কল্পনার চেয়ে সত্য

oputanvir
4.9
(42)

রমিজের বয়স ত্রিশের কিছু বেশি । পেশায় সে রিক্সা চালক । রিক্সা চালাতে হলে পেশি শক্তির প্রয়োজন বেশ ভাল রকমের । শরীর স্বাস্থ্যে সে মধ্যম মানের । তাই যাত্রীর ওজন বেশি হলে সে একটু বিপদে পড়ে যায় । আগে এই রকম অনেক হয়েছে যে যাত্রী নিয়ে সে টানতে পারে নি । একটু গিয়েই যাত্রীকে নামিয়ে দিতে হয়েছে । তাই এখন সে দেখে শুনে যাত্রী নেয় । একটু কম ওজনের যাত্রী পেলে, ভাড়া একটু কম দিতে চাইলেও যেতে রাজি হয়ে যায় । যেমন তার পেছনের যাত্রীটা । বয়সে তার মতই হবে । ওজনও অটিরিক্ত নয় । ৭০ কেজির বেশি হবে না কোন ভাবেই । ৮০/৯০ কেজি পর্যন্ত যাত্রী টানতে রমিজের কোন অসুবিধা হয় না । কিন্তু এর বেশি হলে সে একটু বিপদেই পড়ে । আজকে সে চিন্তা নেই । যদিও আজকে তার মন একটু খারাপ ।
সকাল বেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বের হয়েছে । রমিজের এমনিতে কোন বাজে অভ্যাস নেই । বউ পেটানোর স্বভাবও নেই তার । তবে মাঝে মধ্যে সে বউকে ঝাড়ি দেয় বিনা করণেই । আজও তেমন হয়েছে । বউয়ের সকালের ভাত রান্না করতে একটু দেরি হয়েছে । সকালে বৃষ্টি হয়েছিলো একটু । রান্নাঘরে পানি জমে গিয়েছিলো । সেই পরিস্কার করে রান্না করতে করতে একটু দেরি হয়ে গেছে । এটাতে রমিজের মেজাজ খারাপ হয়েছে । সে রাগারাগি করে সকালের ভাত না খেয়েই বের হয়ে এসেছে বাসা থেকে । যদিও কিছু সময়ে পরে হোটেল থেকে পরোটা খেয়েছে পেট ভরে । তবে একটা কথা তার বারবার মনে হচ্ছে যে তার বউ হয়তো না খেয়ে রয়েছে । যদিও এমনটা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই । তবে মনের ভেতর থেকে এই চিন্তাটা কোন ভাবই যাচ্ছে না ।

মন খারাপের আরেকটা কারণ রয়েছে । রিক্সা নিয়ে সে বইমেলার কাছে চলে এসেছিলো সকালের পরপরই । যেদিন মেজাজ খারাপ থাকে সেদিন সে অনেক দুরে দুরে চলে যায় । আজও তাই এদিকে চলে এসেছিলো । রিক্সা সরাতে গিয়ে হঠাৎ করে সামনের চাকাটা একটা নেতা গোছের মানুষের প্যান্টে লেগে যায় । ওমনি লোকটা রমিজের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় । সাথে কয়েকটা গালি । রমিজ এতোটাই হতভম্ভ হয়ে যায় যে কিছু বলতেই পারে না । তারপর সে বুঝতে পারে সে এটা তার শাস্তি ছিল । সে বিশ্বাস করে যে মানুষ তার কর্ম ফল ভোগ করে এই পৃথিবীতেই । সকালে বেলা তার বউয়ের সাথে বিনা করনে রাগ দেখিয়েছে । এই কারণে সে চড়টা খেয়েছে ।

-মামা আপনার বাসা কোথায় ?
পেছনের যাত্রীর মুখে কথাটা শুনে হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকালো । মানুষটার হাতে অনেক গুলো বই । সে বইমেলা থেকে বই কিনে ফিরছে । যাবে মোহাম্মাদপুর ।
-আমার ?
রমিজ হাসলো । বলল, আমার এই খানে বাসা মামা যাত্রাবাড়ি !
-ওমা । সেতো অনেক দুর । আপনি তাহলে এদিকে কেন ?
-এমনিই মামা । মাঝে মইধ্যে ঢাকা শহর ঢু মাইরা বেড়াই !
-ভাল ভাল ! তা দুপুরে খাওয়া হয়েছে?
-না মামা । আপনারে নামাইয়া দিয়া তারপর খামু !

তারপর দুজেনর মাঝে আরও টুকটাক কথা হতে থাকে । এক সময়ে রিক্সা চলে আসে নির্দিষ্ট গন্তব্যে । রিক্সা থেকে নেমে যাত্রী তার ভাড়া মিটিয়ে দেয় । তারপর রমিজকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে বলে, আসেন মামা দুপুরের খাবার খাওয়া যাক !

প্রথমে রমিজ ঠিক বুঝতে পারলো না সামনের মানুষটা ঠিক কী বলছে । তারা নেমেছে একটা হোটেলের সামনেই । সাধারন মানের ভাতের হোটেল । রমিজের মনে হল যে সে চলে যায় কিন্তু সামনের মানুষটার মুখের ভাব দেখে মনে হল যে সত্যই তাকে ভাত খাওয়াতে চাইছে । কেন চাইছে ? ঢাকা শহরের কে খেল না খেল এসব নিয়ে কেউ চিন্তা করে না । এই মানুষটা কেন করছে ?

একটু দ্বিধা নিয়ে সে হোটেলে ঢুকলো । ছোট একটা হোটেল।মোট তিন টেবিল পাতা । এক সাথে ১২ জন মানুষ খাওয়া দাওয়া করতে পারে । তবে এখন হোটেলে ভীড় কম । শেষের টেবিলে বসলো মানুষটা । হাত মুখ ধুয়ে রমিজ বসল তার মুখোমুখি । হোটেল বয়কে খাবার দিতে বলা হল । রমিজ বুঝতে পারলো যে সামনে বসা মানুষটা এখানে নিয়মিত খেতে আসে । হোটেলের সবাই তার পরিচিত । ভাত চলে এল ।
মানুষটা বলল, বলেন কী খাবেন ?
রমিজ যে কী বলবে সে নিজেই জানে না । একটু দ্বিধা কাজ করছে । কী খেতে ইচ্ছে করছে সেটা সে নিজেই ঠিক করতে পারছে না । কিছ বললে আবার লোকটা তার সম্পর্কে কী ভাববে !
রমিজ বলল, একটা কিছু দ্যান ।
-মুরগি খাবেন ? নাকি মাছ ? আজকে শিং মাছ রান্না করেছে । এদের শিং মাছটা বেশ ভাল । খাবেন?
-আইচ্ছা !
মানুষটা সামনে দাড়ানো হোটেল বয়কে বলল, এই রাকিব, দুইটা শিং মাছ দাও । আর ভাজি ডাও ।

রমিজ অনেক দিন পর শিং মাছ দিয়ে ভাত খেল । কবে সে শিং মাছ খেয়েছে সেটা তার মনেও নেই । শুক্রবার ছাড়া তো ভাল মন্দ রান্না করাই হয় না । খাওয়া দাওয়া করতে করতে কেন জানি আবারও তার নিজের বউয়ের কথা মনে পড়লো । বেচারি কী এখনও মন খারাপ করে বসে আছে ?

খাওয়া শেষ করে রমিজ খেয়াল করলো যে মানুষটা যে পরিমান বিল দিলো সেটা তার রিক্সা ভাড়া থেকেও বেশি । সে কোন কারণ ছাড়াই তার জন্য এতো গুলো টাকা খরচ করলো ।
-আচ্ছা যান তাহলে ।
মানুষটা হাসলো । রমিজ বলল, আপনের বাড়ি ?
-এই তো । সামনেই আমার বাসা ।
হোটেলের সামনের বাসাটা দেখালো সে । তারপর সেই বাড়িতেই ঢুকে গেল ।

রমিজ আরও কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো সেখানে । হঠাৎই তার মনে হল তার এখন বাড়িতে যাওয়া দরজার । সকালে বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলো বলেই সে চড় টা খেয়েছিলো । এখন এই মানুষটা তার সাথে ভাল একটা ব্যবহার করেছে, তাকে যত্ন নিয়ে খাইয়েছে এখন তারও উচিৎ ভাল কিছু করা । সব থেকে ভাল কাজটা হবে বউকে খুশি করা । আজকে আর কোন ভাড়া মারবে না ঠিক করলো । বউয়ের জন্য পুরান ঢাকা থেকে হাজির বিরিয়ানি নিয়ে যাবে সে । বউ নিশ্চয়ই খুশি হবে !

আর কিছু ভাবলো না রমিজ । রিক্সাটা নিয়ে সোজা পুরান ঢাকার দিকে রওয়ানা দিল ।

দুই
রাত তখন বারোটা হবে । মুহিবের মাথাটা ভার হয়ে আছে অনেক বেশি । বিকেল থেকে হঠাৎ জ্বর তার । মাথা তুলতে পারছে না । রাত এগারোটার দিকে একটা ঘুম ভেঙ্গেছিলো ক্ষুধার কারণে কিন্তু অবস্থা এমন যে কোন ভাবেই নিচে নামতে পারে নি । এমন কী ফোনটা কোথায় রেখেছে সেটাও মনে করতে পারছিলো না । নয়তো ফোন করে খাবার আনানো যেত । আবার শুয়ে পড়েছিলো । এখন আর ক্ষুধায় টেকা যাচ্ছে না । কিন্তু কী করবে সে ! হোটেল তো বন্ধ হয়ে গেছে । ফুড পান্ডাও চলে না এতো রাতে ।
আজকে বাসায় কেউ নেই । ওরা চারজন কলিগ মিলে বাসাতে থাকে । বৃহস্পতিবার হলেও বাকি তিনজন নিজেদের বাড়িতে চলে যায় । ওদের বাড়ি ঢাকার আশে পাশেই । কিন্তু মুহিবের গ্রামের বাড়ি অনেক দুরে । তার যাওয়ার কোন উপায় নেই । তাকে থাকতে হয় !
এখন মুহিব কী করবে ? এই ক্ষুধা নিয়ে রাত কাটাবে কিভাবে?
বিস্কিট থাকার কথা ! সেটা খুজতে হবে !
বিছানা ছেড়ে উঠলো । মাথাটা আবারও ঘুরে উঠলো তার । বুঝতে পারলো জ্বর আছে ভালই । হঠাৎ কেন জ্বর এল কে জানে ! নিজের ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হল । এতো রাতে আবার কে এল ?

সাড়ে এগারোটায় গেট বন্ধ হয়ে যায় । তাই বাইরের কেউ আসা এতো সহজ ব্যাপার না । সম্ভবত বিল্ডিংয়ের কেউ এসেছে । এক বাড়িওয়ালা ছাড়া তো আর কেউ আসবে না । কিন্তু এতো রাতে উনি কেন আসবেন ?

আবারও বেজে উঠলো কলিংবেল । মুহিব একটু কষ্ট করে গিয়ে দরজা খুলল । বেশ অবাক হল । দরজায় একটা অপরিচিত মেয়ে দাড়িয়ে । মেয়েটার হাতে একটা প্লেট । প্লেটটা ঢাকনা দিয়ে ঢাকা !

মেয়েটাকে প্রথমে অপরিচিত মনেও এখন আর মনে হল না । মেয়েটা সম্ভবত দুই তলা কিংবা তিন তলাতে থেকে । মুহিব মেয়েটার নাম জানে না তবে সিড়ি দিয়ে উঠতে নামতে দেখা হয়েছে কয়েকবার !
মেয়েটা খানিকটা ইতস্তর করে বলল, আপনার ক্ষুধা লেগেছে আমি জানি । আপনি আজকে খেতে নামেন নি নিচে । কোন ফুড ডেলিভারি বয়ও আসে নি ।
আপনি বলতে গিয়েও মুহিব মেয়েটাকে তুমি করে বলল, তুমি কীভাবে জানো?
-আমার ঘর থেকে সামনের রাস্তা দেখা যায় পরিস্কার । এই নিন খাবার নিন ।
মুহিব হাত দিয়ে প্লেট টা নিতে গিয়ে একটু যেন দুলে উঠলো । জ্বর টা দেখছি ভাল করেই ওকে কাবু করে ফেলেছে । মেয়েটও সেটা ভাল করে খেয়াল করলো । প্লেটটা না দিয়ে অন্য হাত দিয়ে মুহিবকে ধরলো সে । তারপর ধরেই নিয়ে এল ঘরের ভেতরে । মুহিবদের কোন ডাইনিং টেবিল নেই । তবে একটা ছোট টেবিল রয়েছে ডাইনিং স্পেসে । সেটার উপরে প্লেটটা রেখে মেয়েটা মুহিবকে টেয়ারে বসালো । তারপর বলল, আপনার শরীরে তো অনেক জ্বর ।
-হ্যা একটি জ্বর ।
-ঔষধ খেয়েছেন ?
-আরে না । প্রথম দিনেই ঔষধ খাওয়া ঠিক না ।
-বলেছে আপনাকে ! আপনার মাথায় পানি ঢালতে হবে ! কিন্তু আগে খেতে হবে । আগে খেয়ে নিন ।

মুহিবের মনে হল সে যেন একটা ঘোরের ভেতরে চলে গেছে । যা কিছু হচ্ছে কিছুই ঠিক বুঝতে পারছে না । মেয়েটি যত্ন করে মুহিবকে খাইয়ে দিল । মুহিব সেটা খেয়েও নিল । এরপর মেয়েটি মুহিবকে ধরে নিয়ে বিছানাতে শুইয়ে দিল । নিজেই খুজে একটা পলিথিন নিয়ে এল । সেটা মাথার নিচে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে পানি ভর্তি বালতি নিয়ে এসে মুহিবের মাথায় পানি দিতে শুরু করলো । মুহিবের ঠিক কোন কিছুই হুস নেই । জ্বরের ঘোরে ওর মনে হল যেন ও স্বপ্নই দেখছে ।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মুহিব অনুভব করলো শরীরটা বেশ ঝরঝরা লাগছে । রাতের কথা পরিস্কার তার কিছুই মনে পড়লো না । কিছু সময় কে কেবল ভাবতে লাগলো রাতে তার সাথে কী হয়েছে ! আদৌও যা ঘটেছে সেটা কী সত্য ঘটনা? কেবল মনে হল যে ও সে সব কিছু স্বপ্ন দেখেছে । হয়তো ওর শরীর চাইছিলো কেউ তার যত্ন নিক । তাই এমনটা কল্পনা করে নিয়েছে !

সকালের নাস্তা শেষ করে বাড়ির গেটের কাছে এসে দাড়াতেই ওর চোখ গেল দুইতলার দিকে । সেখানে একটা জানলা রয়েছে । জানলা দিয়ে মেয়েটার মুখ দেখতে পেল । মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে হাসি মুখে । সাথে সাথেই মুহিব বুঝতে পারলো রাতে সে মোটেই স্বপ্ন দেখে নি । মুহিবের মনের ভেতরে একটা আনন্দ বয়ে গেল । এই আনন্দের কোন ব্যাখ্যা মুহিবের জানা নেই ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 42

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →