হ্যান্ডসেইক করবে না

4.8
(45)

-তোমার অফিসের লোকজন কেমন বয়স্ক ।

আমার নজর তখন বিফ বার্গারটার দিকে । তৃষা আমাকে বাইরের খাবার একদমই খেতে না । তার কথা হচ্ছে সব সময় বাসার জিনিস পত্র খেতে হবে হবে । কোন ভাবেই বাইরের জিনিস পত্র খাওয়া চলবে না। তেল জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড কিছু খাওয়া চলবে না । আমি যদিও কারো কথা শোনার মানুষ না কিন্তু তৃষার কথা না শুনে উপায় নেই । শুনতেই হয় । তবে আশার কথা হচ্ছে মাঝে মধ্য তৃষার মন ভাল থাকলে সে আমাকে নিজেই আমার পছন্দের খাবার খাওয়ায় । আজকে তেমনই একটা দিন ।

আজকে বৃহস্পতিবার । এই দিনে সবারই মনই একটু ফুরফুরে থাকে । সামনে দুইদিন ছুটিকে কেন্দ্র করে । আজকে তৃষা আমার অফিসে এসে হাজির । তার ইচ্ছে হয়েছে যে অফিসের পরে আজকে সে আমাকে ট্রিট দিবে । আমার হাতে একটু কাজ ছিল । সেটা শেষ করতে এই আধা ঘন্টা মত সময় লাগবে । এই সময়টা আমি ওকে একটু অপেক্ষা করতে বললাম । সে অপেক্ষা করতে লাগলো আর আমাদের অফিস টা ঘুরে দেখতে লাগল।

তৃষা বলল, শুনছো?

-হুম । বল ।

-বললাম তোমাদের অফিসে এতো বুড় মানুষ কাজ করে!

আমি একটা বড় বাইট মুখে নিয়ে গিলে ফেললাম । তারপর বললাম, কি বলছো? বুড়ো?

-হ্যা সবাই কেমন বয়স্ক !

আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, কই বয়স্ক ! আতিক ভাই, সুমন ভাই, আজিজ ভাই সবার বয়স আমার থেকে বছর পাঁচেক বেশি । এছাড়া বেশির ভা এম্লোয়ীর বয়সই চল্লিশের ভেতরে ।

তৃষা বলল, সবাই বয়সই আমার কছে ৫০/৬০ এর বেশি মনে হল । আমার কাছে কেবল তোমার আর তোমাদের ম্যানেজারের বয়স টা কম মনে হল।

এবার আমি তৃষার দিকে তাকালাম । বললাম, তোমার চোখের কি হয়েছে বল তো ! আমাদের ম্যানেজারের বয়স কত জানো? প্রায় ষাটের কাছাকাছি । মাস তিনেক হয় তিনি এখানে জয়েন করেছেন । আর তুমি তাকেই কিনা ইয়াং বলতেছো?

তৃষা খানিকটা রাগত স্বরে বলল, শোন বেশি বুঝবা না । আমার চোখ ভাল আছে তোমার মত চশমা লাগে না । তুমি কাল ভাল করে খেয়াল করে দেখবে ।

তৃষার কথা খুব বেশি আমলে না নিলাম না বটে তবে পরের সপ্তাহে অফিসে গিয়ে ব্যাপারটা আমি প্রথম খেয়াল করলাম । সত্যিই সত্যিই সবার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যেন সবার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে । আতিক ভাই মানুষটা খুব প্রনবন্ত । সবার সাথে সব সময় কথা বার্তা বলে হাই হুল্লোড় করে । সেই মানুষটাকে কেমন যে নির্জিব মনে হল । আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই আতিক ভাই বললেন, কি জানি ভাই কদিন থেকে মনে হচ্ছে বয়স বেড়ে গেছে হঠাত করেই । কেন যে এমন হচ্ছে বুঝতেছি না । চেহারাতে ছাপ পড়েছে এমন কি শরীরেও ।

-ডাক্তার দেখিয়েছেন?

-হ্যা । দেখিয়েছি তো । ডাক্তারও খানিকটা অবাক হয়েছে । আমার বয়স যে ৩৬ এটা সে ঠিক বিশ্বাসই করতে চাইলো না । আমি নাকি বয়স কমিয়ে বলছি । কেমন লাগে বল তো !

আমি ঘুরে ঘুরে বাকি সবার দিকে তাকালাম । এবং সত্যিই খেয়াল করলাম যে সবার বয়সই কেমন যে একটু বেশিই মনে হচ্ছে । আমার কাজটা সবার থেকে আলাদা । আমি সার্ভার ম্যানেজার হওয়ার কারণে আমার ডেস্ক থেকে খুব একটা বের হই না । কাস্টয়ার কিংবা এইচ আর ডিপার্টমেন্টের সবার চেহারাতেই একটা ছাপ রয়েছে বয়সের । হঠাৎ করে সবার বয়স কেন বেড়ে গেল?

