ছুটির দিন গুলোতে আলদিতে সোফিয়ার ব্যস্ত সময় কাটে । ক্যাশ কাউন্টটারে লম্বা লাইণ লেগে থাকে সব সময়ই । একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় থাকে না । পরপর দুইদিন সোফিয়ার ডিউটি পড়েছে ক্যাশ কাউন্টারে । অন্য মেয়েটা আজকে আসে নি শারীরিক অসুস্থতার জন্য । সকাল থেকেই তাই সোফিয়ার মন মেজাজ একটু খারাপ । তার উপরে সকালের কফিটাও একটু ঠান্ডা ছিল । ঠিক মত সকালের নাস্তা না হলে পুরো দিনটা যেন আরও খারাপ যায় । আজকে ওকে সম্ভবত ওভার টাইমই করতে হবে ।
তখনই সোফিয়া মেয়েটাকে দেখতে পেল । আপাদমস্তক কালো বোরখা পরা । কেবল মুখটা খোলা । মেয়েটিকে দেখে সোফিয়ার মেজাজটা আরও একটু খারাপ হল । মেয়েটিকে সোফিয়া চিনে । রিফিউজি । এর আগেও বেশ কয়েকবার এই সুপারসপে এসেছে মেয়েটি । মেয়েটিকে আলাদা ভাবে চিনে রাখার কারণ হচ্ছে প্রতিবার মেয়েটির সাথে একটা বাচ্চা থাকে । সম্ভবত মেয়েটির বাচ্চা । বাচ্চাটা দারুন দুষ্ট । সারাটা সময় এটা ওটা ধরতে যায় । মেয়েটা সামলে রাখতে পারে না । এই সপ্তাহ খানেক আগেই বাচ্চাটা একটা ক্যানের সারি ফেলে দিয়েছিলো । ভাগ্য ভাল ছিল যে খুব বেশি ক্যান সেখানে ছিল না । আর একটা ক্যানও ফেটে যায় নি । তবে সোফিয়াকেই সেই ক্যান গুলো তুলে সাজাতে হয়েছিলো । সোফিয়ার মেজাজ খারাপ হলেও কিছু বলতে পারে নি । কেবল বলেছিলো যেন এরপর থেকে এই বাচ্চাকে সাথে করে না নিয়ে আসে । মেয়েটি বারবার আরবিতে কি যেন বলছিলো । সম্ভবত বাচ্চার আচরনের জন্য সে ক্ষমা চাইছিলো ।
গতকালকেও মেয়েটিকে আসতে দেখেছে । যথারীতি সাথে বাচ্চাটা ছিল । তবে গতকাল সে অন্য কিছু করে নি । করলেও সোফিয়ার নজরে আসে নি । গতকাল তার অনেক ব্যস্ততার সময়ে গিয়েছে । অন্য দিকে তাকানোর সময় ছিল না । আবারও করোনার প্রকোপ বাড়ছে তাই মানুষজন কেনাকাটা করে রাখছে ।
সামনের কাস্টমারকে বিদায় করে দিয়ে সোফিয়া অন্যজনকে ডাকতে যাবে তার আগেই বোরকা পরা মেয়েটি সামনে এসে দাড়ালো । লাইণ ভেঙ্গে চলে এল দেখে সোফিয়ার মেজাজ একটু খারাপ হল । সে ইংরেজিতে মেয়েটিকে বলল, তুমি লাইন ধরে আসো ।
মেয়েটি বুঝলো বলে মনে হল না । মেয়েটি আরবি ছাড়া আর সম্ভবত অন্য কোন ভাষা বুঝে না । মেয়েটি দাড়িয়ে রইলো একই ভাবে ।
সোফিয়া বলল, কী ব্যাপার তোমাকে না বললাম লাইন ধরে আসো ।
মেয়েটি এবার নিজের ছোট ব্যাগ থেকে একটা ৫০ ইউরোর নোট বের করে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে আরবিতে কিছু বলে উঠলো । সোফিয়া কিছু বুঝলো না । তারপর আবারও কথা গুলো বলতে শুরু করলো । সোফিয়া এক সময়ে একটু বিরক্তই হয়ে উঠলো । একটু গলা চড়িয়েই বলল, তুমি লাইন থেকে বাইরে যাও । তুমি তো কিছু কেনই নি । টাকা কেন দিচ্ছো?
মেয়েটি একটু ভয় পেল বটে তবে সামনে থেকে চলে গেল না । এবার আরও একটু আকুল কন্ঠে কিছু বলে উঠলো । কিছু যেন বলতে চাইছে । বোঝাতে চাইছে সোফিয়াকে কিন্তু বুঝতে পারছে না । মেয়েটির অসহায় মুখ দেখেই সোফিয়া একটু নমনীয় হল । তারপর লাইনের দিকে তাকিয়ে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের কেউ কি এরাবিক জানে? একটু এদিকে এসো তো !
একটা ছেলে লাইন ছেড়ে বের হয়ে সামনে এল । সোফিয়া ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো তো এই মেয়ে কী বলতে চাচ্ছে । আমি কিছু বুঝতে পারছি না ।
ছেলেটি বোরকা পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলল। মেয়েটি এবার ছেলেটিকে আবারও সেই একই কথা বলতে শুরু করলো । সোফিয়া ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল । দেখতে পেল সেটা হঠাৎই কেমন বদলে গেল । একবার মেয়ের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে ।
কথা গুলো বলা শেষ হলে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলল, সে বলছে যে গতকাল সে এখানে এসেছিল । তার কাছে দশ ইউরো আর একটা ৫০ ইউরোর নোট ছিল । কেনা কাটা করার পরে সে তোমাকে ১০ ইউরোর নোট দিয়েছিলো । তাড়াহুড়ার কারণে তুমি তাকে খুচরো ভুল করে ৫০ ইউরোর একটা নোট ফেরৎ দিয়েছিলে। বাসায় গিয়ে খেয়াল করে দেখে সে তার কাছে দুইটা ৫০ ইউরোর নোট । সে একটা ফেরৎ দিতে এসেছে ।
সোফিয়া যেন ধাক্কার মত খেল । একজন রিফিউজির কাছে এই সময়ে ৫০ ইউরো মানে অনেক টাকা । এই টাকা সে ফেরৎ দিতে এসেছে ! সোফিয়া নিজে একবার রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়েছিলো । সেখানে মানুষ গুলো কী কষ্টে থাকে সেটা সে নিজের চোখে দেখেছে । এতো কষ্টের ভেতরে থেকেও এমন ভাবে মেয়েটি কাজটা করলো কিভাবে?
ও কি করতো ?
এমন করে যদি ওর কাছে টাকা চলে আসতো তাহলে সে কি ফেরৎ দিতো?
সোফিয়া হাত বাড়িয়ে নোট টা নিল । তারপর একটু হেসে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে ।
ছেলেটি সেই কথা গুলো আরবিতে অনুবাদ করে দিল ।
মেয়েটির মুখেও একটু হাসি দেখতে পেল সে এবার ! সোফিয়ার মনে হল মেয়েটির চেহারা থেকে একটা কালো চিন্তার ছায়া চলে গেল । সেখানে একটা নির্মল আনন্দের আলো দেখা যাচ্ছে । টাকাটা ফেরৎ দিয়ে সে যেন কোন চিন্তা থেকে দায় মুক্ত হল ।
মেয়েটি আর দাড়ালো না । দরজা ঠেলে বের হয়ে গেল । সোফিয়া মেয়েটির চলে পথের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় । পুরো দিন সোফিয়া কেবল মেয়েটির কথাই ভাবতে লাগলো । কোন ভাবেই মন থেকে সেটা বের করতে পারলো না ।
সোফিয়ার সাথে মেয়েটির দেখা হল আরও দুই সপ্তাহ পরে । যথারীতি কেনা কাটা করতে এসেছে । সাথে সেই বাচ্চাটা রয়েছে । তবে আজকে সোফিয়ার মোটেই মেজাজ খারাপ হল না । বরং মেয়েটিকে দেখে তার মনটা ভাল হয়ে গেল যেন একটু । কাউন্টারে বিল দেওয়ার সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সোফিয়া হাসলো । প্রতিউত্তরে মেয়েটিও হাসলো একটু । আজকে অবশ্য সোফিয়া কোন ভুল করলো না । সোফিয়া তাকে জানে ইংরেজি কেমন আছে জানতে চাইলো । সোফিয়া জানে যে মেয়েটি সেটা বুঝতে পারবে না । তবে মেয়েটির আরবিতে তাকে কিছু বলল প্রতি উত্তরে । ভাষা না বুঝলেও সোফিয়ার বুঝতে অসুবিধা হল না যে মেয়েটি তার কুশলের জবাব দিচ্ছে । কিভাবে দিচ্ছে সেটা জানে না । আজকে বাজারের সাথে সোফিয়া নিজ পকেট থেকে বাচ্চাটার হাটে একটা চকলেট ধরিয়ে দিল , মেয়েটি নিতে না চাইলেও সোফিয়া হাতের ইশারাতে বলল যে এটা উপহার ।
তারপর কেটে গেছে কিছু দিন । মেয়েটির সাথে সোফিয়ার একটা আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । মেয়েটি ততদিনে ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান ইংরজি বলা শিখেছে । মেয়েটির নামও সে জানতে পেয়েছে । জয়নাব। বাচ্চাটার নামও সে জেনেছে । আরও জেনেছে যে মেয়েটির স্বামী যুদ্ধে মারা পরেছে । সে এখানে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে এসেছে একা ।
সোফিয়ার মনের ভেতরে অনেক দিন থেকেই একটা প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল । সে একদিন জয়নাবকে প্রশ্নটা করেই ফেলল । বলল, তুমি কেন সেদিন টাকাটা ফেরৎ দিতে এসেছিলে । তুমি যদি না ফেরৎ দিতে তাহলে কেউ কোন জানতে পারতো না ।
জয়নাব হেসে বলল, কেউ হয়তো দেখতো না, জানতো না তবে উঁনি ঠিকই দেখতেন । আল্লাহ দেখতেন ঠিকই । তিনি সব দেখেন।
সোফিয়া সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না । এতো কষ্ট এতো দুঃখ সহ্য করেও এই মানুষটার ধর্ম বিশ্বাস উপরওয়ালার প্রতি বিশ্বাস দেখে সোফিয়া সত্যিই অবাক হল ।
উপরের গল্প দৃশ্যটা বানানো তবে এই গল্পের দৃশ্যপট একেবারে বাস্তব । কদিন আগে জার্মানিতে থাকা একজন ভদ্রলোক এই দৃশ্যটি নিজের চোখে দেখেছেন । সেটা লিখেছিলেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে । এই গল্পের উৎস সেখান থেকেই ।
তারিক স্যারের স্ট্যাটাস ছিল 😍