আফসানার আবেগ

oputanvir
4.5
(50)

আফসানার মনে হল সে আর পারছে না । কেউ তাকে কাধে করে নিয়ে দৌড়াচ্ছে এই ব্যাপারটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । তার আর্মি জীবনে এই ঘটনাটা ঘটছে এই প্রথমে ।

আফসানা বলল, সার্জেন্ট !
দৌড়াতে থাকা সার্জেন্ট ওলি সাথে সাথেই বলল, ইয়েস ম্যাম ।
-আমাকে নামিয়ে দিন ।
-কিন্তু ম্যাম আপনার পায়ে গুলি লেগেছে । ভুলে কেন যাচ্ছেন !
-যা বলছি করুন !

আফসানা দেখলো সার্জেন্ট ওলি ওর কথা শুনলো না । বরং ওকে নিয়ে আবারও জোর গতিতে দৌড়াতে থাকলো । বনের ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে ওরা । যে কোন ভাবেই ওদের লক্ষ বর্ডারের কাছে পৌছানো । ওদের জন্য একটা কাপ্টার অপেক্ষা করে আছে । সংকেত পাওয়া মাত্রই সেটা উড়ে আসবে এপাড়ে । ওদের নিয়ে আবার ওপাড়ে চলে যাবে । কিন্তু সেই নির্দিষ্ট স্থানে আগে যেতে হবে ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেতে পারবে তো ওরা ?

ঠিক দুইদিন আগে ওরা এসেছি মায়ানমারে । অনেকটা টুরিস্টের ছদ্মবেশে । অনেক দিন থেকে আর্মি ইন্টেলিজেন্সের কাছে খবর ছিল যে মায়ানমারের ডিডিএসআই ভয়ংকর কিছু করার প্লান করছে । সেই তথ্য নেওয়ার জন্য ওরা এসেছিলো । খুব সাবধানে টুরিস্টের পোশাকে ওরা এখানকার কন্ট্যাক্টের সাথে যোগাযোগ করেছে । একটা হার্ডড্রাইভ হাতে এসেছে । এটা যে কোন ভাবেই দেশে নিয়ে যেতে হবে । সব কিছু প্লান মাফিকই চলছিল । কিন্তু একেবারে বর্ডার ক্রস করার আগেই ওদের পেছনে লোক লাগে । এবং সেখান থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে । এক পর্যায়ে রীতিমত পালাতে শুরু করলো ওরা । পেছন থেকে ধাওয়া করে আসলো ডিডিএসআইয়ের লোক । ওরা কেবল জানে যদি ওদের হাতে ধরা পড়ে তাহলে জীবনে নরক নেমে আসবে । মেরে তো ফেলবেই ওদের কিন্তু তার আগে ওদের সাথে আসলে কী যে করবে সেটা ওরা নিজেরাও জানে না । সেই কথা কল্পনাও করতে পারছে না ।
পালানোর এক পর্যায়েই একটা গুলি এসে লাগে আফসানার ডান পায়ের । গুলিটা পা ভেদ করে খানিকটা মাংস উড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায় বটে কিন্তু আফসানার চলার গতি কমিয়ে দেয় একদম । প্রথম কিছু সময় আফসানা প্রবল ইচ্ছে শক্তি দিয়ে পা চালালেও এক সময় সে হার মেনে নেয় । ওলি তখন ওকে কাধে তুলে নিয়ে দৌড়াতে থাকে ।

বনের ভেতরে একটা পুরানো ঘর দেখে সেখানে থামলো ওরা । ঘরটা পরিত্যাক্ত । ছাদটা কাঠ দিয়ে বানানো ছিল এক কালে । এখন সেটার অনেকটাই ধ্বংশ হয়ে গেছে । আপাতত এখানেই কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া সিদ্ধান্ত নিল ওরা ।
ওলি আফসানার পায়ের ক্ষত পরীক্ষা করলো । তারপর নিজের টিশার্টের কিছুটা অংশ ছিড়ে সেটা আবার ভাল করে বেঁধে দিল । ওর দিকে তাকিয়ে বলল, রক্তা পরা আপাতত বন্ধ হয়েছে । তবে জলদিই এটার চিকিৎসা করাতে হবে । নয়তো ভোগাবে !
আফসানা ওলির দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । মনের ভেতরে যে কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা সে বলতে চাচ্ছে না । কিন্তু সে জানে যে তাকে সেটা বলতেই হবে ।
ওলি একটু বাইরে তাকালো । দিনের আলো শেষ হতে এখনও বেশ খানিকটা সময় বাকি রয়েছে । এখনও ওরা নিরাপদ স্থানে পৌছাতে পারে নি । কখন পারবে সেটা ওরা জানে না । কেবল মাত্র একটা লোকেশন কো-অর্ডিনেট ছাড়া ওদের কাছে কিছু নেই । কোন আগ্নেও অস্ত্র নেই ওদের কাছে । কেবল ট্রেকিংয়ের জন্য দুজন দুটো ছুরি কিনেছিলো লোকাল বাজার থেকে । অন্য দিকে ওদের হাতে মেশিন গান রয়েছে । ওলি আর আফসানা মাত্র দুজন আর ওরা কতজন সেটা অজানা । এমন অসম লড়াইয়ে কোন ভাবেই জেতা সম্ভব না । এই জন্য ওরা নিরাপদ এলাকাতেই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে । কিন্তু সেটাও সম্ভব হবে কিনা ওরা জানে না ।
-সার্জেন্ট !
-ইয়েস ম্যাম?
-আপনি এখনই রওয়ানা হয়ে যান ।
-এখনই ?
-ইয়েস! আমাকে ছাড়াই !
-কিন্তু ম্যাম ….
-কোন কথা না । আমি যা বলছি করুন ! আমি কেবল আপনার গতিকে ধীর করছি । এভাবে যেতে থাকলে আমরা দুজনই ধরা পরবো । আদতে সেটাতে কোন লাভ হবে না । কিন্তু এই হার্ড ড্রাইভটা অবশ্যই পৌছাতে হবে নয়তো অনেক বড় ক্ষতি হবে । বুঝতে পারছেন নিশ্চিয়ই । এখানে একজন মানুষের জীবনের থেকে দেশের স্বার্থ অনেক বড় । ইটস এন অর্ডার !
-ইয়েস ম্যাম !

ওলি কিছু সময় আফসানার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর হার্ড ড্রাইভটা হাতে নিয়ে একটা শেষ বারের মত স্যালুট দিয়ে চলে গেল !

ওলি চলে যেতেই কিছু সময় আফসানা একই ভাবে বসে রইলো । হঠাৎ করেই ওর নিজের কাছে বড্ড একা মনে হল । এই ভাবে এই অন্য দেশের মাটিতে ওকে মরতে হবে সেটা কি কোন দিন ভেবেছিলো ! এমন কি এই মিশনে ওর আসার কথাও ছিল না । নিজ থেকে ও এগিয়ে এসেছিলো । ওর বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ কোন ভাবেও রাজি ছিলেন না । আফসানা অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছে তাকে । কেবল বলেছে ওরা কেবল টুরিস্ট বেশে যাবে, দেখবে আর ঘুরে আসবে । এর আগেও মায়ানমারে এভাবে যাওয়া আসা হয়েছে । কোন সসম্যা হয় নি । কিন্তু এভাবে যে এভাবে বিপদ চলে আসবে সেটা ওরা কেউ ই ভাবতে পারে নি ।

তখনই আফসানার মনে হল পরের কথাটা মনে হল । ও যখন ধরা পরবে তখন তো কেবল ওকে মেরেই ফেলবে না । এর আগে ওর সাথে কী কী করা হতে পারে এটা ভাবতেই শিউরে উঠলো একটু । তখনই মনে মনে ঠিক করে নিল যে কোন ভাবেই সে ডিডিএসআইয়ের হাতে ধরা পরবে না । দরকার হলে আগে নিজেকে মেরে ফেলবে । আত্মহত্যা মহাপাপ সে জানে কিন্তু এখানে এর থেকে ভাল পন্থা আর নেই ।

তখনই আওয়াজটা শুনতে পেল সে । কয়েকজোড়া পায়ের আওয়াজ এদিকেই আসছে । পকেট থেকে ছুরিটা বের করে আনলো । সামনে ধরলো না সেটা । ছুরিটা ধরলো ঠিক নিজের গলার কাছে । ওকে ধরার আগেই সেটা সে চালিয়ে দিবে ।

বুকের মাঝে বড় বড় নিঃশ্বাস এসে হাজির হল । নিজেকে সাহসী হিসাবেই জানে । কোন কিছুতেই সে ভয় পায় না । কিন্তু আজকে নিজের গলায় ছুরি চালাতে গিয়ে ওর হাত কাঁপছে । মানুষ বলে আত্মহত্যা করে কাপুরুষেরা । কিন্তু আফসানা ঠিক বুঝতে পারছে যে নিজের জীবন নেওয়ার মত সাহসের কাজ আর কিছু হতে পারে না ।

তখনই লোকটাকে দেখতে পেল সে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মুখে একটা হাসি । বুঝতে পেরেছে যে আফসানা ধরা পরেছে । তবে হাতের ছুরিটা দেখে একটু সতর্কতার সাথে এগিয়ে আসতে শুরু করলো । পেছনে আরও একজনকে দেখা গেল । দুজনেই বন্ধুক হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে । একজন আফসানাকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে বলল ছুরি ফেলে দিতে । আফসানা নিজের ছুরিটা আরও শক্ত করে ধরলো । সে এবার ছুরিটা চালিেয়ই দিবে । আর বেশি অপেক্ষা করা যাবে না । নয়তো ওদের হাতে ধরা পরবে সে । প্রথমে ওরা এখানেই ওকে ধর্ষণ করবে । তারপর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে আরও কী কী করতে পারে সেটা আফসানা ভাবতেও পারছে না । এমনটা সে নিজের সাথে কোন মতেই হতে দিবে না ।

ছুরিটা যখনই চালাতে যাবে তখনই ওর চোখ গেল দ্বিতীয় জনের পেছনে । তাকে দেখে একটু অবাক হল । ওকে এখানে মোটেই আশা করে নি সে ।

ওলির মাত্র ৩০ সেকেন্ড লাগলো দুজনকে কাবু করতে । দুজন আফসানাকে দেখে অন্য সব কিছু ভুলে গিয়েছিলো । পেছনের জনের গলায় একটা কোপ মারলো । সামনের জন যখন আওয়াজ পেয়ে ঘুরতে যাবে তার আগেই আরেকটা কোপ এসে তার হাতে তারপর গলায় । কোন আওয়াজ ছাড়াই দুজন মাটিতে শুরু পরলো ।

আফসানা কাউকে দেখে এতো প্রসন্ন হয়েছে বলে ওর মনে পড়ে না । তারপরেও মুখ গম্ভীর করে বলল, আপনাকে আমি অর্ডার দিয়েছিলাম !
ওলি সেদিকে কোন প্রকার ভ্রক্ষেপ না করে মৃত দুইজন সৈনিকদের পকেট খোজ করতে লাগলো । দুটো পিস্তল খুজে পেল । একটা নিজের কাছে রেখে অন্যটা আফসানার হাতে দিল । তারপর একটা মেশিনগান নিজের কাধে তুলে নিতে নিতে আফসানার দিকে তাকিয়ে বলল, দেশে ফিরে এই অর্ডার না মানার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোটমার্শাল কইরেন !
-তাই করবো !
-আমার আপত্তি নাই । চলেন এবার !

ওলি আফসানাকে কাধে তুলে নিয়ে আবারও যাত্রা শুরু করলো । তবে এবার ওলির ভেতরে আর আগের মত তাড়াহুড়া নেই । ও হাটছে বেশ শান্ত ভাবেই । হাটতে হাটতে ওলি বলল, ওদের হাতে ধরা পরলে কী অবস্থা হত আপনার সেটা ভেবেছেন ?
-সেটা আমার টেনশন । আপনার না । আপনি অর্ডার কেন অমান্য করলেন ?
-যদি আপনিও ধরা পরে যেতেন । ওদি এই ডিস্কটা ওরা পেয়ে যেত ।
-গেলে যেত! সেটা আপনার জীবন থেকে বড় কিছু না !
-অবশ্যই বড় কিছু !
-আমার কাছে না ।

আফসানা আরও কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু কেন জানি ওর মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হল না । সত্যিই যদি ওলি না আসতো, যদি ওর অর্ডার মোতাবেকই চলে যেত এতোক্ষণে ওর উপর দিয়ে কী নেমে আসতো ! আফসানা সেটা ভাবতেই পারছে না ।

দুই

তিনদিন পর ।

আফসানা নিজের বেডে শুরু আছে । হাসপাতালে থেকে ওকে একদিন পরেই ছেড়ে দিয়েছে । পায়ের ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে । বলা হয়েছে মাস খানেক কোন হাটা চলা করা যাবে না । নিজের ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটাতে হবে যা আফসানার মোটেও পছন্দ না । মোবাইল সকাল থেকে সে মোবাইল টিপছিল । বই পড়েছে । এভাবে সামনের কিছু দিন কাটিয়েছে ! এমন সময় সার্জেন্ট ওলি এসে হাজির হল তার বাসায় !

আফসানা সরাসরি ওলিকে নিজের শোবার ঘরেই আসতে বলল। ওলি ঘরে ঢুকেই একটা স্যালুট দিল । আফসানা কিছু সময় ওলির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বসুন । রিল্যাক্স হয়ে বসুন ।
-ইয়েস ম্যাম ।
-হার্ড ডিস্ক ডিকোড করা হয়েছে ?
-চলছে ম্যাম ।
-আমি কিন্তু এখনও ফুল রিপোর্ট লিখি নি । সেখানে কিন্তু আপনার অর্ডার অমান্য করার কথা উল্লেখ থাকবে ।
-ইয়েস ম্যাম আমি জানি !
তারপর কিছু সময় কেটে গেল চুপচাপ করেই । আফসানা তারপর হঠাৎ করে বলল, আপনি কেন আমার অর্ডার অমান্য করলেন? যে কোন পর্যায়েই যে একজন উর্ধতন অফিসারের কথা আপনাকে শুনতে হবে এমন ট্রেনিং আপনাকে দেওয়া হয়েছে । আপনি কেন অমান্য করলেন, যেখানে ন্যাশনাল সিকিউরিটি জড়িতো ?

ওলি কিছু সময় নিজের ভেতরেই কী যেন ভাবলো । তারপর বলল, আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যে ওরা আপনাকে ধরতে পারলে কী করতো ! আমি যদি আপনার অর্ডার মেনে চলে আসতাম তাহলে পরের দিন গুলোতে আমি কোন দিন শান্তিমত ঘুমাতে পারতাম না । বারবার কেবল মনে হত যে আমি আমি চাইলেও কিছু করতে পারতাম কিন্তু করি নি । এটা আমাকে শান্তি দিতো না ।
-কেবল এই কারণেই আপনি ফিরে এসেছিলেন?

ওলি হাসলো । বলল, এটা একটা কারণ । আরও একটা কারণ আছে । তবে সেটা বলা যাবে না ।
-আরও একটা কারণ ? বলা যাবে না কেন?
-কারণ সেটা বললে আমার নামে নির্ঘাত কোর্ট মার্শাল হবে ।

আফসানা দেখলো ওলি একদম সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । যদিও আফসানা ঠিক ঠিক জানে ওলির না বলা কারণটা । যখন ঠিক আফসানা যাবে এই মিশনে তখন ওলি অনেকটা বেপোরোয়া ভাবেই এই মিশনের যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছিলো । আগে আফসানার সম পর্যায়ের একজন অফিসার যাওয়ার কথা ছিল । সেই অফিসার ঠিকও হয়েছিলো । তবে ওলি কিভাবে তাকে রাজি করিয়েছিলো সেটা আফসানা জানে না । তবে এটা ওর ঠিকই কানে এসেছিলো যে ওলি অনেকটাই বেপোরোয়া ছিল ।

আফসানা জানে কারণ টা । তবে আফসানা এও জানে যে ওলি যা ইচ্ছে পেষণ করে সেটা কোন দিন সম্ভব না । তার বাবা কোন দিন আফসানা থেকে নিচের র‌্যাঙ্কের একজনের সাথে আফসানার মেলামেশা মেনে নেবে না । আফসানা এই বাস্তবতা খুব ভাল করেই জানে । তাই সে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিয়েছে খুব ভাল ভাবেই । ছোট থেকেই এই আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে শিখেছে সে । তার বাবার দেওয়া প্রথম নির্দেশই ছিল নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে ।

আফসানা সেই ভাবেই আবেগ নিয়ন্ত্রন করে চলেছে । তবুও আফসানার মনে মাঝে মাঝে কিছু আবেগকে প্রবাহিত হতে দিতে ইচ্ছে করে !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 50

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →