গল্পের শুরু
বুলবুল আহমেদ কতটা সময় চেহারে বসে আসেন সেটা তিনি নিজেও জানেন না । নীলার লাশটা এতো সময়ে রিলিজ করে দেওয়ার কথা কিন্তু কি একটা কারনে এখনও দেওয়া হয় নি । সেই কারনটা জানতেই তিনি বসে আছেন তার বাল্যবন্ধু আমিরুল হকের চেম্বারে । এই সরকারী হাসপাতালের অনেক দিন ধরে আছে সে । তার নিয়ন্ত্রনেই সব কিছু হয় । একবার বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন যে যে নীলার লাশটার কোন পোস্ট মোর্টেম না করা হয় কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি । অস্বাভাবিক মৃত্যুর পোস্ট মোর্টেম করতেই হবে ।
একটু মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুলবুল আহমেদ, টেবিলের উপর কিছু কাগজ রাখার মত আওয়াজ শুনে জেগে উঠলেন । চোখ মেলেই দেখতে পেলেন তার বন্ধু আমিরুল হক সামনের চেয়ারে বসছে । তার দিকে তাকিয়ে একটু শুকনো হাসি হাসলো । তারপর বলল
-একটু সময় লাগলো । সরি !
বুলবুল আহমেদ কিছু বললেন না । কিছু বলার মত অবস্থার ভেতরে নেই সে । আমিরুল হক আবার বলল
-নীলার লাশ রিলিজ করে দিয়েছি । এখনই নিয়ে যেতে পারো । পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে । পিউর সুইসাইড কেস ।
বুলবুল আহমেদের মনটা একটু সিক্ত হয়ে আসলো । এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না তার আদরের মেয়েটা এভাবে সুইসাইড করছে । এতো হাসিখুশি একটা মেয়ে । পড়াশুনা শেষ করে একটা ভাল চাকরি করছিল । তার বিয়ের জন্য ছেলে দেখা হচ্ছিলো । কদিনের ভেতরেই হয়তো বিয়ে হয়ে যেত । কত চমৎকার একটা জীবন অপেক্ষা করছিলো তার জন্য । কিন্তু সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল ।
বুলবুল আহমেদ বললেম, তাহলে আমি বরং যাই । নীলাকে নিয়ে অনেক দুর যেতে হবে ।
আমিরুল হক বললেন, একটু বস । তোমার সাথে জরুরী কথা আছে !
-কি কথা ?
আমিরুল আহমেদ তার সামনে রাখা দুইটা ফাইল এগিয়ে দিল বুলবুল আহমেদের দিকে । তারপর বললেন
-এই দুইটাই নীলার পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট ।
-দুই টা ?
-হ্যা দুইটা ! দুইটাই ঠিক । তবে একটা ফাইলে কিছু তথ্য বেশি আছে অন্যটাতে সেটা লেখা নেই ।
বুলবুল আহমেদ খানিকটা সময় ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইলো বন্ধুর দিকে । একজন মানুষের দুইটা পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট তৈরির মানে ঠিক বুঝতে পারছে না । আমিরুল হল বললেন
-দেখ তুমি আমার বন্ধু মানুষ তাই কাজটা করেছি । অন্য কেউ হলে কাজটা করতাম না । তারপরেই তোমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমি কাজ করবো । তুমি যা চাইবে তা হবে !
-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । নীলা এক গাদা ঘুমের ঔষধ খেয়েছে । এর কারনেই মারা গেছে । এটার বাইরে কি কিছু আছে ?
আমিরুল হক কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । মনে মনে ঠিক করে নিলেন কি বলবেন । তারপর বললেন,
-নীলার মৃত্যু অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ খাওয়ার কারনেই হয়েছে । এটার সত্য । এটা দুটো রিপোর্টেই লেখা আছে । তবে একটা রিপোর্টে লেখা আছে যে নীলা মারা যাওয়ার সময় ……
আমিরুল হক কিছু সময় যেন ইতস্তত করলেন । বুলবুল আহমেদ একভাবে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছেন । কি বলবে সেটা শোনার অপেক্ষা করছেন । আমিরুল হল বললেন, মৃত্যুর সময় নীলা দুই মাসের অন্তঃত্ত্বা ছিল !
কথাটা যেন বুলবুল আহমেদ প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না । প্রথম কিছু মুহুর্ত বুঝতেই পারলেন না না কি বলবে। এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অন্য কেউ হলে হয়তো এখনই সামনের মানুষটার উপর ঝাপিয়ে পড়তো কিন্তু সামনে বসা মানুষটা তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু। সে তার কাছে কোন ভাবেই মিথ্যা বলবে না।
আমিরুল হক বললেন, আমি বুঝতে পারছি কথাটা বিশ্বাস করা তোমার জন্য কষ্টের কিন্তু এটা সত্য। সম্ভবত এটার কারনেই নীলা এই পথ বেছে নিয়েছে।
-কিন্তু বিশ্বাস কর আমার মেয়েটা এমন না। এমন না….
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো বুলবুল আহমেদ। বন্ধুকে সান্তনা দিতেই নিজের চেহার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। তারপর বন্ধুর কাধে হাত রেখে শান্তনা দিল কিছু সময়।
বুলবুল আহমেদের সামলে নিতে আরও কিছু সময় লাগলো। নিজের চোখ মুছতে মুছতে আমিরুল হক বললেন, এই জন্যই আমি দুইটা রিপোর্ট বানিয়েছি। আমি নীলাকে খুব ভাল করে চিনি। ওর সাথে নিশ্চিত ভাবেই কোন অঘটন ঘটেছে। হয়তো লজ্জায় বলতে পারে নি কাউকে। কিন্তু এখন সেটা প্রমান করা আমাদের কারো পক্ষ্যেই সম্ভব না। তাই একটা রিপোর্ট এ আমি এই কথাটা লিখি নি। সিদ্ধান্তটা একান্তই তোমার। তুমি যদি চাও এটা প্রকাশ পাবে নয়তো পাবে না।
অনেকটা সময় মাথা নিচু করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি চাই না।
আমিরুল হক যেন জানতেনই বুলবুল আহমেদ এটাই বলবে। সে একটা ফাইল আগেই হাতে নিয়ে ছিলেন। তারপর সেট বাড়িয়ে দিলেন বুলবুল আহমেদের দিকে। তারপর বললেন, এটা নিয়ে যাও। আগুন ধরিয়ে দিও। নীলার এই কথাটা আর কেউ কোন দিন জানবে না।
নীলার মৃত্যুর পরে এমনিতেই নিজেকে বড় বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার আছে আজকে এই সত্যটা জানার পরে বুলবুল আহমেদের নিজেকে বড় অসহায় মনে হল । নীলার এমন কিছু করবে কিংবা নীলার সাথে এমন কিছু হবে সেটা সে কোন ভাবতেও পারছে না । তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন যে এই কথা কাউকে কোন দিন বলবেন না । বাইরের কেউ এই কথা জানতে পারলে মরা মেয়েটার নামে নানা কুকথা ছড়িয়ে পড়বে । মরে গিয়েও মেয়েটা শান্তি পাবে না ।
ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি । অনেকটা দুরে যেতে হবে তাকে মেয়ের লাশ নিয়ে !
পর্ব এক
-রইস ভাই আপনি কোথায়? গাড়ি রেখেছেন কোথায়?
-আফা মনি আজ শনিবার। আপনের মনে নাই আইজ গাড়ি সার্ভিস বন্ধ?
মিতু নিজের জিহবায় একটা ছোট কামড় দিল। একদম ভুলে গিয়েছিল যে আজকে শনিবার। আজকে তাদের অফিসের গাড়িটা চলবে না। মিতু বলল
-তাই তো ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা রাখি।
ফোন রেখে দিল। তারপর পার্কিং লটের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরে একটা অচেনা অনুভূতি হল ওর। এতো পরিচিত জায়গা এটা তবুও আজকে যেন একটু ভয় ভয় লাগলো।
সাধারণত অফিস শুরু আএ ছুটির সময়টা ছাড়া অফিসের এই তিন তলা পার্কিং লটে মানুষের আনাগোনা দেখা যায় না। কেবল ফেটের কাছে দুইজন দারোয়ান দাড়িয়ে থাকে। তাও সেটা একেবারে নিচ তলায়। বেজম্যান্ট দুইয়ে মানুষ থাকে না বললেই চলে। মানুষজন আসে আর গাড়ি রেখে দ্রুত চলে যায়। আর আজকে শনিবার হওয়ার কারনেত পুরো পার্কিং টা একেবারে নির্জন হয়ে আছে। মিতুর একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। অফিস ছুটির পরে নিজের ফোনের ভেতরে ডুবে ছিল একেবারে। অভ্যাসবশত লিফটে বি টু চেপেছিল প্রতিদিনের মত। একটুও মনে ছিল না যে আজকে ওদের অফিসের গাড়িটা নেই। আজকে নিজ নিজ ব্যবস্থা করেই বাসায় যেতে হবে।
মিতু দ্রুত আবার লিফটের দিকে পা বাডালো। লিফটের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেট একেবারে টপ ফ্লোরে চলে গেছে। সেখানে গিয়েই থেমে আছে। মিতু নিজের মধ্যেই একটা অস্থিরতা বোধ করছে। মনে হচ্ছে যেন খারাপ কিছু ঘটবে এখনই।
আরও কিছু সময় তাকিয়ে রইলো লুফটের ইনডিকেটরের দিকে। সেটা নড়ার কোন লক্ষ্মণই দেখা যাচ্ছে না। মিতু এবার সত্য সত্যিই খানিকটা অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। সেই সাথে সেই অস্বস্থির অনুভূতিটা যেন বেড়েই চলেছে ।
লিফট টা এখনও সেখানেই আটকে আছে ! আজকে আসবে না নাকি !
তখনই ওর মোবাইলটা একটু বিপ করে উঠলো । মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো একটা মেসেজ এসেছে । মেসেজটা ওপেন করতেই ওর পুরো শরীরে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল ।
মেসেজে লেখা “পার্কিং একা”
মিতুর মনে হল ওর এখনই ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে । অন্তত একজন মানুষ আছে যে জানে যে ও এখানে একা । মিতু আরেকবার লিফটের সুইচটা টিপ দিল । কিন্তু লিফট টা এখনও সেখানেই আটকে আছে । মিতুর এবার সত্যিই সত্যিই ভয় করতে লাগলো । এখানে আর থাকা যাবে না । মিতু জানে সামনের দিকে গেলে গেলে বের হওয়ার রাস্তা পাওয়া যাবে ।
মিতু দ্রুত সামনের দিকে পা বাড়ালো । ঠিক তখনই অনুভব করলো কেউ যে ওর পিছু নিয়েছে । সে স্পষ্ট শুনতে পেল তার পায়ের আওয়াজ । মিতু একটু একটু এগিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে । তারপরেই সে কালো মুর্তিটাকে দেখতে পেল । কালো কাপড় দিয়ে মানুষটা তার মুখ ঢেকে রেখেছে । মিতু এবার তীব্র ভাবেই ভয় পেয়ে গেল ।
মিতু কোন মতে বলল, কি চাও ?
লোকটা কোন কথা বলল না । তবে মিতুর মনে হল যে লোকটা ওর কথা শুনে মজা পেল খুব । সে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো ওর দিকে । এবার মিতু আর কিছু না ভেবে দৌড় মারলো সামনের দিকে । কোন দিকে সে যাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে না । কেবল মনে হচ্ছে কালো পোশাক পরা ঐ মানুষটা ওর ক্ষতি করতে চাচ্ছে । মানুষটার কাছ থেকে ওর দুরে যেতে হবে ।
পেছনের দিকে বার বার তাকিয়ে মিতু সামনে দৌড়াতে লাগলো । ঠিক সেই সময়েই সামনে থেকে কেউ এসে হাজির হল। মিতু একেবারে গিয়ে পড়লো তার শরীরের উপরে ।
-আমাকে ছাড়ো ছাড়ো ……
মিতু চিৎকার করে উঠলো । এখন মানুষটাকে দেখতে পায় নি । মানুষটা দিকে চোখ পড়তেই বুকে যেন একটু পানি এল । মানুষটা তার পরিচিত । আবীর আহসান ! ওর অফিসের একাউন্স ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে ।
ওর দিকে খানিকটা সময় অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আবীর । এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না মিতু কেন এমন আচরন করছে ! বলল
-আমি তো আপনাকে ধরিই নি ! ছাড়বো কিভাবে ?
মিতু খানিকটা দম নিয়ে বলল
-সরি !
আবীর বলল
-কি হয়েছে ? আপনি এমন করছেন কেন ?
-কেউ আমার পিছু নিয়েছে !
-কে ?
-জানি না । তবে আমি আসলে ভয় পেয়েছি । এই দেখুন সে আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে ।
এই বলেই মেসেজটা দেখালো আবীরকে । আবীর মেসেজটার দিকে তাকিয়ে দেখলো । তারপর বলল
-হুম । তাই তো দেখছি !
কিছু সময় চিন্তা করলো । তারপর বলল
-আপনি এই সময়ে এখানে কি করছেন ?
-ভুল করে চলে এসেছি । আজকে যে আমাদের অফিসের গাড়ি আসবে না এটা মনে ছিলো না ।
আবীর মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর বলল
-আচ্ছা আপনি বরং আসুন আমার সাথে । কে আপনাকে ফলো করছে দেখি !
পরের কিচুটা সময় ওরা পার্কিং লটের কিছু ঘোরাফেরা করলো কিন্তু কাউকেই দেখতে পারলো না । মিতুর ভয় ততক্ষনে কমে গেছে । আবীর নিজের বাইকের সামনে এসে হাজির হল । তারপর মিতুকে অবাক করে দিয়ে বলল, আপনি চাইলে আপানকে লিফট দিতে পারি ! চলবে ?
অন্য সময় হলে মিতু কি করতো কে জানে তবে এখন সে রাজি হল । তারপর উঠে বসলো আবীরের বাইকের পেছনে । মনের ভেতরে তখনও খানিকটা অস্বস্তি কাজ করছে ।
ওর সাথে এমন কিছু কেন হচ্ছে ? কেন কেউ ওকে ফলো করবে । কালো কাপড় পরা মানুষটা ওর দিকে কি ভয়ংকর চোখেই না তাকিয়ে ছিল । মানুষটার চোখই ওকে বলে দিচ্ছিলো যে সে সে ওর ক্ষতি করতে চায় ? কিন্তু কেন ?
যখন মিতুর নিজের বাসার সামনে এসে থামলো তখনও মিতুর মনে খানিকটা ভয় কাজ করছে । আবীর ওকে নামিয়ে দিয়ে বলল
-আচ্ছা তাহলে আমি আসি !
-থ্যাংকস আবীর ভাই । আসলে আমাদের এর আগে কখন কথা হয় নি । আর আজকে আপনি আমাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন !
আবীর হাসলো । তারপর বলল
-আমি আপনার এলাকাতেই থাকি ! এই রাস্তা দিয়েই যাই । মাঝে মাঝে আপনাকে দেখি এখানে । দেখলেন না আপনি না বললেও আপনার বাসাট সামনেই এসে থামলাম ।
মিতু ব্যাপারটা ভাবে নি । সত্যিই তাই । আবীর ঠিক ওর বাসার সামনে এসে থেমেছে । কিন্তু ও আবীরকে বলে নি যে ও কোথায় থাকে । এর আগে কোন দিন ওদের কথায় হয় নি ।
মিতু বলল
-আপনি এখানেই থাকেন ?
-হ্যা এই এলাকাতেই থাকি ! এই তো একটু দুরেই আমার বাসা !
-ও ! আবারও থেঙ্কিউ ।
আবীর হাসলো । তারপর বাইকে স্টার্ট দিল । বলল, আজকে আসি । কাল অফিসে দেখা হবে !
পর্ব দুই
-আরেকটু দেবো !
-না না আন্টি আর লাগবে না ।
-কেন রান্না ভাল হয় নি ?
-কি যে বলেন আন্টি ! রান্না খুব ভাল হয়েছে । আজকে যথেষ্ট খেয়েছি ! আর খাওয়ার উপায় নেই ।
-আরেকটু নাও !
আবীরের অবস্থা দেখে মিতুর হাসি পেয়ে গেল । সে হাসি ঠেকানোর চেষ্টা করলো না । বরং ফিক করে হেসে দিল ।
আবীর ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি হাসছেন ?
-হাসবো না তো কি করবো ? আম্মুর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে ধরে ধরে তার রান্না করে খাওয়ানো । কিন্তু আমি আর আব্বু কেউ এতো খাদক নয় । তাই যাকেই পায় তাকেই খাওয়াতে লেগে যায় ।
মিতুর আম্মু বলল
-তুই চুপ থাকতো । ছেলেটাকে একটু খেতে দে !
মিতুর বাবা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলো । এক সময়ে আবীরকে বলল
-তা বললে যে তুমি এই এলাকাতেই থাকো ?
-জি আঙ্কেল ! এই তো আপনাদের পাশের হাউজিং এ ।
-মিতুর সাথে চাকরি করছো কতদিন ?
-বেশি দিন হয় নি এই ব্যাংকে জয়েন করেছি । আগে প্রাইম ব্যাংকে জব করতাম । সেখান থেকে এখানে এসেছি ।
-ভাল ভাল । তা তোমার বাবা কি করে ?
-উনি এখন কিছু করে না । আগে সরকারি চাকরী করতেন । আম্মু এখনও কলেজের শিক্ষকতা করেন ।
-তুমি কি একাই ?
-এক বড় বোন আছে । আমাদের সাথে থাকে না । এখন আমি বাবা মাকে নিয়ে এখানে থাকি ।
মিতুর কেন জানি ওর বাবার এই প্রশ্ন উত্তর শুনতে বেশ ভাল লাগছিলো । কেন লাগছিলো সেটা ও বলতে পারবে না । সেদিনের পর থেকে আবীর নামের মানুষটা যেন হঠাৎ করেই ওর কাছের মানুষ হয়ে গেছে । ঐদিন বাসায় পৌছে দেওয়ার পরে মিতুর মনে ঘুরে ফিরে কেবল আবীরের কথায় আচ্ছে ।
পরদিন অফিস গিয়েই প্রথমে মিতু আবীরের সাথে দেখা করেছিলো । তারপর সেদিনের লাঞ্চটাও করেছিলো এক সাথে । দুর থেকে আবীরকে যতখানি গম্ভীর মনে হয়েছিলো কাছ থকে দেখলে সেটা মোটেই মনে হয় না । বরং মিতুর মনে হচ্ছে আবীর খুবই চমৎকার একজন মানুষ । কেবল সঠিক মানুষটা খুজে পেলেই সে নিজেকে তার সামনে তুলে ধরে !
সেদিনের পর প্রায় প্রতিদিনই ও অফিসের পর আবীরের সাথে এসেছে । মাঝের একদিনে ওর সাথে গিয়েছিলো বেঙ্গল বইয়ে । সময় গুলো কেমন চট করে চলে যাচ্ছে । আজকে শুক্রবার আবীরকে ওদের বাসায় ডেকেছে খাওয়ার জন্য । সেদিনের ঘটনার পর থেকে ওর বাবাই ওকে আসতে বলেছিলো ।
আবীর বলল
-আঙ্কেল মিতুর ঐ ব্যাপারে কিছু করেছেন কি ? মিতু বলছিলো যে ওর আগেও মনে হয়েছে যে কেউ ওর পিছু নেয় ! কিন্তু এর আগে বিষয়টা পাত্তা দেয় নি । কিন্তু ব্যাপারটা তো সিরিয়াস !
মিতুর বাবা সাফায়েত আহমেদের মুখটা খানিকটা কঠিন হয়ে গেল । সে বলল
-আমি জানি এর পেছনে কে আছে ?
-জানেন ?
আবীর মিতুর দিকে তাকিয়ে দেখলো ও খানিকটা কালো মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ও নিজেও জানে সম্ভত ওকে কে ফলো করে ! সাফায়েত আহমেদ বললেন
-মিতু যখন ইন্টার মিডিয়েট পড়তো তখন আমরা কুমিল্লা থাকতাম । ওখানে ওকে একটা ছেলে ওর পিছু নিয়েছিলো । ভাল পরিবারের ছেলে হলেও ছেলেটা ভাল ছিল না । পড়াশুনা করতো না । বাপের টাকা ছিল বলে সারা দিন টইটই করে ঘুরে বেড়াতো । মিতুকে বিয়েও করতে চেয়েছিলো । আমি রাজি হই নি ।
-তারপর ?
-তারপর আর কি ? ক্ষমতা থাকলে আর যা হয় ! আমাদের পিছু লাগা শুরু করলো । শেষ বাধ্য হয়ে ওর পরীক্ষার পরেই ঢাকাতে চলে এলাম । এতোদিন ভেবেছিলো সে ভুলে গেছে । এখন দেখছি সে ভুলে নি !
-আপনি ব্যবস্থা নেবেন না ?
-অনেক ছাড় দিয়েছি । আর না । এবার কিছু একটা করতেই হবে !
সাফায়েত আহমেদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই তার ফোন বেজে উঠলো । ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় ভুরু কুচকে রইলেন তিনি । তারপর ফোনটা রিসিভ করলেন । মিতু লক্ষ্য করলেন কেবল হ্যালো বলে আর কোন কথা বলল তার বাবা । মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর ফোন রেখে দিলেন ।
টেবিল ছেড়ে উঠতে দেখে মিতুর মা বলল
-সে কি খাওয়া হয়ে গেল ?
-হ্যা । আমাকে একটু যেতে হবে !
-কি হয়েছে !
-কল্যান এক্সিডেন্ট করেছে !
কল্যান ঘোস সাফায়েত আহমেদের অনেক দিনের বন্ধু । মিতু সেটা জানে । আগে যখন কুমিল্লাতে ছিল তখন মাঝে মাঝেই ওদের বাসায় আসতো । ঢাকাতে চলে আসার পরে অবশ্য আর আসে নি সে । মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত এই যা ! মিতুর মা বলল
-সেকি ! কখন ?
-কাল সকালে । মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলো । পেছনে একটা ট্রাক এসে চাপা দিয়ে চলে গেছে ! এখন ঢাকা মেডিক্যালে আছে । আমি একটু দেখে আসি ওকে !
মিতুর মা বলল
-এখনই যাবে ? খাওয়া শেষ করে যাও !
-নাহ ! আর খাওয়া হবে না । আমি গেলাম !
তারপর আবীরের দিকে তাকালো বলল
-তুমি কিছু মনে কর না প্লিজ !
-না না মনে করার কিছু নেই ।
-আমি আসি !
মিতুর বাবা তখনই বের হয়ে গেল । তবে আবীর আর মিতু আরও ধীরে সুস্থে খাওয়া শেষ করলো । খাওয়া শেষ করে মিতু ওকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল । মিতুর মা তখন নিজের কাছে ব্যস্ত ! মিতুর ঘরে বসতে বসতে আবীর বলল
-আমি আসলে ভাবি নি এতো জলদি আমাদের পরিচয় হয়ে যাবে !
মিতু হেসে বলল
-আমিও না । কেবল মনে হচ্ছে আপনার সাথে আমার কোথায় যেন একটা মিল আছে । দেখছেন না পড়লাম তো পড়লাম একেবারে আপনার গায়ের উপর ! আর আপনিও থাকেন একেবারে আমার বাসার পাশে !
-তাই তো দেখছি ।
-সবই কি কাকতালীয় ব্যাপার !
আবীর এই প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো মিতুর দিকে । মিতু হঠাৎ করেই লজ্জা পেয়ে গেল । কিন্তু চোখ সরালো না । মিতুর আবীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে অদ্ভুদ ভাল লাগছে !
পর্ব তিন
নিজের ভালবাসার মানুষটাকে অন্যের সাথে ঘুরতে দেখার মত কষ্টের মত কষ্টের ব্যাপার বুঝি আর হয় না । কেবল চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব না । বারবার মনে হয় সামনের মানুষটা কেন ওকে ভাল না ভেবে অন্য কাউকে ভালবাসছে । এমন কি নেই ওর ভেতরে !
অবশ্য এমন অনেক কিছুই ছিল না সুমনের ভেতরে যার কারনে মিতু কিংবা মিতুর পরিবার ওকে পছন্দ করে নি । কিন্তু সেটা তো সে পরিবর্তন করে ফেলেছে । কেবল মাত্র মিতুর জন্য নিজেকে অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছে । হ্যা কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় নি তবে চেষ্টা তো করেছে । এবং এখনও চেষ্টা করেই যাচ্ছে ।
সুমনের একটা সময় ধারনা ছিল যে সে জীবনে যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে । কোন কিছুই তাকে বাঁধা দিতে পারবে না । অন্তত ছোট বেলা থেকে তাই জেনে এসেছে । এমন ভাবেই সে বড় হয়েছে ।
তাই মিতুকে যখন প্রথম দেখ্বছিল তখন সে ধরেই নিয়েছিলো যে সে মিতুকে পেয়ে গেছে । কিছুদিন মিতুর পেছনে ঘোরাঘুরি করে যখন কাজ হল না তখন বাসায় জানালো যে সে মিতুকে বিয়ে করতে যায় । বাসা থেকে খুব একটা আপত্তি করেনি তখন । কিন্তু মিতুর পরিবার কিছুতেই রাজি হল না । শেষে শক্তি দেখাতে শুরু করলো । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও হল না । মিতুরা এলাকা ছেড়ে চলে গেল ।
সুমনের মনে হয়েছিলো যে সে হয়তো মিতুর আকর্ষন থেকে নিজেকে বের করতে পারবে কিন্তু মিতু চলে যাওয়ার পরে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো যে কিছুতেই মিতুকে নিজের মন থেকে বের করতে পারছে না । যতই চেষ্টা করুক না কিছুতেই কিছু হচ্ছে । শেষে সিদ্ধন্ত নিল নিজেকে বদলানোর । ঠিক সেই সেই কাজ গুলো সে বাদ দিয়ে দিবে যে যে কারনে মিতু তাকে প্রত্যাখান করেছে । আবার নতুন করে পড়াশুনা শুরু করলো । সব খারাপ অভ্যাস গুলো বাদ দিয়ে দিল ।
এখন যখন নিজেকে মিতুর জন্য প্রায় বদলে ফেলেছে তখন এসে দেখলো মিতু অন্য আরেকটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে । এটা সুমনের কিছুতেই সহ্য হল না । কিন্তু কিছু করতেও পারছিলো না । নিজের শহর হলে হয়তো অনেক কিছু করতে পারতো কিন্তু এখানে তার ক্ষমতা সীমিত ।
তবুও সিদ্ধান্ত নিল মিতুর সামনে গিয়ে হাজির হবে । তাকে বলবে যে নিজেকে সে বদলে ফেলেছে । আজকে সেই উদ্দেশ্যেই মিতুর সামনে এসে হাজির হল । ওর ঠিক অফিসের সামনেই এসে হাজির হল সে । মিতু তখন গেটের বাইরে কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো । নিশ্চয়ই ঐ ছেলেটার জন্য । এর আগেও সে দেখেছে ওকে ।
সুমন ধীর পায়ে গিয়ে হাজির হল মিতুর সামনে । ওকে দেখে যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলো । তবে নিজেকে সামলে নিল সাথে সাথেই ।
-কেমন আছো মিতু ?
-ভাল । আপনি এখানে ?
-তোমার সাথে কয়েকটা কথা বলার ছিল !
-দেখুন সুমন ভাই, আপনাকে আমি পরিস্কার ভাবেই জানিয়ে দিয়েছি আমার কথা !
সুমন খানিকটা আশাহত হল । মিতুর কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি । ওর দিকে এমন কি তাকাচ্ছে না পর্যন্ত । যদি তাকাতো তাহলে হয়তো ওর চোখের কষ্ট টুকু ও বুঝতে পারতো ! সুমন বলল
-তুমি আমাকে পছন্দ কর না কেন বলত ? আমি কি করেছি এমন ? এমন কি দেখো তোমার জন্য আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি । একটু দেরি হলেও পড়া শুনা শেষ করেছি । খুব জলদিই একটা চাকরিতে ঢুকবো ! আমাকে না পছন্দ করার কারন কি !
মিতু এবার সুমনের দিকে তাকালো । তারপর বলল
-দেখি ভাল লাগা মন্দ লাগা টা কখনও জোর করে আসে না । আপনাকে আমার কোন দিন ঐ রকম মনে হয় নি আমি আপনাকে নিয়ে ভাবিও নি সেই সব । আমি এই কথাটা কেন বোঝেন না যে জোর করে কিছু হয় না ।
-আমাকে আরেকটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না ?
-আপনি কিসের সুযোগ চা্চ্ছেন ? এটা কোন দিন সম্ভব না । সরি সুমন ভাই । আপনি দয়া করে চলে যান ।
-একটা বার শোন ….।
এই কথা বলে সুমন আরেকটু এগিয়ে গেল মিতুর দিকে । মিতু পিছিয়ে এল কয়েক পা । ঠিক সেই সময়েই বাইক নিয়ে ওদের সামনে এসে হাজির হল আবীর । কিছু সময় বোঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে । তারপর দ্রুত বাইকটা দাড় করিয়ে মিতুর কাছে চলে এল । মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল
-কোন সমস্যা ?
-না ! আপনি কি আমাকে একটু নামিয়ে দিতে পারবেন বাসাতে !
সুমন আবার বলল
-মিতু প্লিজ !
আবীর এবার ওদের মাঝে এসে দাড়ালো । সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার সাথে ও কথা বলতে ইচ্ছুক নয়, বুঝতে পারছেন না । দয়া করে চলে যান !
সুমন সেদিকে কান না দিয়ে মিতুকে বলল
-একবার শোন আমার কথা !
-আপনার সাথে ভাল ব্যবহার করছি !
সুমনের পুরো শরীরের ভেতরে আগুন ধরে গেল যেন । তবে নিজেকে সামনে নিল । তাকিয়ে দেখলো পেছন থেকে অফিসের সিকিউরিটির দুজন লোক এগিয়ে আসছে । এখানে পরিস্থিতি ওর পক্ষে নয় । মিতুর দিকে তাকিয়ে এবার রাগত কন্ঠে বলল
-কাজটা তুমি ভাল করলে না । আমি কিন্তু তোমার জন্য সব কিছু করেছিলাম ।
মিতু কোন কথা বলল না । কেবল আবীরের আড়ালে চলে গেল ।
আগে যখন সুমন ওর সামনে আসতো একটা অদ্ভুদ ভয় কাজ করতো । বারবার মনে হত এখনই যদি ওকে তুলে নিয়ে যায় ! যদি কোন ক্ষতি করে ফেলে । কিন্তু আজকে তেমন কিছুই মনে হল না । আবীর ওর সামনে কি রকম ভাবে দাড়িয়েছিল । যেন ওকে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করবে ।
সুমনকে চলে যেতে দেখলো মিতুর । আবীর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলো ওর মুখের পেশী শক্ত হয়ে উঠেছে । সুমনকে চলে যেতে দেখে খানিকটা শীথিল হয়ে এল । মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল
-এই কি সেই ?
-হু ।
-আর এসেছে এর আগে ?
-সামনে আর আসে নি । আজকেই প্রথম । তবে আমি মাঝে মাঝেই দেখতাম । আমাকে দেখে চলে যেত ।
-তোমার বাবা কি পুলিশের কাছে গিয়েছিলো ?
মিতু চট করে হেসে ফেলল । আবীর খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো মিতুর দিকে । এখনও ঠিক বুঝতে পারে নি মিতু হাসছে কেন ? মিতু আবীরের অবাক হওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি আমাকে তুমি বললেন তো তাই ?
-তাই নাকি ? তুমি করে বলেছি ? আসলে সরি ….। আমি আসলে ….
মিতু এবার হাসি মুখেই বলল
-কোন সমস্যা নেই । তুই ই ভাল । আজ থেকে মানে এখন থেকে আমিও তুমি করেই বলি ! কেমন ?
-আচ্ছা । কোন সমস্যা নেই !
পর্ব চার
আবীরের সাথে সময় গুলো এতো চমৎকার ভাবে কেটে যাবে মিতু কখনও ভাবেও নি । এতোটা দিন ওর মনের মত কাউকে মিতু খুজেও পায় নি । যার সাথেই টুকটাক কথা বলা শুরু করতো, কিছু সময় কথা বলার পরেই সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলতো । মিতুর কাছে মনে হত যেন সব গুলো ওর সাথে একটু দাম দেখানোর চেষ্টা করছে । নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে । অথচ আবীর একেবারে বিপরীত । অন্য মানুষের সাথে ঠিক মত কথাই বলে না কিন্তু ওর সাথে যখন থাকে কত কথা তার মনে আসে । মিতুর সে সব শুনতে খুব ভাল লাগে !
আজকেও আবীর কথা গুলো সে এক ভাবেই শুনে যাচ্ছিলো । তারা আজকে গিয়েছিলো বসুন্ধরাতে । আবীর কদিনের জন্য একটু বাইরে যাবে । কদিন ওদের মাঝে দেখা হবে না সেই জন্যই দুই জনেই চাইছিলো যেন আরো কিছুটা সময় কাছাকাছি থাকতে । আজকে আবীরকে বাইক নিতেও মানা করেছিলো এই জন্যই ।
মিতু বলল, তা কতদিন থাকবা শুনি ?
-জানি না । এক সপ্তাহের ছুটি !
-একটা সপ্তাহ তোমাকে দেখবো না !!
আবীর মিতুর দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল, তাহলে তুমিও চল আমার সাথে ! এক সাথে যাওয়া আসা হবে !
মিতু আবীরের কাধে একটা ছোট্ট ধাক্কা মেরে বলল, ইস শখ কত ! এতো সোজা না বুঝছেন জনাব ! আগে বাবার কাছে বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠান । তারপর !
-তারপর ?
-তারপর যেখানে নিয়ে যেতে চান নিয়ে যাবেন ! এর আগে না !
আবীর কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল । হঠাৎ ই যেন কোথায় হারিয়ে গেল । কিছু একটা ভাবতে লাগলো ! মিতুর মনে হল ও এমন কিছু বলে ফেলেছে যেটা ওর বলা ঠিক হয় নি ! মিতু বলল
-কি হল ?
-হুম ? কি বললে ?
-বললাম কি হল ? মুখ এরকম হয়ে গেল কেন ? আমার কথায় খারাপ লাগলো ?
আবীর একটু হাসার চেষ্টা করলো । তারপর বলল
-আরে না না । কি যেন বল ! আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ ! এই জন্য !
-ওহ ! আমার মত মনে হল আমার কথা শুনে খারাপ লাগলো ! অবশ্য কোন প্রেমিকেরাই বিয়ের কথা পছন্দ করে না !
-কিই !! মোটেই না !
এভাবেই ওদের কথা চলতে থাকে ওদের । মিতু নিজেও অবাক হয় এটা দেখে যে আবীরের সাথে ও কত কথা বলতে পারছে । কেবল যেন একটার পরে একটা কথা চলতেই থাকে !
রিক্সাটা যখন মিতুদের বাসার সামনে এসে থামলো, তখন মিতুর বাবা শাফায়েত আহমেদ বাইরে যাচ্ছিলেন হাটতে । রাতের এই সময়টা তার হাটাহাটির স্বভাব । মেয়েকে নামতে দেখতে এগিয়ে গেলেন সেদিকে । আবীর শাফায়েত আহমেদকে দেখে রিক্সা থেকে নেমে এল । শাফায়েত আহমেদ বললেন, মিতুর কাছে শুনলাম তুমি নাকি কোথায় যাচ্ছো ?
-জি আঙ্কেল ! একটু কাজ ছিল ।
-ও ! তুমি সাথে যেতে বলে এতোদিন খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকতাম । কিন্তু এখন তো আবার চিন্তা লাগবে !
-পুলিশে একটা ডায়রি করে রাখুন । আর অফিসের গাড়ি তো আছেই ।
-হ্যা সেটা আছে তবুও সাথে কেউ থাকলে ভাল হত !
তারপর মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুই এই কটা দিন অফিস থেকে ছুটি নিতে পারিস না ?
মিতু হাসলো । তারপর বলল, বাবা তুমি এমন ভাবে বলছো যেন আমি এর আগে কোন দিন একা একা বের হই নি !
-না সেটা না । কিন্তু কদিন থেকে দেখিস না ঐ বদমাশটার একটিভিটি কেমন বেড়ে গেছে । আগে তো এতো সাহস দেখাতো না । চিন্তা তো এই জন্যই ।
আবীর খানিকটা চিন্তিত গলাতে বলল, তাহলে একটু চিন্তারই কথা ।
-তাহলে এখন কি করা যায় ! ভাবছি আমিও প্রতিদিন ওকে অফিসের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেব আর নিয়ে আসবো !
-এটাই সব চেয়ে ভাল হবে !
শাফায়েত আহমেদ আবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর আমি তোমার মা বাবার সাথে একটু কথা বলতে চাই । ঢাকায় ফিরলে আমাকে জানিও ।
মিতুর হঠাৎই লজ্জা লাগলো । ওর বাবা কেন আবীরের বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাইছে সেই ব্যাপারটা পরিস্কার । সেই সাথে মনে একটা আশ্চর্য আনন্দবোধ হল । সব কিছু এতো দ্রুত হয়ে যাচ্ছে মিতুর ঠিক মত বিশ্বাস হচ্ছে না ।
আমি গেলাম, বলে মিতু দ্রুত বাসার ভেতরে চলে গেল । শাফায়েত আহমেদ মেয়ের লজ্জা পাওয়ার ভাবটা দেখে হাসলো । তারপর আবীরের দিকে তাকিয়ে বলল যে সাবধানে যেতে । ফিরে এসেই যেন সে তাকে তার বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয় !
তারপর দুদিন কেটে গেল কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই । প্রতিদিন শাফায়েত আহমেদ মিতুকে অফিসের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন আর বিকেল বেলা হলে সেখান থেকে নিয়ে আসতেন । কিন্তু তিন দিনের দিন ঝামেলা বেঁধে গেল । শাফায়েত আহমেদ মিতুকে আনতে গিয়ে দেখেন মিতু তখনও এসে পৌছায় নি । কয়েকবার ফোন দিলেন কিন্তু মিতুর ফোন বন্ধু । তার মনটা কু ডেকে উঠলো । বাসায় ফোন দিয়ে জানলেন মিতু বাসাতে পৌছেছে কি না । তার দেরি দেখে হয়তো বাসায়তে একা একাই পৌছে গেছে । কিন্তু বাসাতেও যায় নি সে ! আরও ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করেও যখন মিতু আসলো না তখন সাফায়েত আহমেদ সত্যিই সত্যি চিন্তায় পড়ে গেল । আবীরকে ফোন দিয়ে দেখলেন আবীর তখনও ঢাকার বাইরে । সেও চিন্তা করতে লাগলো । অফিসের কয়েকজনের নাম্বার দিল তাকে । সব নাম্বারে ফোন দিয়ে জানা গেল যে মিতু আজকে নাকি তাদের সাথে অফিসের গাড়িতে আসে নি । তার নাকি কাজ আছে এই বলে রিক্সা নিয়েছে !
রাত দশটার যখন বাজে তখন তিনি থানাতে হাজির হলেন । সব বিষয় খুলে বললেন । আগে থেকে থানায় ডায়রি করা ছিল ছিল তবুও তারা বললেন যে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে । আর ঢাকার হাসপাতাল গুলোতে একটু খোজ নিতে । মিতু যেহেতু একা একা রিক্সা করে বের হয়েছে তাই হয়তো কোন দুর্ঘটনায় পড়তে পারে !
পর্ব পাঁচ
পরের দুইটা দিন সাফায়েত আহমেদ নিজের বাসা থেকে থানায় সময় কাটালো বেশি । প্রতিটা মুহুর্ত যাচ্ছে আর তার মাথার ভেতরে মিতুর জন্য চিন্তা বাড়ছে । একটা সময় তার মনে হল তিনি আর এই উত্তেজনা নিতে পারবেন না । কয়েকবার তার মাথা ঘুরে উঠলো । তিনি পাশে থাকা কোন চেয়ার কিংবা টুলে বসে পড়ছিলেন । থানার পুলিশ ওফিসারেরা তাকে বারবার বলছিলো যে তিনি যেন বাসায় ফিরে যায় । তাদের দ্বারা যা সম্ভব হবে তারা তা করবে । ইতি মধ্যে তাদের সম্ভব সব ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে ।
কুমিল্লাতে ফোর্স চলে গেছে কিন্তু সম্ভাব্য আসামী আগেই খোজ পেয়ে গেছে । সে পালিয়েছে আর তা ছাড়া কুমিল্লাতে সুমনদের পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত তাই সেখানে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে । তবে থানার দারোগা তাকে ভরশা দিয়েছেন যে সুমনকে ধরে আনা হবেই । কোন চিন্তা না করতে !
সাফায়েত আহমেদ কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না । বারবার মনে হচ্ছে মিতুর বড় রকমের কোন ক্ষতি হয়ে যাবে, হয়তো এরই মধ্যে ঐ কিডন্যাপার মিতুকে কিছু করে ফেলেছে । তিনি আর ভাবতে পারছেন না ।
মিতুকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার একটা সম্ভাব্য স্থান বের করা হয়েছে । সেদিন অফিস থেকে মিতু একটু আগে আগেই বের হয়েছিলো । কোন কাজ ছিল হয়তো । অফিসের সিসি টিভি ক্যামেরাতে দেখা গেছে মিতু অফিস থেকে নির্ধারিত সময়ের ঘন্টা খানেক আগেই বের হয়েছে । রাস্তার বিভিন্ন সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ করে তার যাত্রা পথ ঠিক করা গেছে । মিতু তারপর সে একটা রিক্সা নিয়ে পান্থপথের দিকে গেছে । কিন্তু তারপর আর কোন খোজ পাওয়া যায় নি । পান্থপথ থেকে চার দিকে যেতে পারে কিন্তু কোন দিকে গেছে সেটা বের করা যায় নি । এই রাস্তার বেশ কিছুটা অংশে কোন সিসি টিভি ক্যামেরা নেই ।
আরও একটা দিন পার হয়ে গেল । যখন সাফায়েত আহমেদের ধারনা হল যে তিনি এবার সত্যি সত্যিই মিতুকে হারিয়ে ফেলেছেন তখনই মিতু বাসায় ফিরে এল । যদিও একেবারে সুস্থ ভাবে নয় তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো না যে মিতুর বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়েছে!
ওর জামা কাপড় ছেড়া ছিল কয়েক স্থানে । হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালীতে ছিল লাল দাগ ছিল । ওকে বেঁধে রাখা হয়েছিলো কোথায় ! কিন্তু ওকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিংবা কে বা কারা ওকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেটা মিতু বলতে পারলো না । ও কেবল চুপ করে তাকিয়ে ছিল ওর বাবা মায়ের দিকে !
থানা থেকে পুলিশ এল । তাদের জিজ্ঞাসা বাদেও মিতু কিছুই বলল না । কেবল বলল যে ওর চোখ বাঁধা ছিল । কোথায় ওকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো ও বলতে পারবে না আর কেনই বা ওকে ছেড়ে দিল সেটাও ও জানে না !
যেহেতু মিতু ফিরে এসেছে তাই থানার লোকজন কেস এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আর আগ্রহ দেখালো না । তারপরেও তারা জানালো যে তার খোজ খবর করতে থাকবে । আস্তে আস্তে সবার জীবন স্বাভাবিক হয়ে আসলো তবে মিতু ভেতরে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারলো ওর বাবা । মিতু আর সেই আগের মত হাসিখুশি নেই । কিছু একটা পরিবর্তন ঠিকই এসেছে ।
সেটা তিনি আরও পরিস্কার বুঝতে পারলেন একদিন । রাতে খাবার খেতে বসেছে সবাই । হঠাৎ মিতু সাফায়েত আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল
-বাবা তুমি অরিন নামের কোন মেয়েকে চিনো ?
সাফায়েত আহমেদ টুকটাক কথা বলছিলেন আর খাচ্ছিলেন । অরিন নাম টা শুনেই থমকে গেলেন । কয়েক মুহুর্ত কি বলবেন বুঝতেই পারলেন না । তারপর কোন মতে বললেন,
-অ-অরিন ! কত মেয়ের নামই তো অরিন !
মিতু শান্ত চোখে সাফায়েত আহমেদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর বলল
-তোমার সাথে চাকরি করতো । তোমার পিএ টাইপের কিছু ছিল ! মনে নেই !
মিতু ওর বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মিতুর দিকে । কি উত্তর দিবে সেটা বুঝতে পারছে না ! তারপরই চোখ সরিয়ে নিল । ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল
-হ্যা হ্যা মনে পড়েছে । আমার সাথেই চাকরি করতো ! তাই তুই খোজ পেলি কিভাবে !
মিতুর সেই প্রশ্নের জবাব দিল না । বলল
-অরিন আপু মারা গিয়েছে অনেক দিন । তুমি জানো ?
-হ্যা হ্যা একদিন শুনেছিলাম । আর খোজ নেওয়া হয় নি !
-কিভাবে মারা গিয়েছিলো জানো ?
সাফায়েত আহমেদ আবারও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন কিছু সময়ের জন্য । কিছুই যেন বুঝতে পারছে না । এতো দিনের পুরানো কথা তার সামনে এভাবে চলে আসবে তিনি ভাবতেও পারে নি । তিনি কোন মতে বললেন
-আসলে আমার ঠিক মনে নেই ! আমি …..
মিতু আবারও শান্ত কন্ঠে বলল
-সুইসাইড করেছিলো সে !
মিতুর মা এতো সময় চুপ করে দুজনের কথা শুনছিলো । মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল
-তুই কি সব বলছিস আমি বুঝতেছি না । কিসের সাথে কি ! অরিন নামের এই মেয়ে আসলো কিভাবে !
মিতু মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল
-তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস কর মা অরিন কে ! তাহলে আমাকে কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেটা বুঝতে পারবে !
-মানে !
মিতুর মা অবাক হয়ে একবার মেয়ের দিকে আরেকবার তার স্বামীর দিকে তাকালো । সে কিছুই বুঝতে পারছে না । মিতু আর কিছু না বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল । তার খুব বেশি কান্না আসছে । তার জীবনটা হঠাৎ ই একদম অলট পালট হয়ে গেছে । কোন দিন যে এমন কিছুর মুখোমুখি সে হবে সেটা ও ভাবতেও পারে নি !
রাত এখন অনেক বেশি । রাস্তার পাশের ফুটপাতে মিতু আর আবীর বসে আছে । মিতুদের বাসা থেকে একটু দুরে এসেছে ওরা । হাউজিং এলাকা বলে জায়গাটা একেবারে শান্ত হয়ে আছে । মাঝে মাঝে চৌকিদারের বাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে । এছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই । রাতে খাবারের টেবিল থেকে উঠে আসার পর বেশ কিছুটা সময় সে নিজের ঘরে শুয়ে ছিল । কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত করতে পারছিলো না । সে সত্যটা সে জেনেছিলো সেদিন সেটা কিছুতেি বিশ্বাস করতে পারছিলো না । কিন্তু ওর বাবার চেহারার দিকে তাকিয়ে মিতুর বুঝে গিয়েছিলো যে যা শুনেছি তার সব টুকু সত্যি !
নিজেকে কি ক্ষুদ্রই না মনে হচ্ছিল তখন !
সামনের মানুষটা তার বাবা এটা ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছিলো !
যেদিন ওকে কিডন্যাপ করা হয় সেদি অফিস থেকে একটু জলদিই বের হয় ও । ইচ্ছে ছিল বুসন্ধরার দিকে যাবে । কিন্তু মাঝ পথে জ্যামের কারনে রিক্সা নেমে যায় । হাটতে থাকে পান্থপথের দিকে । হঠাৎ ওর চোখ গেল পান্থ কুঞ্জের দিকে । এখান দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ও ওর চোখ এই পার্কটার দিকে যায় কিন্তু কখনও এর ভেতরে ঢোকা হয় নি । কি মনে করে করে ঢুকে পড়লো । একটা বেঞ্চে বসে পড়লো । ওর কাছে মনে হল যেন একেবারেই অন্য জগতে চলে এসেছে ও । কেমন একটা ছায়া শীতল পরিবেশ আর একটা শান্তি শান্তি ভাব রয়েছে ।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ কাধের কাছে একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো । গলার কাছে কাধে কেউ সুচ জাতীয় কিছু ফুটিয়েছে । ফিরে তাকাতেই একটা মানুষকে দেখতে পেল তবে তার আগেই ওর চোখ ঝাপছা হয়ে এসেছে । মাথাটাও ঘুরে উঠেছে । চেহারাটা ওর কেমন যেন পরিচিত মনে হল তবে ঝাপসা দৃষ্টির কারনে সে চিনতে পারলো না ।
কত সময় পরে মিতুর ঘুম ভেঙ্গেছিলো সেটা মিতু বলতে পারবে না । ঘম ভেঙ্গে নিজেকে আবিস্কার করে একটা অচেনা ঘরে । ও একটা খাটে শুয়ে আছে । নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারে ওর হাত এবং পা খাটের সাথে শক্ত করে বাঁধা । মুখে টেপ পেঁচানো । চাইলেও ও চিৎকার করতে পারবে না !
তীব্র একটা ভয় এসে ঝেকে বসলো ওর মাঝে । কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না ।
এমন সময় দরজা খুলে গেল । চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো একজন ঘরে ঢুকছে । ওর বুকের ভেতরের ধক করে উঠলো । এইবার ওকে কি করবে সেটা বুঝতে মিতুর কষ্ট হল না । চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো ভয়ে !
কিন্তু যখন মানুষটা সামনে এসে দাড়ালো তখন তীব্র একটা বিস্ময় পেয়ে বসলো ওকে ! ভয়ের বদলে কেবল অবাক বিস্ময় নিয়ে সে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো । জীবনে কোন দিন কল্পনাও করতে পারে নি যে এই মানুষটা এসবের পেছনে থাকতে পারে !
ওর সামনে আবীর দাড়িয়ে আছে !
পর্ব ছয়
মিতুর প্রথমে মনে হল ও এখনও ঘুমিয়ে আছে । ঘুমের ভেতরে এই স্বপ্ন দেখছে । নয়তো যা দেখছে সেটা মোটেও সত্য হওয়ার কথা নয় । সামনে দাড়ানো এই মানুষটা কোন ভাবেই তার ক্ষতি করতে পারে না কোন দিন । কিন্তু একটা সময় ও বিশ্বাস করতে বাধ্য হল যে যা দেখছে সেটা মোটেই কোন স্বপ্ন নয় । বরং জ্বলৎ জ্যান্ত বাস্তব সত্য ।
মিতু কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল । আবীরও ঠিক ওর দিকে তাকিয়ে ছিল । তারপর আবীরকে নড়তে দেখলো । ওর খাটের ডান দিয়ে এসে হাজির হল আবীর । সেদিকে চোখ যেতেই মিতু লক্ষ্য করলো সেখানে একটা ক্যামেরা স্টান্ড রয়েছে । তার উপর একটা ক্যামেরা সেট করা । আবীর ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-এখন তোমার সাথে কি করবো জানো ?
মিতু তাকিয়ে আছে কেবল ! আবীর বলল
-যা করবো এই ক্যামেরাতে সেটা ভিডিও করা হবে । তারপর সেটা পাঠানো হবে তোমার বাবার কাছে । তোমার বাবাকে এটা দেখানো হবে। তিনি বুঝতে পারবেন যে অপরাধ তিনি করেছিলেন, তার জন্য একজন বাবার মনে কি অনুভূতি হয়েছিলো ।
মিতু কোন কথা বলতে পারছিলো না । তার মনে তখন চিন্তার ঝড় চলছে । সে আসলে কিছুই বুঝতে পারছে না । ভয় যেটা ছিল সেটা চলে গেছে কিন্তু সেখানে এসে যুক্ত হয়েছে একটা তীব্র বিস্ময় ! আবীরকে সে এইভাবে কোন দিন আশা করে নি । বুঝতেও পারছে না তার সাথে এমন কেন করছে !
আর কিছু সময় পরেই আবীর ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো । মিতুর বাঁধা দেওয়ার কোন উপায় ছিল না । কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে । চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো । কয়েক মিনিট পরে আবীর থেমে গেল । মিতুর মনে হল আবীর আসলে যা করছে চাইছে সেটা ও করতে পারছে না । ওর পক্ষে মিতুর সম্ভ্রমহানি করা সম্ভব হচ্ছে না । আস্তে আস্তে সেই তীব্র হিংস্র ভাবটা শান্ত হয়ে এল । তারপর মিতুর উপর থেকে সরে দাড়ালো সে । খাটের পাশে বসে পড়লো মুখ ঢেকে । মিতু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো আবীর কাঁদছে ।
মিতুর নিজেকে ছাড়ানোর আরেকবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হল না । কিছু সে বলতেও পারছে না মুখে টেপ পেঁচনো থাকার কারনে । কতটা সময় এভাবে পার হল সেটা মিতু জানে না একটা সময় আবীর উঠে দাড়ালো । তারপর ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল । ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি যা করতে চেয়েছিলাম পারলাম না । তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো । পুলিশে খবর দিতে পারো তোমার সাথে যা যা হয়েছে সব কিছু সত্য সত্য বলে দিতে পারো । আমার কোন আপত্তি নেই !
মিতু তখন তাকিয়ে আছে আবীরের দিকে । এখনও বুঝতে পারছে না ওর সাথে এসব কেন করছে ও ! মিতু এখন আবীরকে ভয় পাওয়া উচিৎ কিন্তু ভয়ের বদলে মিতু তীব্র একটা কৌতুহল অনুভব করছে । মিতু বলল
-তুমি আমার সাথে এসব কেন করছো ?
আবীর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বলল
-কারন তোমার বাবাকে আমি খুন করতে যাচ্ছি । তার মারার আগে তাকে সেই কষ্ট টা দিতে চেয়েছি যা সে আমার বাবাকে দিয়েছে ! কিন্তু তোমার বাবার মত পশু হতে আমি পারলাম না ।
মিতু আবীরের চোখে আবার সেই
-তুমি কি বলছো এসব আবীর ? কি বলছো ?
মিতু বিস্ময়টা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠলো । ছোট বেলা থেকে সে তার বাবাকে দেখে এসেছে একজন ভাল মানুষ হিসাবে । এমন কি কারো সাথে বিন্দু মাত্র খারাপ ব্যবহার করতে সে দেখি নি । সবার সাথে কি অমায়িক ব্যবহারই করেন তিনি ! আর সামনে দাড়ানো মানুষটা কি বলছে সেটা বুঝতে পারছে না !
মিতু আবীর সামনে গিয়ে দাড়ালো তারপর ওর কাধ ঝাকিয়ে বলল
-তুমি কি বলছো এসব ? আমার বাবা কি এমন করেছে ?
আবীর বলল
-কি করেছে ? তোমার বাবা ? তোমার বাবাকে গিয়ে কেবল জিজ্ঞেস কর যে অরিন আহমেদ কে ? তার সাথে সে কি করেছে ? সে আর তার তার বন্ধু কল্যান ধর মিলে আমার বোনটার সাথে কি করেছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর !
কথাটা বলতে বলতে আবীর মাটিতে বসে পড়লো । মিতু অবাক হয়ে দেখতে পেল তার সামনে বসে পড়া ছেলেটা একটু আগে কি কঠিন ঘৃণা নিয়ে কথা বলছিলো এর এখন বাচ্চাদের মত কান্না শুরু করে দিয়েছে । অনেক দিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট যেন আবীরের কান্নায় বের হয়ে আসছে !
মিতু কোন কিছু না ভেবে আবীর পাশে বসলো । তারপর খুব নরম কন্ঠে বলল, কি হয়েছে আমাকে বল ! প্লিজ বল !
আবীর নিজেকে সামলে নিতে আরও কিছু সময় লাগলো । তারপর নিজের ভেতরের জমানো কথা গুলো বলতে শুরু করলো !
আবীরের সাথে ওর বোন অরিনের বয়সের পার্থক্য একটু বেশি ছিল । প্রায় ১৮ বছর । তাই বোনের থেকে সে আরিনের কাছ থেকে মায়ের ভালবাসা টুকুই বেশি পেয়েছে । সেই মায়ের মত বোন যখন একদিন হঠাৎ করে সুইসাইড করলো তখন আবীর ঠিক মত বুঝতেও পারছিলো না । কেবল বুঝতে পারছিলো যে তার বোন আর কোন দিন ফেরৎ আসবে না । এভাবে ওকে একা রেখে ওর বোন চলে গেল দেখে আবীরের অনেক বেশি অভিমান হয়েছিলো ।
কিন্তু আরও কয়েক বছর পরে বাসা বদলানোর সময় যখন আবীর ওর বোন অরিনের লেখা একটা ডায়েরি খুজে পেল তখন যেন ওর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো । তার বোন এমনি এমনি আত্মহত্যা করে নি । দুটো মানুষের জন্য সে এই পথ বেছে নিয়েছে
অরিন যে অফিসে চাকরি পেয়েছি সেই অফিসেই সাফায়েত আহমেদ আর কল্যান ধর চাকরি করতো । দুজনের জুনিয়র ছিল সে । প্রায় দিনেই অফিস থেকে বের হতে একটু দেরি হয়ে যেত । একদিন একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিলো । আর সেই দিনই সব থেকে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটলো । সাফায়েত আহমেদ আর কল্যান ধর দুজন মিলে অরিনকে অফিসের ভেতরেই ধর্ষন করে । অরিনের বাধা দেওয়ার কোন উপায়ই ছিল না । দুজনের সাথে সে কিছুতেই পেড়ে উঠতো না ।
কাজ শেষ করে তারা দুজনেই তাকে হুমকি দিল যে যদি এই কথা সে কাউকে বলে তাহলে সমাজে সে আর মুখ দেখাতে পারবে না । টারা দুজন মিলে এটা প্রমান করে দিবে যে সে নিজেই টাকার জন্য এসব করেছে তাদের জন্য !
অরিন কোন কথা না বলে বাসায় ফিরে এল । কাউকে কিছু বলল না । সে খুব ভাল করেই জানতো তারা যে হুমকি দিয়েছে সেটা প্রমান করতে তাদের কোন অসুবিধা হবে না । তার উপর দিকে তার কথায় বরং সমাজের কেউ বিশ্বাস করবে না । মেয়েদেরই দোষ – এমন একটা বিশ্বাস আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে ।
অরিন ওর বাবার মান সম্মানের কথা ভেবে চুপ করে গেল । তার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়টার কথা কাউকে বলল না । বলতে পারলো না । ভেবেছিলো হয়তো এখানেই শেষ হবে কিন্তু শেষ হল না । সেই একই ভয় দেখিয়ে দুজন আবারও তার শরীরটা ভোগ করলো । তারপর আবার ।
একটা সময় অরিন তার মাসিক মিস করে ফেলে । তারপর আর ওর বুঝতে বাকি ছিল না যে কি হতে চলেছে । ওর সামনে কিছুই করার ছিল না । এটা আর কোন ভাবেই লুকিয়ে রাখা সম্ভব না । তাই লোক লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য অরিন মৃত্যুর পথ বেছে নেয় ।
কথা গুলো সে কাউকে কোন দিন বলে নি । কেবল তার ডায়েরিতে লিখেছিলো । মানুষের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছিলো । কেবল নিজের সাথে কথা বলতো । আত্মহত্যা করার আগে ডায়েরিটা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলো কিন্তু কি মনে করে সেটা আর করে নি । পুরানো বই পত্রের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলো । বাসা বদল উপলক্ষে সেই বই পত্র ঘাটতে গিয়েই একদিন আবীর সেটা আবিস্কার করে ফেলে । তখন সে খুব বেশি বড় নয় । তবে সিদ্ধান্ত নেয় যে তার বোনের সাথে যে অন্যায়টা হয়েছে সেটার বদলা সে নিবেই ।
যার অর্ধেকটা সে নিয়েও ফেলেছে । কল্যান ধর নামের পশুটাকে সে হত্যা করেছে । যদিও কাজটা সে নিজে করতে পারে নি । লোক লাগিয়ে করিয়েছে । তাদেরকে বলেছিলো যেন তাকে যেন কষ্ট দিয়ে মারা হয় । খুনি সেই কাজটা করেছে ভাল ভাবেই । সেি ভিডিও তার আছে আছে । খুন টা চাপা দেওয়ার জন্য এক্সিডেন্টের নাটকও সাজিয়েছে খুব ভাল ভাবেই !
এবার বাকি কাজটা শেষ করার পালা । আবীর ভেবেছিলো সাফায়েত আহমেদকে হত্যা করার আগে তাকেও সেই কষ্ট দিতে চেয়েছিলো যা ওর বাবা পেয়েছে । অরিনের সাথে এমন কিছু হয়েছিলো সেটা আবীরের বাবা বুলবুল আহমেদ আগে থেকে জানতেন । যখন আবীর খুজে পাওয়া ডায়েরিটা তাকে দেখালো বুলবুল আহমেদ আমার মেয়েটা বলে চিৎকার করতে করতে হু হু করে কেঁদে উঠলো । সেদিনই আবীর ঠিক করে নিয়েছিলো প্রতিশোধ সে নিবেই ।
ঘটনা শুনে মিতু কেবল চুপ করে গেল । একটা কথা যেন মুখ দিয়ে বের হল না ওর । ওর পুরো পৃথিবীটা যেন নড়ে উঠেছে তখন । তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো । দরজার কাছে যেতেই আবীর পেছন থেকে বলল
-তুমি চাইলে আমার নাম পুলিশকে বলে দিতে পারো । আমার কোন আপত্তি নেই । তবে একটা কথা তুমি জেনে রাখো যে তোমার বাবাকে আমি মেরে ফেলবোই । আমি জেলে গেলেও সব কিছু ঠিক করেই যাবো । সে যেন কষ্ট পেয়ে মরে সেটা আমি নিশ্চিত করেই যাবো !
মিতু কথাটা যেন শুনেও শুনলো না । তার মাথার ভেতরে কেবল আবীরের বোনের কথা ঘুরছে ! তারপর বাসায় এসে বাবা যখন সাফায়েত আহমেদকে অরিনের কথা জিজ্ঞেস করলো তখনই বুঝতে পারলো যে আবীর যা বলেছে সব সত্যি । এতো দিনের বাবাকে বড় অচেনা মনে হল ওর । ও একজন ধর্ষক পিতার সন্তান এটা মনে হতেই তীব্র একটা ঘৃণা জন্মালো নিজের উপর !
তারপর আজকে রাতে ফোন দিয়ে আবীরকে ডেকে আনলো । আবীর মিতুর ফোন পেয়ে খানিকটা অবাকই হয়েছিলো । ভেবেছিলো হয়তো পুলিশকে সব কিছু বলে দেবে সে । কিন্তু সেটা কিছুই বলে নি সে ।
মিটু হঠাৎ বলল
-তুমি বরং যে কাজটা করতে গিয়েছিলো সেটাই আমার সাথে কর !
আবীর আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল । মিতুর কথায় ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-কি বললে ?
-বললাম যে কাজটা করতে গিয়েছিলে আমার সাথে সেটাই বরং করে ফেলো ।
-ওটা আমি করতে পারবো না ।
-কেন ? প্রতিশোধ নিবে না ?
-সেটা আমি নিবোই । তবে …..
-তবে কি ? আমি তো তারই মেনে যে তোমার বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ি ?
-হ্যা তার মেয়ে । সে তো নও ! আর যদি এই কাজটা করি তাহলে তোমার বাবা আর আমার ভেতরে পার্থক্য থাকলো কোথায় বল ?
মিতু কি বললে কোন কথা খুজে পেল না । চুপ করে রইলো আবার । আবীর বলল
-আর তাছাড়া …..
-তাছাড়া ?
আবীর এবার মিতুর দিকে সরাসরি তাকালো । তারপর বলল
-আমি সম্ভবত তোমাকে ভালবাসি । আমি চাইলেও এটা করতে পারবো না !
মিতু কিছু বলতে যাবে তখনই ওর বাসার থেকে একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেল সে ।
সাফায়েত আহমেদ আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছেন । তিনি জানতেন এমন একটা দিনের মুখোমুখি তাকে হতে হবে । আজকে নিজের মেয়ের চোখে সে যে ঘৃণা দেখতে পেয়েছেন তিনি জানতেন এটা তিনি একদিন দেখবেন । উপরওয়ালার কাছে দোয়া করতেন যে এই দেখা হওয়ার আগেই যেন তার মৃত্যু হয় । তিনি জানতেন এই কঠিন পরিস্থিতির সাথে তার দেখা হবে !
আজকের পর থেকে আর কোন দিন নিজের মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সে পারবে না । তার সেই শক্তি নেই । অতীতে সে যে অন্যায় করেছে তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে ! অরিন যেদিন আত্মহত্যা করলো, অরিনদের বাসায় তিনি গিয়েছিলো । তার ছোট ভাইটার আহাযারি সেদিন সে দেখেছিলো । সেদিন সে বুঝেছিলো সে কত বড় অন্যায় করেছে । কিন্তু বড় দেরি করে সেটা সে বুঝতে পেরেছে । এখন তার বুঝতে পারাতে কারো কোন লাভ হচ্ছে না ।
ঐঘটনার পরে পুলিশের কাছে যেতে চেয়েছিলেন । অরিনের এই মৃত্যুর জন্য সে যে দায়ী এটা পুলিশকে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেন তার বন্ধু কল্যান ধরের জন্য । সে তাকে বুঝিয়ে ফেলেছিলো এখন এসব ভাবার সময় নয় । যা ভুল হয়ে গিয়েছে গ্যাসে । সামনে আর এসব কাজ করবেন না এই প্রতিজ্ঞা করে এগিয়ে যেতে হবে । আর তাছা ঘরে তার এখন মেয়ে আছে । যদি পুলিশের কাছে যায় তাহলে সব কিছু মানুষ জেনে যাবে । তখন তার বউ আর মেয়ের কি অবস্থা হবে ! এই কথা শুনে সেদিন সাফায়েত আহমেদ কিছু করতে পারেন নি ।
কিন্তু আজকে মিতুর দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন তার মেয়ে আর তাকে কোন দিন আর আগের মত দেখতে পারবে না । কোন দিন আর সেই বাবা মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠবে না তাদের মাঝে । তিনি প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলেছিলেন যে হয়তো মিতু কোন দিন জানতে পারবে না । কোন দিন তার দেখা হবে না সেই পাপী সাফায়েত আহমেদের সাথে ! কিন্তু দেখা হয়ে গেছে ।
সাফায়েত আহমেদ পিস্তলটা সেফটি ক্যাঁচ খুললেন । তারপর ধীরে সুস্থে পিস্তলের নলটা নিজের মুখের ভেতরে নিলেন । চোখ বন্ধ বন্ধ করে মিতুর চেহারাটা একটু ভাবার চেষ্টা করলেন । মনে মনে বললেন, মিতু মা রে আমাকে তুই মাফ করে দিস !
পরিশিষ্টঃ
পুলিশ আসতে আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগলো । তারা এসে মিতুর বাবা লাশ নিয়ে গেল । মিতুর মা ক্ষণে ক্ষণে কান্না করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন । তবে মিতু শান্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । আবীর তার পাশেই বসে আছে অনেকটা সময় ধরে । ঘটনাটা এই দিকে যাবে সে এটা ভাবতে পারে নি । বাসা ভর্তি লোকজন । মিতু একটু নিরিবিলি থাকতে চেয়েছিলো । তাই আবীরকে নিয়ে ছাদে উঠে এসেছে । ছাদের কার্নিশে বসে আছে দুজন চুপ করে !
মিতু হঠাৎ বলল
-ভালই হয়েছে ! আমি হয়তো তার সামনে কোন দিন আর যেতেই পারতাম না।
আবীর কিছু বলল না । মিতু বলল
-তবে আমি যদি সত্যটা না জানতে পারতাম তাহলে সম্ভবত আরও ভাল হত ।
আবীর মৃদু স্বরে বলল
-হয়তো !
-তারপর তোমার প্রতিশোধ তো শেষ । এখন চলে যাবে ?
-হ্যা । অমেক দিন থেকে আমার কাগজ পত্র ঠিক হয়ে আছে ।
-আর দেখা হবে না তাহলে ! আমাদের এক সাথে যাত্রা এই পর্যন্ত ছিল !
অনেক টা সময় কেউ আর কোন কথা বলল না । তাদের দুজনের গল্প হয়তো এখানেই শেষ অথবা হয়তো আবারও কোথাও তাদের দেখা হবে যাবে । আবারও হয়তো নতুন কোন গল্পের সূচনা হবে !