সত্যি বলতে কি আমি এবং আমার আশে পাশের বয়সে যারা আছে তাদেরকে আমি সব থেকে ভাগ্যবান জেনারেশন মনে করি । কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের এই বয়সে একই সাথে একেবারে গ্রাম্য শৈশব পেয়েছি অন্য দিকে আধুনিকার সকল সোঁয়াও আমাদের হাতের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে এই সঠিক বয়সেই । সঠিক বয়স বলতে আমি বুঝিয়েছি যে আমরা ছোট বেলাতে কাদামাটির ঘর নিয়ে যেমন খেলা করেছি এবং কলেজ বিশ্ব বিদ্যালয় জীবনে স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরে বের হয়েছি । ঠিক যেই বয়সে যে জিনিসটা দরকার একেবারে ঠিক ঠিক সেই সময়েই সেই জিনিসটাই আমাদের হাতে এসেছে । যাই হোক যে কারণে এই পোস্ট লেখা শুরু সেটার দিকে যাই ।
আজকে শৈশবের কিছু কাজের কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করি । আশা করি এর ভেতরে অনেক গুলোই আপনারা করেছেন । বর্তমান সময়ের ছেলে মেয়েরা এই কাজ গুলো আর করে না ।
১. রিমোট ছাড়া টিভি দেখা । এই ঘটনা আগে বলি । আমার এক স্টুডেন্ট এখন ক্লাস টেনে পড়ে । বছর দুয়েক আগে একদিন পড়ানোর সময় তাকে বললাম আমাদের বাসায় থাকা প্রথম সাদা কালো নিপ্পন টিভির কথা যেটার কোন রিমোর্ট ছিল না । টিভি স্ক্রিনের পাশে গোল রেগুলেটরের মত একটা সুইট থাকতো সেটা ঘুরিয়ে টিভির চ্যানেল ঘুরাতে হত । এই কথা শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো । তার কাছে টিমোর্ট ছাড়া যে টিভি হতে পারে এই ব্যাপারটা একেবারে নতুন । আমার থেকে যারা বয়সে বড় কিংবা আমার সম বয়সী, সবাই এই রিমোর্ট ছাড়া টিভি দেখেছে । প্রায় সবার বাড়িতেই এই টিভি ছিল তখন । তখন অবশ্য খুব সমস্যা হত না । কারণ চ্যানেল বলতে একটাই ছিল । বিটিভি । চ্যানেল বদলানোর খুব একটা দরকার পড়তো না ।
২. টিভি এন্টেনা। যদিও বেশ ছোট থেকেই আমাদের বাসাতে ডিস সংযোগ ছিল তবে বাড়িতে টিভির একটা এন্টেনা ছিল । বিটিভি দেখার জন্য এই এন্টেনা দরকার পড়তো । কিন্তু যখন এই এন্টেনা নড়ে যেত তখন ছবি আসতো না পরিস্কার । ঝিঝির করতো । তখন ছাদে উঠে এই এন্টেনা ঘুরাতে হত । আর একজন দাড়ানো জানালার কাছে । এন্টেনার বাশ নাড়ানো একটু একটু করে আর বলতো ছবি এসেছে, জানালার ধারে দাড়ানো মানুষটাকে বলতে হত ছবি পরিস্কার হয়েছে কিনা ! বড় এন্টেনার বাঁশ নাড়ানোর আমাদের কর্ম ছিল না । আমরা ছোটরা জানালার সামনে দাড়িয়ে দেখতাম ছবি এসেছে কিনা পরিস্কার !
৩. হেরিকেন ও কুপি বাতি । গতদিনের কথা । আমার আরেক স্টুডেন্টকে বললাম সে হেরিকেন আর কুপির নাম শুনেছে কিনা ! সে আসলে এসবের নাম শুনে নি । এমন কি চেনে পর্যন্ত না । শেষে গুগল থেকে ছবি বের করে তাদের দেখালাম । তারপরেও সে সেটা চিনতে পারলো না । কুপি বাতিটা সে কার্টুনে দেখেছে । তবে অন্য রকম খানিকটা । আমাদের ছোট বেলাতে সন্ধয়া হলেই নিয়ম করে বিদ্যুৎ চলে যেত । এটা নিয়ম ছিল । আমরা এই হেরিকেন বাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসতাম । হেরিকেন জ্বালানো একটা ঝামেলার কাজ ছিল বাড়ির মেয়েরাই কেবল সেটা করতে পারতো । মাঝে মাঝে এমন হত হেরিকেনের কাঁচ ধোঁয়ায় ঘোলা হয়ে যেত । সেটা পরিস্কার করতে হত । কুপি দিয়ে পড়তাম না যদিও । কুপি ব্যবহার হত রান্না ঘরে । সন্ধ্যা বেলা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে রান্না ঘরে কোন কাজের জন্য এই কুপি ! এখন বিদ্যুতের সমস্যা অনেকই কেটে গিয়েছে । তারপরেও যখন বিদ্যুৎ চলে যায় তখন আর হেরিকেন জ্বালানো হয় না । চার্যার বাতি এখন খুব সহজলভ্য হয়েছে ।
৪. পঞ্চের স্যান্ডেল । আমরা অনেকেই এই পঞ্চের স্যান্ডেল পরতাম তখন । এখনও অবশ্য মানুষ এই স্যান্ডেলই পরে। এটা নিয়ে গল্প বলার একটা কারণ আছে অবশ্য । যখন কোন কারণে এই পঞ্চের স্যান্ডেলটা ছিড়ে যেত, বিশেষ করে নিচের দিকে হুকটা ছিড়ে গেলে আমরা অনেকেই কুপি আগুনে সেই হুকটা আবার জোড়া দিয়ে পরতাম । সেটাও টিকে যেত অনেক দিন ।
৫. এখন বিয়ের অনুষ্ঠান গুলো বড় বেশি প্রোফেশনাল হয়ে গেছে । কিন্তু আগে ঠিক এমন ছিল না । আমার এখনও মনে আছে অনেক বিয়ে বাড়ির গেট আমি কলা গাছ দিয়ে বানাতে দেখেছি । কলা গাছের উপরে রং বেরংয়ের কাপড় পেঁচিয়ে গেট সাজানো হত । এমন গেয় জানানো আপনাদের চোখে পড়েছে কি?
৬. এমনিতে সব সময়ই আমরা টুথপেস্ট দিয়েই দাঁত মাজতাম । তবে যখন গ্রামে বেড়াতে যেতাম, তখন দেখতাম আমাদের চাচী কিংবা নানীরা পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজেন না । তারা কয়লা ব্যবহার করেন । কৌতুহলী হয়ে মাঝে মাঝে আমিও সেই কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতাম । দাঁত মাজার আরেকটা বস্তু দিল ম্যাকিজ ট্যুথ পাউডার । এই জিনিসটা এখনও আছে কিনা কে জানে !
৭. বর্ষা কালে আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল । বর্ষা কালে দুপুর কিংবা বিকেলে যদি বৃষ্টি নামতো তাহলে তো আর কথাই নেই । ফুটবল খেলতেই হবে। ফুটবল খেলার কোন নিয়ম কানুন নেই । বল যেদিকে সব প্লেয়ার সেদিকে । মৌমাচির ঝাকের মত সব প্লেয়াররা বলকে ঘিরে লাথি দেওয়ার চেষ্টা করছে । তবে মাঝে মাঝে এমন হত যে বল কোন পেরেক কিংবা সুঁচালো বস্তুতে লেগে ফুটো কিংবা লিক হয়ে গেছে । কিছুতেই হাওয়া থাকছে না । তখন আমরা সেই বল নিয়ে যেতাম মুঁচির কাছে । মুঁচি মশাই তখন সেই লিক সাইকেলের টিউয়ের পট্টি মেরে দিত । তবে এও বলে দিতো যে বেশি হাওয়া ভরা যাবে না । কারণ বেশি হাওয়া ভরলে সেটা খুলে যাবে । আমরা তারপর সাবধানে খেলতাম । তবে সেই টিক পট্টি খুব বেশি সময় টিকতো না । খুলে গেলে আবারও নিয়ে যেতাম মুঁচির কাছে । এছাড়া বল না থাকলে আমরা জাম্বারা দিয়েও ফুটবল খেলতাম । এটাও মজার একটা কাজ ছিল ।
৮. ছেলেরা এখন চুলে তেল দেয় না । কিন্তু সেই সময়ে ছেলেদের চুলে তেল দেওয়া খুবই সাধারন ব্যাপার ছিল । সরিসার তেল কিংবা নারিকেল তেল । স্কুলের সেভেন এইচ পর্যন্ত আমি নিয়মিত মাথায় তেল দিতাম । একবারের একটা মজা ঘটনা বলি । স্কুলে তখন বড় চুল রাখলেই স্যারেরা কেঁচি দিয়ে কেটে দিতো । একদিন স্কুলে এসে শোনা গেল যে হেড স্যার বড় চুলওয়ালাদের ধরে ধরে কেটে দিচ্ছে । তখন আমাদের থেকে বড় ক্লাসের এক ছেলে কি করলো দৌড় দিয়ে সরিসার তেল নিচে আনলো । তারপর সেটা প্রায় পুরোটুকুই মাথায় ঢেলে দিলো । মাথার চুল তেলে একেবারে জুবুজুবু করতে লাগলো । স্যার যখন তার কাছে এল সেই তেলের চুল ধরলেনই না । তার চুল কাটা হল না আর !
৯. আরেকটা মজার ব্যাপার হল টিউবয়ের নিচে বসে গোসল করা । বিশেষ করে যখন পুকুর থেকে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে আসতাম তখন বাসায় এসে আবারও কলের পানিতে গোসল করতে হত । তখন এমন হত আমি টিউবলের নলের নিচে বসেছি আর কেউ কল চাপছে । সেই পানিতে গোসল করছি । মাঝে মাঝে উঠতে গিয়ে মাথায় ঠুয়া খেতাম কলের মুখের সাথে । তারপর মাথা ডলতে ডলতে ঘরে যেতাম ।
১০. আমি জীবনে কোন দিন সিগারেট মুখে দেই নি । তবে পাঠকাঠির এক পাশে আগুন লাগিয়ে অন্য দিকে মুখ দিয়ে টেনে ধোঁয়া ছেড়েছি অনেক । এই কাজটা করতে মজাই লাগতো । এছাড়া তেজপাতা গুটিয়ে সেটাও সিগারেটের মত করে টানা হয়েছে বেশ ।
১১. সাইকেলের টায়ার নিয়ে খেলা আমার জীবনের আনন্দময় ঘটনা গুলোর একটা । এই টায়ার গুলো আমরা সংগ্রহ করতাম সাইকেলের দোকান থেকে । অনেক পরিত্যাক্ট টায়ার সেখানে পড়ে থাকতো । ১০/২০ টাকা দিয়ে পাওয়া যেত । সেই টায়ার গুলো আমরা একটা লাঠির সাহায্যে চালাতাম । আর তার পেছন পেছন দৌড়তাম । সেই লাঠি দিয়েই টায়ারটাকে এক ওদিক নিয়ে যেতাম । এই ব্যাপারটা অবশ্য আমার বাসার লোকজন পছন্দ করতো না । তাদের কাছে এই টায়ার চালানো মানে কোথাও গিয়ে ধাক্কা লাগা । এক্সিডেন্ট করা !
১২. সুপারি গাছের ডাল দিয়ে খেলা ছিল আরেকটা মজার ব্যাপার । একজন সেই ডালের গোড়ার দিকে বসতো । আর অন্য একজন কিংবা দুইঝন পাতা ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেট । এই ভাবে বসার পালা বদল হত । আমি অবশ্য ঠিকঠাক মত বসতে পারতাম না কোন কালেই । ডান কিংবা বাম দিকে কাত হয়ে পড়ে যেতাম । তাই আমি বসার থেকে টেনে নিয়ে যাওয়াটা বেশি পছন্দ করতাম !
আমার ছোট বেলা এই রকম কত কাজ করে কেটেছে । এই গুলো সামান্য কয়েকটা ঘটনা । আরও কত ঘটনা যে রয়েছে । এখনকার ছেলে মেয়েরা এই সবের ধার দিয়েও যায় না । আমি যে ফ্যামিলির সাথে সাবলেট থাকি, তাদের একটা বাচ্চা আছে । সবে মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে । জন্ম হওয়া থেকে তাকে দেখছি । খেলা বলতে সে এখন প্রতিদিন বিকেল বেলা বাসার সামনে রাস্তার উপরে আশে পাশের বিল্ডিংয়ের ছেলেমেয়েদের কিছু সময় দৌড়াডৌড়ি করে । ব্যাস আর কিছু না । আর সারাটা দিন সে ঘরে বন্দী । পড়াশুনা করে আর বাকি সময়ে সে টিভি, কম্পিউটার নয়তো স্মার্ট ফোন নিয়ে কাটায় । এই হচ্ছে এদের জীবন ।
ভাই আপনার লেখা পড়ি 4 বছরের বেশী হবে, তবে আজকের লিখাটা অন্য রকম। এইরকম লেখা ছাড়াও আপনি বিভিন্ন এক্সপেরিরেন্স শেয়ার করেন। এগুলো পড়লে একটা অন্য
রকম ভাল লাগা কাজ করে।এই পোস্ট এর যা কিছু আছে তার আমি সবকিছুই পেয়েছি
ভাই, চাচাতো মামাতো খালাতো ফুপাতো বোনদের সাথে চুমাচুমি এড়িয়ে গেলেন কেন?
এই কাজ আমি কোন দিন করি নি