সাজানো সত্যি বিয়ে

4.8
(88)

চোখ খুলতেই দেখলাম নিশি চায়ের কাপটা বিছানার পাশের টেবিলটাতে রাখলো । চায়ের কাপটা থেকে ধোয়া উঠছে ।
বিছানায় বেড টি খাওয়ার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিল না । কিন্তু এ বাড়ির নিয়ম কানুন সব আলাদা । কেমন একটা বড়লোক বড়লোক ভাব । অবশ্য নিশিরা এমনিতেই বড় লোক । বড় লোক ওয়ালা ভাব না থেকে কি পারে !
চায়ের কাপ থেকে চোখ সরিয়ে নিশির দিকে তাকালাম । মুখটা কেমন একটু চিন্তিত লাগল । উঠে বসতে বসতে বললাম, কি হয়েছে ? চেয়েহারা এমন কেন লাগছে ?
আমার দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, নাহ কিছু না । নে চা নে ।
-নিশি তোর কি লজ্জা শরম বলে কিছু নেই ।
-মানে কি ? লজ্জা শরম থাকবে না কেন ?
-আরে তোর জামাই, রীতিমত পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহ দিয়ে বিয়ে করেছি । আর তুই আমাকে তুই তুই করছিস ।
-ওহ ! অপু ফাজলামো করবি না তো ! এমনিতেই টেনশন লাগছে খুব । আর তার উপর তুই ফাজলামো শুরু করেছিস ।
-টেনশনের কি আছে ?
নিশি বলল, তোর কোন টেনশন নাই । সব টেনশন তো আমার ! কি ঝামেলায় যে আমি পরেছি ! দাদী মনে হয় এবার রিকভার করে ফেলবে !
-কি বলছিস তুই ?
কথাটা এমন ভাবে বললাম যেন নিশির দাদি এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে । কিন্তু একটু পরে নিজের কাছেই লজ্জা লাগল । ছি ছি কি ভাবছি আমি । আমি বললাম
-সরি !! কিছু মনে করিস না ।
-না ঠিক আছে । আমিও খানিকটা চিন্তিত । আমি ভাবিনি এমনটা হবে ! নিজে আটকেছি তোকেও আটকেছি । তার উপর …
নিশি চুপ করে গেল ।
-তার উপর ?
নিশি বলল
-বাবা তোকে আজ অফিস নিয়ে যাবে বলছিল !
-কি বলিস তুই ? উনি কি সিরিয়াস ?
-হুম ।
-সেকি ! কি সর্বনাসের কথা ? কেন ?
-কেন মানে ? তুমি তার এক মাত্র মেয়ের একমাত্র জামাই । তোমাকেই তো সব কিছুর দায় দায়িত্ব নিতে হবে !
-আরে জামাইয়ের গুল্লি মারি !
কথাটা মনে হয় একটু জোরেই বলে ফেলেছিলাম । নিশি বলল
-আরে আস্তে !
আমি গলা নামিয়ে বললাম
-জামাইয়ের গুল্লি মারি । জামাই তো আর আসল না । ভূয়া জামাই ।
-জামাই যে ভূয়া সেটা তুই জানিস , আমি জানি , কিন্তু তোর শ্বশুর মশাই তো আর জানে না ।
-নিশি তা তো আমি জানি । তুই কি বুঝতে পারছিস যে এই খবর যদি আমার বাসায় পৌছায় তাহলে কি হবে ? আমার বাপ যদি জানতে পারে যে আমি বিয়ে করে ফেলেছি তাহলে আমাকে স্রেফ গুলি করে দিবে । আর তুই আমার বৌ না তোকেও গুলি করবে । আমার বাবার কাছে একটা ব্রিটিস আমলের দোনালা বন্দুক আছে । আমার দাদার ।
-বন্দুক আছে বুঝলাম কিন্তু আমাকে কেন গুলি করবে কেন ? আমি কি করেছি ?
-কি কয়েছিস ? আমার বাপ কি মনে করে জানিস ? আমার বাপ মনে করে আমি হলাম গাধা আর আমাকে যে বিয়ে করবে সে হবে আমার থেকেও বড় গাধা । আর তার মতে গাধাদের বেশি দিন বেঁচে থাকার অধিকার নাই ।
নিশি বলল
-ঠিক আছে । বেশি কথা বলতে হবে না । ফ্রেস হয়ে জলদি নাস্তার টেবিলে আয় ।

নিশি আমাকে রেখে চলে গেল । আমি বাথরুমে ঢুকলাম । আমার মনটা ভাল হয়ে গেল । নিশির এই বাথরুমটা আমার খুব পছন্দ ।
পুরো বাথরুম টা একদম নীল রংয়ের । বাথটাব টাও নীল রংয়ের । যখন বাথটাবে গা ভিজিয়ে শুয়ে থাকি জীবনটা বড় আনন্দতময় মনে হয় । ইস যদি নিশি ঐ দিন আমাকে কথাটা না বলতে তাহলে এই নীল বাথরুমে গোছল করাই হত না । জীবনটা অর্ধেক বৃথাই হয়ে যেত !

নিশি সাথে সাখ্যতা প্রথম থেকেই ছিল । তুই তোকারির সম্পর্ক । প্রথম থেকেই ও আমার খুব ভাল বন্ধু । তাই বন্ধুর উপকার করতে এসেছিলাম আর এসে যে এমন ভাবে আটকে যাবো ভাবি নি ।
ক্লাসে একদিন নিশি আমাকে দেকে বলল
-তুই কি কয়দিনের জন্য আমার হাজবেন্ড হতে পারবি ?
আমি প্রথমে ভেবেছিলা নিশি হয়তো এমনিতেই ফান করছে কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল না ও বেশ সিরিয়াস !
-তুই কি সিরিয়াস ?
-রাজি কি না বল ? না হলে অন্য কারো কাছে যাই !
-কেস টা কি আগে বল ? তারপর না হয় বলি । নিশি বলল
-এখানে বলা যাবে না । আগে বাইরে চল ।
ক্যাম্পাসে বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম ।
-এবার বল !
নিশি কিছুক্ষন চিন্তা করে নিল । যেন কিছু গুছিয়ে নিল । তারপর বলল
-আমার দাদীর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল । আই সিইউ তে আছে । খুব বেশি দিন আর স্টে করবে না।
-ও !
-দাদীর খুব ইচ্ছা মরার আগে উনি তার নাত জামাই দেখ যাবেন ।
-ও !
-ও ! মানে ?
আম কিছু বুঝলাম না । নিশি বলল
-আরে গাধা, মানে হল আমার জামাই দেখতে চান উনি !!
আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম নিশির দিকে । এই মেয়ে ঠিক কি বলতে চাইছে ?
নিশি বলল
-আমি চাই তুই আমার হাসবেন্ড হয়ে দাদীর সামনে যাবি !!
-একটা কথা বলব?
-বল !
-আমি যতদুর জানি তুই তোর দাদিকে একদম পছন্দ করিস না । তাহলে ?
-আর বলিস না । আমি পছন্দ না করলে কি হবে আমার বাপতো তার মাকে পছন্দ করে ! নিজের মার শেষ ইচ্ছা বলে কথা ! আমাকে তো আর জোর করে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু আব্বুর মুখটা দেখে আমা রকেমন জানি খুব মায়া লাগছে !
-তাহলে সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেল !
নিশি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-দেখ এডভাইস দিবি না । তুই হেল্পটা করবি কি না বল !!
-তা না হয় করলাম ! কিন্তু যখন সত্য টা সামনে আসবে তখন কি করবি ? তোর বাপকে কি জবাব দিবি ?
-সে চিন্তা আমার !! এখন এই ঝামেলাটা তো দুর হোক !! তুই হবি ?
আমি হাসলাম । বললাম
-হতে পারি !! একটু নাইসলি বল ! আমার সামনে হাটু গেড়ে বল যে অপু হাসান আমি তোমার প্রেমে দেওয়ানা হয়েছি । তুমি কি আমার হাসবেন্ড হবে ?
-আহা !! সাধ কত !!
-কি বলবি না ?
-মরে গেলেও না ।
-ওকে আর কি করা ! তবে একটা কথা । এই কথা যেন আমার বাসায় না পৌছায় !! যদি আমার বাপ জানতে পারবে তাহলে কিন্তু আমার খবর আছে !
-আরে কোন সমস্যা নাই ! ভার্সিটি তো এখন বন্ধ ! সপ্তাহ খানেক তুই আমাদের বাসায় থাকবি । ব্যাস ! আর কিছু না ।
-তোদের বাড়ি মানে ঘর জামাই !
নিশি হাসলো !

আমরা ভেবেছিলাম নিশি দাদি খুব বেশিদিন টিকবে না । আর আমাদের কোন সমস্যা হবে না । কিন্তু এখন দেখছি অবস্থা খারাপ ! যদি এ যাত্রায় টিকে যায় আমার তো খবর আছে !!
আর কোন ভাবে যদি বাসায় জেনে যায় তাহলে তো আর কোন কথাই নাই !!

চুপচাপ নাস্তা খাচ্ছিলাম । এমন সময় নিশি বাবা বলল
-আজকে তোমাদের দুজনের কোন প্লান আছে নাকি ?
নিশি বলল
-কেন আব্বু ?
-না আলসে আমি অপুকে আমাদের অফিসে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম । কি বল অপু?
আমি নিশির দিকে তাকালাম । ও চোখ দিয়ে ইসারা করলো না বলতে । আমি নিশির বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম
-আমি অফিসে গিয়ে কি করবো ?
নিশির বাবা বলল
-এটা কেমন কথা ! সামনে গিয়ে তুমি তো অফিরের দায় দায়িত্ব নিবে !
-আমি ?
আমি হাসলাম ! বললাম
-কিন্তু আমি কিভাবে নিবো ?
-এ সব তো এখন তোমারই !
-আঙ্কেল আপনার একটু ভুল হচ্ছে মনে হয় ! আপনি হয়তো ভেবেছেন নিশির হাসবেন্ড হিসাবে আমি এসব কিছুর দায়িত্ব আমি নিব কিন্তু আমি এটা করতে পারবো না ।
নিশির বাবা আমার দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো । আমি বললাম
-এসব কিছু আপনার আপনার থেকে নিশি পাবে । এগুলোর মালিক নিশি হবে ।এর দেখা শুনার দায়িত্বও নিশির । যদি এর সব কিছুর দায়িত্ব আমি নেই তাহলে মানুষ বলবে যে আমি শ্বশুরের টাকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি । এটাতে আমার আপত্তি আছে । আমি আমার নিজের যোগ্যতায় বড় হতে চাই !
আমার কথা শুনে নিশির বাবা বেশ পুলকিত হলেন বলে মনে হল । নিশিও দেখলাম অর্থপূর্ণ চোখ তাকালো !
নিশির বাবা বলল
-আচ্ছা তুমি যা চাও তাই হবে ! আমি জোর করবো না । তা তোমার বাবার নাম্বার টা আমাকে একটু দাও !!
আমার বুকের ভিতর কেমন করে উঠল ।
-জ্বি??
নিশি বলল
-আব্বু তোমাকে আমি কি বলেছিলাম !
-আরে আমার মনে আছে তো ! আমি ওনাকে আগেই বিয়ের কথা বলবো না । আমি ওনাকে আগে বিয়ের জন্য প্রপোজাল পাঠাবো ! রাজিতো হয়েও যেতে পারে । তারপর দেখা যাবে । আর যদি না রাজি হয় তাহলে ফোন রেখে যাবো ! কোন তো সমস্যা নাই !
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-দাও নাম্বার টা দাও !
আমি একবার নিশির দিকে তাকালাম আর একবার নিশির বাবার দিকে তাকালাম ।
মোবাইল টা বের করতে যাবো ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল ।
আব্বার ফোন !!
আমার বুকটা ধুক করে উঠল !
আমি ফোন রিসিভ করলাম
-আস্লামালাইকুম আব্বা !
-কোথায় তুমি?
সর্বনাশ ! তুমি??
আমার আব্বা আমাকে সবসময় তুই করে বলেন কিন্তু যখন কোন সিরিয়াস বিষয় হয় তখন তুমি !
তারমানে কিছু হয়েছে !!
কি হয়েছে ?
-কি হল কথা বলছো না ? কোথায় তুমি ?
-আমি ?
-শ্বশুর বাড়ি ??
আমার বুকটা মনে হল এখনই ফেটে যাবে ।
আমি শ্বশুর বাড়ি এটা আমার বাপ জানলো কিভাবে ?
-তুমি থাকো ওখানে আমি আসছি তুমি এতো বড় লায়েক হয়ে গেছ যে আমাকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছ । তার উপর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠছ,ঘর জামাই হয়ে ! তুমি থাকো আমি আসছি !!
আব্বা ফোন রেখে দিল ।
ফোন রাখার পর নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে ?
আমার আব্বা আসছে !
-মানে ? উনি জানলেন কি ভাবে ?
-আমি কিভাবে বলবো ?
আমি উঠে পড়লাম । এখানে থাকা এখ ন একদম নিরাপদ নয় ।
আমার অবস্থা আসলে খারাপ । নিশির আব্বা বলল
-আরে তুমি এতো ভয় পাচ্ছ কেন ?
-আপনি আমার বাবা কে চিনেন না ? উনার মত রাগি মানুষ আমাদের এলাকাতে আর একটাও নাই ! আমাকে যদি এখন এখানে পায় একদম চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে ! আমাকে এখন পালাতে হবে । যে করেই হোক !!
-আরে পালাবে কেন ?
নিশির বাবা কি যেন ভাবলো !
-আচ্ছা ঠিক আছে । তোমাদের তো হানিমুন হয় নি ! আর মার অবস্থাও এখন মোটামুটি ভাল । তোমরা এক কাজ কর, সিলেট চলে যাও ! ঠিক আছে ! ওখানে আমার একটা বাংলো বাড়ি আছে । ওখানে কয়দিন থেকে আসো !
আর আমি এদিকে তোমার বাবার জন্য ওয়েট করি । উনি আসলে না হয় ওনাকে সামলাবো আমি !

আমি আর কিছু ভাবলাম না । আসলে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । আমার কেবল মনে হচ্ছে আব্বা আসার আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে !
আমি জলদি ঘরের দিকে রওনা দিলাম । নিশি আমার পেছন পেছন এল !!

দুই

বাবা আমার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছেন তার ব্রিটিশ আমলের বন্দুক নিয়ে ! আমি দৌড়াচ্ছি প্রানপনে কিন্তু যতই দৌড়ানোর চেষ্টা করছি কেন জানি খুব বেশি এগিতে পারছি না । প্রতি মুহুর্তে বাবার দোনালা বন্দুকটা এগিয়েই আসছে ।
আমি তো টেনশনে পড়ে গেলাম ।
-এই একটু আস্তে দৌড়াও !
আমি ডান দিকে তাকিয়ে দেখি আমি কেবল একা দৌড়াচ্ছি না আমার সাথে নিশিও দৌড়াচ্ছে । সব চেয়ে অবাক হওয়ার কথা নিশি দৌড়াচ্ছে বউ এর সাজে । যেন বিয়ের আসর থেকে আমি ওকে নিয়ে পালিয়েছি ।
নিশির পরনে লাল রংয়ের একটা ল্যাহেঙ্গা । আর সারা শরীর জুড়ে গহনা ভর্তি !! গহনার ভারে ঠিক মত দৌড়াতেও পারছে না ।
আমি বললাম
-তুমি এরকম গহনা আর ল্যাহেঙ্গা পরে দৌড়াচ্ছ কেন ?
-গাধার মত প্রশ্ন করবে না । গহনা ফেলে দৌড়ানোর থেকে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া ভাল !
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম । পেছনে একজন বন্দুক নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর এই গহনার পেছনে লেগে আছে ! আশ্চর্য মেয়েদের সাইকোলজি !!
আমি দৌড়াতে দৌড়াতেই হোচট খেয়ে পরে গেলাম । ভেবেছিলাম খুব ব্যাথা লাগবে কিন্তু ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । বিছানায়উঠে বাসেও দেখলাম বুকের ভিতর কেমন ধরফর করছে !
মাই গড !!
যদি এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায় !!
তাহলে উপায় আছে !!
অবশ্য সত্যি হবার সম্ভাবনা কম !! আব্বা এখানে আসতে পারবে না !
মনটা একটু শান্ত হলে বিছানা ছেড়ে জানালায় কাছে আসলাম । বাইরে তখনও খুব বেশি আলো ফোটে নি । বাড়ান্দার দিকে চোখ পড়তেই আমার মনটা ভাল হয়ে গেল ।
এই সকাল বলা নিশিকে দেখলাম বারান্দায় উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে , হাতে একটা কাচের মগ ! ভিতরের তরলের রং দেখেতো মনে হচ্ছে কফি !
কি রে ভাই চা বাগানে বেড়াতে এসে কফি খাচ্ছে !!
আমি বারান্দার বেড়িয়ে এলাম ! আামর পায়ের আওায়জ পেয়ে নিশি আমার দিকে ফিরে তাকালো !
-চারিদিকে চা বাগান রেখে কেউ যদি তার মাঝখানে কফির মগ নিয়ে বসে থাকে তাহলে তাকে কি বলা উচিত্‍ ?
ধোয়া ওঠা কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে নিশি আমার দিকে তাকাল ভাল করে।
কাল নিশিকে যত খানি চিন্তিত মনে হচ্ছিল আজ ততখানি মনে হচ্ছে । নিশি বাংলোর বারান্দায় বসে আছে পা ঝুলিয়ে । আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম ।
-এই চা বাগানে কফি পেলি কোথায় ?
নিশি এবারও কিছু বলল না । কাচের মগটা আমার পাশে রেখে সামনে তাকাল ।
-জানিশ এই জায়গা আমার খুব পছন্দের । এখানে বসে থাকলে মনে হয় বসেই থাকি । আর সকালবেলাটা কি যে চমৎ‍কার লাগে এখানে বসে থাকতে !
-হুম তাই তো দেখছি । শ্বশুর মশাই জব্বর একখ্যান বাড়ি কিনছে !
নিশি আমার দিকে তাকাল ।
-খুব আনন্দে আসিছ মনে হচ্ছে ! কাল তো লেজ গুটিয়ে কেমন দৌড় মারলে ! দেখলাম তো আমি ! আর এখন ?
-আসলে এখন কেন জানি আর ভয় লাগছে না । মনে হচ্ছে না যে আব্বা এখানে আসতে পারবে ! আর সকাল বেলা এমন একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল !! আর ……
-আর ?
-আর সকালবেলা তোকে এই এখানে বসে থাকতে দেখে কেন জানা খুব ভাল লাগল । মনে হল .. মনে হল যে গল্পের কোন নায়িকা বসে আছে বারান্দায় । একটু একটু করে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে । চমৎ‍কার একটি গল্পের শুরু ।
মগটা তুলে এবার আমি চুমুক দিলাম । আমি ভেবেছিলাম নিশি হয়তো চিত্‍কার করে উঠবে ।
কিন্তু কিছু বলল না । আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন । তারপর
-বলল চল ঐ দিকটা যাই ।
বলেই নিশি বারান্দা থেকে ঘাসের উপর লাফ দিল ।
-দাড়া ঘুরে আসছি ।
-আরে এই খান দিয়ে আয় না ।
-স্যান্ডেল পরে আসি ।
নিশি বলল
-আমি খালি পায়ে আসতে পারলে তুই পারবি না ? আর সকাল বেলায় খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা । আয় ।
আমি ওখান থেকেই নিচে নেমে এলাম । নিশির সাথে হাটতে লাগলাম । সত্যি বলব কি আমি কখনও ভাবি নি আমার জীবনে এমন দিন আসবে ! এমন একটা চমৎ‍কার একটা দিন ।
আমরা দুজন এমন সুন্দর সকালে হাটছি পাশাপাশি । নিশি টুকটাক কথা বলছে । আমি চারিদিক দেখছি । চারিদিকের পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে ফেলছে ।
হাটতে হাটতে আমি দাড়িয়ে গেলাম কিছুক্ষনের জন্য । নিশি তখনও কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে । আমি যে দাড়িয়ে পরেছি ও এইটা লক্ষ্য করে নি । যখন লক্ষ্য করলো তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কিরে দাড়িয়ে পরলি কেন ?
আমি একটু দৌড়ে ওর সামনে এসে দাড়ালাম । নিশি আবার বলল
-দাড়িয়ে পড়লি কেন ?
-তোকে দেখছিলাম ।
নিশি আবারও কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল ।

দিন ভালই কাটতে লাগলো । সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই নিশির সাথে । সকাল বেলা একসাথে হাটতে বের হই খালি পায়ে, রাতে একসাথে জোঁছনা দেখি দুজন ! জীবনটা কেন জানি খুব সুন্দর হয়ে গেল । কিন্তু কয়দিনের জন্য ! এই মিথ্যা আর কয়দিন !!
এখান থেকে ফিয়ে গেলে আবার তো …….
আচ্ছা এই মিথ্যা টা কি সত্যি হতে পরে না ?
ছিঃ কি ভাবছি ?
নিশি শুনলে কি ভাববে ?
তবে চিন্তা টা আবার আমার মাথায় এলো । ঐদিন রাতে বারান্দায় বসে ছিলাম দুজন । বাইরে খুব সুন্দর জোঁছনা উঠেছে । আমি মাঝে মাঝে নিশির দিকে তাকাচ্ছি ।
নিশি তাকিয়েই আছে বাইরের দিকে ! হঠাৎ নিশি বলল
-অপু ঘুম আসছে !
-ভিতরে যাবি ।
-না ভিতরে যেতে ইচ্ছা করছে না । তোর কোলে মাথা রেখে একটু শুব ?
আমি একটু অবাক হলাম । হেসে বললাম
-শুবি ? শো !
নিশি আমার মাথা রেখে শুয়ে পড়লো । আমি আস্তে আস্তে নিশির মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম । আমার মনে মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হতে লাগলো ! আশ্চার্য ভালা লাগার অনুভুতি !!
-অপু !
-হুম !
-আমি একটা অন্যায় করেছি । তুই কি আমার উপর রাগ করবি ?
-কি করেছিস ?
নিশি কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়েই রইলো ।
-কি হল বল !
-না বলব না । থাক !
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । একন না হোক পরে একসময় জিজ্ঞেস করে নিবো । এখন এই চমৎকার সময়টা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না ।

সকাল বেলা আবার সেই একই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল । আব্বা বন্দুক নিয়ে আমার পেছনে দৌড়াচ্ছে । তবে আজ হোচট খাওায়ার আগেই ঘুম ভাঙ্গল । নিশির ডাকে ।
-উঠ !
-গুড মর্নিং !
-তোকে গড মর্নিং বলতে পারছি না !
-কেন ?
নিশি কোন কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । আমি বিছানা থেকে উঠে ওর পেছন পেছন গেলাম । বারান্দায় এসে আমার বুকে ৪২০ ভোল্টের একটা শক লাগলো !! আমার মনে হল নিশির পেছন না আসাই বোধ হয় ভাল ছিল ।
বারান্দায় একটা টেবিল পাতা ছিল । টেবিলের চারপাশে চারটা চেয়ার । সেই চারটা চেবিলের একটাতে আব্বা বসে আসে । আর একটাতে নিশির আব্বা ! তিন নম্বরটাতে নিশি গিয়ে বসলো । আমার প্রথমে মনে হল আমি স্বপ্নই দেখছি । এইটা তো হতে পারে না । কিন্তু স্বপ্নতো একটু আগে দেখছিলাম । নিশি আমাকে দেকে আলনো । তাহলে কি স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি । ইনসেপ্শন মুভিতে যেমন হয় !
আব্বা চা খাওয়ায় ব্যস্ত আমার দিকে তাকায় নি এখনও । আম কি করবো ঠি এখনও আমার মাথায় কাজ করছে না !
দৌড় কি মারবো ??
নিশির আব্বা বলল
-দাড়িয়ে কেন ? বস ! নিশি একে চা দে !
নিশি টিপট থেকে চা ঢালতে শুরু করলো । আমি দুরুদুরু বুক নিয়ে বসলাম চেয়ারে ।
চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আব্বা নিশির দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমারা কবে বিয়ে করেছ ?
নিশি বলল
-জি আঙ্কেল, এই দুই সপ্তাহ আগে !
আব্বা নিশিকে জোরে একটা ধমক দিল । এতো জোরে যে আমার হাত থেকে চায়ের কাপ পরে যেত । আব্বা বলল
-আঙ্কেল বলছো কেন ? আমি তোমার আঙ্কেল হই ?
আমি ভেবেছিলাম নিশি ধমক খেয়ে ভয় পাবে অথবা মন খারাপ করবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নিশি হেসে ফেলল।
আরে এই মেয়ের সমস্যা কি ?
এই মেয়ে হাসে ক্যান???
নিশি বলল
-সরি বাবা !!
আব্বা বলল
-কোথায় করেছ বিয়ে ?
-জ্বি মগবাজার কাজী অফিসে !!
-দেন মোহর কত করেছ?
আমি পড়লাসম বিপদে । আল্লাই জানে নিশি কি বলে !!!
-জ্বি ! ৫ লক্ষ এক টাকা !!
এবার আব্বা আমার দিকে তাকাল
-বিয়ে যে করলি বউকে দেন মোহরের টাকা দিবি কোথা থেকে ?
আমি মনে মনে একটু প্রসন্ন বোধ করলাম । আব্বা তুমি থেকে তুই তে নেমে এসেছে ! তার মানে রাগ একটু কমেছে !
কিন্তু !!
পরক্ষনেই আমার মনে আর একটা চিন্তা মাথায় এল ! আব্বার ভাব চক্কর দেখে মনে হচ্ছে তো আব্বা আমার আর নিশির বিয়েটা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে !
ও মাই গড !!
এটাতো আরো বড় সমস্যা !!
বাবা যদি কাবিনা নামা দেখতে চায় ?? ওটা নীলক্ষেত থেকে বানানো !! আমার মনের কথা মনেই রইল । বাবা বলল
-কাবিন নামা কোথায় ?
সর্বনাশ !!
-আঙ্কেল ওটা তো সঙ্গে আনি নি ।
বাবা আবার নিশির দিকে তাকাল । নিশি একটু জিহ্বা কামড়ে বলল
-বাবা !!
নিশির বাবা এতোক্ষন চুপ ছিল । বাবাকে বলল
-আরে বিয়াই সাহেব এবার একটু শান্ত হোন !! আমি তো আপনাকে বললামই ওদের খুব একটা দোষ নাই । আমার ময়ের জন্য ওরা এমন করেছে !
তারপর নিশি কে বলল
-তুই জামাইকে ঘরে নিয়ে যা । আমি বিয়াই সাহেবের সাথে একটু কথা বলি !!
নিশি আমাকে নিয়ে পেছনের বারান্দায় চলে এল । আমি একটু হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । আব্বার সামনে ঠিক মত দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিল ।
নিশি আবার বারান্দা থেকে পা ঝুলিয়ে বসল
আমি বললাম
-আমার বাপ এখানে আসলো কিভাবে ? আর তুই বুঝতে পারছিস কি হতে চলেছে ? এরাতো আমাদের সত্যি সত্যি বিয়ে দিবে !! আমি তো কিছু ভাবতেই পারছি না ।
নিশি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন !! তারপর আমার হাত ধরে বলল
-আমার সাথে বিয়ে হলে কি তোর অনেক সমস্যা হয়ে যাবে ?
নিশির কথা আমি কিছুই বুঝতেই পারলাম না ! বললাম
-মানে ?
-মানে হল আমি চাই তো সাথে আমার ……..
নিশি চুপ করে গেল। আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিশির দিকে । এতোদিনের পরিচিত নিশিকে বর অপরিচিত মনে হতে লাগলো !!
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর নিশি বলল
-আব্বু যখন বিয়ের কথা বলল, জানিস সবার আগে আমার তোর কথাই মনে হয়েছে ! নকল হোক আর আসল হোক আমি এটাই চেয়েছি !
নিশি আমার হাত টা ছেড়ে দিল ।
-কিন্তু তুই যদি না চাস তাহলে এখনও তেমন কিছুই হয়নি !!
আমার কেন জানি রাতের সেই ভাল লাগার অনুভুতিটা ফিরে এল । বললাম
-তুই কি আমাকে তুই করেই বলবি বিয়ের পর ? তাহলে কিন্তু হবে না ! তুমি করে বলতে হবে ! পারবি ??
নিশি হেসে ফেলল
-তোকে কোনদিন তুমি বলব না !!
-আচ্ছা যা ইচ্ছা বলিস । কিন্তু যে মিথ্যাটা ওনারা সত্য ভেবে বসে আছে, সেটার কি হবে ?
-ব্যাপার না !
-তবে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না যে আমার আব্বা কে এই খবে দিলো কে !
এবার নিশি আমার দিকে তাকাল । বলল
-আসলে তোকে একটা কথা বলতে চেয়েছিল ।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আবার বলল
-তোর আব্বা কে আমি ফোন করে সব বলেছিলাম।
-কি??
-প্লিজ রাগ করিস না !
-রাগ করবো না ??
নিশি আর দাড়াল না । বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে বাগানের দিকে দৌড় মারলো !
-তুই কোথায় যাস ! দাড়া !!
আমি নিজের ওর পেছন পেছন দৌড় লাগালাম ! আজকে ওকে ধরতে পারি তারপর মজা দেখাবো । তবে কেন জানি আমার মনের ভেতরে একটা অন্য রকম আনন্দ হচ্ছে । নিশিকে নিজের মত করে পাওয়ার আনন্দ ।

এই গল্পটা সেই ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা । আমার খুব পছন্দের একটা গল্প।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 88

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →