জানালার দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে মুসকান । একটু আগে সে কেঁদেছিলো । এখন চোখের জল শুকিয়ে গেছে । কত সময় ধরে এখানে এভাবে বসে রয়েছে সে জানে না, সময়ের হিসাব তার নেই । ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে না। জানালা থেকে মুখ তুলে সে ঘরের দিকে তাকালো । কয়েকটা কাঁচের গ্লাসের ভাঙ্গা অংশ মেঝেতে ছড়িয়ে । রাকিব ভেঙ্গেছে এগুলো। দরজাটা এখনও হাট করে খোলা । রাকিব চলে যাওয়ার সময় দরজাটা খোলা অবস্থাতেই রেখে চলে গেছে । মুসকানের ইচ্ছে হয় নি উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে !
মুসকান শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে । ভেবেছিলো অন্য সব মানুষের মত তার জীবনটা হবে না । কিন্তু ভাগ্যে যেটা রয়েছে সেটা না হয়ে কোন দিকে যাবে ? ছোট বেলা থেকে যখন থেকে বুঝতে শিখেছে ও নিজের বাবা মা কে দেখে এসেছে সব সময় ঝগড়া করতে । প্রতিটা দিন একই ঘটনা । মাঝে মাঝে মুসকানের মত হত সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে সে চলে যায় অন্য কোথায় ! ওখানে ওর দম বন্ধ লাগতো । হাই স্কুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে বাসা ছেড়ে দিল । নিজের দেখা শুনা নিজেই শুরু করলো । যতই মানুষের সাথে মিশতে শুরু করলো, যতই এই বিয়ে, সম্পর্ক গুলো দেখতে শুরু করলো ততই ওর মনে দৃঢ় ভাবে এই ধারনা জন্মালো যে মানুষ আসলে এক সাথে সুখে থাকতে পারে না । এক সাথে থাকলে গেলে ঝামেলা হবেই ।
তারপরেই রাকিবের সাথে মুসকানের পরিচয় । ছেলে বাংলাদেশী । ওর নিজের মা বাংলাদেশী হলেও বাবা আমেরিকান । যদিও মুসকানের ভেতরে বাঙালী চেহারা বাদ দিয়ে আর কিছুই বাঙালীর মত না । রাকিব ছেলেটাকে ওর ভালই লাগলো । কিন্তু কোন সম্পর্কে সে জড়াতে চাইলো না মোটেই । চাকরিতে ঢোকার পর যখন পরিচিত সবাই বিয়ে করে ফেলছিলো তখন সে নিজের সিদ্ধান্তে অটলই রইলো । বিয়ে কিংবা স্থায়ী কোন সম্পর্কে সে যাবে না ।
তবে রাকিবের সাথে তার ভাব ভালোবাসা চলল বেশ কিছু দিন ধরে । এক সাথে সময় কাটানো, দুর দেশে ঘুরতে যাওয়া রাতে উত্তাল প্রেমে মত্ত হওয়া সব কিছুই ছিল তাদের ভেতরে । রাকিব ওকে কয়েকবার বিয়ের জন্য প্রোপোজ করা সত্ত্বেও মুসকান তাতে রাজি হয় নি । শেষে একটা প্রস্তাব নিয়ে এল । প্রস্তাব টা ওরা প্রথমে এক সাথে থাকা শুরু করবে । এটা এই দেশে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বিয়ের আগে থেকেই এক বাসাতে থাকা শুরু করে । নিজেদের সব কিছু শেয়ার করে । তারপর এক সময়ে গিয়ে বিয়ে করে আবার কারো কারো সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় । নতুন কারো সাথে সম্পর্ক শুরু হয় । রাজিবের প্রস্তাব ছিল এক সাথে থাকা শুরু হোক, কোন কমিটমেন্টের দরকার নেই । যদি মনে হয় সামনে বিয়ে করা যাবে তবেই তারা বিয়ের কথা ভাবনে । যদি মুসকানের মনে হয় যে না সে বিয়ে করবে না তাহলে তারা আলাদা হয়ে যাবে ।
প্রথম মাস ছয়েক বেশ ভালই ছিল । তবে আজকে বেশ ভাল রকমের ঝগড়া হয়েছে দুজনের ভেতরে । দোষ দুইজনেরই ছিল। মুসকান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে এখানে আর থাকবে না । ওর আগেই বোঝা উচিৎ ছিল যে পার্ফেক্ট সম্পর্ক বলে আসলে কিছু নেই । সব সম্পর্কই হচ্ছে ঝামেলার ।
মুসকান উঠতে যাবে তখনই ফোন বেজে উঠলো । স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে রাকিব ফোন দিয়েছে । একবার মনে হল ফোনটা ধরবে না । তবে কি মনে করে ধরলো । রাকিব বলল, রাতে খেয়েছো ?
রাকিবের কন্ঠ অসম্ভব নরম । রাকিব আবার বলল, রাত হয়েছে । খেয়ে নাও । আমার উপর রাগ হয়েছে খাওয়া কোন দোষ করে নি । দেখো ফ্রিজে বিফ রান্না করা আছে । একটু গরম করে নাও । তারপর ঔষধ খাও ।
ফোনটা কেটে গেল । মুসকান চুপ করে কিছু সময়ে বসে রইলো । মোবাইলের ঘড়ির দিকে সময় দেখলো রাট এগারোটার কিছু বেশি বাজে । বাইরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে । এতো রাতে রাকিব বাইরে কি করছে কে জানে ?
ফোনটা হাতে নিয়ে মুসকান রাকিবকে ফোন দিল। রিসিভ করতেই রাকিব বলল, খেয়েছো?
-না ।
-খেয়ে নাও ।
-কোথায় তুমি ?
-এই তো বাইরে !
-বাইরে কোথায়?
কিছু সময় নিরবতা । রাকিব তারপর বলল, এই তো বাস স্টপে । যাত্রী যাউনি আছে ওখানে বসে আছি !
-এই শীতে ওখানে কি?
-কিছু না ।
মুসকান ফোন কেটে দিল। এতো সময় ঝগড়া করে এখন আবার তেজ দেখানো হচ্ছে ।
রাকিব কত সময় ধরে বসে আছে সেটা সে নিজেও জানে না । মোবাইল বের করে সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না । একটু আগে মুসকানের সাথে কথা হয়েছে । এটাতে আপাতত শান্তি লাগছে । আজকে যে কি হয়ে গেল সেটা সে নিজেই জানে না । এভাবে রেগে তো যায় না সে । তখন ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দেখতে পেল তাকে । মুসকান । আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওর দিকে । হাতে একটা বক্স মত কি যেন রয়েছে । পাশেই এসে বসলো । বাক্সটা ওদের ঠিক মাঝে রাখলো । তারপর সেটা রাকিবের দিকে বাড়িয়ে বলল, তুমিও খাও নি । খেয়ে নাও !
-তুমি খেয়েছো ?
-না । আমি রাগ করেছি !
-কি করলে রাগ ভাঙ্গবে ?
-জানি না ।
-আমি খাইয়ে দিলে কি ভাঙ্গবে?
-ভাঙ্গতে পারে । তবে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না ।
রাকিব একটু হাসলো । তারপর প্যাকেটা খুলে আস্তে নিজেও খেলো মুসকানকেও খইয়ে দিতে লাগলো । রাকিবের হাতে সে এর আগেও খেয়েছে । কিন্তু এই নির্জন বাসস্টপের ছাউনি শীতের ভেতরে পরিবেশটা একেবারে অন্য রকম মনে হচ্ছে । কয়েক চামচ খেয়ে মুসকান আপন মনে চিবুতে থাকলো । তখনই মুসকানের মন হল জীবনটা আসলে খারাপ না। এই যে ঝগড়া হল, মান অভিমান রাগ তারপর রাকিবের ফোন করে খোজ নেওয়া খেতে বলা, এতো রাগারাগি ঝগড়ার পরেও রাকিব ঠিক ঠিক খোজ নিল । রাতে ঔষধ না খেলে সমস্যা হতে পারে এটা রাকিবের মনে ছিল । তারপর ও নিজেই এখানে এল খাবার নিয়ে । এসব কেন হল ! ভালোবাসা রয়েছে বলেই তো !
হঠাৎ মুসকান বলল, লেটস গেট ম্যারিড !
-হোয়াট ! আর ইউ শিওর ?
-হুম !
-বাহ ঝগড়া করেই যদি বিয়ের জন্য তোমাকে রাজি করানো যাবে জানলে আর আগেই তো ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতাম ।
মুসকাল হাসলো । তারপর বলল, এরপর যদি ঝগড়া করেছো তাহলে গরুর মাংস র্যাট কিলার মিশিয়ে খাইয়ে দিবো !
রাকিব হাসতে হাসতে বলল, যদি তুমি মিশাতে পারো আমি খেয়ে নিবো । টেনশন কর না ।
খাওয়া শেষ করে ওরা খেয়াল করলো যে সাথে করে পানি আনা হয় নি । রাকিব বলল, চল বাসাই যাই ।
-না। বাসায় যাবো না ।
-কেন?
-ফ্লোরে কাঁচে ভেঙ্গে ছড়াছড়ি । এখন পরিস্কার করতে ইচ্ছে করছে না । তার চেয়ে বরং চল সামনে । হাটি । আজকে সারা রাত আমরা হাটাহাটি করে কাটিয়ে দিই !
রাকিব বলল, একদিন ঝগড়া করেই দেখি তোমার মাঝে রোমান্টিসিজম জেগে উঠেছে ।
-ঝগড়া থেকে যদি ভাল কিছু হয় তাহলে তাই সই ….
ওরা হাত ধরে নির্জন রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলো । সামনে ওদের আরও কদুর এক সাথে যেতে হবে কে জানে….