কোন এক বৃষ্টির রাতে…

4.9
(73)

শশীর মনটা বিকেল থেকে খারাপ হয়ে আছে । আজকে কত শখ করে শাড়ি পড়েছিলো । ভেবেছিলো আজকে অপুর সাথে পুরো বিকেলটা কাটাবে । কাঠালতলার মামা ফুচকাতে বসে ফুচকা খাবে । কত দিন অপুর সাথে ঠিকঠাক মত সময় কাটানো হয় না । অপু নিজের কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে শশী নামের যে তার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে সেটা তার মনেই থাকে না ।

নিজেকে আবার সংশোধন করে নিলো শশী । সে অপুর ঠিক ভালোবাসার মানুষ না । তার সম্ভাব্য স্ত্রী । পারিবারিক ভাবে বছর খানেক আগে শশী আর অপুর এঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে । ঠিক হয়েছে যে শশীর পড়াশুনা শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে । ছেলে হিসাবে অপুকে তার অপছন্দ ছিল না । তার বাবা মায়ের খুব পছন্দের ছেলে । জামাই হিসাবে একটা ছেলের যে যে গুণ থাকা দরকার অপুর মাঝে সে সব কিছুই ছিল, আছে । ভাল পরিবার, ভাল চাকরি ভাল স্বভাব চরিত্র সব কিছু । কিন্তু শশীর কাছে অপু আসলে একটা একটা রোবট টাইপের মানুষ । কিছু ছেলে থাকে না যারা কোন দিন কোন নিয়ম ভাঙ্গে না, বাবা মায়ের শান্ত বাধ্য ছেলে অপু সেই রকম ছেলে ।
প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলো শশী নিজেকে কেবল বুঝিয়েছিলো যে সবার মাঝে সব কিছু থাকে না । থাকাটা সম্ভব না । মেনে নিতেই হবে । সে মেনেই নিয়েছিলো । তবে মাঝে মাঝে যখন ওর অন্য বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডদের রোমান্টিকতা দেখে তখন শশীর মন খারাপ লাগে । মাঝে মাঝে কান্না চলে আসে । আজও আসছে । কী এমন হত কাজ শেষ করে ওর হলের সামনে আসলে ?
ঘন্টা খানেক যদি ওর সাথে বসে গল্প করে যেত তাহলে কি খুব অসুবিধা হত !
কিন্তু সে বলল যে কাজ শেষ হতে দেরি হবে ! আজকে আসা হবে না !
আর কোন কথা না, কোন এপোজি না । কেবল জানিয়ে ফোনটা রেখে দিল !

শশী জানে অপুর এই ব্যাপারটা মনেই থাকবে না । শশীর যে মন খারাপ হয়েছে এটা অপু ঠিক বুঝতেই পারবে না । তার কাছে মনে হবে কাজ শেষ হতে দেরি হয়েছে এই কারণে আসা হয় নি । এইট শশী খুব ভাল করে বুঝবে এবং এটা নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই । এমন লজিকই কাজ করে তার মনে ।

শশীর মন আরও খারাপ হল যখন ঝুম বৃষ্টি নামলো । শশীর কত দিনের শখ নিজের ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবে । ঝুম বৃষ্টিতে মুখ চুল নাক সব কিছু ভিজে যাবে । তবুও তারা হাটতেই থাকবে । শশী এও জানে যে তার এই ইচ্ছে কোন দিন পূরণ হবে না । বিয়ের পর যদি কোন দিন বৃষ্টিতে ভেজার কথা শশী বলেও, অপুর কী বলবে সেটাও শশী খুব ভাল করে জানে । বলবে, গোসল করতে হয় ওয়াশরুমে কর, গরম পানি ঠান্ডা পানি মিশিয়ে আরাম করে গোসল কর । বৃষ্টিতে কেন ভিজতে হবে !

শশী নিজের বিছানা থেকে উঠে বসলো । ওর রুমমেট আজও রুমে নেই । খালার বাসায় গিয়েছে । আজকে ওকে একা একাই থাকতে হবে রুমে । সেটা নিয়ে ওর কোন মাথা ব্যাথা নেই । ঠিক করলো আর শাড়ি পড়ে থাকবে না । এখন আর জেগে থেকে লাভ নেই । ঘুমিয়ে পড়াই ভাল ।

নিচ থেকে কয়েকটা মেয়ের আনন্দ চিৎকার ভেসে আসছে । রাতের বেলা বৃষ্টি হলে অনেক মেয়েই ভিজতে বের হয় । রাতের বেলা গেট বন্ধ থাকার নিয়ম থাকলেও দারোয়ান মামা এই সময়ে কিছু বলে না । গেট খুলে দেয় । শশী কিছু সময় মেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে । ওর মন খারাপের ভাবটা আরও একটু বাড়লো । মনে মনে ঠিক করে নিল আগামী এক মাস সে অপুর সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবে না । এই এক মাসের ভেতরে যদি অপু বুঝতেই না পারে যে শশী তার উপর রাগ করে আছে তাহলে অপুকে বিয়েই করবে না সে । বাড়িতে চিৎকার চেঁচামিচি হবে জানে সে । হোক । তবুও একটা রোবটের সাথে সংসার করে সারাজীবনটা নষ্ট করতে মোটেই রাজি নয় সে ।

ওয়াশ রুমে ঢুকে শাড়ি বদলাতে যাবে তখনই ফোনটা বেেজ উঠলো । আবার বের হয়ে এল । ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো অপু ফোন দিয়েছে । একবার মনে হল ফোনটা সে ধরবে না । কিন্তু তারপরই কী মনে হল ফোনটা ধরলো ।
-হ্যালো ।
শশী কোন কথা বলল না । চুপ করে রইলো কিছু সময় । অপু আবারও বলল, কোথা্য আছো ?
শশী খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, কোথায় থাকবো এখন ? আজিব প্রশ্ন করেন কেন?
-বাহবা ! এতো রাগ !
-আপনি আবার রাগ অভিমান বুঝতে পারেন নাকি ! জানা ছিল না !

শশী অপুর হাসির শব্দ শুনলো । অপু বলল, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি রেগে আছো । আসলে আমি সরি বলার জন্য ফোন দিয়েছি । কিন্তু আজকে এমন ভাবে কাজে আটকে গেছি যে কোন ভাবেই বের হতে পারি নি ।
-বুঝলাম । আর কিছু?
-আমার সত্যিই আসার ইচ্ছে ছিল ।
-আমি বিশ্বাস করছি আপনার কথা ।
-তোমার কন্ঠে এখনও রাগ বুঝতে পারছি ।
-আপনি আর কিছু বলবেন?
-হ্যা কিছু বলার ছিল ।
-বলুন।
-তুমি কি একটু জানালাতে আসতে পারবে?
-মানে?

মানে বুঝতে একটু সময় লাগলো শশীর । কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তখন ওর বুকের মাঝে একটা তীব্র ধাক্কা লাগলো । এক প্রকার দৌড়েই চলে গেল জানালার কাছে । শশীর ঘরটা তিন তলাতে । জানালা দিয়ে পাঁকা রাস্তা রয়েছে । সেখানেই অপুকে দেখতে পেল সে । ল্যাম্প পোস্টের আলোতে অপুকে পরিস্কার দেখতে পা্চ্ছে শশী । এখনও অফিসের পোশাক পরে আছে সে । মাথায় ছাতা ধরে আছে সে । তবে বলতে গেলে সবটুকুই ভিজে গেছে ।
ওর দিকে তাকিয়ে ফোন ধরা হাতটা বাড়িয়ে একটু নাড়লো । তারপর আবার কানে কাছে সেটা ধরলো । বলল আমি সত্যিই সরি বলতে এসেছি ।
শশী অনুভব করলো ওর মনের ভেতরে এতো সময়ে যে রাগ ছিল সেটা একেবারে চলে গেছে । অপু বলল, আমি আসি তাহলে ?
-না না না । যাবেন না প্লিজ ।
-আচ্ছা । বল ।
-না । আপনি দাড়ান ওখানে । আমি আসছি ।
-আরে এই রাতে কেন আসবে?
-বেশি কথা বলবেন না । চুপচাপ দাড়িয়ে থাকুন ।

ফোনটা রেখে নিজেকে আরেকবার আয়নাতে দেখে নিল । আপাতত সব ঠিকই আছে । যে সুযোগ আজকে এসেছে সেটা হয়তো আর কোন দিন আসতে নাও পারে । এই সুযোগ কোন ভাবেই হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না ।

নিচে আসতে কয়েক মিনিট লাগলো । দারোয়ান মামাকে প্রথমে একটু নাহু নাহু করলেও বের হতে দিল । বলল যে খুব বেশি সময় থাকা যাবে না । আধা ঘন্টার ভেতরেই চলে আসতে হবে । শশী বের হয়ে গেল গেট দিয়ে । তারপর এল দৌড় দিয়ে পৌছালো অপুর সামনে । অপু তখনও এক মনে দাড়িয়ে রয়েছে । শশীকে আসতে দেখেই ছাতাটা ওর মাথার উপরে ধরতে গেল । শশী ছাতাটা হাত দিয়ে নিয়ে সরিয়ে দিল ।
-আরে ভিজে যাচ্ছো তো !
-যাই একটু সমস্যা নেই ।
-এভাবে রাতের বেলা বের হওয়ার দরকার ছিল না ।
শশীর কেন জানি খুব বেশি আনন্দ লাগছে । এইবার সে অপুর হাত থেকে ছাতাটা নিয়েই নিল । তারপর সেটা বন্ধ করে হাতে রাখলো ।
অপু আবারও বলে উঠলো আরে ভিজে যাচ্ছি তো !
-আপনি এমনিতেই ভিজে গেছেন । রাখুন তো আপনার ভেজাভিজি ! আসুন হাটি !
-মানে কি ! এই বৃষ্টির ভেতরে !
-চুপ ! কোন কথা না । আসুন তো ।

এই বলে শশী পাকা রাস্তার উপরে হাটতে শুরু করলো । বৃষ্টিতে ততক্ষনে ওর পুরো শরীর ভিজে গেছে । শশীর পাশাপাশি হাটতে লাগলো অপু । অপুর কাধের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে শশী বলল, আপনার অফিসের কাগজ পত্র ভিজে গেলে সমস্যা নেই?
-ব্যাগ ওয়াটারপ্রুফ । সমস্যা নেই ।

শশীর সত্যিই অনেক বেশি ভাল লাগছে এখন । বিকেলে বেলা যদি সত্যিই আজকে অপু চলে আসতো তাহলে এই সময়ে এই ভাবে ওর সাথে ভেজা হত না । এই এতো দিনের একটা শখ এভাবে পুরন হয়ে যাবে ভাবতেই পারে নি । আসলে কখন কার ভাগ্যে যে কী লেখা রয়েছে সেটা উপরওয়ালার থেকে ভাল আর কেউ জানে না ।

হাটতে হাটতে শশী অপুর একদম কাছে চলে এল । তারপর আলতো করে অপুর হাতটা ধরলো নিজ থেকেই । এর আগেও হাত ধরেছে ওর । প্রতিবারই একটা আলাদা শিহরন কাজ করে । আজ যেন একটু বেশি অনুভূত হল অনুভূতিটা ।
শশী বলল, অপু …
-হুম ।
-চলুন কাল বিয়ে করে ফেলি !
-সেকি এতো জলদি !
-হুম । জানি না হঠাৎ মনে হল । করবেন ?
-আচ্ছা বাসায় বলি !
-বাসায় বলাবলি নাই । পালিয়ে বিয়ে লুকিয়ে …..

অপু খানিকটা অবাক হয়ে বলল, বাসায় তো সবাই রাজিই । পালিয়ে কিংবা লুকিয়ে কেন করতে হবে !
-হবে । যা বলছি শুনুন । এতো কেন কেন করেন কেন ! কালকে অফিসের পরে । আপনি আপনার দুজন বন্ধুকে নিয়ে আসবেন আমি আমার দুজন বান্ধবীকে নিয়ে যাবো । ব্যাস বিয়ে । আর কোন কথা না !

অপু হঠাৎ হেসে ফেলল শশীর কথা শুনে । তারপর বলল, আচ্ছা কালকেই । ঠিক আছে ।
-হুম !
-খুশি ?
-ইয়াপ । খুব খুশি ।

এই বলে শশী রাস্তার ঠিক মাঝে অপুকে নিয়ে গেল । তারপর ওর ধরেই একটু নাঁচতে শুরু করলো । গুনগুন করে গাইতে শুরু করলো পছন্দের একটা গান ……

রাতের বেলা আরও অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো । এর ভেতরে শশীর পরিচিত কয়েকজন ক্লাস মেটও ছিল । তারা অবাক হয়ে দেখলো তার নিশ্চুপ বান্ধবীটি একটা ছেলের হাত ধরে রাস্তার মাঝে মৃদু নাচানাচি করছে ……

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 73

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →