হ্যান্ডসেইক করবে না

4.8
(43)

-তোমার অফিসের লোকজন কেমন বয়স্ক ।

আমার নজর তখন বিফ বার্গারটার দিকে । তৃষা আমাকে বাইরের খাবার একদমই খেতে না । তার কথা হচ্ছে সব সময় বাসার জিনিস পত্র খেতে হবে হবে । কোন ভাবেই বাইরের জিনিস পত্র খাওয়া চলবে না। তেল জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড কিছু খাওয়া চলবে না । আমি যদিও কারো কথা শোনার মানুষ না কিন্তু তৃষার কথা না শুনে উপায় নেই । শুনতেই হয় । তবে আশার কথা হচ্ছে মাঝে মধ্য তৃষার মন ভাল থাকলে সে আমাকে নিজেই আমার পছন্দের খাবার খাওয়ায় । আজকে তেমনই একটা দিন ।

আজকে বৃহস্পতিবার । এই দিনে সবারই মনই একটু ফুরফুরে থাকে । সামনে দুইদিন ছুটিকে কেন্দ্র করে । আজকে তৃষা আমার অফিসে এসে হাজির । তার ইচ্ছে হয়েছে যে অফিসের পরে আজকে সে আমাকে ট্রিট দিবে । আমার হাতে একটু কাজ ছিল । সেটা শেষ করতে এই আধা ঘন্টা মত সময় লাগবে । এই সময়টা আমি ওকে একটু অপেক্ষা করতে বললাম । সে অপেক্ষা করতে লাগলো আর আমাদের অফিস টা ঘুরে দেখতে লাগল।

তৃষা বলল, শুনছো?

-হুম । বল ।

-বললাম তোমাদের অফিসে এতো বুড় মানুষ কাজ করে!

আমি একটা বড় বাইট মুখে নিয়ে গিলে ফেললাম । তারপর বললাম, কি বলছো? বুড়ো?

-হ্যা সবাই কেমন বয়স্ক !

আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, কই বয়স্ক ! আতিক ভাই, সুমন ভাই, আজিজ ভাই সবার বয়স আমার থেকে বছর পাঁচেক বেশি । এছাড়া বেশির ভা এম্লোয়ীর বয়সই চল্লিশের ভেতরে ।

তৃষা বলল, সবাই বয়সই আমার কছে ৫০/৬০ এর বেশি মনে হল । আমার কাছে কেবল তোমার আর তোমাদের ম্যানেজারের বয়স টা কম মনে হল।

এবার আমি তৃষার দিকে তাকালাম । বললাম, তোমার চোখের কি হয়েছে বল তো ! আমাদের ম্যানেজারের বয়স কত জানো? প্রায় ষাটের কাছাকাছি । মাস তিনেক হয় তিনি এখানে জয়েন করেছেন । আর তুমি তাকেই কিনা ইয়াং বলতেছো?

তৃষা খানিকটা রাগত স্বরে বলল, শোন বেশি বুঝবা না । আমার চোখ ভাল আছে তোমার মত চশমা লাগে না । তুমি কাল ভাল করে খেয়াল করে দেখবে ।

তৃষার কথা খুব বেশি আমলে না নিলাম না বটে তবে পরের সপ্তাহে অফিসে গিয়ে ব্যাপারটা আমি প্রথম খেয়াল করলাম । সত্যিই সত্যিই সবার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যেন সবার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে । আতিক ভাই মানুষটা খুব প্রনবন্ত । সবার সাথে সব সময় কথা বার্তা বলে হাই হুল্লোড় করে । সেই মানুষটাকে কেমন যে নির্জিব মনে হল । আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই আতিক ভাই বললেন, কি জানি ভাই কদিন থেকে মনে হচ্ছে বয়স বেড়ে গেছে হঠাত করেই । কেন যে এমন হচ্ছে বুঝতেছি না । চেহারাতে ছাপ পড়েছে এমন কি শরীরেও ।

-ডাক্তার দেখিয়েছেন?

-হ্যা । দেখিয়েছি তো । ডাক্তারও খানিকটা অবাক হয়েছে । আমার বয়স যে ৩৬ এটা সে ঠিক বিশ্বাসই করতে চাইলো না । আমি নাকি বয়স কমিয়ে বলছি । কেমন লাগে বল তো !

আমি ঘুরে ঘুরে বাকি সবার দিকে তাকালাম । এবং সত্যিই খেয়াল করলাম যে সবার বয়সই কেমন যে একটু বেশিই মনে হচ্ছে । আমার কাজটা সবার থেকে আলাদা । আমি সার্ভার ম্যানেজার হওয়ার কারণে আমার ডেস্ক থেকে খুব একটা বের হই না । কাস্টয়ার কিংবা এইচ আর ডিপার্টমেন্টের সবার চেহারাতেই একটা ছাপ রয়েছে বয়সের । হঠাৎ করে সবার বয়স কেন বেড়ে গেল?

তখনই ম্যানেজার সাহেবকে ঢুকতে দেখলাম । আমার চোখ চলে গেল তার দিকে । আমাদের অফিসের গেটেই একজন গার্ড দাঁড়িয়ে থাকে । ম্যানেজার সাহেব ভেতরে ঢুকলেন এবং সেই গার্ডের হাত ধরে হ্যান্ডসেইক করলেন হাসি মুখে । কি যেন বললেন গার্ড কে । গার্ড একটু হাসলো সেও হাসলো ! একজন ম্যানেজার হয়ে একজন গার্ডের হাত ধরে হ্যান্ডসেইক করছেন এটা কেন যেন আমার স্বাভাবিক মনে হল না ।

এরপর তার কেবিনের পথে যাওয়ার পথে তিনি আরও চার জনের সাথে হ্যান্ডশেইক করলেন । আমার মনে এই চিন্তাটা কেন এল আমি সেটা কোণ ভাবেই বলতে পারবো না তবে এল । আমি আতিক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আতিক ভাই ম্যানেজার স্যারের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?

-কেমন বলতে? উনি তো চমৎকার মানুষ । যখন দেখা হয় কিংবা তার কেবিনে কোন কাজে যাই তখন তিনি খুবই চমৎকার ভাবে কথা বলেন । এমন বস তো পাওয়াই যায় না ।

-হ্যান্ডসেইক করেন প্রতিবার?

আমার প্রশ্নটা যেন আতিক ভাই ঠিক বুঝতে পারলেন না । বললেন, মানে?

-মানে প্রতিবারই তো হ্যান্ড সেইক করেন । তাই না?

-হ্যা । কেন?

-একটা কথা বলব? রাখবেন?

-হ্যা বল । আগামী কিছুদিন কিছুতেই ম্যানেজার স্যারের সাথে হ্যান্ডসেইক করবেন না । একদমই না । মনে থাকবে তো!

-কেন?

-যা বলছি করবেন । যে কো ভাবে । একটা জিনিস দেখতে চাই । মনে থাকবে তো !

-আচ্ছা । চেষ্টা করবো!

আমি নিজের ডেস্কে এসে বসতে বসতেই আমার ডাক পড়লো ম্যানেজার স্যারের রুমে । মনের ভেতরে একটা ভয় হল আতিক ভাই আমার কথা তাকে বলে দিল কিনা । মানে আমি যাকে যে কাজটা করতে বললাম সেটা আর কি ! তবে তার রুমে গিয়ে দেখি অন্য ব্যাপার । আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখেই বসতে বললেন । আমার হাতের দিকে তাকাতে বললেন, কি আপনার হাতে গ্লোভস কেন?

আমি একটু লজ্জিত স্বরে বললাম, স্যার আসলে হাতে একটু ইনফেকশন হয়েছে । তাই ডাক্তার গ্লোভস পরতে বলেছেন।

ম্যানেজার স্যার খুবই অমায়িক মানুষ এই কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই । কাজ কর্ম ছাড়াও অন্য সবার সব খোজ খবর নেন। সব সময় হাসি মুখে কথা বলেন । তবে আমার হাতে গ্লোভস দেখে কেন জানি তার ভাল লাগলো না । তার মুখ একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেল ।

কিছুর কাজের কথা বলে আমাকে চলে যেতে বললেন । এবং সব থেকে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে তিনি আমার হ্যান্ড সেক করলেন না । আমি নিজের ডেস্কে ফিরে এলাম । তবে আমার মনের ভেতর থেকে সন্দেহটা দূর হল না । বরং আরও বেড়ে গেল ।

তৃষাকে আমার সন্দেহের কথা বলতেই তৃষা বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুঝতে পারছি । আধিভৌতিক গল্প পড়া বন্ধ করবা আজ থেকে ।

আমি বললাম, আমি মানছি আমি যা বলছি যার কোন ভিত্তি নেই । কোণ ব্যাখ্যা নেই ।

-তাহলে আমি আর কিছু শুনতে চাই না ।

-আরে বাবা কি হবে আর বল । তুমি যা বলতে তাতেই আমি ব্যাপারটা খেয়াল করলাম । আসলেই আমাদের অফিসে কাজ করা মানুষ গুলোর বয়স যেন হঠাত করেই বেড়ে গেছে । কি এম কারন থাকতে পারে? কদিন আগেও তো ভাল ছিল সব । তারপর সবার বয়স বেড়ে যেতে শুরু করলো কেবল একজনের বাদ দিয়ে এবং সেই মানুষটাই নতুন এসেছে । তার বয়স বাড়ছে না বরং কমছে ।

-তোমার বয়সও তো বাড়ছে।

-আমার বয়স স্বাভাবিক আছে । কিন্তু ঐ লোকের বয়স কমছে। আর আশে পাশের সবাই বয়স অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে ।

-তো তুমি বলতে চাও যে হ্যান্ড সেইকের মাধ্যমে তোমাদের ম্যানেজার অন্য এমপ্লোয়ীদের থেকে বয়স শুষে নিচ্ছে?

শুনতে হাস্যকর মনে হলেও আমার এটাই মনে হয় । আমার কথা স্বপক্ষে কোন প্রমান কিংবা ব্যাখ্যা না থাকার কারণে আমি আর কথা বাড়ালাম না । কিন্তু এক সপ্তাহে পরে আমার অনুমান যে সঠিক সেটার প্রমান পেলাম ।

আতিক ভাই এই এক সপ্তাহ অফিসে আসেন নি । উনি শরীর খারাপ থাকার কথা বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন । আমি তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । এবং অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে তার বয়স আবার যেন আগের হয়ে যাচ্ছে । পুরোপুরি যায় নি তবে বেশ কিছুটা এগিয়েছে । আতিক ভাই আমাকে আরও একটা কথা বললে যা আমার সন্দেহ একেবারে শত ভাগ নিশ্চয়তায় রূপ নিল । এর মাঝে নাকি আমাদের ম্যানেজার স্যার তাকে দেখতে এসছিল । এবং সে যাওয়ার সময় আতিক ভাইয়ের সাথে হ্যান্ডসেইক করতে চেয়েছিল কিন্তু আতিক ভাই করেন নি ।

আমি বললাম, আপনি যদি আর এক সপ্তাহ অফিসে না যান তাহলে আই গেস আপনি আগের মত শরীরে ফিরে পাবেন ।

আতিক ভাই বললেন, আমার এখনু ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । কিন্তু ম্যানেজার স্যার এটা কিভাবে করছে?

-আমিও জানি না । তবে তার সব কিছু হাতে লুকায়িত । আমার কেবল মনে হয় যে সে হাত দিয়ে মানুষের জীবনী শক্তি চুষে নেয় । নয়তো তার বয়স ষাট কিন্তু তাকে ৩৫ এর যুবকের মত কিভাবে দেখায়? আমি দেখেন এখনো আগের মত আছি কারণ আমি তার সামনে যাই ই বলতে গেলে ।

-এখন কি করণীয়?

-সবাইকে সাবধান করতে হবে। নয়তো সবার জীবনী শক্তি সে চুষে নেবে ।

পরদিন অফিসে গিয়ে খুব গোপনে আমি আর আতিক ভাই একে একে সবাইকে সাবধান করে দিলাম । জানিয়ে দিলাম কি হয়েছে । নিজের সাথেই এই ঘটনা ঘটার কারণে কেউ কেন জানি সেটা অবিশ্বাস করলো না । কিন্তু বস যখন হ্যান্ডসেইক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় তখন সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় তো খুব একটা নেই ।

অনেকেই হাতে গ্লোভস পরে আসা শুরু করলো । কিন্তু পরেও ম্যানেজার সাহেব ঠিকই সুযোগ খুজে বের করতেন । তবে আগের থেকে সেটা পরিমানে কমে গিয়েছিল । মাত্র এক সপ্তাহে তার ফল পাওয়া গেল । ম্যানেজার স্যারের বয়স এই এক সপ্তাহে দশ বছর যেন বেড়ে গেল । অন্যদের বয়স কমে গেল বেশ কিছুটা ।

ম্যানেজার সাহেব তখন খানিকটা মরিয়া হয়ে গেছে । অফিসে নতুন রুল জারি করলো । কেউ হাতে হ্যান্ড গ্লোভস পরতে পারবে না । কেউ কেউ অফিস ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল । কেউ চাকরি ছেড়ে দিল । কিন্তু এটা কোণ সমাধান না । কারণ একজন এমপ্লোয়ী গেলে আরেকজন আসবে । এমন কিছু করতে হবে যাতে ঐ কাজটা সে আর না করতে পারে! কিন্তু কি করবো?

তখনই পুরো বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিল । করোনার কারণে হ্যান্ডসেইক করা বন্ধ হয়ে গেল । কয়েকদিন পরে অফিসও । ব্যাস ! এটাই আমরা চাচ্ছিলাম ।

তিন মাস বন্ধ থাকার পরে যখন আমরা অফিসে আবার হাজির হলাম তখন খবর পেলাম যে আমাদের ম্যানেজার স্যার মারা গেছেন । অনেকেই জানালো যে ম্যানেজার স্যার নাকি লকডাউনের ভেতরে তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিল কয়েকবার । প্রথম বার তারা দরজা খুললেও পরে আর কেউ দরজা খোলে নি । এবং সব থেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যু কালে নাকি তার বয়স ভয়ানক ভাবে বেড়ে গিয়েছিল । শেষের দিকে তাকে নাকি একদমই চেনাই যেত না । খুব বেশি বৃদ্ধ অনেক বেশি বয়স্ক মনে হত ।

তৃষা সব শুনে আবারও আমাকে নিয়ে খুব হাসহাসি করলো । বলল যে বেচারির নিশ্চয় কোন রোগ হয়েছিল । তাই এমন হঠাৎ করে বয়স বেড়ে গেছে মনে হয়েছে । আর আমরা নাকি একটু বেশিই অতিপ্রাকৃত ব্যাপার চিন্তা করছি ।

আসলেই কি? কি জানি ! তবে এরপর থেকে আমার সহ আমাদের অফিসের সবার মাঝেই হ্যান্ড সেইক করার প্রবনতা একেবারে কমে গেছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 43

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →