ষড়যন্ত্র (পর্ব দুই)

oputanvir
4.8
(85)

পর্ব এক

ছয়

নাদিমের সকালটা আজকে এমন হবে সেটা ও মোটেও ভাবতে পারে নি । বিশেষ করে এই বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের মানুষের সাথে এভাবে পরিচয় হবে সেটা ও কোন ভাবেই কল্পনা করতে পারে নি । দেশে থাকতে নাদিম সব সময় সকাল এবং বিকেলে ঘন্টা খানেক হাটাহাটি করে কাটাতো । কিন্তু এখানে আসার পরে বিকেলের হাটা টা বন্ধ হয়ে গেছে । রিসার্চের কাজ করতে হয় বেশ রাত পর্যন্ত । তবে সকালে এখনও নিয়মিত জগিং করেই চলেছে । আজও তেমন একটা দিন ছিল । জগিংয়ের শেষ পর্যায়ে এসেছে ঠিক এমন সময়ে ঘটনাটা ঘটলো । ওর সামনে দিয়েই একটা মেয়ে আসছিলো দৌড়ে । নাদিম অবশ্য সেদিকে খুব একটা খেয়াল করে নি । কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ করেই ”ও মাগো” বলে চিৎকার উঠলো । তারপর সোজাসুজি ওর দিকে হুরমুড় করে এগিয়ে আসতে লাগলো ।

মেয়েটার একটা পা অন্য পায়ের সাথে আটকে গিয়েছিলো সম্ভবত । হোচট খেয়ে সে পড়েই যাচ্ছিলো তখনই নাদিম মেয়েটাকে ধরে ফেলে । মেয়েটার মাটিতে আছাড় খাওয়া থেকে রক্ষা পায় ।
নাদিম পরিস্কার বাংলাতে জানতে চায়, আপনি ঠিক আছেন ?
মেয়েটা জোড়ে জোতে দম নিতে নিতে বলল, হ্যা । অনেক ধন্যবাদ ।

তারপরেই ওরা দুজন ব্যাপারটা ধরতে পারে । আমেরিকার মাটিতে অনেক বাংলাদেশী থাকলেও সহজে তাদের দেখা পাওয়া যায় না । বিশেষ করে নাদিম যেখানে থাকে, কিংবা ওর নিজের ডিপার্টমেন্টে সেখানে কোন বাংলাদেশী নেই । কয়েকজন কলকাতার ছাত্র রয়েছে অবশ্য । অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন আছে । এখানে বাংলাদেশী নানান সংগঠন আছে । তবে নাদিম সেসব একদম এড়িয়ে চলে । এর পেছনে অবশ্য যুক্তিযুক্ত কারণও আছে ওর কাছে ।
ওরা দুজনেই যখন বুঝতে পারলো যে ওরা দুইজনেই বাংলাতে কথা বলছে তখন দুইজনই খানিকটা অবাকই হল । দুজনই প্রায়ই একই সাথে বলল, আপনি বাংলাদেশী?
তারপর দুইজনই হাসলো । নাদিম বলল, হ্যা । আপনি?
-আমিও । আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব !
-আরে না না । এটা যে কেউ করতো । আপনি ঠিক আছেন ?

নাদিম তারপর মেয়েটাকে উঠতে সাহায্য করলো । মেয়ে একটু পা দুটো নাড়িয়ে দেখলো সে আসলেই ঠিক আছে কিনা । তারপর হাসি মুখে বলল, হ্যা । বেশি কিছু হয় নি । পায়ের সাথেপা আটকে গিয়েছিলো কেবল !
-আপনি নিশ্চিত?
মেয়েটা আবারও হাসলো । তারপর বলল, চিন্তা করবেন না । আমি একজন ডাক্তার । কিছু হলে টের পেতাম ।
-আচ্ছা । আমি নাদিম । আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগলো ।

এই বলে মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল । মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই নাদিমের হাত ধরলো । তারপর একটু হেসে বলল, আমার নাম মিমি । নাইস টু মিস ইউ মিস্টার নাদিম।
-তো আপনি ডাক্তার?
-হ্যা । ডিএমসি থেকে এমবিবিএস শেষ করেছি । এখানে এসেছি একটা কোর্সের জন্য ।
-তাহলে তো বেশি দিন আসেন নি । আমি অবশ্য অনেক দিন থেকেই এখানে । ইন্টারের পরপরই চলে এসেছিলাম । পড়াশুনা শেষ করে এখন পিএইচ ডি চলছে । আরও দুতিন বছর লাগবে সম্ভবত । মানে আমার প্রোফেসর সম্ভবত আমাকে একদম পছন্দ করেন না নয়তো খুব পছন্দ করেন । আমাকে এতো সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না ।

মিমি হাসলো । তারপর দুজন আরও খানিকটা হাটতে শুরু করলো । পার্ক থেকে বের হয়ে গেল ।

সাত

-মিস্টার প্রেসিডেন্ট ! মিসটার প্রেসিডেন্ট !
আজিজুর রহমান নিজের মনে কী ভাবছিলো সেটা সে নিজেই জানে না । পিএর ডাকে তার হুশ ফিরলো ।
-কি হয়েছে !
-অপারেশন শেষ হয়েছে । ডাক্তারেরা বের হয়ে আসছেন ।

আজিজুর রহমান উঠে দাড়ালো । তিনি এতো সময়ে ঠিক ওটির সামনেই বসে ছিলেন। তার ঠিক পাশেই ফরিদ হাসান বসে ছিলেন । দুজনই চুপচাপ ভাবে পাশাপাশি বসে ছিলেন এতো সময় । কেউ কোন কথা বলেন নি । অন্য দিকে ফয়েজ হাসান এতো সময়ে কেবল করিডোর বরাবর পায়চারি করে কাটিয়েছে । কত সময় পার হয়েছে তিন জনের কারোই খেয়াল নেই ।

হাসপতাল চত্তর পুরো ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে । তবে হাসপাতালের বাইতে টিভি চ্যানেল আর সংবাদপত্রের কর্মী ছাড়াও অনেক কৌতুহলী মানুষের ভীড় লেগে রয়েছে । তাদের কোন ভাবেই সরানো যাচ্ছে না ।

ডাক্তাররা বের হয়ে এলেন । সবার সামনে জোবাইদা হাসানকেই দেখা যাচ্ছে । সে মুখের মাস্ক খুলে ফেলেছ । মুখে চিন্তার ছাপ । আজিজুর রহমান জোবাইদার দিকে একভাবে কিছু সময় তাকিয়েই রইলেন । কত গুলো বছর পরে তারা একে অন্যের এতো কাছাকাছি চলে এল ! কম করেই হলেও ২৫টা বছর । কোন দিন ভাবেন নি পরিস্থিতি আবারও তাদের এভাবে মুখোমুখি নিয়ে আসবে ।

ফরিদ হাসান বলল, ফারাজের কী অবস্থা ? বল কী অবস্থা?
-বাবা, আপনি কেন এখনও এখানে আছেন ?
-আমার অবস্থা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না । ফারাজের কী অবস্থা আগে বল?
-এখনও বলার সময় আসে নি । শরীর থেকে অনেক বেশি রক্ত গেছে । ৭২ ঘন্টা পার হোক তারপর কিছু বলা যাবে । এখানে বসে থেকে লাভ নেই । আপনি বাসায় যান । আপনার এই শরীর নিয়ে এখানে শরীর নিয়ে এখানে আসা মোটেই ঠিক নয় নি ।

আজিজুর রহমান পাশ থেকে বললেন, উনি ঠিক বলছেন । উনি ঠিক বলছেন । ফারিজের চিকিৎসার কোন ত্রুটি হবে না । আমি কথা দিচ্ছি !
ফরিদ হাসান কিছু সময়ে চুপ করে থেকে ফয়েজ হাসান কে ডাক দিলেন । বললেন, ফজু তুই এখানে থাক সব সময় । আর লিয়াকত কে বলল যে সিঙ্গাপুরে যোগাযোগ করতে । ফারাজকে ওখানে নিয়ে যাবো আমি ।
জোবাইদা নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা এখন ফারাজকে কোথাও মুভ করা যাবে না । আর ডাক্তার আপনি না, আমি । আর সব চেয়ে বড় কথা আমি ফারাজের মা । ওর ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেব সেটা একান্তই আমার নিজের ব্যাপার । এই ব্যাপার কারো কোন কথা আমি শুনতে চাই না । কারো না ।

জোবাইদা আর দাড়ালো না । পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেল । জোবাইদা যদিও কথাটা নিজের বাবার উদ্দেশ্যে বলল কিন্তু আজিজুর রহমানের কেন জানি মনে হল কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হল !

আট
ফোনটা হাতে নিয়ে তিনি বসে রয়েছেন একভাবে । একেবারে শক্ত কাঠ হয়ে গেছেন যেন । একটু আগে যে টিভিতেই সব কিছু দেখেছেন পরিস্কার । সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছিলো । সব কিছু এতো সময়ে তার প্লানের মত হওয়ার কথা ছিল অথচ কিছুই হয় নি । নিজের রাগটা সে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছেন না । ঐ ছেলেটা !
কে এই ছেলেটা?
কেন এভাবে নিজের জীবন দিয়ে দিলো প্রেসিেন্টের জন্য?
এতো ভালোবাসে প্রেসিডেন্টকে?
কেন ?
এটা তাকে জানতে হবে!
ফোনটা বেজে উঠলো । নম্বরটা দেখেই চিনতে পারলো সে ।
-স্যার আমি সরি। আসলে …
-তুমি যা করেছ তার জন্য সরি বলে লাভ নেই । এখন এসব ভাবার বিষয় না । কয়জন আছো তোমরা?
-স্যার আপাতত চার জন ।
-ইন্ডিয়া চলে যাও । কদিন সেখানেই থাকো । পরিস্থিতি বুঝে আবার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে ।
-জ্বী স্যার ।

ফোনের লাইনটা কেটে গেল । ফোনটা হাতে নিয়েই সে ভাবতে লাগলেন কী করবেন এখন? এতোদিনের প্লানটা এভাবে ভেস্তে গেল । তবে সময় চলে যায় নি । আবার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে ।

আজিজুর রহমা যখন নিজের বাস ভবনে ঢুকলেন তখন ভোর চার টা বেজে গেছে । গাড়িটা গেট দিয়ে ঢুকতেই তার স্ত্রী ফার্স্ট লেডি রেবেকা রহমান ছুটে এলেন । তার পেছনে প্রেসিডেন্টের ছেলে আবির আর নিকিতা । আজকে কেউই ঘুমায় নি । পুরো বাসা জেগে আছে । অবশ্য এমন বড় ঘটনার পরে দেশের খুব কম মানুষই ঘুমিয়েছে । সবার চোখ কেবল টিভির দিকে । সেখানে আজিজুর রহমানের পরিবার কিভাবে চোখের পাতা এক করবে?

রেবেকা সব সময়ই একটু লাজুক প্রকৃতির মেয়ে । এতো বছর বিয়ের পরেও ছেলে মেয়ে কিংবা অন্য সবার সামনে স্বামীর হাত পর্যন্ত ধরতে লজ্জা পায় সে । পেশায় সে একজন আর্কিটেক্ট । নিজের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, স্বামী বলতে সে অজ্ঞান । তার কাছে তার স্বামীর উপরে কিছু নেই ।
আজকে আর কোন লজ্জানুভূতি তার ভেতরে কাজ করলো না । আজিজুর রহমান যেই না গাড়ি থেকে বের হয়েছেন তখনই সে তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো । তারপর এক সময়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো । আজিজুর রহমান তাকে শান্তনা দিতে দিতে বলল, আরে বাবা আমার কিছু হয় নি তো । কাঁদছো কেন এভাবে ?
রেবেকা কোন কথা না বলে কেবল কাঁদতে লাগলো । আজিজুর রহমান একটু পরে দেখলেন তার দুই ছেলে মেয়েও তাদের দুইজনকে জড়িয়ে ধরেছেন । আজিজুর রহমানের বেশ ভাল লাগলো । কাজের চাপে তিনি কোন সময়ে ছেলে মেয়েদের সময় দিতে পারেন না । কবে পরিবারের সবাই এক সাথে খাবার খেয়েছে সেটাও সে বলতে পারেন না । আবির তো পড়াশুনার জন্য আমেরিকা থাকে । ছুটিছাটায় সে দেশে আসে ।

কিছু সময়ে পার হওয়ার পরেই একটা আওয়াজ শুনতে পেল তারা ।
-ফয়েজটা হচ্ছে আসল শয়তান । এইবার ফয়েজকে কোন ভাবেই ছাড়া যাবে না । এটার পেছনে ঐ বদমাইশটা রয়েছে ।

আওয়াজ শুনে আজিজুর রহমান মুখ তুলে তাকালো । আওয়াজটা রেবেকার কানেও গেছে । সে আজিজুর রহমানকে ছেড়ে দিয়েছে পাশে দাড়িয়েছে । আজিজুর রহাম দরজার কাছে হুইল চেয়ারে বসে তার বড় ভাই আফিজুর রহমানের দিকে তাকালেন । বললেন, না ভাইজান কাজটা ফয়েজের নয় !
-তুই কিভাবে কিভাবে জানিস?
-আমি জানি ?
-তাহলে কার?
-কার এখনও বের করতে পারি নি । তবে বের করে ফেলবো । জাফরকে ওরা হাত করেছে । জাফরকে খুজে বের করা লাগবে । ইতিমধ্যে তার খোজ শুরু হয়ে গেছে । বর্ডার সিল করে দিয়েছি । কোন ভাবেই সে দেশ ছেড়ে পালাতে পারবে না । আগে তাকে ধরি । তারপর দেখা যাক ।
রেবেকা পেছন থেকে বলল, ছেলেটার কী খবর?
-এখনও বলা যাচ্ছে না । ডাক্তার বলেছে ৭২ ঘন্টা লাগবে ।
আফিজুর রহমান বলল, হাসপাতালে ফয়েজ হাসান এসেছিলো কেন? ছেলেটার সাথে ফয়েজের কী সম্পর্ক ?

কথাটা শুনে আজিজুর রহমানের চোখটা একটু যেন কেঁপে উঠলো । তবে সে সামলে নিল সাথে সাথে । বলল, ছেলেটার নাম ফারাজ । সে ফয়েজ হাসানের ভাগ্নে হয় কথাটা সবাইকে খানিকটা অবাক করলো । প্রতিপক্ষ দলের একজন কেন নিজের জীবন দিয়ে আজিজুর রহমান কে রক্ষা করবে? তবে রেবেকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বুঝতে পারলেন । কিছু একটা তার স্বামীকে পীড়া দিচ্ছে । এর আগেও তার উপর হামলা হয়েছে । তবে প্রতিবারই তার চেহারা অন্য রকম থাকে । এতোটা ভেঙ্গে তিনি কোন ভাবে পড়েন না । তাহলে এইবার কী এমন হল?

নয়
জোবাইদা ছেলের বেডের পাশে বসে রয়েছে । রাত এখন প্রায় একটা । ইতিমধ্যে ৪৮ ঘন্টা পর হয়ে গেছে । ফারাজের অবস্থার কোন উন্নতি হয় নি । তবে আশার কথা হচ্ছে অবনতিও হয় নি । এই পুরো সময় ধরে হাসপাতাল ছেড়ে একদমই যান নি । প্রেসিডেন্ট আর সাবেক প্রেসিডে্ট হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই ভীড় কমে গেছে । যদিও কিছু কৌতুহলী সাংবাদিক এখনও রয়ে গেছেন । ঘুরঘুর করছেন আশে পাশে । সবার মনেই একটাই প্রশ্ন কেন প্রতিপক্ষ দলের মানুষ হয়েও ফারাজ হাসান নিজের জীবন দিয়ে প্রেসিডেন্ট কে রক্ষা করতে গেল । কারো কাছে কোন উত্তর নেই । তবে তিনি খুব ভাল করে জানেন। নিজেকে দোষারোক করতে ইচ্ছে হল তার । কেন তিনি ফারাজকে সব কিছু খুলে বলতে গেলেন । যেদিন থেকে ফারাজ সব কিছু জানতে পেরেছে সেদিন থেকে ওর আচরন যেন একটু বদলে গেছে । অবশ্য বদলে যাওয়ারই কথা । এটাই স্বাভাবিক ।

-ম্যাম !
জোবাইদা ফিরে তাকালো । ওয়ার্ড বয়দের একজন এসেছে ।
-কী ব্যাপার ?
-একজন মেয়ে এসেছে ।
-কেন ?
-ফারাজ স্যারকে দেখার জন্য ।
-বলেছি না কাউকে না ঢুকতে দিতে ।
-ম্যাম আমি ঢুকতে দিতে চাই নি । কিন্তু তাকে আটকানোর উপায়ই নেই আমার ।
-মানে?
-উনি প্রেসিডেন্টের মেয়ে নিকিতা রহমান !
প্রেসিডেন্টের নাম শুনেই জোবাইদা রহমান চমকে উঠলো খানিকটা । ঘটনার দিন প্রেসিডেন্ট আজিজুর রহমান চলে যাওয়ার পর আর আসে । তার লোক রয়েছে হাসপাতাল । সে জানে সর্বক্ষনিক খবর সে রাখছে । ইতিমধ্যে দেশের সব থেকে বড় বড় ডাক্তার ফারাজকে দেখে গেছে । জোবাইদা এও শুনেছে যে সিঙ্গাপুর থেকে একজন ডাক্তার আসছেন । সকাল বেলা আসবেন । জোবাইদার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে । একবার রাগ হচ্ছে, মনে হচ্ছে এই সবের জন্য কেবল প্রেসিডেন্ট আজিজুর রহমানই দায়ী । অন্য দিকে মনে হচ্ছে সে কোন ভাবেই দায়ী না । ফারাজ যা করেছে নিজের ইচ্ছে তে করেছে । এমন কী ফারাজ কেন এটা করেছে সেটাও জোবাইদা জানে খুব ভাল করে ।
জোবাইদা বলল, নিয়ে এসো ।
ওয়ার্ড বয় চলে গেল । তার কিছু সময় পরেই মেয়েটা ঘরে ঢুকলো । জোবাইদা তাকিয়ে দেখলো খুবই স্বাধারন পোশাক পরে আছে মেয়েটা । একটা সাদা টিশার্টের সাথে কালো জিন্স । আর মুখটা একটা স্মার্ফ পরা । নিজের মুখ ঢাকার জন্য । সম্ভবত সে যে এখানে এসেছে সেটা বাসার কেউ জানে না । জোবাইদা সেই প্রশ্নটাই করলো, তোমার বাসায় কেউ জানে যে তুমি এখানে এসেছো?
-আব্বুর জানার কথা । তিনি সব কিছু জানেন । আমার পেছনে একজন সব সময় আঠার মত লেগে থাকে । আমি যখন বাইক নিয়ে আসি তখন পেছন পেছন সেও আসে ।
-বাইক নিয়ে এসেছো?
-হুম । রাতের বেলা আমি প্রায়ই বাইক নিয়ে বের হয় । এটা আমার শখ বলতে পারেন ।

কিছু সময় চুপ রইলো সে । ফারাজের দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । তারপর হঠাৎ বলল, আমি লাই টিভিতে দেখেছি পুরো দৃশ্যটা ।
জোবাইদা মুখ তুলে তাকালো নিকিতার দিকে । মাথায় পেঁচানো স্কার্ফটা সে খুলে ফেলেছে । জোবাইদা দেখলো মেয়েটার চোখে পানি কিচকিচ করছে । নিকিতা আবার বলল, ফারাজ যখন নিজের শরীর দিয়ে আব্বুর গুলিটাকে আটকে দিলো সেই দৃশ্যটা । আমার কেবল মনে হয়েছে এমন একটা কাজ কেন কেউ করবে? কেন? আমি নিজে হলে কী কাজটা করতে পারতাম? আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি । কিন্তু এই কাজটা কী করতে পারতাম?

জোবাইদা কী বলবে খুজে পেল না । নিকিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো জোবাইদার পাশে । তারপর স্যালাইন দেওয়া ফারাজের হাত ধরলো । বলল, এই দুইদিন কেবল আমি এই ব্যাপারটাই ভেবেছি । কেন করলো সে ? তারপর আমার কাছে পরিস্কার হয়েছে সব ।
জোবাইদা যেন চমকে উঠলো ।
নিকিতা বলল, আমি আপনার ডিগ্রির লিস্ট দেখছিলাম । সেখানেই দেখলাম আপনি ডিসিএম আর আর এমপিএইচ ডিগ্রিটা নিয়েছেন আমেরিকার থেকে । যে কেউ নিতে পারে । কিন্তু সব চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ঐ সময়ে আমার বাবাও আমেরিকাতেই ছিল ।

জোবাইদার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠলো । হঠাৎ করেই সেই ২৫ বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল । যে সব সে এতো দিন জোর করে লুকিয়ে রেখেছিলেন মনের গহীনে । সেই পার্কে হোচট খেয়ে পড়ে যেতে যাওয়া, কীভাবে সে তাকে রক্ষা করেছিলো, তারপর প্রতিদিন দেখা হওয়া, কথা বলা এক সময়ে…. উফ কিছু মনে করতে চান না তিনি। সব ভুলে যেতে চান ।
জোবাইদা অনুভব করলো নিকিতা তার হাত ধরেছে। বলল, আপনি মোটেই ভয় পাবেন না । কিংবা অন্য কিছু ভাববেন না । আমি এখন জানি আমার কেবল একটা ভাই না দুইটা ভাই রয়েছে। যে মানুষটা নিজের জীবন দিয়ে আমার বাবার জীবন এভাবে রক্ষা করতে পারে তার পরিবার সম্পর্কে আমি কখনও খারাপ কিছু হতে দিতে পারি না ।
জোবাইদা কেবল একটু হাসলো । নিকিতার দিকে ভাল করে তাকালো । মেয়েটার চোখ দুটো বড় উজ্জ্বল । একেবারে ঠিক সে তার বাবার চোখ পেয়েছে । ফারাজও তার বাবার চোখ পেয়েছে একদম ।
হঠাৎ নিকিতা বলল, আপনাদের কেন কাছে আসা হয় নি? দুই পরিবার মেনে নেয় নি?

জোবাইদা কিছু সময়ে চুপ করে রইলো । তারপর বলল, আসলে ব্যাপারটা ঐ পর্যন্ত যেতেই পারে নি । ইভেন আমরা কেউ আমাদের পরিবার সম্পর্কে জানতামই না । আমরা নিজেদের পরিবার নিয়ে কখনও কথা বলতাম না । আসলে নিজেদের পড়াশুনা আর নিজেদের ঐ সময় নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে অন্য কিছু নিয়ে কথা বলার সময় ছিল না । আর আমি সব সময় নিজের পরিচয়টা লুকিয়ে চলতে পছন্দ করতাম । বুঝতেই পারছো আমি তখন দেশের প্রেসিডেন্টের মেয়ে। এটা মানুষ জানতে পারলে তাদের আচরন কেমন বদলে যেতে দেখেছি আমি । তাই দেশ ছেড়ে এতো দুর পড়তে গিয়েছিলাম ।
-তাহলে?
-একদি হঠাৎ করেই নাদিম বলল যে তাকে বাসায় যেতে হবে । তার বাবার শরীর খারাপ । সে চলে গেল । তারপর প্রায় ছয় মাস পরে তার চিঠি এল তাকে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হয়েছে পারিবারিক চাপে । আমি আর কোন কথা তাকে বলতে পারি নি । তখন ফারাজ….।
লাইনটা শেষ করলেন না জোবাইদা । একভাবে তাকিয়ে রইলেন ফারাজের ঘুমন্ত চোখের দিকে ।
-আপনি কোন দিন বলেনও নি ? কেউ জানে না ?
-আমার বাবা জানে । এই কারণে তিনি অনেক দিন আমার সাথে রাগ করে কথা বলেন নি । আমিও দেশে আসি নি অনেক দিন । তারপর ফারাজের যখন ১৭ বছর বয়স তখন দেশে ফিরে এলাম । বাবা তখন অবশর নিয়েছেন । তার মন নরম হয়েছে । সে সব কিছু মেনে নিয়েছেন । মানে এটা নিয়ে আর কিছু বলেন নি ।
নিকিতা বলল, তারমানে এখন কেবল আমি জানলাম ।
-তোমার বাবাও জেনে গেছে । সে বুদ্ধিমান মানুষ । তুমি তোমার বাবার বুদ্ধি পেয়েছো ।

আরও ঘন্টা খানেক নিকিতা হাসপাতালে থাকলো । চলে যাওয়ার সময়ে নিকিতা বলল, আমি যদি প্রতিদিন আসি আপনার কি কোন আপত্তি আছে?
-প্রতিদিন আসাটা তোমার জন্য ঝুকিপূর্ণ না ?
-সেটা নিয়ে ভাববেন না । আমি সামলে নিবো। আজকে আসি । কাল আসবো আবার !
এই বলে নিকিতা হাসলো । হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে সে ফারাজের মাথার কাছে রাখলো । আর একটা চকলেটের প্যাকেট । যাওয়ার সময় বলল, আমি আসি আন্টি । কোন চিন্তা করবেন না । ভাইয়ার কিছু হবে না । কিছু না ।
তারপর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল । জোবাইদা নিকিতার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
আজকে কিভাবে তিনি এতো বছরের লুকানো সত্য অকপটে বলে দিলেন? মেয়েটার কাছে সব স্বীকার করে নিলেন? কিন্তু তার মোটেও খারাপ লাগছে না । বরং কেন যেন ভাল লাগছে । একটা শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে । এমনটা হওয়ার কারণ কি সেটা জোবাইদা হাসানের জানা নেই । তবে সে নিকিতার বলে যাওয়া কথাটা বিশ্বাস করেন। ফারাজের কিছু হবে না । কিছু হতে পারে না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 85

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “ষড়যন্ত্র (পর্ব দুই)”

Comments are closed.