নীলার খুব কান্না আসতে লাগলো । দুই হাত দিয়ে কুকুর ছানাটাকে যত্ন করে ধরে তোলার চেষ্টা করতেই সেটা কুই কুই করে উঠলো ব্যাথায় । সেটা দেখে নীলা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না । মানুষ কিভাবে এমন করে একটা অবলা প্রাণীকে আঘাত করতে পারে বিনা কারণে । ইস, বাচ্চাটা কেমন করে কষ্ট পাচ্ছে ।
নীলা এখন কী করবে?
কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?
আশে পাশে কোন পশু ডাক্তারকে সে চেনে না । ওর বাড়ির কাছেই একজন ডাক্তার আছেন অবশ্য তবে সে তো মানুষের ডাক্তার । এই পশুটাকে সে কি দেখবে ?
বাসায় নিয়ে গেলে ওর বাবা মা বকবে ওকে । বাড়তি ঝামেলা মনে করবে । নীলা ঠিক করলো একবার নিয়ে যাবে সেই ডাক্তার ভাইয়ার বাসায় । ডাক্তার ভাইয়াটা নতুন এসেছে পাড়াতে । সদ্য বিসিএস দিয়ে ওদের উপজেলা কমিউনিটি হাসপাতালে জয়েন করেছে । থাকার জন্য ওদের এলাকাতেই একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছে ।
নীলা আর চিন্তা করলো না । নিশ্চয়ই ফেলে দেবে না বাচ্চাটাকে এভাবে । কিছু তো করবেই । নীলা খুব যত্ন করে বাচ্চাটাকে কোলে নিল । তারপর দ্রুত হাটতে লাগলো সেই বাসার দিকে ।
দরজাতে কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে বের হয়ে এল সে । ডাক্তারের নাম নওসাদ আহমেদ । নামটা নীলার মনে আছে । সরু চোখে কিছু সময়ে নীলার হাতে ধরে থাকা কুকুরের ছানার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, কোথায় পেলে এটাকে?
আমাদের স্কুলের পাশে । কয়েকজন মিলে এটাকে এভাবে মেরেছে ।
বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে নীলার ।
মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল ডাক্তার নওসাদের । নীলার কেন জানি মনে হল ক্ষণিকের জন্য তার চোখে একটা আগুন দেখতে পেল সে । যেন খুব বেশি রেগে গেছে । তবে সেটা সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল চোখ থেকে । নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো আমার সাথে ।
পরের আধা ঘন্টা ডাক্তার নাওসাদ খুব যত্ন করে কুকুরের ছানাটাকে পরিচর্যা করলো । পেছনের একটা পা ভেঙ্গে গিয়েছে । সেটা প্লাস্টার করতে পারলো না বটে তবে কাঠি দিয়ে আটকে দিলো । এছাড়া আঘাত গুলো পরিচর্যা করলো ।
নীলা বলল, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিবো !
-আরে না । কিছু বলে ধন্যবাদ দিতে হবে না । আমি বরং তোমাকে ধন্যবাদ দেই । কুকুরটা তো রাস্তার কুকুর । এই রকম রাস্তার কুকুরের জন্য এমন মায়া অনুভব করছো !
-রাস্তার কুকুর হলেও ওরা অবলা প্রাণী । আর মানুষ কেন খামোখা এই রকম প্রাণীকে মারবে ? আঘাত করবে?
আঘাত শব্দটা শুনতেই নাওসাদের মুখের ভাবটা আবার যেন কঠিন হয়ে গেল । নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জানো কে ওকে এমন করে আঘাত করেছে?
নীলা যেন একটু চুপ করলে । ও ঠিক ঠিক জানে কে কে কুকুরটার এই রকম অবস্থা করেছে । ওর সিনিয়র ছেলে গুলো । ওদের স্কুলের সাথেই কলেজ রয়েছে । একই কম্পার্টমেন্ট একই গ্রাউন্ড । স্কুল কলেজের সবাই ওদের ভয় পায় । তিনজন ওরা মোটা । একজন আবার এলাকার চেয়াম্যানের ছেলে । তাই সবাই ওদেরকে ভয় পায় । এড়িয়ে চলে ।
নীলা মাথা ঝাকালো । নওসাদ বলল, কে?
-ঐ যে চেয়ারম্যানের ছেলে ! রাফি ! আর ওর দুই বন্ধু । ওরা খুব নিষ্ঠুর । এর আগেও দেখেছি এই রকম প্রাণীদেরকে কষ্ট দেয় । কুকুর কিংবা বেড়াল দেখলেই লাঠি কিংবা ইট দিয়ে আঘাত করে !
-আচ্ছা ঠিক আছে । এরপর আর যাতে না করে সেই ব্যবস্থা করবো ।
নীলা একটু ভয় পেয়ে বলল, না না দেখুন ওদের সাথে লাগতে যাবেন না । রাফির একটা বড় ভাই আছে । সে খুবই গুন্ডা টাইপের মানুষ । একবার আমাদের এক স্যার রাফিকে শয়তানির জন্য বকেছিলো । সেইদিন বিকেলেই সেই বড় ভাই সেই স্যারের বাড়িতে গিয়ে কি না কি সেই হুমকি ! পারলে স্যারকে ধরে মারে । সেই থেকে রাফিকে আর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না । আপনি নতুন মানুষ !
নাওসাদ একটু হেসে বলল, ভয় পেও না । আমার কিছু হবে না । আর এই ছানাটা আমার কাছে কয়েকদিন থাকুক ।
-আপনি রাখবেন ! তাহলে তো খুব ভাল হয় । আমি আসলে খুব চিন্তায় ছিলাম যে ওকে কিভাবে বাসায় নিয়ে যাবো । আর এভাবে একা একা রাস্তায় ছেড়ে দিলে বেচারা আবারও আহত হবে !
-চিন্তা কর না । আমি দেখে রাখবো ।
নীলা যখন ডাক্তারের বাসা থেকে বের হল তখন ওর মনটা বেশ ভাল হয়ে গেছে । ডাক্তার সাহেব যে এতো ভাল হবেন সেটা নীলা মোটেও বুঝতে পারে নি । তবে দুইবার ডাক্তার নওসাদের চেহারায় যেন অন্য কিছু দেখেছিলো সে । তখন কেবল মনে হয়েছে যেন সামনের মানুষটা ঠিক মানুষ না । ভয়ংকর কিছু । এমন কেন মনে হল সেটা বুঝতে পারলো না নীলা । চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিল একেবারে ।
দুদিন পরে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে ডাক্তার নওসাদের বাসায় গিয়ে হাজির হল সে । দরজাতে নক করতেই নওসাদ খুলে দিল । নীলাকে দেখে খুশি হয়ে বলল, আরে তুমি এখানে !
-বাচ্চাটাকে দেখতে এলাম ।
-ও । বেশ ভাল আছে এখন । যেভাবে ভয় পেয়েছিলাম অবস্থা এখন বেশ ভাল । ঐ পাশের ঘরে আছে দেখো ।
নীলা পাশের ঘরে যেতেই দেখতে পেল কুকুরের ছানাটাকে । বিছানার উপরে একটা তোয়ালের উপরে শুয়ে আছে । একটু অবাকই হল । এতো যত্ন সে আশা করে নি । কাছে গিয়ে দেখলো শরীরের আঘাত গুলো বেশ শুকিয়ে গেছে এরই মধ্যে । নীলা কাছে যেতেই মুখ তুলে তাকালো । মুখে একটা হাসির রেখা যেন টের পেল নীলা। প্রাণী যেন ওকে চিনতে পেরেছে । নীলা শুনেছে কুকুরেরা উপকারীর চেহারা সহজে ভোলে না । ওর চেহারা চিনতে পেরেছে ।
পেছন থেকে নওসাদের কন্ঠ স্বর শোনা গেল । সে বলল, তোমাকে সে ঠিকই তোমাকে চিনেছে ।
-হুম ।
আরও কিছু সময় থেকে নীলা বাড়ি চলে এল । কিন্তু ঝামেলা শুরু হল ঠিক এক সপ্তাহ পরে । সেদিন স্কুলে একটা নীলাকে থাকতে হয়েছিলো একটু বেশি সময় পর্যন্ত । স্কুলে বার্ষিক ক্রিয়া অনুষ্ঠান হবে । সেখানে মঞ্চ নাটকের জন্য নাম লিখিয়েছিলো নীলা । সেইটারই রিহার্সাল হচ্ছিলো। সন্ধ্যা পর হয়ে গেল সেদিন । নীলাকে স্কুলের স্যার এগিয়ে দিতে চাইলে নীলা বলল, স্যার সমস্যা নেই । আমার বাসা কাছেই । আপনাকে আমার জন্য আবার উল্টো পথে চলতে হবে । আপনি চিন্তা করবেন না ।
তবে নীলা যখন রাস্তায় নামলো তখন মনে হল যে কাজটা ঠিক হল না হয়তো । নীলা কোন রিক্সা পেল না যাওয়ার জন্য । শেষে হেটেই রওয়ানা দিল । ওর বাড়ি স্কুল থেকে মিনিট বিশেষের পথ । নীলা হাটতে শুরু করলো । মাঝ বরাবর এসেই ওর বুকটা কেপে উঠলো । একটা ছোট আম বাগানের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় রাফিদের দলটাকে দেখতে । ওরা যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো । ওকে দেখেই এগিয়ে এল ওরা । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রাফি বলল, আমি কুত্তার বাচ্চাটাকে আঘাত মেরেছি এই তথ্য তুমি ডাক্তারকে দিয়েছো ?
নীলার বুক এবার লাফাতে শুরু করলো । এই কথা এরা কিভাবে জানলো ?
রাফি আবার বলল, আমি জানি তুমি কুত্তাটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছ । সেটা সমস্যা না । কিন্তু আমার নাম কেন নিয়েছো?
নীলা কোন মতে বলতে চাইলো যে সে নেয় নি । কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । ওরা তিনজন সামনে দাড়িয়ে । নীলা এখন কী করবো । আর কিছু না ভেবে সে পেছন ঘুরেই দৌড় দিতে গেল । কিন্তু পেছনেও যে একজন চলে আসবে সেটা নীলা টের পায় নি । একটা পা বাড়িয়ে দিলো সে। সাথে সাথেই মাটতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে । পালাতে চাইলো বটে কিন্তু লাভ হল না । একজন ওর হাতটা মাটির সাথে চেপে ধরলো । নীলার মনে হল যেন ও কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে । ওর সাথে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা সে ভাল করেই বুঝতে পারছে !
রাফি ওর শরীরের দিকে আসতে আসতে বলল, আজকে তোমাকে মজা বুঝাবো ! আমার পেছনে লাগা ! তোমার জন্য বাবার কাছে আমাকে বকা শুনতে হয়েছে । সেই বকার শোধ আমি তুলবো !
নীলা চোখ বন্ধ করে ফেলল । ওর হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে । একটুও নড়াতে পারছে না সে ।
ঠিক এমন সময়ে একটা হুংকার শুনতে পেল । নীলার বুকটা কেঁপে উঠলো সাথে সাথেই । সেই সাথে অনুভব করলো ওকে ঘিরে ধরা ছেলে গুলোও কেমন কেঁপে্ উঠেছে । হুটোপুটি করে পালানোর আওয়াজ পেল সে । এবং সাথে সাথে একটা তীব্র আর্তনাদ !
চোখ খুলে নীলা তীব্র বিস্ময় নিয়ে দেখলো বিশাল বড় একটা কুকুর জা্তীয় প্রানী রাফির পা কামড়ে ধরেছে । ওর বাকি বন্ধুরা পালিে যাচ্ছে দুরে । রাফি চিৎকার করেই যাচ্ছে । নীলা তাকিয়ে রয়েছে প্রাণীটার দিকে । এই আবছায়া অন্ধকারের প্রাণীটার ধূসর গায়ের রং সে খুব ভাল করেই টের পাচ্ছে ।
এটা কোন কুকুর না ।
নীলা প্রাণীটাকে চিনতে পারলো । এটা একটা নেকড়ে !
কটমট করে হাড় ভাঙ্গার আওয়াজ পেল নীলা । তারপর দেখলো রাফির একটা পা সে ছিড়ে নিয়েছে শরীর থেকে । নীলা সেটা দেখেই জ্ঞান হারালো । তবে জ্ঞান হারানোর আগে নীলা দেখতে পেল প্রাণীটা ওর দিকে ফিরে তাকিয়েছে । চোখ দুটো কেন জানি নীলার বড় পরিচিত মনে হল !
নীলার জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে । চোখ তুলে দেখতে পেল ওর বাবা আর মা রয়েছে বেডের কাছে । নীলার শরীরের কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নি । সামান্য আঘাত কেবল পড়ে গিয়েছে পেয়েছিলো । তখনই তাকে যেতে দেওয়া হল ।
দুইদিন পরে নীলার বাসায় পুলিশ এসে হাজির হল । ওর কাছে কিছু জানার ছিল । নীলা এর ভেতরেই জানতে পেরেছে যে রাফির অবস্থা খবই খারাপ । ওর একটা পা ছিড়ে নেওয়া হয়েছে । আর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত গিয়েচে । এখনও বলা যাচ্ছে না কি হবে !
পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল, দেখো রাফির বন্ধুরা আমার কাছে সব স্বীকার করেছে । ওরা আসলে তোমার সাথে কী করতে যাচ্ছিলো সব । তুমি এবং তোমার পরিবার চাইলে থানায় অভিযোগ করতে পারো তবে এতে অনেক কিছু হবে । সিদ্ধান্ত তোমার !
পেছন থেকে নীলার মা বলল, আমাদের মেয়ে ভাল আছে । আমরা কোন অভিযোগ করতে চাই না । দয়া করে আপনি আমাদের এর ভেতর থেকে আলাদা রাখেন প্লিজ !
নীলা কিছু না বলে চুপ করে রইলো । ইন্সপেক্টর বলল, ওরা যা বলল তা আসলে বিশ্বাস যোগ্য নয় । ওরা বলেছে একটা বড় নেকড়ে বাকি ওদের আক্রমন করেছে । এটা কী বিশ্বাস্যযোগ্য ? তুমি কিছু দেখেছো?
নীলার সাথে সাথেই সেই নেকড়ের চোখ দুটো সামনে চলে এল । এবং তখনই সে মনে করতে পারলো এই চোখ সে কোথায় দেখেছে !
নীলা বলল, আমি কিছু দেখি নি । পরে গিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম !
ইন্সপেক্টর উঠে দাড়ালো । নীলার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা । আজ তাহলে আসি । যেহেতু অভিযোগ করতে চান না সেহেতু নীলা যে ওখানে ছিল এটা উল্লেখই করবো না আমরা । দেখি ওর বন্ধুদের আরও ভাল করে ধরতে হবে !
পরিশিষ্টঃ
আরও দুই সপ্তাহ পরে নীলা বাড়ির বাইরে বের হল । ডাক্তার নওসাদের বাসায় এল । বাসায় ঢুকতেই কুকুরের সেই ছানাটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে ওর দিকে এগিয়ে এল । পা টা একদম যেন ঠিক হয়ে গেছে ।
-আপনি ভাল ব্যবস্থা নিয়েছেন !
হঠাৎ কথাটা বলল নীলা । নওসাদ সাথে সাথে ফিরে তাকালো নীলার দিকে । তারপর বলল, মানে!
-আমার সামনে লুকিয়ে লাভ নেই । আমি জানি সেদিন আপনিই এসেছিলেন ! কিভাবে এসেছিলেন আমি জানতেও চাই না । আর এতে আমার কোন আপত্তিও নেই । আমি কেবল বলতে চাই ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য ।
নওসাদ কেবল একটু হাসলো । আর কিছু বলল না । নীলা সে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার সামনে যে দাড়িয়ে আছে সে কেবল মানুষ নয় সাথে আরও অন্য কিছু । নীলা ভয় করলো না মোটেও । সামনের এই প্রাণীটাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই !
যদিও জানি না এটা এডোপ্টেড থিমের গল্প হল কিনা । নেকড়ে মানব কিংবা ওয়্যার উলফের থিম খুবই কমন একটা থিম । এই নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে । আমার গল্পও তেমনই একটা গল্প
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.