নওরিনের বিপদ (শেষ পর্ব)

oputanvir
4.8
(67)

নওরিন চোখ মেলে দেখলো নিজের বিছানায় শুয়ে আছে । ওর পাশে সবে রয়েছে ইফতি । ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
নওরিন কি তাহলে দুঃস্বপ্ন দেখছিলো? ওর বাবা কি তাহলে আসে নি?
মনের ভেতরে একটা ভয় সব সময় কাজ করতো যে যদি বাসায় জেনে যায় ও একটা ছেলের সাথে একলা একটা ফ্লাটে থাকছে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে ! সেই ভয় থেকেই হয়তো দুঃস্বপ্নটা দেখেছে ও !
ইফতিকে বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হল মনে মনে ।
ইফতি বলল, তোমার বাবা তো চিন্তিত হয়ে গেছিলো বেশ । এখন অবশ্য একটু শান্ত হয়েছেন !

তড়াক করে নওরিন বিছানায় উঠে বসলো । তারপর কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, আব্বু সত্যিই এসেছে?
ইফতি বলল, হ্যা। ড্রয়িং রুমে বসে চা খাচ্ছেন ।
নওরিনের এখন গলা ছেড়ে কান্না এলো । তারপর ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কী করবো?
ইফতিকে দেখে খুব শান্ত মনে হল । সে নওরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কী বলবে তুমি নিজেই ভেবে নাও । সত্যিই বলতে পারো । বলতে পারো যে তুমি আসলে বিয়ে কর নি । এখানে ভাড়া থাকো কেবল । তোমার আব্বু । তোমাকে বিশ্বাস করবে আমার যতদুর বিশ্বাস ! কিন্তু….
-কিন্তু কী …
ইফতি একটু যেন অস্বস্তিতে পড়লো । তারপর বলল, আসলে তুমি যখন বেহুশ হয়ে ছিলে তখন আমি তোমার আব্বুর সাথে কথা বলছিলাম । তাকে বসিয়ে শান্ত করে চা খেতে দিলাম । তার কথা শুনে যা মনে হল তা হচ্ছে তুমি এখানে আমাকে বিয়ে করেছো সেটা তোমার এলাকার কিছু লোকজন জেনে গিয়েছে কোন ভাবে । কেউ হয়তো তাদেরকে বলেছে । সেটা শুনেই তোমার আব্বু এসেছে তোমার এখানে তোমাকে জানিয়ে ! এখন তুমি তোমার আব্বুকে না হয় সত্যটা বিশ্বাস করাতে পারবে কিন্তু এলাকার লোকজনকে!!

নওরিন করুণ চোখে তাকালো ইফতির দিকে । আরও কিছু বলতে যাবে তখনই দরজায় টোকা পড়লো । দরজাটা যদিও ভেজানো ছিল না । ইফতি গিয়ে দরজা খুলে দিল । নওরিন দেখলো ওর বাবা দরজা দিয়ে ঢুকছে । নওরিনের সামনে এসে দাড়ালো । তারপর বলল, আমাকে বলল কী এমন ক্ষতি হত শুনি? আমি কি মানা করতাম? আজ পর্যন্ত কোন কিছুতে কি আমি তোকে মানা করেছি? এই ঢাকা শহরে একা একা থাকিস ! কোন দিন কিছু বলেছি?
নওরিন কী বলবে খুজে পেল না । মাথা নিচু করে রইলো !
নওরিনের বাবা আবারও বললেন, শুনো যা হওয়ার হয়ে গেছে । তুমি যা করেছো তাতে তোমার উপরে রাগ করি নি তবে কষ্ট পেয়েছি ।
ইফতি বলল, আঙ্কেল আসলে ও…
নওরিনের বাবা ইফতিকে ধমকে বললেন, তুমি আমাকে আঙ্কেল কেন বলছো? আমি তোমার আঙ্কেল হই? আর বউয়ের পক্ষ নেবে না সব সময় !

নওরিন কেবল অনুভব করলো যে ওর কান দুটো গরম হয়ে গেছে লজ্জায় ! নওরিনের বাবা আরও কিছু বলছিলো ইফতিকে তবে সেসব নওরিনের কানে ঢুকলো না মোটেও । ওর চোখের সামনে কী সব দৃশ্য ভাশতে লাগলো !

নওরিন দেখলো কিছু সময়ে ওর বাবা আবারও ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালো । ইফতি গেল তার সাথে সাথে । নওরিন একটু পরে উঠে দরজার কাছে এসে দেখলো ওর বাবা ইফতি হাত নেড়ে নেড়ে কিছু যেন বলছে । ওর বাবার মুখ হাসিহাসি । একথা পরিস্কার যে ও যত সময় বেহুশ হয়ে পড়ে ছিল তত সময়ে ইফতির সাথে ওর বাবার কথা হয়েছে এবং কোন ভাবে ওর বাবা ইফতিকে পছন্দ করে ফেলেছে । নওরিন এটা অন্তত বুঝতে পারছে যে ইফতি অবশ্যই পছন্দ করার মত একজন মানুষ ।

নওরিন আবারও বিছানার কাছে চলে এল । বসে পড়লো । মনের ভেতরে তখন ঝড় চলছে । কী হবে এখন ?
ও কেন বলতে পারলো না ওর বাবাকে ?

রাতে খাওয়ার সময়ও নওরিন কোন কথা না বলে চুপ করে খেতে শুরু করলো । নওরিনের বাবা আলতাফ মাহমুদ বললেন, তোর আজার আঙ্কেলের মুখে কথাটা শুনি আমি । কে জানি তাকে বলেছে যে তুই এখানে অন্য কোন এক ছেলের সাথে থাকছিস ! আমার এটা বিশ্বাসই হয় নি । আমার মেয়ে কোন অন্যায় করতেই পারে না । তোর মাকেও জানাই নি ! পরে জানতে পারি যে তুই নাকি বিয়ে করেছিস ! এটা শুনে কষ্ট আমি পেয়েছি তবে আমার নিজেকেই দোষী মনে হয়েছে !
নওরিন মুখ তুলে তাকালো । তারপর বলল, তুমি কেন নিজেকে দোষী ভাবছো?
-বাহ রে ভাববো না? আমার মেয়ে তার পছন্দের কথা আমাকে মুখ ফুটে বলতে পারছে না । তাহলে মেয়ের ঠিক মত বন্ধু হতে পারলাম না আমি ।
নওরিন নিজের বাবার দিকে তাকালো । এখন যদি সে তার বাবা কে বলে যে সে আসলেই ইফতিকে বিয়ে করে নি । এখানে সে ভাড়া থাকে তাহলে তার বাবার মনভাবটা কেমন হবে? একটা ছেলে একটা মেয়ে একই বাসায় থাকছে এই ব্যাপারটা এই দেশে কোন ভাবেই মেনে নেওয়া হয় না ।

নওরিন আবারও মাথা নিচু করে বলল, সরি আব্বু !
ইফতি তখন বলে উঠলো, আসলে আঙ্কেল….
আলতাফ সাহেব বললেন, আবার আঙ্কেল….
ইফতি হেসে ফেলল । তারপর বলল
-সরি বাবা । আসলে নওরিনের দোষ নেই । আসলেই নেই । আমিই ওকে বলেছিলাম । ওকে আপনাকে জানাতে চেয়েছিলো । তবে চাচ্ছিলাম যে আরও কয়েকদিন পরে অনুষ্ঠান হোক আপু আসুক তারপর !

-হ্যা বুঝতে পেরেছি । এখন আর এসব ভেবে লাভ কি! যা হওয়ার হয়েছে । আফতি তুমি তোমার আপুর নম্বর আমাকে দেবে । ঠিক আছে ! আমি তাদের কথা বলতে চাই এবং দ্রুত !
-জ্বী আ…..বাবা ..

এমন ভাবে আঙ্কেল বলতে গিয়ে আটকে গেল তারপর বাবা বলল যে নওরিন নিজেও হেসে ফেলল । ইফতির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু টা সময় !

রাতে ঘুমানোর সময় শুরু হল আরেক ঝামেলা ! আলতাফ সাহেবকে ইফতির বাবা মায়ের রুমটা দেওয়া হল । তারপর ইফতির সাথে ইফতির ঘরে ঢুকতে হল নওরিনকে ! বিছানায় বসতে বসতে বলল, তুমি কি বুঝতে পারছো ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছো?
ইফতি বলল, আচ্ছা এখন আপাতত এতো চিন্তা করে কোন লাভ নেই । আজকের দিনের মত অনেক হয়েছে । এখন একটু ঘুমাও । কাল সকালে আবার অফিস আছে তোমার !

নওরিন তাকালো বিছানার দিকে । বিছানা একটা কিন্তু ওরা মানুষ দুটো । ব্যাপারটা ধরতে পেরে ইফতি বলল, তুমি উপরে ঘুমাও আমি নিচে ঘুমাচ্ছি ।
নওরিন কিছু বলতে গিয়েও বলল ন। চুপচাপ বিছানাতে শুয়ে পড়লো । মাথার ভেতরে কত কিছু যে চিন্তা করছে তার কোন ঠিক নেই । আলো বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে চিন্তা গুলো আরও ফিরে এল । কাল সকালে কী হতে পারে ! এখনও সময় আছে তার হাতে! এখনও যদি নওরিন ওর বাবাকে বলে সব সত্য কথা তাহলে হয়তো সব কিছু সামলে নেওয়া যাবে । ওর ব্যাপারটা বুঝবে । নওরিনের উপর তার বাবার বিশ্বাস এখনও চলে যায় নি । বুঝিয়ে বললে এখনও সব কিছু ঠিকঠাক মিটিয়ে ফেলা যাবে !
এসব ভাবতে ভাবতে নওরিন কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সেটা টের পেল না । ওর ঘুম ভাঙ্গলো মাঝরাতে ।
হঠাৎ অনুভব করতে পারলো যে ঘরের ভেতরটা হঠাৎ ই খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে । ইফতির ঘরে ও এসিই নেই । এতো ঠান্ডা কিভাবে হল !
বিছানায় উঠে বসতেই ওর চোখ গেল বিছানার পাশে মেঝেতে শুয়ে থাকা ইফতির দিকে । পুরো শরীর যেন জমে গেল একেবারে !

ইফতির শরীরের উপরে ওটা কী বসে আছে ?

রাতের বেলা হলেও ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি । তাই কালো অন্ধকারের মত অয়বয়টা পুরোপুরি পরিস্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে । সেটা ইফতির বুকের উপরে বসে আছে । নওরিনের মনে যেন কালো অয়বয়টা হাত দিয়ে ইফতির গলা চেয়ে ধরেছে । ইফতি ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না !

নওরিনের হঠাৎ কি হল সেটা সে নিজেও জানে না । বিছানার উপর থেকে সরাসরি সেই কালো অয়বয়টার উপরে ঝাপিয়ে পড়লো। সাথে সাথে একটা ঠান্ডা ধাক্কার মত খেল সে । আবারও ছিটকে খাটের পাশে এসে পড়লো । তবে আশার কথা যে সেই অয়বয়টাও ইফতির শরীর থেকে ছিটকে পড়েছে পরলো। সাথে সাথেই ইফতি জেগে উঠলো । তাকালো নওরিনের দিকে । তাররপ ওর চোখ গেল সেই কালো অয়বয়টার দিকে । সে তখনও মেঝেতেই পরে আছে ।
ইফতির দিকে তাকিয়ে নওরিন বলল, ওটা কী ?
-তুমি দেখতে পাচ্ছো?
-হ্যা পাচ্ছি পাচ্ছি !

কালো অয়বয়টা মনে হল উঠে বসলো । তাকালো ওদের দিকে । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো ওদের দিকে । এগিয়ে আসা দেখে নওরিন বেশ ভয় পেয়ে গেল । ইফতিকে সাথে সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ।

তখনই ইফতি খেয়াল করে দেখলো অয়বয়টা কেমন যেন টলে উঠলো । থেমে গেল এক স্থানে । কিছু সময় সেখানই স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো । তারপরই সেটা যেন হায়েব হয়ে গেল । গায়েব হওয়াটা ওরা দুজনেই দেখতে পেল ।
তবে তারপরেও ইফতি কিংবা নওরিন কেউ কাউকে ছাড়লো না । খানিকটা জড়িয়েই ধরে রইলো । কত সময় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ছিল ওরা কেউ বলতে পারবে না । তবে এক সময় মনে হল যে ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ।

নওরিন বলল, ওটা ওভাবে চলে গেল কেন? আমি ভয় পেয়ে ছিলাম খুব !
-দোয়া পড়েছিলেন নাকি?
-নাহ । ভুলে গিয়েছিলাম ।
-তুমি যখন আমাকে জড়িয়ে ধরলে তখন ওটা থেমে গিয়েছিলো । আমি এটা খেয়াল করেছি ।

আরও কিছু সময় জড়িয়ে ধরে রাখলো একে অন্যকে । তারপর নওরিন বলল, আসো নিচে ঘুমাতে হবে না আর ! উপরেই শোবে !
-শিওর ! তোমার কোন সমস্যা হবে না ?
-না !

দুটো বালিশে কিছু সময় শুয়ে থাকলো ওরা । তারপরই একটা সময় অনুভব করলো ওরা আর কেউই একে অন্যের কাছে থেকে দুরে নেই । প্রবল আবেগ নিয়ে একে অন্যকে চুমু খাচ্ছে …

পরিশিষ্টঃ
ইফতি আর নওরিন এখন দাড়িয়ে রয়েছে মগবাজার কাজী অফিসের সামনে । নওরিনের বাবা তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে বের হয়েছে । সেই সুযোগে দুজন বের হয়েছে । আজকে অফিসেও যায় নি নওরিন ।

ইফতি বলল, আজই বিয়ে করতে হবে? মানে এই ভাবে !
নওরিন বলল, এই ভাবে ! বাবাকে আর মিথ্যা কথা আমি বলতে পারবো না । এটলিস্ট বিয়ে করলে তাকে আর মিথ্যা বলতে হবে না ! আর রাতে তুমি কী করেছো মনে আছো তো?
ইফতি বলল, আমি একা করেছি ! তুমি করো নি । আমার তো মনে হচ্ছিলো যে তুমি …।
ইফতিকে কথা শেষ করতে দিলো না নওরিন । বলল, চুপ ! কোন কথা না ! আমি জানি তুমি আজ রাতেও একই কাজ করবে । তাই আগে বিয়ে পরে অন্য কিছু …।

ইফতি হেসে ফেলল । তারপর হঠাৎ গম্ভীর মুখে বলল, তবে আমার একটা কথা বলার আছে তোমার ! আমি চাই যে আমাদের বিয়ে হওয়ার আগে এই সত্য কথাটা জেনে নাও তুমি !

নওরিন বলল, এটাই তো যে আমার এলাকা আমার বিয়ের খবর তুমি জানিয়েছো !

ইফতি যেন আকাশ থেকে পড়লো । বলল, তুমি জানো ?
নওরিন হাসলো ! তারপর বলল, ব্যাপারটা আমি কাল ঘুমানোর সময় টের পেয়েছি । তোমার ঘরে যখন ঢুকি তখন তোমার টবিলের উপরে একটা কাগজে একটা মোবাইল নম্বর আমার চোখে পড়েছিল । নম্বরটা আমার বাবার ! প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে ঐ বদটা হয়তো জানিয়েছে । কিন্তু রাতে টের পেলাম যে কাজটা করেছো তুমি ! আমার আসলে আরও আগেই বুঝা দরকার ছিল । বিশেষ করে আমার বাবা যখন একেবারে বাসায় চলে আসলো !
ইফতি মাথা নিচু করে বলল, আসলে ঐ দিন যখন ভয়ে পেয়েছিলাম, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে, এতো নিরাপদ মনে হচ্ছিলো নিজেকে …. মনে হয়েছিলো যে তোমাকে কোন ভাবেই আমি হারাতে চাই না !

নওরিন হাসলো । তারপর বলল, বিয়ে আগে হোক তারপর সব মজা টের পাবে ! ঐ ভুত থেকে এখন থেকে আমি সব সময় তোমার ঘাড়ে চেপে বসে থাকবো ! বুঝেছো !

দুজনেই হেসে উঠলো । তারপর এক সাথে কাজী অফিসের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ! দুজনেই তখন নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 67

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “নওরিনের বিপদ (শেষ পর্ব)”

  1. জীবন সত্যিই আপনার গল্পের মতো নয়?

  2. মগবাজার কাজী অফিস-হাহ অনেকদিন পর

Comments are closed.