শুরুটা হয়তো এখানেই

oputanvir
4.8
(61)

নাতাশা নিজের খাবারের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলো । মনে মনে এখনও একটু দ্বিধান্বিত । বারবার মনে হচ্ছে যে আদিবকে এভাবে লাঞ্চে নিয়ে আসাটা মোটেই ঠিক হয় নি । এতে ছেলেটা আরও বেশি প্রশ্রয় পাবে । অবশ্য নাতাশা জানে যে আজকে লাঞ্চের দাওয়াত না দিলেও আদিব কোন ভাবেই তার পিছু ছাড়তো না । ছাড়বে না । নাতাশা নিজেও বুঝতে পেরেছে ভাল ভাবে । এই ছেলে তাকে ছেড়ে যাবে না । আজকে সে কারণটা জানতে এসেছে । আদিব কেন এভাবে ওকে পছন্দ করে । কোন কারণ আছে কি?

নাতাশা আবারও বলল, আপনি কেন আমাকে পছন্দ করেন?
আদিবকে আজকে খুব বেশি খুশি দেখাচ্ছে । এতোদিন পরে মনে হচ্ছে নাতাশা মেয়েটা একটু নরম হয়েছে । অবশ্য নরম না হলেও আদিব কোন ভাবেই হতাশ হত না । নাতাশার পিছুও ছাড়তো না এতো সহজে যে ছাড়তো না । মেয়েটাকে সে এতো ভাল লেগেছে যে কোন ভাবেই এই মেয়েকে ছেড়ে অন্য কোন মেয়েকে ভাল লাগবে না ।

আদিব গ্লাসের পানিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, আপনি দেখতে সুন্দর । ভাল চাকরি করেন । অনেক টাকা মালিক আপনার বাবা । আর কি লাগে বলুন !
আদিব কথাটা এমন ভাবে বলল যে নাতাশা হেসে ফেলল । তারপর বলল, আমাকে কেউ পছন্দ করে না । আমি খুব ভাল করে জানি ।

এই কথাটা অনেকটা সত্য । অফিসে নাতাশাকে খুব একটা মানুষ পছন্দ করে না । বস হিসাবে নাতাশা খুব কড়া । সবাইকে এতো ঝাড়ি দেয় । আদিব নিজেও কত যে বকা শুনেছে । নাতাশার কারণে বেশ কয়েকজন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলেও গেছে । নাতাশা আবার বলল, আমার কিছু সমস্যা আছে আমি জানি । আমি নিজের রাগকে খুব কমই নিয়ন্ত্রন করি । এই কারণে মানুষজন আমাকে এড়িয়ে চলে । আমার খুব একটা বন্ধু বান্ধবও নেই । তারপরেও আপনি আমাকে পছন্দ করেন । কেন? কারণটা আমি জানতে আগ্রহী !

আদিব একটা বড় মাংসের টুকরো মুখে দিতে দিতে বলল, শুনবেনই ?
-হ্যা ।

আদিব কী যেন ভাবলো । তারপর মুখের খাবার টুকু পেটে চালান করে দিয়ে আরও একটু পানি খেল । তারপর বলল, আমাকে তো বাইক চালাতে দেখেছেন ? আমার একটা সাইকেলও আছে । মাঝে মাঝে ছুটির দিনে আমি সাইকেল চালাই । আপনার এখানে জয়েন করার মাস খানেক পরের কথা । একদিন সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি । কোন নির্দিষ্ট জায়গা নয় । এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছি । হাতির ঝিলে যাওয়ার জন্য সিগনাল জ্যামে অপেক্ষা করছি । এমন সময় দেখলাম এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাকে । সত্যি বলতে কি এতো বৃদ্ধ যে কী বলবো । লোকটার জন্য এতো মায়া জমলো । রিক্সা টানতে পারছে কি পারছে না । কেউ তার রিক্সায় উঠে নি সম্ভব । তখনই দেখলাম একজন তার রিক্সায় উঠলো । আমি একটু দুরে দাড়িয়ে ছিলাম । আর মুখে মাস্ক থাকার কারণে আপনি সম্ভবত আমাকে দেখেন নি । আমি সত্যিই কৌতুহল হল । আপনি সব সময় গাড়িতে চলাচল করেন । এখানে হেটে এসে রিক্সায় উঠবেন, বিশ্বাস হল না । একটু তাকাতেই আপনার কালো রংয়ের গাড়িটা আমি দেখতে পেলাম । আপনি গাড়ি থেকে নেমে রিক্সাতে উঠেছেন ।

আদিব কথা বলার সময় নাতাশার দিকে তাকিয়ে ছিল । নাতাশার চোখ তখন খাবারের দিকে । তবে সে কিছুই খাচ্ছে না । কিছু যেন চিন্তা করছে । আদিব আবার বলতে শুরু করলো, আমি কৌতুহল নিয়ে পিছু নিলাম । আপনি রিক্সা করে মগবাজারের দিকে গেলেন । আপনার গাড়িটা আপনার পিছু পিছু আসছিলো । আমিও । আপনি মগবাজার পর্যন্ত গেলেন । তারপর নেমে আবারও নিজের গাড়িতে উঠলেন । আপনি সেদিন রিক্সা ভাড়া বাবত সম্ভবত কয়েক হাজার টাকা দিয়েছিলেন । ব্যাগে যত টাকা ছিল সব তাই না ? কেবল মাত্র রিক্সাওয়ালাকে টাকাটা দেওয়ার জন্য রিক্সাতে উঠেছিলেন ।

নাতাশা একবারও তাকায় নি আদিবের দিকে । এই ঘটনা যে আদিব দেখে ফেলবে সেটা কোন দিন ভাবতে পারে নি সে । আদিব আবার বলল, তবে আমার সব থেকে কোন টা নাড়া দিয়েছে জানেন? আমি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম । আপনার চোখে ঐ বৃদ্ধ লোকের জন্য পানি চিকচিক করছিলো ! একটা অচেনা মানুষের কষ্ট দেখে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। কী অদ্ভুত তাই না ? আমি যখন প্রথম এই অফিসে আসি তখন আপানকে বদরাগি আর বদমেজাজীই ভেবেছি । অথচ সদিন এই বদরাগের ভেতরে একটা কোমল মন খুজে পেলাম । ঐদিন রাতে আমি একটুও ঘুমাই নি । এক ফোটাও না । ভোরের আলো ফোটার পরে আমি খানিকটা আবিস্কার করলাম যে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি । তখনই ঠিক করে নিলাম যে জীবনে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না । যদি আপনি রাজি না হোন তবে আর কাউকে বিয়েই করবো না । কারণ আপনার প্রতি যে ভাল লাগা আমার জন্ম নিয়েছে সেটা আর কারো প্রতি কোন দিন নিবে না ।

কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল । কেউ কোন কথা বলল না । আদিব হঠাৎ বলল, আমার কেন জানি মনে হয় আপনিও আমাকে পছন্দ করেন ।
এবার নাতাশা আদিবের দিকে তাকালো । বলল, বলেছে আপনাকে । আমি কাউকে পছন্দ করি না ।
-না মানে এই যে আমাকে লাঞ্চে নিয়ে এলেন! আমার এতো জ্বালাতন স্বত্ত্বেও আমাকে স্যাক করেন নি । যতই উপরে উপরে রাগ দেখান না কেন আমাকে আপনি ঠিকই পছন্দ করেন । আমি জানি ।
নাতাশা বলল, আপনি ঘোড়ার ডিম জানেন । আপনাকে আজকে লাঞ্চে নিয়ে এসেছি কারণ সত্যটা জানার ছিল । আর এটা এমন কোন আহামরি জায়গা না । অফিসের পাশের একটা দোকান । চলুন লাঞ্চ আওয়ার শেষ । কাজে লেগে যান । আপনি আগে যান আমি আসছি । যান দেরি করবেন না ।
-এক সাথে যাই?
-জি না । এক সাথে যেতে হবে না । আপনার খাওয়া শেষ । এখনই উঠুন ।

আদিব একটু উহা না হু করে উঠে গেল । ওয়েটার বিল নিয়ে একটু পরে । নাতাশা আদিবের চলে যাওয়া দেখলো । মনে মনে একটু হাসলো কেবল । আদিব মিথ্যা বলে নি । আদিবের জন্য একটা সফট কর্নার নাতাশার আছে । এটা তৈরি হয়েছে অনেক আগেই । সম্ভবত সেদিন আদিবের প্রথম কী দ্বিতীয় দিন ছিল অফিসে । অফিসে আসার আগেই আদিবের সাথে দেখা হয়েছিলো রাস্তায় । দেখা হয়েছিলো বলতে নাতাশা দেখেছিলো আদিব কে । একজন বৃদ্ধলোক কোন ভাবেই রাস্তা পার হতে পারছিলো না । কয়েকবার চেষ্টা করেও পারে নি । তখনই দেখলো একটা বাইক রাস্তায় আড়াআড়ি থেমে থেমে লোকটাকে বেরিকেড দিয়ে রাস্তা পার করিয়ে দিল । সামান্য একটা দৃশ্য । তবে নাতাশার এতো ভাল লাগলো দৃশ্যটা দেখে । কিন্তু যখন বাইকটা ওর সামনে সামনে চলতে লাগলো এবং ওর অফিসের পার্কিংয়ে থামলো তখন অবাক না হয়ে পারলো না । আদিব যখন হেলমেটটা খুলল তখন নাতাশা ওকে চিনতে পারলো । তারপর থেকে ছেলেটার প্রতি একটা আলাদা ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে ।

বিল দিয়ে রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বের হতেই দেখলো আদিব দাড়িয়ে আছে হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে । একটা নাতাশার দিকে বাড়িয়ে বলল, খাওয়ার পরে আমি সব সময় আইসক্রিম খাই । নিজের জন্য কেনার পরে মনে হল আপনি দুপুরের খাবার খাওয়ালেন । আপনাকে না দিয়ে খেলে পেট খারাপ করবে ।
নাতাশা অন্য সময় হলে হয়তো রেগে যেত । তবে আজকে হেসে উঠলো । এই ছেলে তাকে যে ভয় পায় না সেটা সে অনেক আগেই বুঝেছে । নাতাশা হাত বাড়িয়ে আইসক্রিমটা নিল । আদিব বলল, আচ্ছা আপনাকে কি তুমি করে বলতে পারি?
-খবরদার না । অফিসে আবার তুমি কিসের?
-আচ্ছা তাহলে অফিসের বাইরে ?
-না ।
-আচ্ছা কেবল ফোনে ?
-না ।
-তাহলে কেবল মেসেজে ?
-বলেছি না । কোন ভাবেই না ।
-আচ্ছা ঠিক আছে । আসলে আপনি তুমিতে কিছু যায় আসে না । মনের টানই বড় টান । তাই না ।
নাতাশা বলল, কোন মনের টান ফান নেই । বুঝেছেন । যান কাজ করুন ।

নাতাশা যদিও বলল চলে যেতে তবে কেন জানি ওর মনে হল আদিব না যাক । বরং ওর মনে হল যে আজকে এখন যখন ওরা অফিসে ঢুকবে তখন যেন সবাই দেখে ওদের । এমনটা ওর কেন মনে হল সেটা নাতাশা নিজেও জানে না । তবে এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে পাশে বকবক করতে থাকা এই ছেলেটাকে সে কোন ভাবেই নিজের থেকে দুরে রাখতে পারবে না আর খুব বেশি দিন ।

এইটা আসলে গল্পই । তবে গল্পটা বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণীত । প্রথম ঘটনার বৃদ্ধ রিক্সা চালকের মত একজনকে সিগনাল জ্যামে আমি দাড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম । হাতিরঝিলে যাওয়ার মুখে । বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার এতোই বৃদ্ধ যে খালি রিক্সাই টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না । মানুষজন তাই তার রিক্সায় উঠে নি সম্ভবত । আমি ঠিক তার পাশেই দাড়িয়েছিলাম । আমি তখন দেখলাম অন্য একটা রিক্সা হতে একজন মেয়ে নেমে এসে বৃদ্ধর জামার পকেটে একটা টাকার নোট গুজে দিয়ে চলে গেল ! মেয়েটার মুখ দেখে একটা বিষাদের ছায়া আমি দেখেছিলাম ! সেই কষ্ট যে এই বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার জন্য ছিল সেটার ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ ছিল না । সেদিন বাসায় এসে গল্প লিখেছিলাম । ঘটনা মনে রাখার জন্যই গল্পটা লেখা । যতবার গল্পটা আমি পড়বো ততবার আমার সেই মেয়েটির কথা মনে পড়বে ! আদিবের ঘটনা অবশ্য একটা ভিডিওতে দেখা । সেখানে এভাবে বাইক আড়াআড়া নিয়ে এক বৃদ্ধকে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েছিলো ছেলেটা !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 61

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →