শশীর মনটা বিকেল থেকে খারাপ হয়ে আছে । আজকে কত শখ করে শাড়ি পড়েছিলো । ভেবেছিলো আজকে অপুর সাথে পুরো বিকেলটা কাটাবে । কাঠালতলার মামা ফুচকাতে বসে ফুচকা খাবে । কত দিন অপুর সাথে ঠিকঠাক মত সময় কাটানো হয় না । অপু নিজের কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে শশী নামের যে তার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে সেটা তার মনেই থাকে না ।
নিজেকে আবার সংশোধন করে নিলো শশী । সে অপুর ঠিক ভালোবাসার মানুষ না । তার সম্ভাব্য স্ত্রী । পারিবারিক ভাবে বছর খানেক আগে শশী আর অপুর এঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে । ঠিক হয়েছে যে শশীর পড়াশুনা শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে । ছেলে হিসাবে অপুকে তার অপছন্দ ছিল না । তার বাবা মায়ের খুব পছন্দের ছেলে । জামাই হিসাবে একটা ছেলের যে যে গুণ থাকা দরকার অপুর মাঝে সে সব কিছুই ছিল, আছে । ভাল পরিবার, ভাল চাকরি ভাল স্বভাব চরিত্র সব কিছু । কিন্তু শশীর কাছে অপু আসলে একটা একটা রোবট টাইপের মানুষ । কিছু ছেলে থাকে না যারা কোন দিন কোন নিয়ম ভাঙ্গে না, বাবা মায়ের শান্ত বাধ্য ছেলে অপু সেই রকম ছেলে ।
প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলো শশী নিজেকে কেবল বুঝিয়েছিলো যে সবার মাঝে সব কিছু থাকে না । থাকাটা সম্ভব না । মেনে নিতেই হবে । সে মেনেই নিয়েছিলো । তবে মাঝে মাঝে যখন ওর অন্য বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডদের রোমান্টিকতা দেখে তখন শশীর মন খারাপ লাগে । মাঝে মাঝে কান্না চলে আসে । আজও আসছে । কী এমন হত কাজ শেষ করে ওর হলের সামনে আসলে ?
ঘন্টা খানেক যদি ওর সাথে বসে গল্প করে যেত তাহলে কি খুব অসুবিধা হত !
কিন্তু সে বলল যে কাজ শেষ হতে দেরি হবে ! আজকে আসা হবে না !
আর কোন কথা না, কোন এপোজি না । কেবল জানিয়ে ফোনটা রেখে দিল !
শশী জানে অপুর এই ব্যাপারটা মনেই থাকবে না । শশীর যে মন খারাপ হয়েছে এটা অপু ঠিক বুঝতেই পারবে না । তার কাছে মনে হবে কাজ শেষ হতে দেরি হয়েছে এই কারণে আসা হয় নি । এইট শশী খুব ভাল করে বুঝবে এবং এটা নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই । এমন লজিকই কাজ করে তার মনে ।
শশীর মন আরও খারাপ হল যখন ঝুম বৃষ্টি নামলো । শশীর কত দিনের শখ নিজের ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবে । ঝুম বৃষ্টিতে মুখ চুল নাক সব কিছু ভিজে যাবে । তবুও তারা হাটতেই থাকবে । শশী এও জানে যে তার এই ইচ্ছে কোন দিন পূরণ হবে না । বিয়ের পর যদি কোন দিন বৃষ্টিতে ভেজার কথা শশী বলেও, অপুর কী বলবে সেটাও শশী খুব ভাল করে জানে । বলবে, গোসল করতে হয় ওয়াশরুমে কর, গরম পানি ঠান্ডা পানি মিশিয়ে আরাম করে গোসল কর । বৃষ্টিতে কেন ভিজতে হবে !
শশী নিজের বিছানা থেকে উঠে বসলো । ওর রুমমেট আজও রুমে নেই । খালার বাসায় গিয়েছে । আজকে ওকে একা একাই থাকতে হবে রুমে । সেটা নিয়ে ওর কোন মাথা ব্যাথা নেই । ঠিক করলো আর শাড়ি পড়ে থাকবে না । এখন আর জেগে থেকে লাভ নেই । ঘুমিয়ে পড়াই ভাল ।
নিচ থেকে কয়েকটা মেয়ের আনন্দ চিৎকার ভেসে আসছে । রাতের বেলা বৃষ্টি হলে অনেক মেয়েই ভিজতে বের হয় । রাতের বেলা গেট বন্ধ থাকার নিয়ম থাকলেও দারোয়ান মামা এই সময়ে কিছু বলে না । গেট খুলে দেয় । শশী কিছু সময় মেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে । ওর মন খারাপের ভাবটা আরও একটু বাড়লো । মনে মনে ঠিক করে নিল আগামী এক মাস সে অপুর সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবে না । এই এক মাসের ভেতরে যদি অপু বুঝতেই না পারে যে শশী তার উপর রাগ করে আছে তাহলে অপুকে বিয়েই করবে না সে । বাড়িতে চিৎকার চেঁচামিচি হবে জানে সে । হোক । তবুও একটা রোবটের সাথে সংসার করে সারাজীবনটা নষ্ট করতে মোটেই রাজি নয় সে ।
ওয়াশ রুমে ঢুকে শাড়ি বদলাতে যাবে তখনই ফোনটা বেেজ উঠলো । আবার বের হয়ে এল । ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো অপু ফোন দিয়েছে । একবার মনে হল ফোনটা সে ধরবে না । কিন্তু তারপরই কী মনে হল ফোনটা ধরলো ।
-হ্যালো ।
শশী কোন কথা বলল না । চুপ করে রইলো কিছু সময় । অপু আবারও বলল, কোথা্য আছো ?
শশী খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, কোথায় থাকবো এখন ? আজিব প্রশ্ন করেন কেন?
-বাহবা ! এতো রাগ !
-আপনি আবার রাগ অভিমান বুঝতে পারেন নাকি ! জানা ছিল না !
শশী অপুর হাসির শব্দ শুনলো । অপু বলল, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি রেগে আছো । আসলে আমি সরি বলার জন্য ফোন দিয়েছি । কিন্তু আজকে এমন ভাবে কাজে আটকে গেছি যে কোন ভাবেই বের হতে পারি নি ।
-বুঝলাম । আর কিছু?
-আমার সত্যিই আসার ইচ্ছে ছিল ।
-আমি বিশ্বাস করছি আপনার কথা ।
-তোমার কন্ঠে এখনও রাগ বুঝতে পারছি ।
-আপনি আর কিছু বলবেন?
-হ্যা কিছু বলার ছিল ।
-বলুন।
-তুমি কি একটু জানালাতে আসতে পারবে?
-মানে?
মানে বুঝতে একটু সময় লাগলো শশীর । কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তখন ওর বুকের মাঝে একটা তীব্র ধাক্কা লাগলো । এক প্রকার দৌড়েই চলে গেল জানালার কাছে । শশীর ঘরটা তিন তলাতে । জানালা দিয়ে পাঁকা রাস্তা রয়েছে । সেখানেই অপুকে দেখতে পেল সে । ল্যাম্প পোস্টের আলোতে অপুকে পরিস্কার দেখতে পা্চ্ছে শশী । এখনও অফিসের পোশাক পরে আছে সে । মাথায় ছাতা ধরে আছে সে । তবে বলতে গেলে সবটুকুই ভিজে গেছে ।
ওর দিকে তাকিয়ে ফোন ধরা হাতটা বাড়িয়ে একটু নাড়লো । তারপর আবার কানে কাছে সেটা ধরলো । বলল আমি সত্যিই সরি বলতে এসেছি ।
শশী অনুভব করলো ওর মনের ভেতরে এতো সময়ে যে রাগ ছিল সেটা একেবারে চলে গেছে । অপু বলল, আমি আসি তাহলে ?
-না না না । যাবেন না প্লিজ ।
-আচ্ছা । বল ।
-না । আপনি দাড়ান ওখানে । আমি আসছি ।
-আরে এই রাতে কেন আসবে?
-বেশি কথা বলবেন না । চুপচাপ দাড়িয়ে থাকুন ।
ফোনটা রেখে নিজেকে আরেকবার আয়নাতে দেখে নিল । আপাতত সব ঠিকই আছে । যে সুযোগ আজকে এসেছে সেটা হয়তো আর কোন দিন আসতে নাও পারে । এই সুযোগ কোন ভাবেই হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না ।
নিচে আসতে কয়েক মিনিট লাগলো । দারোয়ান মামাকে প্রথমে একটু নাহু নাহু করলেও বের হতে দিল । বলল যে খুব বেশি সময় থাকা যাবে না । আধা ঘন্টার ভেতরেই চলে আসতে হবে । শশী বের হয়ে গেল গেট দিয়ে । তারপর এল দৌড় দিয়ে পৌছালো অপুর সামনে । অপু তখনও এক মনে দাড়িয়ে রয়েছে । শশীকে আসতে দেখেই ছাতাটা ওর মাথার উপরে ধরতে গেল । শশী ছাতাটা হাত দিয়ে নিয়ে সরিয়ে দিল ।
-আরে ভিজে যাচ্ছো তো !
-যাই একটু সমস্যা নেই ।
-এভাবে রাতের বেলা বের হওয়ার দরকার ছিল না ।
শশীর কেন জানি খুব বেশি আনন্দ লাগছে । এইবার সে অপুর হাত থেকে ছাতাটা নিয়েই নিল । তারপর সেটা বন্ধ করে হাতে রাখলো ।
অপু আবারও বলে উঠলো আরে ভিজে যাচ্ছি তো !
-আপনি এমনিতেই ভিজে গেছেন । রাখুন তো আপনার ভেজাভিজি ! আসুন হাটি !
-মানে কি ! এই বৃষ্টির ভেতরে !
-চুপ ! কোন কথা না । আসুন তো ।
এই বলে শশী পাকা রাস্তার উপরে হাটতে শুরু করলো । বৃষ্টিতে ততক্ষনে ওর পুরো শরীর ভিজে গেছে । শশীর পাশাপাশি হাটতে লাগলো অপু । অপুর কাধের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে শশী বলল, আপনার অফিসের কাগজ পত্র ভিজে গেলে সমস্যা নেই?
-ব্যাগ ওয়াটারপ্রুফ । সমস্যা নেই ।
শশীর সত্যিই অনেক বেশি ভাল লাগছে এখন । বিকেলে বেলা যদি সত্যিই আজকে অপু চলে আসতো তাহলে এই সময়ে এই ভাবে ওর সাথে ভেজা হত না । এই এতো দিনের একটা শখ এভাবে পুরন হয়ে যাবে ভাবতেই পারে নি । আসলে কখন কার ভাগ্যে যে কী লেখা রয়েছে সেটা উপরওয়ালার থেকে ভাল আর কেউ জানে না ।
হাটতে হাটতে শশী অপুর একদম কাছে চলে এল । তারপর আলতো করে অপুর হাতটা ধরলো নিজ থেকেই । এর আগেও হাত ধরেছে ওর । প্রতিবারই একটা আলাদা শিহরন কাজ করে । আজ যেন একটু বেশি অনুভূত হল অনুভূতিটা ।
শশী বলল, অপু …
-হুম ।
-চলুন কাল বিয়ে করে ফেলি !
-সেকি এতো জলদি !
-হুম । জানি না হঠাৎ মনে হল । করবেন ?
-আচ্ছা বাসায় বলি !
-বাসায় বলাবলি নাই । পালিয়ে বিয়ে লুকিয়ে …..
অপু খানিকটা অবাক হয়ে বলল, বাসায় তো সবাই রাজিই । পালিয়ে কিংবা লুকিয়ে কেন করতে হবে !
-হবে । যা বলছি শুনুন । এতো কেন কেন করেন কেন ! কালকে অফিসের পরে । আপনি আপনার দুজন বন্ধুকে নিয়ে আসবেন আমি আমার দুজন বান্ধবীকে নিয়ে যাবো । ব্যাস বিয়ে । আর কোন কথা না !
অপু হঠাৎ হেসে ফেলল শশীর কথা শুনে । তারপর বলল, আচ্ছা কালকেই । ঠিক আছে ।
-হুম !
-খুশি ?
-ইয়াপ । খুব খুশি ।
এই বলে শশী রাস্তার ঠিক মাঝে অপুকে নিয়ে গেল । তারপর ওর ধরেই একটু নাঁচতে শুরু করলো । গুনগুন করে গাইতে শুরু করলো পছন্দের একটা গান ……
রাতের বেলা আরও অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো । এর ভেতরে শশীর পরিচিত কয়েকজন ক্লাস মেটও ছিল । তারা অবাক হয়ে দেখলো তার নিশ্চুপ বান্ধবীটি একটা ছেলের হাত ধরে রাস্তার মাঝে মৃদু নাচানাচি করছে ……