নেকড়ের চোখ

oputanvir
4.3
(44)

নীলার খুব কান্না আসতে লাগলো । দুই হাত দিয়ে কুকুর ছানাটাকে যত্ন করে ধরে তোলার চেষ্টা করতেই সেটা কুই কুই করে উঠলো ব্যাথায় । সেটা দেখে নীলা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না । মানুষ কিভাবে এমন করে একটা অবলা প্রাণীকে আঘাত করতে পারে বিনা কারণে । ইস, বাচ্চাটা কেমন করে কষ্ট পাচ্ছে ।
নীলা এখন কী করবে?
কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?
আশে পাশে কোন পশু ডাক্তারকে সে চেনে না । ওর বাড়ির কাছেই একজন ডাক্তার আছেন অবশ্য তবে সে তো মানুষের ডাক্তার । এই পশুটাকে সে কি দেখবে ?

বাসায় নিয়ে গেলে ওর বাবা মা বকবে ওকে । বাড়তি ঝামেলা মনে করবে । নীলা ঠিক করলো একবার নিয়ে যাবে সেই ডাক্তার ভাইয়ার বাসায় । ডাক্তার ভাইয়াটা নতুন এসেছে পাড়াতে । সদ্য বিসিএস দিয়ে ওদের উপজেলা কমিউনিটি হাসপাতালে জয়েন করেছে । থাকার জন্য ওদের এলাকাতেই একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছে ।

নীলা আর চিন্তা করলো না । নিশ্চয়ই ফেলে দেবে না বাচ্চাটাকে এভাবে । কিছু তো করবেই । নীলা খুব যত্ন করে বাচ্চাটাকে কোলে নিল । তারপর দ্রুত হাটতে লাগলো সেই বাসার দিকে ।

দরজাতে কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে বের হয়ে এল সে । ডাক্তারের নাম নওসাদ আহমেদ । নামটা নীলার মনে আছে । সরু চোখে কিছু সময়ে নীলার হাতে ধরে থাকা কুকুরের ছানার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, কোথায় পেলে এটাকে?
আমাদের স্কুলের পাশে । কয়েকজন মিলে এটাকে এভাবে মেরেছে ।
বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে নীলার ।
মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল ডাক্তার নওসাদের । নীলার কেন জানি মনে হল ক্ষণিকের জন্য তার চোখে একটা আগুন দেখতে পেল সে । যেন খুব বেশি রেগে গেছে । তবে সেটা সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল চোখ থেকে । নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো আমার সাথে ।

পরের আধা ঘন্টা ডাক্তার নাওসাদ খুব যত্ন করে কুকুরের ছানাটাকে পরিচর্যা করলো । পেছনের একটা পা ভেঙ্গে গিয়েছে । সেটা প্লাস্টার করতে পারলো না বটে তবে কাঠি দিয়ে আটকে দিলো । এছাড়া আঘাত গুলো পরিচর্যা করলো ।
নীলা বলল, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিবো !
-আরে না । কিছু বলে ধন্যবাদ দিতে হবে না । আমি বরং তোমাকে ধন্যবাদ দেই । কুকুরটা তো রাস্তার কুকুর । এই রকম রাস্তার কুকুরের জন্য এমন মায়া অনুভব করছো !
-রাস্তার কুকুর হলেও ওরা অবলা প্রাণী । আর মানুষ কেন খামোখা এই রকম প্রাণীকে মারবে ? আঘাত করবে?

আঘাত শব্দটা শুনতেই নাওসাদের মুখের ভাবটা আবার যেন কঠিন হয়ে গেল । নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জানো কে ওকে এমন করে আঘাত করেছে?
নীলা যেন একটু চুপ করলে । ও ঠিক ঠিক জানে কে কে কুকুরটার এই রকম অবস্থা করেছে । ওর সিনিয়র ছেলে গুলো । ওদের স্কুলের সাথেই কলেজ রয়েছে । একই কম্পার্টমেন্ট একই গ্রাউন্ড । স্কুল কলেজের সবাই ওদের ভয় পায় । তিনজন ওরা মোটা । একজন আবার এলাকার চেয়াম্যানের ছেলে । তাই সবাই ওদেরকে ভয় পায় । এড়িয়ে চলে ।
নীলা মাথা ঝাকালো । নওসাদ বলল, কে?
-ঐ যে চেয়ারম্যানের ছেলে ! রাফি ! আর ওর দুই বন্ধু । ওরা খুব নিষ্ঠুর । এর আগেও দেখেছি এই রকম প্রাণীদেরকে কষ্ট দেয় । কুকুর কিংবা বেড়াল দেখলেই লাঠি কিংবা ইট দিয়ে আঘাত করে !
-আচ্ছা ঠিক আছে । এরপর আর যাতে না করে সেই ব্যবস্থা করবো ।
নীলা একটু ভয় পেয়ে বলল, না না দেখুন ওদের সাথে লাগতে যাবেন না । রাফির একটা বড় ভাই আছে । সে খুবই গুন্ডা টাইপের মানুষ । একবার আমাদের এক স্যার রাফিকে শয়তানির জন্য বকেছিলো । সেইদিন বিকেলেই সেই বড় ভাই সেই স্যারের বাড়িতে গিয়ে কি না কি সেই হুমকি ! পারলে স্যারকে ধরে মারে । সেই থেকে রাফিকে আর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না । আপনি নতুন মানুষ !

নাওসাদ একটু হেসে বলল, ভয় পেও না । আমার কিছু হবে না । আর এই ছানাটা আমার কাছে কয়েকদিন থাকুক ।
-আপনি রাখবেন ! তাহলে তো খুব ভাল হয় । আমি আসলে খুব চিন্তায় ছিলাম যে ওকে কিভাবে বাসায় নিয়ে যাবো । আর এভাবে একা একা রাস্তায় ছেড়ে দিলে বেচারা আবারও আহত হবে !
-চিন্তা কর না । আমি দেখে রাখবো ।

নীলা যখন ডাক্তারের বাসা থেকে বের হল তখন ওর মনটা বেশ ভাল হয়ে গেছে । ডাক্তার সাহেব যে এতো ভাল হবেন সেটা নীলা মোটেও বুঝতে পারে নি । তবে দুইবার ডাক্তার নওসাদের চেহারায় যেন অন্য কিছু দেখেছিলো সে । তখন কেবল মনে হয়েছে যেন সামনের মানুষটা ঠিক মানুষ না । ভয়ংকর কিছু । এমন কেন মনে হল সেটা বুঝতে পারলো না নীলা । চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিল একেবারে ।

দুদিন পরে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে ডাক্তার নওসাদের বাসায় গিয়ে হাজির হল সে । দরজাতে নক করতেই নওসাদ খুলে দিল । নীলাকে দেখে খুশি হয়ে বলল, আরে তুমি এখানে !
-বাচ্চাটাকে দেখতে এলাম ।
-ও । বেশ ভাল আছে এখন । যেভাবে ভয় পেয়েছিলাম অবস্থা এখন বেশ ভাল । ঐ পাশের ঘরে আছে দেখো ।
নীলা পাশের ঘরে যেতেই দেখতে পেল কুকুরের ছানাটাকে । বিছানার উপরে একটা তোয়ালের উপরে শুয়ে আছে । একটু অবাকই হল । এতো যত্ন সে আশা করে নি । কাছে গিয়ে দেখলো শরীরের আঘাত গুলো বেশ শুকিয়ে গেছে এরই মধ্যে । নীলা কাছে যেতেই মুখ তুলে তাকালো । মুখে একটা হাসির রেখা যেন টের পেল নীলা। প্রাণী যেন ওকে চিনতে পেরেছে । নীলা শুনেছে কুকুরেরা উপকারীর চেহারা সহজে ভোলে না । ওর চেহারা চিনতে পেরেছে ।
পেছন থেকে নওসাদের কন্ঠ স্বর শোনা গেল । সে বলল, তোমাকে সে ঠিকই তোমাকে চিনেছে ।
-হুম ।

আরও কিছু সময় থেকে নীলা বাড়ি চলে এল । কিন্তু ঝামেলা শুরু হল ঠিক এক সপ্তাহ পরে । সেদিন স্কুলে একটা নীলাকে থাকতে হয়েছিলো একটু বেশি সময় পর্যন্ত । স্কুলে বার্ষিক ক্রিয়া অনুষ্ঠান হবে । সেখানে মঞ্চ নাটকের জন্য নাম লিখিয়েছিলো নীলা । সেইটারই রিহার্সাল হচ্ছিলো। সন্ধ্যা পর হয়ে গেল সেদিন । নীলাকে স্কুলের স্যার এগিয়ে দিতে চাইলে নীলা বলল, স্যার সমস্যা নেই । আমার বাসা কাছেই । আপনাকে আমার জন্য আবার উল্টো পথে চলতে হবে । আপনি চিন্তা করবেন না ।

তবে নীলা যখন রাস্তায় নামলো তখন মনে হল যে কাজটা ঠিক হল না হয়তো । নীলা কোন রিক্সা পেল না যাওয়ার জন্য । শেষে হেটেই রওয়ানা দিল । ওর বাড়ি স্কুল থেকে মিনিট বিশেষের পথ । নীলা হাটতে শুরু করলো । মাঝ বরাবর এসেই ওর বুকটা কেপে উঠলো । একটা ছোট আম বাগানের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় রাফিদের দলটাকে দেখতে । ওরা যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো । ওকে দেখেই এগিয়ে এল ওরা । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রাফি বলল, আমি কুত্তার বাচ্চাটাকে আঘাত মেরেছি এই তথ্য তুমি ডাক্তারকে দিয়েছো ?

নীলার বুক এবার লাফাতে শুরু করলো । এই কথা এরা কিভাবে জানলো ?
রাফি আবার বলল, আমি জানি তুমি কুত্তাটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছ । সেটা সমস্যা না । কিন্তু আমার নাম কেন নিয়েছো?
নীলা কোন মতে বলতে চাইলো যে সে নেয় নি । কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । ওরা তিনজন সামনে দাড়িয়ে । নীলা এখন কী করবো । আর কিছু না ভেবে সে পেছন ঘুরেই দৌড় দিতে গেল । কিন্তু পেছনেও যে একজন চলে আসবে সেটা নীলা টের পায় নি । একটা পা বাড়িয়ে দিলো সে। সাথে সাথেই মাটতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে । পালাতে চাইলো বটে কিন্তু লাভ হল না । একজন ওর হাতটা মাটির সাথে চেপে ধরলো । নীলার মনে হল যেন ও কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে । ওর সাথে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা সে ভাল করেই বুঝতে পারছে !
রাফি ওর শরীরের দিকে আসতে আসতে বলল, আজকে তোমাকে মজা বুঝাবো ! আমার পেছনে লাগা ! তোমার জন্য বাবার কাছে আমাকে বকা শুনতে হয়েছে । সেই বকার শোধ আমি তুলবো !

নীলা চোখ বন্ধ করে ফেলল । ওর হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে । একটুও নড়াতে পারছে না সে ।
ঠিক এমন সময়ে একটা হুংকার শুনতে পেল । নীলার বুকটা কেঁপে উঠলো সাথে সাথেই । সেই সাথে অনুভব করলো ওকে ঘিরে ধরা ছেলে গুলোও কেমন কেঁপে্ উঠেছে । হুটোপুটি করে পালানোর আওয়াজ পেল সে । এবং সাথে সাথে একটা তীব্র আর্তনাদ !
চোখ খুলে নীলা তীব্র বিস্ময় নিয়ে দেখলো বিশাল বড় একটা কুকুর জা্তীয় প্রানী রাফির পা কামড়ে ধরেছে । ওর বাকি বন্ধুরা পালিে যাচ্ছে দুরে । রাফি চিৎকার করেই যাচ্ছে । নীলা তাকিয়ে রয়েছে প্রাণীটার দিকে । এই আবছায়া অন্ধকারের প্রাণীটার ধূসর গায়ের রং সে খুব ভাল করেই টের পাচ্ছে ।
এটা কোন কুকুর না ।
নীলা প্রাণীটাকে চিনতে পারলো । এটা একটা নেকড়ে !
কটমট করে হাড় ভাঙ্গার আওয়াজ পেল নীলা । তারপর দেখলো রাফির একটা পা সে ছিড়ে নিয়েছে শরীর থেকে । নীলা সেটা দেখেই জ্ঞান হারালো । তবে জ্ঞান হারানোর আগে নীলা দেখতে পেল প্রাণীটা ওর দিকে ফিরে তাকিয়েছে । চোখ দুটো কেন জানি নীলার বড় পরিচিত মনে হল !

নীলার জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে । চোখ তুলে দেখতে পেল ওর বাবা আর মা রয়েছে বেডের কাছে । নীলার শরীরের কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নি । সামান্য আঘাত কেবল পড়ে গিয়েছে পেয়েছিলো । তখনই তাকে যেতে দেওয়া হল ।

দুইদিন পরে নীলার বাসায় পুলিশ এসে হাজির হল । ওর কাছে কিছু জানার ছিল । নীলা এর ভেতরেই জানতে পেরেছে যে রাফির অবস্থা খবই খারাপ । ওর একটা পা ছিড়ে নেওয়া হয়েছে । আর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত গিয়েচে । এখনও বলা যাচ্ছে না কি হবে !
পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল, দেখো রাফির বন্ধুরা আমার কাছে সব স্বীকার করেছে । ওরা আসলে তোমার সাথে কী করতে যাচ্ছিলো সব । তুমি এবং তোমার পরিবার চাইলে থানায় অভিযোগ করতে পারো তবে এতে অনেক কিছু হবে । সিদ্ধান্ত তোমার !
পেছন থেকে নীলার মা বলল, আমাদের মেয়ে ভাল আছে । আমরা কোন অভিযোগ করতে চাই না । দয়া করে আপনি আমাদের এর ভেতর থেকে আলাদা রাখেন প্লিজ !
নীলা কিছু না বলে চুপ করে রইলো । ইন্সপেক্টর বলল, ওরা যা বলল তা আসলে বিশ্বাস যোগ্য নয় । ওরা বলেছে একটা বড় নেকড়ে বাকি ওদের আক্রমন করেছে । এটা কী বিশ্বাস্যযোগ্য ? তুমি কিছু দেখেছো?
নীলার সাথে সাথেই সেই নেকড়ের চোখ দুটো সামনে চলে এল । এবং তখনই সে মনে করতে পারলো এই চোখ সে কোথায় দেখেছে !
নীলা বলল, আমি কিছু দেখি নি । পরে গিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম !
ইন্সপেক্টর উঠে দাড়ালো । নীলার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা । আজ তাহলে আসি । যেহেতু অভিযোগ করতে চান না সেহেতু নীলা যে ওখানে ছিল এটা উল্লেখই করবো না আমরা । দেখি ওর বন্ধুদের আরও ভাল করে ধরতে হবে !

পরিশিষ্টঃ
আরও দুই সপ্তাহ পরে নীলা বাড়ির বাইরে বের হল । ডাক্তার নওসাদের বাসায় এল । বাসায় ঢুকতেই কুকুরের সেই ছানাটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে ওর দিকে এগিয়ে এল । পা টা একদম যেন ঠিক হয়ে গেছে ।
-আপনি ভাল ব্যবস্থা নিয়েছেন !
হঠাৎ কথাটা বলল নীলা । নওসাদ সাথে সাথে ফিরে তাকালো নীলার দিকে । তারপর বলল, মানে!
-আমার সামনে লুকিয়ে লাভ নেই । আমি জানি সেদিন আপনিই এসেছিলেন ! কিভাবে এসেছিলেন আমি জানতেও চাই না । আর এতে আমার কোন আপত্তিও নেই । আমি কেবল বলতে চাই ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য ।

নওসাদ কেবল একটু হাসলো । আর কিছু বলল না । নীলা সে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার সামনে যে দাড়িয়ে আছে সে কেবল মানুষ নয় সাথে আরও অন্য কিছু । নীলা ভয় করলো না মোটেও । সামনের এই প্রাণীটাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই !

যদিও জানি না এটা এডোপ্টেড থিমের গল্প হল কিনা । নেকড়ে মানব কিংবা ওয়্যার উলফের থিম খুবই কমন একটা থিম । এই নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে । আমার গল্পও তেমনই একটা গল্প

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.3 / 5. Vote count: 44

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →