ছেড়ে যাওয়ার গল্প

oputanvir
4.8
(83)

এক
-এই দেখো তোমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছি ।
আমার কথা শুনেও নীলুর মুখের কোন ভাব পরিবর্তন হল না । গম্ভীর মুখ গম্ভীরই রইলো ।
আমি আবার বললাম, আরে দেখো ! বেলী ফুল । তোমার পছন্দের ফুল । জনো অফিস থেকে আসছিলাম তখন দেখি একটা পিচ্চি এই ফুল গুলো বিক্রি করছে । বেলী ফুল কেউ এই খোলা বিক্রি করে বল ?
নীলুর মুখের ভাব তবুও পরিবর্তন হল না । এই মেয়েটা হঠাৎ করে এমন গম্ভীর হয়ে উঠল কেন?
একটা সময় ছিল বাসায় আসার সময় ওর জন্য কিছু না আনলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো । পিচ্চি মেয়েরা বাবা মার কাছে কিছু আবদার করে না পেয়ে যেমন মুখ করে থাকে ঠিক তেমন ভাবে বসে থাকতো । তখন নীলুর চেহরার একটা আলাদা ভাব থাকতো । একটু অভিমান একটু দুষ্টামী ! আমার দেখতে মজাই লাহতো ।
তবুও আমি প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আসতাম ।

নীলু সব থেকে বেশি খুশী হত ফুল নিয়ে এলে । আর বেলী ফুল নিয়ে এলে তো কথাই নাই ।
কিন্তু এই এখনকার গাম্ভীর্যের কাছে সব কিছু কেমন যেন অন্য রকম লাগছে । কিছুতেই সেই পুরানো নীলুকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
আমি নীলুর হাত ধরতে গেলাম । কিন্তু ও ধরতে দি্লো না ।
-কি হল এমন কেন করছো ?
হঠাৎই লীনুর চেহারায় কেমন একটা রাগের ভাব দেখতে পেলাম । বেশ কর্কশ গলায় বলল
-জানো না আমি এমন কেন করছি ?
আমি চুপ করে যাই । আসলে আমি জানি নীলুর রাগের কারনটা কি ?
আমি আর কিছু বললাম না । সত্যি বলতে কি আমি আর কিছু বলতে পারলাম না ।
অফিসের কাপড় ছাড়ার জন্য শোবার ঘরের দিকে যাবো ঠিক এমন সময় নীলু পেছন থেকে বলে উঠল, আমি আর তোমার সাথে থাকবো না !
গত কালকেই নীলু কথাটা বলেছিল ! রাতের খাবার সময় ! আমি প্রথমে ভেবেছিলাম একটু রাগ থেকে কথাটা বলছে কিন্ত ওর মুখ দেখে মনে হল ও বেশ সিরিয়াস !
গত কালকে অনেক বুঝিয়েছি । বলেছিলাম এই রকম হুট হাট করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না । আর বিয়ে টা তো কোন প্রাইড থেকে কেনা শাড়ি না যে ইচ্ছে হল আর বদলে ফেললাম । ঘুমনোর সময় ভেবেছিলাম হয়তো আর বলবে না এই কথাটা কিন্তু নীলুর মন থেকে কথাটা যাই নাই ।
আমি বললাম, দেখো কাল রাতেই আমরা এই নিয়ে কথা বলেছি । আর কয়টা দিন অপেক্ষা করি আমরা । এখনই তো …..।
নীলু খুব শান্ত কন্ঠে বলল
-আমি তোমার ঘর করবো না ! যতদিনই হোক তোমার দ্বারা ….।
নীলু কথাটা শেষ করলো না !
আমি বললাম
-চুপ করলে কেন ? শেষ কর লাইন টা ?
নীলু আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল
-আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি । ভালই ভালই যদি আমাকে ডিভোর্স দেও তাহলে তো কোন সমস্যা নাই কিন্তু যদি আমাকে কোর্টে যেতে হয় তাহলে কিন্তু আমার মুখ বন্ধ থাকবে না । তোমার অক্ষমতার কথা আমি সবাইকে জানিয়ে দেব ।
-নীলু ! প্লিজ ! এতো তাড়াহুড়া কর না । একটু …….
নীলু আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম । বলল
-দেখ সুমন ! আমি কোন ইমপোটেন্টের ঘর করবো না । আমি মা হতে চাই ! বুঝছো তুমি ? মা ডাক শুনতে চাই কিন্তু তুমি আমাকে সেই জিনিস দিতে পারবে না । ঠিক আছে ?
আমি নীলুর কথাটা শুনে একেবারে চুপসে গেলাম । এতো বড় একটা কথা নীলু কিভাবে বলল ?
প্রায় দুই বছর ধরে ওর সাথে আছি । আর কদিন পরেই আমার দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী । এবার ভেবেছিলাম ওকে নিয়ে কাঠমান্ডু যাবো । সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম কিন্তু মাঝ খান দিয়ে এই ঝামেলা ।

প্রথম বছর থেকেই নীলু খানিকটা অস্থির হয়ে উঠছিল বাচ্চা নেওয়ার জন্য ! আমিই ওকে একটু মানা করছিলাম ।
আরে এতো জলদি বাচ্চা নিয়ে কি হবে ? সবে তো মাত্র আমাদের বিয়ে হল ? একটু আমরা সাথে থাকি ?
নীলু গাল ফুলিয়ে বলত
-একটা বাবু থাকলে কি আমাদের এক সাথে থাকা বন্ধ হয়ে যাবে । তখন আমাদের সংসারটা আরো কত সুন্দর হবে না বল ?
-আচ্ছা ঠিক আছে ! সামনের বছর ! ওকে ?
নীলু না হু না হু করলেো রাজি হয়েছিল !
দিন আসলেই খুব ভাল যাচ্ছিল আমাদের । বলতে গেলে একেবারে পার্ফেক্ট কাপোল ছিলাম ! আমরা যেন দুজনই দুজনকে বুঝতাম । আমি কখন কি চাই নীলু ঠিক বুঝে ফেলতো ! আবার ওর চাহিদা গুলোও আমি বুঝে নিতাম সহজে !
কিন্তু এই আজকের নীলুকে কেমন জানি খুব অচেনা লাগছে !
এতো বেশি অচেনা !

নীলু ব্যাগ নিয়ে বের হয়েই গেল । আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন ! নীলু যাবে বলেছিল কিন্তু এতো জলদি যাবে ভাবতে পারি নি । দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কেবল বলে গেল যেন আমি ওর সাথে যেন কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি !

আমি কেবল বসে রইলাম কিছুক্ষন চুপ করে ! একবার মনে হল কাজটা কি ঠিক হল ?
নীলু কি কাজটা ঠিক করলো ?
এই ভাবে আমাকে একা ফেলে চলে গেল কেন ? এই ছিল ওর ভালবাসা ?

ভালবাসা ?
আমাদের বিয়েটা কি ভালবেসে হয়েছিল ?
কে জানে ?
আমার এখনও সেদিনের কথা ঠিক মনে পড়ে । বাসার গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো এমন সময় একটা আকাশী রংয়ের শাড়ি পরা মেয়ে হঠাৎ আমাকে বলল
-বিশটা টাকা দিন তো ?
-জি ?
আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটা কি বলছে ? ২০ টাকা দিয়ে কি হবে ?
আর সব চেয়ে বড় কথা এই ভাবে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কোন মেয়ে এভাবে টাকা চাইতে পারে আমার ধারনার বাইরে ছিল !
আমি মেয়েটিকে বললাম
-কি বললেন ? বিশ টাকা ?
মেয়েটি একটু মিষ্টি হেসে বলল
-জি বিশ টাকা । রিক্সা ভাড়া দিতে হবে । রিক্সাওয়ালা দাড়িয়ে আছে । আমার কাছে ভাংতি নাই ! আপনি তো এই বিল্ডিংয়েই থাকেন তাই না ?
-জি !
-কয় তলায় ?
-ছয় তলা !
-আচ্ছা ! আমি দিয়ে আসবো !
আমি মানিব্যাগ খুলে টাকা দিলাম ! মেয়েটা টাকা নিয়ে চলে গেল । রিক্সাওয়ালা কোথায় দাড়িয়ে আছে কে জানে ?
আর একটু সময় অপেক্ষা করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু দাড়ানোটা কেমন একটা অশোভন মনে হল ! আমি ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম ।
মেয়েটাকে নতুন মনে হল ! এই বাসাতে প্রায় দুই বছর আছি মেয়েটাকে একবারও দেখি নি ! নতুন এসেছে মনে হয় !
মেয়েটার নামও তো জানি না !
কয়তলাট থাকে তাও জানা হল না !
যাক আবার নিশ্চই আসবে !
তখন জেনে নিবো !
কিন্তু মেয়েটি আর এল না ! একবার মনে হল বিশ টাকা গলে গেল মনে হয় ! কিন্তু বিশ টাকা হারানোর থেকে মেয়েটার সাথে আর একবার দেখা হল না এই দুঃখ আমাকে বেশি দুঃখিত করছিল !
প্রায় একমাস পরে মেয়েটির সাথে আবার আমার দেখা ! অফিস থেকে ফিরছিলাম । মেয়েটির রিক্সা আর আমার রিক্সা পাশাপাশি চলে এল ?
মেয়েটি প্রথমে আমাকে দেখ নি । আমিই কথা বললাম !
-আরে আপনি ?
প্রথমে আমাকে চিনতে না পরলেও একটু পরেই আমাকে চিনে ফেলল
-আরে আপনি ? এই খানে ?
-বাসায় যাচ্ছি !
-আমিও তো বাসায় যাচ্ছি !
-আজকে রিক্সা ভাড়া আছে মানে আজকে টাকা ভাংতি আছে তো ? আমার কাছে কিন্তু অনেক ভাংতি আছে ! লাগলে বলবনে ! কেমন ?
মেয়েটি হেসে ফেলল !
আমি বললাম
-আপনি আমাদের বাসায় ঐ বাসাটাতে থাকেন না তাই না ?
একটু হেসে মেয়েটি আবার বলল
-জি ! ঐ দিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বাজি ধরেছিলাম যে পথে যাকে পাবো তার কাছে থেকে টাকা নিবো ! এমনি মজা !
-আচ্ছা !
-আপনার ২০ টাকা আমি ফেরৎ দিয়ে দিচ্ছি !
-না ! না ! ঠিক আছে ! কোন দরকার নাই ! আপনার নাম টা জানতে পারি ?
-আমি নীলু ! আপনি ?
আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় সিগলাম ছেড়ে দিল ! আমি মোটামুটি চিৎকার করেই বললাম নিজের নাম টা !
ভেবছিলাম হয়তো এটাই নীলুর সাথে আমার শেষ দেখা ! কিন্তু আমাদের আবার দেখা হল !!

রাতে ঘুমুবার আগে নীলুর বড় দুলা ভাই ফোন দিল ! কোন ভুমিকা না করেই আমাকে কেবল বলল
-আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম কাজটা তুমি ঠিক করছো না ! এখন ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না !
দুলাভাই সব সময় খুব রসিক মানুষ ! সাবার সাথেই হাসি ঠাট্টা করেন ! পেশায় ডাক্তার । কিন্তু আজকে তার কন্ঠস্বর আসলেই খুব গম্ভীর শোনাচ্ছিল !
কি রে ভাই সবাই এমন গম্ভীর হয়ে গেলে কিভাবে হবে !
বলতে গেলে নীলুর এই বড় দুলাভাইয়ের জন্যই আবার আমার সাথে নীলু দেখা হয়েছিল । মোটামুটি আমাদের বিয়ের ঘটকালীও তিনিই করেছিলেন !
আমি বললাম
-ভাইয়া থাক ! ও রাগ হয়েছে ! চলে আসবে !
-শুনো সুমন মিয়া বেশি ভাল মানুষী ভাল না ! আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম ! এখনও বলছি !
-আচ্ছা ভাইয়া ! আপনি মাথা ঠান্ডা করুন ! আমি নিজেই বলবো ওকে ! সব ঠিক হয়ে যাবে !
যদিও বললাম সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আমি নিজেও খানিকটা কনফিউজ যে সব কিভাবে ঠিক হবে ? নীলুকে কিভাবে বলবো !

পরের এক সপ্তাহ আমার দিন খুব খারাপ গেল ! কোন কিছুই ভাল লাগে না । আসলে এই দুই বছরে প্রতিটা দিন নীলুর মুখ দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে । যখনই চোখ মেলে তাকিয়েছি তখনই নীলুকে দেখেছি ! কিন্তু এই সপ্তাহ টা ওকে একটা বারও দেখতে পাই নি ! এমন কি আমার ফোন পর্যন্ত ও ধরে নাই ।
শ্বশুর মশাইকে ফোন দিলাম ! দেখি উনিও ধরে না ! একবার ওদের বাসার গেলাম । নীলু সামনেই এল না । অনেকক্ষন বসে থেকের পর শ্বশুর মশাই নিজেই এল হাতে একটা কাগজ নিয়ে ! আমার দিকে এগিয়ে বলল
-এটা নাও বাবা !
-কি এটা ?
কিছুক্ষন ইতস্তত করেলেন । আসলে ঠিক বলতে পারছেন না । আমি বুঝে গেলাম এর ভিতরে কি আছে । আমি বললাম
-ডিভোর্স পেপার ?
আমার মুখ থেকে কথাটা শুনে যেন একটু হালকা হলেন । কোন রকমে বললেন
-আসলে আমরা কিছুই জানি না । ওর এক বন্ধু আছে এডভোকেট । তার কাছ থেকেই নাকি ও মেনেজ করেছে । ও চাচ্ছে কোন ঝামেলা ছাড়াই যেন সব কিছু হয়ে যায় !
আমি শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম
-আপনি কি চান ? আমার মেয়ের কার্যকলাপে আপনার সমর্থন আছে ?
এই কথার জবাবেও দেখি তার অস্বস্থি হচ্ছে । বলল
-আসলে জীবনটা তো ওর । ওর উপর তো আমরা কোন কথা চাপিয়ে দিতে পারি না ।
-হুম ! ঠিক আছে । আমি কিছু বলছি না । কিন্তু এই কথা গুলো মনে রেখেন আব্বা !
আমি আর দাড়ালাম না ! আমার কাছে মনে হয়েছিল নীলু আমার কাছে ঠিক ফিরে আসবে ! এতো দিনের চেনা আমি কে এই ভাবে হঠাৎ করেই অচেনা করে দিবে না ! কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম কেবল নীলুই না ওর পরিবারের সবারই মনভাব আমার বিপক্ষে ! যেন আমি গেলেই ওরা সবাই বাঁচে !

অফিস থেকে ছুটি নিলাম এক মাসের ! ঢাকা শহরে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না । মোবাইল ফোনটাও বন্ধ করে রাখলাম ! কারো সাথে যোগাযোগ রাখতেও ইচ্ছা করছে না আর । আসলেই রাখতে ইচ্ছা করছে না ।
এতো দিনের পরিচিত মানুষটা যখন অপরিচিত হয়ে গেল তখন কি লাভ এই সম্পর্ক রেখে ?
আসলেই মানুষ কে চেনা বড় দায় !
কে যে কখন কি কারনে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি বুঝতেও পারবে না ! কোন মানুষই পার্ফেক্ট না ! দোষ ত্রুটি সবার ভিতর থাকে ! তাই বলে কি এই ভাবে মাঝ পথে একজন কে ছেড়ে চলে যেতে হবে ?
সবাই কি তাই যায় ?
কিন্তু আমি তো ছেড়ে যাই নি ! নীলুর ভিতর ত্রুটি ছিল সেটা জানার পরেও তো আমি ওকে ছেড়ে যাই নি ।
যখন অনেক চেষ্টার পরেও কোন লাভ হচ্ছিল না তখন বাধ্য হয়েই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম টেষ্টের জন্য । সমস্যা টা কোথায় ?
নীলুর বড় দুলাভাই ই সব কিছু দেখছিল ।
রিপোর্টে যখন ধরা পরলো যে নীলুর মা হওয়ার ক্ষমতা নাই তখন তো আমি ওকে ছেড়ে যাই নি । বরং দুলাভাই কে বলেছিলাম ব্যাপার টা চেপে যেতে । আসলে আমার বউ কে কেউ আঙ্গুল তুলে কিছু বলবে সেটা আমার সহ্য হচ্ছিল না ।
সব দোষ নিজের ঘারে নিয়ে নিলাম । দুলাভাইকে অনুরোধ করে বললাম এমন করে রিপোর্ট বানাতে যেন নীলুর মনে কষ্ট না লাগে !
ও যেন নিজেকে ছোট না ভাবে !
কিন্তু ! ও এই রকম ভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে পারি নাই । আসলেই ভাবতে পারি নি । আসলেই মানুষ চেনা বড় দায় !

দুই

আমি আমার গল্প বলে চুপ করে রইলাম কিছুক্ষন ! সূর্যটা প্রায় ডুবে গেছে ! সাথে সাথে একটু যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের পরিমান টা বেড়েছে ! আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম ! কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে ! মনে হচ্ছে দুরের ঐ সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপ দেই ! যদিও চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলাম পরক্ষনেই !
-কি ঝাঁপ দতে ইচ্ছে করছে !
আমি তাকিয়ে রইলাম তানজিনার দিকে । মেয়েটার সাথে পরিচয় এই দুদিন মাত্র ! কিন্তু কেমন কেমন করে যেন মেয়েটা সব কিছু বুঝে যায় !
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-মরতে চাইলে তো বাসাই মরতে পারতাম এতো দুর আসার তো দরকার ছিল না !
তানজিনা খানিকটা মাথা নেড়ে এমন একটা ভঙ্গি করলো যেন আমি খুব গুরুত্বপুর্ন কিছু একটা বলেছি এবং সে সেটার উপর গভীর চিন্তা ভাবনা করছে ।
এই মেয়েটা একটু অন্য রকম কি ?
মনে হয় । নতুবা একটা মেয়ে একা একা এতো দুর মানে এই সেন্টমার্টনে চলে আসতে পারে না ! এখানে আসতে যে কোন মেয়ের পক্ষ্যেই একা আসাটা খানিকটা বেমানান !

সি-ট্রাকেই তানজিনাকে দেখি আমি ! আমার থেকে কয়েক সিট দুরে বসে ছিল ! কালো জিন্স সাথে কালো টি-শার্ট ! চোখে কালো সান গ্লাস ! কালো পরেছিল বলেই মনে হয় তাকে সবার চোখে পড়ছিল বারবার এবং মেয়েটা এটে খুব বেশি কেয়ার করছিল বলে মনে হয় না !

ঐ দিন বিকেল বেলা সেন্সমার্টিনের সি- বীচে মেয়েটাকে আবার দেখতে পেলাম ! সেই সময় মেয়েটা পরেছিল পুরোপুরি সাদা ! সকাল বেলা কালো তে এবং বিকেল বেলা সাদাতে মেয়েটা দেখে কেমন অন্য রকম লাগলো ! আমি কৌতুহল নিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম !

যতটা মুডি ভেবেছিলাম ততটা দেখলাম না ! আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা শুরু করলো ! টুকটাক কথা দিয়ে শুরু হল কথা । জানতে পারলাম সপ্তাহ খানেক থাকার প্লান তার । আমারও তেমনই পরিকল্পনা !

আজকে দুদিন পরে তানজিনাকে আমার জীবনের গল্পটাও বলে ফেললাম ! নীলু আমাকে ছেড়ে গেছে সেই গল্প ! তানজিনা কিছুক্ষন চুপ করে শোনার পর বলল
-আপনি মানুষটা আসলেই একটু বেকুব ধরনের আছেন !
-মানে ?
-মানে কি বুঝেন না ! এমন বোকামী কেউ করে ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না ! তানজিনা বলল
-আপনার বউকে কষে একটা থাপ্পড় দিতেন তাহলে এটা হত না ! আর আপনি কি করলেন ঘর বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হলেন ! আজিব !
-আচ্ছা ! আমি বোকা ! তা আপনি কি শুনি ?
তানজিনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি আবার কি করলাম ?
-আপনিও তো দেশান্তরী হয়েছেন !
-কে বলল আপনাকে ?
-বলতে হবে কেন ? আমি তো দেখতেই পাচ্ছি ! কোন মেয়ে একা একা এতো দুর আসে না ! নিশ্চই আমার মত আপনারও কোন একটা ঘটনা আছে !
-ঘোড়ার ডিম ! আপনার সাথে আসলে কথা বলাটাই ভুল হয়ে গেছে !

দেখতে দেখতে তানজিনা রেগে উঠলো ! আমার পাশ ছেড়ে উঠে চলে গেল ! আমি খানিকটা নিশ্চিত হলাম যে মেয়েটারও আমার মতই কোন না কোন সমস্যা আছে ! তা না হলে রাগতোই না !

আমি ঐ জায়গাতেই বসে ছিলাম ! রুমে গিয়ে কোন কাজ নেই এর থেকে সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকি বেশ রাত পর্যন্ত ! অবশ্য খুব বেশি রাত করার উপায় নেই ! রাত দশটার পর মোটামুটি দোকান পাট সব বন্ধ হতে থাকে ! কারন এগারোটা রপরেই একালার জেনারেটর সার্ভিজ বন্ধ হয়ে যায় ! তার আগেই অবশ্য অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে ! আমিও দশটার দিকে বাজারে যাই একবারে খাওয়া দাওয়া সেরে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি !

দেখলাম আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পরেই আবার তানজিনা এসে হাজির ! আমার পাশে বসতে বসতে বলল
-রুমে বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছি ! তার আবার এলাম !
-হুম !
-আপনি রাগ করেছেন ?
-কেন রাগ কেন করবো ? রাগ তো আপনি করে উঠে চলে গেলেন !
-আমি সরি !
-ওকে ! সরি হওয়ার কিছু নেই !
কিছুক্ষন নিরবতা ! তারপর তানজিনা নিজেই বলল
-আসলে আপনার ধারনা ঠিক !
-আমি জানি !
-আমি আমার হাজবেন্ড কে নিয়ে কিছু টেনশনে আছি ! আরও ভাল করে বললে আমিও তাকে ছেড়ে আসার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ! কঠিন সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্যই আমি এখানে এসেছি !
-ভাল ! তা বলা যায় কি সমস্যা ?
-হুম !
আবারও কিছুটা সময় নিরবতা ! তারপর তানজিনা বলল
-আসলে আমাদের বিয়েটা ছিল পারিবারিক ভাবে ! বিয়ের কদিন পরে জানতে পারি জনির আগের একটা প্রেমিকা ছিল । এবং এখনও সে তাকেই ভালবাসে ! ভেবেছিলাম এরকম সবার অতীত থাকে । সব কিছু ভুলে হয়তো সে নতুন করে সংসার করবে ! কিন্তু বিয়ের তিন বছরেরও কিছুই হল না !
-এখনও তার সাথে যোগাযোগ আছে ?
-কেবল যোগাযোগ ? আরও কত কিছু ! এবং এখন ব্যাপার টা লুকোচুরি নয় ! আমি যে জানি সেটা সে কেয়ারই করে না !
আমি কোন কথা না বলে চুপ করে রইলাম ! তানজিনা আবার বলল
-আসলে আমি আর নিতে পারতেছি না ! আসার সময় একটা চিঠি লিখে এসেছে ! বলে এসেছি কাগজ পত্র রেডি করতে ! ফিরে গিয়ে বাকি কাজটা করবো !
-হুম ! ভাল !
-ভাল ?
-ভাল না ? বারবার কষ্ট পাওয়ার থেকে একবারে কষ্ট পাওয়া ভাল !

এভাবে দেখতে দেখতে তানজিনার সাথে আরও সাতদিন থাকলাম সেন্টমার্টিনে ! বলতে গেলে সময়টা বেশ কাটলো ! আমরা প্রায় সারাদিনই একসাথে থাকতাম ! সারাদিনই প্রায় সমুদ্রের পাড়ে । ছুটে আসা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর নিজেদের জীবনের ছোট ছোট কথা গুলো শেয়ার কতাম !
ও সাতদিন পরে চলে গেল ! আমি রয়ে গেলাম আরও কয়েকদিন থাকবো বলে ! কিন্তু দুদিন পরেই আমার ভাল লাগলো না ! আসলে একাকিত্ব আমার কখনই ভাল লাগে নি ! এখানে তানজিনার সাথে সময় বেশ কেটেছে ! নীলুর কথা একদমই মনে পড়ে নি ! দুদিন পরেই আমিও উঠে পড়লাম সি-ট্রাকে !

ঢাকায় এসে আমার জন্য যেন অন্য রকম কিছু অপেক্ষা করছিল ! বাসায় যেদিন ফিরে গেলেন সেদিনই কোথা থেকে খবর পেয়ে নীলু আর আর ওর বাবা মা এসে হাজির ! আমি ভেবেছিলাম ওরা আসবে তবে এতো জলদি আসবে ভাবি নি !

দরজা খুলে দিতেই দেখি ওরা দাড়িয়ে ! আমি দরজা থেকে সরে দাড়িয়ে ঘরে ঢুকতে দিলাম !
নীলু কিছু না বলে কেবল চুপ করে দাড়িয়ে রইলো ! নীলুর বাবা আমার হাত ধরে বললেন
-দেখো বাবা, কিছু একটা ভুল হয়েছে ! আমার মেয়েটা সব সময় একটু এমন । হুট হাট করে সব কিছু করে ফেলে !
আমি কিছু না বলে দাড়িয়ে আছি !
-কিছু একটা বল !
-কি বলব আমি ?
-তুমি ওর উপর রাগ রেখও না !
-নাতো ! রাগ কেন রাগবো ? কিন্তু ….
-কিন্তু কি ?
-কিন্তু আপনার মেয়ে তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে ! এবং সেটা মনে কার্যকরও হয়ে গেছে । তাই না ! সবার উপর কথা হল এতে আপনার সমর্থনও ছিল ! ছিল না ?
নীলুর বাবা আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন ! আমি বললাম
-সেদিন আমি কি বলেছিলাম আপনাকে মনে আছে ? বলছিলাম ঐ দিনটার কথা মনে রাখতে ! আপনার মেয়ে আমার সাথে ঘর করতে চায় নি, আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি বিনিময়ে সে আমাকে রেখে চলে গেছে, আমার সাথে কোন প্রকার কথা না বলেই আমাকে নোটিশ পাঠিয়েছে ! সব কিছুই সে করলো আমি তো কিছুই করি নি !
-আমরা মানছি ! ভুল টা আমাদের ছিল !
-ভুল যেমন আপনাদের মেয়ে ছিল তেমনি ভুলের মাসুল টাও তাকেই দিতে হবে ! তাই না ? আপনারা আসুন এবার ! আমি ঘুমাবো !

নীলু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না আমার কথা গুলো ! আমারও প্রথমে মনে কি করছি আমি ? সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করি সব কিছু । কিন্তু পরক্ষনেই সেই সেদিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেল ! হঠাৎ রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম ! নীলুর প্রতি ভালবসা টুকুর চেয়ে সেই রাগ আর অভিমানের পরিমান টা অনেক অনেক বড় !
রাতে দুলাভাই ফোন দিলেন ! বললেন যে তিনি সব কিছু ওদের কে বলেছেন ! এবং আমার আজকের অবস্থান সম্পর্কেও তিনি জানেন ! বললেন
-দেখো আমি তোমাকে কিছু বলবো না তবে আরেকবার কি ভেবে দেখবে ?
-ভাইয়া কিভাবে দেখবো বলেন ? এই কদিনে আমি কি পরিমান মানষিক কষ্টে ছিলাম আপনাক আমি বলে বোঝাতে পারবো না ! যতবার ই আমি আরেকবার ভাবা রকথা চিন্তা করি তটবারই নীলুর সেই নিষ্ঠুর ভাবে চলে যাওয়ার কথা মনে যায় ! সারা জীবনে আমি কোন দিন এটা ভুলতে পারবো কি না জানি না !

পরদিন নিজের কেবিনে কাজ করছিলাম । এমন সময় তানজিনা এসে হাজির ! রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল
-বাহ ! কাজে লেগে গেছেন দেখছি !
-হুম ! কি করবো ?
-আপনার না আরও কদিন পরে আসার কথা ছিল ?
-হুম ! ছিল ! আসলে আপনি চলে এসেছেন দেখে একা একা ভাল লাগছিলা না আর !
-তাই ?
তানজিনা আমার দিকে তাকয়ে অদ্ভু্ত ভাবে হাসলো !
-আপনার কি খবর ?
-হুম ! খবর ভাল ! নিজেকে খানিকটা মুক্ত মুক্ত লাগছে !

আমি কিছু বলতে যাবো দেখি নীলু আমার কেবিনে এসে হাজির ! আামাকে আর তানজিনা কে দেখে কি করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না ! আমি নিজেও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ! তবে সামলে নিলাম । খানিকটা কঠিন কন্ঠেই বললাম
-কি দরকার ?
-সুমন ? প্লিজ আমার একটা কথা শুনো !
-বল !
নীলু তানজিনার সামনে কিছু বলতে ইতস্তত বোধ করছিল ! আমি বললাম
-ওর সামনেই বল ! ও নাম তানজিনা ! আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছি !

আমার কথা শুনে রুমে ভিতর যেন বোমা পড়লো ! বোমা পড়ার পর যে একটা শুনশান নিরোবতা দেখা দেয় ঠিক তেমনই নিরব হয়ে রইল কিছুটা সময় ! নীলু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । তার থেকেও তানজিনা বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ! নীলু আর কিছু বলল না ! কেবল চোখে পানি নিয়ে চলে গেল ! নীলুর চলে যাওয়ার পর তানজিনা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
-কি বললেন আপনি ?
-কিছু না ! আসলে ঐ টা আমার এক্স ওয়াইফ ছিল !
-বুঝতে পারছিলাম ! কিন্তু বিয়ে …..
-ঐ টা জাস্ট কথার কথা ! মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে !
-তাই ?
এই কথাটা বলেই তানজিনা আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে হাসলো ! সেই চোখে অন্য কিছু ছিল !

-আচ্ছা চলুন ! লাঞ্চ করা যাক !
তানজিনা সেইঅদ্ভুত চোখের তাকিয়েই রইলো ! আমার কেন যেন একটু অস্বস্তি লাগা শুরু করলো ! ভাল লাগার অস্বস্তি !

(সমাপ্ত)

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 83

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →