বলুইঘাটের বিলে

oputanvir
4.4
(25)

আমার বাবার বদলির চাকরি ছিল। তাই আমাদের জায়গাতে খুব বেশি সময় থাকা হত না। বছর না পেরুতেই আমরা একেক জায়গায় গিয়ে হাজির হতাম। তবে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে বাবার বদলি হল হিলি এরিয়াতে। সেইবার আর আমাদের বাবার সাথে যাওয়া হল না। আমরা গিয়ে হাজির হলাম দাদাবাড়িতে। ঠিক হল যতদিন বাবা এই হিলি এড়িয়াতে থাকবেন ততদিন আমি দাদাবাড়িতেই থাকব।
আমার দাদা বাড়িটাকে ঠিক গ্রাম বলা যাবে না আবার শহরও বলা যাবে না। দাদাবাড়িটা এমন জায়গাতে ছিল যেখানে গ্রাম আর শহরের সব উপাদানই ছিল। একদিকে গেলে আমি পেতাম গ্রামের বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর আর অন্য দিকে একটু গেলেই পাওয়া যেত শহরের আধুনিকতায় ছোঁয়া। সত্যি বলতে দিন ভালই যাচ্ছিল আমার। কিছু বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল। ওদের সাথেই আমার সময় কাটতো। সব থেকে বড় কথা মাথার উপরে বাবার শাসন ছিল না বলে স্বাধীনতাটা আমি খুব উপভোগ করছিলাম।
দাদাদাদী মারা যাওয়ার পরে আমাদের দাদাবাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকত। আমার অন্য দুই চাচা ঢাকাতে থাকেন। আগে ঈদের ছুটিতে আমরা সব কাজিনরা এক জায়গাতে আসার সুযোগ ছিল তবে দাদার মৃত্যুর পরে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ি দেখা শোনার জন্য একজন লোক ছিল। রমিজ কাকা। সে বাবার কেমন আত্মীয় হয়। তার বাড়ি পাশেই ছিল। পরিবার নিয়ে থাকতেন সেখানে আর আমাদের বাড়িটা দেখেশুনে রাখতেন। আমাদের জমিজমার দেখাশোনা করতেন।
এছাড়া এই গ্রামেই আমাদের আরও কিছু আত্মীয় স্বজন ছিল। আমার বড়ফুপুর বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। এই কারণ যে দরকারে আমার মা যাতে মানুষের সাহায্য সহযোগিতা পেতে পারে সেটা নিশ্চিত ছিল। আর রমিজ কাকার বাসা তো পাশেই ছিল। সে যে দরকারে আমাদের সাহায্য করত। আর আমার মা এমনিতেই বেশ শক্ত একজন মানুষ। সব কিছু সে সামলে নিতে পারে সহজেই। তাই বাবা আমাদের হিলিতে আর নিয়ে যায় নি। এছাড়া আমার এসএসসি পরীক্ষা আসবে সামনে। এখানে একস্কুলে থাকা দরকার আমার জন্য। সব মিলিয়ে এই গ্রামে থাকাটাই আমাদের জন্য সব থেকে ভাল সিদ্ধান্ত ছিল।
পরের বছর বৈশাখ আসতে না আসতেই আমি একেবারে গ্রামের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। গ্রামের মাঠে খেলাধুলা, বাগান থেকে ফল চুরি করা, কারো পুকুর থেকে মাছ ধরা এই সব আমার কাছে এক নম্বর কাজ হয়ে উঠল। এই কাজে আমার সাথে গ্রামের আরও অনেকেই থাকত। তবে সব থেকে পছন্দের কাজ ছিল বলুইঘাটের বিলে মাছ ধরা। ছিপ ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা এখানে বসে বসে মাছ ধরতাম। মাছও পাওয়া যেত বেশ। তাজা মাছ নিয়ে বাসায় ফিরলে মা একটু চিৎকার চেঁচামিচি করত বটে তবে আমার হাত থেকে মাছ নিয়ে ঠিকই রান্না করত। আমার ছোটবোন তাজা মাছের ভাজি বেশ পছন্দ করত। এমনে অনেক দিনই গেছে যেখানে আমাদের বাজার থেকে আলাদা ভাবে কোন মাছ কিনতে হয় নি। আমার ধরা মাছ দিয়েই রান্না হয়েছে।
বলুইঘাটের বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। গ্রামের অনেক ছেলে বুড়ো যেমন এই মাছ ধরতে আসত তেমনি এই বিলে প্রচুর বকও আসত মাছ খেতে। আর গ্রামের দুরন্ত ছেলেরা সেই বক শিকার করত। যদিও আমার বক শিকারে তেমন উৎসাহ ছিল না। বাবা এসব মানা করতেন। তবে বক শিকার না করলেও বক ধরা যেত একটা বিশেষ সময়ে। সেটা হচ্ছে ঝড়ের পরে। কাল বৈশাখী ঝড়ের পরে অনেক বক পাওয়া যেত বলুইঘাটের বিলে। ঝড়ের কারণে এই বকগুলোর শরীরের কোন না কোন অংশে আঘাত পেত তারপর সেগুলো বিলের পানিতে বা পাড়ে পড়ে থাকত। এই বকগুলো অনেকে তুলে নিয়ে রান্না করত। একদিন আমিও ঠিক করলাম যে আমিও এই বক ধরব। মাকে অবশ্য বলা যাবে না। মা আমাকে অনেক ছাড় দিলেও রাতের বেলা বাড়ির বাইরে বের হওয়াটা সে একেবারে পছন্দ করে না। তাই আমিও সেটা সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করতাম।
বৈশাখের শেষে এই সুযোগটা এল। সেদিন রাতভর প্রবল ঝড় হল। আমার ঘুম সেদিন আপনা আপনিই ভেঙ্গে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখি ভোরের আলো তখনও ফোটে নি। ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া ছিল সেটা তখনও বাজে নি। সময় দেখলাম আযান দিতে তখনও কিছুটা সময় বাকি। আমি বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলাম। বাইরের ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগল। বৃষ্টির পরে যে ঠান্ডা পরিবেশ থাকে বাইরে ঠিক্স তেমন আবহাওয়া। ঝড় শেষ হয়ে গেছে। বৃষ্টিও পড়ছে না। কিছু সময় আমি চিন্তা করলাম যে কী করব। একটু পরেই আযান দিবে। মানুষজন বের হবে। এরপরই ভেতরে সম্ভবত গ্রামে ছেলেবুড়োরা বলুইঘাটের বিলে গিয়ে হাজির হয়েছে। একবার মনে হল যাওয়ার দরকার নেই। আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। এই সময়ের ঘুমটা ভাল হবে কিন্তু কেন জানি শান্তি পেলাম না। মনে হল একবার বলুইঘাটের বিলে যেতেই হবে। একটা যদিও বক পাওয়া যায় তাতেই সই।
আমি চুপিচুপি উঠে পড়লাম। জামা কাপড় পরে, আমার পকেট টর্চটা নিয়ে নিলাম। আর সাথে নিলাম আমার এন্টিকাটার ছুরিটা। ঝড়ে অনেক সময় কোনো কোনো বকের এমন অবস্থা হয় যে সেগুলো খুব বেশি সময় টিকে থাকে না। তাই সাথে সাথে সেগুলোকে জবাই দিতে হয়। মরে গেলে আর সেগুলো খাওয়ার উপায় থাকে না।
আমি দরজা খুলে বের হয়ে গেলাম। হাটতে শুরু করলাম বলুইঘাটের বিলের দিকে। সত্যি বলতে বাইরের পরিবেশ আমার কাছে একেবারে অন্য রকম মনে হল। গ্রামে আছি বছর পেরিয়ে গেছে বটে তবে একা একা এই ভোর রাতে এই প্রথম বের হলাম। মনের ভেতরে নানান চিন্তা এসে হাজির হল। তবে সেসব পাত্তা না দিয়ে আমি হাটতে লাগলাম বিলের দিকে। কিছু সময়ের ভেতরেই আমার মনটা একেবারে ভাল হয়ে গেল। এতো চমৎকার পরিবেশে হাটতে ভাল লাগছিল। আমি টর্চটা জ্বালাচ্ছিলাম না। জ্বালানোর দরকার ছিল না। মেঘ সরে গেছে এরই ভেতরে। চাঁদের আলো না থাকলেও চারিদিকে ভোর হওয়ার একটা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পথঘাট দেখতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
আমি যখন বলুইঘাটের বিলে পৌছালাম তখন চারিদিকটা আরও শান্ত হয়ে গেছে। তবে বিলের পানির দিকে তাকিয়ে আমার মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। এই অনুভূতির কারণ আমার কাছে জানা নেই। আমার কাছে মনে হল যে এই বলুইঘাটের বিলটা আমার ঠিক যেন পরিচিত নয়। যে বিলটা আমি এতোদিন দেখে আসছি সেই বিলের সাথে এটার কোন মিল নেই। অপার্থিব কিছু রয়েছে এই বিলে। আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না তবে রয়েছে। আমি কিছু সময় বোকার মত বিকের পাড়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
আমি ভেবেছিলাম যে আমার আগেই অনেকেই এই বিলে এসে হাজির হবে। তবে আমি কাউকে দেখলাম না। কেউ আসে নি। মন থেকে অন্য সব চিন্তা দূর করে দিয়ে আমি বিলে নামব ঠিক করলাম। কারণ একটু দুরেই আমি সাদা একটা বক দেখতে পাচ্ছি। প্যান্ট গুটিয়ে আমি বিলের পানিতে নেমে এলাম। বকটার কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম যে সেটা মরে গেছে। এই বক খাওয়ার উপায় নেই। বকটা যেখানে পেয়েছিলাম সেখানেই রেখে দিলাম। তারপর সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
বিলের পানি এখানে অল্প। বেশি পানি বিলের অন্য দিকে। সেদিকে গেলে নৌকা নিয়ে যতে হয়। এই দিকে আমি হাটছি আর মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালছি। আমার চোখে যে কয়টা বক পড়েছে সবগুলো মারা গেছে। মনে মনে যে এই সময়ে আসাটাই মাটি হল। জ্যান্ত বক সম্ভবত পাওয়া যাবে না। এমন ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছিল এমন সময় সুড়ুৎ করে বেশি পানিতে এসে হাজির হলাম। একটু আগে আমি হাটু পানিতে ছিলাম এখন একেবারে বুক পানিতে চলে এলাম। ভাগ্য ভাল যে হাতের টর্চটাকে আমি সময় মত উচু করে ধরেছিলাম। নয়তো টর্চে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যেত। আমি বিরক্তি নিয়ে একটু পিছিয়ে এলাম আবার। আবারও হাটু পানিতে উঠে এলাম। শরীরের কাপড় একেবারে ভিজে গেছে। আমার মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল।
আমার আবারও মনে হল যে এখানে আসাটা একেবারে ঠিক হয় নি। ঘুম কামাই দিয়ে আসাটা বৃথা গেল। আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার মনস্থির করলাম। পেছনে ঘুরে পাড়ের দিকে হাটা দিতেই আমার চোখ পড়ল জিনিসটা। অন্ধকার পানিতে একটা সাদা আলো ফুটে রয়েছে। সাদা বক পড়ে থাকলে সেটা অন্ধকারে বোঝা যায়। কিন্তু এটার ব্যাপারটা আলাদা। ওখান থেকে আলো আসছে। উজ্জ্বল কোনো আলো নয়। ডিম লাইটের সাদা আলোর মত। আমার অবচেতন মন আমাকে ঠিক ঠিক সাবধান করে দিল। বারবার করে বলল যে ওখানে যাওয়ার কোন দরকার নেই। আমার এখন এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল। তবে কৌতুহলের কাছে আমি অবচেতন মন পরাজিত হল। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। কাছে যেতেই সেটা আরও ভাল করে চোখে পড়ল।
একটা সাদা পাখি। বকের মত দেখতে তবে বক না। বকের সাথে পার্থক্য রয়েছে এই পাখিটার। বকের মত শরীর আর ডানা আছে বটে তবে বকার মত গলাটা এতো সরু না। সেই সাথে পাখিটার ঠোটটা বকের মত বেশি লম্বা না। পাখিটা বক থেকেও বেশ বড়। সব থেকে বড় কথা এই সাদা শরীর থেকে আলো বের হচ্ছে। মৃদু ডিম লাইটের মত আলো। আমি আরেকটু কাছে যেতে পাখিটা একটু নড়ার চেষ্টা করল তবে পাখিটার একটা ডানা ভেঙ্গে গেছে। এই কারণেই সেটা পড়ে আছে এই পানিতে। আমি খুব সাবধানে পাখিটাকে কোলে তুলে নিলাম। প্রথমে একটু ভয় পেলেও যখন বুঝল যে আমি তার কোন ক্ষতি করব তখন দেখলাম সেটা শান্ত হয়ে ধরা দিল। আমি আলতো করে পাখিটাকে কোলে তুলে নিয়ে পাড়ের দিকে হাটা দিলাম।
পাখিটার শরীর বেশ উষ্ণ। আমি সেটাকে আদর করতে করতে বাড়িতে এসে হাজির হলাম। বাসায় এসে দেখি তখনো বাড়ির কারো ঘুম ভাঙ্গে নি। নিজের ঘরের আলো জ্বালানোর পরে পাখিটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে আলো ভাবটা ছিল সেটা এখন আর নেই। সম্ভবত এই পাখির পালকেই কিছু একটা আছে। অন্ধকারে জ্বলে সেটা। তবে আলোতে আমি আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। এই পাখিটার চোখের রং নীল। আর সেটা বকের চোখ থেকেও একটু বড়। চোখের দৃষ্টি কেমন গভীর। কোন পশু পাখি এভাবে মানুষের দিকে তাকায় না। আমি পাখিটার চোখের দিকে একভাবে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম।
সবার আগে পাখিটার একটা থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। রান্নাঘর থেকে একটা ঝুড়ি নিয়ে এলাম। সেখানে একটা পুরানো কাপড় বিছিয়ে পাখিটা তার ভেতরে বসিয়ে দিলাম। সেটা শান্ত হয়েই সেখানে বসে রইলো। ভেজা পোশাক বদলে আমি পাখিটা নিয়ে কী করব সেতাই ভাবতে লাগলাম। এই পাখিটাকে কোন ভাবেই খাওয়া যাবে না । এতো সুন্দর একটা পাখিকে জবাই করার কথা চিন্তা করা যায় না। আমি পাখিটার ডানার ভাঙ্গা অংশে একটা ছোট চিকন ডাল দিয়ে বেধে দিলাম যাতে এটা ব্যাথা না পায়। আমি জানি না এই ডানা ঠিক হবে কিনা। ডানা ঠিক না হলে এই পাখি আর আকাশে উড়তে পারবে না। যদি না ঠিক হয় তবে আমি এটাকে আমার কাছেই রেখে দিব। ডানার পরিচর্যার পরে পাখিটার সামনে ছোট একটা বাটিতে খাবার দিলাম সাথে একটু পানি।
বাসায় পাখিটাকে সবাই বেশ পছন্দ করল। মা অবশ্য প্রথমে আমাকে কিছুটা সময় বকাঝকা করলো বেশ। আমি কেন তাকে না বলে রাতের বেলা বলুইঘাটের বিলের গিয়েছি। মা প্রথমে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেও দেখলাম পরে নিজ থেকেই পাখিটাকে খাবার দিচ্ছিল। সে নিজেই পাখিটার ডানা ঠিক করার জন্য কিছু ঘাস লতাপাতা বেটে লাগিয়ে দিল। আমার ছোটবোন মিনুর পাখিটা সব থেকে বেশি পছন্দ হল। দিনের বেশিভাগ সময়ই সে পাখিটার সামনেই বসে থাকত।
এই পাখিটা যেদিন থেকে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে সেদিন থেকে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি খেয়াল করতে শুরু করলাম। রাত হলেই আমার জানালার পাশে আমি ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হত যেন বড় কোন পাখি আমার জানালার পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর যখন এই আওয়াজ শোনা যেত তখন পাখিটার ভেতরে একটা চাঞ্চল্য দেখতে পেতাম। তবে সেটা নিজের স্থান থেকে নড়তো না। মাথা নাড়াত একটু নড়াচড়ার চেষ্টা করত কিংবা মাথাটা ঘুরে বারবার জানালার দিকে চলে যেত। আমি বুঝতে পারতাম পাখিটা কোনো কারণে অস্থিরতাবোধ করছে।
আচ্ছা পাখিটার কোন সঙ্গী সাথী কি এসেছে? আসতেও পারে। পরের দিন যখন আবারও ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ শুনলাম আমি পাখিটাকে কোলে নিয়ে দ্রুত বাইরে বের হয়ে এলাম। তবে কোন পাখিই দেখতে পেলাম না।
মাঝে একবার এলাকার এক পশু চিকিৎসক ডেকে এনেছিলাম। সে পাখিটার পরিচর্যা করে গেছে। সেই জন্যই দ্রুত পাখিটা সুস্থ হয়ে উঠল। তবে ঝামেলা বাঁধল অন্য জায়গায়। পশু চিকিৎসক যেদিন পাখিটাকে দেখে গেল তার পর থেকেই পাখিটার কথা মানুষজন জেনে গেল। এতোদিন পাখিটা ঘরের ভেতরেই থাকত বলে কেউ ঠিক জানতে পারে নি পাখিটার ব্যাপারে।
এরপর থেকে প্রায়ই প্রতিদিনই কেউ না কেউ পাখিটা দেখতে আসত। প্রথমে আমার তেমন কিছুই মনে হয় নি। বিলে গিয়ে আমি একটা পাখি পেয়েছি সেটা একটু অদ্ভুত তাই মানুষ দেখতে আসতেই পারে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পরে এমন এক লোক এল পাখিটাকে দেখতে যাকে দেখে আমার মোটেই পছন্দ হল না। লোকটা একটু বেটে আর তার একটা পা সম্ভবত একটু খাটো। লাঠিতে ভর দিয়ে চলে সে। মা তাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিতে রাজি ছিল না। লোকটা তখন পাখিটাকে দেখার জন্য বাইরে আনার অনুরোধ করল। আমিই কোলে করে নিয়ে এলাম। লোকটাকে দেখার সাথে সাথেই পাখিটা একটু নড়ে চড়ে উঠল, জানা ঝাপ্টানোর চেষ্টা করে আমার কোল থেকে উড়ে যেতে চাইলো তবে আমি তাকে শান্ত করার জন্য শরীরে হাত বুলিয়ে দিলাম। একটু পরে সে শান্ত হয়ে এল।
লোকটা পাখিটার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল যে আমার সেটা মোটেই ভাল লাগল না। লোকটা একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইলে আমি মানা করে দিলাম। বললাম, পাখি দেখতে চেয়েছিলেন, দেখালাম। পাখি ছোঁয়া যাবে না।
তখন লোকটা পাখিটা কিনতে চাইল। আমি পরিস্কার ভাবে বলে দিলাম, পাখি বিক্রি হবে না। শেষে মাও লোকটাকে ঝামেলা না করতে বলে দিল। সেও জানিয়ে দিল যে এই পাখি বিক্রি হবে না। একপর্যায়ে লোকটা পাখিটা কিনতে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চাইলো। আমি আর মা বেশ অবাক হয়ে গেলাম। তখনই আমার মনে হল যে এই পাখি মোটেই সাধারণ কোন পাখি না। আর সামনের এই মানুষটাকে আমাদের কারোই ভাল মানুষ বলে মনে হয় নি। এর কাছে কোন ভাবেই পাখিটা দেওয়া যাবে না।
পরের সপ্তাহে আরো একবার এসে হাজির হল লোকটা। এবার আমার মা আমাদের প্রধান দরজাই খুলল না। দরজাও ওপাশ থেকেই মানা করে দিল। তখন লোকটা একটু রাগত স্বরেই বলল যে এই পাখি আমরা রাখতে পারব না। সে এই পাখি নিয়ে যাবেই। আমার মাও কম যায় না। সে বলল এবার যদি আমাদের বাড়ির আশে পাশে তাকে দেখে তবে সোজা পুলিশে ধরিয়ে দিবে।
কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ হল না। লোকটা সত্যিই বলেছিল যে এই পাখিটা আমরা রাখতে পারব না। এই কথা মর্ম আমরা বুঝতে পারলাম আরও দুইদিন পরে। সেইদিন রাতের বেলা আমাদের বাসায় চোর ঢুকেছিল। আমি রাতের বেলা পড়াশোনা করে ঘুমিয়েছি। ঘুম ভেঙ্গে গেল রাতের বেলা। কেন ঘুম ভাঙ্গল সেটাই ভাবছি এমন সময়ে অনুভব করলাম যে আমার ঘরে পাখিটা একটু ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। আর তখনই আমি প্রধান দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। খুব আস্তে তবে আওয়াজটা আমার কান এড়ালো না। আমাদের গেটের দরজা খুললেই একটা ক্যাঁচকুচ আওয়াজ বের হয়।
আমি খুব আস্তে আস্তে আমাদের ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমার হাতে আমার ক্রিকেট ব্যাট। হঠাতই খেয়াল করলাম আমার মা হাটে বটি নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি কেউ আমাদের ঘরের দরজার সামনে আসবে। আমরা দুজনেই চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের ঘরের দরজাটা বেশ মজবুত করে লাগানো। সেটা চোর খুললে পাড়ল না। আরও কিছু সময় চেষ্টা করতো হয় তবে এমন সময়ে আমরা দুজনেই আমাদের পাশের বাড়ির রমিজ কাকার আওয়াজ শুনতে পেলাম। উনি চিৎকার করে বললেন, এই কে ওখানে !
তারপরই পড়িমড়ি কারো দৌড়ানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম !
একটু পরে রমিজ কাকা আমাদের বাসার দরজায়ে এসে কড়া নাড়তেই আমি দরজা খুলে দিলাম। রমিজ কাকা সব শুনে বললেন, ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। পাখিটার একটা ব্যাবস্থা না করলে ওরা আবারও আসবে।
আরও কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমার নানা বাড়ি ছিল পাশের জেলাতে। হঠাৎ ছোট মামা এসে হাজির। সে খবর নিয়ে এল যে নানার শরীর একটু খারাপ। আমার আমাদের সবাইকে নিয়েই যেতে চাইছিল কিন্তু আমি গেলাম না। আমি বললাম তোমরা যাও আমি বাসায় থাকি। মা কেন জানি আর বেশী জোরাজুরি করল না। আমার ছোটবোনকে নিয়ে চলে গেল। নানার অবস্থা যদি বেশি খারাপ হয় তাহলে আমি যেন নিজে নানা বাড়িতে চলে যাই। আমি সেই মতেই রাজি হলাম। মা রমিজ কাকাকে বলে গেলেন যেন আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
একটা দিন একেবারে ঝামেলাহীন ভাবে কেটে গেল। রমিক কাকার বাসা থেকে তিন বেলা খাবার এল। আমি সারাদিন বাসায় থাকি। পাখিটার সাথে নানান রকম কথা বলি। তবে পরের দিনই ঝামেলা বেঁধে গেল। রমিজ কাকার মেয়ের শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ালেন। সন্ধ্যার দিকে কাকা টিফিন ক্যারিয়ারে আমার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এলেন। তারপর জানালেন যে তিনি হাসপাতালে যাচ্ছেন। রাতে সেখানেই থাকবেন। আমি যেন সাবধানে থাকি। ভাল করে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘুমাই। তিনি সকালেই চলে আসবেন। আমার মনে তখন কেন জানি কু ডেকে উঠল। তবে আমি কাকাকে কিছুই বললাম না।
রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়েছি। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখলাম এক অদ্ভুত প্রাণীকে দেখলাম। ঠিক পাখি না, মানুষ আর পাখির সংমিশ্রন। মাথাটা তার পাখির মত তবে দেহটা একেবারে মানুষের মত। পাখির মাথাটা আমার ঘরে থাকা ঐ পাখিটার মত। চোখ নীল/ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল বলছে, বাড়ি থেকে এখনি পালাও। ওরা আসছে। ওরা আসছে। পালাও।
আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি বাড়ির সব দিকে তাকিয়ে দেখলাম সব শান্ত। কোথাও কোন আওয়াজ নেই। আলো জ্বালিয়ে ঘরের পাখিটার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে এক ভাবে। তার চোখে মুখে এক ভয়ের ছাপ আমি দেখতে পেলাম। আমার তখনই মনে হল যে এখান থেকে আমাকে এখন পালাতে হবে। যে কোন ভাবেই হোক। আজকে বাসায় কেউ নেই। আমি ঠিক এই কারণেই মায়ের সাথে নানা বাড়ি যেতে চাই নি। আমরা চলে গেলে এই পাখিটাকে কে দেখে রাখবে।
আমি গায়ে জামা জড়িয়েই উঠে পড়লাম। ঘড়িতে কয়টা বাজে সেটার দিকে তাকানোর খেয়াল ছিল না। আমি পাখিটাকে কোলে নিয়ে বাস থেকে বের হয়ে গেলাম। রমিজ কাকার বাসায় যাওয়ার উপায় নেই কারণ ওখানে কেউ নেই। আজকে মনে হল ওরা যদি আসে তবে ভয়ংকর ভাবে আসবে। গতদিনের মত চুরি করতে আসবে না। পিস্তল বন্দুক নিয়ে আসতে পারে। আমি যদি রাতে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারি তবেই হবে। ওরা আমাকে আর পাখিটাকে যদি খুজেই না পায় তবে কোন সমস্যা হবে না।
আমি পাখিটাকে কোলে নিয়ে দ্রুত পা বাড়ালাম। আমি এক সময়ে অনুভব করলাম যে আমি বলুইঘাটের বিলের দিকে যাচ্ছি। এই রাতের বেলা আমি ঐদিকে কেন যাচ্ছি সেটা আমি নিজেই জানি না তবে সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। যখন আমি মাঝ পথে এসেছি তখনই অনুভব করলাম যে কেউ আমার পিছু নিয়েছে। ওদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এবার দৌড়াতে শুরু করলাম। পেছন থেকে তখনই ডাকটা শুনতে পেলাম।
-পাখিডা দিয়া যা হারামজাদা, অনেক ঘুরাইছোস! দিয়া যা কইলাম, আইজা তোরে খাইয়া ফালাইমু!
সেদিনের সেই লোকটা। পেছন ঘুরে দেখার সাহস হল না। তবে আমি জানি যে এই লোক আমার সাথে দৌড়ে পারবে না। লোকটা বেটে আর তার এক পা ছোট একটু তবে সাথে যদি লোক থাকে তারা আমাকে ধরে ফেলতে পারে। আমি আরও জোড়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। তখন লোকটার আবারও খিস্তি শুনতে পেলাম, তবে আমার প্রতি নয়। তার সাথের লোকদের প্রতি সে খিস্তি করছে। আমারে ধরণ লাগব না। ঐটারে ধর। বিলে যাইতে দিবি না। বিলে যাইতে দিবি না।
আমার অবতেচন মন আমাকে বিলের দিকে নিয়ে এসেছে। কেন নিয়ে এসেছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াতে থাকলাম বিলের দিকে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ক্রমশ কয়েকটা পায়ের আওয়াজ আমার কাছে চলে আসছিল। আমার দম যেন ফুরিয়ে আসছে। আমি আর দৌড়াতে পারছি না।
তারপরেই কেউ যেন আমার কাধ ছুঁয়ে ফেলল। আমাকে এবার ধরেই ফেলবে। দৌড়াতে দৌড়াতেই পেছনের লোকটা আঞ্চলিক ভাষায় বলল, থাম কইলাম, পাখি দিলে কিছু কইবো তোরে, ছাইড়া দিব। কিন্ত…।
আমি তবুও থামলাম না। আমি দৌড়াতেই থাকলাম। আমার কেবল মনে হল যে আমার প্রাণ থাকতে এই পাখি আমি ওদেরকে দেব না কোন ভাবেই। আমি পাখিটাকে আরও ভাল করে জড়িয়ে ধরেছি যাতে করে ওরা আমার কাছ থেকে কোন ভাবেই এটা ছিনিয়ে নিতে না পারে। কিন্তু ওরা আমার একদম কাছে চলে এসেছে। আমার বুকে একটা তীব্র ভয় এসে জড় হয়েছে। আমি বুঝি ধরা পড়ে গেলাম। আর বুঝি পাখিটাকে বাঁচাতে পারলাম না।
যখন আমার কাধটা চেপে ধরবে, আমার যখন মনে হল যে আমি আর আর পারলাম না, তখনই আমার কোলের পাখিটা অদ্ভুত সুরে ডেকে উঠল আর সাথে সাথে আমি অনুভাব করলাম আমার ঠিক পেছন দিয়ে একটা তীব্র বাতাসের প্রবাহ বয়ে গেল। আমি তখনই বুঝতে পারলাম যে আমার পেছেন যারা ছিল তারা আর কেউ নেই।
আমি কয়েক মিনিটের ভেতরেই আমি বলুইঘাটের বিলে পৌছে গেলাম। বিন্দু মাত্র দেরি না করে আমি বিলে নেমে পড়লাম। তারপর পানির ভেতরেই যেতে লাগলাম। একটা সময়ে এসে আমার মনে হল কোলের পাখিটাকে এবার নামিয়ে দেওয়ার সময়ে এসেছে। আমি খুব ধীরে পাখিটাকে বিলের পানিতে পানিয়ে দিলাম।
প্রথম কিছু সময় কিছুই হল না। পাখিটা শান্ত ভাবেই পানিতে বসে রইলো। তার শরীর থেকে আগের মতই সে আলোর আভা আসছে। তবে তারপরেই আমি পরিবর্তনটা খেয়াল করলাম। পাখিটার শরীর থেকে বের হওয়ার আলোর পরিমান আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করল। একটা সময়ে তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। আমি অবাক হয়েই সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি নড়তে পাচ্ছি না একপাও। আমার চোখের সামনে পাখিটা আরও একটু বড় হয়ে গেল। একটা রাজহাসের থেকেও বড় আকৃত ধারণ করল। তার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারপরে সেটার আকৃতি বদলাতে বদলাতে আমার স্বপ্নে দেখা সেই পাখি মানবের মত হয়ে গেল।
মুখটা পাখির মত হলেই শরীরটা মানুষের তবে পেছনে ডানাও রয়েছে। আমি অপূর্ণ সুন্দর প্রাণীটার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলাম কেবল। আমার বোধ চেতনা সব যেন হারিয়ে গেছে। সে আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। যদিও তার মুখ দেখে বোঝার কোন উপায় নেই তবে চোখের ভাষা আমি যেন পড়তে পারছি। সে আমার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
তারপর কী হল আমি ঠিক বলতে পারব না, আমার মনে হল আমি যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কিংবা আমি কোন ঘোরের ভেতরে রয়েছি। যখন আমার ঘোর কাটল আমি নিজেকে বিলের পাড়ে আবিস্কার করলাম। ঘাসের উপরে শুয়ে ছিলাম। আমি উঠে বসে এদিক ওদিক তাকালাম। সব কিছু একেবারে স্বাভাবিক মনে হল। আমি পাখিটাকে আর কোথাও দেখতে পেলাম না। সেই আলোর লেস মাত্র নেই কোথাও। কেন জানি আমার মন খুব খারাপ হল। যদিও আমি জানি যে আমি পাখিটাকে নিরাপদে পৌছে দিয়েছি তারপরেও আমার পাখিটার উপরে একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল।
আমি যখন ফেরার পথ ধরলাম তখন ভোর হয়ে এসেছে। ফেরার আমি সে বেটে লোকটাকে দেখতে পেলাম। সে রাস্তার ধারে বসে রয়েছে মাথায় হাত দিয়ে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যে অনেক বড় কিছু হারিয়ে গেছে তার কাছ থেকে। আমার মনে একটা ভয় হল যে লোকটা না আবার আমাকে কিছু করে। তবে সেই রকম কিছু করলো না। আমি পাশ কাটিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম।

তারপর আমি অনেকবারই বলুইঘাটের বিলে গিয়েছি রাতের বেলা কিন্তু সেই আলোর পাখি আমি আর দেখি নি। তবে যতবারই আমি রাতের বেলা সেখানে গিয়েছি একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমার ঠিকই হয়েছে। আমার প্রতিবারই মনে হয়েছে যে কেউ বা কিছু একটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে গভীর চোখে। গভীর নীল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.4 / 5. Vote count: 25

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →