শেষ মূর্হুতের অনুভূতি

oputanvir
4.6
(62)

সুপ্তি মেসেঞ্জারের আসা মেসেজটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসলো । এতোদিন ধরে সে অনলাইনে আছে, মানুষ জনের কাজ কর্মের ধরণ সম্পর্কে সে বেশ ভাল রকমেই অবগত আছে । ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা বলার জন্য, একটা নতুন কোন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কত কিছুই না করে।
আয়ান নামের এই ছেলেটার কথাই ধরা যাক । ছেলেটা ওকে প্রথমে মেসেজ পাঠিয়েছিল । আগের আইডি তার নষ্ট হয়ে গেছে । এটা নতুন আইডি। দুদিন পরে আবার ছেলেটা আবার মেসেজ পাঠালো যে সে সরি, সানজিদা নামে ওর এক পরিচিত কে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ওকে পাঠিয়ে ফেলেছে । ওর প্রোফাইলে ছবি দেওয়া নেই দেখে এই ভুল করেছে । এই জন্য সে সরি। সানজিদা ওর ফরমাল নাম । ফেসবুক সহ সব স্থানেই এই নাম দেওয়া । সবাই আসলে ওকে এই নামেই চেনে ।
সুপ্তি জানে এরপর ছেলেটা ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে । নানান রকম প্যাঁচাল দিয়ে শুরু করবে । কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্য রকম হল যখন ছেলেটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা ক্যান্সেল করে দিল । মেসেজ পাঠানোর সাথে সাথে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠিয়েছিল । একটু খটকা লাগলো সুপ্তির, যা ভেবে তা হল না দেখে ! আবার মনে করলো যে হয়তো এটা নতুন কোন চাল । কিন্তু যখন ছেলেটা ওকে আর কোন মেসেজই করলো না, কোন প্রকার যোগাযোগই করলো না তখন সুপ্তির সত্যিই অবাক লাগলো। সত্যি বলতে কি ওর সাথে এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটলো । এমন তো হওয়ার কথা না ।

শেষে আর থাকতে না পেরে সুপ্তি মাস ছয়েক পরে নিজেই নক দিল ছেলেটাকে । ছেলেটার নাম আয়ান আহমেদ । প্রোফাইল দেখে ডিসেন্টই মনে হল । অল্প কিছু ছবি পাব্লিক করে দেওয়া । দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোরার ছবি । বেশির ভাগই পাহাড়ের ছবি । এই ছাড়া ছেলেটার ব্যাপারে আর কোন তথ্য দেওয়া নেই।
-হ্যালো ।
ভেবেছিল সাথে সাথেই বুঝি উত্তর আসবে । এল না । উত্তর এল প্রায় আট ঘন্টা পরে । রাত তখন এগারোটা বাজে । ম্যাসেজের টুং করে আওয়াজে সুপ্তি মোবাইল টা হাতে নিল । আয়ানই ফিরতি ম্যাসেজ দিয়েছে ।
-হ্যালো ।
সুপ্তি লিখলো, আপনার সেই সানজিদাকে খুজে পেয়েছেন ?
আয়ান প্রথমে হাসির ইমো দিল । তারপর বলল, আমার সানজিদা ! হাহাহা ! না না সে আমার সানজিদা নয় । আমার পরিচিত সানজিদা । হ্যা তাকে খুজে পেয়েছি ।
সুপ্তি এরপর কী বলবে খুজে পেল না । কথা যে হারিয়ে গেছে । ঠিক বুঝতে পারছে না ওর এখন কী বলা উচিৎ । আসলে এমন ভাবে সে কোন দিক আগে থেকে কথা শুরু করে নি । তাই ঠিক কথা বলতেও পারছে না । সুপ্তি বলল, তা আপনি কী করেন ?
-তেমন কিছু না । বেকার বলতে পারেন । একি টুকটাক কাজ করি । আর নিজের জন্য বাঁচি ।
-সবাই তো নিজের জন্যই বাঁচে ! তাই না ?
-নাহ । আমাদের বেশির ভাগ মানুষই বাঁচে অন্যের জন্য ।
-যেমন ?
-এই ধরেন আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন একটা মেয়েকে আমার খুব বেশি মনে ধরলো । প্রেম হল । তারপর মেয়েটা বলল যে তার ডাক্তার ছেলে খুব পছন্দ । বেশ আমি তার জন্য প্রবল ভাবে পড়াশুনা করলাম। ডাক্তার হলাম কিন্তু ডাক্তারী পড়ার শেষে এসে দেখি সে চলে গেছে । এই আমি এই এতো কষ্ট করে জীবনের ৬/৭ বছর পড়াশুনা করলাম এটা কিন্তু আমার জন্য না, ঐ মেয়েটার জন্য । ফলাফল হল শূন্য । যদি আমি নিজের জন্য এই সময়টা ব্যয় করতাম তাহলে অন্তত ডাক্তার হতাম না ।
-এখন তাহলে নিজের জন্য কী করেন শুনি?
-যা নিজের ভাল লাগে তাই করি । যা ভালো লাগে না তা করি না । এই যেমন ধরেন, ডাক্তারদের এই এতো পরিশ্রমের জীবন আমার ভাল লাগে না । এইজন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি ।
-তার মানে প্রাক্টিস করেন না?
-প্রক্টিস না করলে খাবো কি বলেন ? এটাই হচ্ছে জীবনের ট্রাজেডি ! আমি আসলে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করি না । দুই তিনটা হাসপাতালের সাথে চুক্তি আছে । যখন ওদের ওখানে কোন ডাক্তার ছুটিতে যায় আমি সেখানে কামলা দিতে যাই । কোণ বাঁধা ধরা নিয়ম নেই । কিছু এনজিও থেকে মাঝে মাঝে ডাক আসে ।
-এতে চলে যায়?
-যাচ্ছে তো !

এইভাবে কথা চলতে থাকে । একটা সময়ে সুপ্তি খেয়াল করে যে ছেলেটার সাথে ওর কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে । কথার পরে কথা উঠেই আসছে ।
সুপ্তিই তারপর আয়ানকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো । দেখতে পেল ভেতরে অনেক ছবি । কোথায় কোথায় যাচ্ছে কী করছে । তবে কিছু ছবি বেশ কমন । আয়ান বলেছিল যে সে এনজিওর সাথে কাজ করে । নানান রকম ক্যাম্পেইন করে মানুষকে সেবা দিয়ে বেড়ায় । এটা জেনেও সুপ্তির বেশ ভাল লাগলো ।
তবে একদিন সত্যি সত্যি দেখা হয়ে গেল । সেদিন সুপ্তি ওর মাকে নিয়ে গিয়েছিলো ঢাকার একটা প্রাইভেট হাসপাতালে । কদিন আগেই সে জানতে পেরেছিলো যে আয়ানের এই হাসপাতালের সাথে চুক্তি আছে । মাঝে মাঝে এখানে সে কামলা দিতে এখানে আসে । ডাক্তারের সিরিয়ালে বসে থাকার সময় সুপ্তির কী মনে হল সে পায়ে পায়ে চলে গেল ইমার্জেন্সীর দিকে । সেখানে ঢুকে একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল যে আয়ান আহমেদ সত্যিই বর্তমানে ডিউটিতে আছে । এবং সুপ্তিকে অবাক করে দিয়ে মিনিট দুয়েকের ভেতরেই আয়ান ওর সামনে এসে দাড়ালো ।
সুপ্তি যখন নিজের পরিচয় দিল তখন আয়ান চিনতে পারলো সাথে সাথে । এখানে কেন এসে জানতে চাইলো । সুপ্তি ওকে আসল কারণ বলে দিলো । এবং অবাক হয়ে দেখলো এরপরে সব কিছু কেমন সহজ হয়ে গেল । আয়ান নিজে গিয়ে সেই অধ্যাপক ডাক্তারের সাথে কথা বলল । সুপ্তির মায়ের সিরিয়াল এগিয়ে এল এবং ডাক্তার দেখে সুপ্তির কাছ থেকে টাকা পর্যন্ত নিলো না । আয়ান ওকে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছে ।

এরপর থেকে আয়ানের সাথে সুপ্তির নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হতে লাগলো । আগে তো কেবল ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা হত এখন ফোননেও কথা হতে শুরু করলো । সুপ্তি আস্তে আস্তে অনুভব করছিলো যে ছেলেটাকে তার অসম্ভব ভাল লাগতে শুরু করেছে । ছেলেটা হাসে গল্প করে বই পরে পাহাড়ে ঘুরতে যায় । এতো কিছু করে । নিজের মত করেই বাঁচে ! এতো চমৎকার ছেলেটাকে প্রথমে কিই না ভেবেছিলো । এটা ভাবতে এখনও সুপ্টির খানিকটা লজ্জার মত অনুভূত হয় । একদিন বলেও ফেলেছিলো সে আয়ানকে কথাটা । কথাটা শুনে আয়ানের সে কি হাসি ! হাসি যেন আর থামেই না ! আয়ানের এই হাসি দেখেই সুপ্তির মনে আরও একটু কাছে জায়গা করে নিলো ছেলেটা !

আরও সপ্তাহ দুয়েক পরের কথা । সুপ্তি ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছে তখনই আয়ানের ফোন এসে হাজির হল ।
-হ্যালো !
-তুমি না যেতে চেয়েছিলে আমাদের ক্যাম্পেইনে !

সুপ্তি অনেক আগেই বলে রেখেছিলো যে আবার যদি আয়ানটা মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন করতে যায় তাহলে যেন ওকে জানায় । গ্রামে মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন করতে গেলে ডাক্তার ছাড়াও আরও নানান ধরনের ভলান্টিয়ার লাগে ।
সুপ্তি বলল, হ্যা । কবে যাবে?
-দল যাবে কাল সকালে । ঢাকা থেকে এই ধর ঘন্টা তিনেকের পথ । তুমি ওদের সাথে যুক্ত হয়ে যাও ।
সুপ্তি বলল, তুমি যাবে না?
-হ্যা আমিও যাবো । তবে আমি যাবো আজকে রাতে । আসলে ওটা আমার দাদা বাড়ির পাশের গ্রাম । আমি আজকে যাবো । আমাদের ওখানে একটা বাড়ি আছে । বাড়ির পাশে নদী । সেই নদীর পাশে বসে জ্যোৎনা দেখবো আজকে ।

সুপ্তি কি যেন ভাবলো । আসলে ক্যাম্পেইনে যাওয়া তো সুপ্তির প্রধান উদ্দেশ্য না । প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আয়ানের সঙ্গ । আর নদীর পাড়ে বসে আয়ানের সাথে জ্যোৎনা দেখার কথাটা শুনতেই সুপ্তির মনের ভেতরে কেমন করে উঠলো ! খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল, তোমাদের দাদাবাড়িতে কে কে আছে?
আয়ান বলল, কেউ নেই । ওখানে কেউ থাকে না । একজন কেয়ারটেকার আছে । তার কাজ হচ্ছে দিনের বেলা গিয়ে ঘর বাড়ি পরিস্কার করা । আর কিছু না । রাতে তালা দেওয়া থাকে ।
-আচ্ছা । আমি যদি তোমার সাথে যাই আপত্তি আছে?

আয়ান কিছু সময় ভাবলো কী যেন । তারপর বলল, ওকে কোন সমস্যা নেই । তুমি এই ধর দশটার দিকে তৈরি হয়ে থেকো । আমি তোমার বাসা থেকে তোমাকে পিক করে নিবো !
সুপ্তি বলল, না না । বাসার সামনে এসো না । আমি বরং তোমার বাসার সামনে আসবো নে । আশে পাশের কেউ তোমার সাথে বাইকে উঠতে দেখলে বাসায় খবর চলে যাবে!
-আচ্ছা তাহলে লুকিয়ে যাবে !
-লুকিয়ে না । বাসায় বলবো যে রত্নার বাসায় থাকবো । আমাদের কয়েক বিল্ডিং পরেই ওদের বাসা !
-আচ্ছা । তুমি তাহলে চলে এস ! তবে একটু কিন্তু খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হবে । কেয়ারটেকারের রান্না একদম ভাল না !
-আচ্ছা সমস্যা নেই ।

ফোন রাখার পরে সুপ্তি দ্রুত এগিয়ে যেতে শুরু করলো বাসার দিকে । যদিও বাসায় কিছু বলা যাবে না তারপরও একটু গুছিয়ে নিতে হবে । কী কী বলে বাসা থেকে বের হবে সেটা আগে থেকেই ভেবে রাখলো সে ! রত্নাকেও বলতে হবে যাতে হঠাৎ করে ওর মা ফোন দিয়ে ফেলে তাহলে যেন সামলে নেয় !

সুপ্তির মনের ভেতরে ভাল লাগার একটা অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে । বারবার সামনে আসা সময়টার কথা সে কল্পনা করার চেষ্টা করছে । জ্যোঁছনা রাত, নদীর ধার পাশে আয়ান বসে ! ব্যাপরটা কল্পনা করতেই মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠছে আপনা আপনিই !

দুই
সুপ্তি চোখ মেলে তাকালো । প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না ঠিক কোথায় আছে ! চোখের সামনে একদম অন্ধকার ঠেকলো সব কিছু ! তবে কিছু সময় যাওয়ার পরেই চোখে অন্ধকার সয়ে এল । তখনই টের পেল যে ও একদম নড়তে পারছে না । ওর হাত পা পা বাঁধা শক্ত করে ! তীব্র একটা আতংঙ্ক এসে জড় হল ওর মনে । চিৎকার দিতে যাবে কিন্তু সেটাও পারলো না । মুখের ভেতরে কিছু দেওয়া রয়েছে । তার উপরে টেপ পেঁচানো শক্ত করে ! কোন আওয়াজই বের হল না !
আরও কয়েকবার চেষ্টা করলো ও । কিন্তু কোন কাজ হল না । আতংঙ্কটা বাড়তেই থাকলো । বারবার চিন্তা করতে লাগলো ও এখানে কিভাবে এল ?

রাতের বেলা সে আয়ানের সাথে এসেছিলো আয়ানের দাদা বাড়ি । বাড়িটা খুব নির্জন ছিল । এমনই থাকবে সেটা জানা ছিল । আয়ানের সাথেই বাড়িতে ঢুকেছিলো । একটা ঘরে তালা খুজে প্রবেশ করলো ওরা । আলো জ্বাললো । ঘরটা বেশ গোছানো ছিল । দেখেই বুঝতে পেরেছিলো যে এখানে মানুষজনের যাতাযাত হয় !

ঘরের এক পাশে একটা ফ্রিজও দেখতে পেয়েছিলো সুপ্তি। আয়ান সেখান থেকে পানি বের করে খেল । তারপর ওদের দুইজনের জন্য একটা শরবত বানালো । সুপ্তির দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে আয়ান বলেছিলো, জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে আছো । এটা খাও । তারপরই আমরা জ্যোঁছনা দেখতে যাবো !
সুপ্তি কোন প্রশ্ন না করেই সেটা খেয়ে ফেলল । একটু অদ্ভুত স্বাদ হলেও খেতে খারাপ লাগলো না ।
খাওয়ার পরে কী হল ?
সুপ্তি মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না । তাহলে কী ঐ….।
সুপ্তি আর কিছু ভাবতে পারছে না !

ঠিক এমন সময়ে ঘরের আলো জ্বলে উঠলো । সুপ্তি চমকে গিয়ে সামনের দিকে তাকালো । আয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীব্র একটা বিস্ময় নিয়ে তাকালো । আয়ানের মুখ হাসি হাসি । সে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুম ভাঙ্গেছে ?
সুপ্তি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা রকলো আবার । কিন্তু কোন লাভ হল না । তীব্র একটা ভয় জেগে উঠলো ওর মনে !
-ভাবছো এখানে কিভাবে এলাম, তাই তো ? বোকা সুপ্তি ! এভাবে মানুষকে বিশ্বাস করতে আছে ? আমাকে তুমি কতই বা চিনো আর বল !

সুপ্তি কেবল অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে আয়ানের দিকে । এখনও ঠিক সে বিশ্বাস করতে পারছে না । আয়ান বলল, তোমরা মেয়েরা খুব বোকা হও । খুব সহজেই ফাঁদে পা দাও । যাই হোক তুমিই তো প্রথম না ! এই চেহারা দেখে অনেকেই ফাঁদে পা দিয়েছে । সবার অবস্থাই তোমার মত হয়েছে । আজকে তোমারও হবে !

সুপ্তি এবার সত্যিই ভয় পেল । তীব্র এক ভয় ! এমন ভয় সে আর কোন দিন পায় নি । আয়ান আস্তে আস্তে এগিয়ে এল । পাশেই একটা টেবিল থেকে বড় একটা ছুরি তুলে নিল । সেটা দেখে সুপ্তি চিৎকার দিয়ে উঠলো । কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না । চোখ দিয়ে কেবল কান্না বের হয়ে এল । সাথে সাথে ওর মায়ের মুখটা মনে পড়লো । ওর মা এখন কী করছে ?
এখন নিশ্চয়ই সে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে । কাল সকালে যখন ওর কথা মনে পড়বে তখন সে আর এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে না । ওকে কী আজকেই মেরে ফেলবে নাকি কষ্ট দিয়ে মারবে ?
বাঁচার একটা তীব্র আকাঙ্খা জেগে উঠলো সুপ্তির মনে । নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো । কিন্তু কোন কাজ হল না । খুবই শক্ত দড়িয়ে দিয়ে ওকে বাঁধা হয়েছে ।

আয়ানকে এগিয়ে আসছে দেখলো । ওর একদম কাছে এগিয়ে এল সে । তারপর হাতের ছুরিটা সে সুপ্তির গলা বরাবর ধরলো । একটু হাসলো সে । কুটিল হাসি । সুপ্তি বুঝতে পারলো ওর সময় এখনই শেষ । এখনই ওকে জবাই করা হবে !

ছুরিটা আয়ান এবার উপরে ধরলো । সুপ্তি কেবল দেখতে পেল সেটা নেমে আসছে ওর গলা বরাবর !

তিন
সুপ্তি এখন কিছুটা শান্ত । ঘরের ভেতরে সে চুপ করে বসে আছে । ওর হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে । এখনও সে হটিক বিশ্বাস করতে পারছে না সে বেঁচে আছে ! তীব্র একটা রাগ হচ্ছে আয়ানের উপর । সেই সাথে আবার বেঁচে থাকার আনন্দ হচ্ছে । এই মিশ্র একটা অনুভূতি !

আয়ানকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখলো সে । একটু আগে সে এই পাতাল ঘরে ছিল । এই বাড়ির নিচে একটা পাতাল ঘর আছে । মুলত সেটা কয়েদ খানা । আয়ানদের পূর্বপুরুষ এই এলাকার জমিদার ছিল । তারা প্রজাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই নিচের কয়েদখানাটা বানিয়েছিলো !

আয়ানের হাতে একটা প্লেটে নানান পদের খাবার । সেই হাতে হাতে সফট ড্রিংস । সেটা বাড়িয়ে দিল সুপ্তির দিকে । সুপ্তি হাতটা বাড়িয়ে দিল না । আয়ান বলল, এতে কিছু নেই । এই দেখো …
বলে সে নিজেই একটা চুমুক দিল । তারপর সেটা আাবারও সুপ্তির দিকে বাড়িয়ে দিল ! সুপ্তি এবার হাতে নিল । আয়ান ওর পাশে বসতে বসতে বলল, আমি জানি যে কাজটা তোমার সাথে করেছি সেটা মোটেই ঠিক হয় নি । আমি আসলে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম । তুমি যেখানে ছিলে সেটার দেওয়ালে চারিদিকে ক্যামেরা সেট করা । তোমার পুরো এক্সপ্রেশনটা ভিডিও করা হয়েছে । ওটা একেবারে র ! পিওর ! কোন ভ্যাজাল নেই ।

সুপ্তি আসলেই কিছুই বুঝতে পারছিলো না । ওর কাছে কেমন যেন সব এলোমেলো লাগছিলো । সত্যিই ভয় পেয়েছিলো ও । খুব বেশি ভয় ! যখন ছুরিটা নেমে আসছিলো নিচে । একেবারে ওর গলার কাছে ওর মনে হয়েছিলো যে ওর প্রাণ বায়ু বুঝি এবারই বের হয়ে যাবে । কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে থেমে গেল সেটা । সুপ্তি অনুভব করছিলো ওর বুকটা কিভাবে লাফাচ্ছিলো ।

