পাগলামী

oputanvir
4.8
(96)

সিগনাল ছেড়ে দিতেই বাসটা চলতে শুরু করলো । সাথে সাথে পানিওয়ালা ছেলেটাও । কাঁধে এতো গুলো পানির বোতল নিয়ে কেমন দৌড়াতে লাগলো । নীলুর কেন জানি খুব বেশি খারাপ লাগলো ছেলেটার জন্য । একবার মনে হল যে টাকা ছুড়ে দিতে ছুড়ে দিলে হয়তো ছেলেটা আর বাসের পেছন পেছনে এভাবে দৌড়াবে না । যদি পানির বোতলটা হাতে নিতো তখন নিশ্চিন্তেই টাকাটা ওভাবে ছুড়ে দিতে পারতো । কেবল পানির জন্য পানিওয়ালা ছেলেটাকে ডেকেছিলো তখনই বাসটা ছেড়ে দিলো । আর একটা বোতল বিক্রি হবে ভেবে ছেলেটা বাসের পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো ।

তবে আর একটু গিয়েই বাসটা আবারও থেমে গেল সিগনাল জ্যামে । পানিওয়ালা ছেলেটা জানলার কাছে বানির বোতলটা বাড়িয়ে দিল নীলুর দিকে । মুখে বিস্তৃত হাসি । যেন রাজ্য জয় করে ফেলেছে । আর একটু দেরি হলে নীলু টাকাটা ছেলেটার দিকে ছুড়েই দিতো ! ছেলেটার মুখে হাসি দেকখে নীলুর ভাল লাগলো । তবুও ছেলেটাকে একটু ধমক দিয়ে বলল, এভাবে দৌড়াতে আছে
ছেলেটা আবারও হেসে বলল, কিছু হইবো না আফা !
তারপর অন্য দিকে চলে গেল ।

পানির বোতলটা হাতে নিয়ে নীলু জানলার ভেতরে তাকালো । সামনে দেখলো পেল বিশাল গাড়ির জ্যাম । কবে এই জ্যাম কবে ছাড়বে কে জানে । আবারও যখন জানলা দিয়ে তাকালো তখন দেখতে পেল যে পানিওয়ালা ছেলেটা একজন বাইকার সামনে গিয়ে দাড়িয়েছে । বাইকার লোকটার মাথায় কালো হেলমেট । দেখা যাচ্ছে না চেহারা । সাদা সার্ট আর কালো প্যান্ট পরে আছে । অফিস থেকে ফিরছে সম্ভব । ছেলেটার সাথে কি যেন বলছে । একটু দুর হওয়ার কারণে নীলু সেটা শুনতে পাচ্ছে না । তারপরই দেখতে পেল ছেলেটা হাতের ইশারায় যেন সব গুলো পানি দেখালো । এতো দুর থেকেও নীলু পানিওয়ালার মুখের বিস্ময় ভাবটা দেখতে পেল পরিস্কার । প্রথমে অবিশ্বাস তারপর আনন্দ । দ্রুত সব পানির বোতল গুলতে শুরু করলো সে । তারপর আবারও তাকালো বাইকওয়ালার দিকে ।

নীলুর বুকে তখন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হওয়া শুরু করেছে । নীলু এতো দুর থেকেও বুঝতে পারছে যে বাইকওয়ালা কী করতে যাচ্ছে । পকেট থেকে টাকা বের করে দিল । পুরো একটা এক হাজার টাকার নোট । হাত দিয়ে একটা বোতল নিল বাইকওয়ালা । তারপর হাতের নেড়ে নেড়ে কিছু বলল । পানিওয়ালা কেবল মাথা নাড়ালো । সে বুঝতে পেরেছে । বুঝতে পেরেছে নীলুও । বাইকওয়ালা সব পানি কিনে নিয়েছে । তারপর পানিওয়ালাকে বলেছে যারই পানি দরকার তাকেই পানি দিতে । কিন্তু টাকা না নিতে ।

একটু পরে হলও তাই । দেখতে পেল পানিওয়ালা একজনকে পানি দিলো বটে কিন্তু টাকা নিলো না । কিছু বলতেই বাইকওয়ালা কে নির্দেশ করে দেখিয়ে দিল । নীলু এক ভাবে তাকিয়ে আছে বাইকে বসা ছেলেটার দিকে । একটা বার কেবল ছেলেটাকে দেখতে চায় সে । ছেলেটাকে একবার দেখতে চায় !

কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না । ছেলেটা নিজের হেলেমট খুলল না । নীলুর খুব ইচ্ছে করছিলো যে বাস থেকে গিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলে কিন্তু ইতস্ততার কারণে সেটা করলো না । কী বলবে ছেলেটাকে সে !
আরেকটু পরে যখন সিগনালটা ছেড়ে দিল তখনও নীলুর চোখ কেবল বাইকের দিকেই । একবার বাইকটা একেবারে কাছে চলে এল । নীলুর এতো ইচ্ছে করলো ডাক দিতে কিন্তু পারলো না । বাইকটা যখন ডান দিকের রাস্তায় চলে যাচ্ছে তখন কেবল বাইকের নাম্বরটা চোখে পড়লো নীলুর । মনের ভেতরে গেথে নিলো সেটা । যত দুর চোখ যায় কেবল তাকিয়েই রইলো । কিছু সময় পরে হারিয়ে গেল বাইকওয়ালা !

নীলু ভেবেছিলো যে হয়তো এই ব্যাপারটা সে সেই সময়েই ভুলে যাবে । ঐদিন রাতে একফোটা ঘুম হল না নীলুর । কেন হল না সেটা নীলু বুঝতেই পারলো না । কিন্তু পরদিনও যখন ঘুম আসলো না তখন নীলু একটু নড়ে চড়ে বসলো । ভোর রাতের দিকে সে আবিস্কার করলো যে সে ঐ নাম না জানা অচেনা বাইকারের প্রেমে পড়েছে । কেবল প্রেম না, উথাপ পাতাল প্রেমে পড়েছে ।
পরবর্তি একটা বছর নীলুর জীবন থেকে শান্তি নামের জিনিসটা একেবারে উধাও হয়ে গেল । কেবল ঘুরে ফিরে সেই রাস্তা সে অফিস ছুটির সময় দাড়িয়ে থাকতে শুরু করলো যদি সেই বাইকারকে আবার দেখা যায় ! বেশ কয়েকবার সেই পানিওয়ালার সাথে দেখা হল নীলুর । তাকে জিজ্ঞেসও করলো যে সেই বাইকার দেখতে কেমন তবে সে কিছুই বলতে পারলো না । হেলমেট পরা ছিল বিধায় তার চেহারা দেখা যায় নি !

দুই
-মিস্টার শাফায়েত হোসেন?
-জ্বী বলছি।
-আমি পল্লবী থানা থেকে বলছি । আমার নাম ইনেসপেক্টার রাশেদুল ইসলাম ! আপনার নামে একটা অভিযোগ আছে । আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে ।
-অভিযোগ ? কিসের অভিযোগ ?
-একজন আপনার বাইকের নম্বর দিয়ে আপনার নামে অভিযোগ করেছে । ইভটিজিংয়ের । আপনি আসবেন নাকি আমরা আসবো?
সাফায়েত যেন আকাশ থেকে পড়লো । তারপর বলল, আমি এমন কোন কাজই কোন দিন করি নি । কে করেছে অভিযোগ ?
-সেটা আসলেই দেখতে পারবেন । আসুন । কখন আসবেন ?
-আমি এখনই আসছি । আমার বাসা থানার কাছেই ।

শাফায়েত যখন থানায় ঢুকলো তখন বিকাল সাড়ে ছয়টা বাজে । থানায় গিয়ে রাশেদুর ইসলামের নাম বলতেই তাকে একটা রুমের দিকে ইশারা করা হল । সেই রুমের দিকে পা বাড়ালো । রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল একজন অফিসার বসে আছেন । নাম রাশেদুল ইসলাম । সামনে একটা মেয়ে বসা । এই মেয়ে কী তাহলে তার নামে অভিযোগ করেছে ?
ও কবে ইভটিজিং করলো?

শাফায়েত যখন টেবিলের কাছে এসে দাড়ালো ইনেসপেক্ট সাহেব বললেন, আপনিই শাফায়েত?
-জ্বী !
ইনেসপেক্টর সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই নিন আপনার আসামী চলে এসেছে !
শাফায়েতের দিকে মেয়েটি ঘুরে তাকালো । শাফায়েত চিনতে পারলো না মেয়েটিকে । জীবনে এই প্রথম দেখতে পাচ্ছে মেয়েটাকে । এই মেয়েটাকে কবে সে ইভ টিজিং করলো কে জানে ?
শাফায়েত কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইনেসপেক্টর রাশেদুল বলল, শাফায়েত সাহেব আসুন ! বসুন এখানে । চা কফি কিছু চলবে?
শাফায়েত আসলে কিছু বুঝতে পারছে না । মেয়েটি যদি ওর নামে অভিযোগ করেই থাকে তাহলে এই ভাবে তাকিয়ে কেন আছে ওর দিকে ! কী গভীর দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে । একটা কথা পর্যন্ত বলছে না

রাশেদুল ইসলাম বললেন, বসুন আপনাকে একটা গল্প বলি । আপনি খানিকটা দ্বিধায় পরে গেছেন যে এই মেয়েটাকে তো আপনি কোন দিন দেখেনই নি তাহলে ইভটিজিং কিভাবে করলেন, তাই না ?
-হ্যা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-আজকে সকালে এই মেয়েটি আমার কাছে এক অদ্ভুত গল্প নিয়ে আসে । কী গল্প শুনবেন?
-বলুন, শুনি ।
রাশেদুল তারপর নীলুর গল্পটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলল। শাফায়েত কেবল অবাক হয়ে শুনে গেল । গল্প শেষ করে রাশেদুল বলল, মেয়েটি গত ছয়মাস ধরে আপনাকে খুজছে । রাতে শান্তিমত ঘুমাতে পারছে না । চোখের নিচে কালি পরা দেখেই বুঝতে পারছেন । ঠিক মত পড়ালেখা করতে পারছে না । সামনেই পরীক্ষা । তাই আমার সাহায্য চেয়েছে । আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা যখন কোন কিছু পা না তখন সেই জিনিসটার প্রতি তীব্র এক আবেগ তৈরি হয় । আপনার প্রতি নীলুরও তাই হয়েছে । তবে এখন আপনাকে দেখা হয়েছে বিধায় এই আবেগটা কমে আসবে আশা করি !

শাফায়েত তখন বলল, থানাতেই বলতে হবে? বাইরে গিয়ে বলি?
-হ্যা হ্যা অবশ্যই ।
তারপর নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল, আশা করি আপনি এরপর থেকে শান্তমত ঘুমাতে পারবেন !
নীলু কোন মতে বলল, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিবো আমি বুঝতে পারছি না !
-ধন্যবাদ দিতে হবে না । কেবল পাগলামী বন্ধ করুন । তাতেই হবে । মনদিয়ে পড়াশুনা করুন !

তিন
নীলু চুপ করে বসে শাফায়েত নামের মানুষটার সামনে । এই ছেলেটার সাথে কোন দিন দেখা হবে সেটা ও ভাবেও নি কোন দিন ।
প্রথম কথা শাফায়েতই বলল, কিছু খাবেন আপনি?
-জ্বী না ।
দুজনই আবার চুপ । নীলু আসলে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে কী বলবে । শাফায়েত বলল, আপনি সত্যিই সত্যিই রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতেন ?
নীলু কেবল মাথা ঝাকালো !
-এমন পাগলামো কেউ করে?
-আমি করছি । নিজের কাজ কর্ম দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেছি । আমি কোন দিন কাউকে এভাবে ভালোবাসবো আমি ভাবতেও পারি নি ।

কথাটা বলেই চট করে তাকালো শাফায়েতের দিকে । তারপর আবার বলল, আপনি প্লিজ বিব্রত হবেন না । আপনার কিছু করতে হবে না । এমন কী আমার সাথে দেখাও করতে হবে না । আপনার নাম্বার আমাকে কেবল দিবেন প্লিজ । আমি কোন দিন আপনাকে ডিস্টার্ব করবো না । কেবল মনের ভেতরে এই একটা শান্তি যে আপনার সাথে চাইলেই কথা বলতে পারবো ! দিবেন নম্বর টা?
শাফায়েত বলল, দেখি আপনার মোবাইল টা !
নীলু মোবাইলটা এগিয়ে দিল । শাফায়েত নম্বরটা সেভ করে দিয়ে বলল, আপনি চাইলে ফোন দিতে পারেন আমাকে !এমন পাগল মেয়ের সাথে কথা বলটে আমার মনে হয় না খারাপ লাগবে !

মোবাইলটা ফেরৎ দিতে দিতে বলল, আসুন এক কাপ কফি খাওয়া যাক ! আমাদের প্রথম দেখা হয়েছে একেবারে খালি মুখে শেষ হলে কেমন দেখায় বলুন ! আমরা একে অন্যের সম্পর্কে জানি একটু !

কফির অর্ডার হয় । কথা এগিয়ে চলে । তারপর কোন দিকে সেটা যায় সেটা বরং পাঠকরাই ঠিক করুক !
ভালোবাসা বড় অদ্ভুত একটা ব্যাপার । কখন যে আপনি কার প্রেমে পড়বেন সেটা আপনি কোন দিন নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেন না !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 96

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “পাগলামী”

Comments are closed.