কল্পনার চেয়ে সত্য

oputanvir
4.9
(48)

রমিজের বয়স ত্রিশের কিছু বেশি । পেশায় সে রিক্সা চালক । রিক্সা চালাতে হলে পেশি শক্তির প্রয়োজন বেশ ভাল রকমের । শরীর স্বাস্থ্যে সে মধ্যম মানের । তাই যাত্রীর ওজন বেশি হলে সে একটু বিপদে পড়ে যায় । আগে এই রকম অনেক হয়েছে যে যাত্রী নিয়ে সে টানতে পারে নি । একটু গিয়েই যাত্রীকে নামিয়ে দিতে হয়েছে । তাই এখন সে দেখে শুনে যাত্রী নেয় । একটু কম ওজনের যাত্রী পেলে, ভাড়া একটু কম দিতে চাইলেও যেতে রাজি হয়ে যায় । যেমন তার পেছনের যাত্রীটা । বয়সে তার মতই হবে । ওজনও অটিরিক্ত নয় । ৭০ কেজির বেশি হবে না কোন ভাবেই । ৮০/৯০ কেজি পর্যন্ত যাত্রী টানতে রমিজের কোন অসুবিধা হয় না । কিন্তু এর বেশি হলে সে একটু বিপদেই পড়ে । আজকে সে চিন্তা নেই । যদিও আজকে তার মন একটু খারাপ ।
সকাল বেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বের হয়েছে । রমিজের এমনিতে কোন বাজে অভ্যাস নেই । বউ পেটানোর স্বভাবও নেই তার । তবে মাঝে মধ্যে সে বউকে ঝাড়ি দেয় বিনা করণেই । আজও তেমন হয়েছে । বউয়ের সকালের ভাত রান্না করতে একটু দেরি হয়েছে । সকালে বৃষ্টি হয়েছিলো একটু । রান্নাঘরে পানি জমে গিয়েছিলো । সেই পরিস্কার করে রান্না করতে করতে একটু দেরি হয়ে গেছে । এটাতে রমিজের মেজাজ খারাপ হয়েছে । সে রাগারাগি করে সকালের ভাত না খেয়েই বের হয়ে এসেছে বাসা থেকে । যদিও কিছু সময়ে পরে হোটেল থেকে পরোটা খেয়েছে পেট ভরে । তবে একটা কথা তার বারবার মনে হচ্ছে যে তার বউ হয়তো না খেয়ে রয়েছে । যদিও এমনটা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই । তবে মনের ভেতর থেকে এই চিন্তাটা কোন ভাবই যাচ্ছে না ।

মন খারাপের আরেকটা কারণ রয়েছে । রিক্সা নিয়ে সে বইমেলার কাছে চলে এসেছিলো সকালের পরপরই । যেদিন মেজাজ খারাপ থাকে সেদিন সে অনেক দুরে দুরে চলে যায় । আজও তাই এদিকে চলে এসেছিলো । রিক্সা সরাতে গিয়ে হঠাৎ করে সামনের চাকাটা একটা নেতা গোছের মানুষের প্যান্টে লেগে যায় । ওমনি লোকটা রমিজের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় । সাথে কয়েকটা গালি । রমিজ এতোটাই হতভম্ভ হয়ে যায় যে কিছু বলতেই পারে না । তারপর সে বুঝতে পারে সে এটা তার শাস্তি ছিল । সে বিশ্বাস করে যে মানুষ তার কর্ম ফল ভোগ করে এই পৃথিবীতেই । সকালে বেলা তার বউয়ের সাথে বিনা করনে রাগ দেখিয়েছে । এই কারণে সে চড়টা খেয়েছে ।

-মামা আপনার বাসা কোথায় ?
পেছনের যাত্রীর মুখে কথাটা শুনে হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকালো । মানুষটার হাতে অনেক গুলো বই । সে বইমেলা থেকে বই কিনে ফিরছে । যাবে মোহাম্মাদপুর ।
-আমার ?
রমিজ হাসলো । বলল, আমার এই খানে বাসা মামা যাত্রাবাড়ি !
-ওমা । সেতো অনেক দুর । আপনি তাহলে এদিকে কেন ?
-এমনিই মামা । মাঝে মইধ্যে ঢাকা শহর ঢু মাইরা বেড়াই !
-ভাল ভাল ! তা দুপুরে খাওয়া হয়েছে?
-না মামা । আপনারে নামাইয়া দিয়া তারপর খামু !

তারপর দুজেনর মাঝে আরও টুকটাক কথা হতে থাকে । এক সময়ে রিক্সা চলে আসে নির্দিষ্ট গন্তব্যে । রিক্সা থেকে নেমে যাত্রী তার ভাড়া মিটিয়ে দেয় । তারপর রমিজকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে বলে, আসেন মামা দুপুরের খাবার খাওয়া যাক !

প্রথমে রমিজ ঠিক বুঝতে পারলো না সামনের মানুষটা ঠিক কী বলছে । তারা নেমেছে একটা হোটেলের সামনেই । সাধারন মানের ভাতের হোটেল । রমিজের মনে হল যে সে চলে যায় কিন্তু সামনের মানুষটার মুখের ভাব দেখে মনে হল যে সত্যই তাকে ভাত খাওয়াতে চাইছে । কেন চাইছে ? ঢাকা শহরের কে খেল না খেল এসব নিয়ে কেউ চিন্তা করে না । এই মানুষটা কেন করছে ?

একটু দ্বিধা নিয়ে সে হোটেলে ঢুকলো । ছোট একটা হোটেল।মোট তিন টেবিল পাতা । এক সাথে ১২ জন মানুষ খাওয়া দাওয়া করতে পারে । তবে এখন হোটেলে ভীড় কম । শেষের টেবিলে বসলো মানুষটা । হাত মুখ ধুয়ে রমিজ বসল তার মুখোমুখি । হোটেল বয়কে খাবার দিতে বলা হল । রমিজ বুঝতে পারলো যে সামনে বসা মানুষটা এখানে নিয়মিত খেতে আসে । হোটেলের সবাই তার পরিচিত । ভাত চলে এল ।
মানুষটা বলল, বলেন কী খাবেন ?
রমিজ যে কী বলবে সে নিজেই জানে না । একটু দ্বিধা কাজ করছে । কী খেতে ইচ্ছে করছে সেটা সে নিজেই ঠিক করতে পারছে না । কিছ বললে আবার লোকটা তার সম্পর্কে কী ভাববে !
রমিজ বলল, একটা কিছু দ্যান ।
-মুরগি খাবেন ? নাকি মাছ ? আজকে শিং মাছ রান্না করেছে । এদের শিং মাছটা বেশ ভাল । খাবেন?
-আইচ্ছা !
মানুষটা সামনে দাড়ানো হোটেল বয়কে বলল, এই রাকিব, দুইটা শিং মাছ দাও । আর ভাজি ডাও ।

রমিজ অনেক দিন পর শিং মাছ দিয়ে ভাত খেল । কবে সে শিং মাছ খেয়েছে সেটা তার মনেও নেই । শুক্রবার ছাড়া তো ভাল মন্দ রান্না করাই হয় না । খাওয়া দাওয়া করতে করতে কেন জানি আবারও তার নিজের বউয়ের কথা মনে পড়লো । বেচারি কী এখনও মন খারাপ করে বসে আছে ?

খাওয়া শেষ করে রমিজ খেয়াল করলো যে মানুষটা যে পরিমান বিল দিলো সেটা তার রিক্সা ভাড়া থেকেও বেশি । সে কোন কারণ ছাড়াই তার জন্য এতো গুলো টাকা খরচ করলো ।
-আচ্ছা যান তাহলে ।
মানুষটা হাসলো । রমিজ বলল, আপনের বাড়ি ?
-এই তো । সামনেই আমার বাসা ।
হোটেলের সামনের বাসাটা দেখালো সে । তারপর সেই বাড়িতেই ঢুকে গেল ।

রমিজ আরও কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো সেখানে । হঠাৎই তার মনে হল তার এখন বাড়িতে যাওয়া দরজার । সকালে বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলো বলেই সে চড় টা খেয়েছিলো । এখন এই মানুষটা তার সাথে ভাল একটা ব্যবহার করেছে, তাকে যত্ন নিয়ে খাইয়েছে এখন তারও উচিৎ ভাল কিছু করা । সব থেকে ভাল কাজটা হবে বউকে খুশি করা । আজকে আর কোন ভাড়া মারবে না ঠিক করলো । বউয়ের জন্য পুরান ঢাকা থেকে হাজির বিরিয়ানি নিয়ে যাবে সে । বউ নিশ্চয়ই খুশি হবে !

আর কিছু ভাবলো না রমিজ । রিক্সাটা নিয়ে সোজা পুরান ঢাকার দিকে রওয়ানা দিল ।

দুই
রাত তখন বারোটা হবে । মুহিবের মাথাটা ভার হয়ে আছে অনেক বেশি । বিকেল থেকে হঠাৎ জ্বর তার । মাথা তুলতে পারছে না । রাত এগারোটার দিকে একটা ঘুম ভেঙ্গেছিলো ক্ষুধার কারণে কিন্তু অবস্থা এমন যে কোন ভাবেই নিচে নামতে পারে নি । এমন কী ফোনটা কোথায় রেখেছে সেটাও মনে করতে পারছিলো না । নয়তো ফোন করে খাবার আনানো যেত । আবার শুয়ে পড়েছিলো । এখন আর ক্ষুধায় টেকা যাচ্ছে না । কিন্তু কী করবে সে ! হোটেল তো বন্ধ হয়ে গেছে । ফুড পান্ডাও চলে না এতো রাতে ।
আজকে বাসায় কেউ নেই । ওরা চারজন কলিগ মিলে বাসাতে থাকে । বৃহস্পতিবার হলেও বাকি তিনজন নিজেদের বাড়িতে চলে যায় । ওদের বাড়ি ঢাকার আশে পাশেই । কিন্তু মুহিবের গ্রামের বাড়ি অনেক দুরে । তার যাওয়ার কোন উপায় নেই । তাকে থাকতে হয় !
এখন মুহিব কী করবে ? এই ক্ষুধা নিয়ে রাত কাটাবে কিভাবে?
বিস্কিট থাকার কথা ! সেটা খুজতে হবে !
বিছানা ছেড়ে উঠলো । মাথাটা আবারও ঘুরে উঠলো তার । বুঝতে পারলো জ্বর আছে ভালই । হঠাৎ কেন জ্বর এল কে জানে ! নিজের ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হল । এতো রাতে আবার কে এল ?

সাড়ে এগারোটায় গেট বন্ধ হয়ে যায় । তাই বাইরের কেউ আসা এতো সহজ ব্যাপার না । সম্ভবত বিল্ডিংয়ের কেউ এসেছে । এক বাড়িওয়ালা ছাড়া তো আর কেউ আসবে না । কিন্তু এতো রাতে উনি কেন আসবেন ?

আবারও বেজে উঠলো কলিংবেল । মুহিব একটু কষ্ট করে গিয়ে দরজা খুলল । বেশ অবাক হল । দরজায় একটা অপরিচিত মেয়ে দাড়িয়ে । মেয়েটার হাতে একটা প্লেট । প্লেটটা ঢাকনা দিয়ে ঢাকা !

মেয়েটাকে প্রথমে অপরিচিত মনেও এখন আর মনে হল না । মেয়েটা সম্ভবত দুই তলা কিংবা তিন তলাতে থেকে । মুহিব মেয়েটার নাম জানে না তবে সিড়ি দিয়ে উঠতে নামতে দেখা হয়েছে কয়েকবার !
মেয়েটা খানিকটা ইতস্তর করে বলল, আপনার ক্ষুধা লেগেছে আমি জানি । আপনি আজকে খেতে নামেন নি নিচে । কোন ফুড ডেলিভারি বয়ও আসে নি ।
আপনি বলতে গিয়েও মুহিব মেয়েটাকে তুমি করে বলল, তুমি কীভাবে জানো?
-আমার ঘর থেকে সামনের রাস্তা দেখা যায় পরিস্কার । এই নিন খাবার নিন ।
মুহিব হাত দিয়ে প্লেট টা নিতে গিয়ে একটু যেন দুলে উঠলো । জ্বর টা দেখছি ভাল করেই ওকে কাবু করে ফেলেছে । মেয়েটও সেটা ভাল করে খেয়াল করলো । প্লেটটা না দিয়ে অন্য হাত দিয়ে মুহিবকে ধরলো সে । তারপর ধরেই নিয়ে এল ঘরের ভেতরে । মুহিবদের কোন ডাইনিং টেবিল নেই । তবে একটা ছোট টেবিল রয়েছে ডাইনিং স্পেসে । সেটার উপরে প্লেটটা রেখে মেয়েটা মুহিবকে টেয়ারে বসালো । তারপর বলল, আপনার শরীরে তো অনেক জ্বর ।
-হ্যা একটি জ্বর ।
-ঔষধ খেয়েছেন ?
-আরে না । প্রথম দিনেই ঔষধ খাওয়া ঠিক না ।
-বলেছে আপনাকে ! আপনার মাথায় পানি ঢালতে হবে ! কিন্তু আগে খেতে হবে । আগে খেয়ে নিন ।

মুহিবের মনে হল সে যেন একটা ঘোরের ভেতরে চলে গেছে । যা কিছু হচ্ছে কিছুই ঠিক বুঝতে পারছে না । মেয়েটি যত্ন করে মুহিবকে খাইয়ে দিল । মুহিব সেটা খেয়েও নিল । এরপর মেয়েটি মুহিবকে ধরে নিয়ে বিছানাতে শুইয়ে দিল । নিজেই খুজে একটা পলিথিন নিয়ে এল । সেটা মাথার নিচে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে পানি ভর্তি বালতি নিয়ে এসে মুহিবের মাথায় পানি দিতে শুরু করলো । মুহিবের ঠিক কোন কিছুই হুস নেই । জ্বরের ঘোরে ওর মনে হল যেন ও স্বপ্নই দেখছে ।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মুহিব অনুভব করলো শরীরটা বেশ ঝরঝরা লাগছে । রাতের কথা পরিস্কার তার কিছুই মনে পড়লো না । কিছু সময় কে কেবল ভাবতে লাগলো রাতে তার সাথে কী হয়েছে ! আদৌও যা ঘটেছে সেটা কী সত্য ঘটনা? কেবল মনে হল যে ও সে সব কিছু স্বপ্ন দেখেছে । হয়তো ওর শরীর চাইছিলো কেউ তার যত্ন নিক । তাই এমনটা কল্পনা করে নিয়েছে !

সকালের নাস্তা শেষ করে বাড়ির গেটের কাছে এসে দাড়াতেই ওর চোখ গেল দুইতলার দিকে । সেখানে একটা জানলা রয়েছে । জানলা দিয়ে মেয়েটার মুখ দেখতে পেল । মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে হাসি মুখে । সাথে সাথেই মুহিব বুঝতে পারলো রাতে সে মোটেই স্বপ্ন দেখে নি । মুহিবের মনের ভেতরে একটা আনন্দ বয়ে গেল । এই আনন্দের কোন ব্যাখ্যা মুহিবের জানা নেই ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 48

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →