কথা । কিছুতেই অয়োবয়টাকে মন থেকে আমি দুর করতে পারছি না । বারবার মনে হচ্ছে রাতে আমি কী দেখলাম ! রাতের সাহার সাথে আমি এইটা নিয়ে কথা বলেছি । আমি ঠিক যা যা দেখেছি সারাহও ঠিক একই জিনিস দেখেছে । ওর বর্ণনা একেবারে আমার সাথে মিলে যায় । তাহলে দুজনেই যদি চোখের ভুল দেখবো তাহলে একই সাথে একই জিনিস কিভাবে দেখলাম আমরা ?
বিকেলে বেলা সারাহ আমাকে জানালো যে সে যাবে না লন্ডন ফিরে । তার মনে একটা প্রচন্ড কৌতুহল জন্মেছে । যদিও সে ভয় পেয়েছে তবে ব্যাপারটা জানার তার আগ্রহ জন্মেছে । আমার নিজেরও আগ্রহটা বেশ ভাল ভাবেই জন্মেছে ।
সন্ধ্যার পরে আমরা ঠিক একই ভাবে সেখানে বসে রইলাম । এবার আমরা কেবল একা নই । আমার সাথে করে আনা ভিডিও ক্যামেরাটা আমি সেট করে রাখলাম । অর্থ্যাৎ আমরা যা দেখবো সেটা ধরা পরবে ক্যামেরাতে । তবে ঘন্টা দুয়েক বে থাকার পরেও যখন কিছু হল না, আমরা কাউকে দেখতে পেলাম না তখন আমরা দুজনেই হতাশ হলাম । আমি উঠেই যাচ্ছিলাম তখনই সারাহ বলল, আচ্ছা কাল যখন পাওয়ার কাট হয়েছিলো তখনই তো আমরা দেখেছিলাম, তাই না?
আমারও তাই মনে পড়লো । কালকে যত সময় আলো জ্বলছিলো তত সময়ে আসলে কিছুই হয় নি । যখনই পাওয়ার কাট হল তখনই দেখতে পেলাম ।
সাথে সাথে কেয়ারটেকারকে ডাক দিলাম । কাছে আসতেই তাকে বললাম, ফ্লাড লাইটটা অফ কর তো !
আলো বন্ধ করতেই কেয়ারটেকার আমাদের দিকে কেমন চোখে তাকালো । বলল, কেন স্যার ? আলো বন্ধ করবো ?
-এভাবে আলো জ্বালিয়ে রাখার মানে কি ? বন্ধ কর ।
-আসলে এই বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম ।
আমি একবার সারাহর দিকে তাকালাম । তারপর আবারও তাকালাম কেয়ারটেকারের দিকে তাকিয়ে খানিকটা শক্ত কন্ঠে বললাম, যা করতে বলছি কর । যাও !
কেয়ার আরও কোন জবাব না দিয়ে নিচে চলে গেল । ঠিক মিনিট খানেক পরেই ফ্লাড লাইট বন্ধ হয়ে গেল । আমি আর সারাহ খানিকটা উৎকন্ঠা নিয়েই তাকিয়ে রইলাম । কত সময় তাকিয়ে ছিলাম আমার জানা নেই, হয়তো একটু মনযোগ সরে গিয়েছিল, সারাহ আমার হাত চেয়ে ধরায় আমি আবারও ফিরে তাকালাম । এবং আবারও অন্ধকারের ভেতরে সেই লাল জ্বলতে থাকা চোখ দুটো দেখতে পেলাম । দেওয়ালের ঠিক বাইরে দাড়িয়ে রয়েছে । এবং আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । এইবার কেন জানি আমার গতকালকের মত ভয় লাগলো না । তবে একেবারে যে ভয় লাগলো না সেটাও কিন্তু না । আমি আর সারাহ একভাবেই তাকিয়ে রইলাম সেটার দিকে । কত সময় তাকিয়ে রইলাম সেটা আমাদের মনে হয় হঠাৎ করেই আলো জ্বলে উঠলো এবং দেখলাম সব কিছু গায়েব হয়ে গেছে ।
কেয়ারটেকারকে ডাকার আগেই দেখলাম উঠে এল দোতলায় । ওর চেহারা দেখেই আমার মনে হচ্ছিলো যে বেটা কিছু জানে । তবে আমাদের কিছু বলতে হল না । দেখলাম সে নিজ থেকেই আমাদের বলা শুরু করলো ।
কেয়ারটেকার বলল, আপনারা যেটা দেখলেন একটু আগে ওটার না ওটুলো।
সারাহ বলল, এটা আবার কী ?
-এক ধরনের ডিমন । তবে এটা মানুষদের ঠিক ক্ষতি করে না । বরং মানুষদের সঙ্গ পছন্দ করে দুর থেকে । কেবল দুর থেকে দেখে তাকিয়ে । আলোতে একদম আসে না । আলো দেখলেই গায়েব হয়ে যায় । অন্ধকারে থাকে । মূলত মানুষকে ভয় দেখানোর কাজে একে ডেকে আনা হয় । কাউকে ভয় পাইয়ে কোন স্থান থেকে তাড়াতে চাইলে এই ওটুলোর কোন জুড়ি নেই । শোনা যায় এই গেস্টহাউজে আগে এক বুড়ো দম্পত্তি থাকতো । স্বামীটা মারা যাওয়ার পরে বুড়িকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে এই ওটুলোকে ডেকে আনা হয় । পুরো এড়িয়া নিয়ে নাকি কিছু করার করার পরিকল্পনা ছিল একটা কোম্পানীর । বুড়িকে জমিটা বিক্রির জন্য বলা হলেও সে বিক্রি করে নি । তাই এই পথ বেছে নেওয়া হয়েছিলো । বুড়ি তো বাড়ি ছেড়ে গেলই না উল্টো ঐ ওটুলোর সাথে ভাব হয়ে গেল !
আমি আর সারাহ দুইজনই এক সাথে বলে উঠলাম, ভাব হয়ে গেল মানে?
কেয়ারকেটার বলল, ভাব হয়ে গেল মানে হচ্ছে স্বামীর মৃত্যুর পরে ভদ্রমহিলা অনেক একা হয়ে গিয়েছিলেন । ঐ ওটুলো যখন আসতো রাতের বেলা তখন এই বারান্দা থেকে মানে আপনারা এখন যেখানে বসে আছেন, সেখান থেকেই ঐটার সাথে কথা বলতো । মানুষের নিঃসঙ্গতা বড় ভয়ানক জিনিস ! নানান খাবার জিনিস ছুড়ে দিতো ওটার দিকে । ওটুলো চুপচাপ বসে থাকতো ওভাবে । ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকতো । সম্ভবত সে নিজেও এমন আচরণ আশা করে নি । এমন আচরণ পেয়ে নিজেও খানিকটা বিস্মিত এবং তারও মনে হয় ব্যাপারটা পছন্দের ছিল । এভাবেই চলল যতদিন মহিলা বেঁচে ছিলেন !
আমি বললাম, এসব তোমরা কিভাবে জানো?
-মহিলা একেবারে অসামাজিক ছিলেন না । সপ্তাহে অন্তত একবার সে বাইরে বের হত সমবয়সী বৃদ্ধদের সাথে দেখা করতে । আমি এখানকার স্থানীয় । আমার কানেও এসেছে এসব । পরে যখন এখানে কাজ নিলাম । আমি প্রথম দিনই দেখতে পেলাম সেটা । সন্ধ্যা বেলা এই উঠোনটা অন্ধকার হলেই সেটাকে দেখা যেত । জানেন এই পেছনের উঠোনের কোন বাতি ছিল না । একদম না । যতগুলো ছিল সব খুলে ফেলা হয়েছিলো । বৃদ্ধ মহিলা ইচ্ছে করেই যে এটা করেছিলেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় নি । পরে আমি অফিসে বলে আবার নতুন করে বাতি লাগিয়েছি । তবে মাঝে মাঝে যখন পাওয়ার কাট হয়ে যায় তখন সে ঠিকই চলে আসে । তাকিয়ে থাকে !
কেয়ারটেকার চলে গেল । আমি আর সারা আরও বেশ কিছু সময় বসে রইলাম বারান্দায় । আজকে কেন জানি আমাদের কারোই আর একদম ভয় করলো না । একা একা বেঁচে থাকাটা সত্যিই বড় বেশি কষ্টের । বিদেশে এসে আমি সেটা টের পেয়েছি হাড়ে হাড়ে ।
আমি সারাহর দিকে তাকালাম । সে তখনও তাকিয়ে রয়েছে সেই ওটুলোর দাড়ানোর দিকে ।
মানুষের মত করে অশরীরিরাও কোন কিছুর মায়ায় পড়ে? আমরা আমাদের পুরো জীবন কাটিয়ে দেই এই একটু মায়ার কারণে । বারবার সেখানে বা তাদের কাছে ফিরে যাই যেখানে বা যারা আমাদেরকে একটু মায়া দেখিয়েছিল । এই অশরীরিটাও কি সেই মায়ার কারণে আসে এখানে ! সেই পরিচিত মুখটাকে খোজার চেষ্টা করে? একবার মায়ায় পড়ে গেলে সেই মায়া কাটানো বড় মুশকিল !
পরিশিষ্ট
স্কটল্যান্ড থেকে আসার পর থেকে সারাহ খানিকটা মিশুক হয়ে উঠলো সবার সাথে । এবং বলাই বাহুল্য যে সবার থেকে আমার সাথে মেশার পরিমান টা একটু অন্য রকম ছিল । তবে সেটা অন্য কোন গল্প । দুইমাস পরে আমি আর সারাহ আবারও স্কটল্যান্ড গিয়ে হাজির হয়েছিলাম সেই ওটুলোর সাথে দেখা করতে । গেস্ট হাউজটা অন্ধকার করে আমরা তার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম অনেকটা সময় । তবে এইবার কেন জানি সে আর আসে নি । আমাদের অপেক্ষা করাটাই সার হয়েছে । কেয়ারটেকার জানালো যে কদিন থেকে অন্ধকার হলেও সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না । কেন যাচ্ছে না কে জানে ! হয়তো মায়া কেটে গেছে !
গল্পের ঘটনা দুটো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হয়েছে ।
লেখাটি উৎসর্গ করা হল ব্লগের ভুয়া মফিজকে । গল্পটি আসলে তারই ।