হি ইজ ওয়াচিং

অপু তানভীর
4.8
(40)

ছুটির দিন গুলোতে আলদিতে সোফিয়ার ব্যস্ত সময় কাটে । ক্যাশ কাউন্টটারে লম্বা লাইণ লেগে থাকে সব সময়ই । একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় থাকে না । পরপর দুইদিন সোফিয়ার ডিউটি পড়েছে ক্যাশ কাউন্টারে । অন্য মেয়েটা আজকে আসে নি শারীরিক অসুস্থতার জন্য । সকাল থেকেই তাই সোফিয়ার মন মেজাজ একটু খারাপ । তার উপরে সকালের কফিটাও একটু ঠান্ডা ছিল । ঠিক মত সকালের নাস্তা না হলে পুরো দিনটা যেন আরও খারাপ যায় । আজকে ওকে সম্ভবত ওভার টাইমই করতে হবে ।

তখনই সোফিয়া মেয়েটাকে দেখতে পেল । আপাদমস্তক কালো বোরখা পরা । কেবল মুখটা খোলা । মেয়েটিকে দেখে সোফিয়ার মেজাজটা আরও একটু খারাপ হল । মেয়েটিকে সোফিয়া চিনে । রিফিউজি । এর আগেও বেশ কয়েকবার এই সুপারসপে এসেছে মেয়েটি । মেয়েটিকে আলাদা ভাবে চিনে রাখার কারণ হচ্ছে প্রতিবার মেয়েটির সাথে একটা বাচ্চা থাকে । সম্ভবত মেয়েটির বাচ্চা । বাচ্চাটা দারুন দুষ্ট । সারাটা সময় এটা ওটা ধরতে যায় । মেয়েটা সামলে রাখতে পারে না । এই সপ্তাহ খানেক আগেই বাচ্চাটা একটা ক্যানের সারি ফেলে দিয়েছিলো । ভাগ্য ভাল ছিল যে খুব বেশি ক্যান সেখানে ছিল না । আর একটা ক্যানও ফেটে যায় নি । তবে সোফিয়াকেই সেই ক্যান গুলো তুলে সাজাতে হয়েছিলো । সোফিয়ার মেজাজ খারাপ হলেও কিছু বলতে পারে নি । কেবল বলেছিলো যেন এরপর থেকে এই বাচ্চাকে সাথে করে না নিয়ে আসে । মেয়েটি বারবার আরবিতে কি যেন বলছিলো । সম্ভবত বাচ্চার আচরনের জন্য সে ক্ষমা চাইছিলো ।

গতকালকেও মেয়েটিকে আসতে দেখেছে । যথারীতি সাথে বাচ্চাটা ছিল । তবে গতকাল সে অন্য কিছু করে নি । করলেও সোফিয়ার নজরে আসে নি । গতকাল তার অনেক ব্যস্ততার সময়ে গিয়েছে । অন্য দিকে তাকানোর সময় ছিল না । আবারও করোনার প্রকোপ বাড়ছে তাই মানুষজন কেনাকাটা করে রাখছে ।

সামনের কাস্টমারকে বিদায় করে দিয়ে সোফিয়া অন্যজনকে ডাকতে যাবে তার আগেই বোরকা পরা মেয়েটি সামনে এসে দাড়ালো । লাইণ ভেঙ্গে চলে এল দেখে সোফিয়ার মেজাজ একটু খারাপ হল । সে ইংরেজিতে মেয়েটিকে বলল, তুমি লাইন ধরে আসো ।
মেয়েটি বুঝলো বলে মনে হল না । মেয়েটি আরবি ছাড়া আর সম্ভবত অন্য কোন ভাষা বুঝে না । মেয়েটি দাড়িয়ে রইলো একই ভাবে ।

সোফিয়া বলল, কী ব্যাপার তোমাকে না বললাম লাইন ধরে আসো ।
মেয়েটি এবার নিজের ছোট ব্যাগ থেকে একটা ৫০ ইউরোর নোট বের করে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে আরবিতে কিছু বলে উঠলো । সোফিয়া কিছু বুঝলো না । তারপর আবারও কথা গুলো বলতে শুরু করলো । সোফিয়া এক সময়ে একটু বিরক্তই হয়ে উঠলো । একটু গলা চড়িয়েই বলল, তুমি লাইন থেকে বাইরে যাও । তুমি তো কিছু কেনই নি । টাকা কেন দিচ্ছো?

মেয়েটি একটু ভয় পেল বটে তবে সামনে থেকে চলে গেল না । এবার আরও একটু আকুল কন্ঠে কিছু বলে উঠলো । কিছু যেন বলতে চাইছে । বোঝাতে চাইছে সোফিয়াকে কিন্তু বুঝতে পারছে না । মেয়েটির অসহায় মুখ দেখেই সোফিয়া একটু নমনীয় হল । তারপর লাইনের দিকে তাকিয়ে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের কেউ কি এরাবিক জানে? একটু এদিকে এসো তো !

একটা ছেলে লাইন ছেড়ে বের হয়ে সামনে এল । সোফিয়া ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো তো এই মেয়ে কী বলতে চাচ্ছে । আমি কিছু বুঝতে পারছি না ।
ছেলেটি বোরকা পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলল। মেয়েটি এবার ছেলেটিকে আবারও সেই একই কথা বলতে শুরু করলো । সোফিয়া ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল । দেখতে পেল সেটা হঠাৎই কেমন বদলে গেল । একবার মেয়ের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে ।
কথা গুলো বলা শেষ হলে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলল, সে বলছে যে গতকাল সে এখানে এসেছিল । তার কাছে দশ ইউরো আর একটা ৫০ ইউরোর নোট ছিল । কেনা কাটা করার পরে সে তোমাকে ১০ ইউরোর নোট দিয়েছিলো । তাড়াহুড়ার কারণে তুমি তাকে খুচরো ভুল করে ৫০ ইউরোর একটা নোট ফেরৎ দিয়েছিলে। বাসায় গিয়ে খেয়াল করে দেখে সে তার কাছে দুইটা ৫০ ইউরোর নোট । সে একটা ফেরৎ দিতে এসেছে ।

সোফিয়া যেন ধাক্কার মত খেল । একজন রিফিউজির কাছে এই সময়ে ৫০ ইউরো মানে অনেক টাকা । এই টাকা সে ফেরৎ দিতে এসেছে ! সোফিয়া নিজে একবার রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়েছিলো । সেখানে মানুষ গুলো কী কষ্টে থাকে সেটা সে নিজের চোখে দেখেছে । এতো কষ্টের ভেতরে থেকেও এমন ভাবে মেয়েটি কাজটা করলো কিভাবে?
ও কি করতো ?
এমন করে যদি ওর কাছে টাকা চলে আসতো তাহলে সে কি ফেরৎ দিতো?

সোফিয়া হাত বাড়িয়ে নোট টা নিল । তারপর একটু হেসে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে ।
ছেলেটি সেই কথা গুলো আরবিতে অনুবাদ করে দিল ।

মেয়েটির মুখেও একটু হাসি দেখতে পেল সে এবার ! সোফিয়ার মনে হল মেয়েটির চেহারা থেকে একটা কালো চিন্তার ছায়া চলে গেল । সেখানে একটা নির্মল আনন্দের আলো দেখা যাচ্ছে । টাকাটা ফেরৎ দিয়ে সে যেন কোন চিন্তা থেকে দায় মুক্ত হল ।

মেয়েটি আর দাড়ালো না । দরজা ঠেলে বের হয়ে গেল । সোফিয়া মেয়েটির চলে পথের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় । পুরো দিন সোফিয়া কেবল মেয়েটির কথাই ভাবতে লাগলো । কোন ভাবেই মন থেকে সেটা বের করতে পারলো না ।

সোফিয়ার সাথে মেয়েটির দেখা হল আরও দুই সপ্তাহ পরে । যথারীতি কেনা কাটা করতে এসেছে । সাথে সেই বাচ্চাটা রয়েছে । তবে আজকে সোফিয়ার মোটেই মেজাজ খারাপ হল না । বরং মেয়েটিকে দেখে তার মনটা ভাল হয়ে গেল যেন একটু । কাউন্টারে বিল দেওয়ার সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সোফিয়া হাসলো । প্রতিউত্তরে মেয়েটিও হাসলো একটু । আজকে অবশ্য সোফিয়া কোন ভুল করলো না । সোফিয়া তাকে জানে ইংরেজি কেমন আছে জানতে চাইলো । সোফিয়া জানে যে মেয়েটি সেটা বুঝতে পারবে না । তবে মেয়েটির আরবিতে তাকে কিছু বলল প্রতি উত্তরে । ভাষা না বুঝলেও সোফিয়ার বুঝতে অসুবিধা হল না যে মেয়েটি তার কুশলের জবাব দিচ্ছে । কিভাবে দিচ্ছে সেটা জানে না । আজকে বাজারের সাথে সোফিয়া নিজ পকেট থেকে বাচ্চাটার হাটে একটা চকলেট ধরিয়ে দিল , মেয়েটি নিতে না চাইলেও সোফিয়া হাতের ইশারাতে বলল যে এটা উপহার ।

তারপর কেটে গেছে কিছু দিন । মেয়েটির সাথে সোফিয়ার একটা আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । মেয়েটি ততদিনে ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান ইংরজি বলা শিখেছে । মেয়েটির নামও সে জানতে পেয়েছে । জয়নাব। বাচ্চাটার নামও সে জেনেছে । আরও জেনেছে যে মেয়েটির স্বামী যুদ্ধে মারা পরেছে । সে এখানে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে এসেছে একা ।
সোফিয়ার মনের ভেতরে অনেক দিন থেকেই একটা প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল । সে একদিন জয়নাবকে প্রশ্নটা করেই ফেলল । বলল, তুমি কেন সেদিন টাকাটা ফেরৎ দিতে এসেছিলে । তুমি যদি না ফেরৎ দিতে তাহলে কেউ কোন জানতে পারতো না ।
জয়নাব হেসে বলল, কেউ হয়তো দেখতো না, জানতো না তবে উঁনি ঠিকই দেখতেন । আল্লাহ দেখতেন ঠিকই । তিনি সব দেখেন।

সোফিয়া সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না । এতো কষ্ট এতো দুঃখ সহ্য করেও এই মানুষটার ধর্ম বিশ্বাস উপরওয়ালার প্রতি বিশ্বাস দেখে সোফিয়া সত্যিই অবাক হল ।

উপরের গল্প দৃশ্যটা বানানো তবে এই গল্পের দৃশ্যপট একেবারে বাস্তব । কদিন আগে জার্মানিতে থাকা একজন ভদ্রলোক এই দৃশ্যটি নিজের চোখে দেখেছেন । সেটা লিখেছিলেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে । এই গল্পের উৎস সেখান থেকেই ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 40

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “হি ইজ ওয়াচিং”

  1. তারিক স্যারের স্ট্যাটাস ছিল 😍

Comments are closed.