তন্বীর দিনটা শুরু হয়েছে বকা শুনে । গত কাল রাতে ফাহমির সাথে বেশ বড় রকমের একটা ঝগড়া হয়েছিলো । সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বাবার কাছে একটা বড় রকমের বকা শুনেছে । বাবা ওর বিয়ে না করাটা নিয়ে বেশ বিরক্ত ! তন্বীর বাবার কথা হচ্ছে যে বিয়েটা তো করতে হবে ! ওর বন্ধবীরা সব ভার্সিটিতে থাকতেই বিয়ে করে ফেলেছে । সেখানে ও পড়া শুনা শেষ করে চাকরি পেয়েও বিয়ে করছে না । তার যে পছন্দের ছেলে আছে তার সাথেই তারা বিয়ে দিতে রাজি তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায় ?
তন্বীর সমস্যাটা হচ্ছে ও চাকরি পেলেও ফাহমি এখনও চাকরি পায় নি । আর চাকরি ছাড়া সে বিয়ে করবে না । এটা নিয়েই ওদের মাঝে এখন প্রায়ই ঝগড়া হচ্ছে ।
সকাল বেলা বেলা সেই বকা শোনার পর থেকে একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ওর সাথে ঘটছেই । সর্ব শেষ ঘটনা ঘটলো রেস্টুরেন্টে ।
তন্বী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা শেষ করে ফাইড স্টার একটা হোলেটের আউটডোর ম্যানেজার হিসাবে চাকরিতে ঢুকেছে সম্প্রতি । ওর কাজই হচ্ছে আউটডোর সারভিসটা ঠিক ঠাক মত হচ্ছে কি না সেটা দেখা ।
সেই ডিউটি দিচ্ছিলো এমন সময় মেইন গেট থেকে এক গার্ড এসে ওকে ডেকে নিয়ে গেল । তন্বী গেইকের কাছের গিয়ে দেখলো এক সুদর্শন দেখতে যুবক ছেলে সেখান দাড়িয়ে আছে । গার্ড তাকে আটকে রেখেছে । ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না ।
তন্বী ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি সমস্যা ?
ছেলেটার বলল, আপনাদের গার্ড আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না ।
তন্বী এবার ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকালো । ছেলেটার পরনে সাইক্লেলিং জার্সি । নিচে একটা টাইট থাইপ্যান্ট পরা । সাইকেল রেসে যেমন টা হয়ে থাকে । ইদানিং ঢাকা শহরে সাইকেল খুব বেশি দেখা যাচ্ছে ।
তন্বী বলল, দেখুন স্যার আপনি এই পোশাক পরে হোটেলের ভেতরে ঢুকতে পারবেন না !
-কেন জানতে পারি ?
-আমাদের একটা রুলস আছে । আর তাছাড়া হোটেলের ভেতরে সম্মানিত গেস্টরা আছে । তারা আপনার এই ড্রেস দেখে বিব্রত হতে পারে !
ছেলেটা এবার তন্বীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় ! তারপর বলল, তাহলে আপনারা আমাকে ঢুকতে দিবেন না ?
-আমি খুবই দুঃখিত স্যার !
-আপনি কি আমাকে চেনেন ?
-নো স্যার ! আমি আপনাকে চিনি না । চেনার দরকারও মনে করছি না । আমি খুবই দুঃখিত । আই হ্যাভ টু আস্ক ইউ টু লিভ !
ছেলেটা এবার বলল, ইউ উইল বি.. মিস !
ছেলেটা এবার গেট থেকে একটু সরে গেল । তারপর নিজের কোমরে আটকে থাকা মোবাইলটা বের করলো । তন্বী দেখলো ছেলেটা কাকে যেন ফোন করলো । তারপর ওর দিকেই তাকিয়েই রইলো এক ভাবে । তন্বীর ইচ্ছে করছিলো এখনই হোটেলের ভেতরে ঢুকে পরে কিন্তু ওর মনে খানিকটা কু ডেকে উঠলো । বারবার মনে হচ্ছিলো কিছু যেন একটা ঠিক হয় নি । সামনে ও বড় কোন রকমের ঝামেলাতে পড়তে যাচ্ছে ।
যখন ও আবারও গেট দিয়ে হোটেলের ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনই দেখতে পেল একটা কালো রংয়ের পাজেরো গাড়ি হোটেলের ঠিক সামনে এসে দাড়ালো । সেখানে থেকে দ্রুত একজন লোক বেরিয়ে এল । লোকটার হাতে একটা কালো রংয়ের স্যুট ! লোকটা সরাসরি গিয়ে সেই সাইক্লিস্ট যুবকের সামনে দাড়ালো তারপর স্যুট টা তার দিকে বাড়িয়ে দিল । তন্বী দেখতে পেল ছেলেটা ওর সামনেই জার্সির উপরে সেই স্যুট পরলো । তারপর তন্বীর সামনে এসে বলল, এবার কি ঢুকতে পারি ?
তন্বী চাইলে এখনও ছেলেটাকে হোটেলের ভেতরে ঢুকতে নাও দিতে পারে । তবে সেই সাহস সে করলো না । যার একটা ফোনে মাত্র কয়েক মিনিটের মাথায় একটা পাজেরো গাড়ি চলে আসতে পারে সে মোটেই ছোট খাটো কোন মানুষ নয় । সাইকেল চালাচ্ছিলো বলেই তন্বী প্রথমে ছেলেটাকে খুব একটা পাত্তা দেয় নি । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা মোটেই ফেলনা নয় ! মনের ভেতরে সেই কু-ডাকটা আরও বড় করে ডেকে উঠলো !
তন্বী বলল, অবশ্যই ! আসুন !
তন্বী তার আসল ভুলটা বুঝতে পারলো যখন হোটেলের ফুড এরিয়াতে ছেলেটা ঢুকলো । গেস্ট দিয়ে প্রায় ভরাই ছিল সেটা ! বেশির ভাগই দেশের বড় বড় বিজনেস ম্যান কিংবা বড় বড় অফিসে কাজ করা মানুষ জন । কেউ বা ব্যবসায়ী আলোচনা করছে কিংবা পরিবার নিয়ে এসেছে । ছেলেটা ঢুকতেই অন্তত অর্ধেক মানুষ উঠে দাড়ালো ! কয়েক জন ছুটে এসে হ্যান্ড শেইক করলো !
তন্বীর বুকের ভেতরটা এবার সত্যিই কেঁপে উঠলো । ওর সামনের এই মানুষটা যে খুব বড় কেউ সেটা বুঝতে ওর মোটেই কষ্ট হল না । ও তাকে চিনতে পারে নি । তাকে দাড় করিয়ে রেখেছে !
ছেলেটা ওর দিকে ফিরে তাকালো একবার । ছেলেটার চোখের দৃষ্টি দেখেই তন্বীর বুঝতে কষ্ট হল না ওর চাকরি গেছে । আর এখানে বসে থেকে লাভ নেই । নতুন চাকরি খুজতে হবে !
পরদিন সকালে যখন হোটেলের জেনারেল ম্যানেজারের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গলো তন্বীর বুঝতে বাকি রইলো না যে ওর ডাক চলে এসেছে । ম্যানেজার সাহেব ওকে খুব দ্রুত রেডি হয়ে হোটেলে চলে আসতে বলল ।
একবার তন্বীর মনে হল ও হোটেলে আর নাই যায় । গিয়ে তো সেই টারমিনেশ লেটার পেতে হবে । এর থেকে চুপচাপ শুয়ে থাকে । কিন্তু শুয়ে থাকতে পারলো না । উঠে পড়লো ।
কিন্তু যখন হোটেলের মেইন গেটে ম্যানেজার সাহেবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো তখন খানিকটা অবাক না হয়ে পারলো না । চাকরি থেকে যখন ছাটাই করে দিবে তখন মেইন গেটে এভাবে দাড়িয়ে থাকার মানে কি ?
ম্যানেজার সাহেব বললেন, এতো সময় লাগে ?
তন্বী বলল, স্যার আমার ডিউটি তো বিকেল বেলা ! আমি রেডি ছিলাম না । একটু সময় তো লাগবে !
-আচ্ছা ঠিক আছে । আসো ! জলদি আসো !
তন্বী তখনও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে । ও ভেবেছিলো ওর চাকরি আজকেই চলে যাবে কিন্তু ম্যানেজার সাহেব এমন আচরন করছে কেন ?
ম্যানেজার সাহেব দ্রুত হাটতে লাগলেন । তন্বীও দ্রুত হাটতে চেষ্টা করলো । ওর দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার সাহেব বললেন কাল রাতে আমাদের হোটেলের মালিকানা রাতারাতি বদল হয়ে গেছে ।
-কি বলছেন স্যার ?
-হ্যা । নতুন মালিক বসে আছে ব্রেকফাস্ট জোনে !
তন্বী কি বলবে খুজে পেল না । মালিক বদল হওয়া মানেই হচ্ছে চাকরি হারানোর ভয় । সেটা ম্যানেজারের চেহারা দেকেই বুঝা যাচ্ছে । এবার নতুন মালিক কে জানো ? দেশের সব চেয়ে বড় ব্যবসাদের একজন । সব থেকে ইয়াং কোটিপতি ! গত ছয় বছর ধরে সেই বিজনেস ম্যান অব দ্য ইয়ারের পুরস্কার পাচ্ছে । সায়ন চোধুরী ! চিনো তাকে !! মাই গড ! আমি তো ভাবতেই পারছি না !
তন্বীকে চিনতে হল না । ব্রেকফার্স্ট জোনে ঢুকতেই মানুষটাকে দেখতে পেল । গতকালকের সেই যুবক । সেই এক সাইকেলিং ড্রেস পরে বসে আছে ।
ম্যানেজার সাহেব তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলল, যাও স্যারকে এটেন্ড কর ! উনি তোমাকে চেয়েছেন ।
তন্বী কিছু বুঝতে পারছিলো না । এই ছেলে হোটেল কিনে নিয়েছে । ভাল কথা । এখন তো সে এক তুড়িতেই ওর চাকরি খেয়ে ফেলতে পারে । ওকে চাকরি থেকে বের করতে দিতে পারে । কিন্তু সেটা করছে না ।
তন্বী নিজের কাছেই খানিকটা অপমানিত বোধ করলো । খাবার সার্ভ করা ওর কাজ নয় । কিন্তু তন্বীকেই খাবার সার্ভ করতে হল । সায়ন চৌধুরীর টেবিলে সেটা সাজিয়ে দিতে হল !
তন্বী বুঝতে পারলো সে গতকালের অপমানের বদলা নিচ্ছে । তন্বীর নাক লাল হয়ে গেল । সে তখনই ঠিক করে নিল যে এই চাকরি সে আর করবে না । হতে পারে দেশের সব চেয়ে বড় লোক তবে এভাবে অপমান করার অধিকার তার নেই । সায়ন চুপচাপ খাবার খেয়ে চলল । কোন কথা বলল না । খাবার শেষ করে তন্বীর হাতে একটা ৫০ টাকার টিপ দিল । তার সার্ভিসে সে খুশি হয়েছে ।
তন্বী কেবল কাঠ হয়ে দাড়িয়ে রইলো । তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে এই চাকরি সে করবে না !
ঐ দিন দূপুরেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাসায় ফিরে এল ! তার জীবন থেকে সায়ন চৌধুরীকে সে বের করে দিল । আর তার মুখ দেখতে চায় না ! কিন্তু মানুষ যা চায় জীবন সে সব সময় সেই রকম কিছু হয় না । তন্বীর জীবনও সেই রকম কিছুই অপেক্ষা করছিলো !
দুই
ঠিক দুইদিন পরে তন্বী ২৭ নাম্বারে ডি এলপাস রুফটপ রেস্টুরেন্ট এসে হাজির হল । ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে আজকে সে সায়ন চৌধুরীকে দেখে নেবে । গতদিন সে তার নিচে কাজ করতো কিন্তু আজকে আর সে তার এম্প্লোয়ি নয় । যদি সে কোন রকম উল্টাপাল্টা কাজ করতে চায় তাহলে সেটা সে কিছুই সহ্য করবে না !
-আসুন মিস তন্বী ! বসুন !
তন্বী গিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়েই দেখতে পেল সায়ন চৌধুরী আগে থেকেই সেখানেই বসে আছে । আজকে সে একটা কালো একটা টিশার্ট পরে আছে । সেই সাথে ঘিয়ে রংয়ের প্যান্ট । যতই মেজাজ গরম থাকুক তন্বীর এটা স্বীকার করে নিতেই হল যে সায়ন চৌধুরী খুবই সুদর্শন একজন মানুষ । মেয়েরা ঠিক এমনই ছেলেকেই নিজেদের প্রেমিক কিংবা স্বামী হিসাবে কামনা করে !
তন্বী সেই চিন্তাটা মাথা থেকে দুর করে দিল । মনে মনে সে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল । আজকে এমন কিছু করে নি !
তন্বী বসতেই সায়ন বলল, কিছু খাবেন ?
-জি না । কি জন্য ডেকেছেন বলুন ? আমার কাজ আছে !
-কাজ ! আমি যতদুর জানি আপনি তো চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন । এখন তো আপনার ফ্রি সময় !
-আপনি আমার সব কিছু জানেন না । কি দরকারে ডেকেছেন বলুন !
সায়ন হাসলো । তারপর বলল, বাহ ! এতো রাগ কেন আমার উপর ? আমি কি করলাম ?
তন্বী বলল, আপনি কি বলবেন না আমি চলে যাবো !
-আচ্ছা আচ্ছা বলছি ।
এই বলে নিজের পকেট থেকে একটা খাম বের করে তন্বীর সামনে রাখলো ।
তন্বী বলল, কি এটা ?
-এটা আপনার এপোয়েন্টমেন্ট লেটার ! আমার পারসোনাল সেক্রেটারি ! পিএস !
-আপনার কেন মনে হল আমি এই চাকরি করবো ? যদি আপনার আন্ডারে চাকরি করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে আমি আগের চাকরি ছাড়তাম না !
সায়ন চৌধুরী হাসলো ! তন্বী সায়ন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো এই হাসিটা আগের হাসি গুলো থেকে আলাদা । ঠান্ড হাসি !
সায়ন চৌধুরী বলল, আমার মনে হয় আপনি চাকরিটা করতে রাজি হবেন । কেন জানেন ?
তন্বী কোন জবাব দিল না । সায়ন চৌধুরী বলল,
-আসুন আপানাকে আমি বুঝিয়ে বলি যদি আপনি চাকরি টা না করেন তাহলে আপনার সাথে কি কি হতে পারে !
সায়ন চৌধুরী একটু দম নিল । তারপর বলল, আমি জানি আপনি কি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন । যদি এই চাকরিটা না করেন তাহলে এই টুকু নিশ্চয়তা আমি আপনাকে দিতে পারি যে আর কোথায়ও আপনি চাকরি পাবেন না । এন্ড আই মিন ইট । আমার টাকার কোন অভাব নেই । আর এই দেশে যার টাকা আছে তার কাছে সব কিছু আছে । আমি এটা নিশ্চিত করবো কোন প্রাইভেট সেক্টরে যেন আপনি চাকরি না পান । যদি সরকারিতে ঢুকতে যান, আমি নিজে ব্যাপারটা দেখবো যাতে ভাইভা বোর্ডে আপনাকে আটকে দেওয়া হয় ! তারপর যদি ভাবেন চাকরি বাকরি করবেন না । বিয়ে করে সংসার পাতবেন সেটাও আমি হতে দিবো না । যে যে সম্মন্ধ আসবে আপনার কাছে সেটা আমি আটকে দিবো যদি একান্তই আটকাতে না পারি তাহলে আপনার স্বামীর উপর যত রকম বিপদ আনা সম্ভব সব আনবো ।
তন্বী খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনে বসা মানুষটার দিকে । মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না । সায়ান চৌধুরী আবার শুরু করলো ।
-এবার আসি অন্য দিকে । আপনি চাকরি করলেন না বিয়ে করলেন না । কিন্তু এখানেই ঝামেলা থেমে থাকবে না । প্রথমে আমি আপনার বাবার দিকে খেয়াল দিল । সে যেখানে চাকরি করে সেখানে তার উপর নানান বিপদ নেমে আসবে । এই মনে করেন টাকা পয়সার ঝামেলা হবে । ঘুম নিতে গিয়ে ধরা পরবে আরও কত কিছু । আপনার বড় ভাই যে কিনা সিলেট থাকে বউ নিয়ে তার উপরে বিপদ নেমে আসবে । হতে তার চাকরিও চলে গেল । আপনার ভাবি সম্প্রতি কনসিভ করেছে সেটা কি জানেন । এই সময়ে আপনার ভাইয়ার চাকরি চলে গেলে কি বিপদ হবে একবার ভেবে দেখেছেন !
তন্বী আর কিছু ভাবতে পারলো না । সায়ন চৌধুরী সেই ঠান্ডা চোখে তার দিকে আছে । এবার খানিকটা ভয় পেতে শুরু করেছে । সামনে বসা মানুষটা মাত্র এক রাতের ভেতরে ওদের পুরো হোটেলটা কিনে নিয়েছে । সে যা যা বলল সেই সব কিছু যে করার ক্ষমতা রাখে সেটা সে জানে !
সায়ান চৌধুরী উঠে দাড়ালো । তারপর বলল, সকাল ঠিক দশটায় আমি ব্লাক কফি খাই অফিসে ঢুকেই । টেবিলের সামনেই যেন কাপটা থাকে । মনে রাখবে ব্যাপারটা ! গুড ডে !
তারপর ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকের বিল ম্যাম দিবেন । চৌধুরী গ্রুপে নতুন চাকরি পেয়েছে সে !
এই বলে সে হেটে চলে গেল । তন্বী তখনও বসেই আছে । সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে কে জানে !
ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল । তারপর বলল, আপনার নতুন চাকরির জন্য কনগ্রাচুলেশন ম্যাম !
তন্বী কেবল রাগত চোখে ওয়েটার দিকে তাকালো ! ইচ্ছে হল কষে এক বড়ে মারে ওয়েটারের গালে । কিন্তু সেটা সম্ভব না ! তীব্র এক রাগে সামনের রাখা পানির গ্লাসটা মাটিতে আছাড় মারলো ।
তিন
ঠিক সকাল নয়টার সময়ে তন্বী অফিসে এসে হাজির হল । মুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটে উঠেছে । এমন একটা চাকরি যে কোন মানুষের জন্য একটা সোনার হরিণ হিসাবেই বিবেচিত হবে । ওর বাসায় চাকরির খবর জানার পরে সবাই খুব খুশি । বিশেষ করে বেতনের পরিমানটা দেখার পরে তার মায়ের খুশি তো আর ধরে না । এমন কি ফাহমিও অনেক অভিনন্দন জানালো । বলল যে এই চৌধুরী গ্রুপটা বেশ ভাল এগিয়ে চলছে । সাথে সে এও বলল যে যদি সম্ভব হয় তাহলে যেন ওর জন্য একটা তকদির করে । যেহেতু যে বসের পিএস হতে যাচ্ছে ।
তন্বী কাউকে কিছুই বলল না । বিশেষ করে কিভাবে আর কেন সে চাকরিটা পেল সেটা নিয়ে কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা কারো কাছে দিল না সে । ব্যাখ্যা করার কিছু ছিলও না । তন্বী কেবল জানে যে সায়ন চৌধুরী নামের মানুষটার খপ্পড়ে পড়েছে সে । এমন ভাবে আটকে গেছে যে সেখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় সে দেখছে না । অন্তত এখন তো মোটেই নয় । তাকে এখন তাই করতে হবে । আচ্ছা সায়ন চৌধুরী যদি তার সাথে অন্য কিছু করতে চায়? সে যেহেতু তার পিএস । এখন থেকে সব সময় তার সাথেই থাকতে হবে । আর অফিসের বস তার মেয়ে সেক্রেটারির সাথে কিছু করার ঘটনা তো হর হামেসাই ঘটে । যদি কিছু করে তাহলে কি তন্বীর কিছু করার আছে?
তন্বী জানে কিছু করার নেই । কিছু করতে পারবে না সে ।
কেন যে সেদিন রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দিলো না । ইস যদি ঢুকতে দিতো তাহলে আজকে এই ঝামেলাতে তাকে পড়তে হত না কোন ভাবেই ।
অফিসে আসতে আসতে সে ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলো । অফিসে পা দিতেই দেখতে খানিকটা চমকে গেল । তার জন্য রিসিপশনেই একটা মেয়ে দাড়িয়ে ছিল । মেয়েটার পরনে হাটু পর্যন্ত লম্বা স্কার্ট । উপরে অফিস টপ । করিডোর দিয়ে আসার সময় যে কয়টা মেয়ের সাথে দেখা হল সবার পরনেই একই ধরনের পোশাক !
তন্বীকেও কি এই ধরনের পোশাক পরতে হবে ?
তন্বীকে নিয়ে সরাসরি তার ডেস্কে এসে হাজির হল । ঠিক সায়ন চৌধুরীর কেবিনের সামনেই তার ডেস্ক । তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার পর বলল, আপনার জন্য ড্রেস আপনার ড্রায়ারের নিচের থাকে আছে । ওটা ওয়াশ রুমে গিয়ে পরে নিন ।
তন্বী যা ভেবেছিলো তাই । তাকেও এই একই ধরনের ড্রেস পরতে হবে !
তন্বী কিছু সময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ের রইলো । তারপর বলল, আমাকেও পরতে হবে!
-জ্বী ! এই অফিসের স্ট্রিকট ড্রেস কোড রয়েছে । ছেলেদের এবং মেয়েদের । এটা সবাইকে মেনে চলতে হয় !
-না মানলে ?
-প্রথমবার ভুল করলে মাফ করে দেওয়া হয় বটে কিন্তু দ্বিতীয় ভুলে চাকরি চলে যায় ।
-গ্রেট !
মেয়েটা যেন ঠিক বুঝতে পারলো না তন্বীর কথা । বলল, কোন মানে নেই । সাবধান করার জন্য ধন্যবাদ । আমি ব্যাপারটা মাথায় রাখবো ।
মেয়েটা কিছু সময় তন্বীর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, স্যার কফি খান দশটার দিকে । উনি অফিসে ঢোকার সাথে সাথেই ।
-হ্যা হ্যা আমার মনে আছে । টেনশন নিবেন না । আমার সব মনে আছে ।
-আর স্যার যদি বেল বাজান তাহলে সাথে সাথে ভেতরে যাবেন । অন্য সব কাজ ফেলে দিয়ে । মনে থাকবে কি?
-হ্যা থাকবে !
তন্বী মনে মনে হাসলো । সে খানিকটা ঠিক করেই নিয়েছে কী কী করবে ।
সায়ন চৌধুরী অফিসে ঢুকলো ঠিক দশটা এগারো মিনিটে । ঢুকেই দেখতে পেল তার টেবিলের উপরে একটা কফির কাপ । অন্যান্য দিন যে যখন ঘরে ঢোকে তারপর তার কফি সামনে আছে কিন্তু আজকে আগেই এসে হাজির হয়েছে । ব্যাগটা এক পাশে সরিয়ে রেখে কাপটা হাতে নিল । একটা চুমুক দিতেই মেজাজটা একটু খারাপ হল। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে । সাথে সাথে কফিতে চিনি বেশি হয়েছে ।
বেল বাজালো । তন্বী একেবারে সাথে সাথে না ঢুকলো না । একটু পরে ভেতরে ঢুকলো । তন্বীকে দেখে সায়নের মেজাজটা আরও একটু খারাপ হল । মূলত তন্বীর ড্রেস দেখে । মেয়েটা একটা সবুজ রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরে আছে ।
সায়ন বলল, কী ব্যাপার এই ড্রেস কেন? নুপুর তোমাকে ড্রেস দেয় নি ।
তন্বী খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, হ্যা দিয়েছে ।
-তাহলে পর নি ।
-আমি আমার এই ড্রেসে খুব একটা সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না । আর ঐ ড্রেসে আমি কমফোর্ট ফিল করবো না ।
-অফিসের নিয়ম তোমাকে মানতে হবে ।
-এইটা কোন নিয়ম না । আর এটা মিলিটারি একাডেমিও না । আমি ঐ ড্রেস কিছুতেই পরবো না ।
সায়ন চৌধুরী শান্ত চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তন্বীর মনভাব যেন বোঝার চেষ্টা করছে । তারপর বলল, কফি ঠান্ডা কেন?
এই জবাব দেন তন্বীর মুখে রেডিই ছিল । বলল, আপনি বলেছিলাম ঠিক দশটা । আমি একেবারে দশটা সময় কফি বানিয়ে রেখেছি । বিশ্বাস না হয় তো সিসি টিভির ফুটেজ দেখতে পারেন ।
তন্বী দেখেছে ওর ডেস্কের সামনেই একটা সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে । কে কে সায়নের কেবিনে ঢুকে সেটা পরিস্কার দেখা যায় । তন্বী যখন কফি নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে সেটাও রেকর্ড হয়ে গেছে নিশ্চিত ।
সায়ন নিজের রাগটাকে দমন করার চেষ্টা করলো । তারপর বলল, এখন থেকে আমি যখন ভেতরে ঢুকবো তখন কফি চাই ।
তন্বী সাথে সাথে বলল, ঢোকার সাথে সাথেই ? এটা কেমন করে হবে ? কফি বানাতে তো সময় লাগবে । নাকি? এক কাজ করবেন । আপনি যখন অফিস থেকে ৫ মিনিট দুরে থাকবেন তখন আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিবেন । আমি কফি রেডি করে রাখবো ।
সায়ন বলল, তুমি কী আমার সাথে ইয়ারকী মারার চেষ্টা করছো?
-মোটেও না । আমি কেবল আমার কাজ করার চেষ্টা করছি । নতুন চাকরি এটা । তাই শিখে নেওয়ার চেষ্টা করছি যেন আপনাকে ভালোভাবে সার্ভিস দিতে পারি । বলা যায় সেদিনের মত ৫০ টাকা টিপও পেয়ে যেতে পারি !
সায়ন বলল আরেক কাপ কফি । ব্ল্যাক । চিনি ছাড়া ।
-ইয়েস বস !
এই বলে তন্বী আর্মির মত স্যালুট দিল । তারপর আবার কেবিন থেকে বের হয়ে গেল । ফিরে এল একটু পরেই । হাতে কফির কাপ । সায় সায়ন কফির কাপটা নিতে নিতে তন্বীকে বলল, আমি বুঝতে পারছি তুমি কী করার চেষ্টা করছো । পরামর্শ থাকবে যে এসব কিছু না করার । তোমার জন্য ভাল হবে যে আমি যা বলবো যেভাবে বলবো সেভাবে কাজ করবে । কথাটা মনে রাখবে । এটাই তোমার জন্য ভাল হবে । বুঝতে পেরেছো কি?
-জি স্যার ।
-গুড ! এখন টেবিলের ওপরে রাখা কাপটা নিয়ে যাও । আর আমার কোর্ট টা ঠিক মত হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখো । আর যাওয়ার আগে পিসিটা চালু করে দিয়ে যাও ।
তন্বী নিজের ডেস্কে এসে বসলো । রাগে ওর মাথাটা সায়ন চৌধুরী ওকে কেবল চাকরের মত হুকুম করে যাচ্ছে । এটা করে মজা পাচ্ছে সেটা তন্বী বুঝতে পারলো । মনে মনে কেবল প্রতিজ্ঞা করলো যে ওর হাতে এমন কিছু যদি কোন আসে যা দিয়ে এই ব্যাটাকে টাইট করা যায় তাহলে সেদিন ব্যাটাকে দেখে নিবে । এখন কিছু করতে পারছে না বলে সহ্য করে নিচ্ছে ।
পরের একটা সপ্তাহ তন্বীর জীবনটা একেবারে নরক বানিয়ে দিল সায়ন চৌধুরী । নতুন চাকরিতে বুঝে উঠতে সময় তো লাগলোই সেই সাথে সায়ন ওর পেছনে লেগে রইলো বরাবরই । এমন কী এক গ্লাস পানি ঢালার জন্যও সে তন্বীকে ডাক দিল । ওকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিল । সেদিন হাত থেকে একটা গ্লাস পরে ভেঙ্গে গিয়েছিলো । তন্বীকে ডেকে সেটাও পরিস্কার করালো । এটা পিয়নের কাজ । সে দরজা থেকে একটু দুরে বসে । তাকে ডাক দিলেই সে কাজটা করবে কিন্তু সায়ন তন্বীকে দিয়েই কাজটা করাবে । তন্বীও মুখ বুঝে সহ্য করে গেল কেবল । সহ্য করা ছাড়া আসলে আর কোন উপায় নেই ।
ফাহমির সাথে প্রতিদিন রাতেই তন্বীর ঝগড়া বাঁধছে । প্রতিদিন কাজের চাপের কারণে এমনিতেই ওর মন মেজাজ ভাল থাকছে না । ফাহমির সাথে কথা বলতে গেলে সমস্ত রাগ ওর উপর ঝাড়ছে সে । ফাহমিকে বেশ কয়েকদিন থেকেই ও বিয়ের জন্য বলে যাচ্ছে কিন্তু ফাহমির কিছুতেই চাকরি না করে বিয়ে করবে না ঠিক করেছে । এটা নিয়ে দুজনের ভেতরে তর্কাতর্কি লেগেই আছে নিয়মিত । তন্বী বুঝতে পারছে যে দিন দিন ওদের সম্পর্কটা খারাপের দিকেই যাচ্ছে । এমন কেন হচ্ছে ?
আগে তো এমনটা ছিল না মোটেও । ফাহমি তো কোন কালেই এমন ছিল না । ওদের ভেতরে কথাও এমন ছিল । যেই আগে চাকরি পাক না কেন, বিয়ে করে ফেলবে । এখন ফাহমি চাকরি পাচ্ছে না বলে বিয়ে না করার অযুহাত দিচ্ছে । এমন কেন করছে ছেলটা ? কেন?
তন্বী তাই ঠিক করলো ফাহমিকে এবার ভাল করে ধরতে হবে । তন্বী খুব ভাল করেই জানে যে ফাহমি ওকে ভালোবাসে । একটু ভাল করে বুঝিয়ে বললে সে রাজি হয়ে যাবে বিয়ের জন্য । বাড়িতে বিয়ে নিয়ে প্যারা আর ভাল লাগছে না । ওদিকে আবার রয়েছে অফিসের ঝামেলা । এতো কিছু এক সাথে সামাল দেওয়া তন্বীর পক্ষে কষ্টের হয়ে যাচ্ছে । অন্তত ফাহমির সাথে যদি ওর বিয়েটা হয় তাহলে বাসার ঝামেলাটা দুর হবে । ফাহমির সাথে ঝগড়াটা আর হবে না । আজকে ছুটির দিনে তাই তন্বী ঠিক করলো ফাহমিকে সব কিছু খুলে বলবে ।বিশেষ করে অফিসের ব্যাপারটা । ও নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারবে সেটা ।
Vai, bakita?
ধন্যবাদ।কিন্তু এতটুকু তে পিপাসা মিটলো না ভাই
কবে আসবে ২য় অংশ???
you are too rude…
Please take my humble request and give the rest..
Vlo