তারপর আয়ান আস্তে আস্তে পা খুলে দিলো, হাত খুলে দিল ছাড়া পেতেই প্রথমে আয়ানের উপরে ঝাপিয়ে পড়লো সে । আঘাত করতে শুরু করলো । আয়ান কেবল নিজেকে রক্ষা করতে ঠেকাতে লাগলো ওর আঘাত গুলো । এক সময় সুপ্তি থামলে আয়ান ওকে খানিকটা জড়িয়ে ধরেই বলল যে এসব সাজানো ছিল । কেবল ওর রিএকশন কেমন হয় সেটা দেখার জন্য । ওর পড়াশোনার একটা ব্যাপার হচ্ছে হিউম্যান মাইন্ড ভয় পেলে কি করে । বাস্তব অভিজ্ঞতা চাইছিল । সেটাই দেখার জন্য ।
তারপর ব্যাগ থেকে বের করে কিছু জার্নালও দেখালো । তারপর সুপ্তি একটু শান্ত হল । তবুও আয়ানের উপর থেকে রাগটা কোন ভাবেই যাচ্ছিলো না ।

পরিশিষ্ট
সুপ্তি নদীর পাড়ে বসে আছে অনেকটা সময় । আয়ান ওর পাশেই বসে আছে । কেউ কোন কথা বলছে না । কেবল তাকিয়ে আছে সামনে ! চমৎকার বাতাস দিচ্ছে । সুপ্তির কাছে সব কিছু যেন আরও সুন্দর মনে হচ্ছে । বেঁচে থাকার আনন্দ । একটু আগে সে সত্যিই যে তীব্র একটা ভয় পেয়েছিল । মৃত্যুকে দেখেছিলো একদম কাছ থেকে । মনে হয়েছিলো আর যদি কিছু সময় পাওয়া যেত তাহলে কত কিছুই না করা যেত । এখন সেই সময় সে পেয়েছে ! এখন মনে হচ্ছে জীবনে আসলে অন্য সব কিছু গৌণ । কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকাটাই মূখ্য একটা ব্যাপার ।
আয়ানের মত করে ! আয়ান যেভাবে বাঁচে এখন নিজের জন্য ! আমরা সব সময় অন্যকে খুশি করতে বাঁচি । নিজের কথা ভুলেই যাই । তারপর শেষ সময়ে যখন এসে হাজির হয় তখন আফসোস হয় । তখন আমরা আসলে বুঝতে পারি যে অন্য সবার থেকে আপন সত্ত্বাকে গুরুত্ব দেওয়ার দরজার ছিল সব থেকে বেশি । সুপ্তিও ঠিক করলো যে আজ থেকে সেও তাই করবে ।

সুপ্তি আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, যাও তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম । তবে আর কোন দিন এসব করবে না !
আয়ান হাসলো । তারপর বলল, আমি আর চাইলেও করতে পারবো না । কারণ আর ভয় পাবেও না তুমি !
-সত্যি জীবনে এতো ভয় পেয়েছিলাম ।
-তবে এটা কিন্তু তোমার বোকামির ফলই । কারণ এভাবে কোন ভাবেই কারো সাথে চলে আসা ঠিক না । আমিয সত্য সত্যি এমন কেউ হতাম তখন ?
সুপ্তি বলল, জানি না । কেবল তোমার চোখ দেখে মনে হয় নি যে তুমি খারাপ কিছু করতে পারো !
-এই সব ভুল তত্ত্ব । গল্পের বইতে লেখা তত্ত্ব । চোখ দেখে ভাল মানুষ বের করা । মোটেই তেমন কিছু না !

এবার থেকে অবশ্যই সাবধান হবে । ঠিক আছে ? যাকে ভাল করে চেনো না, জানো না এমন কারো সাথে একা কোথাও যাবে না ।

সুপ্তির অবশ্য এখন ওসব চিন্তায় আসছে না । জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো সে । সত্য বলতে জীবনে এভাবে সে মৃত্যুর ভয় পায় নি । আজকে যেভাবে সে মৃত্য ভয় পেয়েছে তাতে করে অনেক কিছু বদলে গেছে যেন । যখন ছুরিটা আস্তে আস্তে নেমে আসছিল তখন সুপ্তি যেন ওর জীবনের সব কিছু চোখের সামনে দেখতে পেল । তখন বারবার মনে হচ্ছিলো যে জীবনে এখনও কত কিছু করার বাকি ! কত স্থানে ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল অথচ কিছুই হল না ।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সুপ্ত । এখন থেকে কেবল নিজের জন্য বাঁচবে । একদিন না একদিন মরতে তো হবেই । আবার যখন মরন আসবে তখন যেন এবারের মত আফসোস না আসে !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 62

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →