লা ইয়ারোনা

3.9
(16)

ছোট একটা ছেলে একা একা নদীর ধার দিয়ে হাটছে আপন মনে । এমন সময়ে সে শুনতে পেল একটা কান্নার আওয়াজ । কাছে পিঠেই কেউ কাঁদছে । ছেলেটা কৌতুহলী হয়ে উঠলো । কান্নার আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে শুরু করলো । যতই এগিয়ে যেতে শুরু করলো ততই কান্নাটা আরও স্পষ্ট আকারে শুনতে পেল সে । একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ । কিছুদুর যেতেই সে দেখতে পেল তাকে । সাদা পোশাক পরা এক মেয়ে পানির পাশে বসে রয়েছে মাথা নীচু করে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । ছেলেটি আরও কাছে এগিয়ে গেল । তখনই সাদা পোশাক পরা মেয়েটি খপ করে ছেলেটির হাত চেপে ধরলো । তার ভয়ংকর চেহারা দেখে ছেলেটি ভয়ে চিৎকার করে উঠলো । নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । সাদা পোশাকের মেয়েটি ছেলেটিকে টেনে পানির ভেতরে নিয়ে গেল । এই সাদা পোশাকের মেয়েটি লা ইয়ারোনা নামে পরিচিত । এটি মেক্সিকোর একটা আরবান লেজেন্ড ।

source: deadline.com

পুরো পৃথিবী জুড়ে কত রকম মিথ আর লেজেন্ড যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কোন ঠিক নেই । আমাদের দেশের মেছো ভুত গেছো ভুতও সেই লেজেন্ডের ভেতরে পরে। নানান সময়ে এই সব লেজেন্ড আর মিথ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ । এরই কিছু অংশ খুজে পাওয়া যায় বিভিন্ন গল্প উপন্যাস মুভি কিংবা নাটকে । মানুষ এসব গল্প ব্যবহার করে নিজেদের বিনোদনের জন্য। এগুলোই সেই অঞ্চলের কালচারের একটা অংশ । লা ইয়ারোনা আরবান লেজেন্ডটি মেক্সিকো, সাউথ টেক্সাস এবং ল্যাটিন আমেরিকা্র দেশ গুলো কয়েকশ বছর ধরে টিকে আছে । লা ইয়ারোনা শব্দের অর্থ হচ্ছে দ্য উইপিং ওম্যান । নদীর ধারে কাঁদতে থাকা মেয়েটি ।

লেজেন্ড অনুযায়ী, মেক্সিকোর কোন এক গ্রামে মারিয়া নামের এক চমৎকার মেয়ের বসবাস ছিল । মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দর ছিল তেমনি ছিল আকর্ষনীয় । একদিন মেয়েটি নিজের বাসার সামনে বসে ছিল । সেই সময়ে এক সম্ভ্রান্ত শহুরে পুরুক (মতান্তরে বড়লোক এক স্প্যানিশ) সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো । মারিয়াকে প্রথম দেখেই তার ভাল লেগে যায় । এবং সে নিয়মিত মারিয়ার সাথে দেখা করতে আসে । এক সময়ে তাদের প্রেম হয় এবং তাদের বিয়ে হয় । এভাবেই বেশ কিছু বছর চলে যায় । মারিয়া ততদিনে দুটো ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছে । কিন্তু মারিয়া এক সময়ে আবিস্কার করে যে তার স্বামী ঠিক আগের মত আর নেই । আগের মত তাকে ভালোবাসে না, তাকে সময় দেয় না । মাঝে মাঝে সে মাসের পর মাস থাকে শহরে । মারিয়ার কাছে কম আসে । এমন একদিন মারিয়ার স্বামী ফিরে এসে জানায় যে সে আর মারিয়ার সাথে থাকবে না । তা তাকে ছেড়ে চলে যাবে এবং তার নিজের সম্ভ্রান্ত গোত্রের এক মেয়েকে বিয়ে করবে । সে তার ছেলেদের নিতে এই কথা শুনে মারিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । সে অনেক অনুনয় বিনয় করে কিন্তু তার স্বামীর মন গলে না । শেষে এক সময়ে মারিয়া তার স্বামীর কাছে অনুরোধ করে যাতে শেষ বারের মত সে তার দুই ছেলের সাথে খেলা করতে পারে । স্বামীর মনে দয়া হয় এবং তাকে সুযোগ দেয় ।

মারিয়া তার দুই ছেলেকে নদীর ধারে নিয়ে যায় এবং স্বামীর উপরে ক্রোধ জন্ম নেয় । সে ভাবে যে কিভাবে সে স্বামীকে আঘাত দিতে পারবে যেমন ভাবে তার স্বামী তাকে আঘাত দিয়েছে। তখনই সে তার স্বামীকে আঘাত দেওয়ার জন্য তার দুই ছেলেকে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলে । মেরে ফেলার পরেই সে বুঝতে পারে কি ভুল সে করেছে । কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে । এই দুঃখ সইতে না পেরে সে নিজেও নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে । কিন্তু পরজীবনে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না । তাকে বলা হয় সে নিজের দুই ছেলে ছাড়া সে হেভেনের দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না । তারপর থেকেই মারিয়া বারবার ফিরে আসে । কাঁদতে কাঁদতে তার দুই ছেলে কে খুজে ফেরে । যে বাচ্চারাই তার কান্না শুনতে পায় এবং তার দিকে এগিয়ে যায় সেই বাচ্চাদেরই সে পানির ভেতরে নিয়ে যায় । অনেক স্থানে আবার এই কথাও আছে যে কেবল বাচ্চারাই নয় যে তার কান্না শুনতে পায় তাকেই সে পানিতে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে ।

এর আরও একটা ভার্শন রয়েছে । এনসিয়ান্ট গ্রিক টেল অনুযায়ি জিউস স্ত্রী হেরার অগোচরে এক ডেমি-গডেস লামিয়ার সাথে প্রণয় করে এবং এক সময়ে তাদের কয়েকটা সন্তান জন্ম নেয় । এই খবর যখন হেরা জানতে পারে তখন সে লামিয়ার ঐ সন্তান গুলোকে মেরে ফেলে । এরপর লামিয়া হিংসাত্বক হয়ে অন্য সব মেয়েদের সন্তানদের মেরে ফেলতে থাকে ।

মূলত এই লা ইয়ারোনার লেজেন্ডটা মায়েরা তাদের সন্তানদের ভয় দেখাতে ব্যবহার করে থাকে । তাদেরকে বলে যে যেখানে সেখানে একা একা যেন তারা ঘুরে না বেড়ায়, সব সময় যে বাসায় থাকে । এই রকম অনেক গল্প আমাদের দেশেও আছে । তার ভেতরে একটা হচ্ছে জুজু । আামদের দেশের মায়েরা এমন ভাবে তাদের বাচ্চাদের জুজুর ভয় দেখায় । এটা করো না জুজু চলে আসবে, ওখানে যেও না জুজু চলে আসবে ।

লা ইয়ারোনার কাহিনী নানান সময়ে মুভি কিংবা গল্পে দেখা গেছে । ১৯৩৩ সাথে মেক্সিকোর লা ইয়ারোনা নামে একটা মুভি তৈরি হয় যার কাহিনী এই আরবান লেজেন্ড থেকে নেওয়া । এছাড়া ১৯৬০ সালেও একই নামে আরেকটা মুভি তৈরি হয় সেখানে । ১৯৬৩ সালের দ্য কার্স অব ক্রায়িং ওম্যান, ২০০৬ সালের কিলোমিটার মুভির কাহিনী লা ইয়ারোনার লেজেন্ড থেকে অনুপ্রাণীত । অতি সম্প্রতি, ২০১৯ সালে আমেরিকাতে দ্য কার্স অব লা ইয়ারোনা মুক্তি পেয়েছে । মুভিটাও একই কাহিনী নিয়ে তৈরি । এছাড়া থিয়েটার নাটক, গান এবং গল্পেও লা ইয়ারোনার উপস্থিতি এসেছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 3.9 / 5. Vote count: 16

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →