কেবিন নম্বর ১৭

কেবিন নম্বর ১৭
4.7
(84)

রাতের বেলা হাসপাতলে থাকতে নিকিতার ভাল লাগে । যদিও ওর বাবা ব্যাপারটা পছন্দ করেন না । বিশেষ করে এই সময়ে তার বাবা হাসপাতালে থাকেন না । এই সময়ে চাইলে একটা দুটো সিগারেট খাওয়া যায় ! আজও সিগারেট ধরিয়ে বসেছিলো ক্যান্টিনে । হাসপাতালে সিগারেট খাওয়ার কোন সুযোগ নেই । এমন কি এই ক্যান্টিনেও না । কিন্তু নিকিতার বাবা হচ্ছে এই হাসপাতালটার মালিক । নিকিতা একজন ডিরেক্টর । সে একটু নিয়ম ভাঙ্গতেই পারে । তাছাড়া এখন ক্যান্টিনে মানুষজন নেই ।

-আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?
নিকিতা ফিরে তাকালো । একজন ৩০/৩২ বছরের যুবক তার সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । মানুষটার চেহারা তার পরিচিত । কয়েক দিন ধরেই সে এই মানুষটাকে দেখছে ।
যুবক আবারও বলল, আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি ? যদিও নন স্মোকিং সাইন রয়েছে এখানে কিন্তু আপনি যেহেতু ধরিয়েছেন ! আপনার স্টাফ বলল যে আপনি এই হাসপাতালের মালিক । তাই আপনি পারেন আমি পারি না । আপনার কাছে অনুমুতি নিতে এলাম ।

নিকিতা বলল, বসুন এখানে । এখানেই ধরান ! আর আমি মালিক নই । আমার বাবা মালিক । আমি এখানে কাজ করি ।
চেয়ারে বসতে বসতে যুবক বলল, ধন্যবাদ !
তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো । নিকিতা যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ঠিক সিগারেট খেতে অভ্যস্ত নন । তাই না ?
-কীভাবে বুঝলেন?
-আমি যেহেতু অভ্যস্ত আমি জানি । দেখলেই বোঝা যায় !
-জ্বী ঠিক ধরেছেন । খুব বেশি সময় হয় নি ধরেছি !
-মিস্টার ইফতি, আপনি জানেন যে জীবনের সব কিছুর উপরে মানুষের হাত থাকে না । তাই না?

নিকিতা ইফতি রায়হানকে চেনে কদিন থেকে যদিও তাদের কথা হয় নি একবারও । কয়েকবার কেবল দেখা হয়েছে । কেবিন নম্বর ১৭ তে ইফতি রায়হানের স্ত্রী রয়েছেন । মেয়েটি ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে রয়েছে । গত তিনমাস মেয়েটি সিঙ্গাপুরে ছিল । সেখানে সর্বাত্বক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি । তারা বলে দিয়েছেন যে এখন আর কিছুই করার নেই । শেষ কটা দিন প্রিয়জনের আশে পাশে থাকুক । ডাক্তারদের এমনই একটা মনভাব ছিল । তাই তাকে দেশে আনা হয়েছে । এবং ওদের এই হাসপাতালে রাখা হয়েছে ।

তবে ইফতিকে সে চেনে অন্য কারণে । এই এগারো দিনে ছেলেটা একটা মিনিটের জন্য হাসপাতাল ছেড়ে যায় নি । কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই এগারো দিনে ছেলেটা একটা বারের জন্যও তার স্ত্রীর কেবিনে ঢোকে নি । প্রতিদিন মেয়েটাকে দেখতে অনেকেই আসছে । অনেকে ভেতরে ঢুকছে কিন্তু ছেলেটাকে একটা বারের জন্যও ভেতরে ঢুকতে দেখেনি সে । প্রথমে খানিকটা সন্দেহ হয়েছিলো । তারপর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছে কৌতুহল মেটানোর জন্য । এবং দেখতে পেয়েছে ছেলেটা আসলেই ভেতরে ঢোকে নি । করিডোরে পায়চারি করেছে সারা রাত । কিন্তু ভেতরে ঢোকে নি !
কেন কে জানে !

নিকিতার ইচ্ছে করলো একবার তাকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে কিন্তু করলো না । ছেলেটা কেমন উদাস চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আর মাঝে মাঝে সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে, ধোঁয়া ছাড়ছে । নিকিতা ছেলেটার চোখে একটা অচেনা বিষাদ দেখতে পেল। তার স্ত্রীর জন্য?

সিগারেট খাওয়া শেষ হলে ইফতি বলল, ধন্যবাদ অনুমতি দেওয়ার জন্য । আমি আসি ।
-বসুন ইফতি সাহেব । করিডোরে হাটাহাটি করার চেয়ে এখানেই বসুন ! তাকে তো আর দেখতে যাবেন না । তাই না ?

ইফতি আবার বসলো । নিকিতা বলল, কারণ টা কি বলা যায় যে কেন আপনি কেবিনে ঢোকেন না ?
ইফতি অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি তো নীলাকে দেখেছেন তাই না ?
-হুম !
-সে দেখতে অনেক সুন্দর । আমার চোখে ওর থেকে সুন্দর আর কেউ নেই । যখন ওর প্রথম কেমো দেওয়া হল ওর চুল সব পড়ে যেতে শুর করলো, হাতের চামড়া কেমন ফেটে গেল । নীলা আমাকে একদিন কাছে ডেকে বলল যেন আমি ওর সামনে আর না যাই । ওর এই চেহারা যেন না দেখি । ওর চেহারা যখন আগে সুন্দর ছিল তেমন করেই যেন ওকে মনে রাখি । ওকে দেখে যে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম এটা ওকে কষ্ট দিচ্ছিলো বেশি । ওর সামনে যেতে পারি না আর ! কিন্তু ওকে ছেড়েও যেতে পারি না ! তবে আমরা কথা বলি ফোনে । দেওয়ালের এপাশে বসে থেকে । ও চুপচাপ শোনে আমার কথা ! কত কথা যে বলি তবুও যেন কত কথা বাকি রয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে !

নিকিতা খেয়াল করলো ইফতির চোখ দিয়ে পানি বের হতে শুরু করেছে । একটা পূর্ন বয়স্ক পুরুষের চোখে পানি খুব একটা দেখা যায় না । তবে আজকে এই পানি দেখে নিকিতার মনে হঠাৎ একটা তীব্র কষ্ট এসে জমা হল ! একটা মানুষ কিভাবে এতো ভাল ভাবে আরেকজন কে? ওকে কি কেউ এভাবে ভাল বাসবে কোন দিন ?

-আপনাদের কতদিনের সংসার?
-এই ছয় বছরের ।
নিকিতার হঠাৎ মনে হল বেবির কথা জিজ্ঞেস করে কিন্তু করলো না । এই সব অযাচিত প্রশ্ন করার কোন মানে হয় না । ইফতি আরও কিছু সময় বসে থেকে চলে গেল । নিকিতা আরও কিছু সময় বসে থেকে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো । রাত হয়েছে অনেক । দুইটার দিকে আরেকবার রাউন্ড দেওয়ার কথা । নিজের কেবিনের দিকে না গিয়ে কী মনে করে কেবিন নম্বর ১৭ এর দিকে গেল । ইফতিকে দেখতে পেল । কেবিনের বাইরে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে চুপচাপ । রাতের বেলা এখানে বাইরের কারো থাকার নিয়ম নেই । কিন্তু কোন ইফতির বেলাতে এর ব্যতিক্রম করা হয়েছে । ইফতির বাবার সাথে নিকিতার বাবার কেমন যেন একটা চেনা পরিচয় রয়েছে । সেখান থেকেই এই নিয়মের ব্যতীক্রম করা হয়েছে ।
নিকিতা কেবিনে ঢুকলো । বেডের উপরে মেয়েটা শুনে রয়েছে । ঘুমিয়ে রয়েছে । পাশে আরও একটা বেডে শুয়ে আছে আরও একজন মহিলাম । ইনি নীলার মা । দুইজনই ঘুমিয়ে । নীলা চুপচাপ দেখলো কিছু সময় । তারপর আবার বের হয়ে এল রুম থেকে । চুপচাপ হাটা দিল নিজের কেবিনের দিকে । ওর মন খারাপ হয়ে আছে ।

ঠিক চারদিন পরে নীলার অবস্থা আরও খারাপ হল । নিকিতা বুঝতে পারলো যে নীলার হাতে আর বেশি সময় নেই । মনে হল এই সময়ে ইফতির কাছে থাকাটা দরকার । এর আগে অনেক মৃত্যু সে দেখেছে । দেখেছে যে কাছের মানুষ গুলো কাছাকাছি থাকলে মানুষের মৃত্যুটা সহজ হয় !
নিকিতা নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার হাজব্যান্ডকে ডেকে দিবো?
নীলা মৃদু স্বরে বলল, ওকে ডাকবেন না । আমার এই কষ্ট ও দেখতে পারবে না ।
নিকিতা বলল, আমি সেটার ব্যবস্থা করছি । বিশ্বাস করুন ভাল লাগবে আপনার । একটু অপেক্ষা করুন ।

নিকিতা বেডের সাইডে একটা পর্দা টেনে দিল । নীলাকে আর দেখা যাবে না । এরপর ইফতিকে ডেকে আনলো ভেতরে । ইফতি প্রথমে আসতে চাইছিলো না তবে আসলো নিকিতার কথা শুনে । বসলো পর্দার পাশেই । নীলা একটা হাত বাড়িয়ে দিলো পর্দার বাইরে । ইফতি সেই হাত ধরেই হুহু করে কেঁদে ফেললো !

নিকিতা পাশেই দাড়িয়ে দেখছিলো । কেন জানি ওর চোখ দিয়েও পানি বের হয়ে এল । নীলা মৃদু স্বরে বলল, কাঁদছো কেন বোকা ছেলে ? কাঁদবে না । তুমি জানো এখন প্রতিদিন ঘুমালে আমার কেবল তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো চোখের সামনে ভাসে । কী চমৎকার দিন গুলো কাটিয়েছি আমরা । আমার কোন আফসোস নেই জানো ! আমি ওপাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । উপরওয়ালা নিশ্চয়ই আমাদের আমাদের মিলিয়ে দেবেন !

ইফতি কোন কথাই বলতে বলতে পারলো না । কোন মতে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে চলেছে সে । নীলা আবার বলল, আর তুমি কিন্তু একা থাকবে না মোটেও । তুমি মোটেও নিজের দেখা শুনা করতে পারো না একা একা । অবশ্যই বিয়ে করবে । একটা মিষ্টি মেয়েকে দেখে ! মনে থাকবে তো !

ইফতি বলল, তুমি চুপ করে থাকো । আমার বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না !
নীলা হাসলো । তারপর বলল, না আমাকে কথা দাও যে বিয়ে করবে তুমি ! কথা দাও । দিতে হবে !
-আচ্ছা কথা দিলাম ।
-এই লক্ষি ছেলে । ভাল থেকো ইফতি । আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি । অনেক ।
-আমিও তোমাকে ভালোবাসি !

নীলা আর বেশি সময় বাঁচে নি । শেষ সময়ে ডাক্তাররা তাকে আইসিইউতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো তবে নীলা যেতে চায় নি । ইফতির হাত ধরেই বসে ছিল । নিকিতাও ছিল সেই রুমেই । একটা সময়ে সে রুম ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এল । নিজের কেবিনের ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । এই ছোট জীবনে অনেক মৃত্যু দেখেছে তবে আজকের ব্যাপারটা একটু আলাদা । ওর কেন জানি ভেতর থেকে খুব তীব্র কান্না আসছিলো। এই কান্নার উৎস সে নিজেও জানে না !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 84

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →