অসমাপ্ত গল্প ০১

অপু তানভীরের গল্প
4.7
(49)

টিউশনী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই অহীনের ফোন এসে হাজির । আমার মনে হল ও যেন দুরবীন দিয়ে আমার স্টুডেন্টের বাসার দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল । আমি বের হলাম আর ও ফোন করলো । এমনটাই হচ্ছে প্রতিদিন । প্রত্যেকটা দিন ও ঠিক এই সময়েই ফোন করে ।

-হ্যালো !
-হাই ।

আজকে ওর হাই শুনে কেমন জানি মনে হল । ঠিক প্রাণবন্ত মনে হল না । বললাম
-কি ব্যাপার আজকে তোমার কন্ঠ এমন কেন লাগছে ?
-শরীর খারাপ !
-ও !

কি বলবো বুঝলাম না । আমার এখন জিজ্ঞেস করা উচিৎ কি হয়েছে ? কেমন করে হল কিংবা আরও এরকম কিছু কিন্তু কিছু জানতে চাইলাম না । বললাম
-নিজের দিকে লক্ষ্য দেওয়া উচিৎ !
-হুম !

আরও কিছু সময় নিরবতা । তারপর অহীন আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল
-আসবে আমাকে দেখতে ?
-এখন ?
-হ্যা ! আসবে ?

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । মেয়েটার সাথে আমার খুব বেশি দিন পরিচয় না । বেইলি রোডে আমি হাটছিলাম । মাঝে মাঝেই টিউশনীর জন্য আগে আগে চলে আসি, জ্যাম না থাকলে বাস একটু আগে আগে চলে আসে । তখন সময় কাটানোর জন্য এখানে ওখানে হাটা হাটি করি । সেদিনও হাটছিলাম । এমন সময় দেখতে পেলাম একটা ছেলে একটা মেয়ের কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিল । আর মেয়েটা চিৎকার করবে, কি চুপ করে দাড়িয়ে রয়েছে । আমি অবাক হলাম মেয়েটার আচরনে ।

সেই চোর আমার পাশ দিয়ে দৌড় দেওয়ার সময় এক চড় মারলাম । এমনিতে ছোকড়া বয়সে, হালকা পাতলা চেহারা আমার চড় খেয়ে একেবারে উল্টে পড়লো । আমি ব্যাগ তুলে নিয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম
-আচ্ছা মানুষ তো দেখি আপনি ! নিজের ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে চিৎকার করবেন না ?
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না । একবার মনে হল মেয়েটা সম্ভবত কথা বলতে পারে না তবে একটু পরেই মেয়েটা বলল
-চিৎকার করলেই লোকজন ছেলেটাকে ধরে মারধোর করতো !
আমি খানিকটা সময় মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটা বলল
-ছেলেটাকে মারতে মানা করুন প্লিজ !

তাকিয়ে দেখি চোর বেটাকে ততক্ষনে বেশ কয়েকজন মিলে মাইর দেওয়া শুরু করেছে ।
মেয়েটা আমাকে আবার বলল
-্প্লিজ মানা করুন !

খানিকটা বিরক্তি নিয়েই চোরকে মারের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে চলে যেতে দিলাম । চলে যাবো তখন মেয়েটা আমাকে থামালো । আমাকে ধন্যবাদ দিল । তবে তার ব্যাগ উদ্ধারের জন্য না । চোরকে বাঁচানোর জন্য ! আমি আর কিছু না বলে চলে এলাম ।

পরদিন আবারও মেয়েটার সাথে আমার দেখা হয়ে গেল । পরিবাগে নেমে এসে রিক্সার জন্য দাড়িয়ে আছি । কোন রিক্সা নেই । শেষে না পরের হাটা দিলাম । কিছু সময় পরে দেখি একটা কালো রংয়ের নিশান গাড়ি ঠিক আমার সামনে এসে থামলো । পেছনের কাঁচ নেমে গেল একটু পরে । গত দিনের মেয়েটা মুখটা দেখতে পেলাম । আজকে মেয়েটাকে কেমন জানি বেশি সুন্দর মনে হচ্ছিলো । অথবা কালকের থেকে আজকের পরিবেশ ভিন্ন ছিল বলেই হয়তো এমন মনে হচ্ছিলো !
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-হাই । কোথায় যাচ্ছেন ?
-চৌধুরী গলি !
-আসুন নামিয়ে দেই ।
-না ঠিক আছে ! এই তো সামনেই ।
-বুঝতে পারছি সামনে । আসুন ! ভয় নেই আমি আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো না ।

গাড়িতে উঠলাম । তারপর থেকেই মেয়েটার সাথে বেশ কথা হল । কোথায় থাকি কি করি । এই সব । যোগাযোগের জন্য মেয়েটাই আমার ফেসবুক আইডি নিল । তারপর থেকেই নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়ে গেল । ফেসবুক থেকে মেসেঞ্জার তারপর মোবাইল পর্যন্ত পৌছাতেও বেশি সময় লাগলো না।
আস্তে মেয়েটার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম । তাই ওর সাথে মেলামেশাটা একটু যেন বেড়ে গেল । মেয়েটার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই । খানিকটা আমার মতই । আমার বাবা যখন মারা যায় তখন আমি অনেক ছোট । সবে ক্লাস টুতে পড়ি । মায়ের বাবা ভাই মিলে তাকে আবারও বিয়ে দিল আরেক লোকের সাথে । লোকটা যে খারাপ ছিল কিংবা আমাকে মারধোর করতো সেরকমও না তবে আমি কোন দিনই ঠিক তাকে মেনে নিতে পারি নি । একটু বড় হওয়ার পরই আমি হোস্টেলে থাকা শুরু করি । ইন্টারের পর থেকে টিউশনী আর পার্টটাইম চাকরি করে নিজের খরচ নিজে চালাতে শেখার পর ঐ বাসায় যাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম । মা মাঝে মাঝে ফোন দিত । কান্নাকাটি করে আমাকে যেতে বলতো কিন্তু আমি ঐ লোকটা বিয়ে করার জন্য কোন দিন তাকে ক্ষমা করতে পারি নি । নিজের ভেতরেই থাকতাম । একা একা ।
আমার মনে হত অহীনও আমার ব্যাপারে এসব জেনে আমার সাথে কথা বলতো । সমগোত্রীয় মানুষের সাথে মানুষের মিলমিশটা ভাল হয় ! আমার সম্পর্ক চমৎকার যাচ্ছিলো !

কিন্তু গত পরশু দিন সেটা একটু অন্য দিকেই মোড় নিয়েছে । মেয়েটা কেমন করে জানি ঠিক ঠিক যেনে যেত আমি কখন টিউশনী থেকে বের হই । সেই সময়ই ও ফোন দিত । গত পরশু দিনই ও ফোন দিল । তখন সাড়ে নয়টা বাজে । আমাকে বলল
-বাসার দিকে যাচ্ছেন ?
-হুম !
-আমাকে কি এক ঘন্টা সময় দেওয়া যায় ?
-এখন ? কালকে হলে হয় না ? আসলে এখন রাত হয়ে যাচ্ছে তো !
-প্লিজ ! আপনার বাসায় পৌছানোর ব্যবাস্থা আমি করে দিব ।

এরপরে আর কোন কথা চলে না । আমি আর না করতে পারলাম না । আমাকে বেইলি রোডের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজির হতে বলল । গিয়ে দেখি সেখানে আর কেউ পুরো রেস্টুরেন্টে আর কেউ নেই । সময় তখন সাড়ে নয়টার কিছু বেশি । এই সময়ে এমন জায়গাতে লোকজন ভর্তি থাকার কথা কিন্তু এক দম ফাঁকা ।
আমাকে দরজা থেকেই একটা কোর্ট টাই পরা লোক এসে রিসিভ করে নিয়ে গেল । রেস্টুরেন্ট টা আমি আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছি বাইরে থেকে । বেশ হাই-ফাই একটা রেস্টুরেন্ট । এখানকার ওয়েটারেরাও সব ফরমাল ড্রেস পরে থাকে । লোকটা সম্ভবত এখানকার ম্যানেজার ! আর এই লোকটাই আমাকে রিসিভ করে নিয়ে যাচ্ছে ? ব্যাপারটা কেমন যেন লাগলো আমার কাছে ।
আর আমি যখন অহীনের সামনে হাজির হলাম তখন বেশ অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । কারন আজকে অহীনকে অন্য রকম লাগছে । বিশেষ করে আমি ঠিক যে যে জিনিস গুলো পছন্দ করি অহীনের সাজ সজ্জা ঠিক সেই রকম । সব কিছু সাদা ! ধবধবে সাদা কাজিম আর ল্যাগিংস পরেছে সেই সাথে সাদা ওড়না ।

আমার তখনই মনে হল কিছু একটা ঠিক নেই । ও আজকে অন্য কিছু বলবে । আর বললও তাই । ও আমাকে বিয়ের কথা বলল । বলল যে ওর কষ্ট টা আমি খুব ভাল করেই বুঝবো । আসলে সত্যি কথা হল আমি নিজেও ব্যাপারটা খুব ভাল করেই জানি যে অহীন যেমন আমার কথা গুলো আমার কষ্টের কথা গুলো খুব সহজেই বুঝতে পারতো আমি ঠিক সেই রকমই বুঝতে পারতাম । কিন্তু তবুও আমি খানিকটা নিজেকে দুরে রাখতে চাইতাম ওর কাছ থেকে । কারণ অহীনকে দেখেই এটা পরিস্কার ছিল যে ওর বাবা বেশ অবস্থা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন । আর আমার কথা আমি নাই বললাম ।

আমি কোন কথা বলছি না দেখে অহীন বলল
-কি তুমি রাজি না ? রাজী না হলেও সমস্যা নেই । তবে প্লিজ আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবে না । কারণ আমি যখন তোমার সাথে কথা বলি কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে নিজের কাছে । যা অন্য কারো সাথে হয় না ! আমি এটা হারাতে চাই না !
আমি ওকে কথা দিলাম যে আমাদের ভেতরে যোগাযোগ বন্ধ হবে না !

তারপর যদিও মনের ভেতরে খানিকটা অস্বস্থি কাজ করছিলো তবে সেটা ওকে বুঝতে দিলাম না । এভাবেই ওর সাথে যোগাযোগ হত । আজকেও যখন বের হলাম তখনও ও ফোন দিল । আমাকে আসতে বলল ওর বাসায় ! আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম
-কোথায় তোমার বাসা ?
আমি তখন টিউশনী থেকে বের হয়ে হাটতে শুরু করেছি । হাটতে হাটতেই কথা বলছি । একটা সময় অহীন আমাকে হঠাৎ করেই থামতে বলল । এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সেটা ফোন থেকে বলে নাই । আওয়াজটা এসেছে পাশে বিল্ডিং থেকে ।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম পাশের বাসার একতলা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় অহীন দাড়িয়ে আছে । আমি এবার আসল রহস্যটা ধরতে পারলাম যে অহীন কিভাবে আমাকে টিউশনী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে ফোন দিতো । এটা অহীনের বাসা ?
আমি যখনই এখানে টিউশনীর জন্য আসতাম তখনই ভাবতাম ঢাকার এমন একটা জায়গাতে একতলা বাসায় কে থাকতে পারে ?

বারান্দায় কাছে গিয়ে দাড়ালাম ! বারান্দায় মৃদু আলোতে অহীনের দিকে তাকিয়ে মনে হল মেয়েটার শরীর খারাপ । বারান্দার গ্রীল ধরে দাড়িয়ে আছে । ওর চেহারা দেখেই মনে হল ওর শরীর বেশ খারাপ । দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে যেন । আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো । তারপর বলল, এসো …..

আমি খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বাড়িটার দিকে হাটা দিলাম । কোন দিন এই বাড়িতে আমি ঢুকতে পারবো সেটা আমি ভাবি নি । এটা যে অহীনের বাসা হবে সেটাও না ।

কতদিন আগে যে এই গল্পটা লিখেছিলাম সেটা আমার মনেও নেই । ৪/৫ বছর আগে তো হবেই । লেখাটা এই পর্যন্ত লিখে বন্ধ করেছি আর লেখা হয় নি । আর লেখা হবেই না সম্ভবত ….

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 49

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →