নীরা কি আসবে?

4.7
(68)

নীরা কি আসবে?
এই প্রশ্নটা নিজের মনের ভেতরে বার বার দোল খাচ্ছিলো । মনে হচ্ছিলো যে মেয়েটার ঘৃণা সম্ভবত আমার প্রতি অনেক বেশি তাই সে নাও আসতে পারে । আবার আসতেও পারে । হয়তো সে আমাকে উপহাস করার আরেকটা সুযোগ ছাড়বে না । একবার মনে হয়েছিলো যে মেয়েটার মুখো মুখি আর না হই, মেয়েটা যে ভুল ধারণা নিয়ে আমাকে অপছন্দ করে সে করুন । কিন্তু তারপর মনে হল শেষ একবার দেখা করি তার সাথে । একজন মানুষ আমাকে অপছন্দ করে এমন একটা কারণে যেটা আমি করি নি । মেয়েটার ভুল ভাঙ্গানো দরকার ! নয়তো আমার নিজের মনের ভেতরেই একটা অশান্তি রয়েছে যাবে ।

নীরার বিয়ে ঠিক হয়েছে । গত সপ্তাহে তার বিয়ের কার্ড আমার অফিসে এসে পৌছিয়েছে । ব্যাপারটা আমাকে একটু অবাক না করে পারে নি । সময়ের গ্যাপটা কিন্তু খুব কমও না । প্রায় দুই বছর । এই দুই বছর মেয়েটা আমাকে মনে রেখেছে । কিন্তু আমি যখন ছেলের নাম দেখলাম এবং ছেলের ব্যাপারে খোজ খবর নিলাম তখন মনের ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতি জন্মালো । আমি যে প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করি, ছেলেটাও ঠিক একই ব্যাংকে চাকরি করে এবং আমার থেকে উপরের পোস্টে । ব্যাপারটা জানার পর থেকে একটু অশান্তি কাজ করলো আমার ভেতরে । আমার কেন জানি মনে হল নীরা এমনটা ইচ্ছে করে করেছে । নীরা এতো মানুষ থাকতে বেঁছে বেঁছে আমার ব্যাংকে চাকরি করা ছেলেকেই কেন বিয়ে করবে?

মনের ভেতরে তখনই একটা সুক্ষ ভাবনা ফিরে এল । আমার কাছে মনে হল যে নীরা এটা করেছে আমাকে এটা বুঝানোর জন্য যে চাইলে সে আমার থেকে ভাল কাউকে বেঁছে নিতে পারে । সেটা দেখানোর জন্যই সে এমনটা করেছে । আমার দুই বছর আগের কথা মনে পড়লো । নীরার সাথে আমার বিয়ের কথা বার্তা প্রায় পাঁকা হয়ে গিয়েছিলো । শেষ সময়ে আমি তাকে মানা করেছিলাম । কেন মানা করেছিলাম সেটার পেছনে অবশ্য একটা কারণও আছে । নীরা সম্ভবত সেই কারণটা জানে না । সে আমাকে ভুল বুঝে বসে আছে !

নীরাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলাম । বুকের ভেতরে সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে এল । এতো দুই বছরে মেয়েটা যেন আরও বেশি সুন্দর হয়েছে । এতো দিনে আমাদের এক সাথে থাকার কথা ছিল । আমরা হয়তো এমন দিনে এক সাথে ঘুরতে বের হতাম ।

নীরা আমার সামনে বসতে বসতে বলল, রাশেদ সাহেব । কেমন আছেন?
-জ্বী ভাল । তুমি কেমন আছো?
-আমি ভাল আছি । খুব ভাল আছি !
-অর্ডার দেই?
-আপনি কি আমাকে কফি খাওয়ার জন্য কেবল ডেকেছেন ? নাকি অন্য কিছু বলবেন ?

আমি নীরার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে একটা তীব্র উপহাসের হাসি । সে আমার এই অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছে যেন । আমি বললাম, না কিছু বলার আছে !
-তাহলে বলুন । খাওয়ার দাওয়ার দরকার নেই ।
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম । তারপর বললাম, তুমি আমাকে খুব বেশি ঘৃণা কর । তাই না ?
-ঘৃণা ! আপনাকে কেন ঘৃণা করবো বলুন ! আপনি কে ? আপনাকে চিনি আমি?

আমি জানি কথা টা সত্যি না । তারপরেও কথাটা বুকের ভেতরে বিধলো বেশ ভাল ভাবেই । আমি চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । তারপর বললাম, আমি যে কথাটা এখন তোমাকে বলব হয়তো তোমার কাছে কোন অর্থ বহন করবে না । তবে কথা টা বললে হয়তো আমাকে যে কারণে অপছন্দ কর, সেটা করবে না আর । এই কারণে আজকে তোমাকে ডেকেছি আমি !

নীরা শান্ত চোখে তাকালো আমার দিকে । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নীরা বলল, বলুন । শুনি আপনার কথা !
-তোমাকে আমি প্রথম দেখি তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে । আমার এক বন্ধু তোমাদের স্যার । তার মাধ্যমে তোমার খোজ খবর আমি বের করি । কোন ঘটক আচানক ভাবে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই নি । গিয়েছিলো আমার পছন্দের ভিত্তিতে !

এই কথাটা শোনার পরে দেখলাম নীরা একটু চমকালো ! বলল, মানে?
-হ্যা । আমি তোমাকে প্রথম করি এবং আমার আগ্রহেই আমার বাসার লোকজন তোমার বাসায় যায় । কিন্তু প্রসেসটা এমন হয়েছিলো যে মাঝ থেকে আমাদের কেউ দেখা করিয়েছে । আমার পরিবারের সবার তুমি খুব পছন্দ হয়েছিলে । তুমি এমন একজন যে তাকে কেউ অপছন্দ করতেই পারে না !

নীরা তীব্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । বোঝার চেষ্টা করলো যে আমি মিথ্যা বলছি কিনা ! নীরা বলল, দ্যান হোয়াই ডিন ইউ রিজেক্ট মি?
আমি জোরে করে একটা দম নিলাম । তারপর বলল, যেদিন তোমাকে বাবা মা দেখে এল তার পর দিন অফিসে হঠাৎ একজন আমার সাথে দেখা করতে এল । নাম বলল নাফি । সে আমাকে জানালো যে সে তোমার বয়ফ্রেন্ড । একটা ছবিও দেখালো তোমার সাথে । তারপর অনেক কান্নাকাটি করলো। আমি যেন তোমাকে না বিয়ে করি । তাহলে তুমি আর সে দুজনেই নাকি সুইসাইড করবে ! দুজন দুজনকে ভাল বাসো অনেক দিন থেকে !

নীরাকে দেখলাম বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি বললাম, সত্যি বলতে কি সেদিন খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম । পছন্দের মানুষ যখন অন্য কাউকে ভালোবাসে তার থেকে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না । সত্যিই পারে । কতবার মনে হল দরকার নেই এসব ভাবার । আমি তো আমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারিই চাইলে । কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিলো তুমি তো আর আমাকে পছন্দ কর না । আমি যদি সব জানার পরেও তোমাকে বিয়ে করি তাহলে বউ ঠিকই হবে আমার কিন্তু আমাকে কি ভালোবাসতে পারবে কোন দিন !
নীরা তীব্র কন্ঠে বলল, নাফি কোন দিন আমার বয়ফ্রন্ড ছিল না । সে আমার পেছনে ঘুরঘুর করতো !
-হ্যা । এটা আমি বছর খানেক পরে জানতে পেরেছি । জানার পরে কতবার যে মনে হয়েছে তোমার কাছে যাই । কিন্তু কোন মুখ নিয়ে যাবো বল ! আর যেতে পারি নি ।
-তাহলে আজকে কেন এলেন?
-কারণ তুমি বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছো । আমার কাছে কেবল মনে হয়েছে যে তুমি হয়তো আমাকে এখনও ঘৃণা কর !
-ইয়েস আই হেইট ইউ । আপনার কারণে সেদিন নিজেকে এতো ছোট মনে হয়েছিলো ।
-এই জন্য আমারই ব্যাংকে চাকরি করা আমার থেকে ভাল কাউকে বিয়ে করছো !
-ইয়েস । আমার বিয়ের শর্তই ছিল না । ছেলে যেমনই হোক ছেলে যেন এই আপনার ব্যাংকে চাকরি করে এবং আপনার উপর পোস্টে হয় !

আমি হাসলাম । তারপর বলল, আই ডিজার্ভ ইট । আমার তোমার সাথে একবার কথা বলার দরকার ছিল । তাহলে হয়তো এমন কিছু হত না !
নীরা কথার জবাব দিল না । আমি বললাম, আমাকে ঘৃণা করো না কেমন ! আমি আর কিছু চাই না ।

কিছু সময় চুপ করে রইলাম আমরা দুজনেই । নীরা হঠাৎ বলল, একটা সত্যি কথা বলবেন ?
-বল ?
-আপনি এখনও বিয়ে কেন করেন নি?
আমি নীরার দিকে তাকলাম কেবল । জবাব দিলাম না । তবে নীরা যা বুঝে নেওয়ার বুঝে নিল । উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল, অনেক দেরি হয়ে গেছে রাশেদ সাহেব !
-আমি জানি !
-আচ্ছা আমি আসি । ভাল থাকবেন !
-তুমিও । উইস ইউ এ হ্যাপি ম্যারেড লাইফ !

নীরা আমার চোখের দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর উঠে চলে গেল । আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে । ভেবেছিলাম দরজার কাছে গিয়ে একবার হলেও আমার দিকে ফিরে তাকাবে কিন্তু তাকালো না । কাঁচ ঠেলে বের হয়ে গেল । বুকের ভেতরে এমন একটা হাহাকারের অনুভূতি জেগে উঠলো যেটা কোন ভাবেই আমি ভাষার প্রকাশ করতে পারবো না ।

আরও কিছু সময় বসে রইলাম রেস্টুরেস্টে । তারপর নিজেও বের হয়ে গেলাম । হতাশ লাগলেও এই ভেবে ভাল লাগছিলো যে নীরা অন্তত আর আমাকে ঘৃণা করবে না । বাসায় পৌছালাম বেশ রাত করেই । এতো সময় রাস্তায় রাস্তাু ঘুরে বেড়ালাম কেবল ।

দরজায় কলিং বেল চাপ দিয়ে অপেক্ষা করছি । দরজা খুলে গেল । এবং তখনই ধাক্কাটা দেখলাম !
নীরা দাড়িয়ে রয়েছে । সন্ধ্যাতে যে পোশাকটা পরে ছিল সেটাই পরে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এতো সময় কোথায় ছিলেন শুনি?
আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না । নীরা বলল, কি হল ?
-তুমি?
-হ্যা আমি । কোন সমস্যা ?
-না সেটা না । তুমি এখানে কেন ?
-এখন থেকে আমি এখানেই থাকবো ।
-মানে ?
-এতো মানে মানে করবেন না । আসুন ভেতরে ।

ভেতরে ঢুকে যা জানতে পারলাম তার সারমর্ম হচ্ছে নীরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে তার বাসায় ফোন দিয়েছে । বলেছে যে সে বিয়ে করবে না । এটা শুনে নাকি ওর বাবা খুব রেগে গিয়েছে । এখন নীরা কোন ভাবেই বাসায় যেতে পারবে না । বাসায় গেলে তার বাবা তাকে ঠিকই জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে ঐ ছেলের সাথেই । অন্য কোন বন্ধুর বাসায় যে লুকিয়ে থাকবে সেটাতেও কাজ হবে না । তার বাবা ঠিক ঠিক খুজে বের করে ফেলবে বিয়ের আগে ।
তাই সে সোজা চলে এসেছে আমাদের বাসায় । বাবা মাকে সব খুলে বলেছে । বাবা মা তো আমাকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে গেলেছিলো । আর নীরাকে তাদের পছন্দ ছিল খুব । আমি মানা করাতে তারা বেশ অবাক হয়েছিলো । এখন আসল কারণ জানতে পেরে তারাও রাজি হয়ে গেলেন ।

একটু পরে কাজীকে ডেকে আনা হল । ঐদিন রাতেই বিয়ে হয়ে গেল আমাদের । আমি আসলে তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম যে নীরার সাথেই বিয়ে হয়েছে আমার । আমি বরাবরই ভাবছিলাম যে ওর সাথে দেখা করা ঠিক হবে কিনা ! যদি না করতাম তাহলে আজকে কি এটা হত !

পরিশিষ্ঠঃ
বাসর রাত বলতে আমার ঘরে নীরা ঘুমাতে এল খুব স্বাভাবিক ভাবে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শোনা তোমাকে বিয়ে করেছি তার মানে এই না যে তোমাকে আমি এতো সহজে ছেড়ে দিবো । এই দুটি বছর তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি । তোমাকেও এতো পরিমান কষ্ট দিবো তারপর !
আমি বললাম, আমি সুখে ছিলাম ?
-তা আমি জানি না । সব কিছুর শোধ তুলবো তারপর …. এই এই কাছে আসো কেন শুনি? নো কাছে আসাআসি ! আমি যতদিন অনুমতি না দেব ততদিন কাছে আসা যাবে না !

তবে সেটা অবশ্য খুব বেশি সময় টিকলো না । রাতে নীরাকে দেখলো আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠতে । যেন অনেক দিন পরে খুব কাছের কাউকে সে আবার ফিরে পেয়েছে । ফোঁপাতে ফোঁপাতেই নীরা বলল, জানো তোমাকে ছাড়া জীবনে আর কাউকে পছন্দ করি নি কোন দিন । যেদিন থেকে তোমার আমার বিয়ের কথা বার্তা চলা শুরু করলো সেদিন থেকে কেবল তোমাকে আমি নিজের মনের ভেতরে বসিয়েছি । আর কিছুতেই বের করতে পারি নি ।
-তাহলে কেন বিয়ে করতে যাচ্ছিলে?
-রাগ থেকে । যাকে ভালবাসা যায় তাকে ঘৃণাও করা যায় ! বুঝেছো !
-বুঝলাম । ভাগ্যিস তুমি কার্ডটা পাঠিয়েছি নয়তো কোন দিন তোমার সাথে কথা বলা হত না । আর হয়তো এভাবে আমাদের কাছে আসাও হত না !
-আমাদের মিলন লেখা ছিল বুঝলে । এভাবে না হোক অন্য ভাবে হতই !

আমার এখন তাই মনে হচ্ছে । আমার এভাবে এক হওয়াটা লেখা ছিল !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 68

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →