দ্য লাইফ ট্রি

oputanvir
4.5
(31)

মেয়েটি আমার সামনে চুপচাপ বসে ছিল । আপন মনে বিয়ারের ক্যান শেষ করে যাচ্ছিলো একের পর এক । আমি জানি মেয়েটি কিছু সময়ের ভেতরেই মাতাল হয়ে যাবে । তখন সে কিভাবে বাসায় যাবে সেটা নিয়ে একটু চিন্তিত বোধ করছি ।
পাবটার নাম দ্য এরিয়ানা বে । যদিও এর আশে পাশে কোন উপসাগর নেই । কেবল উপসাগর কেন দুর দুরান্তে সামান্য কোন পুকুর পর্যন্ত নেই । এই এলাকাতে পানির বেশ সমস্যা । সরকারকে রীতিমত হিমশিত খেতে হয় পানির সরবারহ ঠিক রাখতে । গরম কালে সেটা আরও কষ্টকর হয়ে পড়ে । লোকালয় থেকে একটু দুরেই এই পাবটা । হাইওয়ের পাশে । মূলত রাস্তায় চলচল করতে থাকা গাড়ি গুলো এখানে থামে তেল নেওয়ার জন্য । এই পাবের সাথেই একটা তেলের পাম্প রয়েছে । রাতের বেলা ট্রাক ড্রাইভাররা এখনে থামে । খাওয়া দাওয়া করে, কেউ কেউ আবার বিয়ার টেনে উপরের ঘুপটির মত ছোট কামড়াতে রাতটা কাটিয়ে দেয় । সকালে আবার নিজ গন্তবব্যের দিকে রওয়ানা দেয় । সব থেকের কাছের লোকালিটিটাও এখান থেকে মোটামুটি ১০ মাইল দুরে ।
এখানে আসতে হলে গাড়ি হাকিয়েই আসতে হবে । মেয়েটিও তাই এসেছে এখানে ।
আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, আর খাবেন না দয়া করে । বাসায় যাবেন কিভাবে?
-সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না ।
মেয়েটি আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল । আমি হাত তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে বললাম, আমি জানি তবুও আপনার মত একজন সুন্দরী মেয়ের বিপদের সম্ভবনা দেখে চুপ থাকতে পারলাম না । তাই বললাম আর কি !
মেয়েটি এবার আমার দিকে তাকালো । তারপর বলল, ফ্ল্যার্ট করছেন?
-করলে কী সমস্যা বলুন । করতেই তো পারি !
-কোন লাভ নেই ।
-কেন? এঙ্গেইজড? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি সিঙ্গেল ।
-কেন এমনটা মনে হল আপনার?
-কারণ যদি আপনি এঙ্গেইজ হতেন তাহলে এই সময়ে এই পাবে বসে একা একা বিয়ার খেতেন না । মানে বুঝতেই পারছেন । এটা আসলে আপনার মত মেয়েদের স্থান ন। আপনার বিয়ার খেতে ইচ্ছে হতেই পারে শহরে অনেক বার রয়েছে । সেখানে গিয়েই খাওয়া যেত । না করে আপনি এতো দুর এখানে এসে একটার পর একটা ক্যান শেষ করছেন । আমার মনে হচ্ছে আপনার মনে কোন দুঃখ রয়েছে । কিংবা বলা যায় এই পাবকে কেন্দ্র করে কোন স্মৃতি রয়েছে । আরও হতে পারে আজকে কোন বিশেষ দিন !

এতো গুলো কথা একসাথে বলে আমি চুপ করলাম । মেয়েটা আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বলল, এতো কথা কিসের ভিত্তিতে আপনি বললেন?
-কোন কিছুর ভিত্তিতে না । কেবল অনুমান ! আর কিছু না ।
-কেবলই অনুমান?
-জ্বী জ্বী ! একদম অনুমান । দয়া করে অন্য কিছু ভাববেন না । আসলে সত্যি কথা হচ্ছে আমার এক বন্ধুর সাথে আমার এই পাবে দেখা হয়েছিলো । সে আর এখানে নেই । বছরের একটা সময়ে আমি এখানে আসি । কিছু সময় একা একা বসে থাকি । তার কথা মনে করি । আমার কেন যেন মনে হল আপনার অভিজ্ঞতাও এই রকম । এই জন্য বললাম । আর কিছু না !

মেয়েটার মুখের পেশি দেখলাম এবার একটু শান্ত হল না । বিয়ার ক্যানে আরেকটা চুমুক দিয়ে মেয়েটা আমার দিকে বলল, আপনার আর আমার গল্প অনেকটা একই রকম । আসলেই আমিও আপনার মত এখানে এসেছি কিছু স্মৃতির কথা মনে করতে । আজকে প্রায় চার বছর এই দিনে এখানেই আসি ।
-আচ্ছা । গল্পটা কী বলা যায়?
মেয়েটা বলল, আসলে গল্পের তেমন কিছু নেই । আমার বাবা আসলে ছিল একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী । ব্যবসার কাজে একবার তাকে সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছিলো । আমিও সেবার তার সাথে ছিলাম । এখানে থেমেছিলাম তেল নেওয়ার জন্য । কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য আমি ঢুকলাম এখানে । তখনই একটা ছেলের সাথে আমার চোখাচোখি হল । আপনার মত লেদার জ্যাকেট পরা । হাতে গ্লোভস ! সামনে একটা হেলমেট । বুঝলাম পাবের বাইরে যে বাইকটা দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি ওটা আসলে তার । চোখাচোখি হল আমাদের । তারপর কি যে হল আমি নিজেও জানি না । যখন আবারও আমরা গাড়ি নিয়ে পথে নামলাম লক্ষ্য করছিলাম যে একটা বাইক আমাদের ফলো করছিলো । কে ফলো করছিলো সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না । আমার বিরক্ত লাগার পরিবর্তবে কেন জানি ভাল লাগলো বেশ । পরদিন কাজ শেষ করে আবারও আমরা একই পাবে ফিরে এলাম । এই পুরোটা সময় সেই ছেলেটা আমাদের পেছনে লেগে ছিল । পাবে ফেরৎ এসেও তাকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে ছিল সে । যাওয়ার সময়ে আমি কৌশলে আমার মোবাইল নম্বরটা তার টেবিলে দিয়ে গেলাম ।
-তারপর?
-তারপর আর কী ! ফোন কথা বার্তা । এখানেই আমাদের আবার দেখা হল । এভাবে চলল বেশ কিছু দিন ।
-কোথায় সে এখন?
-জানি না ।
-মানে কি ? জানেন না বলতে?
-জানি না বলতে জানি না । একদিন সে গায়েব হয়ে গেল । তার বাসার ঠিকানা আমি জানতাম । সেখানে গিয়ে দেখি সব কিছু আগের মত রয়েছে কেবল সে নেই । আরও কত খুজলাম । আমার বাবাকে বললাম । বাবাও খোজ লাগালো কিন্তু ছেলেটা যেন একেবারে গায়েব হয়ে গেছে । ও একটা একটা ফুড প্রোসেসিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো । সেখানে নাইটডিউটি শেষ করে রাত দুইটার দিকে বাইক নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়েছিলো । বাসায় পোছাতে আধাঘন্টার মত লাগার কথা তার । কিন্তু তারপর আর পৌছায় নি সে । সেখান থেকে তাকে বের হতে অনেকেই দেখেছে কিন্তু বাসায় সে পৌছায় নি । কোথায় গেছে কেউ জানে না ।

আমি কি বলবো চুপ খুজে পেলাম না । মেয়েটি বলল, আপনার কাহিনী কি একই রকম ?
-একই রকম ! এখানে তার সাথে দেখা । তারপর একদিন আর দেখা হল না আমাদের । আমি আসি এখানে মাঝে মাঝে । এই পরিচিত চেয়ার টেবিল গুলো দেখি । তাকে মনে করার চেষ্টা করি ।
মেয়েটা হাসলো । আমি বললাম, মিস আরিয়ানা জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না । কারো জন্য নিজেকে আটকে রাখা ঠিক না । আপনার উচিৎ মুভ অন করা !

লাইনটা বলার পরেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম । আরিয়ানাও সেটা ধরতে পারলো সাথে সাথেই । তার মুখ শক্ত হয়ে গেল। কঠিন কন্ঠে বলল, কে আপনি? আমার নাম জানলেন কিভাবে?
আমি খানিকটা হাসার চেষ্টা করলাম । তারপর বলল, আরে আপনিই তো বললেন?
-আমি আপনাকে আমার নাম বলি নি । এতোটাও মাতাল হই নি আমি । কে আপনি ? আমার পিছু নিয়েছেন কেন?

আমি কিছু সময় চুপ করে থেকে বললাম, আসলে আমি আপনার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি । আসলে ….

আরিয়ানা উঠে দাড়ালো । তারপর কোন কথা না বলে কাউন্টারে বিল দিয়ে বের হয়ে গেল । আমি দরজার কাছ পর্যন্ত গেলাম । দেখলাম আরিয়ানা গাড়িতে উঠে পড়েছে । উইন্ডশীল্ডের কাঁচ দিয়ে আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল । আমি আবারও ফিরে এলাম নিজের টেবিলে ।
খানিকটা অপরাধবোধ আমাকে পেয়ে বসলো । সেটা মন থেকে দুর করতে চাইলাম বটে কিন্তু খুব একটা কাজ হল । প্রতিবার যখন আমি এই কাজটা করি তখন আমার এই অপরাধবোধটা ফিরে আসে । কিন্তু সেটা খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় না । মাহতিমের বেলাতা এই অনুভূতিটা এখনও রয়ে গেছে । বিশেষ করে আরিয়ানার প্রতি তার ভালোবাসার অনুভূতিটা আমাকে এই অপরাধটাকে কিছুতেই ভুলতে দিচ্ছে না ।

আমার জন্ম আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে । হাজার বছর ধরে আমি জীবিত রয়েছি । এক সর্প দেবতাকে নিশ্চিত মরনের হাত থেকে রক্ষা করার কারণে সে আমাকে একটা আশ্চর্য একটা গাছ উপহার দিয়েছিলো । সেই গাছের ফলের ভেতরে ছিল আশ্চর্য এক ক্ষমতা । আমি সেই ফল যখনই খেতাম তখনই আমার আয়ু বৃদ্ধি পেত । এই ভাবেই আমি এতো গুলো বছর জীবিত আছি । কিন্তু একটা সমস্যা ছিল তাতে । গাছে কখনও এমনি এমনি ফল ধরতো না । ফল ধরার জন্য আমাকে সেই গাছকে একজন মানুষ দিতে হত ।
আসলে গাছটা ছিল একটা জীবনশক্তি প্রতিস্থাপন কারী গাছ । আমি যে যে মানুষকে মেরে গাছকে দিতাম, গাছটা সেই মানুষের জীবনী শক্তি শুষে নিয়ে একটা ফল তৈরি করতো । আমি যখন সেই ফল খেতাম তখন সেই মানুষটার জীবনীশক্তি আমার ভেতরে চলে আসতো । এভাবেই অন্যের জীবনী শক্তি নিয়ে আমি এতো গুলো বছর বেঁচে আছি ।

তবে এই জীবনী শক্তির সাথে সাথে সেই মানুষটার স্মৃতি অনুভূতি আর জ্ঞানও আমার ভেতরে চলে আসতো । আমি এভাবে অনেক কিছু জানি । দিনের পর দিন অনেক জ্ঞানী হয়েছি । অন্যের অনুভূতি গুলোকে নিয়ন্ত্রনে এনেছি । কিন্তু মাহতিম ছেলেটার অনুভূতিটা মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । তখন আমি আরিয়ানার কাছে ছুটে যাই । ওকে দুর থেকে দেখি । মনের ভেতরে শান্তি লাগে । সেই সাথে একটা অপরাধবোধও জেগে ওঠে মনে !

আি পাব থেকে বের হয়ে গেলাম । বাইকটা নিয়ে সোজা নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম । আরিয়ানার কথা আর ভাবা যাবে না । তাহলে মনের ভেতরে কেবল অপরাধবোধই কাজ করবে । জীবনে বেঁচে থাকাটাই সব থেকে বড় কথা । আর কোন কথা নেই । এমন আপন চিন্তায় মগ্ন ছিলাম তখনই ঘটনা ঘটলো । একটা কার গাড়ি পেছন থেকে এসে আমাকে ধাক্কা দিল জোরে । আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার উপরে । মাথাটা এতো তীব্র ভাবে আঘাত করলো যে আমি সেটা ফাঁটার আওয়াজ শুনতে পেলাম । কয়েক মুহুর্তের ভেতরে আমার সকল চেতনা হারিয়ে গেল ।

কত সময়ে আমি জ্ঞান ফিরে ফেলাম সেটা আমি জানি না । দেখলাম গাড়ির হেড লাইটের আলোতে আরিয়ানা হেটে আসছে । তার পেছনে একটা মানুষকে দেখতে পেলাম । তাকে দেখার সাথে সাথেই আমার আত্মারাম কেঁপে উঠলো ।

আরিয়ানা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ঘৃণা ভরা চোখে । তার পেছনে দাড়ালো লোকটা আরিয়ানা কে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ । অনেক দিন পর বেটাকে পেয়েছি । এতোবার আমাকে ফাঁকি দিয়েছে । এইবার আর পারবে না !
তারপর আমার মুখে কাছে এসে বসলো । বলল, তুমি তো জানো মৃত্যুকে কেউ কোন দিন ধোকা দিতে পারে না । আমি চলে এসেছি দেখো ।
আমি কোন মতে বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । আমার শরীরে কোন চেতনা নেই । আমি যেন সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি ।
সে বলল, তুমি যখন অন্যের জীবনটা কে চুরি করছো তখন তার সব কিছু তোমার সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে সেই সাথে তার মৃত্যুর দিনটাও । আজকে মাহতিমের মৃত্যুর কথা ছিল । তুমি যেহেতু তার জীবন নিয়ে বেঁচে আছো তাই এই মৃত্যু তোমার জন্য । এখন যদি তুমি তোমার ঐগাছের কাছে পৌছাতে পারো তাহলে হয়তো আবারও আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে কিন্তু এইবার আর হবে না । তোমার হাতে আর সময় নেই ।

আমিও জানি আমার হাতে আমার হাতে আর সময় নেই । অন্ধকারের দিকে তাকালাম । দেখলাম সেই অন্ধকারের মাঝ দিয়ে একটা তীব্র আলোর ঝলকানী এগিয়ে আসছে আমার দিকে । আমি সেদিকে একভাবে তাকিয়ে রইলাম ।
এই তাহলে শেষ সময় ।
এই তাহলে মৃত্যু !

এই গল্পটার আইডিয়া এসেছে টেল অব নাইল টেল ড্রামা থেকে । সেখান থেকেই এই লাইফ ট্রির কথাটা জানতে পারি । যে গাছের ফল খেয়ে অন্যের জীবনী শক্তি নিজের ভেতরে আনা যায় । সেখান থেকেই এই গল্পের উৎপত্তি !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 31

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →