ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টঃ নিজেকে সবজান্তা ভাবার রোগ

oputanvir
5
(6)

জীবনে চলার পথে আমাদের এমন মানুষের সাথে এক বার না একবার দেখা যায় যে কিনা নিজেকে সব জান্তা মনে করে । কর্মক্ষেত্র, আড্ডা কিংবা কোন ফ্যামিলি পার্টিতে দেখা যাবে এমন কোন মানুষ যে কিনা দুনিয়ার সব কিছু জানে । সব কিছু সম্পর্কে তার জ্ঞান অঘাত । আমার জব্বার একটা কথা বলতেন । একটা না অনেক কথাই বলতেন তার ভেতরে বেশ কিছু কথা আমার মনে আছে । সেই কথা গুলোর ভেতরে একটা কথা হচ্ছে, কেবল মাত্র বলদে জানে সব । কথাটা আসলেই অনেকাংশে সত্য । সাধারন কিংবা অসাধারণ মানুষের জীবন এতো ছোট একজনের মানুষের পক্ষে সব কিছু জানা একবারে অসম্ভব একটা ব্যাপার কিন্তু বলদে এমন ভাব করবে যেন সে সব কিছু জেনে বসে আছে এবং সবার থেকে সে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন এবং বেশি জ্ঞান রাখে । এটা কেবল বলদের ভাবনা !

যাই হোক যা লিখতে বসেছিলাম সেটা নিয়ে লিখি । এই যে নিজেকে সব জান্তা ভাবার একটা ব্যাপার, এটা কিন্তু স্বাভাবিক কোন ব্যাপার না । এটা একটা ধরণের মানসিক রোগ ! এটার নাম হচ্ছে ডানিং ক্রগার ইফেক্ট । সাইন্সবিতে একটা আর্টিকেল পড়তে গিয়ে মূলত এই ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট সম্পর্কে জানতে পারি । বিশেষ করে এর পেছনে যে পটভূমি আছে সেটা বেশ মজাদার ! এই কাহিনী পড়েই ব্যাপারটা নিয়ে আরও একটু পড়াশোনা করলাম ।
ঘটনা ১৯৯৫ সালের । আমেরিকার পিটসবার্গের একজন বাসিন্দার ম্যাক আর্থার হুইলার । ভদ্রলোকের বয়স ৪৪। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে জানতে পারলো যে লেবুর রসের ভেতরে এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে । এই লেবুর রস অদৃশ্য কালী হিসাবে ব্যবহৃত হয় । অর্থ্যাৎ লেবুর রস দিয়ে কিছু লিখলে সেটা দেখা যায় না । পরবর্তিতে আগুনের নিচে ধরলে সেই লেখা ফুটে ওঠে । অতীতে গুপ্তচরেরা এই ভাবে চিঠি আদান প্রদান করতো । তো এই তথ্য জানতে পেরে তার মনে একটা ধারণা জন্মালো যে কাগজের মত করে যদি লেবুর রস যে কোন কিছুর উপরে মাখা হয় তাহলে সেটা অদৃশ্য হবে । ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যই সে নিজের শরীরে লেবুর রস মাখলো এবং একটা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলল নিজের ।
কিন্তু ক্যামেরার ত্রুটির কারণে সেই ছবি উঠলো না। হুইলার সাহেবের মনে তখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে লেবুর রস যদি কোন কিচুর উপরে মাখা হয় তাহলে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায় । এবং এই থিউরির উপরে তার অঘাত বিশ্বাস জন্মালো । বিশ্বাস আর আস্থা এতোই তীব্র হল যে সেটার থেকে তার ব্যাংক ডাকাতির করার ইচ্ছে জাগলো । যেহেতি সে অদৃশ্য হবে লেবুর রস মেখে তাই কেউ তাকে ধরতে পারবে না । হুইলার সাহেব তারপর একই দিনে দুইটা ব্যাংক ডাকাতি করলো । যেহেতু তার নিজের এবং নিজের উদ্ভাবিত থিউরির উপরে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাই সে ব্যাংক ডাকাতি করার সময়ে কোন মুখোশ পরলো না । এমন কি সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসিও দিল । সে জানে অদৃশ্য । লেবুর রস মেখে সে অদৃশ্য হয়ে আছে । তাকে দেখা যাচ্ছে না ।

কিন্তু পুলিশ তাকে রাতের ভেতরেই ধরে ফেলল । হুইলার মিয়া তো অবাক । তার তো ধরা পড়ার কথা না । সে তখন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো তাকে তারা কিভাবে খুজে পেল । পুলিশ জানালো যে তাকে সিসি টিভিতে দেখা গেছে । এই কথা মার্ক হুইলার কোন ভাবেই বিশ্বাস করলো না । কারণ নিজের উদ্ভাবিত থিউরি মতে তাকে কোন ভাবেই দেখা সম্ভব না । এমন কি তাকে সেই ফুটেজ দেখানোর পরেও সে বিশ্বাস করে নি । সব জুড়ি পুলিশ জজ মিলেও তার সেই বিশ্বাস থেকে টলাতে পারে নি ।

তাইলে বুঝেন বলদের কন্সিডেন্স লেভেল কতবড় !

এই মজার ঘটনা জানতে পারলেন কর্নেল উইনিভার্সিটির ডেভিড ডানিং এবং জাস্টিন ক্রগার । তারা ব্যাংক ডাকাত হুইলার সাহেবের এতো কনফিডেন্স লেভেল দেখে এইটা নিয়ে একটা গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কিছু সাধারন মানুষের উপরে গবেষণা চালালেন । তারা দেখতে পেলেন যে যে সব মানুষ অল্প জানে সেই অল্প জানার উপরে তাদের কনফিডেন্স অনেক বেশি থাকে । তারা তাদের পুরো পরীক্ষাটার একটা গ্রাফে রূপান্তর করলেন ! গ্রাফটা নিচের দেওয়া হল !

ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট

এই গ্রাফ খেয়াল করলে দেখা যাবে যেই মানুষের মাঝে জ্ঞান একদম নেই তার আত্মবিশ্বাসও একেবারে শূন্যের কোঠায় । অন্য দিকে যেই না একটু জ্ঞান এসে হাজির হল তখনই একদম আত্মবিশ্বাস গিয়ে ঠেকলো চুড়ায় । চিত্রের এ স্থানের মত । তারা এই এ স্থানের নাম দিলেন মাউন্ট স্টুপিড । আমাদের আশে পাশে এই স্থানে বসবাস করা মানুষের অভাব নেই । যাদের আসলে জানার কিংবা জ্ঞানের পরিধি কম তারা নিজেদের কে অন্য সবার থেকে বেশি যোগ্য মনে করে । এরপর গ্রাফের দিকে যদি তাই তাহলে দেখা যাবে যতই মানুষ জ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাদের আত্মবিশ্বাসের পরিমান ততই কমছে । একটা পর্যায়ে গিয়ে সে বি স্থানে পৌছায় । তারপর আবারও যখন সে জ্ঞান অর্জন শুরু করে তখন তার ভেতরে আস্তে আস্তে একটা আত্মবিশ্বাস এসে বাসা বাঁধতে শুরু করে । ভেবে বসে যে হ্যা আমি ব্যাপারটাা সম্পর্কে কছুটা হলেও জানি । তারপর এক সময় সে এগিয়ে যায় একেবারে সি স্থানে । প্রকৃত পক্ষেই তারা আসলে জ্ঞানের শিখরে পৌছান । তখন আবারও তাদের আত্মবিশ্বাসের পরিমানটা বৃদ্ধি পায় !

ভারতের রিয়ালিটি শো ইন্ডিয়ান আইডল অনেকেই দেখে থাকবেন । মূল পর্ব শুরু আগে সেখানে অডিশন পর্বের বেশ কিছু পর্ব থাকে । সেখানে দেখে থাকবেন যে সেখানে ভাল শিল্পীর সাথে সাথে অনেক আনাড়ি শিল্পীও এসে থাকে । যখন সেই আনাড়া শিল্পী অডিশন দেয় এবং জাজরা তাদেরকে রিজেক্ট করে দেয় তাদের মুখ দেখলে মনে হয় যেন তারা খুব হতাশ হয়েছে । এই কাজটা জাজদের মোটেই করা ঠিক হয় নি । এটা উদাহরন ডানিং ক্রুগার ইফেক্টের ।

আমি আসলে সব জানি, আমি ভূল হতেই পারি না – মূলত এমন মনভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে যদি এই ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট থেকে আমরা মুক্ত পেতে চাই । সত্যিই যদি আপনার মনে হয় যে আপনি সব সময়ই ঠিক, অন্য সবাই ভুল করছে, আপনি ভুল করতেই পারেন না তাহলে খুব সম্ভবত আপনি এই রোগে ভুগছেন ।
আশে পাশের মানুষের কথা শুনুন । তাদের কাছে আপনার আচনর সম্পর্ক ফিডব্যাক নিন । তোষামুদে কারো কারো কাছে না যাওয়াই ভাল ।

তথ্যসুত্রঃ

লিংক এক

লিংক দুই

লিংক তিন

লিংক চার

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 6

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →