কেবিন নম্বর ১৭

কেবিন নম্বর ১৭
4.8
(98)

রাতের বেলা হাসপাতলে থাকতে নিকিতার ভাল লাগে । যদিও ওর বাবা ব্যাপারটা পছন্দ করেন না । বিশেষ করে এই সময়ে তার বাবা হাসপাতালে থাকেন না । এই সময়ে চাইলে একটা দুটো সিগারেট খাওয়া যায় ! আজও সিগারেট ধরিয়ে বসেছিলো ক্যান্টিনে । হাসপাতালে সিগারেট খাওয়ার কোন সুযোগ নেই । এমন কি এই ক্যান্টিনেও না । কিন্তু নিকিতার বাবা হচ্ছে এই হাসপাতালটার মালিক । নিকিতা একজন ডিরেক্টর । সে একটু নিয়ম ভাঙ্গতেই পারে । তাছাড়া এখন ক্যান্টিনে মানুষজন নেই ।

-আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?
নিকিতা ফিরে তাকালো । একজন ৩০/৩২ বছরের যুবক তার সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । মানুষটার চেহারা তার পরিচিত । কয়েক দিন ধরেই সে এই মানুষটাকে দেখছে ।
যুবক আবারও বলল, আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি ? যদিও নন স্মোকিং সাইন রয়েছে এখানে কিন্তু আপনি যেহেতু ধরিয়েছেন ! আপনার স্টাফ বলল যে আপনি এই হাসপাতালের মালিক । তাই আপনি পারেন আমি পারি না । আপনার কাছে অনুমুতি নিতে এলাম ।

নিকিতা বলল, বসুন এখানে । এখানেই ধরান ! আর আমি মালিক নই । আমার বাবা মালিক । আমি এখানে কাজ করি ।
চেয়ারে বসতে বসতে যুবক বলল, ধন্যবাদ !
তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো । নিকিতা যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ঠিক সিগারেট খেতে অভ্যস্ত নন । তাই না ?
-কীভাবে বুঝলেন?
-আমি যেহেতু অভ্যস্ত আমি জানি । দেখলেই বোঝা যায় !
-জ্বী ঠিক ধরেছেন । খুব বেশি সময় হয় নি ধরেছি !
-মিস্টার ইফতি, আপনি জানেন যে জীবনের সব কিছুর উপরে মানুষের হাত থাকে না । তাই না?

নিকিতা ইফতি রায়হানকে চেনে কদিন থেকে যদিও তাদের কথা হয় নি একবারও । কয়েকবার কেবল দেখা হয়েছে । কেবিন নম্বর ১৭ তে ইফতি রায়হানের স্ত্রী রয়েছেন । মেয়েটি ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে রয়েছে । গত তিনমাস মেয়েটি সিঙ্গাপুরে ছিল । সেখানে সর্বাত্বক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি । তারা বলে দিয়েছেন যে এখন আর কিছুই করার নেই । শেষ কটা দিন প্রিয়জনের আশে পাশে থাকুক । ডাক্তারদের এমনই একটা মনভাব ছিল । তাই তাকে দেশে আনা হয়েছে । এবং ওদের এই হাসপাতালে রাখা হয়েছে ।

তবে ইফতিকে সে চেনে অন্য কারণে । এই এগারো দিনে ছেলেটা একটা মিনিটের জন্য হাসপাতাল ছেড়ে যায় নি । কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই এগারো দিনে ছেলেটা একটা বারের জন্যও তার স্ত্রীর কেবিনে ঢোকে নি । প্রতিদিন মেয়েটাকে দেখতে অনেকেই আসছে । অনেকে ভেতরে ঢুকছে কিন্তু ছেলেটাকে একটা বারের জন্যও ভেতরে ঢুকতে দেখেনি সে । প্রথমে খানিকটা সন্দেহ হয়েছিলো । তারপর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছে কৌতুহল মেটানোর জন্য । এবং দেখতে পেয়েছে ছেলেটা আসলেই ভেতরে ঢোকে নি । করিডোরে পায়চারি করেছে সারা রাত । কিন্তু ভেতরে ঢোকে নি !
কেন কে জানে !

নিকিতার ইচ্ছে করলো একবার তাকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে কিন্তু করলো না । ছেলেটা কেমন উদাস চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আর মাঝে মাঝে সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে, ধোঁয়া ছাড়ছে । নিকিতা ছেলেটার চোখে একটা অচেনা বিষাদ দেখতে পেল। তার স্ত্রীর জন্য?

সিগারেট খাওয়া শেষ হলে ইফতি বলল, ধন্যবাদ অনুমতি দেওয়ার জন্য । আমি আসি ।
-বসুন ইফতি সাহেব । করিডোরে হাটাহাটি করার চেয়ে এখানেই বসুন ! তাকে তো আর দেখতে যাবেন না । তাই না ?

ইফতি আবার বসলো । নিকিতা বলল, কারণ টা কি বলা যায় যে কেন আপনি কেবিনে ঢোকেন না ?
ইফতি অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি তো নীলাকে দেখেছেন তাই না ?
-হুম !
-সে দেখতে অনেক সুন্দর । আমার চোখে ওর থেকে সুন্দর আর কেউ নেই । যখন ওর প্রথম কেমো দেওয়া হল ওর চুল সব পড়ে যেতে শুর করলো, হাতের চামড়া কেমন ফেটে গেল । নীলা আমাকে একদিন কাছে ডেকে বলল যেন আমি ওর সামনে আর না যাই । ওর এই চেহারা যেন না দেখি । ওর চেহারা যখন আগে সুন্দর ছিল তেমন করেই যেন ওকে মনে রাখি । ওকে দেখে যে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম এটা ওকে কষ্ট দিচ্ছিলো বেশি । ওর সামনে যেতে পারি না আর ! কিন্তু ওকে ছেড়েও যেতে পারি না ! তবে আমরা কথা বলি ফোনে । দেওয়ালের এপাশে বসে থেকে । ও চুপচাপ শোনে আমার কথা ! কত কথা যে বলি তবুও যেন কত কথা বাকি রয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে !

নিকিতা খেয়াল করলো ইফতির চোখ দিয়ে পানি বের হতে শুরু করেছে । একটা পূর্ন বয়স্ক পুরুষের চোখে পানি খুব একটা দেখা যায় না । তবে আজকে এই পানি দেখে নিকিতার মনে হঠাৎ একটা তীব্র কষ্ট এসে জমা হল ! একটা মানুষ কিভাবে এতো ভাল ভাবে আরেকজন কে? ওকে কি কেউ এভাবে ভাল বাসবে কোন দিন ?

-আপনাদের কতদিনের সংসার?
-এই ছয় বছরের ।
নিকিতার হঠাৎ মনে হল বেবির কথা জিজ্ঞেস করে কিন্তু করলো না । এই সব অযাচিত প্রশ্ন করার কোন মানে হয় না । ইফতি আরও কিছু সময় বসে থেকে চলে গেল । নিকিতা আরও কিছু সময় বসে থেকে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো । রাত হয়েছে অনেক । দুইটার দিকে আরেকবার রাউন্ড দেওয়ার কথা । নিজের কেবিনের দিকে না গিয়ে কী মনে করে কেবিন নম্বর ১৭ এর দিকে গেল । ইফতিকে দেখতে পেল । কেবিনের বাইরে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে চুপচাপ । রাতের বেলা এখানে বাইরের কারো থাকার নিয়ম নেই । কিন্তু কোন ইফতির বেলাতে এর ব্যতিক্রম করা হয়েছে । ইফতির বাবার সাথে নিকিতার বাবার কেমন যেন একটা চেনা পরিচয় রয়েছে । সেখান থেকেই এই নিয়মের ব্যতীক্রম করা হয়েছে ।
নিকিতা কেবিনে ঢুকলো । বেডের উপরে মেয়েটা শুনে রয়েছে । ঘুমিয়ে রয়েছে । পাশে আরও একটা বেডে শুয়ে আছে আরও একজন মহিলাম । ইনি নীলার মা । দুইজনই ঘুমিয়ে । নীলা চুপচাপ দেখলো কিছু সময় । তারপর আবার বের হয়ে এল রুম থেকে । চুপচাপ হাটা দিল নিজের কেবিনের দিকে । ওর মন খারাপ হয়ে আছে ।

ঠিক চারদিন পরে নীলার অবস্থা আরও খারাপ হল । নিকিতা বুঝতে পারলো যে নীলার হাতে আর বেশি সময় নেই । মনে হল এই সময়ে ইফতির কাছে থাকাটা দরকার । এর আগে অনেক মৃত্যু সে দেখেছে । দেখেছে যে কাছের মানুষ গুলো কাছাকাছি থাকলে মানুষের মৃত্যুটা সহজ হয় !
নিকিতা নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার হাজব্যান্ডকে ডেকে দিবো?
নীলা মৃদু স্বরে বলল, ওকে ডাকবেন না । আমার এই কষ্ট ও দেখতে পারবে না ।
নিকিতা বলল, আমি সেটার ব্যবস্থা করছি । বিশ্বাস করুন ভাল লাগবে আপনার । একটু অপেক্ষা করুন ।

নিকিতা বেডের সাইডে একটা পর্দা টেনে দিল । নীলাকে আর দেখা যাবে না । এরপর ইফতিকে ডেকে আনলো ভেতরে । ইফতি প্রথমে আসতে চাইছিলো না তবে আসলো নিকিতার কথা শুনে । বসলো পর্দার পাশেই । নীলা একটা হাত বাড়িয়ে দিলো পর্দার বাইরে । ইফতি সেই হাত ধরেই হুহু করে কেঁদে ফেললো !

নিকিতা পাশেই দাড়িয়ে দেখছিলো । কেন জানি ওর চোখ দিয়েও পানি বের হয়ে এল । নীলা মৃদু স্বরে বলল, কাঁদছো কেন বোকা ছেলে ? কাঁদবে না । তুমি জানো এখন প্রতিদিন ঘুমালে আমার কেবল তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো চোখের সামনে ভাসে । কী চমৎকার দিন গুলো কাটিয়েছি আমরা । আমার কোন আফসোস নেই জানো ! আমি ওপাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । উপরওয়ালা নিশ্চয়ই আমাদের আমাদের মিলিয়ে দেবেন !

ইফতি কোন কথাই বলতে বলতে পারলো না । কোন মতে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে চলেছে সে । নীলা আবার বলল, আর তুমি কিন্তু একা থাকবে না মোটেও । তুমি মোটেও নিজের দেখা শুনা করতে পারো না একা একা । অবশ্যই বিয়ে করবে । একটা মিষ্টি মেয়েকে দেখে ! মনে থাকবে তো !

ইফতি বলল, তুমি চুপ করে থাকো । আমার বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না !
নীলা হাসলো । তারপর বলল, না আমাকে কথা দাও যে বিয়ে করবে তুমি ! কথা দাও । দিতে হবে !
-আচ্ছা কথা দিলাম ।
-এই লক্ষি ছেলে । ভাল থেকো ইফতি । আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি । অনেক ।
-আমিও তোমাকে ভালোবাসি !

নীলা আর বেশি সময় বাঁচে নি । শেষ সময়ে ডাক্তাররা তাকে আইসিইউতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো তবে নীলা যেতে চায় নি । ইফতির হাত ধরেই বসে ছিল । নিকিতাও ছিল সেই রুমেই । একটা সময়ে সে রুম ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এল । নিজের কেবিনের ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । এই ছোট জীবনে অনেক মৃত্যু দেখেছে তবে আজকের ব্যাপারটা একটু আলাদা । ওর কেন জানি ভেতর থেকে খুব তীব্র কান্না আসছিলো। এই কান্নার উৎস সে নিজেও জানে না !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 98

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →