আমি নাতাশার দিকে তাকিয়ে রইলাম । তাকিয়ে দেখি ও খানিকটা রাগ আর মন খারাপের চোখে তাকিয়ে আছে । ওর এই রকম তাকিয়ে থাকার কারণ আমি খুব ভাল করেই জানি । অন্য কেউ হলে তো আমার সাথে কথাই বলতে চাইতো না কিন্তু নাতাশা বলেই হয়তো আমার সাথে কথা বলছে । আমি অনুরোধের সুরে বললাম, কয়েকটা কথা শুনবে প্লিজ?
-কী হবে শুনে? তোমার কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই শুভ । কোন কৈফিয়ৎ তো আমি চাই নি !
-তবুও আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই । প্লিজ শুনো একটু !
আমার একবার মনে হল যে নাতাশা আমার কথা শুনবে না ! সে আমার সাথে কোন কথাই বলতে চাইবে না । তবে সে রাজি হয়ে গেল । আমি ভেবেছিলাম যে ও হয়তো লাঞ্চ আওয়ারে বলবে আসার কথা । কিন্তু আমাকে একটু অবাক করে দিয়েই সে বলল, বল এখনই ।
-এখানে?
-এখানে বলা যাবে না?
-একটু নিরিবিলি হলে ভাল হত না ?
-ওকে এসো !
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাতাশা হাটতে শুরু করলো । আমিও বিনা বাক্য ব্যয়ে ওর পেছন পেছন হাটতে শুরু করলাম । আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাদের অফিসের ক্যাফেটরিয়ার দিকে যাবে । তবে সেদিকে না গিয়ে সে সোজা ছাদের দিকে পা বাড়ালো । আমিও পেছন পেছন ওর সাথে ছাদে উঠে এলাম ।
আমাদের অফিসের ছাদটা বেশ বড় । কয়েকটা ছাউটির মত তৈরি করা আছে । এখানে বিড়ি খোরেরা এসে বিড়ি খায় । তবে এখন ছাদে আমরা কাউকেই দেখতে পেলাম না । ছাউনির নিচে দাড়িয়ে রইলাম দুজন কিছু সময় । নাতাশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো আমি আগেই বলেছি যে কৈফিয়ত দিতে হবে না কোন ভাবেই । আমি তোমাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি, তুমি মানা করে দিয়েছো । ব্যাস ঝামেলা শেষ । আমাকে পছন্দ নাই করতে পারো !
আমি তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলাম, না না । আমি তোমাকে …। মানে এমন না !
-কেমন ?
-আমি তোমাকে … তোমাকে …. আমার চোখের দিকে তাকাও । চোখ কখনও মিথ্যা কথা বলে না । তাকাও চোখের দিকে ।
নাতাশা আমার চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, এই চোখ দেখেই তো মনে হয়েছিলো যে তুমি আমাকে পছন্দ কর । তাহলে কেন বিয়ে করতে চাও না ? ইম্পুটেন্ট তুমি ?
শব্দটা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল । বললাম, না ।
-তাহলে তোমার চোখ বলছে তুমি আমাকে অসম্ভব পছন্দ কর । শারীরিক ভাবেই সুস্থ । আমি দেখতে নিশ্চয়ই খারাপ নই !
-তুমি আমার দেখা সব থেকে সুন্দর মেয়ে !
-তাহলে সমস্যা কোথায় ? কেন বিয়ে করবে না আমাকে ?
আমি প্রথমেই কী বলবো খুজে পেলাম না । তবে আজকে এই কথা গুলো আমাকে বলতেই হবে। নয়তো আমি হয়তো শান্তি পাবো না । আমি মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বললাম, সেই কথা বলার জন্যই এসেছি ।
নাতাশা কোন কথা বলল না । তবে আমি বুঝতে পারলাম যে ওর মনযোগ আমার দিকে । সেই চোখে আমি তীব্র একটা আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি । আমি বলা শুরু করলাম !
-তুমি তো জানোই যে আমার বাবা মা ডিভোর্সড ! তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে আমার কাস্টেডির জন্য কোর্টে কেস হয় । যা ভাবছো তা নয় । তারা আমাকে নিজের কাছে নেওয়ার জন্য নয়, বরং একে অন্যকে গছিয়ে দেওয়ার জন্য কেস লড়ছিলো ! তখন আমার বয়স সাত বছর । সেই ছোট বয়সে আমি তীব্র ভাবে উপলব্ধি করলাম অবহেলা আর অভালোবাসা টা ! একবার ভাবার চেষ্টা কর আমার ছোট সেই মনে কী চলতে পারে ? আমি সেই কথা আসলে মনে করতে চাই না । কোর্টে ঠিক হল যে আমি থাকবো আমাদের নানান আত্মীয়ের বাসায় তবে খচর পাঠাবে দুজনই । তাতে তারা রাজি হল ! সেই থেকে আমি কেবল সারা জীবন মানুষের করুনা দৃষ্টিই দেখেছি । উপলব্ধি করেছি যে কেউ আসলে আমাকে ভালোবাসে নি কোন দিন । আমিও আর সাহস করে কোন দিন কারো কাছে যাই নি । যেতেই পারি নি । কলেজে উঠে কেমন করে একটা মেয়ের সাথে আমার ভাব হয়ে গেল । তারপর প্রেম । প্রায় চার বছর প্রেম করলাম । এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলাম । তারপর সেও একদিন ছেড়ে চলে গেল । বলে গেল যে আমি ঠিক তার যোগ্য না । জানো সেই সময়ে আমি দুইবার সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম ।
আমি একটু দম নিলাম । তাকিয়ে দেকি নাতাশা একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ওর চোখের কোনে আমি জল দেখতে পেলাম যেন । আমি আবারও বলতে শুরু করলাম ।
-তারপর অনেক দিন আমি একদম একা ছিলাম । নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুললাম । মন কে এটা বোঝালাম যে বেঁচে থাকার জন্য আসলে অন্যের দরকার নেই । তারপর এই অফিসে জয়েন করলাম । এক বছর পরে যখন তুমি এলে এখানে, তোমাকে প্রথম দেখে আমার মনের ভেতরে কেমন আন্দোলন সৃষ্টি হল সেটা আমি আজও জানি না । কেবল মনের ভেতর থেকে একটা আওয়াজ বারবার বলে উঠলো যে তোমাকে আমার চাই ই চাই । কিন্তু পূর্বাভিজ্ঞতার জন্য সব সময় দুরে দুরে থাকতাম । কিন্তু সেটাও হল না । তোমার কাছাকাছি চলে আসতেই হল । আমার মনে তোমাকে হারানোর সেই তীব্র ভয়টা এসে জড় হল । কারণ এবার যদি তোমার কাছে পেয়ে হারিয়ে ফেলি, তাহলে সত্যি আমি নিজেকে আর জোড়া দিতে পারবো না । আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়বো ! এর থেকে না জড়াই যাতে ….. আমি
আমি কথাটা ঠিক মত বলতেই পারলাম না । আমার গলা ধরে এল কেবল । অনুভব করলাম যে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে । আমি আমার কথা গুলো ঠিক ঠাক মিলাতে পারছি না । তখনই নাতাশা একটা কান্ড করে বসলো । আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে তীব্র ভাবে আমাকে চুমু খেতে শুরু করলো । এতো তীব্র আর জোড়ালো যে সেই অনুভূতি যে আমি কিছু সময়ের ভেতরেই নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেললাম ওর ঠোঁটে মাঝে ।
কত সময় পরে আমরা দুজন দুজনার থেকে আলাদা হয়েছিলাম আমার মনে নেই । নাতাশা কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, এখন নিচে যাবে । তোমার ঐ দুই বজ্জাত বন্ধু আছে না, ওদের নিয়ে লাঞ্চ আওয়ারে হাজির হবে মগবাজার কাজী অফিসে । আমরা আজকেই বিয়ে করব।
নাতাশা আমাকে কোন অনুরোধ করলো না । ওর কন্ঠস্বর অনেকটা হুকুমের মতই শোনালো । তবে আমার কেন জানি সেই হুকুম শুনতে মোটেও খারাপ লাগলো না ।
ছাদের গেট দিয়ে যখন সিড়ির দিকে যাবো তখন নাতাশা আমার কাধ চেপে ধরলো আবারও । আবারও আরেক দফা আমার ঠোঁটে তীব্র ভাবে চুমু খেল কিছু সময় । তারপর খুব নমনীয় কন্ঠে বলল, তোমাকে ছেড়ে আমি কোন দিন যাবো না। কোন দিন না । বুঝেছো ?
আমি বুঝতে পারলাম । আমার কেন জানি সত্যিই মনে হল এই মেয়েটা কোন দিনই আমাকে ছেড়ে যাবে না ! আমাকে একা রেখে কোন দিন চলে যাবে না !