অপেক্ষার শাস্তি

4.5
(63)

মাশরুফ এবার কোন ভাবেই শুনবে না । সে একটা জবাব চায় । সাবাকে সে এইভাবে এড়িয়ে যেতে দেবে না কোন ভাবেই । সাবা শান্ত কন্ঠে বলল, মাশরুফ সাহেব, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না ।
-কেন ? আমি কেবল কারণ জানতে চাইছি !
-আমি আগেই বলেছি । আমি একজনকে ভালোবাসি । তাকেই বিয়ে করবো !
-মিথ্যা কথা । আপনার কারো সাথে কোন রিলেশন নেই । এক সময়ে ছিল তবে সেটা ব্রেক আপ হয়ে গেছে । আমি সব খোজ নিয়েছি ।

সাবা কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, ওকে । আসুন আমার সাথে । তবে সব কিছু শোনার পরে আশা করি আর আমার সামনে এই কথা তুলবেন না । মনে থাকবে?

মাশরুফ বলল, ওকে ।

সাবা আর মাশরুফ একই অফিসে অনেক দিন ধরে চাকরি করছে । সময়টা প্রায় তিন বছর হতে চলল । একে অন্যের সাথে কাজের ফাঁকে আস্তে আস্তে একটা চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । অফিস ছাড়াও বাইরেও বাসা বাড়ির টুকটাক কথা বার্তা হত তাদের মাঝে । এরই মাঝে একদিন মাশরুম সাবাকে বিয়ের জন্য বলল । সাবা সেটা সরাসরি মানা করে দিল । কিন্তু মাশরুফ এমনি এমনি সেটা যেতে দিল না । কারণ এতোদিনে সে জেনেছে যে সাবার কোন ভালবাসার মানুষ নেই । ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য বলছে কিন্তু সাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না । এদিকে মাশরুফেরও বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে ।

অফিসের পাশেই একটা ছোট রেস্টুরেন্টে বসলো ওরা । মাশরুফ বলল, এবার বলুন শুনি !
-যা বলব সেটা আপনার কাছে কেমন মনে হবে সেটা আমি জানি না । জানতে চাই ও না । কেবল আপনি ইনসিস্ট করছেন বলে বলছি । আপনার সাথে আমার একটা চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে এই জন্য বলছি । সব কিছু শোনার পরেও যদি আপনি না শুনতে চান তাহলে আমার মনে হয় এর পরে আমাদের সম্পর্ক কোন দিকে যাবে সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই ।

মাশরুফ সাবার কথা গুলো বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারলো । সে সোজাসুজিই বলেই দিল যে মাশরুফকে থামতে হবে । নয়তো সাবা হয়তো তার সাথে আর কোনদিন কথাই বলবে না । তবে মাশরুফ আসলে জানতে চায় যে কেন সাবা তাকে বিয়ে করতে চায় না । কী এমন সে কারণ । যদি সাবার ভালোবাসার মানুষ থাকতো তাহলে ব্যাপারটা সে বুঝতে পারতো এবং কোন ভাবেই সাবার সামনে এই কথা তুলতো না । কিন্তু মাশরুফ খুব ভাল করেই জানে যে সাবার কেউ নেই । এই তিন বছরে কোন ছেলের সাথে তাকে ঐ ভাবে মিশতে দেখে নি সে । তার উপরে মাশরুফকে সে পছন্দ করে বেশ । তার আচরণেই বুঝা যায় সব । তাহলে বিয়ে না করতে চাওয়ার পেছনে কারণ টা কী ?

সাবা বলতে শুরু করলো, ইন্টারে পড়ার সময় থেকেই আমার একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল । ফারহান কবির । তারপর ইউনিভার্সিটি শেষ পর্যন্ত আমাদের রিলেশন ছিল । এমন কি চাকরিতে ঢোকার পরেও । আমার আগেই সে বের হয়েছে । সে আগেই চাকরিতে ঢুকেছিলো । আমিও এক বছর চাকরিতে ঢুকলাম । তারপর যা হয় আর কি ! চাকরিতে নতুন পরিবেশ একেবারে । নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হল । এক সময় আমি অন্য দিকে চলে গেলাম । অন্য একটা ছেলের সাথে মিশতে শুরু করলাম । তবে কোন দিন ফারহানকে ছাড়ার কথা আমি ভাবিও নি । কেন যে অন্য সেই ছেলেটার সাথে ইনভল্টভ হয়েছিলাম আমি নিজেও এখনও জানি না । ফারহান আমাকে যেভাবে ভালোবাসতো সেই ভাবে কোন মানুষ কোন দিন কাউকে বাসতে পারে না । সেটা আমি খুব ভাল করেই টের পেতাম । তারপরও আমি ফারহানকে বিট্রে করে অন্যায়টা করেই গেলাম । একদিন ফারহান সেটা জানতে পারলো । আমার সাথে কোন রাগারাগি করলো না । এমন কী আমাকে ছেড়েও দিল না । তবে কঠিন এক শাস্তি দিল সে ।
-কী শাস্তি ।
-ফারহান সেদিন খুব শান্ত ছিল । ওর কাছে ধরা পরে যাওয়ার পর আমার মনে আসলে ওকে হারানোর একটা তীব্র ভয় কাজ করছিলো । বারবার ওকে সরি বলছিলাম । কাঁদছিলাম । ও আমার সাথে চমৎকার সুন্দর ব্যবহার করলো । কখনও আমার সাথে ও খারাপ ব্যবহার করে নি । ঝগড়া হয়েছি আমাদের মাঝে কিন্তু কিন্তু সব সময় সে তার লিমিট বজায় রেখেছে । কখনও সেটা ক্রস করে নি । সেদিন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারছিলাম কী অপরাধ আমি করেছি । ঐ মানুষটাকে কষ্ট দিয়েছি । ফারহান সেদিন বলেছিলো, আমি কোন দিন ভাবিও নি তুমি আমার সাথে এই কাজটা করবে সাবা । সত্যিই কোন দিন ভাবি নি । নিজ চোখে তোমার ফোনের কনভারশেসন না পড়লে আর ছবি গুলো না দেখলে কোন দিন বিশ্বাসও করতাম না । যাই হোক, ভয় পেও না যে তোমার সাথে আমি ব্রেক আপ করবো । এই ভয়ে হয়তো তুমি কাঁদছো । তবে তুমি চাইলে আমাকে ছেড়ে দিতে পারো যে কোন সময় । চাও ব্রেক আপ করতে !
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, না না আমি চাই না । বিশ্বাস কর আমার ভুল হয়ে গেছে । আমি কিছুতেই তোমার থেকে আলাদা হতে চাই না ।
ফারহান অনেক সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, বুঝতে পারছি । ভয় নেই আগেই বলেছি । আমি তোমাকে কখনই ছেড়ে যাবো না । তবে তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে । অন্য সব কিছু আমি মুখ বুঝে সহ্য করে নিতে পারি কিন্তু এই বিট্রায়ালটা আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না । তুমি তোমার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছ । সেটা আবার তোমাকে অর্জন করে নিতে হবে ।
আমি তখনও কেঁদেই চলেছি । ফারহান বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই । সত্যিই চাই । তবে আজকে নয় । আজ থেকে ঠিক সাত বছর পরে । আজকে ২৫ শে আগস্ট ২০১৫ । ঠিক সাত বছর পরে ২০২২ সালের এই দিনে আমি এই টিএসসির মোড়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো । আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে এই সাত বছরে আমি কোন মেয়ে সাথে যুক্ত হব না । কেবল তোমাকে ভালবাসবো । তুমি জানো সেটা করবো । ইনফ্যাক্ট পুরো জীবনে আমি আর কাউকে কোন দিন ভালবাসতে পারবো কিনা জানিও না । তুমি এই সাত বছর আমাকে ছাড়া থাকবে । আমার প্রয়োজন যদি সেই সাত বছর পরেও তোমার অনুভব হয় তাহলে তুমি আবার তোমার গ্রহনযোগ্যা অর্জন করবে । হ্যা অবশ্যই তুমি অপেক্ষা নাই করতে পারো । এটা একান্তই তোমার ব্যাপার । অন্য কাউকে বিয়ে করে অন্য জীবন বেঁছে নিতো । তবে আমি ঠিক ঠিক সাত বছর পরে আসবো । তোমার জন্যই ।

মাশরুফ বলল, তারপর?
-তার আর পর নেই । প্রথম কিছুদিন আমি ফারহানের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি বারবার ক্ষমা চেয়েছি । তবে সে কিছু শোনেনি । সে একই কথা বলেছে । আমি স্বাধীন যে কাউকে কাছে টানতে পারি অপেক্ষা নাই করতে পারি । তবে তাকে পেতে হলে আমাকে এই সাত বছর অপেক্ষা করতেই হবে । এরপর ও বাইরে চলে যায় । আমি আর ওর খোজ পাই নি ।
-তারপর থেকে অপেক্ষা করছেন?
-হ্যা । করছি । আমি জানি ফারহান আসবে । সে সারা জীবনে আর কাউকে কোন দিন ভালবাসবে না । এই ভাবনা যতবার আসে ততবার নিজেকে বড় ছোট মনে হয় । মানুষটা আমাকে কীভাবে ভালবাসতো । জানেন একবার কী হয়েছে ! একবার ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করলাম । আমার হাত ভেঙ্গে গেল । রাস্তাঘাটে এতো জ্যাম ছিল যে আমাকে কোন ভাবেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছিলো না । ও আমাকে কোলে নিয়ে ফুটপাথ দিয়ে সে কী দৌড় । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখান দিয়ে কেমন করে পানি পড়ছে । আমার থেকে যেন ওর বেশি কষ্ট হচ্ছিলো । সেদিন প্রায় দুই কিলোমিটার সে আমাকে নিয়ে দৌড়েছিলো ।

দুজনই চুপ করে রইলো বেশ কিছুটা সময় । এরপর সাবা বলল, মাশরুফ সাহেব, আমি আপনাকে পছন্দ করি । আপনি চমৎকার একজন মানুষ । কিন্তু ফারহানকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে কল্পনা করতে পারি না । আশা করি বুঝতে পারছেন । এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মাঝে আর কথা না হওয়াই ভাল ।

পরিশিষ্টঃ

সকাল থেকে আজকে বৃষ্টি হচ্ছিলো । তবে এখন সেটা নেই । আকাশে মেঘ আছে । যে কোন সময়ে বৃষ্টি শুরু হতে পারে ।
হোক । তবুও সাবা এখন থেকে যাবে না । আজকে সাবা শাড়ি পরেছে । খোপাতে ফুল দিয়েছে । হাতে পরেছে কাঁচের চুড়ি । ফারহান আসবে একটু পরেই । তাকে আসতেই হবে । আজকে সাত বছর অপেক্ষার অবসান ঘটবে । আজকে সব অপরাধ থেকে মুক্তি মিলবে ।
আজকে সে আসবে !
তাকে আসতেই হবে ।

একটা গাড়ি এসে থামলো সাবার ঠিক সামনেই ।
এই তো গাড়ির গেট খুলে যাচ্ছে । সাবা সেদিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ….।
সে চলে এসেছে । তাকে আসতেই হয়েছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 63

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “অপেক্ষার শাস্তি”

Comments are closed.