ছেলেমানুষী প্রতিশোধ

oputanvir
4.6
(68)

ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে একটু অস্থিরবোধ করলো নীলিমা । যতই কাজে মন দিতে চাচ্ছে কিন্তু বারবার ঘুরে ফিরে মাহিরের চেহারাটা বার বার ভেসে উঠছে । বারবার ওর হাস্যজ্ঝল চেহারাটা চোখের সামনে ফুটে উঠছে । কাল সারা রাত ও একদম শান্তিমত ঘুমাতে পারে নি । বার বার কেবল মনের ভেতরে একটা তিক্ত না পাওয়ার বেদনা ফুটে উঠেছে । নিজের কৃত কর্মের জন্য নিজেকে দোষারোক করেছে বারবার । আজকে মাহির ঐ হাসিটা ওর দিকে তাকিয়ে দিতো যদি সেদিন মাহিরকে ওভাবে ছেড়ে না যেত । জীবনের মোড়টা ঘুরে যাবে সে কোন দিন ভাবতে পারে নি । একটা অচেনা কষ্ট এসে ভর করেছে ওর ভেতরে । কিছুতেই সেটা মন থেকে দুর করতে পারছে না ।

জীবনে একটা বড় ভুল সে করেছে । সেটা সে মেনেও নিয়েছিলো কিন্তু তাই বলে মাহির কে কেন ওর জীবনে আবার আসতে হবে ? কেন আবার পুরানো কষ্টটা জেগে উঠতে হবে ! রায়হানের সাথে ওর বিয়েটা সুখের হয় নি । যে টাকা পয়সা আর নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য রায়হানকে সে বিয়ে করেছিলো সেসবই সে পেয়েছে কিন্তু তারপরেও সে সুখী হয় নি । রায়হান নিজের কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝে না । রায়হানের কাছে নীলিমা কেবল একটা দেহ ছাড়া আর কিছু না । শারীরিক চাহিদা মেটানো ছাড়া রায়হান ওর কাছে আর কিছুই চায় না। কোন চেষ্টাও করে না । সপ্তাহ নিয়ম করে ঘনিষ্ঠ হয় তারপর ঘুমিয়ে পরে । সকালে অফিস যায় । রাতে ফেরে । খেয়ে দেয়ে ঘুম । এই হচ্ছে রায়হানের জীবন । এই চার বছরেই নীলিমা একেবারে হাফিয়ে উঠেছে যেন ।

নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যই এই অফিসে জয়েন করেছিলো । কাজও চলছিলো বেশ ভালই । তখনই আবারও মাহির ওর জীবনে এসে হাজির হল । গতকালকে অফিস থেকে বের হয়ে সিড়ির উপরে দাড়িয়ে ছিল । কোন দিকে যাবে এই ভাবছিলো ঠিক সেই সময়েই সে মাহিরকে দেখতে পায় । ওদের অফিসের সামনে এসে হাজির হয়েছে । কাউকে যেন খুজছে । চার বছর পরে মাহিরকে দেখছে । তবে চিনতে একদম ভুল হয় নি । দেখতে আগের থেকে আরও সুন্দর হয়েছে । পোশাক পরিচ্ছদে আরও পরিপাটি হয়েছে । বাইক কিনেছে নতুন । আগের বাইকটা নয় এটা । সেই বাইকে নীলিমা কত চড়েছে । ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় সেই বাইকেই কাটিয়ে দিয়েছিলো দুজন ! পুরানো আমলের একটা হোন্ডা । মাহিরের ছোট মামার বাইক ছিল সেটা । ছোট মামা হঠাৎ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় সেটা ওর হাতে চলে এসেছিলো !

নিজেকে একটু লুকিয়ে ফেলল থামের আড়ালে যাতে মাহির ওকে দেখতে না পারে । তবে মাহিরের দিকে চোখ রাখলো ঠিকই । বারবার কেবল মনে হতে লাগলো যে মাহির এখানে কি করছে ? কার সাথে দেখা করতে এসেছে সে ?
উত্তরটা পেয়ে গেল কিছু সময়ের ভেতরে । রিদি ম্যাডামকে দেখতে সে । মাহির কাছে গিয়ে দাড়ালো । মাহির কেমন হেসে হেসে কথা বলছিলো । রিদিও তাই । তারপর রিদি উঠে বসলো বাইকে । বাইকটা বের হয়ে গেল গেট দিয়ে । অনেকটা সময় ভেসে রইলো চোখের সামনে দৃশ্যটা । কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারলো না সেটা । যখন বাসায় যাওয়ার জন্য সিএনজিতে উঠেছে কেবল অনুভব করলো যে ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ।
এতো দিন পরে মাহিরকে দেখার জন্য ?
নাকি মাহির অন্য কোন মেয়ের সাথে সুখে রয়েছে এই জন্য ?

লাঞ্চ আওয়ার শুরু হতেই নীলিমা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ক্যান্টিনের দিকে । রিদি রহমান হচ্ছে ওদের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ । তার আন্ডারেই নীলিমা কাজ করে । মেয়েটা এমনিতে ভাল বেশ । ওর থেকে বড় হবে কয়েক বছরের । মাহির সমান হবে । কিংবা একটু বড় ।

ক্যান্টিনে পাওয়া গেল রিদিকে । এক কোনাতে বসে হটপট বের করে খাবার খেতে ব্যস্ত । মোবাইলের দিকে চোখ । রিদির সামনের গিয়ে নীলিমা বলল, বসবো আপু ?
রিদি মুখ তুলে তাকালো । তারপর একটু হেসে বলল, আরে বস বস । লাঞ্চ করেছো ?
-এই তো আপু করবো।
-ওকে ওকে বস । শেয়ার কর আমার সাথে ।
-না না আপু ঠিক আছে । আমার সাথে খাবার আছে ।
-আরে আছো তো বুঝলাম । আমার থেকে নাও । বাসার খাবার ।

নীলিমা দেখলো হটপটের ভেতরে পরোটা আর খাসির মাংস ভুনা করা । দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে রান্না ভাল হয়েছে । তখনই মনে হল রান্নাটা মাহিরের । মাহির ভাল রান্না জানতো । ওকে কতবার খাইয়েছে রান্না করে । কৌতুহল দমাতে না পেয়ে এক টুকরো মুখে নিল সে । এবং সাথে সাথেই বুঝতে পালরো যে রান্নাটা মাহিরের । এতো বছর পরেও মাহিরের হাতের রান্না একদম ভুলে যায় নি সে ! বুকের ভেতরে আবারও খচ করে উঠলো । তাহলে কি রিদিকে বিয়ে করে ফেলেছে মাহির ?
অফিসে নীলিমা নতুন । কলিগদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এখনও সে খুব একটা কিছু জানে না । রিদি রহমান বিবাহিত কিনা সেটা সে জানে না ।

টুকটাক খেতে খেতে ওরা এটা ওটা নিয়ে গল্প করতে লাগলো । নীলিমা এক সময় বলল, কালকে আপনাকে মাহির ভাইয়ার সাথে দেখলাম ।
রিদি অবাক হয়ে বলল, তুমি মাহিরকে চেনো নাকি?
তারপর নিজেই যেন কি একটা মনে পড়লো এমন ভাব করে বলল, ওফ ! দেখছো আমি ভুলেই গিয়েছিলো তোমার আর ও একই ভার্সিটি । তুমিও ওর মত আইআর এ পড়তে । ওর জুনিয়র । ওকে চিনতেই পারো ! হ্যা মাহিরই ।
-বয়ফ্রেন্ড ?
রিদি একটু হাসলো । তারপর, বয়ফ্রেন্ড ! আরে বোকা মেয়ে এখন কি আর বয়ফ্রেন্ডের বয়স আছে ! হাসব্যান্ড !

নীলিমার বুকের ভেতরে আবার কেউ যেন একটা ছুরি চালিয়ে দিল । রিদি খাবার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওরই রান্না । বউ হয়েছি আমি অথচ ও আমাকে রাত দিন নানা রকম রান্না করে খাওয়ায় ।
নীলিমা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আপনাদের কিভাবে পরিচয় ?
-আরে ও তো আগে এখানেই জব করতো । একই সাথে কাজ করতাম আমরা । তারপর এক সময় ঘনিষ্ঠতা হল !
-ভাইয়া খুব কেয়ারিং । তাই না?
-তা আর বলতে । আসলে যখন বন্ধুত্ব হল তখনই টের পেয়েছিলাম যে ছেলেটা একটু বেশি সেনসেটিভ ! একটু ইমোশনাল । যখন ওকে আকড়ে ধরলাম অদ্ভুত ভাবে আবিস্কার করলাম যে রত্ন আমি পেয়েছি । তারপর ওর বাংলাদেশ ব্যাংকে জবটা হয়ে গেল । আমাদের বিয়ের কয়েক দিন পরেই অফার লেটার এসেছিল । ও বলে দিল আমাকে ছেড়ে যে ওখানে যাবে । এখানেই জব করবে । এতো টাকা পয়সা দিয়ে হবে কি ! শেষে আমি ধমক দিয়ে পাঠিয়েছি । এই যে দেখো কালকে আমার একটু মাথা ঘুরছিলো দুপুরের দিকে । এই কথা ওকে বলতেই জনাব বাইক নিয়ে হাজির আমাকে নিতে । আজকে নিজে রান্না করেছে সকালে উঠে । আমাকে পৌছে দিয়ে অফিস গেছে আবার বিকেলে আসবে !

নীলিমা কেবল তাকিয়ে ছিল রিদির দিকে । কথা গুলো বলার সময় রিদির চোখ মুখে কেমন আনন্দে ঝলমল করছিলো । নীলিমা আর কিছু বসলো না । উঠে গেল । অফিসের ওয়াশ রুমে ঢুকলো । কেন জানি ওর খুব বেশি কান্না আসতে লাগলো । সেটাই আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে !

ক্যাম্পাসে তিন বছরের জুনিয়র ছিল নীলিমা মাহিরের । ফার্স্ট ইয়ার পার করতেই ওদের প্রেম হয় । মাহির আসলেই এমন ছেলে ছিল যে তাকে পছন্দ করতেই হয় । বিশেষ করে খুব বেশি কেয়ারিং তবে পজেসিভ না । চুটিয়ে প্রেম করেছে ওরা । নীলিমার অনার্স শেষ হওয়ার আগেই ওর জন্য বিয়ের প্রোপোজাল আসতে শুরু করে । এমন একটা প্রোপোজালে বাড়ির সবাই রাজি । সত্যি বলতে কি নীলিমা নিজেও রাজি ছিল । বেশ ভাল চাকরি ছেলেটার । ইঞ্জিনিয়ার । বেসরকারি জব হলেও বেতন বেশ ভাল । রাজি হয়ে গেল সে । ওর কাছে তখন নিশ্চিত জীবনের হাত ছানি ।

মাহির খবরটা শোনার পরে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলো । বলেছিলো যে ওকে কয়েক দিন সময় দিতে । একটা চাকরি সে করছে । এর থেকে ভাল চাকরি সে জোগার করবে । মাহির যদিও চাকরিতে ঢুকেছিলো তবে সেটা খুব একটা ভাল ছিল না । বেতনও খুব বেশি না । ওর হবু বরের সামনে তো কিছুই না ।

কিন্তু আজকে ! মাহির ঠিকই ভাল একটা চাকরি জোগার করে নিয়েছে । ও যদি এই সময়টা মাহিরের সাথে থাকতো তাহলে রিদির মত এই ঝলমলে আনন্দময় মুখ নিয়ে অন্য কারো কাছে মাহিরের গল্প করতে পারতো !

দুই
পাতলা কম্বলটা রিদির গায়ের উপর তুলে দিতে দিতে মাহির বলল, আজকে শরীরে ভাল তো । কালকের মত কিছু মনে হচ্ছে না তো?
রিদি বলল, হ্যা খুব মনে হচ্ছে ।
-তাই নাকি?
রিদি হেসে ফেলল । তারপর বলল, এতো চিন্তা কেন কর শুনি? আমি কি বাচ্চা ?
মাহির কোন কথা বলল না । নিজেও কম্বলের ভেতরে চলে এল । রিদি বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
-কর?
-ডু ইউ মিস ইয়োর এক্স?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-আহা বল না?
-এক সময় করতাম । মিথ্যা বলবো না । তবে তুমি যেদিন থেকে আমার জীবনে এলে । আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম যে তুমি ছাড়া আর এখন কারো দরকার নেই আমার । কারো না । ওর কথা মনেও পড়ে না আমার । হ্যা এক সময় কাছের ছিল । তবে সেটা অতীত । হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন শুনি ?
রিদি একটু দুষ্টামির হাসি দিয়ে বলল, তোমার এক্স এখন আমার নিচে কাজ করে !
-কি! সত্যিই নাকি?
-হুম !
মাহির একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিদির দিকে । রিদি বলল, আমাকে অফিসে কদিন আগেই কর্মী নিয়েছে । সেখানে সে এপ্লাই করেছে । সিভিতেই আমি চিনেছি । তুমি তো তার কথা বলেছো । প্রথমে ভাবলাম বদটাকে চাকরি দেব না ।
-তারপর?
-তারপর মনে হল না, চাকরি দেব এবং এখানেই তাকে মজা বুঝাবো?
-কেন খুব বেশি প্যারা দাও নাকি?
-আরে না । তার সাথে আমি খুব ভাল ব্যবহার করি।
-তাহলে প্যারা দাও কিভাবে?
-সেটা তোমাকে বলবো না । তবে আমি জানি সে রাতে শান্তিমত ঘুমাতে পারবে না আর !
মাহির হাসলো । বলল, তুমি বাচ্চাই রয়ে গেলে ।
-তোমাকে সে কষ্ট দিয়েছে । একটু প্যারা তো দিতেই হবে ।
-কস্ট দিয়েছে বলেই তোমার কাছে এসেছি । আর ওর ভাল থাকার ইচ্ছে ছিল । সবারই এই ইচ্ছে থাকে ।
-ভাল থাকার ইচ্ছে থাকা অন্যায় না । কিন্তু একজনকে স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝ পথে হাত ছেড়ে দেওয়া অন্যায় । ঘোর অন্যায় ।
-আচ্ছা ঠিক আছে বাবা । অন্যায় । আসো ঘুমানো যাক । ওর কথা চিন্তা করে আমাদের মুভ অফ করার কোন মানে নেই ।
রিদি বলল, আরে শোনো না, আজকে যখন আমি তোমার কথা বলছিলাম তখন ওর চোখে কী যে একটা বেদনার ছাপ দেখতে পেয়েছি । দেখে এতো ভাল লাগলো । আমি নিশ্চিত সে স্বামীর সাথে সুখে নেই ।
-কিভাবে জানো?
-জানি । মেয়েরা জানে । শোনো এই কদিন আমার অফিসে নিয়মিত যাবে । কেমন ? আগামীকাল লাঞ্চ আওয়ারে যাবে । তাহলে মজা হবে খুব !
মাহির হাসলো । তারপর বলল, তুমি আসলেই ছেলেমানুষ ।
-হলাম ! এই ছেলেমানুষী খেলাটা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে খেলতে চাই ।

মাহির রিদির চোখে মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারলো সে আসলেই খুব মজা পাচ্ছে । আরও কি কি করবে সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে রিদি এক সময়ে চুপ করে গেল । ঘুম চলে আসছে ওর !

নীলিমার কথা সে এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলো । রিদির প্রভাব ওর জীবনে এখন এতোই প্রবল যে অন্য কোন মেয়ে সেখানে আসতেই পারে না । নীলিমার জন্য ও মাহিরের মন খারাপ হল? নিজের মনকে প্রশ্ন করলো সে ? ততক্ষনে রিদি ঘুমিয়ে পড়েছে । বাইরে থেকে আলো এসে রিদির মুখের উপরে পড়েছে । রিদির ঘুমন্ত চেহারা দেখে মাহিরের কেবল এই কথাই মনে হল যে রিদি ছাড়া এখন ওর জীবনে আসলেই কেউ নেই । নীলিমা এক সময়ে ছিল বটে ওর জীবনে তবে সেটার কোন মূল্য এখন মাহিরের কাছে নেই । নীলিমা ভাল থাকুক কি মন্দ থাকুক তাকে ওর কিছুই যায় আসে না ।
রিদির কপালে একটা ছোট চুমু খেল মাহির । কালকে রিদির অফিসে যাবে ঠিক করলো সে । রিদির ছেলেমানুষীতে সেও যোগ দিবে ! তারপর ওকে খানিকটা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 68

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

3 Comments on “ছেলেমানুষী প্রতিশোধ”

Comments are closed.