তখনই ম্যানেজার সাহেবকে ঢুকতে দেখলাম । আমার চোখ চলে গেল তার দিকে । আমাদের অফিসের গেটেই একজন গার্ড দাঁড়িয়ে থাকে । ম্যানেজার সাহেব ভেতরে ঢুকলেন এবং সেই গার্ডের হাত ধরে হ্যান্ডসেইক করলেন হাসি মুখে । কি যেন বললেন গার্ড কে । গার্ড একটু হাসলো সেও হাসলো ! একজন ম্যানেজার হয়ে একজন গার্ডের হাত ধরে হ্যান্ডসেইক করছেন এটা কেন যেন আমার স্বাভাবিক মনে হল না ।

এরপর তার কেবিনের পথে যাওয়ার পথে তিনি আরও চার জনের সাথে হ্যান্ডশেইক করলেন । আমার মনে এই চিন্তাটা কেন এল আমি সেটা কোণ ভাবেই বলতে পারবো না তবে এল । আমি আতিক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আতিক ভাই ম্যানেজার স্যারের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?

-কেমন বলতে? উনি তো চমৎকার মানুষ । যখন দেখা হয় কিংবা তার কেবিনে কোন কাজে যাই তখন তিনি খুবই চমৎকার ভাবে কথা বলেন । এমন বস তো পাওয়াই যায় না ।

-হ্যান্ডসেইক করেন প্রতিবার?

আমার প্রশ্নটা যেন আতিক ভাই ঠিক বুঝতে পারলেন না । বললেন, মানে?

-মানে প্রতিবারই তো হ্যান্ড সেইক করেন । তাই না?

-হ্যা । কেন?

-একটা কথা বলব? রাখবেন?

-হ্যা বল । আগামী কিছুদিন কিছুতেই ম্যানেজার স্যারের সাথে হ্যান্ডসেইক করবেন না । একদমই না । মনে থাকবে তো!

-কেন?

-যা বলছি করবেন । যে কো ভাবে । একটা জিনিস দেখতে চাই । মনে থাকবে তো !

-আচ্ছা । চেষ্টা করবো!

আমি নিজের ডেস্কে এসে বসতে বসতেই আমার ডাক পড়লো ম্যানেজার স্যারের রুমে । মনের ভেতরে একটা ভয় হল আতিক ভাই আমার কথা তাকে বলে দিল কিনা । মানে আমি যাকে যে কাজটা করতে বললাম সেটা আর কি ! তবে তার রুমে গিয়ে দেখি অন্য ব্যাপার । আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখেই বসতে বললেন । আমার হাতের দিকে তাকাতে বললেন, কি আপনার হাতে গ্লোভস কেন?

আমি একটু লজ্জিত স্বরে বললাম, স্যার আসলে হাতে একটু ইনফেকশন হয়েছে । তাই ডাক্তার গ্লোভস পরতে বলেছেন।

ম্যানেজার স্যার খুবই অমায়িক মানুষ এই কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই । কাজ কর্ম ছাড়াও অন্য সবার সব খোজ খবর নেন। সব সময় হাসি মুখে কথা বলেন । তবে আমার হাতে গ্লোভস দেখে কেন জানি তার ভাল লাগলো না । তার মুখ একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেল ।

কিছুর কাজের কথা বলে আমাকে চলে যেতে বললেন । এবং সব থেকে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে তিনি আমার হ্যান্ড সেক করলেন না । আমি নিজের ডেস্কে ফিরে এলাম । তবে আমার মনের ভেতর থেকে সন্দেহটা দূর হল না । বরং আরও বেড়ে গেল ।

তৃষাকে আমার সন্দেহের কথা বলতেই তৃষা বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুঝতে পারছি । আধিভৌতিক গল্প পড়া বন্ধ করবা আজ থেকে ।

আমি বললাম, আমি মানছি আমি যা বলছি যার কোন ভিত্তি নেই । কোণ ব্যাখ্যা নেই ।

-তাহলে আমি আর কিছু শুনতে চাই না ।

-আরে বাবা কি হবে আর বল । তুমি যা বলতে তাতেই আমি ব্যাপারটা খেয়াল করলাম । আসলেই আমাদের অফিসে কাজ করা মানুষ গুলোর বয়স যেন হঠাত করেই বেড়ে গেছে । কি এম কারন থাকতে পারে? কদিন আগেও তো ভাল ছিল সব । তারপর সবার বয়স বেড়ে যেতে শুরু করলো কেবল একজনের বাদ দিয়ে এবং সেই মানুষটাই নতুন এসেছে । তার বয়স বাড়ছে না বরং কমছে ।

-তোমার বয়সও তো বাড়ছে।

-আমার বয়স স্বাভাবিক আছে । কিন্তু ঐ লোকের বয়স কমছে। আর আশে পাশের সবাই বয়স অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে ।

-তো তুমি বলতে চাও যে হ্যান্ড সেইকের মাধ্যমে তোমাদের ম্যানেজার অন্য এমপ্লোয়ীদের থেকে বয়স শুষে নিচ্ছে?

শুনতে হাস্যকর মনে হলেও আমার এটাই মনে হয় । আমার কথা স্বপক্ষে কোন প্রমান কিংবা ব্যাখ্যা না থাকার কারণে আমি আর কথা বাড়ালাম না । কিন্তু এক সপ্তাহে পরে আমার অনুমান যে সঠিক সেটার প্রমান পেলাম ।

আতিক ভাই এই এক সপ্তাহ অফিসে আসেন নি । উনি শরীর খারাপ থাকার কথা বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন । আমি তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । এবং অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে তার বয়স আবার যেন আগের হয়ে যাচ্ছে । পুরোপুরি যায় নি তবে বেশ কিছুটা এগিয়েছে । আতিক ভাই আমাকে আরও একটা কথা বললে যা আমার সন্দেহ একেবারে শত ভাগ নিশ্চয়তায় রূপ নিল । এর মাঝে নাকি আমাদের ম্যানেজার স্যার তাকে দেখতে এসছিল । এবং সে যাওয়ার সময় আতিক ভাইয়ের সাথে হ্যান্ডসেইক করতে চেয়েছিল কিন্তু আতিক ভাই করেন নি ।

আমি বললাম, আপনি যদি আর এক সপ্তাহ অফিসে না যান তাহলে আই গেস আপনি আগের মত শরীরে ফিরে পাবেন ।

আতিক ভাই বললেন, আমার এখনু ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । কিন্তু ম্যানেজার স্যার এটা কিভাবে করছে?

-আমিও জানি না । তবে তার সব কিছু হাতে লুকায়িত । আমার কেবল মনে হয় যে সে হাত দিয়ে মানুষের জীবনী শক্তি চুষে নেয় । নয়তো তার বয়স ষাট কিন্তু তাকে ৩৫ এর যুবকের মত কিভাবে দেখায়? আমি দেখেন এখনো আগের মত আছি কারণ আমি তার সামনে যাই ই বলতে গেলে ।

-এখন কি করণীয়?

-সবাইকে সাবধান করতে হবে। নয়তো সবার জীবনী শক্তি সে চুষে নেবে ।

পরদিন অফিসে গিয়ে খুব গোপনে আমি আর আতিক ভাই একে একে সবাইকে সাবধান করে দিলাম । জানিয়ে দিলাম কি হয়েছে । নিজের সাথেই এই ঘটনা ঘটার কারণে কেউ কেন জানি সেটা অবিশ্বাস করলো না । কিন্তু বস যখন হ্যান্ডসেইক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় তখন সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় তো খুব একটা নেই ।

অনেকেই হাতে গ্লোভস পরে আসা শুরু করলো । কিন্তু পরেও ম্যানেজার সাহেব ঠিকই সুযোগ খুজে বের করতেন । তবে আগের থেকে সেটা পরিমানে কমে গিয়েছিল । মাত্র এক সপ্তাহে তার ফল পাওয়া গেল । ম্যানেজার স্যারের বয়স এই এক সপ্তাহে দশ বছর যেন বেড়ে গেল । অন্যদের বয়স কমে গেল বেশ কিছুটা ।

ম্যানেজার সাহেব তখন খানিকটা মরিয়া হয়ে গেছে । অফিসে নতুন রুল জারি করলো । কেউ হাতে হ্যান্ড গ্লোভস পরতে পারবে না । কেউ কেউ অফিস ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল । কেউ চাকরি ছেড়ে দিল । কিন্তু এটা কোণ সমাধান না । কারণ একজন এমপ্লোয়ী গেলে আরেকজন আসবে । এমন কিছু করতে হবে যাতে ঐ কাজটা সে আর না করতে পারে! কিন্তু কি করবো?

তখনই পুরো বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিল । করোনার কারণে হ্যান্ডসেইক করা বন্ধ হয়ে গেল । কয়েকদিন পরে অফিসও । ব্যাস ! এটাই আমরা চাচ্ছিলাম ।

তিন মাস বন্ধ থাকার পরে যখন আমরা অফিসে আবার হাজির হলাম তখন খবর পেলাম যে আমাদের ম্যানেজার স্যার মারা গেছেন । অনেকেই জানালো যে ম্যানেজার স্যার নাকি লকডাউনের ভেতরে তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিল কয়েকবার । প্রথম বার তারা দরজা খুললেও পরে আর কেউ দরজা খোলে নি । এবং সব থেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যু কালে নাকি তার বয়স ভয়ানক ভাবে বেড়ে গিয়েছিল । শেষের দিকে তাকে নাকি একদমই চেনাই যেত না । খুব বেশি বৃদ্ধ অনেক বেশি বয়স্ক মনে হত ।

তৃষা সব শুনে আবারও আমাকে নিয়ে খুব হাসহাসি করলো । বলল যে বেচারির নিশ্চয় কোন রোগ হয়েছিল । তাই এমন হঠাৎ করে বয়স বেড়ে গেছে মনে হয়েছে । আর আমরা নাকি একটু বেশিই অতিপ্রাকৃত ব্যাপার চিন্তা করছি ।

আসলেই কি? কি জানি ! তবে এরপর থেকে আমার সহ আমাদের অফিসের সবার মাঝেই হ্যান্ড সেইক করার প্রবনতা একেবারে কমে গেছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 45

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →