তোমার আমার পথ চলা

4.8
(60)

গল্পের শুরু 

রিক্সা থেকে নেমেই সবজিওয়ালার দিকে চোখ গেল। মীরার প্রতিদিনের রুটিনের একটা হচ্ছে অফিস থেকে ফেরার পথে বাসার সামনের এই সবজির ভ্যান থেকে সবজি কিনে বাসায় ফেরা।

আজকে নামতেই সবজিওয়ালার হাসি মুখে বলল, আইজ ভাল লাল শাক আছে আফা! মাত্রই লইয়া আইছি।

মীরা হাসলো। ইচ্ছে হল নিয়ে নেয় কয়েক আটি শাক কিন্তু নিল না। বলল, আজকে সবজি লাগবে না।

সবজিওয়ালা অবাক হয়ে বলল, কেন আফা? সবজি কি খারাপ দিছি কোনদিন?

মীরা বলল, না না সেটা বলি নি। সেটার জন্য না। আসলে আপনার ভাইয়া আগেই সবজি নিয়ে গেছে আজ।

লাইনটা বলেই মীরার কেমন যেন লাগলো। দুদিন আগেও অপুকে সে কেবল অপু বলেই ডাকতো। কারো সামনে ওর কথা বলতে গেলেও সোজাসাপটা অপু বলেই বলতো। আর আজকে অপুর বদলে বলছে আপনার ভাইয়া! কি অদ্ভু্ত শোনাচ্ছে!

সবজিওয়ালা বলল, আফা আপনি বিয়া করছেন? কবে!! কইলেন তো না!

মীরার কেন জানি অস্বস্তি লাগলো না প্রশ্নটা শুনে। অফিসে এখনো কাউকে জানানো হয় নি। বাইরের কেউ বলতে গেলে জানেই না যে ও বিয়ে করেছে!

মীরা আবারও হাসলো। তারপর বলল, হঠাৎ করে বিয়ে হয়েছে। কাউকেই বলি নি। একটু গুছিয়ে নিই, তারপর সবাইকে জানাবো। আপনাকেও দাওয়াত দিবো। টেনশন নিয়েন না।

সবজিওয়ালার মুখের হাসি বিস্তৃত হল। মীরা কিছু কিনবে না কিনবে না করেও এক কেজি শসা নিয়ে নিল ; অপু ওকে ফোনে বলছিলো আজকে আকাশ মেঘলা। রাতে বৃষ্টি হতে পারে। তাই আজকের রাতের স্পেশাল খাবার হচ্ছে গরুর মাংসের সাথে ভূনা খিচুড়ি। শসা হলে ভালই হবে।

মীরা কি কোনদিন ভেবেছিল ও আর কোন দিন বিয়ে করতে পারবে! তাও আবার অপুকে! কেমন করে ওদের বিয়েটা হয়ে গেল! অন্ততঃ এমন করে মীরা কোনদিন বিয়ে কিরতে চায় নি। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে। কেবল নিজের একার কথা হলে কোন পরিস্থিতিতেই ও বিয়েতে রাজি হত না। কিন্তু ওর সাথে ইরার জীবন জড়িয়ে আছে। মায়ের মারা যাওয়ার পরে ইরার আর কেউ নেই ও ছাড়া। ওর কথা তো ভাবতেই হবে!

এক

আমাদের সমাজে একা একা একটা মেয়ের চলাটা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার । মাঝে মাঝে সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে । মীরার জন্য ওর জীবনটা কোন দিনই সহজ ছিল না । ছোট বেলা থেকেই ওর মাথার উপর বাবার কোন ছায়া ছিল না । ছোট বেলাতেই ওর বাবা মারা গিয়েছিলো । ওর মা মীরা আর ইরাকে খুব খুব কষ্ট করে মানুষ করেছে । তবুও যতদিন ওর মা ওদের মাথার উপর ছিল, তাই আসল সমস্যাটা ও বুঝতে পারে নি ।

তারপর মাস দুয়েক আগে ওর মা যখন মারা গেল মীরার মনে হল এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ রইলো না । কথাটা এক প্রকার সত্যিই । ওদের দুই বোনের কাছের মানুষ বলে আর কেউ নেই । বাবার কয়েক জন আত্মীয় স্বজনকে ছোট বেলাতে দেখেছিলো । তবে জমি জমা নিয়ে কি একটা ঝামেলা হওয়ার পর থেকে তাদের সাথে আর যোগাযোগ নেই ওদের । আর মায়ের দিককার কোন আত্মীয়কে কোন দেখে নি ।

তারপর ওর মায়ের মারা যাওয়ার পরে মীরা সত্যিই সত্যিই বুঝতে পারলো একা একা দুজন মেয়ের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা কত কষ্টের । ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই মীরা বুঝতে পারলো ওর চারিপাশের মানুষ গুলোর আচরন কেমন যেন পরিবর্তিত হয়ে গেছে । সবাই যেন খানিকটা করুণার চোখে ওদের দিকে তাকচ্ছে । মীরা এই ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না।

মীরা একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে । নিজ চেষ্টায় সিএ কম্প্লিট করেছে । মাসে মাসে বেশ মোটা অংকের বেতন পায় । টাকা পয়সার কোন অভাব হয় না । কিন্তু তার পরেও সবার আচরনটা এমন যেন মীরা আর ওর বোনটা কতটাই না অসহায় এই পৃথিবীতে । সবাই কেন এমন হবে ? আজকে যদি ও মেয়ে না হয়ে ছেলে হত তাহলে কি সবার মনভাব এমন হত ? নিশ্চয়ই হত না । তাহলে ওর মেয়ে হওয়ার কারনে কেন এমন হবে!

তখন সবে মাত্র মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠেছে ও। স্বভাবিক কাজ কর্ম শুরু করেছে । এমন সময় ওদের বাড়িওয়ালা ওদের বাসায় এসে হাজির হল । ওদের কে বাসা ছাড়তে বলল । কোন কারণ দেখালো না । কেবল বলল যে যত জলদি পারো যেন বাসাটা ছেড়ে দেয় ।

মীরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। একটা ফ্যামিলি বাসায় ওরা দুজন মেয়ে থাকছে কেবল । ব্যাপারটা হয়তো অনেকের কাছে ভাল ঠেকছে না । মীরার একটা তীব্র রাগ হল সবার উপর কিন্তু কিছু করতে পারলো না সে । কিছু করার ছিলও না । তারপর থেকে বাসা খুজতে শুরু করলো । বাড়িভাড়া ওর জন্য কোন সমস্যা ছিল না । কিন্তু যখনই বাড়িওয়ালারা শুনলো যে ও অবিবাহিত এবং বাসাতে কেবল ওরা দুবোন থাকবে তখনই তারা বাসা ভাড়া দিতে চাইলো না ।

ইরার সাথে কথা গুলো বলার পরপরই ইরা বলল, আপু একটা কাজ করি । আমার তো হলে সিট আছেই । আমি ওখানে উঠে যাই । আর তুই কোন হোস্টেলে উঠে যা ! ফার্ম গেটের দিকে ।

মীরার সামনে অবশ্য এই ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না । সেই সময়েই অপু কথাটা বলল । অপুর সাথে ওর বন্ধুত্ব সেই কলেজ জীবন থেকে । একই সাথে ওরা কোচিং করতো । চুপচাপ স্বভাবের ছেলে । মানুষের সাথে খুব একটা কথা বলে না । তবে মীরার সাথে ভালভাবেই মিশতো । তারপর ভার্সিটিতে উঠে একই বিষয়ে ভর্তি হয়ে গেল । তখন থেকে ওদের বন্ধুত্বটা আগের থেকেও আরও মজবুত হল । তারপর থেকেই মীরার যে কোন সমস্যায় অপু সামনে এগিয়ে এসেছে । যেমন টা এই সমস্যাতেও এগিয়ে এল।

দুই

অপু যখন কথাটা মীরাকে বলল মীরা প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না । খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো । ও এসেছিলো অপুর সাথে কথা বলতে । নতুন বাসা কিভাবে যোগার করবে সেটা নিয়ে । ওর হোস্টেলে থাকতে মোটেই ইচ্ছে করছে না । সেই সময়েই অপু বলল, তুই আমাকে বিয়ে করতে পারিস । তাহলে একটা সমাধান হবে ।

মীরা প্রথমে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । তারপর বলল, কি বললি ? বিয়ে ?

অপু শান্ত কন্ঠে বলল, শোন তোকে এই বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে বল ? কেন কেউ ভাড়া দিতে চাইছে না ?

মীরা জানে কেন তাদেরকে এই বাসা ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে । অপু বলল

-কারন তুই বিবাহিত নোস এই জন্য । তারা ধারনা তোরা একলা দুটো বোন । কি না কি করবি তোরা ! তারা ধরেই নিয়েছে তোদের যেহেতু বিয়ে হয় নি, একা দুইটা মেয়ে, মাথার উপর কোন বাবা মা নেই তোরা নিশ্চয়ই তোরা …..

অপু লাইনটা শেষ করলো না । মীরা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । অপু বলল

-দেখ আমি জানি তুই কেন বিয়ে করতে চাস না । রায়হান ভাইয়ের ঐ আচরনের জন্য । তোকে এভাবে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য । তোর পক্ষে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব না । এই জন্যই আমাকে বিয়ে করতে বলছি । অন্য যে কারো সাথে বিয়ে করলে তার সাথে তোর কেমন সম্পর্ক হবে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না । কিন্তু আমার সাথে বিয়ে হলে তুই আমার বন্ধুই থাকবি । কেবল পার্থক্য হবে আমরা একই বাসায় থাকবে । আমাদের রুম আলাদা হবে । যেমনটা মনে কর তোদের এই বাসায় আমি আলাদা একটা রুম নিয়ে পেয়িং গেস্ট থাকছি । এটাই । এটা ছাড়া তোর জীবনে আর কোন পরিবর্তন হবে না । তবে মানুষজন তোর সাথে যেমন এখন আচরন করছে তখন আর সেটা করবে না । বুঝেছিস ? হোস্টেলে উঠলে হয়তো বাসার সমস্যাটা সমাধান হবে তবে মানুষের আচরনের পরিবর্তন হবে না ।

মীরা কথাটা চিন্তা করলো কিছু সময় ধরে । অপুর কথাটা এক হিসাবে সত্যিই । আসলেই তাই । মীরা বলল

-আমি বুঝলাম । কিন্তু এতো বড় একটা কাজ তুই আমার জন্য করবি ?

অপু বলল

-দেখ তুই আমার বন্ধু এটা তোর উপকার হবে । এটা একটা কারন । তবে বড় কারন টা আমার নিজের । তুই জানিস আমার ব্যাপারটা ! তোর মত বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহ নেই আমারও । কারনটা তুই জানিস ।

মীরা কারনটা খুব ভাল করেই জানে । মীরার সাথে ঠিক যেমন ঘটনা ঘটেছে ঠিক একই ঘটনা অপুর সাথেও ঘটেছে । অপুর সাথে মেয়েটার সম্পর্ক খুবও গাঢ় ছিল । অন্তত অপুর দিক থেকে । কিন্তু সেই মেয়ে ওকে ছেড়ে চলে যায় আরও ভাল একটা বিয়ের প্রস্তাব আসার কারনে । ভাল অপশন পেয়ে চলে গেছে । রায়হানও ঠিক একই কাজ করেছে । অপু বলল

-ছেলের বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে করছে না । মানুষ ভাবছে ছেলের ভেতরে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে । সমস্যা বলতে বুঝতে পারছিস আমি কি বলতে চাচ্ছি !

-হুম পারছি ।

-দেখ আমি এখানে একা থাকি, একা কাজ করি আমার সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু বাসায় তো যেতে হয় মাঝে মাঝে, আর মা বাবা তো আছে । তাদের কত কথা শুনতে হয় । তারা তো আর আমার মত নয় !

মীরা খানিকটা সময় চুপ করে রইলো । ভাবতে লাগলো অপুর কথা । যদি ওদের দুজনের বিয়ে হয় তাহলে দুজনের সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে । মীরা বলল

-আমি কিছুটা সময় ভাবি । তারপর জানাই ?

-হ্যা অবশ্যই । আর শোন আমি তোকে প্রোপোজ করি নাই যে তুই রাজি না হলে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে । তুই যদি রাজি নাও হৌস তবুও আমরা আগের মতই বন্ধু থাকবো । বুঝেছিস ?

-হুম ।

মীরা একদিন সময় নিয়েছিলো ভাবতে । তারপরেই রাজি হয়ে গেল । ইরা সব ব্যাপারটাই জানতো । ইরার কথাটা চিন্তা করে ওর সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছে । অন্তত ইরার বিয়ের আগ পর্যন্ত এই ব্যাপারটা চালিয়ে যাওয়াই যায় । বড় বোনের বিয়ে হয় নি এই ব্যাপারটা ছোট বোনের বিয়ের উপর একটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে ।

ওদের বিয়েটা হল খুব সাধারন ভাবে । কাউকেই জানালো হল না । কেবল কয়েকজন কাছের বন্ধু বান্ধব জানালো । আর জানালো হল মীরাদের বাসার বাড়িওয়ালাকে । এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে তারপর দিনই বাড়িওয়ালা ওকে জানালো যে ও চাইলে এই বাসায় থাকতে পারে । যে সমস্যাটা ছিল সেটা এখন আর নেই ।

তিন

দরজা খুলতেই মীরার নাকে একটা চমৎকার সুগন্ধ এসে লাগলো । দরজার সামনে ইরা দাড়িয়ে আছে । ইরাকে দেখে মনে হল এখনই বাইরে থেকে এসেছে । এখনও বাইরের পোশাক বদলায় নি । মীরাকে দেখতেই ইরা বলল

-আপু, অপু ভাইয়া যে কি চমৎকার রান্না করতে পারে ! তুই সত্যিই লাকি রে !

মীরা জানে যে অপু রান্না করতে পারে । নিজের মুখে অপুই এই কথা ওকে বলেছে কতবার । কিন্তু মীরা কোন দিন বিশ্বাস করে নি । কেবল ভেবে নিয়েছে যেঅপু হয়তো ওর সাথে দাম বাড়ানোর জন্য এই সব কথা বলছে । কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সত্যিই রান্না করে চমৎকার । অন্তত চমৎকার একটা সুগন্ধ আছে । খেতেও চমৎকার হবে ।

খাওয়ার সময় দেখা সত্যি চমৎকার হয়েছে খাওয়াটা । ইরা তো প্রসংশাতে পঞ্চমুখ । মীরা কি বলবে বুঝতে পারছিলো না । ওর নিজের মনের ভেতরে ভাল লাগছিলো । মায়ের মারা যাওয়ার পরে আজ কয়েকটা দিন পরে ওর মনটা বেশ ভাল লাগছে । কেন লাগছে সেটা ও জানে না ।

রাতে ঘুমানোর সময় অপুকে লক্ষ্য করলো বারান্দাতে বসে আছে চুপচাপ । মীরার মনে ওর মন খারাপ । ওর পাশে গিয়ে বসে পড়লো । দুজন কিছুটা সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো । মীরার এখনও ভাবতে খানিকটা অবাক লাগছে পাশে বসা এই মানুষটা তার বিয়ে করা স্বামী । যেভাবেই ওদের বিয়েটা হোক না কেন অপু তো ওর স্বামীই বটে ! বেশ কিছুটা রাত পর্যন্ত ওরা বসেই রইলো চুপচাপ । তারপর চলে গেল নিজেদের ঘরে ঘুমানোর জন্য ।

কয়েকটা দিন এভাবেই চলে গেল । অপু যেভাবে বলেছিলো সেই ভাবেই সব কিছু হচ্ছিলো । আসলেই ওদের জীবনে খুব একটা পরিবর্তন আসে নি কিছু । সকাল হলেই মীরা অফিস চলে আসে, ইরা চলে যায় ক্যাম্পাসে । অপু নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে । সন্ধ্যার পরে এখন প্রতিদিনই তিনজন বসে গল্প করে, রান্না চলে । মাঝে মাঝে ইরা থাকে না ওদের সাথে, আগে যেমন ওরা বইরে আড্ডা দিতো এখনও তেমন কাজটাই করে ।

তবে মীরা এখন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছে যে মায়ের মত্যুর পরে মীরার মনে যেমন একটা মন খারাপ ভাব থাকতো, ওর মনে হত এই পৃথিবীতে ওর আসলে কেউ নেই ওকে দেখে রাখার মত কেউ নেই, সেই অনুভূতিটা অদ্ভুত ভাবে চলে গিয়েছে । কেন গিয়েছে সেটা ও বলতে পারবে না । তবে গিয়েছে ।

মীরা তখনও অফিসে কাউকেই জানায় নি তার বিয়ের কথা । একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল । মীরার অফিসের ওর উপরে পোস্টে চাকরি করতো আজগর খালেক । বয়সে মীরার থেকে বছর দশেকের বড় হবে । একবার বিয়ে হয়েছিলো । বছর খানেক আগে তার স্ত্রী মারা গিয়েছে । বাসায় দুই ছেলে মেয়ে আছে ।

মীরার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই খালেক সাহেব আকারে ইঙ্গিতে মীরাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে সে তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী । মীরা প্রথম থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করে থাকলো । তবে সেদিন খালেক সাহেব একটু বেশি দুর এগিয়ে গিয়েছিলো ।

মীরার বাসা ওর অফিসের কাছেই । রিক্সাতে মিনিট পনের সময় লাগে । বিয়ের পর মাঝে মাঝেই তাই অপুকে লাঞ্চ আওয়ারে মীরা ডাক দিতো । এক সাথে দুপুরের খাওয়ার জন্য । অপুর সময় থাকলে সে এসে হাজির হত । এমন একদিন মীরা অপুর জন্য অপেক্ষা করছিলো অফিসের সামনের একটা রেস্টুরেন্টে । এমন সময় সেখানে খালেক সাহেব এসে হাজির । মীরার টেবিলে বসে পড়লো কিছু না বলেই । তারপর নানান কথা বার্তা শুরু করলো । মীরা চাইলেও কিছু বলতে পারছিলো না । কারন অফিসে খালেক সাহেব তার বস ! কিছু বলার উপায় নেই । একটা পর্যায়ে খালেক সাহেব সরাসরি মীরাকে বিয়ের কথাটা বলেই ফেলল ।

মীরা এড়িয়ে এড়িয়ে গিয়ে বলল যে এসব নিয়ে এখন সে কিছুই ভাবছে না । সময় হলে ভাববে !

যদি ঘটনা এই পর্যন্ত ঘটতো তাহলে সব কিছু ঠিকই থাকতো কিন্তু খালেক সাহেবের মনে হল তিনি আজকে আর কিছু শুনবেন না । এই মেয়েকে তিনি আজকে রাজি করাবেনই । সে মীরার হাত চেপে ধরলো বেশ শক্ত ভাবে । পুরো রেস্টুরেন্ট ভর্তি মানুষ তবে কেউ তাদের দিকে তাকাচ্ছে না । মীরা বসেছিলো একেবারে কোনার দিকের একটা টেবিলে । মীরা কয়েকবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন কাজ হল না ।

ঠিক সেই সময়েই অপু এসে হাজির । মীরার চেহারার দিকে আর খালেক সাহেব হাত ধরা দেখে অপুর বুঝতে কিছু বাকি রইলো না । সে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় খালেক সাহেবের মাথা ধরে একটা জোরে ধাক্কা মারলো । এটা যে হতে পারে খালেক সাহেব ভাবতেও পারে নি । মীরার হাত ছেড়ে কোন মতে পতন সামলালো । উঠে গিয়ে “হাউ ডেয়ার…. বলতে গেল কিন্তু শেষ করতে পারলো না । অপুর এবার তার গাল বরাবর চড় বসিয়ে দিল ।

পুরো রেস্টুরেন্ট টা একেবারে চুপ হয়ে গেল । খালেক সাহেব একেবারে হতভম্ভ হয়ে গেছেন । কিছু যে বলবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না । কেউ যে তাকে চড় মারতে পারে সেটা তিনি ভাবতেও পারে নি । রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার দৌড়ে এসে হাজির হলেন । অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, আরে আরে কি করছেন ?

অপু খুব শান্ত কন্ঠে বলল, আপনার বউয়ের সাথে বেয়াদবী করলে আপনি কি করবেন ? এই বদমাইশটা আমার স্ত্রীর হাত ধরে তার সাথে বেয়াদবী করার চেষ্টা করছিলো ।

রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার বলল, কি বলছেন ?

-সিসি টিভি ক্যামেরা আছে না ? সেখানে গিয়ে ফুটেজ চেক করে দেখুন ।

তারপর মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, চল এখান থেকে ।

অপু তাকালো খালেক সাহেবের দিকে । তারপর সরাসরি বলল, এরপরে যদি মীরার আশেপাশে দেখি একেবারে হাত ভেঙ্গে দেব বলেদিলাম !

মীরার নিজের ব্যাগটা হাতে নিল । তারপর সবাইকে হতভম্ভ অবস্থায় রেখে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এল । মীরা ভেবেছিলো অপু আর কিছু করবে না কিন্তু ওকে নিয়ে যখন ওর ব্যাংকে ঢুকলো তখন ও একটু অবাকই হল । সরাসরি ওকে নিয়ে হাজির হল ব্যাংকের ম্যানেজার ঘরে । তারপর রেস্টুরেন্টে যা যা হল সব বলল নিজের মুখে । সে যে মীরার স্বামী এটা বলতেও ভুললো না ।

ম্যানেজার সাহেব বললেন,তুমি বিয়ে করেছো মীরা ?

-জি স্যার কদিন হল ।

-জানালে না একবারও ।

মীরা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল

-কাউকেই জানাই নি । বিয়ের অনুষ্ঠান এখনও করি নি । যখন করবো তখন সবাইকে জানাবো ভাবছিলাম ।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, খালেক সাহেবের নামে কানা ঘুষা আমি নিজেও শুনেছি কিন্তু কেউ তার নামে সরাসরি কিছু বলে নি । তুমি আজকে বললে এর পেছনে একশন নেওয়া হবে । নিশ্চিত থাকো ।

অফিস থেকে বের হওয়ার পর অপর দিকে তাকিয়ে বলল,এমন টা না করলেও হত !

অপু বলল, ইস আমার বউয়ের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে তার খবর খারাপ করে দিবো না!

মীরা জানে অপু কথাটা খানিকটা ঠট্টা করেই বলেছে কিন্তু কথাটা শুনে ওর হঠাৎ করে ভাল লাগলো খুব । কোন কারণ নেই তবুও । সেদিন থেকেই অফিসে সবাই জেনে গেল যে মীরা ওর অনেক দিনের বন্ধুকে বিয়ে করেছে । এবং তার স্বামী অনেক বেশি প্রটেক্টিভ । রেস্টুরেন্টের খবরটাও জানতে আর কারো বাকি ছিল না । বিশেষ করে ওর মেয়ে সহকর্মীরা যারা কদিন আগেও ও কেন বিয়ে করছে না এটা নিয়ে কানাঘুষা করতো তারা এসে ওকে অভিনন্দন জানালো । এও জানালো যে সে অনেক লাকি এমন একজন স্বামী পেয়ে ! তারপরই মীরা খেয়াল করতে শুরু করলো যে সব কিছু আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করেছে ।

চার 

অফিস থেকে একদিন বাসায় ফিরে দেখতে পেল অপু মুখ অন্ধকার করে বসে আছে ।

-কি হয়েছে ?

-কিছু না ।

-আরে বাবা কি হয়েছে ? না বললে কিভাবে বুঝবো ?

-মা ঢাকাতে আসতে চাইছে ?

-তোর মা ?

-হ্যা !

-তো এতে মুখ ভার করার কি আছে !

-সে আসছে তোকে দেখতে । তার পুত্রবধুকে দেখতে ।

বিয়ের পর প্রায়ই দিনই অপুর মায়ের সাথে মীরার কথা হয় । উনি বলেন বেশি মীরা সে সব চুপ করে শোনে । অপু ওকে বলেছিলো যে ওর মায়ের একটু বেশি কথা বলার স্বভাব । সেটা যেন ও মেনে নেয় ! কিন্তু সরাসরি এখনও দেখা হয় নি । মীরা বলল

-তো সমস্যা কোথায় ?

-সমস্যা নেই ?

মীরা কি বলবে বুঝতে পারলো না । অপু বলল

-দেখ তোর সাথে আমার কিভাবে বিয়ে হয়েছে সেটা মা জানে না । আমি তাকে এটা জানতে দিতে চাই না ।

মীরা বলল

-জানবে না সে । চিন্তা করিস না । তিনি যে কদিন থাকে আমি সামলে নিবো ! বুঝেছিস ? কবে আসবেন উনি ?

-আগামী পরশু !


পাঁচ

রাবেয়া খাতুন যখন কমলাপুর স্টেশনে নামলো তখন সকাল হয়ে গেছে । ট্রেন থেকে নেমে তিনি তার ছেলেকে ফোন দিতে যাবেন তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেলেন । তার সামনে এসে হাসি মুখে দাড়ালো । তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো ।

প্রথমে একটু চমকে গেলেও মেয়েটাকে তিনি চিনে ফেললেন তারপরই । এটাই তার ছোট ছেলের বউ । এর আগে মেয়েটাকে সে সরাসরি দেখে নি । ভিডিও কলে দেখেছে কয়েকবার । এই প্রথম তাদের দেখা হচ্ছে । তবে মেয়েটা ঠিকই তাকে চিনে ফেলেছে ।

রাবেয়া বলল, বেঁচে থাকো ! অপু কোথায় ?

তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ছেলেকে খোজার চেষ্টা করলেন ।

মীরা একটু হেসে বলল বলল, আপনার ছেলে আসে নি । আপনি জানেন না সে সকালের ঘুম কত পছন্দ করে !

রাবেয়া খানিকটা মুখ শুকনো করে বলল, হ্যা জানি । তার ঘুমের কাছে সব কুরবান ।

তারপর মীরার দিকে তাকালো ভাল করে ।

মীরার ব্যাপারে তার আপত্তি ছিল । অপু যখন ফোনে বলেছিলো মীরার কথা তখন তিনি খানিকটা মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন । মেয়েটার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই । থাকার ভেতরে কেবল এক ছোট বোন আছে । এমন একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে তার ছেলে কোন দিন শ্বশুর বাড়ির আদর পাবে না, এই কথাই তার মনে হয়েছিলো । তবে এই কথা তিনি বলতে পারেন নি ।

অপু এমনিতেই বিয়ে করতে চাইছিলো না । ওর বয়সও হয়ে যাচ্ছিলো । ওর পরিচিত সবাই বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করে দিয়েছে সেই কবে । সবারই প্রায়ই ছেলে মেয়ে আছে । কেবল অপু এখনও বিয়ে করে নি । রাবেয়ার কানে তো এই কথাও আসছিলো যে অপুর মাঝে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে । নয়তো ছেলে বিয়ে কেন করবে না । তাই তিনি সাহস করে আর কিছু বলতে পারেন নি । ছেলে বিয়ে তো করুক । নয়তো দেখা যাবে আবারও বেঁকে বসছে আর বিয়েই করছে না ।

তবে সামনা সামনি মীরাকে দেখে রায়ের মন ভাল হয়ে গেল । চেহারার মাঝে একটা অন্য রকম স্নিগ্ধতা আর সারল্য আছে । মীরা নাকি অপুর ক্লাসমেট ছিল । একই সাথে পড়া শুনা করতো । তবে দেখে তেমনটা মনে হচ্ছে না ।

মীরা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে কেবল শ্বাশুড়ির জন্য । কেন এই কাজটা ও করলো, ও নিজেই বলতে পারবে না ।

রিক্সা করেই বাসায় পৌছানো গেল । স্টেশন থেকে বাসা কাছেই । রাবেয়া লক্ষ্য করলো রিক্সায় চলা অবস্থায় মিরা তার হাত ধরে রেখেছিলো । যেন পড়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। রাবেয়ার কাছে মনে হল তার একটা মেয়ে থাকলে হয়তো এমন করেই তার হাত ধরে থাকতো । দুই ছেলে হওয়ার পরে তার খুব ইচ্ছে ছিল তার এক টা মেয়ে হবে । সেই আশা করেই তিনি তিনবার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । কিন্তু সেবারও ছেলেই হল । সারা জীবন তার মনে একটা মেয়ের আশা ছিলই । সেটা আর পুরণ হয় নি ।

বাসায় এসেই মীরা তাকে তার ঘর দেখিয়ে দিল । প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো তাকে গেস্ট রুমেই থাকতে দিবে কিন্তু রাবেয়া লক্ষ্য যে রুমে তাকে থাকতে দিবে কিন্তু রুমের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো রুমটা মাস্টার বেড রুম । রাবেয়া বলল, এটা তোমাদের রুম না ?

মীরা একটু হেসে বলল, হ্যা মা । এটা আমাদের রুম ।

-এখানে আমি থাকবো ?

-হ্যা সমস্যা কি ? রুম পছন্দ হয় নি ?

-তা সেটা না । তোমরা কোথায় থাকবে ? আমি বরং গেস্ট রুমে থাকি ?

মীরা হাসলো আবার । তারপর বলল

-আপনি এখানেই থাকুন । আপনার ছেলের আরেকটা রুম আছে পাশে । দিনের বেশির ভাগ সময়ে সে সেখানেই থাকে । তার কাজ কর্মও সেখানে । সেখানেও শোয়ার জন্য খাট আছে । আপনি চিন্তা করবেন না । আপনি আরাম করে থাকুন এখানে !

সকালের নাস্তার টেবিলেই প্রথম অপুর সাথে দেখা হল রাবেয়ার । সে খানিকটা অসন্তুষ্ট কন্ঠে বলল, এতোদিন পরে আমি আসলাম একবার আমাকে আনতেও গেলি না ?

অপু রুটিতে কামড় দিতে দিতে বলল, মা তুমি সাড়ে চারশ কিলোমিটার পথ একা একা চলে আসলে আর স্টেশন থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার পথ আসতে তোমার আমাকে দরকার পড়বে কেন ?

রাবেয়া বলল, হ্যা তাই তো তা পড়বে না । সব কিছু তো একা একাই করে গেছি সারাজীবন । তোর বাপও শান্তি দেয় নি তোরাও দিবি না !

অপু বলল, আবারও সেই কথা! এক কথা আর কত ! আমরা তো জানি আমার বাবার সাথে বিয়ে না হলে তুমি একদম রাজরানী হয়ে থাকতে । সে কথা তো জানি ….

রাবেয়া রেগে যাবেন এমন সময় মীরা অপুকে ধমক দিয়ে উঠলো । বলল, অপু তুই চুপ থাক । উনি কেবল এসেছেন । এতো কথার দরকার । চুপচাপ খা তো !

রাবেয়া এবার মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা একে অন্যকে তুই বলে ডাকো ? এটা কি ধরনের কথা !

মীরা একটু যেন লজ্জা পেল । অপু বলল, মা ও আমার বন্ধু, কলেজ থেকে ওকে চিনি । সাত বছর ধরে তুই বলে ডাকি ওকে !

রাবেয়া বিন্দু মাত্র দমে না গিয়ে বলল, তখন তোমরা বন্ধু ছিলে এখন স্বামী স্ত্রী । না না এসব চলবে না । আজকে থেকে কোন তুই তোকারি না । তুমি !

রাবেয়া যেমনটা ভেবেছিলো অপুর বউ মোটেই তেমন না । একে তো মীরা অপুর সমান তার উপর চাকরি করে । তিনি ভেবেছিলো অপুর বউয়ের কাছে দাম পাবে না । কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, তার বড় দুই ছেলের বউ থেকেও মীরা তাকে বেশি যত্ন নিচ্ছে । সকাল বেলা অফিস গেল ঠিকই তবে কিছু সময় পরেই ফিরে এল । তার জন্য সে ছুটি নিয়ে এসেছে । সারা দিন সে রাবেয়াকে সময় দিবে । তিনি নিজে পুরোটা সময় অপুর সংসার দেখতে লাগলেন । মনে মনে খুশিই হলেন । এখন কেবল অপুর সংসারে একটা বাচ্চা এলেই তিনি খুশি । আর কিছু চাওয়ার নেই তার ।

রাতে খাওয়ার সময় কথাটা আবারও খাবার টেবিলে তুলল । এবার অপু রেগে গেল একটু ! বলল

-মা আমি বুঝতেছি না, সব কিছু এতো জলদিই কেন দরকার শুনি ?

-তা তোরা বাচ্চা নিবি না ? বয়স হয়ে যাচ্ছে । বংশের একটা বাতি দিতে হবে না !

-তোমার স্বামীর বংশ তো নির্বংশ হচ্ছে না । এতো চিন্তা কেন করছো ? তোমার বড় দুই ছেলের দুটো করে ছেলে আছে । আর কি দরকার ! ছোট ছেলে ছেলে মেয়ে না হলে এতো চিন্তার কিছু নেই ।

মীরা মা ছেলের ঝগড়া দেখছিলো । ওর কেমন যেন লাগছিলো । একটু অস্বস্তি যে লাগছিলো না সেটা বলবে না তবে মজাও লাগছিলো । সেই সাথে মনের কোথায় যেন একটা সুখের অনুভূতি হচ্ছিলো । ব্যাপারটা সে বলে বোঝাতে পারবে না ।

ঝামেলা বাঁধলো রাতে শোয়ার সময় । অপুর মা কে নিজের ঘরে ঘুমাতে দিয়ে সে এসে হাজির হল । অপু ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে শুবি ?

-মা যখন দেখবে তার নতুন বিয়ে হওয়া ছেলে আর ছেলের বউ আলাদা ঘুমায় তখন কি ভাববে?

-এই জন্য আমি তাকে আসতে দিতে চাই নি ।

-আচ্ছা বাদ দে । কটা দিনই তো !

অপু বলল

-তুই বিছানায় ঘুমা । আমি ফ্লোরিং করছি !

-দরকার নেই । মাঝে একটা কোলবালিশ দিয়ে দেই । আর তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে ।

-শিওর তুই ?

মীরা কিছু বলল না । হাসলো একটু । মনে মনে একটু অস্বস্তি লাগছিলো সেটা প্রকাশ করলো না । মাঝে একটা কোল বালিশ দিয়েই শুয়ে পড়লো লাইফ অফ করে ।

অনেকটা সময় পরে হঠাৎ অপু বলল, কিছু বলবি ?

মীরা বলল, জানি আজকে যখন তোর মা কে নিয়ে আসছিলাম স্টেশন থেকে, ওনার হাত ধরে ছিলাম যাতে পড়ে না যায় । যদিও তোর মা যথেষ্ঠ শক্ত সামর্থ আছে এখনও । আমার আম্মু রিক্সা বসতে পারতো না ঠিক মত । জানিসই তো অসুস্থ ছিল । তাকে ধরে রাখতাম সব । সেই অভ্যাস টা রয়ে গেছে ।

তারপর অপেকটা সময় চুপ করে রইলো দুজন । মীরা তারপর অন্ধকারে খুজে খুজে অপুর হাতটা ধরলো । বলল

-তোকে ধন্যবাদ রে ।

-কেন ?

-জানি না । আজকে অনেক দিন পরে কেন জানি ভাল লাগছে । তোর মা একটু বেশি কথা বলে ঠিক আছে কিন্তু মায়ের মত করে বলে । মা নেই তো আমার তাই আমি জানি ! আজকে সারাদিন উনি আমাকে কত কথা যেন বলেছে । শুনতে কি যে ভাল লাগছিলো বলে বোঝাতে পারবো না ।

-ঘুমা !

-তুই ও ঘুমা !

হাত ছাড়লো না মীরা । ঐ অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেল ।

সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গলো মীরা দেখলো ওদের মাঝের কোলবালিশটা সরে গেছে । মীরা একেবারে অপুর বুকের কাছে এসে পড়েছে । ওর পুরো শরীরে হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল । প্রকাশ করার মত । কিছুটা সময় সেভাবেই শুয়ে থাকলো । অপুর ঘুম খুব গাঢ় । ও কিছু টের পেল না । মীরা চুপ করে শুয়েই রইলো । ওর মনে অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা আসছে । কেন আসছে সেটা ও জানে না !

রাবেয়া থাকলো আরও সাত দিন । এই সাত দিনের একদিনও মীরা অফিস গেল না । সারা দিন শ্বাশুড়ির পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো । দুজন মিলে সংসারের জন্য কেনা কাটা করলো । রাবেয়া আর কি কি দরকার সেসবের একটা লিস্ট তৈরি করলো । তারপর দুজন মিলে সেই সব কেনা কাটা করলো । বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে শপিং করলো, মুভি দেখলো আরও কত কিছু ।

রাবেয়া যখন ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠলো অদ্ভুত ভাবে তার চোখে পানি চলে গেল । তার মনে হল তিনি নিজের মেয়ের বাসা থেকে ফিরে যাচ্ছেন । মীরাকে অনেকটা সময় ধরে জড়িয়ে ধরে রাখলেন । বললেন তার গাধা ছেলেকে যেন সে দেখে রাখে । মীরা নিজেও অশ্রুসজল চোখে তার শ্বাশুড়িকে বিদায় দিল । এই কটা দিন তার খুব বেশি আনন্দে কেটেছে । একটা মেয়ে ছোট বেলা থেকে যে যে স্বপ্ন গুলো দেখে বড় হয়ে ওঠে তার মাঝে একটা হচ্ছে মায়ের মত একজন শ্বাশুড়ি পাওয়া । মীরা যেন এই কদিন তার শ্বাশুড়ি নয় মায়ের সাথেই সময় কাটিয়েছে । যে হিসাব করে সে অপুর সাথে বিয়ে করেছিলো সে সব হিসাব পত্রে উলট পালট হয়ে যাচ্ছে । প্রথমে ঐ খালেক সাহেবর ব্যাপারে অপুর আচরন তারপর অপুর মায়ের আগমন । এই দুই ঘটনাতে মীরা যেন নতুন ভাবে অপুকে চিনতে শুরু করেছে । নতুন ভাবেই ওকে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে । চাইলেও আগের সেই বন্ধু রুপে অপুকে দেখতে পারছে না ।

ছয়

অপুর ঘুম খুবই গাঢ় । শুরু থেকেই ও যখন ঘুমায় তখন ওর অন্য কিছু আর হুস থাকে না । কিন্তু আজকে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল সকাল হওয়ার আগেই । তখন সবে মাত্র পুর্ব আকাশে আলো পড়তে শুরু করেছে । চোখ মেলেই একটা অস্বাভাবিকত্ব লক্ষ্য করলো । মীরা গত রাতে ওর সাথেই ঘুমিয়েছিলো । গ্রাম থেকে মা এসেছে ওদের বাসায় বেড়াতে । মায়ের সামনে তো আর দুজন দুই রুমে থাকা যায় না । তখন সে আবার নানান প্রশ্ন করবে ।

ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই ওর চোখ গেল মীরার উপর । মীরা একেবারে ওর শরীর ঘেষে শুয়ে আছে । গুটিসুটি ভাবে বাচ্চা মেয়ের মত ঘুমিয়ে আছে । ওদের মাঝে একটা কোলবালিশ দেওয়া ছিল যখন ওরা ঘুমাতে গিয়েছিলো কিন্তু সেটা এখন আর নেই । কোন ভাবে সেটা সরে গিয়েছে । একটু খোজার চেষ্টা করলো তবে নড়লো না । মীরার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে । অপু বেশ খানিকটা সময় এক ভাবেই তাকিয়ে রইলো । এতো গুলো বছরের মাঝে এই প্রথম মীরার প্রতি ওর অন্য রকমের একটা অনুভূতি কাজকরা শুরু হল ! অপু এই অদ্ভুত অনুভূতির ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারবে না ।

একভাবেই তাকিয়ে রইলো সেদিকে । তারপর কখন যে আবার ঘুমিয়ে গেল ও বলতে পারবে না । আবার যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন দেখতে পেল মীরা ওর পাশে নেই । একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উঠে পড়লো

পরের দিন গুলোতেও ঠিক একই কাজ হল । অপু কিছুতেই বুঝতে পারলো না যে ওদের মাঝের কোলবালিশটা গায়েব কেন হয়ে যায় বারবার । ওর ঘুম গাঢ় হলেও এলোমেলো নয় । ও ভাবে ঘুমায় সকালে ঠিক সেভাবেই ওঠে । মীরার ঘুম কি খানিকটা এলোমেলো । হতে পারে । তবে এটা নিয়ে ওর কোন অভিযোগ ছিল না । বরং মনের কোথায় যেন একটা ভাল লাগা কাজ করছিলো ।

মায়ের সাথে মীরার ভাবটা দেখেও অপুর কেন জানি খুবই ভাল লাগলো । একদম বউ শ্বাশুড়ির সংসারের মত মনে হচ্ছিলো । মুভিতে সুখী সংসারে যেমনটা দেখা যায় ঠিক তেমন । এতো গুলো দিনে ওর মায়ের চিন্তার শেষ ছিল না ওর বিয়ে নিয়ে । অন্তত মায়ের এই আনন্দ দেখেও অপুর ভাল লাগছিলো খুব । যেমন করেই ওদের বিয়ে হোক না কেন, ওর মা তো খুশি হয়েছে । মীরার মা বেঁচে থাকেলও নিশ্চয়ই এমন খুশি হত !

অপুর মায়ের চলে যাওয়ার পরে ওদের জীবন আবারও আগের মত হয়ে গেল । মীরা সকালে অফিস যায় । অপু ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের কাজে । তারপর সারা দিন পরে মীরা বাসায় ফিরে । রাতে খাওয়া দাওয়ার সময় গল্প গুজব তারপর ঘুম । পরদিন আবারও একই রুটিন !

অপুর মনে হয় এমন জীবন কি ও চেয়েছিলো ? নাকি মীরাই চেয়েছিলো এমন জীবন । যখন দিবা ওর জীবনে এসেছিলো কত নতুন স্বপ্ন ছিল । কোন দিন হয়তো মুখ ফুটে বলে নি কিন্তু অন্য আট দশটা পুরুষের মতই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে । পড়াশুনা শেষ করে একটা চাকরি তারপর দিবার সাথে চমৎকার এক সংসার ! কিন্তু সেই সুযোগই তাকে দেওয়া হল না । তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল !

অপু তারপর আর কাউকে ভাবতেই পারে নি । মীরা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে ঠিক মিশতোও না । মীরার সাথেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিলো । রায়হান ভাইয়ের প্রতি মীরার যে আবেগ ও দেখেছে ঠিক সেই আবেগ ও দেখতে চেয়েছিলো দিবার মাঝেও । রায়হান ভাইও কত সহজেই ওকে ছেড়ে চলে গেল । আর আজকে ওরা দুজন এক সাথে সংসার করছে কি অদ্ভত ভাবে ।

অবশ্য এক দিন দিয়ে ভালই হয়েছে । ওর নিজের যেমন উপকার হয়েছে মীরারও তাই । বাইরের সমাজকে যতই দুরে ঠেলার চেষ্টা করুক না কেন মানুষ, সমাজে বাস করতে হলে না চাইলেও কিছু কাজ করতে হয় । অপু আর মীরা হয়তো সেই কাজই করে চলেছে ।

জীবন স্বাভাবিক ভাবেই চলতে শুরু করলো ওদের । তারপেই ওদের জীবনে এক ছন্দপতন হল । অফিসের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ওর পা মচকে গেল ভাল ভাবে । এতোটাই খারাপ অবস্থা যেন পায়ে প্লাস্টার করতে হল । সেদিনই মীরা হঠাৎ করেই অপুকে নতূন ভাবে আবিস্কার করলো । এমন কি অপু নিজেও নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করলো । এতো দিনে মীরার প্রতি তার একটা আলাদা অনুভুতি সৃষ্টি হয়েছে সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো সেই সময়ে ।

মীরা মোট এগারো দিন প্লাস্টার নিয়ে বিছানাতে শুয়ে ছিল । এই এগারো দিন অপু পুরোটা সময় ওর আশে পাশে থাকলো । একটা মিনিটের জন্যও মীরাকে ছেড়ে গেল না কোথাও । প্রথম দিন রাতে মীরাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে অপু প্রথমে চলে গিয়েছিলো । তবে নিজের বিছানাতে গিয়ে কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছিলো না । বারবার মনে হচ্ছিলো মীরা মনে হয় ওকে ডাক দিলো । ওর হয়তো কিছু দরকার হবে ।

ইরার তখন পরীক্ষা চলছে । সে চাইলেই বোনের পাশে থাকতে পারছে না । নিজের ঘরে পড়াশুনাতে ব্যস্ত । বার কয়েক মীরার ঘরে উকি দিয়ে শেষ ওর ঘরে এসেই বসে পড়লো । ঘুমন্ত মীরার দিকে তাকিয়ে বসে রইলো ঘরে । কেন এই অনুভূতি হচ্ছে সেটা অপু নিজেও জানে না । কেবল মনে হচ্ছে এখন মীরার পাশে থাকতে হবে ওর ।

-অপু ?

অপু খানিকটা চমকে উঠলো । তাকিয়ে দেখে মীরা জেগে আছে । ও ভেবেছিলো ও ঘুমিয়ে থাকবে ! বলল

-কি হল ? কিছু লাগবে ?

-ঘুম আসছে না তোর ?

-উহু !

-অস্থির লাগছে ?

অপু উত্তর দিলো না । মীরা বলল

-আমার জন্য ? মনে হচ্ছে আমার কিছু দরকার কি না ?

অপু কি বলবে বুঝতে পারলো না । মীরা বলল

-এদিকে আয় আমার পাশে শুয়ে থাক !

অপু কোন কথা না বলে মীরার পাশে গিয়েই শুয়ে পড়লো চুপ করে । মীরা হাত বাড়িয়ে অপুর হাত ধরলো । এর আগেও অনেকবারই মীরা অপুর হাত ধরেছে তবে এইবারের হাত ধরারটার ভেতরে অন্য রকম কিছু একটা ছিল । অপু আর মীরা দুজনেই সেটা বুঝতে পারলো ভাল ভাবেই । কেউ কোন কথা বলল না । কিছু কিছু সময়ে কোন কথা বলার দরকার পড়ে না !

পরের প্রতিদিন অপু ঠিক আদর্শ স্বামীর মতই করেই মীরার দেখা শুনা করতে লাগলো । তার কখন কোনটা দরকার কি করতে হবে কখন করতে হবে সেটা অপুর ঠিক ঠিক নজর রইলো । কেবল মীরাই অবাক নয়, ইরাও অবাক হয়ে দেখতে লাগলো সব ।

ইরাই প্রথমে কথাটা এসে বলল ওকে ।

-অপু ভাইয়াকে দেখছিস ?

মীরা একটা বই পড়ছিল । ইরার কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো । বলল

-মানে ?

-ঢং করিস না তো ! দেখেও না দেখার ভান করে আছিস !

-মানে কি ?

-মানে হচ্ছে একজনের জন্য অন্যজনকে দুরে সরিয়ে রাখার কোন মানে নেই ।

মীরা বলল

-তুই কি বলছিস আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না !

ইরা এবার বলল

-তুই বুঝতে পারছিস না নাকি বুঝতে চেষ্টা করছিস না ! একটা মানুষ তোর সাথে অন্যায় করেছে তাই বলে অন্য সবাই করবে এটা ভাবা বোকামী । কেবল বোকামীই নয় বিরাট মুর্খামীও বটে । আমি জানি তোদের মাঝে ঠিক কোন শর্তে বিয়ে হয়েছিলো । একটা ডিলের মত কিন্তু এই কদিনে যা হচ্ছে আমার মনে হচ্ছে না এটা আর কোন ডিল আছে । তোরা দুজনেই এটা স্বীকার করতে চাচ্ছিস না কিন্তু তোরা দুজনেই যে একে অন্যের প্রতি কি পরিমান আসক্ত হয়ে হয়ে গেছিস বুঝতে পারছিস ?

মীরা কোন কথা বলল না । ওর বুকের মাঝে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে । ইরা মোটেই মিথ্যা কথা বলে নি । ওর দিক থেকে তো নয়ই !

অপুকে বিয়ে করার পর মীরার মনে এই কথাটা কয়েকবার এসেছিলো যে ও ভুল কোন কাজ করলো কি না ! তারপর অপুর প্রতি ওর অনুভূতি যখন বদলাতে শুরু করলো তখনও নিজেকে খানিকটা ধরেই রেখেছিলো । একবার যে অভিজ্ঞতা ওর হয়েছে সেটা যদি আবার হয় এই ভয়ে । কিন্তু ওর শরীর খারাপের এই কদিনে ও খুব ভাল করে বুঝতে পারলো না আবার ও মোটেই ভুল করতে যাচ্ছে না । ও এটা মেনেই নিয়েছিলো অন্য সবার মত ওর জীবনটা হবেনা । কিন্তু এখন মনে হতে লাগলো যে এমন কিছু হয়তো উপরওয়ালা ওর জন্য লিখে রেখেছে । হয়তো অন্য ভাবেই । মীরা আবারও প্রেমে পড়লো । অপুর প্রেমে !

তারপর থেকেই মীরার আরও বদলে গেল । অপুর দিকে সরাসরি তাকাতেও লজ্জা করতে লাগলো । বারবার মনে হল এতো দিনের বন্ধুত্ব্য ওদের হঠাৎ করেও সব সম্পর্ক বদলে গেল ওদের । অবশ্য যেদিক ওদের বিয়ে হয়েছিলো, কাজীর দেওয়া খাতায় সই করেছিলো সেদিনও সব কিছু বদলে গিয়েছিলো । দিনের পর দিন সেই বদলে যাওয়াটা আরও প্রকট আকার ধারন করেছে কেবল !

সাত

-এটা কি ইরা ?

-খুলেই দেখুন !

অপু নিজের কাজ করছিলো ঘরে বসে । এমন সময় ইরা এসে ওর হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল । সেটা খুলে পড়তেই খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো ইরার দিকে । কানাডার একটা ইউনিভার্সিটিতে ইরার স্কালরশিপ হয়েছে । আগামী মাস থেকেই ওর ক্লাস শুরু হবে । অপু খানিকটা অবাক চোখে তাকালো ইরার দিকে । ইরা বলল

-গত বছরও আমার এই লেটারটা এসেছিলো । আমি তখন যেতে পারি নি আপুকে ছেড়ে । ওকে একা রেখে কিছুতেই যাওয়া সম্ভব হয় নি আমার পক্ষে ।

-কাউকে বলও নি ।

-নাহ । আপু জানতে পারলে আমাকে ঠিকই জোর করে পাঠিয়ে দিত । নিজের কথা কোন দিন ও ভাবেও নি । সব সময় আমার কথাই ভেবেছে । তাই ওকে একা রেখে যেতে পারি নি । বারবার মনে হয়ে আমার বোনটা জীবনে কোন দিন একটু সুখ পেল না । একা একা কষ্ট করে গেল সারা জীবন । ওকে একা রেখে কিভাবে যাবো !

অপু বলল

-আর এখন ?

-এবার যাবো ঠিক করেছি । দুই বছরের জন্য, হয়তো সামনে মাস্টার্সের পর পিএইচডির জন্য ফান্ডিং পেতে পারি সেটা পরের ব্যাপার । আমি জানি আপনি ঠিক ঠিক আমার বোনটাকে দেখে রাখবেন । আর সুখেই রাখবেন ! আপুর আগে তাই আপনাকে কথাটা বললাম । অভিভাবক বলতে তো আপনি আর আপুই আর কেউ নেই আমার !

অপু কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না । ইরা বলল

-আপনি কি খেয়াল করেন নি আপু আপনার প্রেমে পড়ে গেছে ? আপনি যে যে কাজ গুলো করতে পছন্দ করেন সে এখন আরালে সেই কাজ গুলো করার চেষ্টা করে । দেখেছেন !

অপু নিজেও খুব ভাল করে লক্ষ্য করেছে ব্যাপার গুলো । ব্যাপার গুলো ওর নিজেরও ভাললাগছে ।

ইরা বলল

-আপনারা কি ভেবে বিয়ে করেছিলেন, ভেবেছিলেন নিজেরা নিজেদের মত থাকবেন কিন্তু , মানুষ যা ভাবে তা কখনও হয় না । যখনই আপনারা কবুল বলে বিয়ে করলেন তখনই আপনাদের মাঝে এক পবিত্র বন্ধনের সৃষ্টি হল । এটা উপরওয়ালার ম্যাজিক বলতে পারেন । যতই এটা থেকে দুরে যেতে চান না কেন পারবেন না । আমি জানি আপুর মত আপনারও একই অনুভূতি হচ্ছে । কিন্তু একটা সংকোচের কারনে কেউ বলতে পারছেন না । তাই না ?

অপু কি বলবে সত্যিই বুঝতে পারছে না । কিন্তু ইরা যে কথা গুলো বলল সেটা যে কোন ভাবেই মিথ্যা না সেটা ও নিজেও জানে । এক সাথে দিনের পর দিন যখন দুজন মানুষ থাকা শুরু করে তখন তাদের মাঝে এক আশ্চর্য বন্ধনের সৃষ্টি হয় ! সেটা ছিন্ন করা কিংবা অস্বীকার করা খুবই কঠিন একটা কাজ !

ইরা বলল

-আপনারা বন্ধু ছিলেন, স্বামী স্ত্রী হতে সমস্যা কোথায় ? দুজন দুজনকে এতো ভাল ভাবে চিনেন, তাহলে ?

অপু বলল

-জানি না । আসলে….

-কোন আসলে ফালসে না ! আপু খুব প্রবল ভাবে চাচ্ছে আপনি প্রথম পদক্ষেপটা নিন । দেখবেন সব কিছু অন্য রকম হয়ে যাবে।

তারপরের কয়েকটা দিন কাটলো খুবই ব্যস্ততায় । ইরার স্কলারশীপের কথা জানার পরে মীরা খুবই উত্তেজিত হয়ে গেল । সেই সব থেকে বেশি আগ্রহী যেন বোনকে কানাডা পাঠানোর ব্যাপারে । দেখতে দেখতে দিন চলেও এল ।

ওরা দুজনেই ইরাকে প্লেনে তুলে দিতে হাজির হল এয়ারপোর্টে । দুবোনের অনেকটা সময় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো কিছুটা সময় । তারপর ভেতরে প্রবেশ করার আগে ইরা অপুর কানের কাছে এসে বলল, আমি এসে যেন একটা জুনিয়র অপুকে দেখতে পাই । বুঝলেন ?

মীরার এক দিন দিয়ে যেমন খুশি লাগছিলো ঠিক তেমনি ভাবে অন্য দিকে কষ্টও লাগছিলো । জন্মের পর থেকে দুজন কখনও আলাদা থাকে নি । আজকে দুই বছরের জন্য অনেক দুরে চলে যাচ্ছে । ভাবতেই কান্না আসছে । ফেরার পুরোটা পথ অপুকে খানিকটা জড়িয়ে ধরেই কাঁদছিল । তখনই অপু সিএনজিওয়ালাকে সিএনজি থামাতে বলল ।

মিন্টু রোডের একটু দুরেই নেমে পড়লো ওরা । মীরার কন্না হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল । মীরা জানে এই মিন্টু রোডটা অপুর বেশ পছন্দ । এর আগেও ওরা এখানে এসেছে । এখানে একটা চায়ের দোকান আছে । ঠিক ডিবি অফিসের পাশে । সেখানে বসে দুজন চা খেয়েছে আর গল্প করেছে । কিন্তু এই রাতের বেলা এই প্রথম ।

একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে আছে । অপু ওর হাত ধরে হাটতে লাগলো আস্তে আস্তে । তারপর একটা ফুটপাত দেখে বসে পড়লো ওকে নিয়ে । বলল

-একা লাগছে তোর ? ইরা চলে যাওয়ায় ?

মীরা বলল

-কষ্ট লাগছে । ওকে ছেড়ে থাকি নি তো কোন দিন । তবে …..

-তবে ?

-একা লাগছে না । তুই আছিস । আমি জানি তুই থাকবি সব সময় । অন্য সব পুরুষের মত তুই হবি না । এই যে আমার হাত ধরেছিলো, কোন প্রতিজ্ঞা করিস নি তবুও তুই আমার পাশেই থাকবি । আমি কোন দিন আর একা হব না ।

কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল মীরা । কেমন করে বলল ও নিজেও জানে না । অনেক দিন থেকে এই কথা গুলোই বলার চেষ্টা করছিলো । আজকে বলে ফেলে শান্তি শান্তি লাগলো ওর ।

অপু হঠাৎ হাত দিয়ে মীরার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল । তারপর ওর ঠোঁটে গভীর ভাবে চুমু খেল ।

মীরা কেবল চোখ বন্ধ করে অপুর চুম্বনটা অনুভব করলো কিছু সময় । তারপর নিজেও প্রবল ভাবে সেই চুম্বনে অংশ গ্রহন করলো । ওরা যে বাইরে বসে আছে এটা কারো মনেই থাকলো না।

পরিশিষ্টঃ

মীরা খানিকটা ব্যাকুল ভাবে অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুই কিন্তু মন খারাপ করবি না !

অপু কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাবেয়া মীরাকে ধমক দিয়ে বলল, এই মেয়ে তোমাকে না বলেছি স্বামীকে তুই বলে না ডাকতে ! আর কিছু হবে মানে কি ?

অপু পাশেই ছিল । মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা ওকে বকছো কেন ?

রাবেয়া বলল, আহা ! এসছে আমার বউ পালগ ছেলে । বিয়ে করতে চাচ্ছিলি না আর এখন বউ ছাড়া কিছু বুঝিস না । আর বকবো না তো কি করবো । অলুক্ষ্যনে কথা কেন বলবে !

মীরার ব্যাথা উঠেছে । তবে চিন্তার কোন কারন নেই । ডাক্তার বলেছে যে সব কিছু ঠিক আছে । সব স্বাভাবিক । তবুও মীরার ভয় কাটছে না । রাবেয়া মীরার হাত শক্ত করে ধরে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে বলছে, কোন ভয় নেই । সব মেয়েই এই শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে । কিছু হবে না বুঝেছো, কিছু না । উপরওয়ালার নাম নাও ।

মীরার মনে হল ও হঠাৎ করেই অন্য জগতে চলে গেছে । ওকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে আসা হয়েছে । নরমাল ডেলিভারিই হবে । এক পাশে ওর শ্বাশুড়ি রয়েছে । মীরার হাত ধরে আছে আর কথা বলেই যাচ্ছে । অপুকে একটু আগে বের করে দেওয়া হয়েছে । বাইরের দেশের হাসপাতাল গুলোতে স্বামীকে ভেতরে থাকতে দেয় । এখানে দিতো সম্ভবত তবে তার শ্বাশুড়ি অপুকে থাকতে দেয় নি ।

মীরা কেবল তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে । হঠাৎ ওর মনটা আনন্দে ভয়ে উঠলো । আজকে থেকে ওর জীবনটা সত্যিইকার অর্থেই পরিপূর্ণতা পাবে । উপরওয়ালার প্রতি সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তাকে এই চমৎকার জীবন দেওয়ার জন্য ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 60

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “তোমার আমার পথ চলা”

  1. ভাই প্রতিদিন একটা গল্প দিয়েন!
    আপনার গল্প না পড়লে শান্তির ঘুম হয় না!
    পুরাতন গল্প হলেও চলবে প্লিজ!

Comments are closed.