দ্যা ম্যাও প্রিন্সেস (শেষ পর্ব)

4.8
(63)

পরদিন সকালে ঘটলো আরেক ঘটনা । আমাকে নিতে অফিসের গাড়ি আসে । আজকে গাড়িতে উঠেই অবাক হলাম । গাড়ি যদিও আগেরটাই রয়েছে তবে গাড়ির ড্রাইভার বদলে গেছে । এই ড্রাইভারকে আমি আগেও দেখেছি । কিন্তু সে তো এই গাড়ি চালায় না । আমি নতুন ড্রাইভারকে বললাম, কী ব্যাপার মজিদ কোথায়?
ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে একটা না জানার হাসি দিলো । বলল, জানি না স্যার । শুনছি মজিদের চাকরি নাই ।

তথ্যাটা আমি একটু চমকে গেলাম । আমার কেন জানি কাল রাতেই মনে হচ্ছিলো যে রিয়ানা আরমানের কাছে তথ্যটা ঠিকই চলে গেছে । কেমন করে গেছে আমি জানি না । বিশেষ করে কাল যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো সেটার কোন ব্যাখ্যা ছিল না । এখন মজিদের চাকরি নেই শুনে মনে হল নিশ্চিত ভাবেই রিয়ানা আরমানের কাছে খবর চলে গেছে ।

আমার ধারণা সত্যি করে দিতেই রিয়ানা আরমান যখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল তখন তার চেহারার দিকে তাকিয়েই আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে রিয়ানা আরমান গতকালকের ঘটনা জানে । আমি যে তার নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে হেটে হেটে বাসায় ফিরেছি এবং পথের মাঝখানে বিপদে পড়েছিলাম, এই তথ্য সে জানে ।

গাড়ি এগিয়ে চলল । রিয়ানা মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো সিটের উপর । আমার দিকে কেবল একবার তাকিয়েছে সে । তারপর নিজের মোবাইলে কী যেন করছে । আমি যেন গাড়িতেই নেই এমন একটা ভাব করে আছে । আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না । চুপ করে বসে রইলাম। তখনই খেয়াল হল গাড়ি অফিসের দিকে যাচ্ছে না । গাড়িটা যাচ্ছে মুন্সিগঞ্জের দিকে ।

আমি ড্রাইভারকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই পেছন থেকে রিয়ানা বলল, রফিক, ফার্ম হাউজের দিকে নিয়ে যাচ্ছো তো ?
-জে ম্যাডাম ।
-গুড ।

আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । তবে একেবারে চুপচাপ বসে থাকতেও ভাল লাগছিলো না । কি যে করি !
অনেক সাহস করে পেছনে ফিরে তাকালাম । তারপর বলল, ম্যাম ফার্মহাউজে যাচ্ছি ! কোন কাজ ছিল কি?
-হ্যা ।
-ও !

আবারও আমি চুপ করে গেলাম । কি বলবো খুজে পেলাম না আর । বসে বসে আপন মনেই গত রাতের কথা ভাবতে লাগলাম । কিভাবে গত কাল রাতের ঘটনাটা ঘটে গেল ! কালো মত ঐ প্রাণীটা আসলে কি ছিল ? আর মিউ ওভাবে সামনে চলে এল কেমন করে ! এছাড়া মিউর আশে পাশে ঐ বিড়ালগুলোই বা কোথা থেকে এল ? মিউয়ের আশে পাশের ঐ বিড়ালগুলো দেখে আমার কেন যেন মনে হয়েছে ওরা সবাই মিউয়ের বডিগার্ড টাইক কিছু একটা ।
কিন্তু মিউয়ের সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিলো সেইদিন মিউয়ের সাথে তো কেউ ছিল না । আর সেদিন মিউয়ের তো এতো সাহসও ছিল না যেমনটা ও গত রাতে দেখালো । আমার মিউয়ের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন মনে পড়লো । সেদিনও এমন রাতই ছিল । তবে সেদিন বেশ বৃষ্টি হয়েছিলো । আমার অফিসে বেশ কিছু কাজ ছিল । বের হতে হতে প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে । আমি যখন অফিস থেকে বের হয়েছি তখন সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে । আমি আগেই বলেছি যে দিনের বেলা এই অফিস পাড়াটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় । আর সেদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে এলাকাটা যেন একেবারে সুনসান নিরব হয়ে গেছে । আমি চুপচাপ নিজের বাসার দিকে হাটা দিলাম ।

সেদিনও অর্ধেক পথ এসেছি তখনই কাছে কোথাও কয়েকটা বেড়ালের তীব্র চিৎকার শুনতে পেলাম । এতোই জোড়ে যে আমি বেশ চমকে গেলাম । রাস্তায় কেবল ল্যাম্প পোস্টের আলো জ্বলছে । সেই আলোতেই আমি দেখতে পেলাম একটা ধবধবে সাদা বেড়ালে দৌড়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে । ঠিক তার পেছনেই দুটো কালো বেড়াল ধাওয়া করে আসছে । আমি সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে । পেছনের বেড়াল দুটো একটু বড় । বনবেড়ালের সমান বড় !
সাদা বেড়ালটা দৌড়ে এসে আমার পায়ের পেছনে লুকালো । আমি একবার ওটার দিকে তাকালাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম কাধের কাছে একটা ক্ষত হয়ে আছে । সেখান দিয়ে রক্ত ঝরছে । এতো চমৎকার একটা বেড়াল আর এই দুটো পাজি বেড়াল ওটাকে একা পেয়ে এমন ভাবে আঘাত করেছে । মেজাজটা এতো খারাপ হল ! কালো বেড়াল দুটো এগিয়ে আসছে আর মুখ দিয়ে কেমন ঘড়ঘড় করতে লাগলো ।

ডান পাশের বেড়াল একটু যেন বেশিই কাছে চলে এসেছে । এতো সাহস দেখে আমি খানিকটা অবাকই হলাম । এবং সাথে সাথে মেজাজ আরও খারাপ হল । ডান পায়ে আমার ফুটবলের শট খুব ভাল । ক্যাম্পাসের ফুটবল টিমে আমি সেক্ন্ডব ফরওয়ার্ড ছিলাম । অনেক দিন যদিও খেলি না তবে এই বেড়ালকে মিস করার কোন চান্সই নেই ।

বেড়ালের ঠিক পেট বরাবর আঘাতটা লাগলো । এবং সেটা উড়ে গিয়ে কোথায় যে পড়লো আমি নিজেও জানি না । কেবল একটা ভয়ংকর ডাক শুনতে পেলাম বেড়ালটার । অন্য বেড়ালটা দেখলাম একটু পিছিয়ে গেছে । একবার আমার দিকে, একবার আমার পায়ের দিকে তাকালো কয়েকবার । তারপর কয়েক মুহুর্ত চুপ করেই কেটে গেল । আমি আরেকটা লাথি মারার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রাখলাম । বেটা সামনে এগিয়ে আসতে গেলেই আরেকটা লাথি হাকাবো । কিন্তু বেটা এল না । আস্তে করে পেছনে সরে গেল ।

আমি পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখি সাদা বেড়ালটা কেমন যেন মাটিতে শুয়ে পড়েছে । ক্ষত থেকে রক্ত পরছে । আমি সেটাকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর নিজের বাসার দিকে দ্রুত হাটা দিলাম ।
বাসায় পৌছে সবার আগে বেড়ালটাকে পরিস্কার করে, ক্ষত স্থানে স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম । তারপর যত্ন করে নিজের বিছানার পাশেই শুইয়ে দিলাম ওটাকে । আরাম করে ঘুমাতে শুরু করলো ।

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন তাকিয়ে দেখি বেড়ালটা সেখানে নেই । তবে ঐদিন রাতে ঠিকই ফিরে এসেছিলো । অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম ক্ষত স্থানটা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে । এতো দ্রুত শুকিয়ে যাবে আমি ভাবি নি । এরপর থেকে অফিস থেকে ফিরে এসেই তাকে দেখতে পেতাম । রাতে থাকতো আর সকালে হাওয়া হয়ে যেত ।

খেয়াল করলাম যে গাড়ি থেমে গেছে । একটা বাংলো টাইপের বাড়িতে ঢুকছে গাড়ি । আমি কয়েকবার শুনেছি এই ফার্ম হাউজের কথা । তবে এইবারই প্রথম এসে হাজির হলাম । গাড়ি থামতেই রিয়ানা বের হয়ে গেল গাড়ি থেকে । তারপর সোজাসুজি হাটতে শুরু করলো । আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে তার পেছনে হাটা শুরু করে দিলাম । সত্যি আমি এসবের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখি রিয়ানা বসার ড্রয়িং রুমের সোফার উপরে বসে রয়েছে গম্ভীর ভাবে । আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সেদিকে । এখনও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-ম্যাম !
-ইয়েস !
-আপনি কি কোন কারণে আমার উপরে রেগে আছেন ?
-তোমার কি মনে হয় না আমার রেগে থাকা উচিৎ?

আমি খানিকটা অবাক হলাম । কারণ এই কয়দিন রিয়ানা আমাকে ঠিকই আপনি আপনি করে বলতো আজকে সোজাসুজি তুমি করে বলছে । এবং আমাকে তখন আরও অবাক করে দিয়ে বলল, চাইলে তুমিও আমাকে তুমি করেই বলতে পারো!

আমি কয়েক মুহুর্ত কেবল অবাক হয়ে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এই মেয়ে কিভাবে জানলো আমার মনের কথা! আমি কী ভাবছি সেটা তো কোন ভাবেই তার জানার কথা না !

এই কথাটা ভাবতেই দেখলাম রিয়ানা সোফা থেকে উঠে দাড়ালো । তারপর আস্তে আস্তে আগিয়ে আসছে লাগলো আমার দিকে । পুরোপুরি চোখ আমার চোখের দিকে । আমি এমনিতেই রিয়ানার চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না । এই মেয়ের চোখের ভেতরে কিছু একটা আছে যা আমাকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় । আর এমন সুন্দর চোখের দিকে খুব বেশি সময় এমনিতেও তাকিয়ে থাকা যায় না । কিন্তু আজকে আমি চাইলেও চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । একেবারে ওর নীল চোখের দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে হল । রিয়ানা থামলো একেবারে আমার সামনে । ওর মুখ থেকে আমার মুখ মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরে । আমি তখনই একটা গন্ধ পেলাম । খুব পরিচিত গন্ধ । এই সুগন্ধটা আমি কোথায় পেয়েছি !

মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম ।

আমার চোখের দিকে তাকিয়েই রিয়ানা বলল, মনে পড়েছে?
কোন মতে বললাম, মানে?
-মানে এই পরিরিত গন্ধটা । মনে পড়েছে ?

আমার তখনই মনে পড়লো ! এটা মিউয়ের শরীরের গন্ধ । কিন্তু রিয়ানার শরীর থেকে কিভাবে আসছে এই গন্ধ !
কিভাবে?

রিয়ানা এবার আমার আরো কাছে এল । আলতো করে আমার ঠোঁটে চুমু খেল একটা । আমি যেন একেবারে জমে গেলাম । আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না । কেন হচ্ছে আর কিভাবে হচ্ছে ! একবার মনে হল আমি নিশ্চিত ভাবে গাড়িতে আসতে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছি । সেই ঘুমের ভেতরেই আমি স্বপ্ন দেখছি । নয়তো এমন কিছু তো হওয়ার কথা না ।

রিয়ানা আবার গিয়ে বসেছে সোফাতে । আমাকে ইশারা করলো ওর পাশে বসতে । আমি কোন কথা না বলে গিয়ে বসলাম ওর পাশে । রিয়ানা আমার হাত ধরলো । তারপর বলল, ভেবেছিলাম তোমাকে কোন দিন জানাবো না ব্যাপারটা । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জানাতেই হবে । এটার সাথে তোমার জীবনের নিরাপত্তা জড়িত ।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
-বলছি !

রিয়ানা একটা দম নিল জোড়ে । তারপর বলল, আমি এখন যা বলবো তা তোমার কাছে হাস্যকর মনে হবে কিংবা অবিশ্বাস্য । তবে এটা সত্য !
আমি একভাবে তাকিয়ে রইলাম রিয়ানার দিকে । রিয়ানা বলল, এটা তো মানো এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যার কোন ব্যাখ্যা নেই । আছে না?
-হ্যা । তা তো আছেই !
-আমাদের জাতিটাও ঠিক তেমনই একটা জাতি, যা কোন ব্যাখ্যা নেই ।
-আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না । আমাদেরকে বলা হয় মিরুচুং । সুন্দরবনের ইন্ডিয়ান পোর্সনে বাস করতো আমাদের পূর্বপুরুষেরা । তারপর এক সময় বন কমতে শুরু করলে তারা লোকালয়ে চলে আসে । সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে । যখন দেশ ভাগ হয়ে যায় তখন এই এদেশে চলে আসে । তারপর থেকে এখানেই থাকছি । যদিও আমাদের কিছু অংশ এখনও বনের ভেতরেই বাসবাস করে । তবে গোত্র প্রধান এখন এখানে । সেটা হচ্ছে আমার বাবা ।
-তার মানে তুমি প্রিন্সেস ?

রিয়ানা হাসলো । তারপর বলল, বলতে পারো ।
আমি বললাম, এতে অবিশ্বাস করার কী আছে ! খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ! আগে একটা সম্প্রদায় বনের ভেতরে থাকতো তারপর তারা লোকালয়ে চলে এসেছে । সিম্পল !
-এতো সিম্পল না । আমাদের গোত্রটা ঠিক অন্য সব গোত্রের মত স্বাভাবিক না । এমন কী আমরা ঠিকঠাক মত মানুষও না ।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, কী বলছো এসব !
-বন বেড়াল চেনো তো ? যেটাকে তোমাদের এলাকাতে খাটাস বলে ! চিনো না ?
-হ্যা । মুরগি চুরি খায় !
রিয়ানা হেসে ফেলল । তারপর বলল, হ্যা । ওটাই । ঐ বনবেড়াল হচ্ছে সম্পর্কে আমাদের কাজিন !
আমি কোন কথা না বলে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
রিয়ানা বলল, বিশ্বাস করছো না জানি । কিন্তু এটা সত্য । আমরা অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক বেড়াল । আমরা মানুষের মনের কথা খুব ভাল করে বুঝতে পারি কেবল তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে । একটু আগেই তুমি বুঝতে পেরেছো সেটা ।
অন্য কেউ হলে আমি এই কথা হেসেই উড়িয়ে দিতাম তবে রিয়ানার চোখের দিকে তাকিয়ে সেটা আমি পারলাম না ।

আমি বললাম, কিন্তু এতো কিছুর ভেতরে আমি কোথা থেকে এলাম ?
-তুমি ! আমাকে তুমি কিভাবে পেয়েছিলে মনে আছে?
-তোমাকে !

আমি যেন ঠিক মত বুঝতে পারলাম না ওর কথাটা !
রিয়ানা বলল, তোমার মিউকে ! ঐ রাতের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই ?

আমার খুব ভাল করে মনে আছে ! রিয়ানা বলল, আমি আসলে গোত্রের পিওর ব্লাড না । পিওর ব্লাড বলতে আমার বাবা আগের স্ত্রীর পক্ষের দুই ছেলে । ওদের মাও একজন মিরুচুং। কিন্তু আমার মা মিরুচুং নয় । আমার মা একজন মানুষ । এই জন্য আমি মিক্স ব্লাড । এটাই আসলে আমার দুই ভাই পছন্দ করতো না । আমাদের গোত্রে ছেলেরাই গোত্র প্রধান হবে এমন কোন কথা নেই । ছেলে মেয়ে যে কেউ প্রধান হতে পারে । আমিও পারি । কিন্তু একজন মিক্স ব্লাড প্রধান হবে সেটা ওরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না । তাই সেদিন দুইজন মিলে আক্রমন করেছিলো । নিশ্চয়ই দেখেছো ওদের তুলনাতে আমি খানিকটা ছোট । পেরে উঠতাম না । তাই পালাচ্ছিলাম । যেহেতু ভাই বোন আমরা তাই অন্য কেউ আমাদের মাঝে ইন্টারফিয়ার করে নি । এমন কি আমাদের বাবাও না । তার ভাষ্য হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই একান্তই আমার । এখানে আমাকে সাহায্য করলে অন্য ছেলেদের প্রতি অবিচার করা হবে । ওরা হয়তো ঐদিন আমাকে মেরেই ফেলতো যদি তুমি মাঝে না চলে আসতে । বিশেষ করে ওভাবে কিকটা যে মেরেছো ! মাই গড ! ও কোথায় গিয়ে পড়েছিলো জানো?
-কোথায়?
-গাছের ওপাশেই একটা দেওয়াল ছিল । দেওয়ালের উপরে লোহার শিক দেওয়া ছিল । ঠিক ওটার মাঝে !

রিভুকে তারপর শায়েস্তা করতে আমার খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি । আমরা মিরুচুংরা মানুষ হিসাবে একটু ভলনারেবল । যখন বেড়ালের বেশে থাকি তখন শক্তিশালী । কিন্তু আমি মিক্স ব্লাড হওয়ার কারণে মানুষের বেশেও আমি বেশ ভাল ।
আমি এবার বললাম, তার মানে তুমি বলতে চাও তুমি মিউ ? আমার বেড়াল !
-এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না?
-না । সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না ।
-আচ্ছা থাক দরকার নেই বিশ্বাস করার । ওটা সময় আসুক নিজ চোখের দেখবে । এখন তোমাকে যে কারণে আমি সব সময় চোখে চোখে রাখি, সেটা হচ্ছে রিগুকে ওভাবে কিক মারার কারণে কিছু মিরুচুংয়ের রাগ রয়েছে তোমার । গতকাল রাতেই ওদের পাঠানো একটা মিরুচ তোমাকে আক্রমন করেছিলো । মিরুচ হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের অপদেবতা । যখন আমরা প্রথম এই লোকালয়ে বাস করতে এলাম মানুষের সাথে তো শক্তিতে আমরা পেরে উঠতাম না । তখন এই মিরুচকে ডেকে আনা হয় নরক থেকে আমাদের সাহায্য করার জন্য । এখন যদিও আর দরকার পড়ে না তারপরেও কেউ কেউ এখনও এসবের চর্চা করে ।

এইবার আমি একটু ভয় পেলাম । যতই আমি রিয়ানার কথা বিশ্বাস না করি, গতকাল যে কিছু একটা আমার সামনে এসেছিলো সেটার ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই । এবং মিউ সহ ঐ বেড়াল গুলো যে আমাকে রক্ষা করেছিলো সেটাও ভুল না । কেবল মাত্র মিউই যে রিয়ানা এই ব্যাপারটা বাদ দিলে রিয়ানার পুরো গল্পটুকু একেবারে বিশ্বাস যোগ্য ।

আমি কিছু বলতে যাবো তখনই রিয়ানা উঠে দাড়ালো । বেড়ালের মত নাক উচু করে কি যেন শুকলো বাতাসে । সাথে সাথেই দেখলাম আমাদের ড্রাইভার ও সাথে আরেকজন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো ।
রিয়ানা তাকে জিজ্ঞেস করলো, কত জন ?
-অন্তত দশ জন ! আমাদের আজকে এখানে আসার কথা ছিল না । আমি বলেছিলামা বডিগার্ড নিয়ে আসতে ! ওদের কেউ হয়তো পিছু নিয়েছিলো তারপর অন্যদের খবর দিয়েছে !
-চিন্তা কর না । গেট লক কর । আর খবর পাঠাও । বাকিটা দেখছি ।

ওরা চলে গেল !
আমি রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললাম, কি হচ্ছে এসব ?
রিয়ানা শান্ত কন্ঠে বলল, বিভু বাইরে গিয়েও ঠিক হয় নি । ওকে যেতে দেওয়াই ঠিক হয় নাই ।

আমি অবাক হয়ে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম । ওকে এই কদিনে কাছ থেকে যেমন টা দেখেছি আজকে কেমন যে অপরিচিত মনে হচ্ছে। ও মোবাইল বের করে কাকে যেন ডায়েল করতে লাগলো । তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, তুমি এক কাজ কর, পাশের ঘরের ভেতরে চলে যাও । দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ।

একটা মেয়ে আমাকে বলছে ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে থাকতে এই বাক্যটা কেন জানি আমার পৌরষত্ব্যে খানিকটা আঘাত করলো ।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই রিয়ানা বলল, এখানে অন্য কোন ভাবে নিও না । যা আসছে সেটার সাথে তুমি কোন ভাবেই লড়তে পারবে না । সো দরকার কি ! এখানে হিরোইজম দেখানোর কোন মানে নেই । আর আমি আছি, আমার সাথে ওরা আছে । সামলাতে পারবো । ততক্ষনে ফোর্স চলে আসবে । কোন চিন্তা নেই ।

আমি তবুও দাড়িয়ে রইলাম । কিছুতেই আমি ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে থাকবো না । তখনই অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো । রিয়ানা আমার চোখের দিকে তাকালো । একেবারে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । সাথে সাথেই আমার মাথায় ভেতরে কেউ যেন বাড়ি মারলো কিছু একটা দিয়ে । সেখানে কেউ আমাকে বলছে এখনই ঘরের ভেতরে যাও । দরজা বন্ধ করে বসে থাকো !
আমি কিছুতেই এই নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পারলাম না । আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলাম, কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু অবাক হয়ে কেবল লক্ষ্য করলাম যে আমার হাত পা নির্দেশের প্রতি সাড়া দিতে শুরু করেছে । আমি আস্তে আস্তে দরজার দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছি ।

আমি কয়েকবার নিজের মনকে নিজের নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন কাজ হল না । বিন্দু মাত্র লাভ হল না । আমি ঘরের ভেতরে গিয়ে হাজির হলাম । তারপর দরজা বন্ধ করে দিলাম । আমি নিজের ভেতরে যেন নেই । বারবার আমার মাথার ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে ঘরের ভেতরে ঢুকে বসে থাকো । চুপ চাপ বসে থাকি । আমি খাটের উপরে চুপ করে বসে রইলাম ।

কত সময় এই ভাবে বসে রইলাম আমি নিজেও বলতে পারবো না তবে হঠাৎ আমার কানে বেড়ালের ভয়ংকর আওয়াজ প্রবেশ করলো । যেন অনেক গুলো বেড়াল এক সাথে চিৎকার করছে । এই সব আওয়াজের ভেতরে মিউয়ের আওয়াজ চিনতে কেন জানি আমার মোটেও কষ্ট হল না। আমার বারবার মনে হতে লাগলো বাইরে কিছু হচ্ছে, রিয়ানা মানে বিপদে পড়েছে । ওরা মাত্র তিনজন । সবার সাথে কি পারবে !
আমার মস্তিষ্ক যেই এই চিন্তা করতে লাগলো যে আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে তখনই একটা সুক্ষ যন্ত্রনা টের পেলাম আমি । সেটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো । চিন্তাটা আমি যতই করতে থাকলাম যন্ত্রনাটা ততই বাড়তে লাগলো । আমি জানি কোন ভাবে আমার মনের ভেতরের নিয়ন্ত্রন রিয়ানা নিয়ে নিয়েছে । সে যা হুকুম দিয়েছে আমাকে এখন সেটাই শুনতে হচ্ছে ।

আমি চিন্তা করাটা বাদ দিলাম না । আমাকে এই চিন্তা করে যেতেই হবে । ঠিক তখনই কাজ হল । মনে হল যেন আমার মাথার উপর থেকে একটা ভার কমে গেল । সাথে সাথে বাইরে আমি সেই বেড়ালের আওয়াজ শুনতে পেলাম !

আমার মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো । সম্ভবত রিয়ানার কিছু হয়েছে এই কারণে তার আমার উপর থেকে নিয়ন্ত্রন কমে গেছে ।

আমি দ্রুত দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে বের হয়ে এলাম । দরজা দিয়ে বাইরে বের হতে যাবো তখনই দেওয়ালে সাজানো একটা তরবারির দিকে চোখ গেল । সেটা নামিয়ে নিলাম । খাপ থেকে খুলে আবারও বের হয়ে এলাম ।

বাইরে বের হয়ে দেখলাম মিউকে ঘিরে ধরে ধরেছে অন্তত ডজন খানেক বেড়াল । আকারে সব গুলো বড় বড় । চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও গোটা ৫/৬ বেড়াল । রক্তাক্ত । মিউয়ের শরীরেও লাল রক্ত আমি দেখতে পেলাম । আমার মাথার ভেতরে কি হল আমি সোজা দৌড়ে গেলাম সেদিকে । আমার সেই বিখ্যাত কিক মারলাম বেড়ালগুলো দিকে । একজনের শরীর লাগলো কেবল সেটা । আর বাকি গুলো সরে গেল । আমি সরাসরি মিউকে আড়ালে নিলাম ঠিক সেদিনের মত ।

এবং সেদিনেই সেই কালো বেড়ালটাকেও চোখে পড়লো আমার । আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । আমি যেমন ওটাকে চিনতে পেরেছি আমার মনে হল সেটাও আমাকে চিনতে পেরেছে । এটাই তাহলে রিভু আরমান ! সত্যিই কি তাই । তবে আজকে তার চোখে আগের মত সেই দৃষ্টি নেই। আমি কিছু চিন্তা না করে আগের মত করেই তাকে কিক মারতে গেলাম তবে সেটায় কাজ হল না । অদ্ভুত দক্ষতায় সে কটিয়ে গেল আমার কিক । তারপর আমার উপর লাফিয়ে উঠে এল । হাত দিয়ে গালে আচড় দিল বেশ জোড়ে । তীব্র একটা যন্ত্রনা অনুভব করলাম । একটু পরেই বুঝতে পারলাম গাল বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে । বেড়ালটা থাবা দিয়ে লাফ দিয়ে দুরে সরে গেছে । অন্যান্য বেড়ালগুলো একটু যেন স্থির হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে । সবাই যেন মজা দেখছে এমন একটা ব্যাপার । এরপর কালো বেড়ালটা একের পর এক আমার উপর হামলা করতেই লাগলো । এতো তীব্র আর দ্রুত যে আমি বিন্দু মাত্র কোন প্রতিরোধ করতে পারলাম না । আমার পুরো শরীরে বেয়ে রক্ত ঝড়তে শুরু করলো । শেষ আঘাতটা পায়ের কাছে এমন ভাবে দিয়েছে মনে হল পায়ের অর্ধেক মাংশ উঠে গেছে । আমি হাটু গেড়ে বসে পড়লাম কেবল ।

পেছনে তাকিয়ে দেখি মিউ কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে । ওর পুরো শরীর রক্তাক্ত !

আমার কেবল মনে হল এখন আমার মরার সময় হয়ে গেছে । আজকে সকালেই কি আমি জানতাম যে আমার সাথে এই রকম কিছু হটে চলেছে। এই ভাবে মরে যাবো !!

শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি ! মরলে মরবো ! বেটা রিভুকে নিয়েই মরবো !

আমি এবার তরবারিটা শক্ত করে চেপে ধরলাম । তাকিয়ে দেখি কালো বেড়ালটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে । ওর চোখ মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব । সেই সাথে বেপোয়ারা । এমন একটা ভাব যেন আমার উপরে সে পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব পেয়ে গেছে । এইটাই আমাকে সুযোগ করে দিল । বেটা যখন শূন্যে, আমার থেকে আর কয়েক মুহুর্তের দুরুত্ব, আমার দিকে এগিয়ে আসছে তখনই আমি তরবারিটা ঠিক বেটাকে লক্ষ্য করে তুলে ধরলাম ।
কাল হল এতেই । বেটা সোজা এসে ঢুকলো ফলার ভেতরে ! ঢুকে গেল অর্ধেক । এবার শরীরের সব শক্তি একত্রে করে তরবারিটা উল্টে মাটিতে চেপে ধরলাম । বেশ পুরো টুকু ঢুকে গেল ভেতরে । কিছু অংশ মাটিতেও পুতে গেল !

আমি সরে এলাম । বেটা এখানেই শেষ । যেভাবে গেথেছে বের হতে পারবে না আর !
তবে আর দরকার পরলো না । কিছু সময় চিৎকার করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গেল । আমার শরীর থেকে রক্ত বের হয়েছে অনেক । কেমন মাথা ঘুরে উঠলো । তবে তখন বিপদ কাটে নি । আরও কত গুলো বেড়াল রয়ে গেছে । মিউকে রক্ষা করতে হবে !

আমি দ্রুত মিউয়ের কাছে গিয়ে হাজির হলাম । এরপর নিজের শরীর দিয়ে গোল করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । বাইরে যতই আক্রমন আসুক মিউ পর্যন্ত আসবে না । এভাবে জড়িয়ে ধরেই কখন যে জ্ঞান হারালাম আমার মনে নেই ! হয়তো আর জ্ঞান ফিরবে না আমার । তবে একটা কাজ তো অন্তত করতে পেরেছি !

তাজা রক্তের গন্ধ আসতে লাগলো আমার নাকে । তবে সেই সব ছাপিয়ে মিউয়ের শরীরের সেই অদ্ভুত চমৎকার গন্ধটা আমার নাকে লাগলো ! গতকাল রাতে মিউয়ের সাথে ঘুমানো হয় নি । আজকে শেষ ঘুমটা হোক !

পরিশিষ্টঃ

চোখ মেলে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম সাদা সিলিংয়ের দিকে । একটু নড়তে গিয়েই টের পেলাম সারা শরীরে ব্যাথা ।
-এই নড়বে না !

আমি একটু মাথা কাত করতে পারলাম । তাকিয়ে দেখি বেডের ঠিক পাশেই রিয়ানা বসে রয়েছে । আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । বলল, কী লাগবে ?
কোন মতে বললাম, কিছু না ।
-তাহলে নড়ছো কেন ? আগে সুস্থ হও । তারপর তোমাকে আমি মজা দেখা্চ্ছি । হিরো সাজতে গেছে, না ?
আমি রিয়ানার চোখে হঠাৎ কেন জানি চিকচিক অশ্রু দেখতে পেলাম ! কিভাবে এখানে চলে এলাম সেটা পড়ে শোনা যাবে । আপাতত যে বেঁচে আছি আর রিয়ানাও ঠিক রয়েছে সেটাই হচ্ছে সব থেকে আনন্দের ব্যাপার !

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 63

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →